‘এই তোমাকে একটা কথা বলবো?’
-‘বলো।’
-‘না, মানে ইয়ে, তুমি কিছু মনে কোর’না যেন-’
-‘কেন, মনে করার কী আছে?’
-‘এমনিতে কিছু নেই, তোমার আপত্তিও নেই, তা জানি, তবু তোমার কোনো অনুমতি না নিয়েই করলাম কিনা! অবশ্য এখন তুমি মনে করলেও কিছু করবার নেই।’ এতটা কথা একটানে ব’লে ব্রতীন একটু থামে, স্বভাবে সচরাচর স্বল্পভাষী ব্রতীনকে লক্ষ্য করছিল লাজবন্তী, এতটা বিব্রত, এতটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে কেন? লাজবন্তী জিজ্ঞেস করে, ‘কী করলে, আমার অনুমতি না নিয়ে? ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাছে নোটিস দিয়েছ?’
-‘না। তা নয়। তবে কাছাকাছি একটা কাজ করেছি। আচ্ছা – তুমি আমার ওপর রাগ করবে না বলো।’
-‘কী করলে সেটা তো বলবে আগে-’
-‘কোনটা?’
-‘যা বললে, মনে করছ যে, আমি কিছু মনে করতে পারি – সেইটা।’
-‘সেরকই দুটো আছে।’
-‘এ-ক সঙ্গে দু-উ-টো? আচ্ছা যেটা আগে করেছ সেইটাই বলো – সেভাবেই বলো।’
একটু গলাখাঁকারি দেয় ব্রতীন। রুমাল দিয়ে মুখও মোছে ‘হয়েছি কি আমার পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চের কোনো স্কোপ তো এখানকার কোনো ইউনিভার্সিটি দিলও না, দেবেও না, তাই আমি বাইরের কয়েকটা ইউনিভার্সিটিতে আমার প্রপোজাল পাঠিয়েছিলাম, তা অস্ট্রেলিয়া রেসপন্স করেছে, বলেছে রোল রেস্পন্সিবিলিটি নেবে, একটা পুরো জোন প্রোভাইড করবে, তা আমি আমার কনসেন্ট লেটার দিয়ে দিয়েছি।’
-‘তা এতো খুব ভালো কথা, এতে আমি কিছু মনে করবো কেন?’
-‘না, তোমায় না বলে, তোমার কনসেন্ট না নিয়ে – ’
-‘না, আমি কিছু মনে করি নি, আর?’
-‘আর, আর, তোমার, তোমার না, দুই বা তিন সপ্তাহের মধ্যেই ল্যাজ গজাবে।’
-‘মানে?’
-‘মানে, তোমার এবার সত্যিকারের ল্যাজ গজাবে। দুই বা তিন সপ্তাহ, খুব বেশী হলে চার। মানে আমার তো দুই সপ্তাহেই গজালো। তোমারটা খুব বেশী হ’লে তিন-’
-‘কী বলছো?’ এবার লাজবন্তীর গলায় আর্তনাদ।
-‘কেন? তুমি খুশি হওনি?’
-‘খুশি, মানে, না ,তবে –’ কথা আটকে যায় লাজবন্তীর। একটু পরেই কথা খুঁজে পেয়ে ‘যদি জানো যে খুশিই হব’ তো কিন্তু কিন্তু করলে কেন?’
-‘না, মানে তোমার কনসেন্ট না নিয়েই ব্যাপারটা করলাম কি না!’
-‘কী করলে?’
-‘তোমার ওই লেজ গজাবার সিরামটা ইনজেকশান দিলাম যে-’
-‘অ্যাঁ! মানে- এখন-’
-‘হ্যাঁ।’ ব’লে গর্ব আর লজ্জার মাখামাখি মুখে হাত চালায় তার পাঞ্জাবির পেছনে, তারপরেই লাজবন্তী টের পায় সে বাঁধা পড়ে গেছে ব্রতীনের ল্যাজবন্ধনে।
ব্রতীন আবাল্যই ল্যাজলালায়িত। জীবনে প্রথমবার চিড়িয়াখানা ভ্রমণের পর্বে, বাঘ-সিংহ-হাতি-জেব্রা-হনুমান মায় কুমির ইত্যাদি দেখবার পর, তার প্রথম প্রশ্ন ছিল, আমাদের ল্যাজ নেই কেন? এমত প্রশ্ন নাকি শতকরা বিরানব্বইটি শিশুই করে থাকে, এতে বিস্ময় ছিল না। কিন্তু বাড়ি ফিরবার পর পিতামহের কাছে চিড়িয়াখানার অনুপুঙ্খ বিবরণী আচারে ও উচ্চারণে বিবৃতির পর, সে জানায় তার প্রস্তাবনাপ্রাণিত প্রাঞ্জল বক্তব্য : আমাদেরও ল্যাজ থাকলে খুব ভালো হ’ত।
শোনা যায় এ-কথায় পিতামহ বলেছিলেন : আমাদের ব্যাপারটা বলতে পারছি না, তবে তোমার যে থাকলে ভালো হ’ত, তা মানছি। লেগে থাকো, নিশ্চয় তোমার ল্যাজ গজাবে একদিন।
সেই পর্ব সেখানেই থামলেও, ব্রতীন কিন্তু এই ল্যাজের বিষয়টি ভোলে নি। বিশেষ করে দশম শ্রেণিতে বিবর্তনতত্ত্ব পড়বার পর থেকেই, তা, তার মনে মাথায় লাফিয়ে ওঠে পুনর্বার। উচ্চশিক্ষা পর্বেও সে লেগে থাকে জেনেটিক্স-এ। এবং জেনেটিক্স এঞ্জিনিয়ারিং-এ গবেষণা উপাধিও পেয়েছে সম্প্রতি। কিন্তু মূল গবেষণার সমান্তরালে সে সক্রিয় ছিল লাঙ্গুলতত্ত্বকেন্দ্রিক পাঠের ধারাবাহিকতায়।
অতটা না হ’লেও লাজবন্তীও অনুরূপ ল্যাজলোলুপ। অবশ্য তার এই আগ্রহ কিঞ্চিৎ বহিরঙ্গ প্রণোদিত। পিতামাতা তাঁকে একটি ফেরঙ্গি বিদ্যালয়ে প্রেরণ করলে, শিক্ষিকার জিহ্বায় সে প্রথমদিনেই আখ্যাত হয় ল্যাজব্যান্টি রূপে। অতঃপর সহপাঠিনীরাও ডাকাডাকির পর্বে নিষ্ঠার সঙ্গে রক্ষা করেছে তার সল্যাজতা।
যদিও কিয়ৎকাল পরেই সেই ফেরঙ্গি বিদ্যাক্ষেত্র থেকে বিদায় নিয়ে একটি নামকরা বাংলা মাধ্যম বালিকা বিদ্যালয়ে গিয়ে যথাযথ লাজবন্তী হয়েছিল; কিন্তু বেশ কিছুদিনই আশৈশবের শ্রুতিতাড়িত অভ্যাসে নাম জিজ্ঞাসায় সেই ল্যাজত্ব মুক্ত হতে পারেনি। যদিও সেই সব পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণির কথা কালে দিনে স্মৃতি-বিস্মৃতির টানাটানি, তবুও সেই ল্যাজত্বের পরিশিষ্টটুকু পুরোনো বন্ধুদের ঘনিষ্ঠতায় টিকেছিল লেজু আখ্যার লেজুড়ে।
কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্বের নতুন বন্ধুদের মধ্যে তা সঞ্চারিত বা পল্লবিত না হলেও, কোনো অচিন বা অবান্তর কার্যকারণযোগে লাজবন্তীয় মুড়োয় আবারও গেড়ে বসে ল্যাজের মতন।
লাজবন্তী আর শিশু বা বালিকা নয়, সুতরাং লম্বা দড়ি কোমরে বেঁধে আমার ল্যাজ হয়েছে বলে দৌড়ে বেড়াবে! কিন্তু তার খাতার কোণে, ডায়েরির পাতায়, হাতে আসা বাতিল কাগজে নিয়তই অঙ্কিত হ’ত ল্যাজ গর্বিত নারীপুরুষের কল্পচিত্র। বোন ঠাট্টা করে, দাদা গাঁট্টা মারে, মা আতঙ্কে রাগেন – কাঁদেন। আর স্নেহাতুর বাবা ল্যাজাতুর মেয়ের সঙ্গে বসে মশগুল হন আরো অমন ল্যাজওয়ালা লোকজনের অস্তিত্বকল্পনায়।
ব্রতীন ছাত্র ভালো। সুতরাং বেশ কিছু সমধর্ম-সমমর্ম মিত্রও হয়েছিল তার।
একদিন তাদেরকেই সে বলে, ‘দ্যাখ একমাত্র মানুষের ল্যাজ নেই, থাকলে সে-ই এই প্রত্যঙ্গকে অনেক ভালো ব্যবহার করতে পারতো।’
-‘কেমন?’
