কার মঞ্জীর বাজে
রাজশ্রী বসু

মাঝখানে গম্বুজের মত দেখতে স্তম্ভটা। মাথাটা সরু হয়ে এসেছে। কত যে বয়স এই স্তম্ভের তা কেউ সঠিক বলতে পারবে না। কেউ বলে ব্রিটিশ আমলের তৈরি। কেউ বা বলে তারও আগের। আবার অনেকে বলে স্বাধীনতার পরে রাস্তাঘাট সংস্কার করতে গিয়ে কোন উদ্যমী ব্যক্তি এর নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন। সে ইতিহাস যাই হোক না কেন, দেখতে লাগে সটান স্বাস্থ্যবান এক পক্ককেশ জ্ঞানী বৃদ্ধের মত। এ শহরের নাড়ী রয়েছে এই স্তম্ভের হাতে। সে এই শহরকে দিনে দিনে শিশু থেকে যুবক, এমনকি প্রৌঢ়ত্বের সীমানায় পৌঁছাতে দেখেছে। যখন স্তম্ভ প্রথম দাঁড়ালো আকাশের নীচে, এই জায়গাটা বেশ ফাঁকা ছিল। এখন কালিম্পং শহরের প্রাণকেন্দ্র বলা যায়।
এখানে চারদিক দিয়ে দিনে রাতে চলেছে অজস্র গাড়ি, ট্যাক্সি, মানুষজন। আর দোকান। দোকানে দোকানে ছয়লাপ চারপাশ একেবারে। শহর যত পুরনো হয় ততই নতুন নতুন দোকানের জন্ম হতে থাকে। এই স্তম্ভের চারদিক ঘিরে এখন শুধুই দোকান বাজার। চারদিকে চারটি রাস্তা চলে গেছে সাপের মত এঁকে বেকে কয়েক হাজার দোকানের পসরা সাজিয়ে। তার এক কোণে দেড় ফুট বাই দেড় ফুট ছোট্ট পানের দোকানখানা ব্রিজমোহনের। গত চল্লিশ বছর ধরে এই দোকান খুলে বসে থাকে সে সারা দিনরাত। থাকা খাওয়া নামমাত্র, সেও চোখের পরিধির মধ্যেই। আগে আগে খদ্দের যদি ছিল দুই পাঁচজন তো এখন তা বেড়ে হয়েছে বেশ কয়েক হাজার। কারণ আর কিছুই না, শহরের মাঝখানে পানের দোকান এই একটিই মাত্র। পাহাড়ে বেড়াতে আসা বাইরের মানুষ নিজেরাই খুঁজে বের করে নেয় ব্রিজমোহনের দোকান।
তেমনিই এসেছিল রম্ভা। একা নয়, তার স্বামী সুরেশ পানের বড় ভক্ত। সকাল বিকেল সুগন্ধি জর্দা মেশানো বেনারসী মিঠে পান না পেলে তার চলে না। মাত্র দিন পাঁচেক হল সুরেশ আগরওয়াল এলাহাবাদ থেকে পুলিশের বড় কর্তা হয়ে কালিম্পং শহরে এসেছে। তার পান যে কেউ এনেই দিতে পারে। কিন্তু আজ সে নিজে এসেছে সঙ্গে নতুন বিয়ে করা বউকে নিয়ে। উদ্দেশ্য বউকে শহরটা ঘুরিয়ে দেখানো, বিশেষ করে মহিলাদের প্রিয় কিছু বিশেষ জিনিসপত্র যেমন ঘরসাজানোর আইটেম বা ড্রেস মেটেরিয়াল, শাড়ি সালোয়াড় ইত্যাদির দোকানগুলোর সঙ্গে দুজনেই পরিচিত হয়ে নেওয়া। সবসময় তো সুরেশ থাকতে পারবে না। রম্ভা সৌখীন মানুষ। সে যাতে নিজের প্রয়োজন নিজেই মিটিয়ে নিতে পারে। তাছাড়া সুরেশ সিনীয়র ব্যাচমেটদের উপদেশ মনে রেখেছে। বউ এর কাছে তুমি পুলিশ অফিসার নও, সেখানে শুধুই ডিউটিফুল স্বামী। তাছাড়া নতুন এসে এখনো কাজের চাপ তেমন পড়েনি, সকলের সঙ্গে আলাপ পরিচয়ের পর্ব চলছে। এইসময়েই যতটা পারা যায় রম্ভাকে সময় দিয়ে দেওয়া যাক। এই ভেবে সুরেশ বউ নিয়ে বেরিয়েছে। এস পি সাহেবের সঙ্গে যথারীতি পাইক বরকন্দাজ তো থাকবেই। তাদের সবাইকে থামিয়ে সুরেশ নিজেই এসে দাঁড়িয়েছে ব্রিজমোহনের দোকানের সামনে। রম্ভার আবদারে তাকেও সঙ্গে এনেছে।
“এই যে কাকা, আমাদের সাহেব ম্যাডাম নিজে এসেছেন। ভাল করে পান বানাও গোটা ছয়েক।” এস পি সাহেবের পার্সোনাল সিকিওরিটি অনল হাঁকডাক পেড়ে বলে। তার এমন পুলিশি গলা যে, আশেপাশের চার পাঁচখানা দোকান থেকে বেশ কিছু মানুষ এসে নমস্কার সালাম করতে থাকে এস পি সাহেবকে পেয়ে। সুরেশ আলাপী মানুষ। তাছাড়া নিজের কাজের জায়গার মানুষজনকে জেনে বুঝে নেওয়া, তাদের সুবিধা অসুবিধার দিকে প্রখর দৃষ্টি রাখাটাও সে নিজের ডিউটির মধ্যেই রাখে। মুসৌরীর ট্রেনিংয়ের দিনগুলোয় ডিরেক্টর দীনদয়াল শর্মার বলা প্রতিটি কথা সে মনে রাখে চাকরির প্রতিটি পর্যায়ে। তাই চারপাশে জড়ো হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
রম্ভা দিল্লীর কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়া মেয়ে। তাদের এলাহাবাদ শহরের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে মা ঠাকুমাদের আচার আচরণের সঙ্গে তাই কিছুই মেলে না তার। সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল ব্রিজমোহনকে। লোকটার শণের মত ঘাড়ছোঁওয়া চুল আর ঘোলাটে জল রঙ ঢিলে শার্ট, গাল থেকে গলা ভাঁজে ভাঁজে নেমে এসেছে বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতার ঝুরি। চুল কপাল থেকে পেছনে ওলটানো। লম্বা একটা কমলা সিঁদুরের তিলক। বাঁ চোখের কোণ থেকে একটা কাটা দাগ চলে গেছে প্রায় কানের কাছে। চোখদুটো যেন এখানে ধারে কাছে কিছু দেখছে না। অনেক দূরে কোথাও যেন নিবদ্ধ তার দৃষ্টি। রম্ভা খুঁটিয়ে দেখছিল লোকটাকে তার একটাই কারণ। সে একজন আর্টিষ্ট। মানুষের স্কেচ করা তার পেশা। ব্রিজমোহনকে দেখার মুহূর্ত থেকেই তাকে সামনে বসিয়ে আঁকার জন্য প্রবল একটা ইচ্ছে জেগেছে মনের মধ্যে। কিন্তু এখন নয়, এই নিয়ে পরে আলোচনা করতে হবে। মনে মনে ভাবে রম্ভা। গরীব মানুষ। উপযুক্ত পারিশ্রমিক পেলে নিশ্চয়ই মডেল হতে আপত্তি করবে না ।
“তম্বাকু, সুপারি, অউর কুছ? …” সাহেবের ছ’খানা পান সাজতে সাজতে জিজ্ঞেস করে ব্রিজমোহন।
“না না আর কিছু নয়। ব্যস তম্বাকু একনম্বর হোনা চাহিয়ে …” হেসে বলে রম্ভা। হাত বাড়িয়ে সাহেবের পানের প্যাকেট অনলকে এগিয়ে দেয় ব্রিজমোহন। রম্ভা গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়।
“ম্যাডাম…” ব্রিজমোহন ডাকে। তার হাতে একখানা আলাদা করে তৈরি পান।
“আমি তো পান খাই না, ভে এ এ রি রেয়ারলি …”
“আপকি স্পেশ্যাল হ্যায় ইয়ে, ইত্বর কি সাথ … বহত পসন্দ হ্যায় আপকি ইয়ে পান …”
কি বলছে লোকটা! পাগল নাকি! কখনো খেলোই না আর বলছে বহত পসন্দ হ্যায় আপকি …!” রম্ভা হেসে ফেলে মনে মনে। হাত বাড়িয়ে বলে, “ওকে ওকে, দিন দেখি …খাই একবার …”
সামনে পেছনে একগাদা পুলিশের লোকজন। সুরেশ কথা বলতে বলতে চৌমাথা থেকে নেমে গিয়েছে কারস্ট্যান্ডের রাস্তায়। এই জায়গাটা ভয়ঙ্কর ভিড়। গাড়ি পার্কিং একটা সমস্যা। তারপর দোকান বাজার লোকজন এইসব নিয়েই লোকাল মানুষের সঙ্গে আলাপ করছে সুরেশ।
“আপলোগ সাহাব কে সাথ যাইয়ে না। ম্যায় আতি হু …” চোখের ইশারায় সব পুলিশের লোকেদের নিজের চারপাশ থেকে সরিয়ে ঠিক মোড়ের মাথায় গম্বুজটার সামনে দাঁড়ায় রম্ভা। হাতে ধরে থাকা খিলি খুলে পানটা মুখে দেয়। অদ্ভুত এক নেশাধরানো গন্ধ! কি বলছিল যেন? ইত্বর! এই পান তো কখনও খায় নি রম্ভা। কিন্তু মুখে দিতেই মনে হচ্ছে গন্ধটা কত চেনা। সামনে তাকায় ও অলস চোখে। আর তাকিয়েই থেমে যায় ওর চোখ। সেই বাড়িটা! এখানে কি করে এল সেই তিনতলা বিশাল বাড়িটা! এই বাড়িটা তো অনেক দূরে কোথাও ছিল …। কিন্তু কোথায় যেন ছিল! ঠিক কোনখানে যেন! রম্ভা মনে করতে পারে না।
প্রানপণে মনে করার চেষ্টা করে। মাথার ভেতরে যেন পাক দিয়ে দিয়ে উঠছে। কিছুতেই মনে পড়ছে না কোথায় ছিল এই বাড়িটা! কি করে এইখানে এল। অদ্ভুত একটা অস্বস্তি ছেয়ে যায় রম্ভার শরীরে। বুকের ভেতরটা কেমন ধরফর করছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট। কে যেন গলাটা চেপে ধরেছে। কিছুতেই মনে পড়ছে না কিছু।
শরীর হাল্কা হয়ে এসেছে। মাথাটা ঘুরে গম্বুজের সামনেই পড়ে যাচ্ছিল রম্ভা। কিন্তু কখন যেন পানদোকানের লোকটা উঠে এসেছে, ও কি খেয়াল রাখছিল নাকি এদিকেই! রম্ভাকে ধরে ফেলেছে দু’হাতে, পড়ে যেতে দেয়নি মাটিতে।
ওদিক থেকে ছুটে এসেছে পুলিশের লোকজন। সুরেশ ।
“কি হল ম্যাডামের! গাড়িতে তোলো, কুইক!” ব্রিজমোহনের কাছ থেকে রম্ভাকে সরিয়ে নিয়ে নিজেই ধরে ধরে তাকে গাড়িতে তোলে সুরেশ।
ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সে। বারবার ডেকে যাচ্ছে, “এনি প্রবলেম! কি হয়েছে? ঠিক কি হল বল তো? ভালই তো ছিলে একটু আগেও। ডক্টর-এর কাছে যাচ্ছি আমরা। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
রম্ভার মাথাটা একটু ঘুরে গিয়েছিল। এবার তাকায় সে। অজ্ঞান হয়নি। কিছুক্ষনের জন্য চোখে অন্ধকার দেখেছিল মাত্র। মাথা নেড়ে বলে, “নো ডক্টর প্লিজ। আয়্যাম অলরাইট নাউ …”
“কি মুশকিল, এভাবে হঠাৎ মাথা ঘোরাও তো ভাল নয়। একবার ডাক্তার দেখিয়ে নেওয়াই তো ভাল …” সুরেশ ব্যস্ত হয়। চিরকাল হোষ্টেলেই থেকেছে সে। কারুর কিছু হলে কিভাবে সেটা সামলাতে হয় সে ব্যাপারে জ্ঞান নেই বিশেষ। তাই একটুতেই অস্থির হয়ে পড়ে সে। রম্ভা জানে সে কথা। সুরেশের হাতে চাপ দিয়ে হেসে বলে, “ছোড়ো না, কিঁউ ইতনা ঘাবড়াতে হো! ঠিক হু ম্যায় …”
যাক, নিশ্চিন্ত। এই তো রম্ভা হেসে কথা বলছে। সুরেশ গা ছেড়ে দিয়ে বসে। “অনল এবার তাহলে …”
“না না আমি এত তাড়াতাড়ি বাংলোয় ফিরব না। আমি শুনেছি এখানে গলফ গ্রাউন্ডের পাশে একটা খুব সুন্দর কফি জয়েন্ট আছে। ওখানে নিয়ে চল …” রম্ভা বলে ওঠে।
সেদিকেই এগোচ্ছিল গাড়িটা। সুরেশের নির্দেশ পেয়ে কফির দোকানে থামে। দোকান আর কি! বিশাল জায়গা তারজালি দিয়ে ঘিরে মাথায় শেড দিয়ে বসার জায়গা করা হয়েছে। সামনে ঢেউ খেলানো গলফ গ্রাউন্ড। নানা শিল্পকর্ম দিয়ে ছবি দিয়ে সুন্দর সাজানো চারপাশ। অজস্র টেবিল চেয়ার রয়েছে ছড়ানো ছেটানো। যার যতক্ষন খুশি এখানে এক কাপ কফি নিয়ে বসে সামনের পাহাড়ের সৌন্দর্য্য দেখতে পারে। একপাশে একটা মাত্র ঘর যেখানে দাঁড়িয়ে দোকানটা পরিচালনা করছেন একজন দু’জন লোক। এরাও সরকারি লোক বলেই মনে হয়। ইউনিফর্ম রয়েছে পরনে। রম্ভা গাড়ি থেকে নেমেই পুরো জায়গাটা ঘুরে ঘুরে দেখতে শুরু করে দিয়েছে। সুরেশ মাঝের একটা টেবিলে বসে পাশে দাঁড়ানো অনলের সঙ্গে কথা বলছে। এস পি সাহেব নিজে এসেছেন জেনে দোকানের কর্মীটি ছুটে এসেছে। কথায় কথায় সুরেশ জেনে নেয় সিজন টাইমে এখানে চেয়ার পাওয়া দায়। প্রচুর ট্যুরিষ্ট যায় এই পথে। যাওয়া আসার পথে সকলেরই কিছুক্ষণের বিরতি এই কফি জয়েন্টে।
হবে নাই বা কেন, সামনের ছবিটা এত সুন্দর যাকে কোন শব্দ দিয়ে বর্ণনা করা যাবে না। সমতলের মানুষ এমনি এমনি পাগল হয়ে দৌড়ে আসে না বার বার। সুরেশ এখানে আসার আগে কালিম্পং সম্বন্ধে যেটুকু পড়াশোনা করেছে তাতে বিশেষভাবে ছিল এখানকার পুলিশ বিভাগের সম্বন্ধে নানা তথ্য। এতবড় সাবডিভিশন চালাতে গেলে সেখানকার আইনকানুনের সমস্ত খুঁটিনাটি জানা দরকার। কিছুটা সে গুগল থেকে জেনেছে। আর এই তিন চারদিনের অফিস থেকে ফাইল ঘেঁটে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। কিন্তু এই মাথা তুলে সগর্বে দাঁড়িয়ে থাকা যে হিমালয় পর্বত তার মনের ভেতর কি রহস্য আছে সে নিয়ে সুরেশ মাথা ঘামায়নি। কারণ ওটা তার সাবজেক্ট নয়। ওদিকটা দেখতে চাইবে রম্ভা। কতখানি সবুজের সঙ্গে কতখানি নীল মিশলে ওই দূর বনানীর যথার্থ প্রতিফলন ঘটানো যাবে ক্যানভাসে সেই গবেষণা করবে রম্ভা। ওটা তার বিষয়। সুরেশ দেখবে এই শান্ত সুন্দর পাহাড়ে যেন কোন খুন জখম মারদাঙ্গা না হয়। সেটাই তার কাজ।
এইসব কথাগুলোই ভাবছিল সুরেশ কফির কাপে চুমুক দিয়ে। আর রম্ভা তার গভীর সুন্দর দুচোখ মেলে মনের ভেতর ভরে নিচ্ছিল সামনের ঢেউ তোলা সবুজের কার্পেট।
ওদের চোখের সামনে সন্ধ্যা নেমে আসছে। দূরের পাহাড়ে একটা দুটো তারার আলো দেখা যাচ্ছে। একটু বাদেই পুরো জায়গাটা দেখে মনে হবে কে যেন ছড়িয়ে রেখেছে তারার মালা।
“কি অপূর্ব সুন্দর তাই না?” রম্ভা মুগ্ধ বিস্ময়ে বলে। সুরেশ চিন্তা করছিল এখন আরেকবার থানায় যাবে কি না। সে মাথা নাড়ায় আনমনে, “হাঁ হাঁ বহত সুন্দর আছে …বিলকুল মেরি জান কে তরাহ …”
রম্ভা বুঝতেই পেরেছে সুরেশের মন এখানে নেই। স্বাভাবিক। কত বড় দায়িত্ব তার ওপর। এসব ছোটখাট ব্যাপারে মানিয়ে নিতে হবে। কফি শেষ করে উঠে দাঁড়ায় সে, “চলো , উঠঠোও …। ঘর চলেঙ্গে। অউর কাঁহি নেহি যানা …”
“ম্যাডাম…সামনেই তো …” অনল নিচু গলায় বলে।
“হাঁ মুঝে মালুম হ্যাঁয়। পর আজ নেহি। ফির কভি আ যাউঙ্গি মরগ্যান হাউস …”
সুরেশ রম্ভার হাত ধরে গাড়িতে বসায়। নিজে বসে। হাতের মুঠো ছাড়ে না সে। সত্যিই মনটা খুব থানা থানা করছে। কিছু না বলতেই রম্ভা সেকথা বুঝেও গেল। এইজন্যই নিজেকে লাকি মনে হয় তার। এমন ওয়াইফ পাওয়া সহজ নয়। গাড়ি ফিরে চলে এস পি বাংলোর দিকে।
২
রাত গভীর। রম্ভা নিজের বিছানায় ঘুমিয়ে ছিল। বিয়ের প্রথম রাত থেকেই সে নিজের আলাদা ঘরে শুয়ে আসছে। এটাই ছিল বিয়ের ক্ষেত্রে তার একমাত্র শর্ত। যা সুরেশ একবাক্যে মেনেও নিয়েছে। সে তখন যেকোন কিছুই করতে রাজি রম্ভাকে পাওয়ার জন্য। এগুলো তাদের দুজনের মধ্যেকার কথা। বাইরে দেখতে গেলে দুই খানদানী পরিবার নিজেদের মধ্যে ছেলে মেয়ে দেখাশোনা করেই বিয়ে দিয়েছে।
আলাদা শোওয়াটা শুনতে খারাপ হলেও আসলে তা কিন্তু নয়। সুরেশ রম্ভা দুজনেই আজকের যুগের শিক্ষিত আধুনিক ছেলেমেয়ে। তাদের রয়েছে নিজস্ব চিন্তাধারা ও লাইফস্টাইল। তার সঙ্গে পুরনো রীতি রেওয়াজের মিল না থাকাটাই স্বাভাবিক। রম্ভা শিল্পী। কখনো কখনো রাত জেগে একাগ্র হয়ে সে ক্যানভাসের বুকে ঢেলে দেয় নিজের সমস্ত শিক্ষা এবং আবেগ। এই সময়টা একাকীত্ব প্রয়োজন। আবার সুরেশও আই পি এস হয়েছে সদ্য। তারও পড়াশোনা ফাইলপত্র নাড়াচাড়ার জন্য অনেকটাই প্রাইভেসি প্রয়োজন। স্বামী স্ত্রী একবিছানায় বসে এই সমস্ত কাজ কর্ম শুরু করলে কাজ একবিন্দুও এগোবে না এটা ওরা বিয়ের আগে থেকেই বুঝে নিয়েছিল। রম্ভাই একটা কাফেতে ডেকে ডিটেল আলোচনা করার পর আলাদা ঘরে ঘুমোনোর প্রস্তাবটা দিয়েছিল। যা কিছু ভালবাসাবাসি তার জন্য যতক্ষণ দরকার থাকো একসঙ্গে, তারপর যার যার পথ তার তার ঘর। বেশ ভাল লেগেছিল প্রস্তাবটা সুরেশের। ঘরের অভাব নেই কোন তার বাংলোয় বা বাড়িতে। তাই প্রথমদিন থেকে এই চলছে।
কিন্তু ভালবাসাবাসির জন্য প্রয়োজনীয় ইচ্ছা, সময়, আবেগ এই কালিম্পং-এ এসে যেন একদিনও ঠিক এক মাত্রায় দুজনের মাঝখানে ধরা পড়ল না। আজ সুরেশ বেশ ভাল মেজাজে ছিল। বেড়াতে বেরিয়েছে বউ নিয়ে। ফিরে এসে ও বাকি সময়টা মনের মত করেই কাটাবে এমন প্ল্যান ছিল। কিন্তু রম্ভার শরীরটা খারাপ হয়ে সেই চাপা আবেগ বদলে গেল টেনশনে। তাই তাড়াতাড়ি ডিনার করিয়ে তাকে শুইয়ে দিয়ে গেছে। তারপর নিজের নতুন দায়িত্বের কাগজপত্র নিয়ে বসেছিল।
দুটো ঘর পাশাপাশি। মাঝখানে দরজা থাকলেও তা ভেজানো। এমনভাবে ভেজানো যে দেখলে বন্ধই মনে হয়। রাত কত জানা নেই। তবে বারোটার কম নয়। পাহাড়ে সন্ধ্যার একটু পরেই নেমে আসে নীরবতা। বাজার হাটের সংখ্যা বেড়ে এখন কোলাহল গিয়ে ঠেকেছে ন’টা সাড়ে ন’টা অবধি। দশটা বাজল তো সবাই ঘরে ঢুকে পড়ল। সুরেশ খাওয়ার পর অফিস ফাইলে ডুবে গিয়েছিল। গত তিনবছরের ক্রাইম রিপোর্ট মন দিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে নিচ্ছিল। এমনিতে শান্ত জনপদ। কিন্তু মাথায় খুন চেপে গেলে মার্ডার করে ফেলা খুব শক্ত নয় কিছু মানুষের কাছে। এইরকমই কিছু মার্ডার আর গোটা কয়েক ডাকাতি ছাড়া খুব বড় মাপের কিছু চোখে পড়েনি এই দুটো ফাইলে। কিন্তু আরো তিনটে ফাইল রয়েছে থানায়। সেগুলো সব চেক না করে কোন ধারণা করা ঠিক হবে না। সুরেশ টেবিলে বসেই একহাতে ভর দিয়ে মাথা হেলিয়ে ভাবছিল এবার শুয়ে পড়বে কিনা। ঠিক তখনি আশ্চর্য হয়ে সামনে তাকায়।
ছম ছম করে পায়ে মল বাজিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল রম্ভা। সুরেশ অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে। লাল জয়পুরী প্রিন্ট ঘাগড়া, গায়ে লাল ভেলভেট চোলি। বুকের ওপর দিয়ে আলগোছে ফেলা সবুজ ওড়নি। মাথার চুলে বেলফুলের গোড়ে জড়ানো। হাতে মোটা রুপোর খাড়ু। নাকে রূপোর নথ। কানে বড় ঝোলানো কানবালা। বিশাল একটা পাথর বসানো লকেট নেমে এসেছে বুকের ওপর। সবমিলিয়ে রম্ভাকে অপূর্ব দেখাচ্ছে। বড় কোন সম্ভ্রান্ত রাজস্থানী পরিবারের বধূ যেন। এরকম সাজে কোনদিন রম্ভাকে দেখেনি সুরেশ। তার চোখে ঘুমের যেটুকু রেশ এসেছিল একধাক্কায় কেটে যায়। এই পোষাক কোথায় পেল রম্ভা? ওর কাছেই কি ছিল? ও তো ঘুমিয়ে ছিল একটু আগেও। কখন উঠে এভাবে সাজগোজ করল? কেনই বা করল? সুরেশ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রম্ভার হাত ধরতে যায়। কিন্তু রম্ভা যেন তাকে চিনতেই পারছে না। সে অচেনা এক মহিলার মত সুরেশের দিক থেকে ওপাশে তাকায়। তারপর যেন ঘরে সুরেশ বলে কেউ নেই এমন ভাবে পাশে রাখা পানের মোড়ক থেকে খুঁজে খুঁজে একটা কোন নির্দিষ্ট পান বের করে। নাকের কাছে ধরে নিবিষ্ট মনে গন্ধ শোঁকে। ভাললাগার আমেজ ফুটে ওঠে তার চোখে মুখে। তারপর পান মুখে দিয়ে সুরেশের ঘরের দরজা খুলে ছম ছম শব্দ তুলে বেরিয়ে যায়।
সুরেশ অত্যন্ত অবাক হয়ে দেখছিল রম্ভাকে। ইংরেজীতে যাকে বলে স্পেলবাউন্ড হয়ে যাওয়া, সেরকমই বসে ছিল সে। এবার চোখের সামনে থেকে রম্ভা অদৃশ্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসে চেতনা। ছুটে দরজা দিয়ে বাইরে আসে সে। ডাকতে থাকে উঁচু গলায়।
“রম্ভা, কাঁহা গয়ি তুম ইতনি রাত কো! কুছ চাহিয়ে তো মুঝে বাতাও … কিধার গয়ি তুম…”
দরজার বাইরে টানা লম্বা কড়িডোর। একধার দিয়ে পরপর ঘর। একধারে গ্রীল। ব্রিটিশ আমলের বিল্ডিং। সুরক্ষার কিছু অভাব নেই। দোতলার অংশে দুদিকের বের হওয়ার দরজাগুলোতেই আছে মোটা বড় তালা। নিচে রয়েছে গার্ডরা। একটু দূরে আউট হাউসেও সাত আটজন স্পেশাল গার্ড। তারা পালা করে রাত জেগে বাংলো পাহারা দেয়। এই দোতলার অংশে সাহেব তার পরিবার নিয়ে থাকেন তাই একজন মাত্র বৃদ্ধ আটেনড্যান্ট ছাড়া আর কেউ থাকে না।
সুরেশ এপাশ ওপাশ তাকিয়ে রম্ভাকে দেখতে না পেয়ে তাকেই ডেকে তোলে।
“রামদীন, দেখো তো ম্যাডাম কাঁহা গয়ি …”
ঘুমচোখে উঠে এসেছে সেই বৃদ্ধ। সে অবাক হয়ে বলে, “বেডরুম মে নেহি হ্যায়? ড্রয়িং রুম মে ওউর লিভিং মে ভি দেখনা পড়েগা …”
নিজেই সে ড্রয়িং, লিভিং, কিচেন, গেষ্টরুম সব জায়গা ঘুরে আসে। সুরেশ সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে। সে নিজের চোখে রম্ভাকে বেরিয়ে যেতে দেখেছে। দোতলার দুদিকেই তালা। কোন ঘরে নেই রম্ভা। তাহলে গেল কোথায় সে?
