জয়তী রায়
মহারানী কুন্তী, মহাভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। বলা যায় মহাভারতের যুদ্ধ হবার পিছনে তাঁর মস্তিষ্ক কাজ করেছিল সবচেয়ে বেশি। তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির স্তম্ভ ছিলেন তিনি। অসীম ক্ষুরধার বুদ্ধির অধিকারী এই নারী কুন্তী আমাদের অবাক করেন। যৌনতা, ক্ষমতা, মানসিক টানাপোড়েন নিয়ে কুন্তী , আজকের যুগেও সমান আধুনিক। লৌহ মানবী এই নারী নিজেকে কখনো মহিয়সী প্রমাণ করার চেষ্টা করেন নি। অথচ, নিত্য স্মরণীয় পঞ্চকন্যার মধ্যে তিনি একজন।
তিনটি পর্যায়ে লেখা উপন্যাস কুন্তী ও ভারতবর্ষ।
১. বিবাহ পূর্ব
২. বিবাহ পরবর্তী
৩. রাজ্য রাজনীতি
মথুরা অঞ্চল। সংঘ অধিপতি আর্যশূরের সভাগৃহে পাশা খেলা চলছে। খেলছেন রাজা আর্যশূর আর তাঁর পিসতুতো ভাই তথা প্রিয় বন্ধু, অন্য এক সংঘের অধিপতি কুন্তিভোজের সঙ্গে। বিপত্নীক এবং সন্তানহীন বলে, আর্যশূর , প্রায়শই তাঁর বন্ধুকে ডেকে ডেকে পাশা খেলে , নানাবিধ আনন্দ দেবার চেষ্টা করেন। আজকের পাশা খেলাও জমে উঠেছে। খেলার মধ্যে মধ্যে দাস দাসী এসে এসে মদ্য, ঘৃতে ভাজা পশু মাংস ছাড়াও টুকরো টুকরো খাবার পরিবেশন করেই চলেছে। দুই রাজা নিমগ্ন চোখ নিবদ্ধ ।
এই সভাগৃহের এক কোণে বসে আপন মনে খেলছিল রাজা আর্যশুরের একমাত্র কন্যা পৃথা। বছর পাঁচেকের এই বালিকা অতীব সুন্দরী। মাতা পিতার প্রথম সন্তান। পিতার কোল ছাড়া হতে চায়না। খেলতে খেলতে কৌতুহলী চোখ দিচ্ছিল পিতার দিকে। খেলা যাই চলুক, কোনো মতেই যেন তাঁর পিতা হেরে না যায়!
খেলা শেষ হবার পরে হল এক কাণ্ড। কুন্তিভোজ আর আর্য শূর __ দুই রাজা পরস্পরের কাছে বিদায় নেবার জন্য তৈরি, নানা রকম কথাবার্তা চলছে। তার মধ্যে রাজা কুন্তীভোজ অভিমান ভরে বললেন “তোমার প্রতিজ্ঞা ভুলে গেলে? বলেছিলে, প্রথম যে সন্তানটি জন্মাবে, তাকে দান করে দেবে আমাকে? আমি দত্তক নেব। সে প্রতিজ্ঞার আর বুঝি কোনো দাম নেই?”
রাজা আর্যশূর নিতান্ত লজ্জিত হয়ে মাথা চুলকে, ক্ষমা ভিক্ষা করে, নিজের মহারানী কে আদেশ দিলেন এখুনি পৃথা কে তুলে দাও রাজা ভোজের রথে। এখন থেকে ওখানেই প্রতিপালিত হবে সে।”
ছিটকে এলো মহারানী। অসহায় ক্রোধে চিৎকার করে বলে উঠল প্রথম সন্তান। তাঁকে তুমি দান করে দেবে? কোনো অধিকার নেই আমার?
তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে রাজা বললেন:
প্রথম সন্তান? কন্যা সন্তানের আবার প্রথম দ্বিতীয় কিসের? কন্যা সন্তান দানের যোগ্য। অর্থ যেমন দান করা যায় বন্ধুকে, কন্যাও তেমনি দান করা যায়।”
পৃথা নিতান্ত শিশু হলেও খুব বুদ্ধিমতি। সংবেদনশীল। কচি মনে এক বিরাট ধাক্কা লাগল তাঁর। সে একটুও কাঁদল না। ঘাড় শক্ত করে, চলে গেল অন্য এক বাড়িতে। পিছনে পড়ে রইল প্রিয় খেলনা, তাঁকে পরিচর্যা করার প্রিয় দাসী, মায়ের শরীরের গন্ধ। পৃথা নাম মুছে গেল প্রায়। কুন্তিভোজের দত্তক কন্যা কুন্তী বলে পরিচিত হল এরপর থেকে। সেদিন রাতে, অপরিচিত মহলে, একলা শয্যায় সে উচ্চরণ করল এক ভীষণ প্রতিজ্ঞা
“পুত্র নই বলে দান করা হল আমাকে। ইতিহাস একদিন বলবে, পৃথা কোনো অংশে কম ছিল না কোনো পুরুষের চাইতে।”
জন্মদাতার নাম বদলে গেল পৃথার। সে এখন রাজা কুন্তীভোজের কন্যা কুন্তী। নাম বদল করার এই নোংরা খেলা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে, নিজেকে তৈরি করতে লাগল নিঃশব্দে। বিদ্যা শিক্ষা, রাজনীতির জ্ঞান, গৃহ কর্ম, পূজা-অর্চনা, প্রজাদের সুখ সুবিধা দেখা, মাত্র চোদ্দ বছর বয়সের মধ্যেই কুন্তী রাজ্যের ভরসা হয়ে উঠল। সর্বোপরি কুন্তী কখনো উত্তেজিত হত না। তাঁর মাথা ছিল খুব ঠাণ্ডা। যে কোনো জটিল সমস্যার সমাধান সে ভেবে ভেবে ঠিক উপায় বার করে ফেলত।
শুধু গুণ না, রূপে তার তুলনা নেই। শ্বেত চন্দনের মত গায়ের রং, নাতিদীর্ঘ শরীর। টানা কালো বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। এক ঢাল কালো চুল। চিবুক কঠিন। চাপা। সেখানে একটি বড় কালো জ্বলজ্বল তিল। তবে, সে হাসে কম। স্বভাবত গম্ভীর। চোদ্দ বছরের তুলনায় তাঁর সৌন্দর্যে কিশোরীর লাবন্য চোখে পড়ে কম। বরং তার ব্যক্তিত্ব স্নেহের চাইতে সমীহ আদায় করে বেশি। দিন এমন করেই কাটত। কিন্তু, যে নারী ইতিহাস রচনা করবে বলে জন্ম নিয়েছে, তার জীবনের আকাশে ঘটনার মেঘের আনাগোনা চলতে থাকবে, এ জানা কথা।
ঠিক তাই হল। হঠাৎ করেই রাজবাড়ীর আতিথ্য গ্রহণ করতে এলেন, মহারাগী, মহাতেজী ঋষি দুর্বাসা। সঙ্গে তাঁর যত চ্যালা চামুণ্ডা। সে এক দেখবার মত দৃশ্য! রাজপ্রাসাদের সিংহ দরজার সামনে, পঞ্চাশ জন ঋষি মুনির দল। মাথায় জটা, হাতে কমন্ডুল। পরণে গেরুয়া বস্ত্র। সকলের মুখে কেমন রাগ রাগ ভাব। সবার মাঝে দুর্বাসা। তাঁর হাতে আবার এক ত্রিশূল! কপালে লাল সিঁদুর।
সেই সময়, ভারতবর্ষে, দুর্বাসা মুনির দাপট ছিল দেখার মত। যত বড় রাজাই হোক না কেন, তাঁর ভয়ে সব রাজাই দূরে থাকত। তিনি যখন ইচ্ছে, যে কোনো রাজার ঘরে অতিথি হবেন এবং রেগে গেলে অভিশাপে তাঁর রাজ্য ধ্বংস করে দেবেন। এ হেন দুর্বাসা মুনি সদলবলে চলে এলেন কুন্তীভোজের রাজ্যে।
রাজার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল! তাড়াতাড়ি কোন রকমে মুনির দলকে একটা বাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়ে, কুন্তী কে ডেকে পাঠালেন। কুন্তী এসে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। মুখ গম্ভীর। এমনিতে তাঁর পালক পিতা লোক খারাপ না। তাঁকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়েছেন। কিন্তু, তবু কোথায় যেন একটা বাধা কাজ করে। পিতা, বলতে যে আবেগ, যে আদর সেটা কিন্তু এই পালক পিতার মধ্যে দেখে না! বরং, কেমন কৌশলী মনে হয়! এই মুহূর্তে কুন্তীর যেমন মনে হচ্ছে, কিছু একটা বিপদে তাঁকে ফেলবে এই রাজা!