-‘ধর, বাঘ বা সিংহ, গরু বা ঘোড়া, বেড়াল বা কাঠবেড়াল, তাদের ল্যাজ নিয়ে করে কী? কোন কাজে আসে?
-‘কেন? ঘোড়ার ল্যাজ দিয়ে তো জুতোর বুরুশ, তুলি – এসব হয় শুনেছি- ’
-‘আর ঘোড়া সেই বুরুশ দিয়ে নিজের খুর পালিশ করে – ক্যানভাস খাটিয়ে ছবি আঁকে – অ্যাঁ? এমন সব কথা বলিস – ’
-‘তা-ও তো বটে! সত্যিই তো – ’
-‘ভেবে দ্যাখ, অতবড় হাতি, ওইটুকু ল্যাজ, ক্যাঙ্গারু না হয় ল্যাজের বাড়ি-টারি মারে-’
-‘কে বা কারা, কী বা কী কী করে, বাদ দে, তুই কী চাস? তুই চাস তোর ল্যাজ গজাক?’
-‘আমি চাই আমাদের সকলের ল্যাজ গজাক, মানে মনুষ্যপ্রজাতিরই।’
-‘কেন?’
-‘ল্যাজ গজালে মানুষ আরো অনেক বেশী সক্রিয় হ’তে পারবে, ল্যাজের অনেক উপযোগ আছে-’
এই কথার পর বলাবাহুল্য শুধু তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুবৃত্তেই টান লাগেনি- তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে অনেকে। কেবলমাত্র তন্ময় আর শুভদীপ থেকে গিয়েছিল, কেন যে, বোধহয় তা জানে না তারাও। কিন্তু তাদের গবেষণা পর্বের সমান্তরালে, নিজেদের ভাবনাচিন্তার আদান-প্রদান পর্বে তারা খুব উৎসাহের সঙ্গেই শুনত ব্রতীনের লাঙ্গুলস্বপ্নের হরেক তত্ত্ব।
ব্রতীন তৈরি করে ফেলেছিল এক সুদীর্ঘ সরণি। স্তন্যপায়ী থেকে সরীসৃপ, জলচর-খেচর তাবৎ প্রাণীকুলের লাঙ্গুল প্রকৃতি আর তার ক্রিয়াকলাপের বিবরণী। তন্ময়কে বলছিল ব্রতীন ‘এই যে টেব্ল্টা বানিয়েছি না, তাতে দেখতে পাচ্ছি সত্যি সত্যি ল্যাজকে ব্যবহার করে খুব কম প্রাণী, তার মধ্যে সব থেকে বেশী ব্যবহার করতে পারে ইনসেক্টস, পতঙ্গরা, আর ওদিকে হনুমান, যদি মানুষের বিছের মতো বা হনুমানের মতো ল্যাজ থাকতো-’
-‘ঠিকই তো মাষ্টারমশাই দিদিমণিরা ল্যাজে চক দিয়ে বোর্ডে লিখতে লিখতে সামনে তাকিয়ে পড়াতেও পারতো-’
-‘তুই বুঝতে পারছিস না, ধর বিছের হুল থাকে ল্যাজে, যদি-’
-‘তোর ল্যাজ থাকতো, তুই হুল ফোটাতি-’
-‘ইনি তো ঠিকই বলছেন-’
ব্রতীন বা তন্ময় কেউ খেয়াল করেনি, একটি মেয়ে ক্যান্টিনের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে শুনছিল তাদের কথা। তারপর শেষ পর্যন্ত এগিয়ে আসে কথা বলতে।
লাজবন্তী আগের দিনেই যখন লাইব্রেরীতে বসে নোট নিচ্ছিল, তার পাশের টেবিলেই ছিল ব্রতীন। এবং ব্রতীন তার রীতিমাফিক নথিবদ্ধ গবেষণার জন্য প্রয়োজন নোটানুটি-টোকাটুকির অন্তে তার নিভৃত থাকায় আরম্ভ করেছিল তার লাঙ্গুলপ্রকল্প। লঘু প্রকৃতির গুরুডাকে সাড়া দিতে সে চলে যায়, বৈশাখী বিকেলের এক প্রস্থ ঝড়ো হাওয়া- অসতর্ক জানলা বেয়ে সাপটেছিল তার টেবিলে। পাতলা খাতা আর তার কোলে ক’রে রাখা ল্যাজ গজানোর ‘কথা’মালা মেঝেতে ছড়িয়েছিল পালকের মতো। স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াতেই লাজবন্তী কুড়িয়েছিল সেই খাতা আর ল্যাজাক্ত ছিন্নপত্রাবলি। ওরকম পাতার পর পাতাজোড়া ল্যাজের নকশা তাকে বিহ্বল করেছিল যারপরনাই। তবে আর কারো কাগজপত্র ঘাঁটাটা অসৌজন্য এবং অনৈতিকও। তাই খাতা তুলে তার মধ্যে পাতাগুলো ঠেসে যখন টেবিলে রাখছে আবার, তখনই ব্রতীন এসেছে সেই ঘরে। ‘আপনার খাতাটা হাওয়া পড়ে গিয়েছিল – আলগা কাগজগুলো তুলে দিয়ে লাজবন্তীর একটু ইচ্ছে ছিল এই ল্যাজমনস্ক যুবাটির সঙ্গে একটু কথা বলার। কিন্তু গরুর মতোই ল্যাজ দিয়ে মাছি তাড়ানোর মুদ্রায় ‘ওঃ আচ্ছা, থ্যাংকস’ বলে একটা ঢাউস বই-এর মধ্যে মুখ ডুবিয়েছিল ব্রতীন।
লাজবন্তী ভেবেওছিল একটু অপেক্ষা করবে। অত অত চিত্র-বিচিত্র লাঙ্গুল আলেখ্য, তাও আবার কুটিরশিল্পের মতোই স্বহস্তচালিত, কোনোদিনই দেখেনি লাজবন্তী। একটু উৎকণ্ঠা নিয়েই সে অপেক্ষা করেছে, তারপর মন দিয়েছে নিজের পড়ায়। একটা ফোন আসায় একটু বাইরে গিয়েছিল, ফিরে এসে দেখে টেবিল ফাঁকা। বেরোবার সময় কাউন্টারে মাধবীদিকে জিজ্ঞেস ক’রেই ফেলে ‘আমার পাশের টেবিলে কে ছিলেন?’