“সাব, একবার ফির বেডরুমমে দেখনা চাহিয়ে …গুস্তাকি মাফ হুজুর…”
রামদীনকে জোরে ধমক দিয়ে উঠতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয় সুরেশ। ট্রেনিং এ শেখা শিক্ষা মনে পড়ে। বিপদ থেকে বেরোতে গেলে কোন অপশনই ছাড়তে নেই। কে জানে কখন কোনটা কাজে লেগে যায়। রামদীনকে একথা বোঝানো অর্থহীন যে সে নিজেই রম্ভাকে বেরিয়ে যেতে দেখেছে তার ঘর থেকে। পাশাপাশি তার ও রম্ভার ঘরে ঢোকার একটাই দরজা এবং সেটা তার রুম দিয়ে। কাউকে আসতে গেলে সেটাও সুরেশের সামনে দিয়েই আসতে হবে। সেখানে রম্ভা বেরিয়ে গিয়েছে সুরেশের চোখের সামনে। ঢোকেনি তো সে আর, একথাটা সুরেশ রামদীনকে কি বোঝাবে! সে বুড়ো মানুষ! কোন কথা না বলে আবার নিজের ঘরে আসে সে। গম্ভীর মুখে এগিয়ে যায় রম্ভা আর তার ঘরের মাঝখানের দরজার দিকে। দরজা পার করে রম্ভার ঘরে খাটের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সুরেশ।
এই তো রম্ভা শুয়ে আছে তার খাটে। এই তো সেই হাল্কা গোলাপী নাইট ড্রেস তার শরীরে। এই পোশাকেই তো শুয়ে পড়ার আগে সুরেশকে সে গুডনাইট কিস দিয়েছিল। বালিশের পাশে পড়ে আছে আধাখোলা প্রিয় নভেল, জার্নি টুওয়ার্ডস লাইফ। এই বইটা নিয়েও তো কত আলোচনা হয়েছিল তাদের মধ্যে। সুরেশ একজন পুলিশ অফিসারের চোখ দিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে নিজের ঘুমন্ত স্ত্রীকে। লালচে চুলের গুচ্ছ ছড়িয়ে আছে রম্ভার মুখে বুকে। পাতলা রাতপোশাকের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে উদ্গত যৌবন। যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে সুরেশকে। রম্ভার ঠোঁটের বাঁকে কি লেগে আছে হাল্কা হাসির রেখা? সুরেশ যেন সেই রাজস্থানী মহিলার সঙ্গে যুক্তির দাড়িপাল্লায় বসিয়ে রম্ভাকে ওজন করে নিতে চায়। কাকে দেখল সে? এতটাই ভুল দেখল? সে কি থানা থেকে নিয়ে আসা ফাইলগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছিল টেবিলে মাথা রেখে? ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখেছে কোন?
একমাত্র এটা হলেই এই মুহূর্তে শান্ত হত ওর মন। কিন্তু সুরেশ নিজে তো জানে সে ঘুমিয়ে ছিল না। জানা আর চাওয়ার মধ্যে বিরাট ফারাক। তবু দ্বিতীয়টাকেই আঁকড়ে ধরতে চায় শিক্ষিত স্মার্ট যুবক পুলিশ অফিসারটির মন। রম্ভা গভীর ঘুমে রয়েছে। তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে সে নিশ্চয়ই হেসে উঠে উড়িয়ে দেবে এতক্ষনের সব টেনশন। সুরেশ একনাগাড়ে মাথা খাটিয়ে চলেছে। আর ভাবতে পারে না সে। নিজেই ভুল দেখেছে ভেবে নিতে চায়। নিচু হয়ে রম্ভার কপালে এঁকে দিতে চায় ঠোঁটের ছোঁয়া।
এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল সুরেশ। এবার নিচু হয়ে রম্ভার মুখের কাছে মুখ আনতে গিয়ে চমকে ওঠে। কিছু একটা মিষ্টি গন্ধ। কিসের গন্ধ তা মনে করতে পারে না। ভাল করে তাকিয়ে আরো একবার স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয় তাকে। রম্ভা ঘুমোচ্ছে। ঘুমের মধ্যে হাসছে। আর সবচেয়ে যেটা ভয়ঙ্কর, ঘুমের মধ্যে তার মুখে রয়েছে পান। সেই পান থেকে আসছে মিষ্টি গন্ধটা। হাত দিয়ে মুখটা খুলে আধা চেবানো পানটা বের করে আনে সুরেশ। এনে নাকের সামনে ধরে সে। কি আশ্চর্য, এতটা নাড়াচাড়াতেও ঘুম ভাঙে না রম্ভার। সে আলগোছে সুরেশের হাতটাই টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে পাশ ফেরে।
সুরেশ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। তার স্পষ্ট মনে পড়ে ডিনারের পর সে যখন পান খায় তখন বলেছিল রম্ভাকে, “ইয়ে লিজিয়ে ম্যাডাম, আপকি স্পেশ্যাল পান” খায়নি রম্ভা। মুখ ফিরিয়ে বলেছে, “আমার ভাল লাগছে না। এখন পান খেতে ইচ্ছেই করছে না।” তারপর আরো দু একটা কথা বলে সুরেশকে কিছুটা আদর করে সে শুয়ে পড়েছিল। রম্ভা ঘুমিয়ে পড়ার পর সুরেশ এঘর থেকে গিয়েছে। রম্ভার পানটা নিজের পানের প্যাকেটের মধ্যেই আলাদা করে কাগজ মুড়ে রেখেছে ড্রয়্যার টেনে। তারপর নিজের ফাইল খুলে বসেছে। তাহলে রম্ভার মুখে পান এলো কী করে? সুরেশের চোখে ভেসে ওঠে রাজস্থানী সাজে সেজে রম্ভা ওর টেবিলের পাশ থেকে পান বের করে নাকের কাছে ধরে গন্ধ শুঁকছে। তারপর অল্প হেসে মুখে দিচ্ছে পানটা। তারপরেই সে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
রম্ভা? নাকি রম্ভারই মত আর কেউ? মধ্যরাত্রে বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষিত সুরেশের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সে নিজেকে স্থির করতে চেয়েও পারে না। নিজের ঘরেও যে উঠে যাবে সেই ক্ষমতাও যেন নেই শরীরে। সামনে ঘুমিয়ে থাকা রম্ভার হাত থেকে নিজের হাতটাও আলাদা করতে পারছে না।
বাইরে থেকে ভেসে আসে রামদীনের গলার আওয়াজ। এতক্ষণ সে সাহেবের হুকুমের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছে দরজায়। সাহেব যেতে না বললে যায় কি করে! কিন্তু আর বোধহয় পারছেনা বেচারা।
“সাব, ম্যায় আপ কে লিয়ে চায়ে লাঁউ ক্যা?”
অনেক মাথা খাটিয়ে একটা প্রশ্ন বের করেছে রামদীন। এতে যদি সাহেব ওকে নিজের ঘরে যাওয়ার অনুমতি দেন। সুরেশের এমনই কোন আওয়াজ দরকার ছিল। আচ্ছন্নতা কাটিয়ে সে উঠে আসে। মনে মনে লজ্জা পায় বুড়োমানুষটাকে এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য। গম্ভীর গলায় বলে, “নেহি, আভভি নেহি। সুবা হোনে দিজিয়ে। আপ আব শো যাইয়ে।”
চলে যেতে যেতেও রামদীন দাঁড়িয়ে যায়। কোঁচকানো চোখদুটো তুলে সুরেশের দিকে একবার তাকিয়েই মাথা নিচু করে, একটু থেমে বলে, “মেমসাব ঘর মে হি হ্যায় না?”
সুরেশ থমকে যায়। অন্যসময় হলে তাকে একজন অর্ডারলির প্রশ্ন করার মত অবস্থাই তৈরি হত না। কিন্তু এখন পরিস্থিতি আলাদা। অন্যমনস্ক গলায় সুরেশ বলে, “হাঁ”
৩
কালিম্পঙয়ের আকাশ আর নারীর মন, এই দুইয়ে অনেক মিল। কখন মেঘলা আর কখন সূর্যের আলোয় ঝকমকে তা বোঝা যাবেনা কিছুতেই। এখানে আবহাওয়া দপ্তরের কাজ তাই দিনরাত সমস্ত মেশিন খুলে বসে থাকা। কিন্তু যতই পরিশ্রম করে রিডিং দিক না কেন তারা, যে কোন সময় দেখা যায় উলটো আকাশ। মেয়েদের মনের সঙ্গে আকাশের এই তুলনা মনে পড়তে সুরেশ একাই হেসে ফেলে। হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে থাকে সামনের খোলা কালচে বিশাল স্লেটের মত আকাশের টুকরোটার দিকে। ব্রিটিশ আমলের দেওয়াল ঘড়িতে কিছু আগেই ঢং করে জানিয়ে দিয়েছে সকাল সাড়ে নটা বাজে। আর কিছুক্ষন মাত্র। তারপরেই সুরেশকে নেমে যেতে হবে নিচে। ব্রেকফাষ্টের অপেক্ষায় আছে সে। আজ কয়েকটা গ্রাম ভিজিটে যাওয়ার কথা। ডি এস পি সাহেব মিশিরলাল শর্মা এলেই দুজনে বের হয়ে পড়বে।
কিন্তু আকাশের ভাবগতিক মোটেই সুবিধার নয়। কাল রাত্রে ঘুম হয়েছিল অনেক দেরীতে। তবুও আজ সময়মতোই উঠে পড়ে তৈরি হয়ে নিয়েছে সুরেশ। ডিসিপ্লিন তার রক্তে। বাবাও ছিলেন আই পি এস অফিসার। তাছাড়া দেরাদুনের কনভেন্ট এসব দিকে প্রচুড় কড়া। শক্ত হাতে যেন আই পি এস হওয়ার জন্যই বড় করা হয়েছে ওকে। ঘুম ভেঙ্গে এই টেবিলে বসতে ভাল লাগে সুরেশের। সামনে লম্বা পাইন গাছগুলোর দুলতে থাকা মাথার দিকে তাকিয়ে চায়ে চুমুক দেওয়া, আর উল্টোদিকে বসে থাকা রম্ভার সঙ্গে খুনসুটি করা, এটুকুই সারাদিনে বিলাসিতা তার। কিন্তু আজ রম্ভা এখনো আসছে না কেন? হঠাৎ চিন্তা হয় সুরেশের। কাল রাত্রে কি তারও ঘুম হয়নি ভালো? এখনও কি ওঠেনি সে?
কালরাত্রের কথা মনে পড়তেই ভেতরে একটা অস্বস্তি হয়। ঐ লাল ঘাগড়া চোলিতে কাকে দেখল সে? রম্ভা তো নিজের জায়গায় শুয়েই ছিল। এতটাই ভুল দেখল কী করে সুরেশ? ঘুমিয়ে পড়েছিল বসে বসে? তাই হবে। তাছাড়া আর তো কিছু হওয়ার নেই। সুরেশ নিজের মনের অস্বস্তিটা ঝেড়ে ফেলে দিতে চায়। শুধু মনের কোনায় কাঁটার মতো জেগে থাকে একটি প্রশ্ন, পানটা কখন খেলো রম্ভা? সে কি সুরেশের কাছ থেকেই পানটা নিয়ে মুখে পুড়েছিলো? তাই হবে নিশ্চয়ই। নাহলে পানটা তার মুখের ভেতরে গেল কী করে? দিনের আলোয় মনের যাবতীয় সংশয় উড়িয়ে দেয় সুরেশ। এতক্ষনে তার মনটা বেশ ঝরঝরে লাগছে। যে কোন কাজের যথাযথ ব্যাখ্যা না পাওয়া পর্যন্ত শান্ত হয়না মন। ঐ তো রম্ভা আসছে। হেসে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় সুরেশ, “গুড মর্নিং ডার্লিং … এত দেরী করে উঠলে, আজ আর আমাদের ব্রেকফাষ্ট টেবিলের আড্ডাটাই হবেনা …”
রম্ভা ঘুম থেকে উঠেই প্রতিদিনের মত আজও ফ্রেশ হয়ে সুন্দর জামাকাপড়ে পরিপাটি হয়ে এসেছে। গাঢ় নীল ম্যাক্সি ড্রেসে তাকে ভীষণ প্রাণবন্ত লাগছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে সুরেশের গালে টুক করে ঠোঁট ছুঁইয়ে সে চেয়ার টেনে বসে পড়ে।
“গুড মর্নিং এস পি সাহাব। এখুনি কি বেরোচ্ছ তুমি?”
“হ্যাঁ, কাল রাত্রেই প্ল্যানিং হল কি পিপুলগাঁও আর উজাপুর যাব। হেড অফিস থেকে অর্ডার এসে গেছে … ওইখানকার রিপোর্ট পাঠাতে হবে উইদিন আ উইক।”
টি পট থেকে চা ঢেলে সুরেশ রম্ভার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলে।
রম্ভা চায়ে চুমুক দেয়। “কি হয়েছে ওখানে? কিসের রিপোর্ট?”
“স্ট্রেঞ্জ সব কান্ড কারখানা। গত একমাসে ওই দুই গ্রামে পাঁচজন এর ডেথ হয়ে গেছে …”
“সে কি! কিভাবে? এনি ক্রাইম অর এনমিটি?”
“ওখানে একটা জঙ্গল আছে দুই গ্রামের মাঝখানে। সেই জঙ্গলে একটা বিরান আই মিন ভাঙ্গা পুরানো বাড়ি আছে। সেই বাড়ির যে কোর্ট ইয়ার্ড সেখানে সাত আট দিন পর পর এক একজনের ডেডবডি পরে থাকতে দেখা গেছে। গলায় চার চার আঙ্গুলের দাগ। স্ট্র্যাঙ্গুলেশন।”
“কি আশ্চর্য! এতজন এভাবে মার্ডার হয়ে যাচ্ছে! কেউ অ্যারেষ্ট হয়নি?”
“ধরা হয়েছে কয়েকজনকে বাট পুলিশের মধ্যেই কারোর কারোর কথা যে এরা নেহাত স্কেপগোট …। তাছাড়া ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও মেলেনি তাদের সঙ্গে।”
রম্ভা গম্ভীর হয়ে ভাবে। “ব্যাপারটা খুব সাধারণ লাগছে না। বী কশাস। তুমি না ফেরা অবধি আমার চিন্তা থাকবে।”
সুরেশ তাড়াতাড়ি ব্রেকফাষ্ট শেষ করতে করতে বলে, “আমি তো সবে সবেই এলাম। এসেই যে এরকম একটা কেস পাব ভাবিনি। ইন ফ্যাক্ট কাল রাত্রে ফাইলগুলো দিয়ে গিয়েছিল। থানায় গিয়ে দেখলাম। তোমার সঙ্গে আলোচনা করতাম রাত্রেই। কিন্তু …”
“যাক গে ছাড়। সাবধানে যেও।”
সুরেশ উঠে পড়ে, “বাই দ্য ওয়ে, তুমি বোরড ফিল করবে আজ … আমার দেরী হতে পারে। কোথাও যাবে? তাহলে বলে দিয়ে যাব। গার্ড নিয়ে যাবে।”
“তুমি আমাকে নিয়ে ভেবো না। আমি আঁকতে বসব। আর যদি ইচ্ছে হয় তো একটু বেরিয়ে কোথাও ঘুরে আসব। রিং করব তোমায়।”
“ওকে সুইটহার্ট, টেক কেয়ার …” জানলা দিয়ে নিচে গাড়ি ঢুকতে দেখে উঠে পড়ে সুরেশ। মিশিরলালজী মোটা শরীর নিয়ে ওপরে উঠবেন তার চেয়ে সে আগেই নেমে যেতে চায়।
নিমেষের মধ্যে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে তড়তড় করে নেমে লনে এসে যায় সে। মিশিরলালজী তড়বড় করে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়, “নমস্কার স্যার। আমার একটু দেরী হয়ে গেল কি?”