খুব ছোট বেলায় প্রায় জোর করে তাঁকে অন্য আশ্রয়ে যেতে হল বলে কি না জানে না , কুন্তীর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় খুব প্রখর। বিপদের গন্ধ পায় আগে থেকেই। সে সতর্ক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রাজা মিহি চিকন সুরে বলল:
“পৃথা! তুমি রাজা আর্যশুরের কন্যা। এখন আমার প্রাসাদে মহাতেজা মুনি দুর্বাসা উপস্থিত। তোমাকে তাঁর সেবা যত্নের ভার নিতে হবে। কোনো জটিলতা হলে, আমার কিছু হবে না। তোমার বংশের বদনাম হবে! ঋষির অভিশাপে সব ধ্বংস হয়ে যাবে!”
কুন্তীর কান মাথা থেকে আগুন ছুটতে লাগল।
এই ব্যাপার! সিংহের মুখে তাঁকে ছুঁড়ে দিচ্ছেন এই রাজা? এই সময় তাঁকে কুন্তী বলেও ডাকছেন না! কি অদ্ভুত এনার চরিত্র! সে একটুও ভয় পেলো না। বরং ঘৃণা হল তাঁর। মাথা উচুঁ করে দীপ্ত চোখ দুটি রাজার উপর ফেলে, চিবুক সোজা করে বলল:
“হে রাজন! আপনি আমাকে যে কাজ দেবেন, আমি করব। আমি আপনার পালিতা। আজ্ঞাবহ। চিন্তা করবেন না। আপনার কোনো অসুবিধে হবে না।”
“আমাকে পিতা সম্বোধন করতে পারো পৃথা!”
বিষ তেতো হাসি হেসে কুন্তী বলল:
“কাজের ক্ষেত্রে রাজা প্রজার সম্পর্কই সুবিধা জনক। পিতা কন্যার সম্পর্কের নরম ভাব এখানে শোভা দেবে না মহারাজ!”
রাজা কুন্তীর ভাবান্তর লক্ষ্যই করলেন না। মহা উল্লসিত হয়ে, নধর হরিণীর মত কুন্তী কে সঙ্গে করে, নিয়ে এলেন দুর্বাসা মুনির প্রকোষ্ঠে।
কুন্তীর বুক কেঁপে উঠল। তাঁর সামনে যিনি বসে আছেন, তাঁর সর্ব অঙ্গ দিয়ে যেন আগুনের হল্কা বেরুচ্ছে। লাল লাল জটা, রক্ত জমা দুই চোখ। হাত পা সরু সরু।
কর্কশ শরীরে সাদা ভস্ম, চোখ দুটি অতিশয় ধূর্ত। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে, ত্রিশূল সজোরে ঠুকে মুনিবর বললেন:
“এ তোমার কন্যা? পালিতা! মুনিবর। পালিতা কন্যা। কিন্তু খুব সেবাপরায়ণ। আপনি চিন্তা করবেন না!”
ঘর ফাটিয়ে হেসে উঠলেন ঋষি:
দুর্বাসা চিন্তা করে না মূর্খরাজা। চিন্তার কারণ হয় সে।
যদি পারে, তবে তো ভালই, না পারলে…?
যে শাস্তি হয় দেবেন ঋষিবর। অভিশাপ দেবেন এঁকে।
আপনার চরণে এঁকে উৎসর্গ করলাম। যেমন আপনার ইচ্ছে, এঁকে ব্যবহার করুন।
বলে, দুই হাত ঘষতে ঘষতে বেরিয়ে গেলেন রাজা। চিন্তা মুক্ত রোদ্দুরে ঝলমল মুখ! যাক বাবা! বন্ধু কন্যার উপর দিয়ে বিপদ উদ্ধার হলেই ভালো। বাঁচা গেল!
****
দুর্বাসা স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন সামনে বসা নত মুখী কন্যাটির দিকে। মাটির দিকে চোখ রেখে, হাঁটু মুড়ে বসে আছে। ভঙ্গিটি ভারি সুন্দর। শান্ত। পাশের কক্ষে তাঁর চ্যালা চামুণ্ডা হৈ হৈ করছে। তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন
“কল্যাণী! আমাদের ভোজনের ব্যবস্থা করো। আমরা এখন বাইরে যাব। কখন আসব ঠিক নেই। আশা করি অসুবিধে হবে না।”
মুখ নিচু করে ছিল বলে কুন্তী, তাঁর চোখ দেখেন নি দেখলে চমকে উঠতেন। সে চোখে আর ভয় নেই। পরিবর্তে খেলা করছে ভয়ানক আত্মবিশ্বাস। সামনের অটল পাহাড় বাধা চূর্ণ করতে পারে এই আত্মবিশ্বাস।
এ চোখের অধিকারী হারতে জানে না। প্রতিদ্বন্দ্বী যত কঠিন হোক না কেন, পিছন ফিরে চলে যাবার জন্যে এ কন্যার জন্ম হয় নি।
নিজ মহলে ফিরে এলো কুন্তী। ডেকে পাঠাল তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর শঙ্খচূড় কে। নিজের নামের মত হিংস্র আর চতুর এই পাহাড়ী যুবক, কুন্তীর একটা শব্দ উচ্চারণ মাত্র, সব কিছু করতে পারে। এদের একটা দল আছে। পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। ধনুক বাণ বর্শা এদের অস্ত্র। ছোট দল টিতে মহিলা পুরুষ মিলিয়ে আছে জনা দশেক। গিরগিটির মত নিঃশব্দে কাজ করে। রাজ্যের সব খবর কুন্তী পায় এদের কাছ হতে। তার হাতে তৈরি এই দল। এমন ছোট ছোট দল সে তৈরি করেছে, গত তিন বছর ধরে। রাজ্য জুড়ে এরা মিশে থাকে বাতাসের মত। বাইরে থেকে দেখলে, সাধারণ খেটে খাওয়া গ্রামবাসী মনে হবে। ভিতরে ভিতরে এদের একটা সংগঠন কাজ করে। রাজা কুন্তীভোজ তেমন জনপ্রিয় রাজা নন। রাজ্যের বহু সমস্যায় তিনি উদাসীন থাকেন। পাশা খেলা, শিকার আর পানভোজনে মত্ত থাকেন বলে সীমান্তে বিদেশী শত্রুর আক্রমণ করছে বার বার। রাজ পুরোহিত, আচার্য নরোত্তমভট্ট, রাজার উপর বিরক্ত। তিনি পণ্ডিত মানুষ। মহর্ষি ব্যাসদেবের সঙ্গে মিলে অনেক কাজ করেছেন। নরোত্তম ভট্ট, কুন্তীর শিক্ষকও বটে। শিক্ষকতার ফাঁকে ফাঁকে, রাজনীতির পাঠ দিতেন আচার্য্য। কুন্তীর তীক্ষ্ণ মেধা তাঁকে মুগ্ধ করত। দিনে দিনে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার সুবাদে, কুন্তী পরিচিত হয় তাঁর কাজের সঙ্গে।