-‘তোমার পাশে, ওঃ, ও তো ব্রতীন, রিসার্চ স্কলার।’
-‘আচ্ছা ওঁর কী ল্যাজ – ’ প্রশ্ন শেষ হয় না, খুবই বিরক্ত গলায় মাধবীদি, ‘হাউ মাচ্ সিলি কোয়েশ্চন – ওর ল্যাজ থাকবে কেন? ও কেমন –’
-‘না, না, তা নয়। আমি জানতে চাইছি ল্যাজ কী ওঁর-’
বিরক্তিতর মাধবীদি বললেন, ‘তোমার পড়া হয়ে থাকলে যাও- এ আবার কেমন কথা! হুঁঃ! এরকম কথা আর বলবে না। ইউজি-র বাচ্চা মেয়ে তো আর নও-’
ভগ্নমনোরথ লাজবন্তী সেদিন বাড়ি ফিরেও মন বসাতে পারনি তার পড়ায়। খাতার ওপর তার হাতেও তখন আঁকা হয়ে যাচ্ছি, ল্যাজের পর ল্যাজ। আর তার সঙ্গে সেই বইখাতায় মুখ ডোবানো অগোছালো পাকানো-পাকানো চোখের তরুণ। গুছি গুছি কোঁকড়ানো চুল নেমেছে কপাল বেয়ে, গাল ঢেকে।
ভেঙে আধা ঘুমে লাজবন্তী দেখলো সেই ছেলেটাকে মাথায় তার বড়ো বড়ো ল্যাজ! কোন মধুবন্তীর ডাকে ঘুম-ভাঙা ঘোরে জিজ্ঞেস করে ‘হ্যাঁরে মধু, কারো মাথায় ল্যাজ গজায়?’
-‘গজায়ই তো-’
-‘তা-ই? কার- কার রে?’
-‘ওই তো তোর আর তোর বরের-’
ভেঙে যায় ঘুমের আবেশ ‘অ্যাকদম ফালতু বকরবকর করবি না। আমার আবার বর এলো কোত্থেকে?’
-‘আসবে, আসবে’ বলতে বলতে লাজবন্তীর বিনুনি টেনে ধরে বলে ‘ওই তোর ল্যাজ, মাথায় গজিয়েছে, এই ল্যাজ-এর টানেই তোমার ল্যাজওয়ালা বর আসবে এখুনি।’
ক্যান্টিনের সামনে আবারও সেই ছেলেটাকে দেখেই ঢিমিয়ে গিয়েছিল লাজবন্তীর পা। একটু ঘেঁষেই দাঁড়িয়েছিল সে। তারপর ঢুকে যায় তাদের কথায়। ‘আমি বলছিলাম যে,’ বলে ব্রতীনকে দেখায় ‘মানুষের যদি বিছের মতো হুলওয়ালা ল্যাজ থাকতো – তবে ম্যাটার অব সিকিউরিটি বেশি হ’ত অনেক।’
-‘এক্স্যাকট্লি, আমি এই কথাই বলছিলাম, দ্যাখ হনুমানরা তাদের ল্যাজ কাজে লাগায় অনেকটা। অ্যাকরডিং টু এপিক রেফারেন্স হনুমান ল্যাজকে ব্যবহার করেছিল লঙ্কাকাণ্ডে। অঙ্গদ রাবণের সভায় গিয়ে উচ্চাসন না পেয়ে ল্যাজকে বাড়িয়ে নিয়ে তার প্যাঁচ মেরে মেরে নিজের বসবার আসন কে টপ হাইট দিয়েছিল। তার মানে এক ইউটিলিটি, ইউটিলাইজেশন অব ল্যাজ অ্যান্ড ইট্স্ ইলাসটিসিটি –
মার্ক কর ডারউইন – ’
-‘আর ডারউইন, তুমি তো বাবা ডারউইনের লয়-ও নামাচ্ছো, এরপর বলবি, মানুষেরও মাথায় শিং, পায়ে খুর, হাতে নখ, নাকে খড়্গ, পেটে ক্যাঙ্গারুর মতো থলে – পটিতে গোবরের পবিত্রতা-’
-‘বাজে বকিস না, আমি বলছি ল্যাজের ইউটিলিটির কথা, আর মানুষের তো ল্যাজের জন্য একটা আকুলতা আছেই।’
-‘যে তোর মতো মানুষের আছে, আমাদের মতো-’
-‘ইনি তো ঠিকই বলছেন’ বলে ব্রতীনকে দেখিয়ে আবার বলে মধুমিতা।
-‘কী? কী ঠিক বলছে? মানুষ ল্যাজ চায়?’
-‘চায়-ই তো, নইলে মেয়েরা মাথায় পনিটেল করে কেন?’
-‘অ্যাঁ!’ তন্ময় ভ্যাবাচ্যাকা। সকালের সেই স্বপ্ন আসলে পিছু ছাড়েনি লাজবন্তীর। আর ব্রতীনকে ওভাবে আক্রান্ত হ’তে দেখামাত্রই তারও মাথায় গজালো সমর্থনী বাচনের তাৎক্ষণিক ল্যাজ।
হালে পানি পায় ব্রতীনও। ‘হ্যাঁ, তারপর ধর টেল-কোট, সে তো একদম ল্যাজওয়ালার লুক। তায় আবার হুঁকোমুখো হ্যাংলার মতো ডবল ল্যাজ!’