“আরে না না, ইটস ওকে …, আসুন, আমার গাড়িতেই চলে আসুন। কিছু ডিসকাসন ভি হয়ে যাবে। অনল, ফাইলগুলো সব এই গাড়িতেই তুলে দাও।”
পরপর তিনখানা গাড়ি স্টার্ট দেয় এস পি বাংলো থেকে। কিন্তু প্রথম গাড়িটা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে পড়ায় বাকি গাড়িগুলোকেও দাঁড়াতে হয়।
সামনের গাড়ি থেকে নেমে গিয়েছে দু’তিনজন। কেউ একটা লোক গেট দিয়ে ঢুকতে চাইছিল। ওরা গিয়ে তাকে আটকেছে। কিছু কথা চলছে ওদের মধ্যে।
“ক্যা হুয়া উধার? … “এই গাড়ি থেকে সুরেশ হাঁক পারে।
“আমি কি একবার দেখব?” ডিএসপি সাহেব বলেন।
“নেহি। আপ বৈঠিয়ে …” সুরেশ নেমে পড়ে গাড়ি থেকে।
গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে একটা লোক। সে ভেতরে ঢুকবেই। কিন্তু পুলিশের বড়সাহেবের বাংলোয় ঢোকা এত সহজ নয়। গেটের চারজন গার্ড থেকে আরো অন্তত পাঁচ ছ জন তাকে আটকে দিয়েছে। জিজ্ঞেস করছে তার কি দরকার এখানে। কোন প্রয়োজন থাকলে সে থানায় আসতে পারে, ইত্যাদি। কিন্তু লোকটি ভেতরে যাবেই। কিছু নিয়ে এসেছে সে। বড়সাহেবকে নয়, ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করে তার হাতেই দেবে সেই জিনিস। তাকে বোঝানোই যাচ্ছে না যে এভাবে এসব হয় না।
“ক্যা হুয়া অনল? কী বলছেন ইনি?”
“দেখুন স্যর এই লোকটি ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করতে চাইছে। পান এনেছে নাকি ম্যাডামের জন্য।”
“পান? ম্যাডাম পান খায়না। তার জন্য এলো আর যে খায় তার জন্য এলো না?”
সুরেশ হেসে ফেলে।
“না স্যর, আপনার জন্যও এনেছি …এই যে …” লোকটি কাঁধের ঝোলা থেকে বের করে দেয় পানের পুঁটুলি ।
“আরে? আপনি ব্রিজমোহন না? কাল তো আপনার দোকান থেকেই পান খেলাম …” সুরেশ এতক্ষনে চিনতে পেরে বলে ওঠে।
“হ্যাঁ স্যর …”
পান খেতে ভালবাসে সুরেশ। হাতের প্যাকেট থেকে একখানা বের করে মুখে পুরে খুশি হয়। এই পান ঠিক তার মনের মতো।
“অনল, ব্রিজমোহনজী কো পেমেন্ট কর দো। ম্যায় তুমকো অনলাইন পে কর দেতা হুঁ।”
“ইতনি ভি ক্যা জলদি হ্যায় সাহাব। আপ বাহার যাকে আইয়ে, বাদ মে লে লুঙ্গা …। বাস অউর কিসিকো হাত সে পান মত খাইয়েগা। ম্যায় হররোজ আপকে লিয়ে বানা কর লাউঙ্গা।”
সুরেশ হাসতে থাকে কথা শুনে। এমনি সময় হলে বড়সাহেবের সঙ্গে এতো কথা বলারও সাহস পায়না লোকে। গেটের লোকেরা ব্রিজমোহনকে সবাই চেনে তাই বুঝিয়ে যাচ্ছিল। তবু ভেতরে যেতে দেয়নি তারা। এবার সাহেবকে এভাবে কথা বলতে দেখে তারা ভাবে ভাগ্যিস ব্রিজমোহনকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়নি! এ তো দেখা যাচ্ছে সাহেবের চেনা লোক। সাহেব রেগেও গেলেন না একে দেখে।
সুরেশ গাড়ির দিকে এগোচ্ছিল। অনেকটা দেরিও হয়ে গেছে তার। ব্রিজমোহন পেছন থেকে খুবই কুন্ঠিত স্বরে ডাকে, “সাহাব, মেমসাবকে লিয়ে ভি পান লায়া থা।” কথাটা শুনে সুরেশের আবারও মনে পড়ে যায় কাল রাত্রের কথা। পান মুখে দিয়ে কেমন ঘুমিয়ে ছিল রম্ভা। পানটা কখন মুখে দিল সে? লাল ঘাগড়া চোলি পড়ে কে চলে গেল সুরেশের সামনে দিয়ে? তাছাড়া বিকেলে বেড়াতে বেরিয়ে মাথা ঘুরে যাওয়া রম্ভা। সবগুলো দৃশ্য চোখের ওপর দিয়ে ভেসে যায়।
একটু থেমে ব্রিজমোহনের দিকে তাকিয়ে বলে, “আজ মেমসাব পান নেহি খায়েঙ্গে। ও অ্যায়সেই পান খাতি নেহি।”
ব্রিজমোহন কেমন অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে আছে। আর কোন কথা না বলে গাড়িতে উঠে পড়ে সুরেশ।
যখন সুরেশদের গাড়িগুলো এক এক করে বেড়িয়ে গেল তখনও ব্রিজমোহন তাকিয়েই আছে বাংলোটার দিকে। ওপরে জানলা দিয়ে একঝলক দেখতে পায় রম্ভা। সে এঘর থেকে ওঘরে যাচ্ছিল। কী মনে হতে জানলার সামনে এসে একবার দাঁড়িয়েছে। এতদূর থেকে ভাল দেখতে পাওয়া যায় না। তবু বেশভূষা দেখে যেন কিছুটা চেনা চেনা লাগে ব্রিজমোহনকে। আরে! কালকের সেই পানওয়ালা না! সেরকমই তো লাগছে। ওই ঢোলা ঢোলা ধূলো রঙ কামিজ …! রম্ভা চট করে ভেবে নেয় ডেকে পাঠাবে নাকি ওকে! ওর একটা স্কেচ যদি করা যেত! লোকটার মুখের রেখায় রেখায় জমে আছে অনেক ইতিহাস আর ক্ষয়ে যেতে থাকা শিল্পের হাতছানি। রম্ভা তো কালই ভাবছিল ওকে আঁকার কথা। কিন্তু এই লোকটা এখানে কি করছে! ডাকবে কি ডাকবে না ভাবতে ভাবতে মনস্থির করতে পারে না রম্ভা। তারপর যখন আবার জানলা দিয়ে তাকায় ততক্ষনে গেটে আর নেই ব্রিজমোহন। সে এগিয়ে চলেছে ঢালু রাস্তা ধরে সামনের দিকে।
যাহ … চলেই গেল। যাক গে, পরে ডেকে আনলেই হবে। রম্ভা একখানা আর্ট ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে জানলা ছেড়ে নিজের ঘরের দিকে এগোচ্ছিল। কিন্তু পায়ে নরম কিছু ঠেকতে সে মেঝেয় তাকায়। ঠিক পায়ের পাতার কাছে পড়ে আছে একখানা রূপোলী তবকে মোড়া পান। এটা এখানে কি করে এলো! বহত তাজ্জব কি বাত! সুরেশ আনিয়ে রেখেছিল ওর জন্য? ও তো পান খায় না! তাহলে? তাছাড়া আনলোই যদি তো দিয়ে গেল না কেন! নিচু হয়ে পানটা হাতে তুলে নিয়ে নাকের সামনে ধরে রম্ভা। আ আ আহ … অপূর্ব এই গন্ধটা। এবার বোঝা যাচ্ছে সুরেশ কেন বেনারসি পানে মিঠে জর্দা দিয়ে খেতে এত ভালবাসে। তবে এটাও ঠিক, বিয়ের পর থেকে সুরেশকে এতো পান খেতে দেখেছে রম্ভা, নিজেও খেয়েছে মাঝেমধ্যে দু’ একদিন। কখনই এতো ভাল গন্ধ পায়নি। এই কালিম্পঙয়ে এসেই যেন ভীষণ সুন্দর গন্ধটা রম্ভাকে পাগল করে দিচ্ছে।
পানটাকে হাতে নিয়ে নাকের কাছে ধরে জোরে জোরে শ্বাস টানে ও। নাহ, পানটা এখন খাবে না। খেলেই তো শেষ হয়ে গেল। ও শুধু বার বার এই গন্ধটা নেবে। সুরেশ এলে তারপর খাবে বরং। খুশিমনে মোবাইলে মেসেজ টাইপ করে রম্ভা, “মাই ডিয়ার হাজব্যান্ড, খুশবুদার পান কে লিয়ে তুমহে এক সুউউউইইইইট কিসসি …। তুরন্ত আইয়েগা। তুমহারা জানু।”
৪
ব্রিজমোহন দুলকি চালে হেলে দুলে এগোচ্ছিল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। এখন এই পথে তার যাওয়ার কথা ছিল না। বরং তাড়াতাড়ি গিয়ে পানের দোকানটা খোলার কথা। অন্যদিন এসময় ভিড় হতে শুরু করে। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আছে যারা রেগুলারের খদ্দের। ব্রিজমোহনের পান ছাড়া তাদের চলে না। শরীর খারাপ, বৃষ্টি, প্রচন্ড ঠান্ডা সব উপেক্ষা করেও তাদের জন্য গিয়ে পানের গুমটি দোকানখানা খুলে বসে থাকে ব্রিজমোহন।
কিন্তু আজ আর ওদিকে পা গেল না। যেদিন থেকে চূর্ণীকে দেখেছে ওর রাতের ঘুম, মনের শান্তি সব চলে গেছে। চূর্ণীর জন্যই এতদিন এতবছর ধরে অপেক্ষা ছিল। জানত যে একদিন না একদিন তাকে ফিরে আসতেই হবে ব্রিজমোহনের কাছে। জবাব দিতে হবে কেন সে অমন না বলে কয়ে হারিয়ে গিয়েছিল ব্রিজমোহনের জীবন থেকে। রাজস্থানের বিশাল ব্যবসায়ী ঘরানার ছেলে ব্রিজমোহন তার ভালবাসার মানুষকে পাওয়ার জন্য কিই না করেছে! চূর্ণীর বাবার শর্ত ছিল পাঁচ লাখ টাকা। দিন রাত এক করে সেই টাকা নিজে যোগাড় করেছে সে। বাবুজির কাছে এক পয়সা নেয়নি। তারপর যেদিন ওই টাকা চূর্ণীর বাবুজির হাতে তুলে দিয়ে তাকে বিয়ে করে নিয়ে এল, সেদিন থেকে ব্রিজমোহনের ভাগ্য খুলে গেল। চূর্ণী ছিল তার জীবনের লক্ষ্মী।
দেখতে দেখতে বিদেশে রঙ্গীন সূতা সাপ্লাইয়ের কাজ ফুলেফেঁপে উঠলো। এক ব্রিজমোহন সারাদিন একশ’ হয়ে কাজ করে বেড়াতে লাগল। দিনশেষে সন্ধ্যা নামলে যখন সে বাড়ি ফিরত, দোতলার দেওয়ালে সাদা জাফরির ভেতর দিয়ে চূর্ণী তাকে দেখার জন্য চোখ পেতে থাকত। ব্রিজমোহনের নাগড়ার শব্দ কানে গেলেই রুপার পাঁয়জোড় ছমছমিয়ে সে দৌড়ে উঠত ছাদের ওপর। ব্রিজমোহন কখন এসে তাকে জড়িয়ে ধরবে দুই সবল হাতের বাঁধনে, সেইজন্যই সে অপেক্ষায় থাকত। তার ঘাগড়া দুলিয়ে ছুটে যাওয়া আজও ব্রিজমোহন চোখ বুজলেই দেখতে পায়। রামধনু রঙ চোলির বাঁধনে উদ্ভিন্ন যৌবন যেন সমস্ত ক্লান্তি দূর করতে ব্রিজমোহনের চোখে বুলিয়ে দিত রঙ্গিন পাখির পালক। সন্ধ্যা কখন গাঢ় হত খেয়াল থাকত না দুজনেরই। হাসি কথা ছোটাছুটি খেলা এইসবের মধ্যে কানে এসে ঢুকত নিচে থেকে জোরে জোরে বাজানো কাসরের আওয়াজ। বোঝা যেত এবার বাবুজি নিচের হলে এসে বসেছেন।
সুন্দর একটা নিয়ম ছিল বাড়িতে। সারাদিন যে যাই করুক, যার যা ব্যবসা তাই নিয়ে মেতে থাক, রাত্রিবেলায় একটা নির্দিষ্ট সময়ে সবাইকে হাজির হতে হত বাবুজির দরবারে। তাকে নজরানা দিতে হত একশ’ টাকা করে। দরবারই বলত ব্রিজমোহনেরা সবাই। তার দুই দাদা শঙ্করমোহন, অনাদিমোহন আর তিন ভাই রুপেশ, রাকেশ, রাজেশ সবাই সপরিবারে থাকত সেই দরবারে। বিশাল কাঠপেতলের ঝুলায় দুলতে থাকা আধোশোওয়া বাবুজি আর মা, সামনে মেঝের ওপর লাইন করে বসে থাকা ওরা সব ভাইয়েরা। দেওয়ালের ধার ঘেঁষে উকিঝুঁকি মেরে যাওয়া চূর্ণী আর ভাবীজিরা। এই দৃশ্যটা চোখে লেগে থাকে ব্রিজমোহনের। বড় দাদাদের ওপর ভার ছিল বাবুজির ক্ষেতিবাড়ি দেখাশোনা করার। মাইলের পর মাইল জুড়ে জোয়ার বাজরা গম আর সর্ষে চাষ হত ওদের। এখানে ব্রিজমোহন শুধু বেড়াতেই গিয়েছে মাঝে মধ্যে। কাজের ভার ছিল শঙ্করমোহন আর অনাদিমোহনের ওপর। নতুন বিয়ের পর চূর্ণীকে ওদের ক্ষেত দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল ব্রিজমোহন। আর ঘন লম্বা জোয়ারের ক্ষেতের মধ্যে শুয়ে পড়ে সেই যে ওদের আদিম খেলা, তা মনে পড়লে তো এখনও রক্ত গরম হয়ে উঠতে চায়।
মনে করতে চায় না ব্রিজমোহন। কিচ্ছু মনে করতে চায় না। কারণ স্মৃতি তো ঐখানেই দাঁড়িয়ে থাকে না। সে আরো এগিয়ে যায়। কানে ভেসে আসে চূর্ণির কথাগুলো। কতদিন গভীর রাত্রে জড়িয়ে ধরে ফিসফিসিয়ে বলেছে।
অনেকটা নেমে এসে পাইনের জঙ্গলে একটা গাছের সরু গুঁড়িতেই হেলান দিয়ে বসে পড়ে ও। সামনে আকাশটা মেঘের চাদরে ঢাকা। বৃষ্টি নামবে যেকোন সময়। ধূসর স্লেটের দিকে তাকিয়ে আবার ছবি আঁকা শুরু করে মন।
চূর্ণির মুখ ভার ছিল সেদিন। ব্রিজমোহন কাজ থেকে ফিরে তার পায়েলের ছম ছম শব্দ শুনতেই পায়নি।
“কী হয়েছে জানু? ছাদে যাওনি? আমি খুঁজে এলাম তোমাকে!” ব্রিজমোহন ঘরে এসে গালে হাত দিয়ে বসা চূর্ণীকে দেখে অবাক হয়েছিল।
“গিয়েছিলাম তো! তোমার ভাইদের চোখ ভাল না। রাকেশ অউর রুপেশ …ও দোনো হরবখত তং করতে হ্যায় মুঝে …”
“কী বলছো? ওরা আমার ভাই! সমঝে কথা বল…” ব্রিজমোহন রেগে উঠেছিল মুহূর্তে। চূর্ণী পা দাপিয়ে চলে যেতে যেতে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলেছিল, “পর মেরা নেহি …”
চূর্ণীর কথায় কেন গুরুত্ব দিইনি সেদিন? কেন তাকে খুলে জিজ্ঞেস করিনি কী ঘটেছিল? কেন ভাইদের নামে অভিযোগ শুনে রেগে গিয়েছিলাম? কী হল তার নতিজা? ব্রিজমোহন নিজের কাঁচা পাকা চুলগুলো মুঠি করে ধরে ঝাঁকাতে থাকে।
ঠিক সাতদিন পর ওই জোয়ারের ক্ষেতের মধ্যেই পাওয়া গিয়েছিল চূর্ণীর ক্ষত বিক্ষত শরীর। শ্মশানে যখন দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন, উল্লম্ব লেলিহান শিখা ধরে ক্রমঃশ মেয়েটার আত্মা উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে পৃথিবীর সব মোহ মায়া কাটিয়ে, ঠিক সেই সময় নিজের সার্ভিস রিভলভার থেকে দুখানা গুলি খরচ করেছিল ব্রিজমোহন। পর পর শ্মশানের মাটিতে শুয়ে পড়েছিল রাকেশ আর রুপেশের শরীর।
প্রায় একটা জীবন জেলে কাটিয়ে ব্রিজমোহন যখন বেরোল ততদিনে আমূল বদলে গেছে পৃথিবীটা। বাবুজি মা দুই দাদা, দুই ভাবী কেউ নেই আর। শুধু আর এক ভাই রাজেশ কোথায় চলে গেছে তা কেউ বলতে পারল না। নেই সেই বিশাল সাদা বাড়িটাও। গাঁয়ের লোকের মুখেই শোনা, ঐ বাড়ি থেকে সন্ধ্যে হলেই শোনা যেত ছম ছম শব্দ, কাঁচের চুড়ির রিন ঠিন অথবা মেয়েলি গলার তীক্ষ্ণ হাসির আওয়াজ। রাজেশের মাথাও ঠিক ছিল না। নানা কথা একা একা বলে যেত সে। জমিজমা সব বিক্রী করতে গিয়েছে কয়েকবার। কিন্তু ঐ জোয়ার ক্ষেতের ধারে কাছে এগোলেই যেন বিছের কামড় খাওয়ার মত করে আতঙ্কে চিৎকার করতে করতে ফিরে এসেছে। একদিন সকালে তাকেও আর দেখা গেল না। কোথায় চলে গিয়েছে সে কেউ জানে না।
বাড়িটা জঙ্গলে ভর্তি। জায়গায় জায়গায় ধ্বসে পড়েছে। যেন সামান্য নাড়া দিলেই ভেঙ্গে পড়বে ঝুড় ঝুড় করে। ব্রিজমোহন চারদিকটা ঘুরে ঘুরে দেখল। গ্রামের লোকেরা তার সঙ্গেও স্বাভাবিকভাবে কথা বলছিল না। পাঁচটা কথার উত্তরে একটা উত্তর। এতবছর জেলে কাটানো আসামীর সঙ্গে কেই বা মিশবে ভাল করে!