আচার্য নেতৃত্ব দ্যান এই গুপ্ত সংগঠনের। বাইরে তিনি রাজার পুরোহিত। ভিতরে রাজ বিদ্রোহী। রাজকুমারীর মনের ভিতরের অবসাদ তাঁর চোখ এড়ায় নি। কারণ জেনেছেন অল্প অল্প করে। লক্ষ্য করেছেন মেয়ের আছে ছাইচাপা আগুন। দরকার উপযুক্ত শিক্ষা।
কুন্তী ধীরে ধীরে শিখছে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস। অস্ত্র বিদ্যা শিখছে। গোপনে চলে গেছে গভীর অরণ্যে। মিশেছে আদিবাসীদের সঙ্গে। সহজাত নেতৃত্ব তাঁর স্বভাবে। তাঁকে দেখে মুগ্ধ হয় সরল লোকগুলি। রাজকুমারী তাদের কাছে দেবীর মত।
এই আদিবাসীদের নেতা হল বছর আঠারোর শঙ্খচূড়। কালো কষ্টিপাথরে কুঁদে তোলা শরীর। ছোট ছোট চোখে অপার সারল্য। হাতে বর্শা থাকে একটা। চটপটে। ক্ষিপ্র।
কুন্তীর সব কাজে শঙ্খচূড় গোপনে হাজিরা দেয়।
*****
সন্ধ্যা সমাগত। দুর্বাসা দল বল নিয়ে বেরিয়ে গেছে। কালো ছায়ার মত কুন্তীর ঘরে ঢুকে এলো শঙ্খচূড়।
“আদেশ রাজকুমারী।”
“লোক ঢুকিয়ে দাও, ঋষিদের সঙ্গে। যেখানে যেখানে ওনারা যাচ্ছেন, সব খবর পলকের মধ্যে চাই। কি কথা বলছেন, সেটাও জানা চাই। ওনারা দেব ভাষায় কথা বলবেন। তাই সঙ্গে রেখো শিক্ষিত কিছু লোক। রণপা ব্যবহার করে, খবর জানাবে দ্রুত।”
“আপনার আজ্ঞা পালন হবে। চিন্তা করবেন না।”
কুন্তী স্মিত হাসল। খুব কম হাসে সে। আজ হাসল। কারণ তাঁর সামনে কেউ শর্ত রেখেছে। বাজি রেখেছে। এই সব সময় তাঁর হাসি পায়। সামনের পরাজিত প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখ মনে করে হাসি পায় তাঁর।
******
আর্যাবর্ত ভারতবর্ষে ঋষিরা ছিলেন প্রবল প্রতাপশালী। একথা মনে করা ভুল, যে, ওনারা তপোবন বানিয়ে, জপ ধ্যান করতেন! প্রতিটি আশ্রমে রাজ্য রাজনীতি আলোচনা হত। সক্রিয় ভূমিকা থাকত এদের। কোনো কোনো আশ্রমে অস্ত্র থাকত। জপ ধ্যান হত অবশ্যই, কারণ ও ছিল তার। সমাজ বিজ্ঞান, দর্শন শাস্ত্র, রাজনীতি__সবেতেই ঋষিরা নাক গলাতে ভালোবাসতেন। ক্ষত্রিয় রাজারা সমীহ করতেন ঋষিদের যথেষ্ট।
এর মধ্যে ঋষি দুর্বাসা আরো এক কাঠি উপরে। ওনার মন কখনো ভালো। কখনো খারাপ। মানুষকে নানা ভাবে জব্দ করতে খুব ভালোবাসেন।
যখন তখন ক্ষ্যাপার মত অভিশাপ দিয়ে বসেন! ওনার বেশ কিছু শিষ্য আছে। তাদের নিয়ে ” বম বম” করতে করতে ঘুরে বেড়ান।
ঋষিদের দলটি পাহাড়ের পাশ দিয়ে সংকীর্ণ পথ ধরে এগোচ্ছিল। গন্তব্য নদীর ধার। ওখানে বসে নানারকম আলোচনা করে, প্রাসাদে ফিরবেন।
ওনারা লক্ষ্য করলেন না, দু একটি ছায়া তাদের সঙ্গে ঘুরছে ফিরছে। নিজের মনে মত্ত ঋষির দল, নদীর দিকে এগোতে লাগল।
******
প্রায় এক বছর হতে চলল, দুর্বাসা আছেন কুন্তীর সঙ্গে। এক বছর! এত দিন ঋষি দুর্বাসা থাকেনি কারো সঙ্গে। ঋষি হলেও, তিনি মোটেও বৃদ্ধ নন।
অতি অল্প বয়সে সিদ্ধি লাভ করেন, এখন তাঁর চল্লিশ বছর। তবে কি রূপসী রাজকুমারীর মোহে বাঁধা হলেন ঋষি?
এমন প্রশ্ন দুর্বাসা কে মুখের উপর করতে কেউ সাহস পায় না, কিন্তু সকলে অবাক হচ্ছে।
অবাক নিজেও হচ্ছেন ঋষি ! এ কন্যা কোন ধাতুতে তৈরী? প্রতিদিন নতুন নতুন আদেশ করেন, খেতে বসে সব খাবার ফেলে দিয়ে একেবারে অদ্ভুত খাবারের নাম করেন, মৃদু হেসে সে সব হাজির করে কুন্তী! যা চাইছেন, যা ভাবছেন সব পাচ্ছেন হাতের কাছে! কি করে সম্ভব? এত টুকু কিশোরী ! দুর্বাসা উত্তরোত্তর অবাক! মুখে হম্বি তম্বি করছেন বটে, কিন্তু তেজ আগের চাইতে অনেক কম। বরং সুযোগ পেলে গল্প করেন রাজকন্যার সঙ্গে। খুব পরিণত বুদ্ধির, আধ্যাত্মিক জ্ঞান প্রচুর, ধীর কন্যাটির সাহচর্য মুগ্ধ করছে তাঁকে। তিনি কি ভালোবাসছেন ? কঠোর দূর্মুখ ঋষির মনে আসছে প্রেম? শিউরে উঠলেন দুর্বাসা! এ কি ভাবছেন তিনি? যে আশ্রয় দেয়,তাঁর কন্যা নিজ কন্যা সম। এমন ভাবনা অন্যায়! নাহ্। এবার যাবার সময় হলো তাঁর। চলে যেতে হবে এবার। দুর্বাসা মনস্থির করলেন। কিন্তু তার আগে কুন্তীকে দান করবেন এক মহামন্ত্র। সেই মন্ত্র, যা পৃথিবীতে কেউ কোনোদিন লাভ করবে না। করতে পারবে না। কুন্তীর সেবার উত্তরে কালজয়ী মন্ত্রটি হবে তাঁর পুরস্কার।
হাতে জল আর ফুল নিয়ে বসলেন দুর্বাসা। কুন্তী কাছে এসে বসল। সাদা বস্ত্র পরিধানে পূর্ণিমার চাঁদের মত দেখাচ্ছে তাঁকে। গম্ভীর গলায় দুর্বাসা বললেন:
তোমার সেবায় তুষ্ট আমি রাজনন্দিনী। বর দিচ্ছি তোমাকে। গ্রহণ করো।
জীবনে প্রথমবার, নিজের মন থেকে কাউকে বর দিতে চাইলেন মহামুনি দুর্বাসা। সামনে বসে আছে যে কন্যা, শুনেছেন সে পালিতা। বুঝেছেন, পালক পিতা অত্যন্ত ধূর্ত বলেই, তাঁর মত বাঘের মুখে ফেলে দিয়েছেন এই কিশোরীকে। জীবনে প্রথম বার স্বীকার করছেন, নিজের মনে হলেও, স্বীকার করছেন এই কন্যা সাধারণ নয়। এই কন্যা একদিন পৃথিবী জয় করবে !