-‘বেশ। খুব ভালো, খু-উ-উ-ব ভালো, আমি চললাম, তোমরা নিজেদের ল্যাজ গজাবার জন্য সাধনা – আরাধনা- উপাসনা- কূপাসনা সব করো।’ বলে একটু তাড়াতাড়িই চলে গিয়েছিল বিরক্ত তন্ময়।
‘আচ্ছা, আপনার কী ল্যাজ-’ ব্রতীনকে সামনে পেয়ে গত বিকেলে মাধবীদিকে করা প্রশ্নটাই দৌড়ে আসে হুড়মুড়িয়ে ,আর খুবই কাতর দুঃখী অসহায়তার শেষ বিন্দুতে দাঁড়িয়ে মাথা নীচু করে, ইস্কুলের পড়া না-পারা ছেলের গ্লানি মেখে বলে ‘ ‘না – এখনও তো নেই-’
-‘না, না, আমি, ছি ছি, আপনার-’
-‘না, দেখুন, ইয়ে, সত্যি সত্যি না থাকলেও, একটা সাবস্টিটিউট বোধহয় থাকবে-’
বলে একটু দাড়ি খামচায় ব্রতীন।
-‘দেখুন, আমি কিন্তু আদৌ আপনার ল্যাজ আছে কি না এমন কথা জিজ্ঞেস করিনি – ল্যাজ নিয়ে আপনি গবেষণা করছেন কিনা, আমার প্রশ্নটা তাই, একটু উত্তেজনাতেই সেনটেন্সটা হয়ে যাচ্ছিল, আপনার কী ল্যাজ নিয়ে রিসার্চ চলছে, মানে-’
-‘ও, না। আমার পিএইচ-ডি-র কাজটা জেনেটিক্সের যে ধারায়, তা আলাদা- আর ল্যাজ মানে, এই আপনার ল্যাজের ব্যাপারটা আমার খুব, খুব, মানে খুবই একটা প্যাশন বলতে পারে। আমি চাই মানুষের ল্যাজ গজাক। ল্যাজ মানুষের দরকার-’ খুবই উৎসাহের সঙ্গে তড়বড়িয়ে কথা বলতে বলতে, হঠাৎ ঝিমিয়ে যায় ব্রতীন ‘দেখুন, আমি সত্যি খুব বাজে বকছি’
-‘কেন? এখানে বাজে বকার মতো কোনটা বললেন? ল্যাজ আপনার প্যাশন – আমারও তো-’
-‘অ্যাঁঃ?’ প্রায় লাফ দিয়ে ওঠে ব্রতীন। লাজবন্তীর মনে হয় যদি বেচারার ল্যাজ থাকতো, তবে হয়তো লাফটা জোরালো হ’ত আরও, হয়তো, দু-চারটে হুপ-হুপ-হর্রাও জাগতো সঙ্গে সঙ্গে!
-‘হ্যাঁ’ যথাযথ লাজবন্তী, কন্ঠস্বরেই সে বলে,’ আমারও না ল্যাজ খুব ভালো লাগে- দেখুন না দেখুন – ’
খুবই উৎসাহের সঙ্গেই তাকায় ব্রতীন। কিন্তু কামিজের আড়াল থেকে ল্যাজের বদলে কাঁধের ঝোলায় হাত ডুবিয়ে বার করে আনে একটি খাতা। তুলে দেখায় তার পাতায় পাতায় কত কত মানুষের ল্যাজনম্র ছবি এঁকেছে সে। ব্রতীনও আনন্দে বার করেছিল তার খাতা।
সেই যে তারা পরস্পরের ল্যাজসম্ভার নিয়ে বসেছিল ক্যান্টিনের টেবিলে, তারপর অতিক্রান্ত হয়েছে সপ্তাহ-মাস-বছর, দু’বছর। লাজবন্তী পাশ করেছে এমএসসি। ব্রতীন পেয়েছে পিএইচডি। কিন্তু ব্রতীন ল্যাজ গজাবার গবেষণায় ভীষণরকম নিমগ্ন।
নানারকম প্রাণীর ল্যাজের গঠন আর সঞ্চারের ক্রিয়া নিয়ে রীতিমতো নিরীক্ষাশীল ব্রতীন একরকম বাড়িছাড়া। একমাত্র তন্ময় তার আকৈশোরের বন্ধুর জন্য প্রবল অনুরাগ আর দুর্বলতায় তাদের সাবেকি বাড়ির বাতিল আউটহাউসটা ছেড়ে দিয়েছে।
সুকুমার রায়ের হ য ব র ল –র সেই হিজিবিজবিজ বিবৃত চরিত্রের মতোই ব্রতীন টিকটিকি পুষেছে এক রাশ। শুয়োর, খরগোশ, গিনিপিগ, দুটো বাছুর। বলতে গেলে ভোর হওয়ামাত্র তাদের নিউ আলিপুরের ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে আসে তন্ময়ের গড়িয়ার বাড়িতে ‘তোদের বাড়িরই শালা এমন ল্যাজ, আর সেই বাড়ির ছেলে হয়ে তোর ল্যাজ নেই- এ-কথা ভাবা যায়?’
-‘তা তোর মতলব কী?’
-‘বিশেষ কিছু না, এই টিকটিকির ডিএনএ-র একটা এক্সট্রাক্ট নিয়ে একটা সিরাম বানাচ্ছি বুঝলি। ল্যাজওয়ালা, ল্যাজখষা, নতুন ল্যাজ গজানো – এই তিন অবস্থায় ইনটারনাল সিস্টেমের যে টোটাল প্যাটার্ন তার চেঞ্জেস, ওটা থেকে একটা সিরাম তৈরি করেছি, যেটা গিনিপিগদের দিলাম, বুঝলি, খাটলে তোকেও দেবো!’
-‘নিজের বাপকে গিয়ে দিয়ে আয়, যেন পরের জন্মে ল্যাজওয়ালা বাচ্চা পায়- তুই তো মাল ভয়ংকর জীব। নিজেকে ওই ইনজেকশান দে শালা!’
-‘দেবো- নিশ্চয় দেবো। নিজেকে দেবো, তোকে দেবো, শুকদীপকে, লাজবন্তীকে-’
-‘ওই মেয়েটা শালা, আরেকটা হারামির আঁটি, ল্যাজ, ল্যাজ ক’রে তোকে বার খাইয়ে, তোর মাথা, ফিউচার সব খাচ্ছে, তোকে স্রেফ ল্যাজে খেলাচ্ছে- বুঝলি ল্যাজে-’
-‘যাঃ, ল্যাজ থাকলে তো খেলাবে-’
-‘ও ল্যাজ বাবা, পেছনে গজাবার নয়, ও ল্যাজ থাকে মাথায় ঠোসে পাছায়-’
-‘তবে স্বীকার করলি তো-’
-‘কী?’