ব্রিজমোহন চলে এল রাজস্থনের গ্রাম ছেড়ে। নিজের বাড়িটা আর নিজের বলে মনে হচ্ছিল না তার। যেন এতগুলো মানুষের প্রেতাত্মা তার দিকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে। কিন্তু সে বাঁচতে চায়। সে জানে তার চূর্ণী তার কাছে ফিরে আসবেই। প্রতি রাত্রে এসে এসে সে বলে গিয়েছে সে কথা। জেলে কাটানো প্রতিটি রাত্রে এই স্বপ্নই দেখে গেছে সে। এখনও বলে যায়।
ব্রিজমোহন বেড়িয়ে পড়ল। এই পথ ওই পথ, এ রাজ্য সে রাজ্য ঘুরে সে এল উত্তরবঙ্গের এই পাহাড়ে। এলোমেলো পা ফেলে ভবঘুরে পথিকের মতই হাঁটছিল সে এক সকালে। কালিম্পং বাজারের চৌমাথায় এসে দাঁড়াল আর অবাক বিস্ময়ে যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। তাদের সেই বাড়িটা! সেই সাদা রঙ, চারপাশে জাফরি কাটা রেলিং ঘেরা। ছাদের ওপর ছোট্ট গম্বুজ। বাড়ির সামনেও একটা গম্বুজ ঠিক যেমন ছিল গ্রামেও। নিচের চওড়া বারান্দাটায় পা ফেলে ফেলে অনেকটা সময় হেঁটে বেড়ালো সে। দেওয়ালগুলো হাতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল। ভেতরে ঢোকার সিঁড়িটা খুঁজছিল। পেয়ে গেল ঠিক। এই বাড়ির কোথাও কোন তালা নেই। দরজাগুলো ভেজানো। কেউ থাকে না বোধহয়। থাকবে কী করে? সে ছাড়া আর কেউ তো নেই। রাজেশও কী আর বেঁচে আছে এতদিনে? চূর্ণী তাদের কাউকেই বাঁচতে দেবে না। রাজেশ কোন অপরাধ না করেও হয়তো শাস্তি পেয়েই গেছে এতদিনে। শুধু ব্রিজমোহনকেই ভালবাসত চূর্ণী। তার কাছেই আবার ফিরে আসবে। তাই এত দিন পরেও ব্রিজমোহনের স্বাস্থ্যে টাল খায়নি এতটুকু।
অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে দেওয়ালের একজায়গায় হাত ঠেকে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ব্রিজমোহন। হাতে ঠেকল বহুদিন আগের এক পেরেক খোদাই করা নামের অংশ। লাইটার জ্বেলে দেখল। হ্যাঁ, এই তো চূর্ণী লিখেছিল, ব্রিজ … মেরা প্যার …। ব্রিজমোহন হাত বুলিয়ে বুলিয়ে জায়গাটা নিজের বুকের ভেতর বসিয়ে নিয়ে নিশ্চিন্ত হল, এই বাড়িটা চূর্ণীই এখানে নিয়ে এসেছে। তাকেও এখানেই এনে ফেলেছে চূর্ণী। এই সেই বাড়ি যেখানে অলিতে গলিতে রয়ে গেছে ব্রিজমোহনের সঙ্গে তার যাবতীয় ভালবাসাবাসির মুহূর্ত।
আর কোথাও যাওয়া হল না ব্রিজমোহনের। প্রথম কিছুদিন বারান্দায় পড়ে রইল। ভয়ঙ্কর শীতে বারান্দায় কম্বল মুড়ি দিয়েও কাটানো দায়। ঘরগুলোয় থাকা যায় না। যেকোন সময় ঝুড় ঝুড় করে ভেঙ্গে পড়তে পারে বালি সিমেন্টের চাঙ্গর। কিছু হলে তবু বারান্দা থেকে দৌড়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচানো যাবে। আর মরতে চায় না ব্রিজমোহন। এবার তাকে চূর্ণীকে পাওয়ার জন্যই বেঁচে থাকতে হবে।
পুলিশের অশান্তি ভোগ করেও ওই বারান্দা ছাড়েনি সে। তারই দেখাদেখি আরো কয়েক’টি ভিখিরি পরিবার কোথা থেকে এসে বারান্দাতেই শুতে আরম্ভ করেছে। থাক। ওরাও থাক। ওদেরও হয়তো এই জায়গাটাতেই থাকা প্রয়োজন। কারুর সঙ্গে কোন বিবাদ নেই ব্রিজমোহনের। সে শুধু চূর্ণীকে ফিরে পেতে চায়।
ট্রাফিকের কয়েকজন পুলিশম্যানের সঙ্গে কিছুটা বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল ব্রিজমোহনের। তারা ওর ভদ্র ব্যবহার, মানুষের সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দেওয়া এই সমস্ত স্বভাব দেখে সবাই মিলেই চেষ্টা করছিল যাতে কোনভাবে কোথাও তাকে সেটল করে দেওয়া যায়। কিন্তু ব্রিজমোহন এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না। এই মোড়টুকুর মধ্যে কোথাও কিছু পেলে তবেই সে কাজ করবে যাতে দিনরাত এই বাড়িটাকে চোখে দেখতে পায়। লোকে তার এই বাড়ি আঁকড়ে থাকার কারণ জানে না। অনেক ঠাট্টা তামাসাও করে। কিন্তু ব্রিজমোহন নিজের জেদে অনড়। লোকাল লোকজন জানে বহুবছর আগে এই বাড়ির মালিক মারা গিয়েছেন। তার উত্তরাধিকার বলতে কেউ না থাকায় প্রায় পোড়োবাড়ি হয়ে পড়ে আছে। ব্রিজমোহন নিজের ইচ্ছেখুশিমত বাড়িটায় ঢোকে, কখনো ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, এতে কেউ কিছু ভাবে না। কারই বা অত সময় আছে বেশি ভাবনাচিন্তা করার! সবাই নিজের নিজের জীবনের চাকা ঘোরাতেই ব্যস্ত। অন্ধকার ঘুপচি ভাঙ্গা সিঁড়িগুলো ব্রিজমোহন ছাড়া আর কাউকেই টানে না। নইলে এই বাড়ি এভাবে ফাঁকা পড়ে থাকত কী না সন্দেহ।
সামনের বড় বাড়িটার নিচের তলায় সবটাই দোকান। চায়ের, মনোহারির, ওষুধের, কেক বিস্কুটের ইত্যাদি। তারই সব শেষের দিকে সিঁড়ির তলায় একটা ছোট্ট ঘুপচি মত অংশ একদিন খালি হল। এতদিন ওখানে একজন পুরনো শিশি বোতল কেনাবেচার কারবার করতেন। ট্রাফিক পুলিশের একজন ওই জায়গাটা ব্রিজমোহনকে ব্যবস্থা করে দিল। ওইটুকু জায়গার জন্য মালিক আর আলাদা করে কোন টাকাও নেয়নি। নিতে চাইলেও সে দিতে পারত না। তার তখন পেটের ভাত যোগানোই সমস্যা। লোকেই তাকে খাইয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। ব্রিজমোহন ব্যবসায়ী ঘরের ছেলে। সে এই ঘুপচিতে পানের দোকান দিল। ব্যবসা তার রক্তে। ওই ছোট্ট দোকান এখন গোটা উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বেশী ব্যবসা করা পানের দোকান। আর ব্রিজমোহন ভোলেনি তার উপকারীদের। এখনো রোজ ওই ট্রাফিকের লোকগুলোকে সে বিনি পয়সায় সবচেয়ে ভাল পানটা খাইয়ে দোকান শুরু করে। পুলিশের লোকের ওপর তার স্পেশ্যাল টান রয়েছে। পুলিশের জন্যই তার এই দোকান হতে পেরেছে। পুলিশের জন্যই সে এই বাড়িটাকে দিনরাত চোখে দেখতে পায়। এই বাড়ির কাছে আছে বলেই একদিন তার চূর্ণীও তার কাছে ফিরে আসবে। এই বিশ্বাসটুকু বুকে নিয়ে এই কালিম্পং এও কেটে গেল কত বছর।
অবশেষে সে এল। মাত্র ক’দিন আগে গাড়ি থেকে নতুন চেহারায় নতুন মানুষের হাত ধরে নেমে এল ব্রিজমোহনের চূর্ণী। সে যতই ভোল পাল্টে ফেলুক না কেন, ব্রিজমোহনের চোখকে তো ফাঁকি দিতে পারবে না। ঐ নাক চোখ মুখ চুল ঠোঁট, ঐ হাসি, কথা বলা, হেঁটে যাওয়া এসব কী চূর্ণী ছাড়া আর কারুর হতে পারে? সাহেবের ঘরে গিয়ে চূর্ণী তাকে ভুলে গেছে। ব্রিজমোহন তাকে আবার মনে করিয়ে দেবে সেই সব দিনের কথা, সেই ছাদের ওপরকার সন্ধ্যাগুলোর কথা, সেই শক্ত পাঞ্জাওয়ালা ব্রিজমোহনের কথা। কিন্তু তা যে খুব সহজে হবে না তা সে বোঝে। তাকে অনেকটা অপেক্ষা করতে হবে। করবে। ব্রিজমোহন যতদিন বাঁচবে অপেক্ষা করবে।
মাথাটা বড্ড ধরেছিল। চুলের গোড়া ধরে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে এবার একটু যেন আরাম হচ্ছে মনে হয়। আকাশে মেঘের ঘনঘটাও কিছু কমেছে। বৃষ্টিটা আর নামল না। অশান্ত মনকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে শান্ত করে এবার ফেরার পথ ধরে ব্রিজমোহন। একবার চূর্ণীকে দেখতে পেলে ভাল হত। কী আর করত সে? পানটা হাতে দিয়ে দুচোখ ভরে একবার দেখে চলে আসত। কারুর কোন ক্ষতি করার মানুষ সে নয় তা কী জানে না চূর্ণী? জানে তো। হয়তো ভুলে গেছে। কিম্বা হয়তো তারও সব মনে আছে, শুধু ভুলে যাওয়ার ভাণ করে আছে। রাম জানে।
ব্রিজমোহন বাধ্য হয়েই পানটা ওভাবে হাওয়ায় হাওয়ায় পাঠিয়ে দিয়েছে। পাবে কী সে? পেলেও সেটা খাবে কী? খাবে নাই বা কেন? এই সুগন্ধি ঈত্বর দেওয়া পান তো বড় প্রিয় জিনিস চূর্ণীর। প্রতিরাত্রে তাকে দিতে হত শোবার আগে। আদরে মাতোয়ারা হতে হতে চূর্ণীর নিঃশ্বাসে মিশে এই সুগন্ধ ব্রিজমোহনের সারা শরীরে মাখামাখি হয়ে যেত।
এলোমেলো পায়ে এগিয়ে যেতে যেতে, নানা কথা ভাবতে ভাবতে এইখানটায় এসে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে ব্রিজমোহনের। কিন্তু সাহেব! এই সাহেবটাও যে বড্ড ভালমানুষ মালুম হয়। তাকে কী ঠকানো হবে যদি ব্রিজমোহন তার চূর্ণীকে কাছে ডেকে নেয়? কেনই বা নেবে না? সাহেব কদিনের? ব্রিজমোহন তার কত বছর আগেই না চূর্ণীকে নিজের করে পেয়েছে! শুধু কপালের দোষে তাকে মাঝখানে হারিয়ে ফেলেছিল। এখন আবার সে যখন ফিরেই এসেছে ব্রিজমোহনের এত কাছে, তার ওপর নিজের অধিকার কী করে ছেড়ে দেবে? আজ গার্ডরা ওকে ভেতরে ঢুকতে দিল না, দেখতে দিল না চূর্ণীকে। কিন্তু এভাবে তো চলবে না। যে করেই হোক দেখার একটা ব্যবস্থা করতেই হবে ব্রিজমোহনকে ।
৫
রম্ভা একবার নিজের ঘরে গিয়ে খাটের ওপর বসে। পা দুলিয়ে দুলিয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখে। ঘরের দেওয়ালে নিজের হাত আঁকা বেশ কিছু সিনারি টাঙ্গিয়েছে ও। তার মধ্যে সূর্যের ঝকঝকে রূপ যেমন আছে, মেঘে ঢাকা কালো আকাশও আছে। কিন্তু সিনারির চেয়েও পোর্ট্রেট আঁকতেই বেশি স্বচ্ছন্দ রম্ভা। ভালওবাসে তুলির টানে নিঁখুত করে সামনে বসা মানুষটির মুখ অবিকল ফুটিয়ে তুলতে।
আজ কী আঁকা যায় ভাবছিল ও। প্রতিদিন একটা কিছু না আঁকলে মনে হয় যেন কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকি থেকে গেল।
রান্নার মেয়ে, কুসমি এসে জিজ্ঞেস করে গেল কী খাবে ম্যাডামজি। কী রান্না হবে আজ। রম্ভা বহুবার বলেছে এসব সংসারের কথা ওকে না জিজ্ঞেস করতে। নিজের মত করে যেন চাওল সব্জি মছলি চিকেন যা কিছু একটা রান্না করে রেখে যায়। কিন্তু ও জিজ্ঞেস করবেই। রম্ভা চিকেন আর স্কোয়াসের সব্জি করতে বলেছে। নিজের ব্রেকফাষ্টও সারা। এবার কী করা যায়? সারা ঘরে একবার চরকি পাক দিয়ে ঘর ছেড়ে বারান্দায় আসে ও।
পুরোটা বারান্দা কাঠের ফ্রেমে কাঁচ দিয়ে ঘেরা। দূরে পাহাড়টা যেন রম্ভার দিকেই তাকিয়ে আছে। এদিকে এই বাংলোটার পর আর ঘরবাড়ী নেই বিশেষ। প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে রম্ভার খুবই ভাল লাগে। কিন্তু আজ কেন যেন মানুষজন ভিড় ভাট্টা দেখতে মন চাইছে। যাবে নাকি একবার বাজারের দিকে? রম্ভা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে চিন্তা করে। সুরেশ তো বলেই গেল ও মন চাইলে বেরিয়ে আসতে পারে। রোজই এই এক কথা বলে যায়। রম্ভা একা একদিনও বেরোয়নি। আজ একবার বেরিয়ে আসতে মন চাইছে। কিন্তু একা যাবে কী করে? কোন রাস্তাই তো চেনে না। সুরেশকে একবার জিজ্ঞেস করে নেবে? আনমনে মোবাইলটা খুলে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে রম্ভা। সুরেশ তো ওর মেসেজটা এখনো দেখেইনি! থাক, ফোন করবে না ওকে। খুব কাজে ব্যস্ত আছে বোঝাই যাচ্ছে।
রম্ভা চটপট নেভি ব্লু উলেন প্যান্ট আর জ্যাকেট পড়ে তৈরি হয়ে নেয়। মাথায় খোলা চুলের ওপর চাপিয়ে নেয় লাল টুপি।
“কুসমি! ড্রাইভার কো গাড়ি তৈয়ার করনে কে লিয়ে বোলো।” লিপষ্টিক ঠোঁটে বোলাতে বোলাতে হাঁক পাড়ে।
কিছু পরে দেখা যায় বাংলো থেকে সাহেবের পার্সোনাল গাড়িটা বেরিয়ে পাহাড়ি পথে এঁকে বেঁকে এগোচ্ছে। রজেন নামের বাচ্চা একজন গার্ড সঙ্গে এসেছে। সাহেবের হুকুম আছে ম্যাডামের ঠিকঠাক খেয়াল রাখার জন্য। রম্ভা আপত্তি করেনি। ছেলেটা হাসিমুখ, অল্পবয়সি। ও সামনের সিটে বসে থাকলে রম্ভার কোন অসুবিধে নেই।
“কোনদিকে যাব ম্যাডাম?” রজেন বলে।
“একটা ভাল কোন ঘড়ির দোকানে নিয়ে চল আগে।” রম্ভা ভেবে নিয়েছে, আগামী মাসে সুরেশের বার্থডে। এখন থেকেই একটু একটু করে গিফট কিনলে ওকে ভাল সারপ্রাইজ দেওয়া যাবে। এই কেনাকাটা ওর আড়ালেই হওয়া ভাল।
গাড়ি এসে চৌমাথার একটু ভেতরদিকে বড় শোরুমের সামনে দাঁড়ায়। রম্ভা নেমে ঘড়ি দেখতে শুরু করে। বাব্বা! এই পাহাড়ে এত এত ডিজাইনের ঘড়ি রেখেছে! এত বড় শোরুম এখানে পাওয়া যাবে তা ও ভাবতেই পারেনি। সুরেশ ঠিকই বলেছিল, এখানে মানুষজন খুবই শওকিন। খুব সুন্দর একটা সি গ্রীন কালার কোয়ার্জ ঘড়ি পছন্দ করে রম্ভা। এটা সুরেশের ফর্সা হাতখানায় খুব মানাবে। রম্ভা পেমেন্ট করে দেয় ইউ পি আই-তে। তারপর নেমে আসে দোকানের সিঁড়ি বেয়ে।
“এবার কোথায় যাবেন ম্যাডাম?” রজেন বলে।
“এখানে ভাল কেকের দোকান আছে? চল।”
“একটু হাঁটতে হবে ম্যাডাম। ওই গম্বুজের কাছে চারমাথায় খুব ভাল কেক পাওয়া যায়। যাবেন? হাঁটবেন নাকি গাড়িটা ডাকব?”
“এইটুকু রাস্তা হেঁটেই যাই চল। সবসময় গাড়ি ভাল লাগে না।” রম্ভা রজেনের দেখানো পথে হাঁটতে শুরু করে। এই ছেলেটা ভারী মিষ্টি। একটা ভাই ভাই ভাইব আছে ওর মধ্যে। প্রতিকথায় সুন্দর হাসে।
“তোমার বাড়িতে কে কে আছে রজে্ন?”
“আমার ভাবি, ভাইয়া আর ছোট্ট মুন্নি।” রজেন বাড়ির লোকের উল্লেখে খুশি হয়ে ওঠে।
“কোথায় তোমার বাড়ি?”
“দার্জিলিং এর এক গ্রামে ম্যাডাম, বিজনবাড়ি। সুন্দর পাহাড়ি নদীর ধারে আমার ঘর। এখন তো নামকরা ট্যুরিষ্ট স্পট হয়ে উঠেছে। সাহেবকে বলবেন আপনাকে নিয়ে একবার ঘুরে আসতে। অনেক ভালভাল হোমস্টে হয়েছে।” অনেকটা কথা বলে একটু লজ্জা লজ্জা মুখে বলে, “আমার ভাইয়ার তো সরকারি নোকরি লাগল না। সেও একটা হোমস্টে করেছে দুই কামরার। ভাবি রান্না করে দেখভাল করে, সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে ঘরবাড়ি। ভাইয়া গেষ্টদের বেড়াতে নিয়ে যায় গাইড হয়ে।”
“বাহ, খুব ভাল তো। তাহলে আমরা তোমাদের হোমস্টেতেই থাকব। আমার আঁকা ছবি দেব তোমাকে একটা। ভাবিকে বলবে টাঙ্গিয়ে রাখতে।” রম্ভা বলে।
“এ তো আমার খুশনশিবী, ম্যাডাম। কিন্তু আমাদের তো নতুন হোমস্টে। আপনারা আরো অনেক ভাল জায়গা পেয়ে যাবেন, অনেক লাক্সারি সেখানে।”
“আরে না না। আমার লাক্সারি চাই না। আমি নদীর ধারেই থাকব। কাঠের বাড়িতে নিজের হাতে ছবি এঁকে দিয়ে আসব।”
রম্ভা নিজের মনে রজেনের সঙ্গে গল্প করতে করতে কখন চৌমাথায় চলে এসেছে। গম্বুজের সামনে এসেই ও দাঁড়িয়ে পড়ে। যেন ওর পা দুটো কেউ মাটির সঙ্গে আটকে দিয়েছে।
আরে! ঐ তো সেই লোকটা। ওর কাছ থেকেই তো পান কিনেছিল সুরেশ। আজই সকালে ও গিয়েছিল না বাংলোর গেটে? লোকটা গম্বুজের উল্টোদিকের পুরনো সাদা ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাড়িটার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে একটা খিলানে হেলান দিয়ে। ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। যেন আর কোথাও যাওয়ার নেই ওর। যেন ও জানতই যে রম্ভা এখানে আসবে, তাই অপেক্ষা করছে। লোকটা তো একটা গুমটি পানের দোকানে বসে। এই ভরা দিনের বেলা ওর তো সেই দোকানেই বসার কথা। কিন্তু কী অলসভাবে খিলানে হেলান দিয়ে এদিকে তাকিয়ে আছে! রম্ভার অদ্ভুত লাগে দেখে। লোকটার কাঁচা পাকা কাঁধছোঁওয়া চুলগুলো এলিয়ে আছে মুখের চারপাশ দিয়ে। কপালে যেন কত হাজার বছরের অভিজ্ঞতার ভাঁজ। একটা ধূসর রঙ এর জ্যাকেট আর ঝলঝলে প্যান্ট। এমনভাবে তাকিয়ে আছে রম্ভার দিকে যেন কতদিনের আত্মীয়তা ওর সাথে।
রম্ভার মনে পরে যায় এই মুখটা আঁকতে চেয়েছে সে। ভেবে রেখেছে সুরেশকে বলে দেখবে যে ওকে মডেল হওয়ার জন্য রাজি করানো যায় কিনা। সেই লোক এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ওর এত কাছাকাছি! রম্ভার কী মনে হয়, সে কোন কিছু না বলে সিঁড়ি ভেঙ্গে ভেঙ্গে ওই সাদা বাড়িটার বারান্দায় উঠে যায়। লোকটা তখনও ওকে দেখেই যাচ্ছে একইভাবে। কোন হুঁস নেই যেন ওর। রজেন পেছন থেকে লোকটাকে অকারনেই ধমকায়, “ব্রিজমোহনজী ক্যা দেখ রহে হো, ম্যাডামজি কো সালাম দো।”
ব্রিজমোহন যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল। নড়ে চড়ে ছুটে এসে রম্ভার সামনে হাতজোড় করে দাঁড়ায়, “আপনি নিজে এলেন ম্যাডাম! মুঝে বুলা লিয়া হোতা!”
রম্ভা হাসে, সে বোঝাবে কী করে যে কোন পরিকল্পনা করে আসা হয়নি। বাজার ঘুরতে ঘুরতেই চলে এসেছে। এই লোকটা ভেবেছে সে তারই কাছে এসেছে। সহজ সরল গ্রাম্য মানুষ, রম্ভা যে তার কাছে কোন প্রয়োজনেই আসতে পারে না, এটা ধারনাই করতে পারে না বোধহয়। অন্য যে কেউ হলে ইগোয় নিয়ে নিত কথাটা। কিন্তু রম্ভা শিল্পী। তার মন অন্য মানুষের চেয়ে আলাদা।
সে কিছুই মনে না করে বারান্দা থেকে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় ঘরের ভেতরে। একটা শত পুরনো ভাঙ্গা চোরা বাড়ি। এটাও তার কাছে দ্রষ্টব্য। সাদা রঙএর ওপর কত বছরের ধূলোর প্রলেপ পড়েছে। জানলার গরাদবিহীন শূন্যতা যেন বাইরের আকাশটাকে ঢোকার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। জানলার বাইরে চওড়া বারান্দা। বারান্দার ধারে কাজ করা রেলিং।
রম্ভা পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় বিশাল ঘরখানার মাঝখান দিয়ে। পেছনে পেছনে রজেন। তারও পেছনে ব্রিজমোহন। হলের শেষে একটা সরু কড়িডোর। সেখান থেকে ওপরে উঠে গিয়েছে ঘোরানো সিঁড়ি। উল্টোদিকে পরপর চারটে ঘরের দরজা। সব দরজাগুলোই বন্ধ। চারপাশের বারান্দা জানলার ফাঁক দিয়ে বাইরে থেকে উঁকি মারছে লোহার গ্রিলের সজ্জা নিয়ে। রম্ভা সিঁড়ির মুখে এসে থমকে দাঁড়ায়। কিছুটা অংশই দেখা যাচ্ছে। তারপর অন্ধকার। ওই সিঁড়ির ভেতর দিয়ে যে পথ গিয়েছে তা যেন রম্ভাকে আকুল হয়ে ডাকছে। ছাদ ছাড়া আর কী হবে! ওপরে গেলে নিশ্চয়ই পাহাড়টাকেই বাজারসমেত আরো বেশি করে দেখা যাবে। বাইরে থেকে তো বাড়িটা একতলাই মনে হচ্ছিল। নাকি দোতলা? রম্ভা গুলিয়ে ফেলে। চোখ কুঁচকে ভাবতে চেষ্টা করে।
“ম্যাডামজি, উপর যায়েঙ্গি আপ? মগর …” রজেন নিচু গলায় বলতে চেষ্টা করে। ম্যাডামকে তো একথা বলা যায় না যে যাবেন না ওপরে। রম্ভা পেছনে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করে, “হাঁ, কিঁউ?”