ঠাণ্ডা গলায় কুন্তী বলল, ‘বর চাই না। কাজ করেছি। আপনি খুশি। পিতা খুশি। আমার কিছু চাই না।’
দুর্বাসা চমকে উঠলেন। নিষ্ঠুর প্রত্যাখ্যান ! ভয় নেই। আশঙ্কা নেই। নির্লিপ্ত চাউনি। এর মন বলে কিছু নেই নাকি ?
‘কুন্তী ! তুমি কি পাথর কন্যা ?’
না মহর্ষি। আমি সাধারণ। অতি সাধারণ। নিচু স্বরে বলে কুন্তী।
‘আমি এমন দেখিনি। আগে কখনো দেখিনি। বর পাবার জন্য মানুষ সব কিছু করে। আর তুমি ! যাক শোনো, মন্ত্র দিচ্ছি তোমাকে। তোমার রূপ, তোমার ব্যক্তিত্বের বিভা এমন সাংঘাতিক যাকে স্পর্শ করবে এমন যোগ্য পুরুষ নেই।’
ফিসফিস করে আপন মনে দুর্বাসা বললেন, ‘তোমাকে চাইতে পারে এমন কেউ নেই। কেউ নেই। দেব সঙ্গমের অধিকারী তুমি। এমন এক মন্ত্র দেব, যা উচ্চারণ মাত্র ইপ্সিত দেবতা আসবে, সঙ্গমের জন্য। মানুষ তোমাকে স্পর্শ করবে না। কিছুতেই না।’
ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছিল দুর্বাসা মুনির।
চোদ্দ বছরের কিশোরী, কিছু বুঝল, কিছু বুঝল না। দেবতা হল সবচেয়ে পরাক্রমী জাত। স্বর্গ মর্ত্য পাতাল তিন লোক দেবতার পরাধীন। তাদের যোগ্য সে ?
সে তীব্র স্বরে বলে উঠল, ‘আপনি আমার জীবন ইতিহাস জানেন। পরিহাস করছেন আমার সঙ্গে ?’
জোরে হেসে উঠলেন দুর্বাসা, ‘জীবন ইতিহাস ? শোনো কন্যা,তোমার ইতিহাস তুমি নিজেই রচনা করবে। বিধাতা পুরুষের ক্ষমতা নেই তোমার ভাগ্য নির্ধারণ করার। সেই সঙ্গে তুমিই রচনা করবে,ভারতবর্ষের ইতিহাস। যতদিন থাকবে ভারত, ততদিন উচ্চারিত হবে কুন্তীর নাম।’
সূর্যদেব এলেন। মন্ত্রের অসীম প্রভাব। তাঁর কাছে বার্তা পৌঁছে গেল। তিনি চলে এলেন। কানে সোনার কুণ্ডল। সোনার মত শরীরের রঙ। দীর্ঘ দেহ, বলিষ্ঠ শরীর। হাসি মুখে কুন্তীর সামনে দাঁড়ালেন।
ভোরের আলো আঁধারির ভাবটি নষ্ট হতে দিলেন না সূর্যদেব। মন্ত্র বার্তায় তিনি জেনেছেন, অতুল রূপের অধিকারিণী কন্যা, দেব সঙ্গমের অধিকারী। সঙ্গমে আর আপত্তি কিসের ? আর কন্যা যদি এমন কিশোরীসুন্দরী হয় ! কুন্তীর সামনে দাঁড়িয়ে মিটি মিটি হাসতে লাগলেন তিনি।
কুন্তী হকচকিয়ে গেল। কপাট বন্ধ। তাঁর অনুমতি বিনা কেউ বিরক্ত করবে না। তবু শুকিয়ে গেল বুক। ভয়ে কেঁপে উঠল সে। লজ্জা। তার বসন ঠিক নেই। লজ্জা । তার শরীর প্রায় অর্ধেক উন্মুক্ত। লজ্জা। সে একলা। একপুরুষ তার সামনে।
শয্যার পাশে বসে কুন্তীর ঠাণ্ডা হাতখানি ধরে, নরম সুরে ডাকলেন সূর্য
‘ভয় কিসের ? তাকাও আমার মুখের দিকে।’
বলতে বলতে তাঁর ঠোঁট নেমে এলো মসৃণ কাঁধে।
‘আহ্। সুন্দর তুমি কন্যা। দেবকন্যার চাইতেও সুন্দর।’
এমন তাড়াতাড়ি শরীর আক্রান্ত হবে, বোঝেনি কুন্তী। সারারাত ধরে শরীরের কত কল্পনা করে, এখন স্পর্শমাত্র গুটিয়ে পড়তে চাইল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। অনিচ্ছুক হাতে সূর্যের ঠোঁট ঠেলে সরিয়ে দেবার প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে চোখে জল এলো তাঁর। ভালো লাগছে না।
‘নাহ’ কাতর গলায় বলে কুন্তী।
‘না ! কিসের না ?’
সূর্য দেব অবাক হলেন, ‘না মানে কি ! তুমি ডেকেছ আমাকে। এখন… !’
কথা শেষ না করে বিরক্তিতে চোখ কুঁচকে তাকিয়েই পরক্ষণে মিষ্টি হাসলেন। পরিপক্ক যুবক তিনি। প্রেমের খেলায় অভিজ্ঞ। সামনের কিশোরীর চোখে মুখে ভয়। মন্ত্র উচ্চারণ করে ফেলে, এখন কর্তব্য ঠিক করতে পারছে না !
তিনি সজোরে আলিঙ্গন করলেন তাঁকে,
‘শোনো শোনো। কোনো চিন্তা করো না। এ এক মজার খেলা। আমি খুব সুখ দেব তোমাকে। শরীর সুখ। যা কখনো পাওনি তুমি। দেবতা হলেও তোমার কাছে এসেছি মন্ত্রের জন্য। এমন সুযোগ বার বার আসে না।’
সূর্যের আলিঙ্গনের মধ্যে ছট্ফট্ করে উঠে কুন্তী বলল,
‘ছাড়ুন আমাকে, ছাড়ুন। আমি মজা করে মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলাম। আমি কুমারী কন্যা। এসব কিছু চাই না। ক্ষমা করুন। ক্ষমা করুন। ফিরে যান। ফিরে যান। দয়া করুন।’ অনুনয়ে ভেঙে পড়ে কুন্তী। স্বভাবত সে খুব শক্ত। চট করে উতলা হয় না। বুদ্ধি তাঁর প্রখর। অথচ এখন সব গুলিয়ে যাচ্ছে !
কাকে ডাকবে সে ? নিজেই যেখানে আমন্ত্রণ করে বসে আছে ! সূর্যদেবের আঙুল শরীর স্পর্শ করলেই তাঁর বমি পাচ্ছে। সংকুচিত হচ্ছে মন। রাতশয়নের বস্ত্র ছিল খোলা মেলা। তারপরে সে ঋতুমতী। শরীর প্রায় উন্মুক্ত। সূর্যদেব চোখ সরিয়ে নিচ্ছেন, আবার অবাধ্য চোখ গিয়ে পড়ছে কোমল কিশোরীর গৌর দেহের উপর।
কুন্তীর জলভরা দুটি চোখ বিরক্তি উৎপাদন করছে সূর্যদেবের।
এ আবার কেমন কথা ! তাঁকে আমন্ত্রণ করে ডেকে বলছে কি না ‘চলে যান !’ তিনি সজোরে বললেন,
‘ওই দিকে তাকাও। খোলা বাতায়ন দিয়ে তাকাও। আকাশ দেখো। দেখো, আমার সব বন্ধুরা অপেক্ষা করছে ওখানে। মর্ত্যের কুমারী ডেকেছে আমাকে। সকলে জানে সেটা। এখন কোন মুখে ফিরব আমি ?’