-‘মানুষের ল্যাজ থাকলে তা কত বেশি সক্রিয় হ’ত-’
খুবই হতাশভঙ্গিতে দুই হাতের পাটা উল্টে বিনাবাক্যে ঘর ছেড়ে চলে যায় তন্ময়। নিজের মনেই একটু ফিক করে হাসে ব্রতীন। একটা সিগারেট ধরিয়ে প্রথম আরামের টানটা দিয়ে চলে আসে তার ওয়ার্ক টেব্ল-এ। আজ লাজবন্তী আসবে একজন অ্যাসিস্ট্যান্টকে নিয়ে। যতক্ষণ না আসে ততক্ষণ নকল ল্যাজ তৈরি করে তাকে অ্যাক্টিভেট করানোর কাজটা সেরে রাখবার। ছোট ছোট দেশলাই বাক্সের মতো প্রায় ফুট ছয়েক লম্বা একা চর্ম বর্ণ ফাইবার চেন বার করে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার সংযুক্তিটা পরীক্ষা করলো ব্রতীন। প্রথম তিনটে বাক্সের মধ্যে নেগেটিভ পজিটিভ করে বসালো ছ-টা পেন্সিল ব্যাটারি। বাক্সর ওপরকার বোতামে চাপ দিয়ে দেখলো তার সূচাগ্রমুখ ডগার সঞ্চালন। ছোট ছোট বারোটা ফাইবারের টোপর পাঁচটা – পাঁচটা করে বসিয়েছিল সেই ডগার পাতের ওপর। পাতের গায়ে দুই সারি, আর পাতের সামনের পাড়ে আরো দুটো। বসানোর পর, সুইচ অন করে বোতাম টিপতে থাকে – আর সেই চেনটিও সঞ্চালিত হতে থাকে বোতামের দিক নির্দেশিকায়। ‘বাঃ’ প্রগাঢ় পরিতৃপ্তিতে শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেট ফেলে দিয়ে ধরিয়ে নেয় আরেকটা আত্মপ্রশংসার সিগারেট। এটা উদযাপনের।
নটা চল্লিশ। ব্রতীন একটু বিচলিতই। লাজবন্তীর আসবার কথা সোয়া নটায়। এতক্ষণ দেরি? ঘড়িতে আবার তাকায়, নটা একচল্লিশ। বিস্বাদ লাগে সিগারেটের স্বাদ। একটু ছটফট ক’রে গিয়ে দাঁড়ায় দরজায়। আঃ, স্বস্তি। ঝলমলে বাসন্তী বর্ণ শিলওয়ার কামিজ, তার ওপর শৈবাল বর্ণ ওড়না, লাজবন্তীকে দেখামাত্র ব্রতীন উচ্ছ্বসিত, ‘তুমি এত দেরি করলে কেন? এস শিগগির ঘরে এস -‘ বলে হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান, টাল সামলাতে না পারা লাজবন্তী হোঁচট খায় চৌকাঠে। কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা ধাতব সব্দ ‘উফ্, কী যে করো, দাঁড়াও, ঢাকনা খুলে গেলো বোধহয়-’
-‘ওসব ঢাকনা পাখনা থাক, তোমার ঢাকনাটা তোলো তো- জামাটা তোলো-’
ব্রতীনের মুখে এ-ধরণের কথা লাজবন্তীর কাছে অপ্রত্যাশিত। তবে নিজের ঢাকনা না সরিয়ে ব্যাগে হাত চালিয়ে বের করে আনে একটি পলিথিন প্যাকেট মোড়ানো টিফিন বাক্স। ‘নাও- আগে একটু খেয়ে নাও, তারপর ওসব অসভ্যতা ক’রো। নাও, আজ আমার জন্মদিন তো, তাই একটু পায়েস এ-’
-‘অসভ্যতা? অসভ্যতার আবার কী হ’ল!’ একটু বিরক্ত হয়েই ব্রতীন বলে ‘পায়েস-টায়েস পরে, আগে চট করে তোমার জামা তোলো তো-’
বলতে বলতেই, একটু পিছু ঘুরে, টেবিল থেকে সেই লম্বা চেন তুলে নিয়ে চলে আসে লাজবন্তীর সামনে, হতভম্ব লাজবন্তীর কামিজের কিনার ধরে তা তুলে আনে তার শিলওয়ারের কোমর বরাবর। নারীর স্বাভাবিক লজ্জাবোধের প্রতিবর্ত ক্রিয়া হারানো লাজবন্তীর চোখ বা চোখে ভাসা জিজ্ঞাসা যেন আর আঁটেনা চোখের মাপে। ‘কী’হল এরকম দাঁড়িয়ে কেন? জামার কিনারটা ধরে পেটের কাছে ধরে রাখো।’ আর তা-ই করে লাজবন্তীর হাত। ব্রতীন তার কোমরে বেড় দিয়ে পরিয়ে দেয় সেই শৃঙ্খল-সদৃশ বেল্ট। ‘দাঁড়াও এক কাজ করো- নাও-’ বলে কামিজের নিম্নপ্রান্ত তুলে গিঁট বেঁধে দেয় সেই বেল্টের এক সেন্টিমিটার মতন ওপরে। ‘নাও এবার, সবুজ বোতামগুলোয় ইচ্ছে মতো চাপ দাও। লাজবন্তী প্রথম বোতামে চাপ দেওয়া মাত্র সপাৎ ক’রে সেই ফাইবার চেন খুলে গিয়ে আছড়ে পড়ে টেবিলের গায়। ‘নাও, এবার পরের সবুজ বোতামে চাপ দিয়ে, তার ডান, বাঁ, ওপর-নীচ যেরকম অ্যারো মার্ক, তাতে ইচ্ছে মতো চাপ দাও’ লাজবন্তী বোতাম টেপে, সেই চেন ডান পাশ – বাঁ পাশ করে ওপরে নীচে ওঠে নামে। ‘নাও এবার তিন নম্বর বোতামে চাপ দাও’। চাপ দেওয়ামাত্র চেন আরেকটু লম্বা হয়ে তার সেই ডগাকে আছড়ায়। ‘ও মা! এটা কী?’
-‘এর নাম বৃশ্চিকা। মানে বিছের ল্যাজ। তুমি এই ল্যাজটা পরবে? দ্যাখো, এবার হলুদ বড় বোতামটা টেপো।’ লাজবন্তী নির্বাক আজ্ঞাবাহিকা। চেন আবার গুটিয়ে এলো কোমরে। ‘বুঝলে? এর নাম বৃশ্চিকা দিলাম। মেয়েরা এটা প’রে চলাফেরা করলে, ইয়ে, মানে কেউ যদি অসভ্যতা করতে আসে, তো দরকার এটা তাদের আত্মরক্ষার অস্ত্র – ’
-‘ওরে ব্ বাবা!! তুমি এটা বানালে?’ উচ্ছ্বসিত লাজবন্তী প্রায় লাফিয়ে এসে হামলে পড়ে ব্রতীনের ওপর, একরকম অসভ্যতারই মুদ্রায়।
সেদিন লাজবন্তী যতক্ষণ ব্রতীনের সেই ঘরে ছিল, ক্রমাগত তার সেই কটিজড়িত লাঙ্গুলকল্পকে ঘুরিয়েছে, ফিরিয়েছে, নাচিয়েছে, কাড়িয়েছে, কাল্পনিক অসভ্যতাকারীদের অনাচার থেকে নিজেকে বাঁচিয়েছে, অন্তত বাঁচাবার মহড়া নিয়েছে। মোদ্দা কথা যেন, প্রাণ জুড়িয়েছে তার।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তেমন খুশি হ’ল না ব্রতীন ‘নাঃ, এতো নকল। আমি চাইছি একদম আসল ল্যাজ। দুটো শুয়োরকে হনুমানের জেনেটিক কম্পোনেন্ট-এর ইনজেকশন দিয়েছি, এরপর আরো দুটো মেল আর ফিমেলকে ইনজেকট করবো – তারপর দেখতে হবে, তাদের কন্ডিশন, আর তাদের বাচ্চা হ’লে তারা – ’
‘বাঁদরে শুয়োরের বাচ্চা হয় কি না! অ্যাঁ?’