“না, মানে সাপ খোপ, কিড়ে মকোরে হো সকতা হ্যায় … কেউ তো থাকে না এখানে। ওপরেও যায় না” রজেন বলে।
“আরে কিছু হবে না। ঐ তো, উনিই তো বোধহয় এখানেই থাকেন। কী? ঠিক বোলা না ম্যায়?” ব্রিজমোহনের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে রম্ভা। ব্রিজমোহন সেই থেকে তাকিয়েই ছিল রম্ভার দিকে। এবার মাথাটা নিচু করে নেয়। ধীরে ধীরে বলে, “ম্যাডামজি, আজ উপর যাইয়েগা মত। ফির কিসি দিন …”
রম্ভা অবাক হয়, “কেন? আজ কেন যাব না? কী আছে আজ? আই ক্যান গেস যে উপর সে বহত সুন্দর লাগেগা চারোঁ তরফ …”
“আজ চাবি নেহি হ্যায় …ও লোগ সব দরওয়াজা পে তালা ঝুলাকে চলে গঁয়ে। মুঝে মালুম নেহি থা কে আপ আয়েঙ্গি। নেহি তো…”
রম্ভা বুঝে নেয়, ছাদের দরজায় কেউ তালা দিয়ে গিয়েছে। চাবিটা এখন পাওয়া যাবে না।
“ও কে। ফির কিসি দিন ম্যায় আউঙ্গি ছাদ মে যানে কে লিয়ে।”
সিঁড়ির সামনে থেকে ফিরে চলে রম্ভা মেন দরজার দিকে, যেদিক দিয়ে সে ঢুকেছিল। পেছনে রজেন ফিসফিস করে ব্রিজমোহনের কানের কাছে, “ম্যাডামজি কো ক্যা বোলা আপনে? কৌনসা তালা ……? এখানে কে তালা লাগাবে?”
“ও আপ সমঝেগা নেহি। আভি ভি বাচ্চা হো …”
রজেন কিছু বলতে যাচ্ছিল। রাস্তায় নেমে গিয়ে রম্ভা ডাকে, “রজেন, চল কেকের দোকানে যাব।”
“হাঁ ম্যাম …”
রম্ভা কেকের দোকানে ঢুকে সবেমাত্র দাঁড়িয়েছে। রজেন গাড়িটাকে ডাকতে বাইরে দাঁড়িয়ে ফোন কানে চেপেছে। রম্ভা চমকে তাকায় পেছনে। ব্রিজমোহন দুহাতের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। তার হাতে সোনালী কাগজে মোড়ানো পানের ঠোঙ্গা। এগিয়ে দিয়েছে রম্ভার দিকে।
“আরে! এটা কখন বানালেন? আপনি তো এখানেই ছিলেন। তাছাড়া আমি তো পান …”
“ম্যায় জানতি হুঁ। ইয়ে আপকি পসন্দিদা খুশবু হ্যায়। সিরফ আপ হি কে লিয়েই লায়া হুঁ” ব্রিজমোহন এমনভাবে কথাগুলো বলে, রম্ভা আর না করতে পারে না। লোকটার গলায় যেন মিনতি ঝরে পড়ছে। যেন শুধুমাত্র ওরই জন্য এই পান তৈরি করেছে লোকটা। হাত বাড়িয়ে পানটা নেয় রম্ভা। নাক টেনে অপূর্ব ঝিমঝিমে গন্ধটা বুকের ভেতর পাঠাতে পাঠাতে খানিক আনমনা হয়ে যায়। কী যেন আছে এই গন্ধটার মধ্যে। যেন কতদিনের চেনা গন্ধ। কোথায় যেন এই গন্ধ আগেও পেয়েছে ও। রম্ভার চোখের সামনে থেকে কেকের দোকান, দোকানের লোকজন, চৌরাস্তার মোড়, লোকজনে ভরা ব্যস্ত বাজার, ব্রিজমোহন, সব কেমন ধোঁওয়াটে হয়ে ভেসে যায়। জেগে থাকে শুধু একটা অনেক বড় ছাদ। সেই ছাদে ছম ছম ঘুঙ্গুরের আওয়াজ তুলে হেঁটে বা দৌড়ে বেড়াচ্ছে এক রাজস্থানী রমণী। তার মাথার লম্বা বিনুনী কোমড় ছাপিয়ে নিচে নেমে এসেছে। সেই বিনুনীর শুরুতে মোটা বেলফুলের গোড়ে জড়ানো। তার লাল ঘাগড়ার নিচে দুটো মেহেন্দী রাঙ্গানো পা, সেই পায়ে মোটা রুপোর পাঁয়জোড়। আলগা হাতে সলমা চুমকি বসানো উড়নি টেনে ঘোমটা দিয়ে ছাদের এপাশ থেকে ওপাশে ছুটে যায় সেই নারী। খুলে যায় ঘোমটা। তার বুকের সবুজ কাঁচুলি ভেদ করে যেন বাইরে আসতে চায় কোন ভালবাসারং পাখি। পেছন থেকে দীর্ঘ বলিষ্ঠ এক যুবাশরীর এসে সেই দৌড়ে বেড়ানো নারীশরীরকে টেনে চেপে ধরে নিজের বুকে। সেই যুবার মুখ বা সেই নারীর মুখ দেখতে পায় না রম্ভা। শুধু অদৃশ্য এক ছায়াছবি বারে বারে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে চায় ওর ক্রমশঃ বুজে আসতে থাকা চোখের পাতায়।
“ম্যাডামজি, আপনার শরীর খারাপ লাগছে কী? জল খাবেন? একটু জল চোখে মুখে ছিটিয়ে দেব কী?” রজেন ভয়ানক টেনশনে পড়ে গেছে রম্ভাকে দেখে। ম্যাডামকে ধরে নিয়ে যে গাড়িতে বসাবে, সেটাও পারছে না। গাড়িটা এখান থেকে তিন চার মিনিটের দূরত্বে আছে। এইটুকুও উনি হেঁটে যেতে পারবেন না হয়তো। সেন্সলেস হয়ে যাননি, অথচ মুখ চোখ দেখে মনে হচ্ছে কেমন অন্যরকম। যেমন উনি একটু আগেও ছিলেন তেমন নেই এই মুহূর্তে।
একটা চেয়ারে ম্যাডামকে বসিয়ে আবার ড্রাইভারকে ফোন করে রাজেশ। গাড়িটা এসে গেলে ধরে ধরে রম্ভাকে গাড়িতে তোলে।
গাড়িতে উঠে আচ্ছন্নের মত সিটে মাথা এলিয়ে দেয় রম্ভা। এই পুরো সময়টা ব্রিজমোহন কেবলই রম্ভার দিকে তাকিয়ে ছিল। রম্ভার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে একটাই কথা, “ও কাঁহা গয়ি! কৌন থা উসিকে সাথ?”
“কী বলছেন ম্যাডামজি? এই তো আমরাই তো আছি সেই থেকে। স্যরকে কী ফোন করব? শরীর বেশি খারাপ লাগছে আপনার?” রজেন বেচারি ভয় পেয়ে যায় মনে মনে। ম্যাডামকে নিয়ে সে বেরিয়েছে। ম্যাডামের দায়িত্ব এখন তার। যদি ম্যাডামের কিছু হয়ে যায় তাহলে সাহেবের কাছে কী মুখ দেখাবে সে!”
তাড়াতাড়ি গাড়িটা ছাড়তে বলে রাজেশ। রম্ভা আবার চোখ বুজে ফেলেছে। কোন কথার জবাব দেওয়া তো দূর, সে যে কিছু শুনতেও পাচ্ছে তাও মনে হচ্ছে না।
চলে যেতে থাকা গাড়িটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ব্রিজমোহন। দাঁড়িয়েই থাকে সে একভাবে তাকিয়ে, যতক্ষণ না গাড়িটা তার দৃষ্টিসীমার মধ্যে থেকে হারিয়ে যায় পাহাড়ের বাঁকে।
৬
সুরেশ গাড়ি থেকে নেমে তড়িঘড়ি এগিয়ে যাচ্ছিল বাংলোর দিকে। অনেক আগেই ফেরার কথা ছিল। কিন্তু রাস্তায় কিছু জায়গায় ছোট ছোট অবরোধ ফেস করতে হয়েছে। অবরোধ আর কী, নতুন সাহেব এসেছেন শুনে বেশ কিছু জায়গায় মানুষ জড়ো হয়েছিল, তাদের সবার অনেক দুঃখ যন্ত্রণা অভাব অভিযোগ। সুরেশ কোন প্রতিকার করতে পারুক না পারুক, তাদের কথা না শুনে চলে আসতে পারেনি। যে কাজ রাজনৈতিক নেতাদের করার কথা সে কাজ তাকে দিয়ে যে হয় না এই বোধটুকুও বেশিরভাগ সরল সাদাসিধে মানুষের নেই। কোন জায়গায় পানীয় জলের কষ্ট, কোথাও রাস্তা নেই, কোথাও হাসপাতালে ডাক্তার নেই। এইসব নানা কথায় অনেকটা দেরি হয়ে গেলেও সুরেশ মুখ ফুটে একথা একজনকেও বলতে পারেনি যে তার কোন ক্ষমতাই নেই যে এইসবকিছুর একটা ব্যবস্থা নেবে।
যা সে করতে পারে, অর্থাৎ আইনের রক্ষণাবেক্ষণ, তারই বরং বিশেষ সুযোগ নেই এখানে। এই পাহাড়ি মানুষগুলো সাধারণভাবে অত্যন্ত সরল বন্ধুবৎসল পরোপকারী। দিনেরাতে সমতলের মত এখানে ছোটখাট ক্রাইম লেগে থাকে না। এরা শান্তি চায়। এদের জীবন কাটানোর জন্য খুব সামান্য উপকরণের প্রয়োজন। সেটুকুও যখন না মেটে, তখনই ঝামেলা হয়। নইলে এই জায়গাগুলো শান্তই থাকে।
জায়গায় জায়গায় দাঁড়াতে দাঁড়াতে ফিরছিল সুরেশ। রজেন নামের সিকিওরিটি ছেলেটা সুরেশের সিকিওরিটিকে ফোন করে খবরটা দিয়েছে। রম্ভা আবার বাজারের মধ্যে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। সে নিজে সাহেবকে ফোন করে ওঠার সাহস পায়নি। তাছাড়া এতটা দেরি করে ফোন করছে যে তারজন্যও সে ভয়ে ভয়ে আছে।
চলন্ত গাড়িতেই সুরেশের সিকিওরিটি অনল প্রশ্ন করে, “ইতনা দের কিঁউ কিয়া? পহলেই বাতানা চাহিয়ে থা …”
সুরেশ মোবাইলে ম্যাপ দেখছিল। চোখ তুলে বলে, “ক্যা হুয়া অনল?”
জানা যায় রম্ভার অজ্ঞান হওয়ার খবর। রজেন সঙ্গে সঙ্গে ম্যাডামকে নিয়ে বাংলোয় ফিরেছে, ডাক্তারও ডেকেছে। কিন্তু একটু পরে জ্ঞান ফিরতেই ম্যাডামই বারণ করেছে কাজের সময় ফোন করে সাহেবকে না ব্যস্ত করতে। আরো বলেছে ম্যাডাম নিজেই ফোন করে জানাবে। রজেন তাই আর ফোন করেনি। সুরেশ রেগে উঠতে গিয়েও রাগে না। সে বোঝে, ম্যাডাম বারণ করলে সেই কাজটা করা রজেনের পক্ষে সম্ভব ছিল না। যাই হোক সে তবু একটু ফাঁক পেয়েই জানিয়েছে। তাছাড়া পুরোটা শুনে যা বোঝা গেল, পুরোপুরি অজ্ঞান হয়নি রম্ভা, বেশকিছুক্ষণের জন্য একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। এটাও কম চিন্তার বিষয় নয়।
“গাড়ি তেজ চালাও” সুরেশ গম্ভীর গলায় হুকুম করে। তার বেশ চিন্তা হচ্ছে এবার। এই নিয়ে দু’বার রম্ভা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে গেল। এই পাহাড়ে এসেই হচ্ছে এটা। আগেরদিনও ওই বাজারে গম্বুজটার কাছে মাথা ঘুরে গিয়েছিল। আজও ওইখানেই গিয়েছিল সে। কি করবে সুরেশ বুঝে উঠতে পারে না। শিলিগুড়ি নিয়ে যাবে? নাকি কলকাতায় একবার ডাক্তার দেখিয়ে আনবে! বাড়ি থেকে মা বাবুজিকে আনিয়ে নেবে কী! তার তো বাড়ি বসে থাকলে চলবে না। রম্ভার কী ভেতরে ভেতরে কঠিন কোন অসুখ হল! এখানে ডক্টর তো নাকি বলেছেন সব নর্মাল আছে। তাহলে কী ওনাকেই আরেকবার ডাকিয়ে আনবে? আগে দেখা যাক উনি কী বলেন, তারপর না হয় কলকাতা বা শিলিগুড়ি যেখানে হোক নেওয়া হবে। কিন্তু সবেমাত্র জয়েন করেছে। ছুটি পাবে কী সুরেশ!
নানা চিন্তায় মাথা ভারি করে বাকি রাস্তা এসেছে সে। এখন লাফিয়ে গাড়ি থেকে নেমে বাংলোর দিকে এগিয়ে যায়। আগে রম্ভাকে দেখতে হবে, কেমন আছে সে। ফোনে তো বোঝা যায় না সবকিছু ঠিকমত। নিচের অফিসরুমে বসে ছিল বুড়ো শিউনারায়ন। সে হোমগার্ড। এখানেই বসে থেকে গার্ড দেয় সে। বাইরের কেউ এলে তাকে জেরা করে করে নাজেহাল করাই তার কাজ। শিউনারায়নের চোখ ফাঁকি দিয়ে মাছিটাও পারে না দোতলার সিঁড়িতে পা রাখতে।
“কোই আয়া থা? কৈ চিঠঠি ব্যগারা?” হেঁটে এগিয়ে যেতে যেতেই প্রশ্ন করে সুরেশ।
“হাঁ সাহাব। ইয়ে বাক্সা…, ম্যাডামকে লিয়ে দে গয়া এক জেনানা। দুকানদার নে ভেজা।”
হয়তো রম্ভা কিছু মার্কেটিং করেছিল। অজ্ঞান হয়ে পড়ায় তা আর নেওয়া হয়নি। দোকানদার পাঠিয়ে দিয়েছে। এই ভেবে হাত বাড়িয়ে ছোট্ট লাল ভেলভেটের বাক্সটা নেয় সুরেশ। উঠে যায় ওপরে।
“রম্ভা, ডিয়ারি… হোয়্যার আর ইউ? ক্যা হুয়া থা তুমহে …” সুরেশ ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে।
“মুঝে ক্যা হোগা? কুছ ভি তো নেহি… “রম্ভা আধাশোওয়া হয়ে বই পড়ছিল। উঠে বসে একমুখ হাসি নিয়ে। সুরেশ ভাল করে তাকিয়ে দেখে রম্ভার মুখের দিকে। সবই ঠিক আছে শুধু চোখের নিচেটায় যেন একটু কালির ছোঁওয়া। মুখটাও একটু শুকনো লাগছে। আঙুল দিয়ে রম্ভার চোখের নিচেটায় ছোঁয় সুরেশ। “এখানে কী হয়েছে? লেগে যায়নি তো?”
“না তো! লাগবে কী করে?”
“তুমি আজকেও অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে? আই কান্ট আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াটস হ্যাপেনিং টু ইউ। মা বাবুজিকো বুলা লাউ?”
“আরে না না, সামান্য একটু চক্কর এসেছিল। মা বাবুজিকে এত ঠান্ডায় আনতে হবে না। বরং আমরাই যাব নেক্সট মান্থে এক সপ্তাহের জন্য। অনেকদিন বাড়ি যাওয়া হয়নি।”
“পাক্কা? তোমার কিছু হলে আমি কাজ করব কী করে? বাইরে বাইরে কাজ আমার।” ভীষণ চিন্তিত শোনায় সুরেশের গলা। রম্ভা ওর কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে।
“কিচ্ছু হবে না আমার। ডক্টর এলেন তো! ওষুধ খেয়েছি। তুমি যাও ফ্রেশ হয়ে এস। ডিনার করব”
“হ্যাঁ যাই। আর শোন, এই বক্সটা কেউ দিয়ে গিয়েছে। কিছু কিনেছিলে বোধহয়” রম্ভার হাতে ছোট্ট লাল ভেলভেটের বাক্সটা দিয়ে বাথরুমে ঢুকে যায় সুরেশ।
রম্ভা বাক্সটা হাতে নিয়ে উলটে পালটে দেখে। না তো, এমন তো কিছু কেনেনি সে। একটা ঘড়ি আর কেক, এই তো শুধু কিনেছিল। কী আছে এর ভেতরে! বাক্সটা খুলে চোখের সামনে মেলে ধরতেই স্থির হয়ে যায় ও।
একটা পুরনো সোনার আংটি। খুব ভারি। মাঝখানটায় একটা লাল পাথর বসানো। আর পুরো আংটিটায় অপূর্ব কারুকাজ করা। কে দিল এটা? দেখে তো পুরনো বলে বেশ বোঝা যাচ্ছে। হয়তো অন্য কাউকে দিয়েছে। ওকে কেন কেউ এই আংটি দিতে যাবে! বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিজের আঙ্গুলে পরার চেষ্টা করে রম্ভা। অনামিকাতে হলনা, তর্জনিতেও না। ঠিকঠাক ফিট করল মধ্যমায়। আংটিটা পরার পর মুহূর্তে কি যেন একটা হয়ে গেল মাথার ভেতরে। যেন একটা বিদ্যুতের রেখা মাথাটাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে গেল। রম্ভা চোখ বুজে ফেলল। ওর বোজা চোখের ভেতরে ভেসে উঠল একটা বহু পুরনো জমিদার বাড়ি। জোওয়ার বাজরার মাইলের পর মাইল ক্ষেত দিয়ে ঘেরা এক গ্রামের মাঝখানে সেই বাড়ি। তাতে সরু সরু উঁচু উঁচু সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি গিয়ে শেষ হয়েছে এক বিশাল ছাদে। সেই ছাদে দাঁড়ালে পুরো গ্রামটাকেই দেখতে পাওয়া যায়। রম্ভা দেখতে পায় লাল বাঁধনি ছাপা ঘাগরা চোলি পরা এক তরুনী যেন ওই ছাদের রেলিং এ ভর দিয়ে দুরের দিকে তাকিয়ে সন্ধ্যা নেমে আসা দেখছে। তার পিঠ ছাপানো বিনুনীতে রঙ্গিন টার্সেল বাঁধা। সেই টার্সেলের ঘুঙ্গুর থেকে টুং টাং শব্দ আসছে শরীরের নড়াচড়ায়। সেই মেয়ের মুখটা দেখতে পায়না রম্ভা। শুধু যেন কী এক আকর্ষণে ও বোজা চোখের ভেতর দিয়ে প্রাণপনে দেখতে চেষ্টা করে মুখটা। পেছনদিক থেকে বলিষ্ঠ এক যুবক এসে জড়িয়ে ধরল তরুণীকে। লম্বা মানুষটার পরনের সাদা চোস্ত পাজামা আর ঢোলা কুর্তাটুকুই শুধু দেখা যায়। মুখ দেখা যায় না কারুরই। রম্ভার মনে হয় ওর সামনে যেন কোন নাটকের দৃশ্য অভিনীত হয়ে চলেছে। ও যেন জন্ম জন্ম ঘুমের ওপার থেকে নীরব দর্শক হয়ে দেখে আসছে ওদের। ঘোরলাগা চোখে রম্ভা দেখে যায়। অপেক্ষায় থাকে কখন একবার ঐ মানুষ দু’জনের মুখটা দেখতে পাবে। একবারও কী ওরা মুখ ফেরাবে না পেছনদিকে!
নিজের অস্তিত্বও বুঝি আর মনে নেই ওর। সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে শুধু ওদের মুখগুলো দেখতে চাইছে। এই চাওয়া ওর বাহ্যিক চেতনার সম্পুর্ণ বাইরে। ওকে কোন অচেনা পৃথিবীতে নিয়ে এসেছে এই চাওয়া। রম্ভা ছটফট করে বিছানায় শুয়ে যেন ঘুমের মধ্যে ওকে কেউ কোথাও নিয়ে যেতে চাইছে আর ও যেতে চেয়েও যেতে পারছে না কোন অলঙ্ঘ্য বাধায়।
“রম্ভা! রম্ভা! ক্যা হুয়া তুমহারা! শো গয়ি ইতনি জলদি? ডিনার নেহি কিয়া আভভিতক। উঠঠো …” সুরেশ ঝাঁকুনি দেয় রম্ভার শুয়ে থাকা শরীরে। এইমাত্র যে জেগে ছিল এত তাড়াতাড়ি সে এভাবে ঘুমিয়ে পড়ল দেখে অবাক লাগে ওর। তবে কী শরীরটা খুবই খারাপ হয়েছে? আরেকবার কী ডাক্তারবাবুকে কল দেবে? রম্ভাকে জড়িয়ে রেখে ভাবে সুরেশ। মোবাইলে টাইম দেখে। তারপর অনলকে কল করে।
অনল নিচেই কোয়ার্টারে থাকে। ছোটখাট একটা পুলিশ ব্যারাকই রয়েছে বাংলোর হাতায়। সঙ্গে সঙ্গেই ফোনটা ধরে সে।
“স্যর, কিছু লাগবে স্যর?”