কুন্তী তাকিয়ে দেখতে পেল, অনেক গুলি কৌতুক ভরা মুখ।
তার মানে তার শরীর ভোগ করে ফিরে না গেলে
নষ্ট হবে সূর্যের পৌরুষ ! ব্যাপার যে এরকম গুরুতর আকার ধারণ করবে, স্বপ্নেও ভাবেনি সে। সঙ্গমে ইচ্ছুক নয়,
এইকথা বলার মধ্যে এতখানি বিপদ লুকিয়ে থাকবে সে ভাবেনি একবারও।
বিপদের আরো বাকি ছিল।
কুন্তী খুব নম্র স্বরে, প্রায় অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলল,
‘হে দেব ! কুমারী শরীর একবার চলে গেলে আর ফিরে আসে না।
পিতা মাতার কাছ থেকে এই শরীর পেলাম আমি। একে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার। আমি নিছক কৌতুকবশে আপনাকে ডেকেছি। দয়া করুন।
ফিরে যান !’ সূর্য গম্ভীর হলেন। আর সহ্য হচ্ছে না তাঁর। সামান্য মানবী বার বার প্রত্যাখ্যান করছে ! এই মুখ নিয়ে স্বর্গে গেলে উপহাস করে করে শেষ করে দেবে সকলে। ভোগ তাকে করতেই হবে। যে ভাবেই হোক। অনেক হল ঠাণ্ডা মাথায় বোঝান। তিনি রূঢ় গলায় বললেন,
‘শোনো, তোমার ওই ঋষি দুর্বাসা, তাঁকে দেখে নেব আমি। অপাত্রে মন্ত্র দেবে কেন সে ? আর আমার মত দেবপুরুষকে ঘরে ডেকে তুমি এখন তোমার পিতা মাতার কথা বলছ ? তাদেরও ধ্বংস করব আমি। ছারখার করে দেব এই রাজ্য। ভেবে দেখো। এই শেষ বার বলছি !
বলে, কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন সূর্যদেব। থমথমে মুখ। সোনার মত বর্ণ। ক্রোধে আরো লাল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলছেন, ‘এই শেষ। আমি ফিরেই যাব। তুমি অক্ষত রাখো তোমার কুমারীত্ব। পরিবর্তে ধ্বংস হবে রাজ্য আর তোমার প্রিয়জন। বলো,কি চাও ?’
কুন্তী স্থির দৃষ্টিতে তাকাল সামনের লোভী দেবতাটির দিকে। নাহ, আর ভয় করছে না। ঘৃণা হচ্ছে। একটু পরেই লন্ডভন্ড হবে শরীর। থাক। এখন অদ্ভুত শীতল বোধ করছে। ঠাণ্ডা হয়ে আসছে একটু আগের জ্বলন্ত অনুভূতি। সোজা তাকিয়ে সে বলল, ‘জ্ঞান বিজ্ঞানে আপনারা বহু উন্নত বলেই, দেবতার আসন অর্জন করেছেন। আপনার কাছে ভুলের শাস্তি এত কঠিন জানতাম না। দেবতা হলে মানুষের চাইতে কিছু উপরে তো থাকতেই হয়। তাই না ?
যাক। হে সূর্যদেব , আপনার ইচ্ছা ও তৃপ্তি সাধনের আগে আমার দুটি শর্ত আছে। আমার শরীর আপনি ভোগ করলেও আমি আগের মত অক্ষত যোনি থাকতে চাই। আর সঙ্গমের ফলে যে সন্তান জন্ম নেবে, সে যেন আপনার কবচ কুন্ডল নিয়ে জন্মায়। যতক্ষণ এই কবচ থাকবে তার শরীরে, প্রাণ কিছুতেই যাবে না পুত্রের।’
কুন্তীর গভীর নাভিদেশে হাত রাখলেন সূর্যদেব। কামনায় চকচক করছে মুখ। ওষ্ঠ ডুবিয়ে দিলেন স্তনে। ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন, ‘রানী রানী। সব হবে। সব পাবে। দেবতার কৃপা হলে কিই না হয় ! সর্ব শক্তিমান আমরা।’
এক মুহূর্তে ছিঁড়ে গেল সমস্ত আবরণ। প্রচণ্ড আবেগে দলিত মথিত হতে লাগল পাখীর মত শরীরটি। বলশালী যুবকের শরীরের ঘর্ষণে তীব্র ব্যাথা লাগল কুন্তীর। যোনি পর্দা ভেদ হবার সময় জ্ঞান হারাল সে। বিরক্ত সূর্য আর দেরী করল না। অজ্ঞান কিশোরীটিকে বার বার ধর্ষণ করে, তৃপ্ত সূর্যদেব বিদায় হলেন। এক পুকুর রক্তের মধ্যে পড়ে রইল কুন্তী।
স্বপ্ন দেখছিল কুন্তী। হালকা শরীরে ভেসে ভেসে কোথায় যেন যাচ্ছে। কোথায় ? মেঘ যেন ভেলা। তাতে সাদা পোশাকে সে। মৃদু বাতাস বইছে। ভেসে আসছে অজানা ফুলের মিষ্টি গন্ধ। খুব ভালো লাগছিল তার। কোথা থেকে উড়ে এলো এক দল পরী। হাতের যাদু লাঠি বুলিয়ে দিল তার সারা শরীরে। মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করল কোথায় যাবে চলো। নিয়ে যাই তোমায় !
কুন্তী অবাক। তার শরীরে আর ব্যথা নেই। যন্ত্রণা নেই। অনেক দিন পরে হেসে উঠল সে। পরীদের হাত ধরে বলল, ‘আমি মার কাছে যাব। মার কাছে।’
অমনি গম্ভীর হল পরীর দল। বলল যা চাও তাই পাবে। কেবল মা চাইবে না।
সে কেঁদে উঠে বলল ‘আমি মা চাই গো। মা চাই।’
ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়। ঘুম ভাঙল না জ্ঞান ফিরল, জানে না কুন্তী। শরীরে অসহ্য ব্যাথা। বিছানায় রক্ত। লন্ডভন্ড সব। যেন পরিত্যক্ত যুদ্ধ ক্ষেত্র ! জেগে উঠে প্রথম মনে হল ভাগ্যিস কুন্তিভোজ বিপত্নীক ! সব লুকোতে হবে এখন। বাকি দাস দাসী কিছু জানার আগেই, সব লুকিয়ে ফেলতে হবে। ওহ ! এই মুহূর্তে প্রয়োজন উষ্ণ জলে স্নান। কিন্তু সম্ভব না। ওই সব বিলাসিতা এখন থাক। সে কোন মতে ঘষটাতে ঘষটাতে কপাট একটুখানি খুলে দেখে,বাইরে তিন চারজন উদ্বিগ্ন মুখের দাসী। তার মধ্যে তার বিশ্বাসী প্রিয় দাসীও আছে। হাতের ইশারায় শুধু তাকেই ভিতরে ডেকে আনল।
দাসী সব শুনে সব দেখে ডুকরে কেঁদে উঠতে গেলে তার মুখে হাত চাপা দিল কুন্তী,
‘শোনো, একটু পরেই স্বাভাবিক ভাবে বেরুতে হবে আমাকে।’
‘কিন্তু আপনার তো যন্ত্রণা করছে।’
‘সে করছে। যোনি পথ পুরো ক্ষতবিক্ষত। চিকিৎসার আশু প্রয়োজন। কিন্তু রাজবৈদ্য কে খবর দিলে চলবে না।তুমি গোপন পথ দিয়ে অরণ্যে যাও। সম্বুক কে বুঝিয়ে বলো। সঙ্গে ওদের দুজন ধাত্রী এনো। অরণ্য অনেক ভালো চিকিৎসা জানে।’