লাজবন্তী নিজে হাসলেও, ব্রতীন হাসে নি। ‘আসলে যে গিনিপিগগুলোকে ইনজেকশন দিলাম, তারা মরে গেল।
-‘ওরকম তো একটু-আধটু হবেই। তুমি একবার বাঁদর নিয়ে পরীক্ষা করো তো – বাঁদরকে হনুমানের ডিএনএ-’
-‘না। আমার একটা স্টেপ ভুল হচ্ছে – ’
-‘কী?’
-‘শুধু তো অন্য প্রাণীর ডিএনএ চাপালে চলবে না, সেই প্রাণীর যে বেসিক প্যাটার্ন তাকেও তো পার্শিয়ালি কন্ট্রোল করতে হবে।’
-‘কেমন ক’রে করবে?’
-‘সেইটাই ভাবছি। তা তুমি এটা ব্যবহার করবে? মানে এই ল্যাজটা, আচ্ছা জামার গিঁট খুলে, এবার একটু মুভমেন্ট করাও তো।’
কিন্তু তা হ’ল না। কামিজের কাপড়ের ঘেরাটোপ উতরে বাইরে এল না সেই ল্যাজ। ‘নো প্রবলেম, আমি কামিজের উপরেই ওটা পরে নিচ্ছি।’ বলে সেই ল্যাজ খুলে নিয়ে জামার ওপর দিয়েই তা বেঁধে নেয় লাজবন্তী। আবারও বোতাম টিপে টিপে দেখে, তার নবলব্ধ ল্যাজের সক্রিয়তা। ল্যাজ নাড়াতে নাড়াতে ব্রতীনকে পায়েস খাওয়ায় সে।
‘এই, আজ তোমার জন্মদিন বললে না?’
-‘হ্যাঁ – তো।’
-‘তাহলে এটা তোমায় আমি তোমার জন্মদিনের উপহার দিলাম!’ খুবই গর্বিত দেখালো ব্রতীনের মুখ। আর অমন অভাবনীয় উপহারে বিহ্বলতর লাজবন্তী একটু থমকালেও, শেষ পর্যন্ত আলোমাখা মুখে গেয়ে ওঠে ‘এ নতুন জন্ম আমার –’
গড়িয়া থেকে হাতিবাগান, লাজবন্তী বাড়ি ফিরেছিল অপার্থিব উল্লাসে আর অমেয় হতাশায়। তাবৎ পৃথিবীতে সেই একমাত্র নারী, যার নকল হ’লেও একটি ল্যাজ আছে! কিন্তু কলকাতার পথে অসভ্যতা করবার মতো ছেলের এত অভাব কেন, তার যন্ত্রণা ছিল প্রতিপদে। মাঝে মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে একবার, দুবার বোতাম টিপেছে – ভিড় মেট্রোয় তা সক্রিয় হয় নি তেমন। সিট পেয়েও না ব’সে, তা ছেড়ে দেয় এক প্রৌঢ়কে। গিরিশপার্কে ভিড় একটু হালকা হলে আরেকবার বোতাম টিপলে, তা পেছনে দাঁড়ানো এক ভদ্রমহিলার গায়ে লাগে ‘অ্যাই – তুমি অমন করে আমার পেটে সুড়সুড়ি দিচ্ছ কেন?’, এ কথায় মনে মনে জিভ কেটে, হলুদ বোতাম টিপেছে, তার ঠিক এক ফুট পেছনে দাঁড়ানো এক গোবেচারা মতন লোকের দিকে। ‘অ্যাই-অ্যাই, আবার, আবার তোমার – ’ বলতে বলতে সেই ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ তোমার কেমন বেল্ট?’
-‘বেল্ট নয় ল্যাজ।’ বেশ গর্বের সঙ্গে উত্তর দিয়ে, আরেকটু ল্যাজ নাড়িয়ে শোভাবাজার-এ নেমে পড়ে লাজবন্তী।
‘কী রে কোথায় গিয়েছিলি? একেবারে বেলা গড়িয়ে ফিরলি?’ মা-র প্রশ্নে ঝাঁঝ থাকলেও রাগ ছিল না। তা ছিল মধুবন্তীর ‘তোর জন্য অপেক্ষা ক’রে বসে আছি – কোথায়-’
-‘গড়িয়ায়।’
-‘কেন, গড়িয়ায় কী আছে?’
-‘ল্যাবরেটরি।’
-‘গড়িয়ায় ল্যাবরেটরি? কার? কীসের?’
-‘ব্রতীনের।’
-‘ও, তুই ব্রতীনদার কাছে গিয়েছিলি? তা ওর তো পিএইচ. ডি হয়ে গেছে – এখন?’
-‘নতুন গবেষণা করছে।’
-‘তা করুক। আচ্ছা-আচ্ছা, আজ তোর বার্থ ডে তে ব্রতীনদা কী গিফট্ দিল রে-’
সবুজ বোতাম টিপে সড়াৎ করে ল্যাজ বের করে, আরেকটা বোতামে চাপ দিয়ে সপাটে আছড়ায় মধুবন্তীর গায়ে ‘এই ল্যাজটা।’
লাজবন্তীর মা আর চুপ করে থাকতে পারলেন না ‘ল্যাজ! ল্যাজ দিল মানে কী?’
সুতরাং পুনর্বার ল্যাজের কার্যকারিতা মাকে দেখায় সে। স্নানের পর বারান্দায় গামছা মেলতে এসে লাজবন্তীর বাবা ‘এই তো, এসে গেছিস, আয় এবার একসঙ্গে খেতে বসবো, কী যে তোর মা বলে! একটু দেরি হ’ল তো-’
-‘তাই তো, মা তো সর্বদাই খারাপ কথা বলে। কিন্তু আজ যা হ’ল এরপর কী বলবে?’
-‘কেন কী হয়েছে?’
-‘তোমার মেয়ে, তোমার গুণধর মেয়ে আজ ল্যাজ নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। বোঝো।’
-‘মানে? কী যে বলো, ল্যাজ নিয়ে, তা আমার পাগলীটার তো বরাবরই একটু ল্যাজ ল্যাজ বাই-’
-‘আর বাই নয়, তোমার মেয়ে নাকি ল্যাজ নিয়ে ফিরেছে!’
-‘কে? কে ওর ল্যাজ? জামাতা বাবাজীবন না কি!’
বাবার স্নেহার্দ্র গলায় ভরসা পেয়ে লাজবন্তী ঘর থেকে এগোয় বারান্দায়, কোমরের বোতামে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাবাকে দেখায় ল্যাজের ক্রিয়াকর্ম। ‘কে দিলে রে? কিনলি?’
-‘না বাবা। ব্রতীন দিয়েছে। জন্মদিনে।’
-‘হুঁ, তবেই তো হ’ল। তোর সেই ল্যাজবন্তী নাম সার্থক হ’ল এদ্দিনে।’
-‘বাবা।’
-‘বল।’
-‘বা-বা-’
-‘ব-ল-’
-‘বা-বা-’
-‘কী বলবি বলই না-’
-‘বলছি এবার আমার বিয়ে দেবে?’
-‘বটে, বটে! নিশ্চয় দেবো। কিন্তু কার সঙ্গে?’