“অনল, ডাক্তারবাবুকে একবার কল কর। ম্যাডামের শরীরটা মনে হচ্ছে আবার খারাপ হয়েছে।”
সুরেশের গলা শুনে ধরফর করে এতক্ষণে উঠে বসে রম্ভা।
“আরে! তুমি উঠেছো? ডরা দিয়া মুঝে …”
“কেন? ভয় পাওয়ার কী আছে? আমি তো ঠিকই আছি। চল ডিনার করবে।” রম্ভা খাট থেকে নেমে দাঁড়ায়।
সুরেশ ওর হাতটা ধরে ফেলে, “দেখি দেখি এদিকে তাকাও তো …”
“কী হল আবার?”
সুরেশ এগিয়ে আসে রম্ভার দিকে। ডানদিকের চোখের তলায় হাল্কা একটুখানি দাগমত ছিল, সেটা যেন আর একটু গাড় হয়েছে। কী ব্যাপারটা হল? এইটুকু সময়ের মধ্যে দাগটা এতটা বেড়ে গেল কী করে! হাত দিয়ে ছোঁয় চোখের নিচটা।
“কী হয়েছে গো? কী দেখছ?”
সুরেশ রম্ভার হাত ধরে আয়নার সামনে নিয়ে আসে। “এই যে এই দাগটা কী করে হল? একটু আগে দেখলাম কতটা লাইট ছিল, এইটুকু সময়ের মধ্যে এতটা বেড়ে গেলই বা কী করে?”
রম্ভা হাসে, “দাগ? কোথায় দাগ? কী বলছ তুমি? কোন দাগ তো নেই!” রম্ভা নিজের মুখে চোখে হাত বোলায়।
“মানে? আর ইউ ম্যাড? তুমি দেখতে পাচ্ছ না দাগটা?”
“সত্যি কোন দাগ নেই। আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। কী সব বলছ তুমি!”
সুরেশ প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল। বাইরে রামদীন ডাকে, “সাহাব, ডগদার বাবু আয়েঁ হেঁ …”
রম্ভাকে কাঁধে হাত দিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ডাক্তারবাবুকে ভেতরে আসতে বলে সুরেশ।
“কী হয়েছে এস পি সাহেব? ম্যাডামকে আমি আগে একবার দেখে গিয়েছি। ওঁর প্রেশার চেক করেছি। ঠিকই তো আছেন। আবার কী কিছু …”
“আমার কিচ্ছু হয়নি ডাক্তারবাবু, শুধু শুধু আপনাদের এস পি সাহেব চিন্তা করছেন” রম্ভা হেসে হেসে বলে।
“ডাক্তার বাবু, একটু আগে ম্যাডাম ঘুমোচ্ছিলেন। বাট আই থিঙ্ক শি ওয়জ সিমড সামথিং অ্যাবনর্মাল। ঘুমের মধ্যেই ও খুব ছটফট করছিল। আমার দেখে মনে হল হয়তো ব্রিদিং ট্রাবল হচ্ছে। কিন্তু ও জেগে গিয়ে কোন অসুবিধের কথাই বলছে না। তাছাড়া এই চোখের নিচে দাগটা … বিলিভ মি, আধঘন্টা আগেও এটা অনেক হালকা ছিল। এখন দেখুন কতটা ডার্ক হয়ে গেছে। আর সবচেয়ে আশ্চর্য কী উনি কোন দাগ দেখতেই পারছেন না।”
“সে কী! ঘুমের মধ্যে ছটফট করাটা না হয় বোঝা গেল। একটা ইসিজি করে দেখে নিচ্ছি। কিন্তু চোখের নিচের দাগটা উনি দেখতে পাচ্ছেন না? তাহলে কী পাওয়ারটা চেক করাব একবার? আজ তো আর হবে না … কাল সকালে …”
ডাক্তারবাবুকেও চিন্তিত দেখায় ।
“ক্যা মুসিবত! আমি বলছি কিচ্ছু হয়নি আমার, কেন তুমি এত চিন্তা করছ?”
রম্ভাকে এবার একটু অস্থির দেখায়।
“অনল কো বুলাও” রামদীনকে বলে সুরেশ।
দুমিনিটের মধ্যে অনল বাইরে এসে দাঁড়ায়। সুরেশ বেরিয়ে আসে। ডক্টর তার সঙ্গে লেডি অ্যাটেন্ড্যান্ট এনেছেন। তিনি ইসিজি করতে শুরু করলে সুরেশ বেরিয়ে আসে।
অনল, এক কাম করো, আই টেষ্টিং করনেবালা কিসিকো লা সকতে হো? আভভি?”
অনল না বলতে শেখেনি। এই সন্ধ্যের পর মেশিনপত্র সমেত আই টেষ্টিং এর জন্য কাকে পাওয়া যাবে তা নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগলেও মাথা নেড়ে চলে যায়।
ডাক্তারবাবুর ইসিজি করা হয়ে গিয়েছিল।
“এস পি সাহেব, ম্যাডামের ইসিজি রিপোর্ট একদম নর্মাল। নাথিং টু ওয়ারি অ্যাবাউট। আর ওই দাগটা আমার মনে হয় কোথাও চোট আঘাত লেগে গেছে, হয়তো ঘুমের মধ্যে খাটের পাশের টেবলেও ঠোকা লেগে যেতে পারে … ওটা যদি বাড়ে তবে কাল একটা ব্লাড টেষ্ট দেব। আজকের রাতটা দেখুন”
“কিন্তু ডাক্তারবাবু, ও নিজে এটা দেখতে পাচ্ছে না কেন? ইজনট ইট পিকিউলিয়ার?”
এই প্রশ্নের উত্তর ডাক্তারবাবুর কাছে ছিল না। তিনি গম্ভীর হয়ে চিন্তা করতে থাকেন।
যখন এইসব কথা হচ্ছে, তার মধ্যেই পোর্টেবল মেশিন সমেত একজন টেকনিশিয়ানকে নিয়ে হাজির করে অনল। একেই পাওয়া গেল। পাওয়ার চেক করতে পারবে। আই স্পেশ্যালিষ্টকে কাল সকালের আগে পাওয়া যাবে না। তিনি শিলিগুড়ি গিয়েছেন।
রম্ভাকে চোখ পরীক্ষার জন্য বলতেই সে বেঁকে বসে, “কিঁউ? ক্যা হুয়া মেরি নজরোঁ কো? খুব দেখ সকতি হুঁ ম্যায়।”
“তুমি তো তোমার চোখের নিচে দাগটা দেখতেই পাচ্ছ না। ক্যা ইয়ে নর্মাল হ্যায়?” সুরেশ নরম গলায় বোঝাতে চেষ্টা করে রম্ভাকে। আর কিছু না বলে চোখের টেষ্ট করিয়ে নেয় রম্ভা। এখানেও তার পাওয়ারের কোন সমস্যা চোখে পড়ে না।
সবাই চলে গেলে ডিনার টেবিলে বসে সুরেশ। মনে মনে সে ভেবে নিয়েছে কাল রম্ভাকে নিয়ে একবার শিলিগুড়িতে বড় নার্সিংহোমে দেখিয়ে আনবে। ও ঘুমের মধ্যে এমন ছটফট করছিল কেন সেটা জানতে হবে। হার্টের কোন সমস্যা থাকলে সবসময় তা ইসিজি তে ধরা নাও পড়তে পারে। তাছাড়া দাগটাও দেখাতে হবে। ফর্সা মুখে কালচে দাগটা যেন চাঁদের গায়ে কলঙ্কের মত ফুটে আছে। সুরেশের মনে হয় ওটা আরও একটু প্রমিনেন্ট হয়েছে। কিন্তু কিছুই বলে না সে মুখে। এমনিতেই সারাদিনের কাজে অজস্র ধকল গিয়েছে। তারপর এখনও পর্যন্ত একটুও বিশ্রাম পেল না। আর কোন কথা বলে রম্ভার সঙ্গে আর্গুমেন্টে যেতে ইচ্ছে করছে না ওর।
রম্ভাও মনে হচ্ছে ক্লান্ত। মন দিয়ে চুপচাপ খাচ্ছে সে। রুটি ছিঁড়ে চিকেনের ঝোলে ডুবিয়ে মুখে দিচ্ছে আর কী যেন ভাবছে। সুরেশ ওর দিকে একবার তাকিয়ে জলের বোতলটা গলায় উলটে ধরে।
“আমার আঙটি? আমার আঙটিটা কোথায় গেল? কে নিল আমার আঙটি?” খেতে খেতে তীব্র স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে রম্ভা।
বিষম খেতে খেতে সামলায় সুরেশ। ওপাশের কিচেন থেকে ছুটে এসেছে রামদীন।
“কিসের আঙটি? এই তো তোমার আঙ্গুলেই তো আছে” সুরেশ রম্ভার ডানহাত তুলে ধরে ফুলশয্যায় উপহার দেওয়া হিরের আংটিসমেত অনামিকাটা দেখায়। সেদিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকায় রম্ভা, “এটা না, এটা না, আমি ওই সেই আংটিটার কথা বলছি … যেটা … যেটা …”
“কী বলছো তুমি? কোন আংটি? আর তো কোন আংটি ছিল না তোমার হাতে। মা পড়তে বলায় তুমি বলেছিলে একটাই থাক। মনে পড়ছে না?”
“ছিল না?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে রম্ভা। তার চোখে মুখে একটা ক্লাস ফাইভের মেয়ের জিজ্ঞাসা। সুরেশ এই রম্ভাকে দেখেনি কোনদিন। সে বুঝতে পারেনা কী হচ্ছে তার রম্ভার সঙ্গে।
কিছুক্ষণ পর শান্ত হয়ে ঝিমিয়ে যায় রম্ভা। আর কোন জিজ্ঞাসা নেই তার। চেয়ারে হেলান দিয়ে তাকিয়ে আছে দেওয়ালের দিকে। খাওয়ার দিকে কোন নজর নেই। সুরেশ দু একবার ডেকে সাড়া পায় না। চামচে করে স্যুপ খাইয়ে দিতে থাকে। রম্ভা হাঁ করছে, গিলেও নিচ্ছে। কিন্তু সে যেন এসবের মধ্যেই নেই। একটু আগেও যে আঙটি আংটি করে জিজ্ঞাসা করছিল, সেই প্রাণের লক্ষণটুকুও নেই ওর মধ্যে। সুরেশ বুঝে উঠতে পারে না কী করবে সে।
কোনরকমে স্যুপটুকু খাওয়ানো শেষ করে রম্ভাকে এনে বেডরুমে শুইয়ে দেয় সুরেশ। নিজে এসে বড় কাঁচের জানলার পাশে দাঁড়ায়। তারপর ধীরে ধীরে মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে বাইরে চলে আসে। বাড়িতে একবার ফোন করবে। রম্ভা জেগে যেতে পারে। তাই ড্রয়িংরুমের দিকে আসা।
এখানে রয়েছে কিছু বড় বড় পুরনো দিনের সোফা। গদিতে গা ঢেলে দেয় সুরেশ। ক্লান্তিতে তারও চোখ বুজে এসেছে।
রামদীন এসে দাঁড়ায়। কুন্ঠিত গলায় ডাকে, “সাহাব …”
“উমম … রামদীন? ক্যা হুয়া?” সুরেশ সোজা হয়ে বসে।
“সাহাব, আগর কুছ মাইন্ড না করেঁ তো এক বাত বাতানা থা …”
“হাঁ হাঁ বোলো না।”
“সাহাব, ম্যাডামজি কো মন্দির লে যানা চাহিয়ে।”
“মন্দির? কিঁউ? ম্যাডামজি ঘুমনে যায়েঙ্গে ক্যাঁ? অনল কো বাতা দো। কাল সুবা চাহে তো যা সকতি হ্যায়”
“জী নেহি সাহাব।” রামদীনের মাথা আরো ঝুঁকে পড়ে মাটিতে। গলার আওয়াজ প্রায় শোনাই যায় না। “ভাংরি মাতাজী কী মন্দির হ্যায় পাহাড়ি কে উপর। ওখানে গিয়ে পূজা চড়াতে হোবে। লাগতা হ্যায় কী কোই রুহ কী হাওয়া লাগা হ্যায় উনহে …”
কী বলছে এসব রামদীন? সুরেশ ধমকে উঠতে গিয়েও চুপ করে যায়। তার মনে পড়ে যায় ক’দিন আগেই দেখা সেই লাল ঘাগড়া চোলি পরা রম্ভার মূর্তি। সুরেশের চোখের ওপর দিয়েই তো বেরিয়ে গেল রম্ভা। অথচ তারপর আবার তাকে বিছানায় ঘুমন্ত পাওয়া গেল। ওইদিন থেকে মনের তলায় একটা খটকা লেগেই আছে। যত কাজই করুক ওই দৃশ্যটা তো ভোলেনি সুরেশ। কিন্তু তাই বলে রুহ কী হাওয়া? এই দুহাজার চব্বিশে দাঁড়িয়ে সেকথা বিশ্বাস করতে হবে? এটাতেও মন সায় দেয় না বিজ্ঞানের ছাত্র সুরেশের।
“সাহাব, আমি আপনার চেয়ে চালিশ সাল বড়। অনেক দেখলাম এই পৃথিবী। ম্যাডামজির চোখ আমার নর্মাল লাগছে না। গুস্তাকি মাফ সাহাব। ম্যাডামজি আমার বেটি য্যায়সি। উনকো কোই খারাবি মুঝে বরদাস্ত নেহি হোগা।”
“আচ্ছা রামদীন, তুম অব শোনে যাও। দেখতা হুঁ ম্যায় ক্যা কিয়া যায়।” সুরেশ ক্লান্ত পায়ে বেডরুমে এসে ঢোকে। রম্ভা রোজের মতই হাত দুটো ছড়িয়ে শুয়ে আছে। বালিশের ওপর থেকে তার কোঁকড়া চুলের গুচ্ছ নেমে এসেছে বুকে গলায়। ডানহাতখানা বুকের ওপর।
আজ এঘরেই শোবে সুরেশ। রম্ভার শরীরটা খারাপ। তাকে একা ছাড়া উচিত হবে না। পাশের বালিশে মাথা দিয়ে বেডসুইচটা অফ করতে গিয়েই চমকে ওঠে সে। চোখ আটকে যায় ঘুমন্ত রম্ভার বুকের ওপর রাখা ডানহাতের অনামিকায়। সেখানে জ্বলজ্বল করছে সূক্ষ্ম কারুকাজ করা ভারি সোনার একটা আংটি যার মাঝখানে লাল পাথর বসানো। এই আংটি কোনদিন দেখেনি সুরেশ। কোথায় পেল রম্ভা এটা? ওর কাছেই কী ছিল? কখনই বা পড়ল? এটাই কী সেই আংটি যার খোঁজ করছিল খেতে বসে? কোথা থেকে এল এই আংটি? হাজারটা প্রশ্ন তেজি ঘোড়ার ক্ষুরের মত সুরেশের মাথার ভেতর দিয়ে এদিক থেকে ওদিকে চলে যায়। আর ঠিক তখুনি সুরেশ আরেকটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার নজর করে। রম্ভার চোখের নিচের কালচে দাগটা যেন আরো কিছুটা গাড় হয়ে উঠে গালের কাছে নেমে এসেছে। কী আশ্চর্য! এসব কী ঘটছে রম্ভার সাথে?
সুরেশের মাথা কাজ করে না কী করবে সে। আঙুল বুলিয়ে দেয় রম্ভার চোখের নিচের দাগটাতে। টেনে খুলে নিতে যায় আংটিটা। কিন্তু রম্ভা ঘুমের ঘোরে হাত গুটিয়ে সুরেশকে একটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। তারপর পেছনে ফিরে শোয়। এতটা জোর রম্ভার গায়ে! সুরেশ হতভম্বের মত বসে থাকে। হঠাৎ তার কানে আসে তীব্র শিশের আওয়াজ।
বাইরে পর্যাপ্ত গার্ড রয়েছে। সুরেশ আলগোছে কাঁচের জানলা দিয়ে নিচে তাকায়। কয়েকজন গার্ড একজন কাউকে ঘিরে ধরেছে। তাদেরই কথার আওয়াজ এই পর্যন্ত এসে থেমে গেছে।
সুরেশ হাঁক পারতে চায়, “ক্যা হুয়া, কৌন উধার?” কিন্তু তার গলা দিয়ে আওয়াজ ফোটে না। একটু আগেই যে ধাক্কাটা সে পেয়েছে রম্ভার কাছ থেকে তার কাছে এই চিৎকার কিছুই না। তবু হয়তো সে নিজেই নিচে ফোন করত। তার আগেই অনলের মেসেজ এসে ঢোকে।
স্যর, পারহ্যাপস ইউ আর স্লিপিং। সেই পানের দোকানের লোকটি, ব্রিজমোহন, বাংলোর দেওয়াল থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙ্গেছে মনে হচ্ছে। উই টু আর টেকিং হিম টু হসপিটাল।
সে কী? ব্রিজমোহন এত রাত্রে? সে এখানে কী করছে? এত রাত্রে? দেওয়ালেই বা উঠেছিল কেন?”
অনলকে ফোনে ধরে সুরেশ, “অনল, টেক হিম ইনসাইড। গেটিং ডাউন।”
“ওকে স্যর।”
ঘর থেকে ঝড়ের বেগেই নেমে যাচ্ছিল সুরেশ। সামনে রামদীনকে দেখে থেমে যায়।
“সাহাব, আমি ম্যাডামজির কাছে বসছি।”
তাকে বারণ করতে গিয়েও কিছু বলেনা সুরেশ। কাঠের সিঁড়িতে মচমচ শব্দ তুলে নিচের দিকে এগোয়। রম্ভাকে একা রেখে যেতে তারও মন সরছিল না। থাকুক রামদীন ওর কাছে।
৭
সুরেশকে এগিয়ে আসতে দেখে গার্ডরাও কাছে আসে।
“কী হয়েছে অনল? এত রাত্রে ব্রিজমোহন এখানে কেন? কোথায় সে?”
“স্যর … একমুহূর্তের মধ্যে স্যর ও প্রায় হাওয়া হয়ে গেল। আপনাকে ফোন করে পেছন ফিরেই দেখি অনেকটা এগিয়ে গেছে। দুজন ফলো করে অনেকটা নেমে গিয়েও আর দেখতে পেল না” অনল বলে।
“কী বলছো? পা ভেঙ্গেছে বললে! ভাঙ্গা পায়ে অতদূর যাবে কী করে? যাও খোঁজো। ধরে আন।”
“স্যর, ও নিজেই বলল পা ভেঙ্গেছে। পা ফেলতেই পারছিলনা স্যর, আমরাও দেখলাম।”
“এসেছিল কেন? হোয়াই দেওয়াল? ও তো চেনা মানুষ। কোন দরকার থাকলে তো গেট দিয়েই আসবে। কিছু বলল?”
“না স্যর, কিছু বলার আগেই তো …” অনল মাথা নাড়ে দুদিকে …
একজন কনষ্টেবল নিচু গলায় পাশেরজনকে কিছু বলছিল। সুরেশ দেখতে পেয়ে বলে, “আপলোগ ক্যা বোল রহে হো? জোরসে বোলো …”
কনষ্টেবলটি বলে, “সাহাব, ও এক হি বাত বাতায়া, ম্যায়নে শুন লিয়া …”
“ক্যা বোলা?”
“যব অনল স্যর পুছতাছ কর রহে থে ও চুপ থা। সিরফ একবার বোলা কি জান হ্যায় মেরা ইয়হা …”
এবার অনল উত্তেজিত হয়ে ওঠে, “এই কথা বলেছে ব্রিজমোহন? কখন বলল? আমি তো শুনতে পেলাম না …কেন বলল এই কথা?”