‘এই সময় আপনার মা সঙ্গে থাকলে ভালো হত রাজকুমারী।’
‘কেন ? আমি আমার মা। চিন্তা করো না। যা বলছি তাই করো। বাইরে প্রচার কর, রাজকুমারী ব্রত করছেএক। দিন কতক বিরক্ত না করে কেউ।’
‘উষ্ণ জলে পরিষ্কার করে দিয়ে, কিছু খাবার দিয়ে যাচ্ছি।’ দাসী ব্যস্ত হয়ে দৌড়ায়।
সূর্যদেব চলে গেছে। সর্ব শরীরে আঁচড়ের কামড়ের দাগ। সেই সঙ্গে তাঁর ফেলে রাখা বীর্যের কারণে ধারণ করতে হবে সন্তান। আর সে পুরুষ নিশ্চয়ই এতক্ষণে বন্ধুদের সঙ্গে বসে রসের আলোচনা করছে।
দাসী হঠাৎ জড়িয়ে ধরল তাকে। আঃ আঃ শব্দ করতে লাগল। সমস্ত শরীরে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। একজন নারী বুঝবে ধর্ষণ কতখানি কষ্টের ! প্রেমহীন সঙ্গম কত ক্ষতি করে ! আহা ! এই ছেলেমানুষ কন্যাটির এমন ভয়ানক পরিণতি ! আহা, দাসী যতখানি পারে শুষে নিতে চাইল বেদনা।
ধাত্রী হিসেবে, সম্বুক যাদের পাঠিয়েছিল তারা অল্পবয়সী। যেমন চতুর, তেমনি কর্মঠ। তেমনি নীরব। সঙ্গে এনেছিল প্রচুর জংলী লতাপাতা। মূল কক্ষের লাগোয়া আর একটি ঘরে আস্তানা গড়ল তারা। মুখে কোন কথা নেই। নানা রকম পাথর ঘষা হচ্ছে। পাতা ছেঁচা হচ্ছে। রস তৈরি হচ্ছে। কোনটি লেপনের, কোনটি খাবার। কুন্তী এতটুকু হেলতে পযর্ন্ত পারছে না। সমস্ত শরীরে প্রলেপ পড়ছে ঘড়ি ঘড়ি। নিমতেল মালিশ হচ্ছে। বড় বড় ফোস্কাগুলো বসে যাচ্ছে, ত্বকে আর দাগ ফেলতে পারছে না। ক্রমশ সজীব হচ্ছে শরীর। মুখের পাণ্ডুর ভাব কেটে রক্ত আভা ফুটছে। রাত গভীর হলে, চরাচর ঘুমিয়ে পড়লে, বয়ষ্কা ধাত্রী , মালসার মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে কি সব ছুঁড়ে দিচ্ছে। তার থেকে বেরুচ্ছে ঔষধি ধোঁয়া। অনেক কষ্টে ফাঁক করা হল কুন্তীর দুটি পা। ওষুধ যুক্ত ধোঁয়া ভরা মালসা রাখা হল সেখানে। যোনির মধ্যে ধীরে ধীরে যেতে লাগল ওষুধ। প্রাচীন আরণ্যক পদ্ধতি। ক্ষত মুখ শুকিয়ে যাবে। সেই সঙ্গে মন্ত্র বলে চলেছে দুর্বোধ্য ভাষায়। শরীরের ভিতরের জখম ধীরে ধীরে শুকিয়ে আগের মত ঝরঝরে তাজা হয়ে উঠবে কুন্তী।
দেখতে দেখতে কেটে গেল পাঁচ মাস। কুন্তী একদম স্বাভাবিক। চলাফেরা দেখে কেউ বুঝবে না যে, তার গর্ভে আছে সন্তান। পরিচিত পুরনো দাসী ছাড়াও, সঙ্গে ছায়ার মত থাকে অরণ্যের ধাত্রী দুজন। এর মধ্যে কুন্তী আর রাজপুরোহিত মিলে এক গোপন পরামর্শ করেছিল। সেখানে সুস্পষ্ট বক্তব্য রাখে কুন্তী, ‘শোনো সকলে, আপনিও শুনুন তাত। এ সন্তান আমি রাখব না। সমাজের জন্য না। আমার পালক পিতা ,সুযোগ পেলেই কথা শোনাবে। জন্মদাতা মাতা পিতাকে ছোট করবে। আমি তাদের সম্মান রক্ষা করিনি, এই দোষ দেবে আমার সমস্ত পরিবারকে। বিনা দোষে ভুগতে হবে তাঁদের।’
অন্ধকার নামছে। বিশাল উচুঁ বৃক্ষ ভেদ করে আকাশ দেখা যায় না । আঁধার ভাব থাকে। হিংস্র জানোয়ার থেকে আদিম বাসিন্দা নিশ্চিন্তে চলা ফেরা করে। অরণ্য এদের মা। ঘিরে রাখে। বাঁচিয়ে রাখে। আজকাল কুন্তী এখানে এসে সুস্থির বোধ করে। নাগরিক জীবনের প্যাঁচ আক্রান্ত করে না এখানে। সে স্বাভাবিক ভাবে হাত পা ছড়িয়ে বসে। কোমরের বসন আলগা করে, নিজের স্ফীত উদরে পরম মমতায় হাত রাখে। তেলের বাটি নিয়ে আসেকেউ, কুন্তী আপন মনে কথা বলে, সন্তানের সঙ্গে। ক্ষমা চায় বার বার। সাবধানে থাকতে বলে। গুনগুন গান গায় কুন্তী। বিষয়বস্তু ছেলে। ছেলে বড় হবে। ভালো থাকবে।
আচার্য নরোত্তম চিন্তিত। গম্ভীর মুখে বলেন,
‘এ পুত্র সাধারণ না। বরং বিশেষ বলে বিবেচিত হবে। এর জন্ম লুকিয়ে রাখা বড়ই দুষ্কর হবে কুন্তী। চোখ বুজে বলে দেওয়া যাবে এ রাজার কুমার।’
‘আচার্য…’ ভারি গলায় কুন্তী বলে, ‘যেমন ভাবেই জন্ম নিক, এ আমার সন্তান। মাতৃত্ব আস্বাদ কিছু তো পেয়েছি, সেই শৈশবে চলে এলাম,তবু… আমার প্রথম সন্তান ! সে বঞ্চিত হবে মাতৃদুগ্ধ থেকে। আমার পুত্র…!
কুন্তী কেঁদে উঠল। যা তার স্বভাব বিরুদ্ধ। জ্বলন্ত লাভার মত তরল অশ্রু গড়িয়ে পড়ল দুগাল বেয়ে।
‘আচার্য। একে জন্ম দেব আমি। একে বাঁচিয়ে রাখতে চাই।’
‘কুন্তী। ভুল করছ। পাপ এবং অন্যায় থেকে সৃষ্ট এ সন্তান পৃথিবীর কোনো মঙ্গল করবে না। জন্মের আগেই বিনষ্ট করলে ভালো করতে !’
‘না না। না না।’ ভীত কিশোরী নিজেকে দুহাত দিয়ে আগলে ধরে,
‘থাক। বেঁচে থাক। বাছা আমার। আমার কাছে না হোক, অন্য কোথাও। অন্য কারো কাছে। যার কাছেই থাক, গোপনে অর্থ সাহায্য করা হবে। যেন রাজার কুমারের মতই বড় হয় সে। আপনি উপায় দেখুন আচার্য।’
‘উপায় এখুনি দেখছি না। ভাবতে হবে। তোমার শরীর লুকনো যাচ্ছে ?’
‘বিশেষ ধরনের পোশাক, শরীর অনেকটা ঢেকে দিচ্ছে। আর আমাকে বিরক্ত করে এমন লোক কম।’
চিন্তিত আচার্য । কপালে ভাঁজ। সন্ধ্যার ঘন অন্ধকারে কারো মুখ দেখা যায় না। কুন্তী তাঁর স্নেহের পাত্রী। ভারতবর্ষের পালাবদলে এই কন্যার বুদ্ধি কাজে লাগবে একদিন, এ ব্যাপারে তাঁর সন্দেহ নেই কোনো। সহসা এ কেমন দৈব দুর্বিপাক উপস্থিত হল ?