-‘আগে বলো দেবে-’
এবার স্নেহার্দ্রতার প্রলেপ সরে যায়। ‘কার সঙ্গে- ছেলে কেমন- এসব না জেনে তো-’
-‘খুব ভালো ছেলে বাবা। খুব ভালো, ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট, এমএসসি-তে ফোর্থ হয়েছিল, ডক্টরেট করেছে, প্রফেসারি পাবেই প্লাস পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চের কাজও করছে-’
-‘তা তো হ’ল। ছেলে ভালো বুঝলাম। চাকরি পাবে তাও বুঝলাম। কিন্তু তার নাম কী? কেমন বংশ? রাঢ়ী না বারেন্দ্র না বৈদিক – তারপর আমাদের তো শান্ডিল্য – শান্ডিল্য হ’লে চলবে না। এরপর ঠিকুজি –’
-‘চিন্তা করো না গোত্র নিয়ে ভাবনা নেই – ওর নাম ব্রতীন্দ্র দত্ত –’
-‘দ-ত্ত! আমরা হলুম বাঁড়ুজ্যে, এর মধ্যে দত্ত আসে কোত্থকে। এ নিয়ে আর একটিও কথাও বলবে না।’ বাবার গলায় নিমেষেই মাখনের বদলে শিরিষ কাগজ। মা-র মুখেচোখে খুশির দমক। মধুবন্তী সরে যায়।
এই ঘটনার পরেও কেটেছে সপ্তাহ। মাস-দুমাস-তিনমাস।
লাজবন্তী ব্রতীনকে বলেছে, ‘আমি তোমাকে ছাড়া আর কারোক্কে বিয়ে করতে পারবো না। তুমি চলো, সরাসরি বাবার সঙ্গে কথা বলবে।’
-‘আমিও তোমাকে ছাড়া বিয়ে করতে পারবো না অন্য কাউকে। বেশ যাবো, তা তিনদিন বাদে যাই?’
-‘কেন? তিনদিনে তোমার কী ল্যাজ গজাবে?’
-‘তা পারে।’ বলেই একটু লাজুক হাসে ব্রতীন।
তিনদিন পর ব্রতীন বলে, ‘চলো আজ তোমাদের বাড়ি যাই।’ বলে ব্যাগ থেকে বের করে দেখায় স্টেট্স-এর এক ইউনিভারসিটির চিঠি ‘আমার অ্যাপ্লিকেশনের অ্যাকসেপট্যান্স লেটার। মেল করেছিল আগেই। এবার চিঠি পেলাম- ওখানকার একটা ল্যাবরেটরিতে-’
-‘আচ্ছা। আচ্ছা। চলো, চলো তো আগে।’
লাজবন্তীর বাড়িতে ব্রতীনের অভ্যর্থনা ছিল কুমেরু কঠিন শীতল। ব্রতীনের কোনো একটি কথারও জবাব দেন নি লাজবন্তীর বাবা। মা এসে প্লেটে দিয়েছিলেন কয়েকটি মিষ্টি আর গরম শিঙাড়া। তা-ও ধরাই থাকে। পর্দার আড়ালে কান্নায় ভাসছিল লাজবন্তী। প্রায় একঘণ্টার নীরবতা ভেঙে ব্রতীনই বলে, বেশ তবে আমি যাচ্ছি।’ ঘাড় নাড়িয়েই সৌজন্য আর নীরবতা দুই-ই রক্ষা করেছিলেন লাজবন্তীর বাবা।
গড় বঙ্গীয় পরিবারে যা হয় ব্যতিক্রম ঘটেনি তার। বাবার যাবতীয় স্নেহ পলকেই রুক্ষতার ব্লটিং পেপারে, কোলেস্টেরল, প্রতিষেধক ওষুধে বা তেলেভাজার কড়াই নিমেষেই কাঠখোলার আবার শুকনো খট্খটে। বন্ধ হয়ে যায় তার বহির্পৃথিবীর অধিকার। এমনকি বাজেয়াপ্ত হয়ে যায় কথাযন্ত্রটিও। তবু অন্যরকম প্রতি কৌশলে লাজবন্তী আবারও যোগাযোগ করে ব্রতীনের সঙ্গে। গড়িয়ার সেই বাড়িতেই অনেকটাই বিমর্ষ ব্রতীন তার গবেষণায় ব্যস্ত। মুখে মাসখানেকের দাড়ি, গাল যেন অনেকটাই বসে গেছে, চোখও খানিকটা যেন ভয়ে ভয়ে লুকিয়ে পড়েছে ভুরুর আড়ালে। খোলা দরজা দিয়ে ঢুকেই বিশীর্ণ মূর্তি ব্রতীনকে দেখে কেমন আঁতকে ওঠে লাজবন্তী ‘এ কেমন চেহারা হয়েছে তোমার?’ হাতের বীকার, টেস্টটিউব রেখে ব্রতীনও দৌড়ে এসেছিল লাজবন্তীর কাছে, দুই হাতে জাপটে নেয় নিজের শরীরে, সম্ভব হলে হয়তো লুকিয়ে ফেলতো পাঁজরার খাঁচার আড়ালেই।
সেই আড়ালের আশ্রয়েই ব্রতীনকে সমস্তই বললো লাজবন্তী। দাড়ি খামচে ব্রতীন বলে ‘তাহ’লে?’
-‘ত্যা হ্যা লে? ত্যা হ্যা লে, সমস্তই কি আমি বলবো? চলো, তোমার বাড়ি আমায় নিয়ে চলো। আমি আর বাড়ি ফিরবো না।’
-‘না, না, ওরকমটা ক’রো না। আমায় ভাবতে দাও একটু।’
-‘ভাববার সময় নেই ব্রতীন, বাবা যে অমন পুরো একশো আশি ডিগ্রি উল্টে যাবে ভাবতেই পারি নি।’
-‘ওটাও তোমারই ভাবনার ভুল। তিনি ঠিকই আছেন। আগে এ নিয়ে কোনো কথা হয় নি, জানতে পারো নি। আচ্ছা, আমি আরেকবার যাবো।’
-‘না, না, যেয়ো না। আবার তোমায় অপমান-’
-‘কিচ্ছু অপমান নয়, ট্রাই টু থিঙ্ক দ্য ম্যাটার ফ্রম হিজ স্ট্যান্স – এই ধরোনা কেন, আমাদেরও তো ছেলেপুলে হবে, মনে করো ছেলে এসে বললে সে একটি ক্যানিবাল মেয়েকে বিয়ে করবে-’
-‘যাঃ’
-‘মনে করো মেয়ে এসে বললো, সে সাপের মতো বিষদাঁতওয়ালা চারফালা জিভের একটি ছেলেকে বিয়ে করতে চায়, মানতে পারবে?’
-‘না। তবে? তোমার বাবা-ই বা ল্যাজওয়ালা জামাই-এর বিষয়ে তার বিষদাঁত বসাবেন না কেন?’
-‘বাবার আবার বিষদাঁত কোথায়? তোমারই বা ল্যাজ-’
-‘ওটা কথার কথা, তোমাকে বকাবকি করে বিষ সব বেরিয়ে গিয়েছিল ব’লে সেদিন চুপ ক’রে বসেছিলেন। দ্যাখো না, পরের দিন কী হয়!’