“তব আপ সাহাবকে সাথ ফোন পে থে স্যর …”
সুরেশ চোখ কপাল কুঁচকে চিন্তা করে। ইয়হা জান হ্যায় মেরা! কী মানে এই কথাটার? ব্রিজমোহন পানওয়ালার কী থাকতে পারে এই বাংলোয়? এত রাত্রে? দেওয়ালে উঠে সে কী বাংলোর ভেতরে যেতে চেয়েছিল? কেন? তাহলে কী সুরেশ এখানে আসার আগে কোন কিছু ঘটেছিল এখানে? সেরকমও তো কিছু শোনেনি সুরেশ। ওর আগের এস পি নিশ্চয়ই তাহলে সেকথা বলত।
“এক পেট্রল ভ্যান কো ভেজো আভভি, দেখ কর আয়ে উসকো। যাহা রহতে হ্যায়, আভভি হ্যায় কী নেহি। আকে মুঝে রিপোর্ট করনা হ্যায়।” সুরেশ কথাগুলো বলে দিয়ে চলে যায় ভেতরে।
কী সব যে ঘটছে চারপাশে, মাথাটা ভার হয়ে থাকে চিন্তায়। লোকটাকে দোকানে দেখেছে, সেদিন গেটের কাছে দেখল। দেখে তো মনে হয়নি চোর বা ডিজঅনেষ্ট ধরনের কিছু। এত সুন্দর পান বানায়। দোকানে যথেষ্ট বিক্রিও আছে। ফ্যামিলি সম্বন্ধে অবশ্য জানেনা সুরেশ। মাত্রই তো কটা দিন এসেছে। একটা সাধারণ লোকের সম্পর্কে শুধু শুধু খবর নিতে যাবেই বা কেন যদি না তার কোন ক্রিমিনাল রেকর্ড থাকে।
সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে উঠে আসে সে। বেডরুমের মেঝেতে রামদীন বসেছিল। ওকে দেখেই উঠে দাঁড়ায়। প্রথমবার কুন্ঠিত গলায় বলেছিল। এবার জোরের সঙ্গেই বলে, “সাহাব, ম্যাডামজি কো কালই ভাঙ্গরি মাতাজীকী মন্দির লে চলিয়ে। নেহি তো অনর্থ হো যায়গা।”
ঘুমন্ত রম্ভার দিকে তাকিয়ে সুরেশ দেখে নেয়। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে মেয়েটা। দেখে মনেই হবেনা কোনরকম অ্যাবনর্মাল কিছু হয়েছে ওর সাথে। সুরেশ ভাল করে চোখের নিচটা দেখে। দাগটা কী একটু হাল্কা লাগছে? নাকি আরো গাঢ় হল এইটুকু সময়ের মধ্যে? কী করে হল এই দাগটা? আঙ্গুলে ওই আংটিটা কী এখনও আছে? হাতটা চেপে পাশ ফিরে শুয়ে আছে তাই দেখা যাচ্ছে না। কোথা থেকে এল ওই আংটি? অনেক পুরনো বলেই মনে হয়েছে একনজরে। বাড়িতে কী মাকে একবার ফোন করে জিজ্ঞেস করবে রম্ভাকে কেউ এরকম কোন আংটি বিয়েতে উপহার দিয়েছিল কিনা? ওর বাড়িতেও জানতে চাইবে কী? কিন্তু এমন একটা প্রশ্ন শুনলেই বাবা মা আবার টেনশন করতে শুরু করবে। চারজনেরই বয়স হয়েছে। কী করা উচিত কিছু বুঝতে পারে না সুরেশ। তারমধ্যে ব্রিজমোহনের এই মাঝরাত্রে দেওয়ালে উঠে পড়ে গিয়ে পা ভাঙ্গা এবং প্রায় অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। এখন রামদীন বলছে অনর্থ হো যায়েগা। মন্দির নিয়ে যাবে কীভাবে? কাল সকাল দশটায় সিপি মিটিং আছে দার্জিলিং-এ। সেখানে তো যেতেই হবে সুরেশকে।
সুরেশ মাথার চুল খামচে ধরে সারাঘরে পায়চারি করতে থাকে। এতদিন চাকরি জয়েন করেছে, বেশ কিছু ঝামেলার কেস ডিল করেছে। মনেপ্রাণে প্রতিদিন একটু একটু করে পোক্ত পুলিশ অফিসার হয়ে উঠছে। কিন্তু এরকম জটিল সমস্যায় পড়েনি কোনদিন।
রামদীনও কোনদিন সাহেবকে এত টেনশনে দেখেনি। লোকে বলে এই সাহেব কাজের জায়গায় কঠিন কঠোর কিন্তু যখনি ঘরে ম্যাডামের সঙ্গে থাকে, দিব্যি হাসিখুশি সহজ সরল। এমনকি রামদীনকেও ডেকে ডেকে বাড়ির খোঁজখবর নেয়। সে কোনফাঁকে বেরিয়ে গিয়ে এক বড় কফিমাগ ভর্তি করে কফি করে এনেছে। বহুদিন রয়েছে বাংলোয়। সাহেবদের নাড়ি বোঝে। সুরেশ কফিটা পেয়ে রম্ভার পাশে বিছানায় বসে আরাম করে চুমুক দেয়। অনেকটা রিল্যাক্সড লাগছে। যেন তার শরীর এই কফিটারই অপেক্ষায় ছিল। রামদীন সেলাম ঠুকে চলে যাচ্ছিল। সুরেশ তাকে দাঁড় করায়।
কফি হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা রামদীন, আপ বোলিয়ে তো ক্যায়সে ম্যাডামকো মন্দির মে লে যায়া যায়? মুঝে দার্জিলিং যানা হ্যায় …”
“সাহাব, আপ শোচিয়ে মত। কিসিকো দে দিজিয়ে সাথমে। ম্যায় খুদ লে যাউঙ্গা।”
“আপ যায়েঙ্গে? লেকিন আপকা ভি তো তবিয়ত ঠিক নেহি …”
“কুছ নেহি হোগা সাহাব। ম্যাডাম মেরা লেড়কি য্যয়সি …”
সুরেশ কিছুটা চিন্তামুক্ত হয়। রামদীন চলে গেছে। কফিটা শেষ করে রম্ভার পাশে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। এখন আর চোখে ঘুম নেই। রাত প্রায় শেষ হয়ে এল। শুধু শরীরটা ক্লান্তিতে ভেঙ্গে আসছে। ঘন্টা তিনেক বিশ্রাম না নিয়ে নিলে কাল উঠতেই পারবে না। রম্ভাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে চোখ বোজে সুরেশ।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে রম্ভা বলে ওঠে, “বহত ডর লাগতা হ্যায় মুঝে। ম্যায় কভি ক্ষেত মে না যাউঙ্গি। ও লোগ সব আচ্ছা নেহি হ্যায়, সব ঘুরতা হ্যায় মুঝে …”
সুরেশের ক্লান্তি কেটে যায় মুহূর্তে। এসব কী বলছে রম্ভা? দু’হাত দিয়ে ঠেলতে থাকে সে রম্ভাকে। নিজের দিকে ফেরানোর চেষ্টা করে।
“রম্ভা, রম্ভা কী বলছো এসব … আমি তোমার হাবি …দ্যাখো …এই যে আমি … এসো আমার আরো কাছে এসো …”
এতো ডাকাডাকিতে একবার চোখ মেলে তাকায় রম্ভা। তার চোখে প্রথমে ঘোর ছিল। যেন কোন দূরের পর্দায় ঢাকা ছিল তার দৃষ্টি। ধীরে ধীরে সেই চোখের আলোতে পরিচয়ের ছোঁয়া লাগে। বুকের কাছে সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকে দেখে তাকে আঁকড়ে ধরে রম্ভা। এই জড়িয়ে ধরার ভঙ্গি সুরেশের চেনা। এই ছোঁয়া তার অতি আপন। কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে সে রম্ভাকে টেনে নেয় বুকের মাঝখানে। এমনভাবে ধরে রাখে যেখান থেকে দেখা যায় না চোখের নিচের কোন দাগ বা কোন পুরনো সোনার আংটি।
৮
সুরেশ একফাঁকে রিষ্টওয়াচে চোখ রাখে। বেলা বারোটা বাজতে আর সাত মিনিট বাকি। সিপি সাহেব ওভাল শেপের টেবিলের সেন্টারে রয়েছেন। তাদের সমস্ত অফিসারদের বলে দিচ্ছেন কিভাবে কাজ করলে এই পার্বত্য অঞ্চলে সমস্যাগুলো সঠিকভাবে মোকাবিলা করা যাবে। মানুষ এখানে সাধারণতঃ শান্ত উদার। প্রকৃতির মতোই সহনশীল তাদের স্বভাব। কিন্তু একবার যদি কোনভাবে তাদের আঁতে ঘা লাগে বা তারা কোন বিষয়ে রেগে যায় তাহলে মুহূর্তে দাবানলের মত জ্বলে উঠতে সময় লাগে না। সেই আগুন ছড়িয়ে যায় দূর দূর গ্রামে, শহরে। কিভাবে কাজ করলে এঁদের মনে বন্ধুর মত পৌঁছোনো যাবে, এদের সহমর্মিতা সংগ্রহ করা যাবে সেটাই একটা বড় শিক্ষা। সিপি সাহেব বারবার সবাইকে বলে দিচ্ছেন কোন কোন পরিস্থিতিতে কোনরকমভাবে এগিয়ে যেতে হবে।
সাব ডিভিশনের সর্বোচ্চ পদাধিকারীর জন্য এই লেসনগুলো খুবই জরুরী। অনেকে নোটস ও নিচ্ছে। কিন্তু সুরেশের মনে ছটফটানি তাকে একাগ্র হতে দিচ্ছে না শুরু থেকেই। অনলকে আজ সঙ্গে আনেনি সে। সঙ্গে অন্যান্য গার্ড কনস্টেবলদের একটা ফোর্স রয়েছে। অনল রামদীন আর রম্ভাকে নিয়ে ভাংরিদেবীর মন্দিরে যাবে। সেখান থেকে মিনিটে মিনিটে সব খবর দেবে সুরেশকে। এমনটাই অর্ডার করেছে অনলকে। ছেলেটা যথেষ্ট ইনটেলিজেন্ট। ওর ওপর ভরসা করা যায়। সুরেশ প্রথমটা বেশ হাল্কা মনেই ছিল।
রামদীনের কথাগুলো দিনের আলোয় যতবার চিন্তা করেছে তাতে অসংলগ্নতাই ধরা পড়েছে। তাছাড়া কাল শোওয়ার পর থেকে রম্ভার মধ্যে আর কোন অ্যাবনর্মাল কিছু ব্যবহারও দেখা যায়নি। অতএব সুরেশ ভাল মনেই আজ চলে এসেছে দার্জিলিং। ওরাও রওনা দিয়েছে মন্দিরের দিকে বেলা দশটা নাগাদ। প্রতি মুহূর্তের খবর সাপ্লাই করার জন্য তো অনল আছেই।
রম্ভা মন্দির যাওয়া হচ্ছে শুনে প্রথমে বেশ খুশী হয়েছিল। নতুন জায়গা, যেকোন বেড়ানোতেই তার আনন্দ। সুরেশের চাকরির জন্য তাকে যে সবসময় পাওয়া যাবেনা এটাও সে জানে।
“তুমি কাজে যাও, আমি রামদীনের সঙ্গেই মন্দির দর্শন করে পূজা দিয়ে আসব। আর যদি ছবি তোলার মত ভাল কিছু ল্যান্ডস্কেপ পাই তো আউটলাইনটাও ওখানে বসেই করে আসব।” খুশি মনেই জানিয়েছিল রম্ভা। ব্রেকফাষ্টের টেবিলে বসে হেসে হেসে জানিয়েছিল তার প্ল্যান।
“ল্যান্ডস্কেপ তো পাবেই। পাহাড়ের প্রতিটা কোণে কোণে শুধু ন্যাচারাল বিউটি।” সুরেশ স্যান্ডুইচে কামড় দিয়ে বলেছিল। তারপর তার খেয়াল হল রম্ভা স্যন্ডুইচ খাচ্ছে না। তার সামনে একগ্লাস দুধ শুধু।
“কী হল রামদীন, ম্যাডামজি কো অউর কুছ কিউ নেহি দিয়া আপনে? ভুখ লাগ যায়েগা …”
রামদীন জানিয়েছিল ম্যাডাম নিজেই আর কিছু খাবেনা বলেছে। মন্দিরে যাওয়ার আগে সে কোন ভারি খাবার খেতে চায়নি।
“তো ঠিক হ্যায়, থোড়া কুছ প্যাক করকে লে যাইয়ে। যব ভুখ লাগেগি তো কাম আয়েগা।” সুরেশ রম্ভাকে একবার জড়িয়ে ধরে চট করে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে উঠে পড়েছিল।
তারপর দার্জিলিং আসার আগেই খবর পেয়েছে ওদের রওনা হওয়ার কথা। কিছুক্ষণ পরে মন্দিরে পৌঁছোনোর খবরটাও দিয়েছে অনল। সে মেসেজ করে যাচ্ছে মোবাইলে। এমনটাই বলা আছে। যখন সুরেশরা মিটিংয়ে ঢুকছে তখন অনলের মেসেজ এলো। রম্ভা মন্দিরে ঢুকতে চাইছে না। হাসিখুশি ছিল। এদিক ওদিক ছবি তুলছিল গাড়িতে বসেই। যেইমাত্র মন্দিরের শিখা দেখা গেল, রম্ভা গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। তারপর সেই যে গাড়ির জানলায় মাথা ঠেকিয়ে বসেছে, আর নামতেই চাইছে না। সুরেশ ভেবেছিল হয়তো এতটা জার্নিতে শরীরটা খারাপ করেছে রম্ভার। কিছু ওষুধ রাখা থাকে বাড়িতে। বমি, মাথাব্যাথা এইসব। অনলকে বলে দিয়েছিল সঙ্গে নিতে।
“মে বি শি ইজ টায়ার্ড। এক ভমিটিং কা গোলি খিলা দো। শি কানট টলারেট মাচ ট্রাভেল, দ্যাট ট্যু অন দ্য হিলস।” অনলকে ডিরেকশন দিয়ে সুরেশের হাতে আর সময় ছিল না। সে মিটিংয়ে বসে গিয়েছে।
মনটা খুঁতখুঁত করতে শুরূ করেছিল সেই থেকেই। এরপর অনল খবর দিয়েছে যে পূজা শুরু হতে কিছু দেরি আছে। বেলা বারোটায় পুজারী আসবেন।
সুরেশ মিটিংয়ের মধ্যেই বারবার ঘড়ি দেখছে। সামনের ম্যাপে সিপি সাহেব স্পেশ্যাল কিছু স্পট দেখাচ্ছেন। যে জায়গাগুলো বেশি খতরনাক। যেখান দিয়ে ঘটতে পারে বিদেশী অনুপ্রবেশ, স্মাগলিং, টেররিজম। অত্যন্ত ইম্পর্ট্যান্ট এই লেকচার অ্যান্ড সেশন। কিন্তু সুরেশের আধখানা মন এখানে নেই। কারণ এইমাত্র অনলের আরেকটা মেসেজ এসেছে। রম্ভা অনেকক্ষন গাড়ির জানলায় মাথা ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে থাকার পর হঠাৎ দরজা খুলে মন্দিরের পেছনদিকের জঙ্গলে ঢুকে গেছে। হয়তো সে নতুন জায়গা দেখে বেড়াতেই গিয়েছে। কিন্তু যতক্ষণ না তাকে আবার দেখতে পাচ্ছে অনল, সুরেশ মন স্থির করে বসতেই পারছে না।
একটা ভুল হয়ে গিয়েছে তার। রামদীনকে বলা উচিত ছিল গাড়ির সামনেই থাকা, রম্ভাকে চোখে চোখে রাখা। তাহলে রম্ভার সঙ্গে সেও জঙ্গলে যেতে পারত। এত চিন্তার কিছু ছিল না। কিন্তু রামদীন পূজার জোগাড়ে ব্যস্ত ছিল মন্দিরের ভেতরে। অনল ছোট ছোট মেসেজে এগুলো জানিয়েছে। আর যত এসব জানতে পারছে, সুরেশ ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠছে। কাল রামদীন যে কথাটা বলল সেটাই বারবার মনে পড়ছে। মন্দির লে যানা হোগা, নেহি তো অনর্থ হো যায়েগা। ক্যায়সা অনর্থ? কিউ হোগা অনর্থ? সুরেশ নিজের মনেই প্রশ্ন করে।
“কী ব্যাপার মিষ্টার সুরেশ? আর ইউ ফিলিং আনওয়েল?” সিপি সুজিত বড়ুয়া লেকচার থামিয়ে এবার সুরেশকেই প্রশ্ন করে। লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় সুরেশ। নিজের ওপরেই রাগ হচ্ছে তার। এতজনের মধ্যে থেকে সিপি সাহেব তার দিকে স্পেশ্যাল নজর দিয়েছেন এবং বুঝেও গেছেন যে সে ঠিক নেই। কী বলা যাবে উত্তরে ভেবে পায়না সে।
“ওকে, আই থিঙ্ক উই নিড সাম ব্রেক, মে বী টি ব্রেক, কফি ব্রেক! আপ লোগ বাতাইয়ে? ফিফটিন মিনিটস?”
সবাই খুশি। ইয়েস স্যর বলে গুঞ্জন ওঠে। একটানা এত সিরিয়াস আলোচনা শুনতে অনেকেরই মন ক্লান্ত হয়ে উঠেছে।
সিপি সাহেব হেসে উঠে চলে যান অ্যান্টিরুমে। সুরেশ ফোন হাতে অনলকে ডায়াল করতেই যাচ্ছিল। কিন্তু ভেতর থেকে ডাক আসে তার। সিপি সাহেব ডেকেছেন।
এতগুলো অফিসারের মধ্যে তাকেই সাহেবের ডাকতে ইচ্ছে করল! মাত্র একমাসও হয়নি সে জয়েন করেছে। কাজের কথা এখনো জানাই হলনা ভাল করে। কী বলবেন সাহেব! ভাবতে ভাবতে চট করে ভেতরে এসে দাঁড়ায় সুরেশ।
বড়ুয়া সাহেবের রিটায়ারমেন্টের আর দেরি নেই। অনেকটাই বড় বয়সে। বেশ একটা অভিভাবক সুলভ ভাব আছে। হেসে দু’হাত বাড়িয়ে দেন সুরেশের দিকে। এত উষ্ণ অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুত ছিল না সে।
“কী হয়েছে সুরেশ? প্রথম থেকে দেখছি তুমি কিছুটা আনলাইকলি জেসচারে আছ। আমাদের তো অবজার্ভেশানটাই সব। তুমি নিশ্চয়ই বলবে না, নো স্যর কিছু হয়নি। আমি জানি কিছু হয়েছে। যদি অসুবিধা না থাকে, ইউ মে ডিসক্লোজ টু মি।”
সুরেশ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। একদম ঠিক ধরেছেন সাহেব। কিন্তু কী বলবে সে? কতটুকু বলবে? যা বলবে তা কী করেই বা বলবে? সে নিজেই তো বুঝতে পারছে না কিছু। কোথা থেকে শুরু করবে?”
“টেক ইয়োর সিট প্লিজ। তুমি আমাকে রিলাই করতে পার। আমার মনে হয়, অফিস রিলেটেড কিছু নয়, ইউ আর ওরিড অ্যাবাউট সাম পার্সোনাল প্রবলেম, রাইট ডু ইউ নিড লিভ?”
সিপি সাহেবের আন্তরিক কথাগুলো সুরেশের মন ছুঁয়ে যায়। সে ধীরে ধীরে খুবই কুন্ঠিত স্বরে যতটা সংক্ষেপে পারা যায় ব্যাপারটা বলে। সিপি সাহেব কিন্তু ঘটনাটা একটুও হাল্কাভাবে নিলেন না। বরং সুরেশ যা ভেবেছিল তার চেয়ে অনেক সিরিয়াসভাবেই পুরোটা শুনলেন। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন।
“আই ক্যান ফিল ইয়োর টেনশন। দেয়ার আর সো মেনি থিংস ইন ওয়ার্ল্ড বিয়ন্ড আওয়ার নলেজ। বিশেষ করে এই যে চোখের নিচের দাগটার কথা, আংটিটার কথা তুমি বলছো এগুলোকে আমার অত্যন্ত অস্বাভাবিক বলেই মনে হচ্ছে কিন্তু আমি উড়িয়েও দিতে পারছি না। সুপারন্যাচারাল সামথিং মে বী বাট উই হ্যাভ নো প্রুফ।”
সুরেশ চুপ করেছিল। সিপি সাহেব নিজের মত বলে চলেছেন। এখানে শোনা ছাড়া তার আর কী করার আছে। উনি যে ওর কথাগুলো হেসে উড়িয়ে দেননি বা রেগে যাননি এটাই অনেক বড় ব্যাপার। কিন্তু অনেকক্ষণ অনলের কোন মেসেজ আসেনি। রম্ভাকে ওরা পেল কিনা সেটা জানার জন্যই তার মন ছটফট করে।
ওর অস্থির ভাব সিপি সাহেবের চোখ এড়ায় না।
“তুমি বরং আরেকবার সিকিওরিটিকে ফোন করে নাও। ব্যাপারটা খুব ঠিক লাগছে না আমার।”
সুরেশ রিং করে অনলকে। ফোন বেজে যায়। একবার দুবার তিনবার। অনল ফোন ধরছে না। কী ব্যাপারটা হল? অনল তো কখনও এমন করে না! সাহেবের জন্য চব্বিশ ঘন্টা তার ফোন রেডি। সেই ছেলে এতক্ষণ ধরে ফোন ধরছে না! সুরেশের মুখ শুকিয়ে গেছে। সিপি সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন।
“সুরেশ, বেটার ইউ লিভ নাও। মনে হচ্ছে ইউ নিড টু গো …”
“স্যর …আমি …আমি …স্যর কিছুই বুঝতে পারছি না …”
“আচ্ছা, তুমি প্যানিক কোরো না। তোমার ওই গার্ডটি …কী যেন নাম বলছিলে? রামদীন না কী যেন? ওনাকে একবার দেখা যায় না?”