তবে সব মহাকালের খেলা। তিনি নিমিত্ত মাত্র। যে প্রাণ জন্ম নিতে চলেছে, তাঁকে আটকানোর ক্ষমতা স্বয়ং ঈশ্বরেরও নেই। আসুক। আসুক সে। সূর্যের কবচ কুন্ডল ধারণ করে জন্ম নিক কুন্তী পুত্র কর্ণ।
জলদ গম্ভীর কণ্ঠে আচার্য ঘোষণা করলেন, ‘সন্তান পুত্র হবে। নাম হবে কর্ণ। যেখানেই সে প্রতিপালিত হোক, জন্ম বৃত্তান্ত কঠোর ভাবে গোপন রাখতে হবে। শুধু নাম আর কবচ কুণ্ডলের কথা জানিয়ে একটি পত্র সঙ্গে থাকবে। বাকি সব পরিকলপনার কথা পরে হবে।’
(মহাভারতের কথা অমৃত সমান। মহাভারত না পাঠ করলে চেনা যায় না ভারতবর্ষ। আর কুন্তীকে না জানলে অজানা রয়ে যাবে মহাভারত।)
পূর্ববর্তী ঘটনার পরে কেটে গেছে বহুকাল। ঘটে গেছে মহাযুদ্ধ। স্বজনের রক্তে ভেজা মাটিতে গাঁথা হয়েছে ভারতবর্ষের নতুন পতাকা। শ্মশানে একলা বসে আছে কুন্তী। কিছুক্ষণ আগেই কুরু পাণ্ডব দুই পক্ষের বিধবাদের আর্তরবে ভারি ছিল শ্মশানভূমি। নিজের পাঁচ সন্তান জীবিত। কুন্তী অপরাধী ভাবছিল নিজেকে। ভার হয়ে ছিল মন। একান্তে বসে নিজের মনে ভাবছিল কত কথা।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষে সারিসারি জ্বলন্ত চিতার সামনে বসে মনে হয়, শেষ পর্যন্ত লাভ কী হল? আত্মীয় পরিজনদের আর্তনাদ, মাংস পোড়ার তীব্র কটু গন্ধ, গান্ধারীর হাহাকার, একে অন্যের প্রতি অভিশাপ বর্ষণ, এ সবের মধ্যে স্থির অবিচল থেকে কুন্তী ভাবছিল, মৃত্যুতে কি শেষ হয় মানব? নাকি নতুন শুরুর পদধ্বনির সূত্রপাত করে মৃত্যু? শোক কেন? শোক তো সমাধান হতে পারে না! তবে এই অনর্থক শোক কেন? দু’দিন পরে আবার তো ফিরে যেতে হবে জীবনে। কেননা, মানুষ নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।
ভাবছিল কুন্তী। কর্ম যা ছিল শেষ হল তবে, এবার ফিরে গেলে হয় উৎস মুখে। অরণ্যে। প্রকৃতির কোলে। যেখানে আছে অপার শান্তি। পুত্র যার ভারতসম্রাট, সেই মা অহংকারের মুকুট পরে রাজ অন্তঃপুরে বিলাসিতায় শরীর না ভাসিয়ে, লেলিহান চিতার সামনে বসে আগামী অরণ্যবাসের পরিকল্পনা করছে, এ কাজ সাধারণ কোন নারী করলে আশ্চর্য বোধ করা স্বাভাবিক। কিন্তু সে কুন্তী। ব্যতিক্রমী ভাবনা তাকেই মানায়। প্রতিটি লাঞ্ছনা, অপমান, দুঃখকে মণিহারের মতো কণ্ঠে ধারণ করে আরো উজ্জ্বল হয়েছে সে। হয়েছে আরও অহংকারী, আত্মবিশ্বাসী। দুঃখ ছিল তাঁর বিশ্বাসী সঙ্গী। নাহ, কোনো অভিযোগ কুন্তী করবে না। অভিযোগ করে তারা, যাদের কাছে জীবন এক ভার মাত্র।
টুকরো টুকরো ভেঙে যাওয়া অজস্র ঘটনা জুড়ে জুড়ে সে একের পর এক সৃষ্টি করে গেছে। সে কাজে সাহায্য করেছে তাঁর অদম্য জেদ আর সাহস। ‘একলা’ শব্দটার অনেক মানে। তবে যাদের বিপন্ন শৈশব তাদের একাকিত্বের রকমটি বড় ভয়ঙ্কর। স্নেহের ঘেরাটোপ ছিনিয়ে নিয়ে জ্বলন্ত বাস্তবের মুখে ফেলে দেওয়া শিশু, নিজেকে বাঁচাতে কতখানি হিংস্র হতে পারে কুন্তী তার চাইতে বেশি কিছু তো নয়। সেই দিনের কথা আজ এই শ্মশানে বসে ভাবতে গিয়েও শিউরে ওঠে শরীর। পনেরো বছরের কুমারী কন্যা নির্মম ভাবে ধর্ষিতা হল। ধর্ষণ জাত পুত্র কর্ণ, নিহত হল তাঁর আর এক পুত্র অর্জুনের হাতে!
সামনে জ্বলছে অগুন্তি চিতা। লেলিহান আগুন কি শুধু বাইরে জ্বলে? অন্তর যখন পুড়ে যায়, সে আগুন কেউ দেখতে পায় না। কুন্তী রূপসী। বিদুষী। সক্ষম সুন্দরী নারী। অথচ যৌনমিলনে অক্ষম এক পুরুষের সঙ্গে বিবাহ হল তাঁর? মহারাজ পান্ডু। যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবল পরাক্রম! শৌর্য বীর্য যাঁর অনায়াস। রূপবান পুরুষ। অথচ নারীশরীরের কাছে তিনি অসহায়। নাহ্। ভুল। অসহায় হলে, আরও একটি সুন্দরীকন্যা মাদ্রীকে বিবাহ করে সর্বনাশ করতেন না তাঁর। পুরুষ! এরা পুরুষ? এদের ভিতর শুধু কাজ করে স্বামিত্বের অধিকারবোধ। অদ্ভুত জটিল মানসিকতা! মহারাজ পান্ডু যখন জানতে পারলেন কুন্তী ইচ্ছা করলে যে কোন দেবতাকে সঙ্গমে আহবান করতে পারে, তখন লকলক করে উঠলো তাঁর লোভ। দেবপুত্রের পিতা হবার আকাঙ্খায়, নিজের পছন্দমতো দেবতার অঙ্কশায়িনী করতে কুন্তীকে বাধ্য করলেন তিনি। সতী অসতীর সঠিক সংজ্ঞা কেউ জানে না। পুরুষের ক্ষেত্রে এই সংজ্ঞা কেন প্রয়োগ হয়না, তাও জানা যায় না। সুযোগ থাকলেও নপুংসক স্বামীর প্রতি অবিশ্বাসী হয়নি কুন্তী। স্বামীর ইচ্ছেতেই অনিচ্ছুক সঙ্গমে বাধ্য হয়েছে। পুত্র জন্ম দিয়েছে একের পর এক। আর অনিচ্ছুক সঙ্গমও যে ধর্ষণের নামান্তর মাত্র, এ কথা কে না জানে? শুধু তাই নয়, প্রিয়পত্নী ওই আদুরে বিড়ালীর মতো মাদ্রীর জন্যও একটি মন্ত্রভিক্ষা করলেন রাজা। আর তারপর? পাঁচটি অসহায় পুত্রকে কুন্তীর উপরে ফেলে রেখে, রমণে মৃত্যু অনিবার্য এ তথ্য জেনেও মাদ্রীর সঙ্গে সম্ভোগের ফলে মৃত্যু ঘটলো তাঁর।
ধূ ধূ করছে চারিদিক। নদীর উপর দিয়ে বয়ে চলেছে শনশন উষ্ণ বাতাস। মধ্যাহ্ন শেষ হতে চলল প্রায়। আজ মনে হচ্ছে, মৃত্যু একমাত্র সত্য। বাকি সমস্ত অর্থহীন। সমস্ত জীবনের নীচে পড়ে থাকে মৃত্যুর চিহ্ন। এই দেশ, এই রাজ্য, এই ক্ষমতা… হলুদ কুয়াশা মেখে হারিয়ে যাবে। কিছুতেই কিছু নয়। আত্মীয়তা বলা হয় যাকে, সেও ছায়াঘোর হয়ে ওড়ে। ছাই হয়ে ভাঙে অন্ধকারে। মনে পড়ে কত স্মৃতি আজ। সংগ্রামের, বেদনার, বঞ্চনার, প্রতারণার কত ঘটনা। তবে, হতাশার নয় কোন কিছু। হতাশ হতে জানতো না কুন্তী। পিতৃহীন পঞ্চপান্ডবকে সঙ্গে নিয়ে অপমানিত হয়েছে বারবার, কামুক পুরুষের চোখ বিদ্ধ করেছে অহরহ। একলা তরুণী মা, ছলনা, প্রতারণায় জর্জরিত। প্রাপ্য রাজ্যটুকু থেকে বঞ্চিত। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে একটু আশ্রয়ের আশায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকেছে দিনের পর দিন। আর বুকের ভিতর ফনা তোলা হিংস্র সাপকে আদর করেছে মনে মনে। শিকার করার সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হলো ধৈর্য। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছে সে সুযোগের। প্রতিশোধের। প্রতিহিংসার।
ইতিহাস বলবে, কুন্তী নির্মম। রাজনীতির খেলায় পটু। আপন সন্তানদের হাতিয়ার করে, দখল করেছে ক্ষমতা। কিন্তু একজন একলা মা, কোন পিতার ছায়া ছিল না যার পুত্রদের জীবনে, সে যদি ছেলেদের ছোটবেলা থেকে এই শিক্ষা না দেয় যে, ক্ষমতা কেউ দেয় না ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে হয়, তবে প্রাপ্য সাম্রাজ্য উদ্ধার হতো কেমন করে? দিনের প্রতিটি সময়, সে অরণ্যবাস হোক, কিংবা হস্তিনাপুর রাজ্যে বসে হোক, প্রতিমুহূর্তে তাদের প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রেখে যেতে হয়েছে। লৌহ মানব তৈরি হয়েছে সন্তান! ক্ষমতা দখলের খেলা বড় নির্মম। মায়ামমতা সহানুভূতি, প্রেম, করুণাকে একচুল জায়গা ছেড়ে দিলে, সেখান থেকে গুটিগুটি পায়ে প্রবেশ করবে পরাজয়ের কালো ছায়া। তাই দ্বিধা হয়নি, পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে দ্রৌপদীকে ভাগ করে দিতে। উপায় ছিল না। যন্ত্রমানবের মতো পাঁচটি অস্ত্র, যুধিষ্ঠির ভীম অর্জুন নকুল সহদেবের মধ্যে ঈর্ষার কালোছায়া প্রথমবার অনুভূত হল দ্রৌপদীকে দেখার পরে। পাঞ্চালী সাধারণ নারী নয়, জ্বলন্ত অগ্নিশিখা। পুড়িয়ে দেবে তিলতিল করে গড়ে তোলা পাঁচটি সন্তানকে? তখন কি হবে? তারচেয়ে বলিপ্রদত্ত হোক পাঞ্চালীর অর্জুন প্রেম। ‘পাঞ্চালীকে পাঁচ জন মিলে বিবাহ করো’- কুন্তীর মুখে এ আদেশ উচ্চারিত হওয়া মাত্র, দ্রৌপদীর মুখে নেমে এলো ঘোরবিষাদ। অভিমানে থমথম। দৃষ্টিতে ক্রোধের আগুন। কুন্তী ভাবে, তার কি ক্ষমা চাওয়া উচিত দ্রৌপদীর কাছে? আজ সে ভারতবর্ষের মহারানী। কিন্তু প্রেমিকা হওয়ার নিবিড় সুখ হতে বঞ্চিত রইল সে সারাজীবন। পুরুষচোখে ভালোবাসার তৃষ্ণা কত তীব্র হয়ে জ্বলে, অর্জুনের চোখে তা দেখেছিল কুন্তী। গুরুত্ব দেয়নি। তখন উচ্চাশার রথ ছুটছে, যুবক পুত্রের প্রথমপ্রেম সে রথের চাকার নীচে দলিত হলেও পরোয়া করেনি সে। অর্জুন আর দ্রৌপদী, চিরবিচ্ছেদের মালায় গেঁথে রইল দুটি প্রাণ।
অথচ এই পাষান বুকেও কর্ণের অভিমান বড় তীব্র হয়ে বেজেছিল। আজ জীবনের শেষদিনে এসেও পুত্রের ওই অভিমানী মুখখানি মনে পড়ে। একমাত্র কর্ণের কাছে কিছু ঋণ রয়ে গেল কুন্তীর। দিনদিন প্রতিদিন জীবন হয়ে উঠেছিল রুক্ষ্ম নির্মম, শুধু বিদুরের নীরব ভালোবাসা তাকে বলয়ের মতো ঘিরে থাকতো, যখন যেখানে যেভাবে হাত বাড়িয়েছে বিদুর এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে। তবে ভালোবাসা নামক কোন নরম ভাবকে প্রশ্রয় দেবার মত মন তখন তার ছিল না। শুধু লক্ষ্যপূরণের জিদের ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে পাঁচপুত্রকে নিয়ে এগিয়ে চলেছে সে হস্তিনাপুরের সিংহাসনের দিকে।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষ। বিজয়ী পঞ্চপান্ডব। তবে যুদ্ধে যদি তাদের মৃত্যুও ঘটতো, তাহলেও সংকল্প থেকে সরে যেতো না কুন্তী। কারণ পুত্রস্নেহের থেকে অনেক বড় তার কাছে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। অধর্মের হাত থেকে রক্ষা করেছেন দেশকে। ভারতবর্ষ আজ ধর্মরাষ্ট্র। দেশের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য সে যা করেছে, নাহ্। কোনো গ্লানি নেই। নেই অপরাধবোধ। কুন্তী অনুতপ্ত হতে শেখেনি। যা হয়েছে, তাই হবার ছিল। তার জন্য কোনো পাপবোধ, দুঃখবোধ কিছু নেই। এখন সংসারকে আঁকড়ে থাকারও কোনো অর্থ নেই। ছেলেদের প্রাপ্য তারা পেয়ে গেছে। নিজের জন্য কিছু আর চাইবার নেই। সম্পূর্ণ উদরপূর্তির পরে ঘুমিয়ে থাকা অজগর যেন সে।
কুন্তী ব্যতিক্রমী নারী। গান্ধারীর মতো ধার্মিক বা ভাগ্যের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে চোখে সাতপুরু কাপড় বেঁধে কাটিয়ে দেওয়ার নাম যদি ধর্ম হয়, তবে তা সে নয়। দ্রৌপদীর মতো পঞ্চস্বামী ছিল না তার। পিতৃগৃহ বলে কিছু ছিল না, শ্বশুরঘর ছিল না। স্বামী পাশে ছিল না। ছেলেদের সংসারেও থাকেনি সে। সারাজীবন সে স্বাবলম্বী। স্বাধীন। মহাকালের ইতিহাসে কুন্তী একজনই মাত্র হয়। বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাস মহাভারতের কুন্তীকে দ্বিতীয়বার জন্ম দিতে সাহস করবে না। পুরুষের তৈরি সমাজে কুন্তী যেন এক প্রতিবাদ মশাল। সতী বা অসতী উপাধি নিয়ে নয়, কুন্তী মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকবে কেবলমাত্র কুন্তী হয়েই।
সহায়তা: কালী প্রসন্ন সিংহ – মহাভারতের একশটি দুর্লভ মুহূর্ত – ধীরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য
কৃষ্ণা কুন্তী এবং কৌন্তেয় – নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী
How I will read the Novel?
পাশের “+” গুলো ক্লিক করলে খুলে যাবে।