রামদীনকে যে ফোন করা যায় এটা সুরেশের মাথাতেই আসেনি। সে তড়িঘড়ি রিং করে রামদীনকে। একবার, দুবার …। রামদীন ধরেছে ফোনটা।
চাপা ফিসফিসে গলায় কথা বলে সে, “সালাম সাহাব। পুজা চল রাহি হ্যায়। ইসি লিয়ে …”
“ইয়ে বাতাও ম্যাডাম ক্যায়সি হ্যায় …অনল কো রিং করনে কে লিয়ে কহো, আভভি …”
রামদীন একটু সময় চুপ করে থেকে বলে, “সাহাবজী, ম্যাডাম জঙ্গল মে ফির সেন্সলেস হো গয়ি থি, য়হা সে অনল স্যরজী উনকো উঠাকে লে আয়া। পুজারি জী উনকো শুলা দিয়া। আভভি পুজা চল রাহি হ্যায়।”
এত কিছু হয়ে গেছে! সুরেশ স্তম্ভিতের মত দাঁড়িয়ে থাকে।
“কী হল? সুরেশ? স্পিক আপ …” সিপি সাহেব জিজ্ঞেস করেন। তিনিও বেশ চিন্তিত তা বোঝাই যাচ্ছে। সুরেশের কাছে সবটা শুনে তিনিও যে বেশ টেনশন করছেন তা বোঝাই যায়। একজন সুস্থ সবল মহিলা কেন বারবার অজ্ঞান হয়ে যাবে এই প্রশ্নটা তাকে চিন্তায় ফেলেছে।
সুরেশ স্যালুট মেরে বেরিয়ে যাচ্ছিল। পেছন থেকে ডাকেন সিপি সাহেব,
“ওয়েট, আমিও আসছি। তুমি এখানে নতুন। জায়গাটাই চেনো না এখনো ভাল করে।”
সুরেশ অনেক ভরসা পায় সাহেবের কথায়। উনি ভেতরে গিয়ে কাউকে দায়িত্ব দিয়ে এলেন বোধহয়। সুরেশ কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করে। ভেতরে ভেতরে সে অত্যন্ত লোনলি ফিল করছিল।
সাহেবদের দুখানা গাড়ি আরো দু’খানা ফোর্সভর্তিগাড়ি পাহাড়ি রাস্তায় যথাসম্ভব স্পিড নিয়ে ছুটে চলে কালিম্পং-এর দিকে।
৯
নিচে থেকে ওপরে তাকালে মন্দিরের চূড়ো ছাড়া কিছু দেখা যায় না। চারপাশটা গহন জঙ্গলে ঘেরা। নিচে রাস্তা থেকে পাহাড়ের ধাপে ধাপে পাথর ফেলে বানানো হয়েছে সিঁড়ি। সেও কতকাল আগের কথা! এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগে এই পাথরগুলোর ধার ক্ষয়ে এসেছে, জায়গায় জায়গায় নড়বড় করছে। খুব সাবধানে একটা একটা করে সিঁড়ি উঠতে হয়। এই রাস্তা গিয়ে শেষ হয়েছে একপাথরের ছোট্ট মন্দিরটিতে, যার পেছন থেকেই ঘন গাছের দেওয়াল শুরু হয়েছে। সেই দেওয়াল শুধু মাত্র পেছনদিকেই না, ডাইনে বাঁয়ে সবদিক দিয়ে ঘিরে ফেলেছে জায়গাটা।
সুরেশ উঠছিল সিপি সাহেবের পেছন পেছন। ওদের সামনে এবং পেছনে বেশ বড়ো একটা বাহিনী। সুরেশের কেমন অদ্ভুত লাগছে। অনল ফোনে যা বলল, তাতে এখানে সবটাই কেমন অবিশ্বাস্য গল্পের মত ঘটনা ঘটেছে। সুপার ন্যাচারাল বা অলৌকিক বলে কী সত্যি কিছু আছে? সেসব তো গল্পে পড়া যায়। তাই বলে সুরেশের ওয়াইফ, যাকে সে প্রাণের চেয়ে ভালবাসে তাকে নিয়ে সেই লৌকিক বা অলৌকিক যাই হোক না কেন সেই অজানা ক্ষমতার এ কেমন খেলা! সিপি সাহেব ও সবটা শুনে কেমন থম মেরে আছেন সেই থেকে। সুরেশের মাঝেমাঝেই মনে হচ্ছে এর চেয়ে যদি রম্ভা কোন খারাপ লোক বা ক্রিমিনালের পাল্লায় পড়ত তাহলেও তাকে সেখান থেকে বের করে আনার জন্য জান লড়িয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু গতজন্মের কোন এক না দেখা শক্তির সঙ্গে কী করে সুরেশ লড়াই করবে!
রম্ভা জঙ্গলের অনেক গভীরে একটা গাছের তলায় পড়ে ছিল অজ্ঞান হয়ে। অনল তাকে খুঁজতে খুঁজতে দেখতে পায়। তার তখন এমন অবস্থা, কাউকে যে সাহায্যের জন্য ডাকবে তারও কোন উপায় ছিল না। তাহলে রম্ভাকে আবার একা রেখেই ফিরতে হবে মন্দিরের সামনে। অনল একাই রম্ভাকে কাঁধে তুলে নিতে চেষ্টা করে। কিন্তু মাত্র পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি ছাপ্পান্ন কেজি রম্ভার শরীর সে মাটি থেকে তুলতেই পারেনি, এত ভারি ছিল অজ্ঞান রম্ভা।
অনল যখন কী করবে ভেবে না পেয়ে দিশাহারা, ঠিক সেই সময় সে দেখতে পায় উঁচু গলায় মন্ত্র পড়তে পড়তে মন্দিরের পুরোহিত এগিয়ে আসছেন। সঙ্গে রামদীন। ঠাকুরমশাই মন্ত্রপূতঃ জল রম্ভার শরীরে ছিটিয়ে দিতে ঘটে গেল সেই অসম্ভব কান্ড। একটা লাল ঘাগরা চোলি পরা হাল্কা কোন বায়বীয় অস্তিত্ব যেন রম্ভার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। সেই চেহারাটা কোন মহিলার, পুরনো দিনের সম্ভ্রান্ত পরিবারের বধূর মত তার সাজপোষাক, লম্বা চুলের বিনুনী, মোটা মোটা সোনার গয়না সারা শরীরে। চোখের পলক ফেলতে যেটুকু সময় লাগে, রামদীন আর অনল দেখতে পেয়েছে এই দৃশ্য। পুরোহিত ঠাকুর তখনও মন্ত্র পড়ে যাচ্ছেন। রম্ভার চারপাশে ছড়িয়ে যাচ্ছেন মন্ত্রপূত জল। চারপাশের গাছপালা, মাটি, আকাশ, পায়ে চলা রাস্তা, কোন জায়গাটাই তিনি বাদ দেননি।
স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল অনল আর রামদীন। তারা তাকিয়েছিল পুরোহিতের দিকে অনেক জিজ্ঞাসা নিয়ে। তারপর কানে এল রম্ভা ম্যাডামের অস্ফূট গলার আওয়াজ। “ম্যায় য়হা কিউ? ক্যায়সে? ক্যা হুয়া মেরা?
জ্ঞান ফিরে এসেছিল রম্ভার। কিন্তু তা কেবল কিছু সেকেন্ডের জন্য। বারেবারেই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল সে। পুরোহিত মাটিতে বসে ম্যাডামের মাথায় হাত দিয়ে চোখ বুজে আরো কিছুক্ষণ মন্ত্র পড়েছিলেন। তারপর পুরোহিত মশাইয়ের নির্দেশে অনল রম্ভাকে মন্দির অবধি নিয়ে আসে। এবার পুরোহিতের নির্দেশে রামদীন আর অনল দুজনে তাকে এনে ভেতরে ভাংরি দেবীর মূর্তির পায়ের কাছে শুইয়ে দিয়েছিল। এখন আর ততটা ভারি ছিল না রম্ভার শরীর।
পুরোহিত হাত নেড়ে আশ্বস্ত করেছেন ওদের, “ডরো মাত বেটা। মা কী পাশ আ গয়ে, অব মা হি সামহালেঙ্গে। উনকি পতিদেবকো খবর করো। জনম জনম কী বাত হ্যায় … যিনকো আপলোগোনে ম্যহসুশ কিয়া ও ইনহি কী দুসরি শরীর থা। ধরতিসে চলি গয়ি পর উনকো ফির সে বুলায়া গয়া। ও আয়েগি নেহি তো ক্যা করেঙ্গী? পর আজ কে বাদ ও কভি নেহি আয়েঙ্গী। কিঁউকে কোই উনকো বুলানে কী লিয়ে জিন্দা নেহী রহেগা। ভাংরি মা কী ইচ্ছা হ্যায় ইয়ে। ইসি ম্যাডাম কো কুছ নেহি হোগা …”
পুরোহিত ঠাকুর অনেক কথা বলে গিয়েছিলেন নিজের মনে আর মায়ের পায়ে নিবেদন করছিলেন মুঠো মুঠো চাল, যা নাকি পূজার উপকরণ। গ্রামের লোক রামদীনের জানা ছিল তাই সে তৈরি হয়েই গিয়েছিল। সুরেশ এত কথা জানেই না। রামদীন রম্ভার মাথায় হাত রেখে বসেছিল। অনল ছুটে গিয়ে ফোন করেছিল এস পি সাহেবকে। তখন মাঝরাস্তায় তারা। সবটা শুনে পাথর হতে বাকি আছে শুধু।
এখন মন্দিরের সামনে চলে এসেছে। কিন্তু অজানা এক ভয়ে যেন সুরেশের পা উঠছে না। তার রম্ভা, তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার মধ্যে অন্য কোন আত্মা! এও কী সম্ভব! তাহলে সেদিন রাত্রে লাল ঘাগড়া চোলিতে সে যাকে দেখেছিল সেই এসে রম্ভার শরীরের দখল নিয়েছিল! সুরেশ ভুল দেখেনি? তাহলে তারই চোখের নীচের কালো দাগ, তারই আঙ্গুলের আঙ্গটি, তারই সুগন্ধি জর্দাপান খাওয়ার অভ্যাস, সব একে একে রম্ভার শরীরের দখল নিচ্ছিল! এও কী সম্ভব! আত্মা কী এতই শক্তিশালী যে বহুবছর পরেও সে আবার এসে নিজের বিগত চেহারা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে পারে? সুরেশের মাথার মধ্যে অজস্র প্রশ্ন যেন সুঁচ ফোটাতে থাকে। এত প্রশ্নের কোন উত্তরই তার কাছে নেই। এমন একটা অদ্ভুত মানসিক অবস্থায় সে মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে যেখানে বিজ্ঞান হার মেনে যায়।
“ইউ শ্যুড বী নর্মাল নাও, সুরেশ। আই ক্যান ফিল ইয়োর ডিলেমা, বাট ইটস ইয়োর লাইফ। শি ইজ ইয়োর ওয়াইফ, নট এনিবডি এলস হ্যাজ এনি রাইট টু হার্ম হার। প্রসিড, গো ইনসাইড, কল হার, টাচ হার …” সিপি সাহেব সুরেশের কানের কাছে বলে যান।
নিজেকে সামলে নিয়ে জুতো খুলে, চামড়ার বেল্ট পার্স ইত্যাদি একজন কনস্টেবলের হাতে দিয়ে সুরেশ ভেতরে ঢোকে। পুরোহিত ঠাকুর যেন ওরই অপেক্ষায় ছিলেন হেসে রম্ভাকে দেখিয়ে দেন, ইঙ্গিতে রম্ভার মাথাটা কোলে নিয়ে বসতে বলেন। তাই করে সুরেশ। পুরোহিত ঠাকুর শেষ চালের মুঠিটি মায়ের পায়ে ছুঁড়ে দিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রনাম করেন। তখনও অবধি কিছু বলে যাচ্ছিলেন তিনি। বহু চেষ্টা করেও সুরেশ বুঝতে পারেনা ঠিক কী বলে চলেছেন তিনি। সে শুধু রম্ভার বোজা চোখ দুটোয় পরম মমতায় আঙুল বুলিয়ে দিচ্ছিল আর সারা মনপ্রাণ দিয়ে একটা কথাই বলে যাচ্ছিল, “তুমি আমার। তুমি আমার ওয়াইফ রম্ভা। তুমি আর কেউ নও। আর কেউ তোমাকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যেতে পারবে না।”
এতক্ষণে একজন দুজন করতে করতে পাহাড়ের তিনখানা সাবডিভিশনেই এই ঘটনার কথা কিছুটা প্রচার হয়ে গিয়েছে। সিপি সাহেব আছেন তাই সঙ্গের ফোর্স কিছুটা দূরত্ব রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তাদের মধ্যেও উত্তেজনা তুঙ্গে। তারা প্রায় কেউই নতুন এস পি সাহেবের স্ত্রীকে দেখেনি। সবারই ইচ্ছা একবার তাকে দেখার। কোন একজনের পকেটে ফোন বেজে ওঠে। সে সবার নজর এড়িয়ে একটু দূরে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করে। কানে লাগিয়েই চমকে ওঠে।
“ক্যা? কব?”
অনলের চোখে পড়েছে ব্যাপারটা। সে তাড়াতাড়ি এসে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে? রামলাল?”
“স্যর … টাউন মে বম্বিং …”
রামলাল কালিম্পং থানারই কনস্টেবল। তাই থানা থেকে তারই র্যাঙ্কের কেউ তাকে ফোন করে খবরটা জানিয়েছে। অনল ফোনটা নিয়ে নেয়। কিছু শুনে তার মুখটাও গম্ভীর হয়ে যায়। নিরীহ ভাল লোকটাকে কে এমন করে মারল? তাও আবার ঐ পুরনো বাড়ির ভেতরে, যেখানে ও ছাড়া কেউ থাকেনা! অনল ভাবছিল এই খবরটা এখন এস পি সাহেবকে দেওয়া ঠিক হবে কিনা। সাহেব ম্যাডামকে নিয়ে এমনিতেই প্রচন্ড চিন্তায় আছেন।
মন্দিরের ভেতরে চোখ খুলে তাকিয়েছে রম্ভা। নিজেকে সুরেশের কোলে দেখে সে চরম বিস্মিত শুধু নয়, তার মনের আনন্দটা চোখ দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে। এতক্ষণের বুজে থাকা চোখদুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে। তারপরেই দুর্বল গলায় বলে, “আমার কী কিছু হয়েছিল? তাই বুঝি এরা তোমাকে ডেকে এনেছে? সরি …ভেরি সরি… তোমার মিটিং ছেড়ে এলে কেন?” কথা বলতে বলতে উঠে বসতে যায় রম্ভা।
সুরেশ জড়িয়ে থাকে তাকে, “ইউ নিড নট বী সরি। আমার আরো আগেই আসা উচিত ছিল। কাম …, লেটস গো”
পুরোহিত ঠাকুর কুঁচকে যাওয়া মুখে একগাল হাসেন “অব মরতে দম তক ইয়ে আপহি কী বনি রহেগী। সিরফ আপহি কী”
সুরেশ পুরোহিত ঠাকুরের হাত দুখানা জড়িয়ে ধরে মাথায় ঠেকায়। রম্ভা কিছুই বুঝতে না পেরে অবাক চোখে তাকায় । সুরেশের এত ভক্তি ও কখনো দেখেনি আগে। ভাল লাগছে ভেবে যে তার ভালবাসার মানুষটা শুধুই একটা ওয়ার্কোহলিক মেশিন নয়। তারমধ্যে রয়েছে আবেগ, শ্রদ্ধা, ভালবাসা, ভক্তি।
সুরেশের নিশ্চিন্ত মুখ দেখে এতক্ষণে সিপি সাহেবের মুখেও হাসি ফোটে। তিনি সিঁড়িতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করেন। তারপর গার্ড ডেকে নিজের ব্যাগটা আনিয়ে তার থেকে বের করেন একটা চকোলেট বার। এগিয়ে দেন রম্ভার দিকে।
“আপাততঃ এটাই থাক। সুরেশ আমাদের ইনভাইট করলে ভাল গিফট দেব।”
রম্ভা লজ্জা পেয়ে হাসে।
মনটা ভাল লাগছে সিপি বড়ুয়ার। এই চাকরি করতে এসে আবেগ ভালবাসা সব উর্দির নিচে চেপে রাখতে হয়। কিন্তু এই নতুন অফিসারটিকে দেখে কেবলই নিজের ভাইয়ের কথা মনে পড়ছিল । সব কাজ ফেলে রেখে তাই তার বিপদে ছুটে না এসে পারেননি। হয়তো মিটিং অর্ধেক রেখে চলে আসার জন্য ওপর থেকে কোন অর্ডার পেতে হতে পারে। কিন্তু সুরেশকে বিপদ মুক্ত দেখে যে তৃপ্তিটা হল তার কাছে কোন কিছুই লাগে না।
“ওকে, বাই। ভাল থেকো তোমরা। সুরেশ, রম্ভাকে দেখে রেখো। একটু রেষ্ট দরকার কিছু দিন। “সিপি সাহেবের গাড়ি ছেড়ে দেয়। একে একে সবগুলো গাড়ি রওনা হয়। রামদীন উঠতে যাচ্ছিল অন্য গাড়িতে। সুরেশ তাকে ডেকে নিয়ে নিজের গাড়ির ব্যাক সিটে বসায়। সামনে অনল।
কিছুক্ষণ পরে অনল ঠিক করে এবার সাহেবকে খবরটা বলা দরকার।
সে নিজের মোবাইলে আসা ছবিগুলো সাহেবকে দেখাতে চেয়ে পারমিশন চায়,
“স্যর, কয়েকটা ছবি …”
“কী ছবি? কিসের?”
“স্যর, টাউনে একটা বাজে ঘটনা ঘটে গেছে। একটা ডেথ…, পসিবলি বম্ব ব্লাষ্ট … সেই ছবিগুলো…”
“হোয়াট? কখন? দেখি …” সুরেশ মোবাইলটা নিয়ে চোখের সামনে ধরে। রম্ভা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল। সেও ফিরে তাকায়।
একটা পুরোনো বাড়ির সিঁড়ির কাছে রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে একটা লোক । পাশের দেওয়ালের খানিকটা অংশ ভেঙ্গে পড়েছে মেঝের ওপর।
“ওহ মাই গড! কিভাবে কখন হল এসব? আর এই লোকটাকে চেনা চেনা লাগছে … মুখটা যদিও পাশে ঘোরানো। কিন্তু ড্রেসটা … কোথায় দেখেছি ওকে …” সুরেশ ছটফট করতে থাকে। রম্ভা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে মোবাইলের ছবিগুলোর দিকে।
“কী খবর এসেছে? বম্ব ব্লাষ্ট হয়েছে? তার মানে এটা নিশ্চয়ই ক্রিমিনালদের কোন ডেন ছিল …। এই লোকটা একাই গেল নাকি আরও কেউ…”
পেছন থেকে রামদীন নিচু গলায় বলে, “নেহি সাহাব, কোই বম্ব ব্লাষ্ট নেহি, ভাংরি মাতা নে ইসিকা দেহান্ত নির্দিষ্ট কিয়ে থে। ওহ রুহ চলি গয়ি, ইসিকো ভি সাথ লে কর গয়ি। নেহি তো বারবার আনা পড়তা থা।”
“তার মানে? এই লোকটার জন্যই” সুরেশ উত্তেজিত হয়ে পেছনে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।
“হাঁ সাহাব। ব্রিজলাল হ্যায় ইয়ে। ওহি তো পিছলে জনম সে বুলা কর লাতা থা বার বার ম্যাডামজি কী…”
“বাস …, সাইলেন্স! অউর কুছ নেহি শুননা মুঝে” রম্ভার কথা চিন্তা করে, আবার তার কী এফেক্ট হয় না হয় ভেবে সুরেশ আচমকাই থামিয়ে দেয় রামদীনকে।
কিন্তু রম্ভার বোধহয় এদিকে কান নেই। সে অন্ধকার পাহাড়ে নেচে চলা জোনাকির আলো দেখছে মুগ্ধ হয়ে। এবার সুরেশের হাত চেপে ধরে বলে, “অন্ধকারে আলো জ্বলছে, কী সুন্দর …দ্যাখো …মুঝে ড্র করনি হ্যায় … পর ক্যায়সে! বহত ক্রিটিকাল ড্রয়িং হোগি।”
রম্ভা কী ব্রিজলালের কথা কিছুই খেয়াল করেনি? বোধহয় না। তাহলে সে এমন স্বাভাবিক থাকতে পারত না। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সুরেশ রম্ভার কাঁধ জড়িয়ে ধরে। তারপর আস্তে আস্তে বলে, “ইউ হ্যাভ টু ট্রাই। এগেইন আন্ড এগেইন।”
প্রথমদিনের কথা মনে পড়ছে সুরেশের। এই ব্রিজলাল লোকটা তাকে ভারি সুন্দর পান খাইয়েছিল। আবার সেইদিনই রম্ভা প্রথম মাথা ঘুরে পড়েছিল ওই চৌরাস্তার ওপর। তবে কী রম্ভাকে দেখেই ব্রিজলাল চিনে নিয়েছিল তার বহু বছর আগের চলে যাওয়া সঙ্গিনীকে! এমনটাও হয়!
সুরেশের রাগ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা হচ্ছে না। মানুষটার জন্য একটা ব্যাখ্যাতীত কষ্ট হচ্ছে। ভালবাসার মানুষকে জীবনে পেয়ে হারানো, তারপর তার পরজন্মের রুপ চিনতে পেরে কাছে আসার বিভিন্ন চেষ্টা এবং শেষ অবধি এই নিষ্ঠুরতম মৃত্যু, এই করুণতম পরিণতিই অপেক্ষা করছিল ব্রিজলালের ভাগ্যে! কে দায়ী এজন্য? সে নিজে ছাড়া আর কেউ তো দায়ী নয়!
তবু সুরেশের খাকি উর্দির ওপরে ঝরে পড়ে দু’ফোঁটা চোখের জল। যা অন্ধকারে দেখা যায় না। যার সৃষ্টি এক অত্যন্ত অলৌকিক অথচ প্রখর বাস্তব সত্যের আঘাত থেকে।
আনন্যাচারাল ডেথ-এর পরবর্তী কার্যকলাপ যা হবার তা হবে নিয়মানুযায়ী। কিন্তু সুরেশ অন্ধকার পাহাড়ি পথে ছুটে বেড়ানো জোনাকিদের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে ব্রিজলালের আত্মার শান্তিকামনা করে। এই জন্ম হোক, গত জন্ম হোক, যাই হোক, ব্রিজলালও যে তার রম্ভাকেই ভালবেসে ডেকে গিয়েছে বারবার, এমনকি নিজেকে মৃত্যুর হাতেও তুলে দিয়েছে রম্ভারই জন্য। ওই তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে আই পি এস সুরেশ তার থেকে বহু যোজন দূরের এক পানওয়ালার সঙ্গে কোন এক অদৃশ্য বন্ধন অনুভব করে। এই বন্ধনের টান হয়তো তাকে আজীবন বয়ে ফিরতে হবে, যা সে পৃথিবীর কাউকে মুখ ফুটে জানাতে পারবে না।।