-‘কী হবে?’
-‘হবে, হবে, ধৈর্য ধরো। গবেষনার প্রথম শর্ত কার্যকারণ সূত্রে কল্পনা। দ্বিতীয় শর্ত দুঃসাধ্য কল্পনায় কার্যকারণসূত্র আবিষ্কার। তৃতীয় শর্ত, একাধিক কার্যকারণসূত্রে সমন্বয়। চতুর্থ শর্ত, সেই সমন্বয়কে ফলিত আকারে দেখবার ধৈর্য।’
-‘ওফ্ তোমার কথাগুলো যেন বি.কে.র লেকচার – ’
-‘বিকে-র লেকচার হোক, টিকে-র তামাক হোক ওটা একদম আলটিমেট স্টেপ ডিভিশন – একটু ধৈর্য ধরো।’
-‘ধরলাম।’
-‘কী ধরলে? কোথায়?’
-‘ওই যে ধৈর্য – ’
-‘শুনলাম ধরলে, কিন্তু ধরবার প্রমাণ কোথায়? কী ধরলে বুঝলাম না তো কিছুই!’ এগোয় ব্রতীন, ‘দ্যাখো ধরতে হয়, এই, এই, এইভাবে’ বলে লাজবন্তীর দুই বাহুতে গেঁথে দেয় তার করতল, ‘উঁ-উঁ-উঁ না-না-’ নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার একটা নকল চেষ্টা করতে করতে ‘ধৈর্য ধরতে হবে – ধৈর্য একটা অ্যাবস্ট্রাকট – ধৈর্যটা অমন খাবলে ধরবার নয়-’
-‘সে তোমার নয়, বা তোমার কাছে নয়, কিন্তু আমার ধৈর্যর ব্যাপারটা তো না ধরলে বুঝবে না-’ ব্রতীন তার হাত দিয়ে লাজবন্তীর হাত টেনে নিয়ে যায় নিজের পশ্চাদ্ভাগে, মেরুদণ্ডের নিম্নতম প্রান্তে। লাজবন্তীর হাত বোঝে অন্তত ব্রতীনের মেরুদন্ড শেষ নয় সেখানেই তা ঈষৎ প্রলম্বিত। ভদ্রতাশোভন লজ্জা ভুলে ব্রতীনের করতল, নিরপেক্ষভাবেই লাজবন্তীর হাত এগোতে থাকে – একটু একটু, একটু,একটু, একটু, – লাজবন্তী টের পাচ্ছিল ব্রতীনের হৃৎস্পন্দন। আর ব্রতীনও তো, লাজবন্তীর উৎকণ্ঠায় মর্মকথা। ফুরিয়ে যায় ব্রতীনের শিরদাঁড়ার নিম্নাবতরণ, এবার ব্রতীন একটু আন্দোলিত করে তাকে। ‘এই, শোনো’
-‘বলো।’
-‘একটু দেখাবে?’
-‘কী’
-‘কী আবার, তোমার ইয়ে-’
-‘ইয়ে আবার কোনটা-’
-‘ল্যাজ গো ল্যাজ – দেখাবে?’
-‘আচ্ছা-’ ব্রতীন ডান হাত পেছনে চালিয়ে, পায়জামার পেছনে করানো একটি বৃত্তাকার দ্বারপথ দিয়ে বার করে দেখায় তার ফুটখানেক লম্বা ল্যাজ, রঙ ব্রতীনের গায়ের রঙের মতোই ঈষৎ মৃদু তাম্রাভ। গোড়ায় চমৎকার তুলির ডগার মতো সুচারু রোমগুচ্ছ। ‘জানো এটা দিয়ে তুলির কাজ করা যাবে, দেখবে?’ বলে একটা টুল টেনে উঠে দাঁড়ায় টেবিলে রাখা কাগজের ওপর পাশে থাকা রঙের প্যালেট-এ ল্যাজ নাড়িয়ে রঙ মাখিয়ে বোলায় কাগজের ওপর। ‘জানো আরো বড় হলে ল্যাজ সামনে এনেই ছবি আঁকতে পারবো!’
-‘তুমি খুব পাজি, জানো?’
-‘কেন? এর মধ্যে পাজির কী আছে?’
-‘কেমন আমাকে বাদ দিয়ে একা একা ল্যাজ গজিয়ে নিলে – ’
-‘কেন তোমার জন্য তো-’
-‘ও তো নকল-’
-‘হবে, হবে, তুমি চাইলে আসলও হবে, আমার যখন হয়েছে, তখন তোমারও হবে।’
-‘তবে হয়নি কেন?’
-‘মানে এর জন্য তো অনেক পরীক্ষা-টরিক্ষা লাগে, তারপর তোমার কনসেন্ট-’
-‘জানোই তো আছে-’ প্রগাঢ় গলায় ব্রতীনের বাহুবন্ধে ডুবে থাকা লাজবন্তী প্রবল এক কামাত্মক আবেশে হাত বোলাচ্ছিল ব্রতীনের ল্যাজে ‘কতদিন হ’ল গো? আর কতটা বড় হবে?’
-‘ধৈর্য – ধৈর্য – আমার ওপর ভরসা আছে?’
-‘ওরে বাবা! এমন ল্যাজ গজিয়ে তোলা লোক, তার ওপর ভরসা থাকবে না।’
ব্রতীন তার বাবাকে পাঠিয়েছিল লাজবন্তীর বাড়িতে। ঠিকুজিসহ। সেদিনও লাজবন্তীর বাবা বসেছিলেন প্রায় নীরব। ‘আমার মেয়ে না-হয় বোঝেনি, আপনার ছেলেও না-হয় জানে না, কিন্তু আপনি কেমন করে বামুনের বাড়ির মেয়ের সঙ্গে আপনার ছেলের বিয়ের সম্বন্ধ আনেন!’ কুষ্ঠী রেখে চলে এসেছিলেন ব্রতীনের বাবা। লাজবন্তী জানিয়েছিল তার জন্মপত্রিকার সঙ্গে নাকি সে কুষ্ঠী একেবারে বেমানান!
‘তোমাকে তো বলছি, চলো ম্যারেজ রেজিস্ট্রারকে নোটিস দাও। আমি সাবালিকা-’
-‘আমি আরেকবার যাবো।’
-‘একবার কেন হাজারবার যাবে, কিন্তু –’
-‘কিন্তু টিন্তু না আমি আজই যাবো – চলো।’
লাজবন্তীর বাড়ির কাছাকাছি এসে, হঠাৎ করে দুটো বাড়ির মৃদু ব্যবধানের আশ্রয়ে সেঁধিয়ে যায় ব্রতীন। তারপর বেরিয়ে আসে আবার, ‘এবার দ্যাখো’। লাজবন্তী দেখে আরো ফুট তিনেক লম্বা হয়েছে তার ল্যাজ। সড়াৎ করে গুটিয়ে নেয় পেছনে। অফিস থেকে ফিরে ব্রতীনের বাবা বসেছিলেন ক্লান্তিহর দীর্ঘকায় আরামকেদারায়। ব্রতীন ঘরে ঢুকে বলে ‘বিয়ের কথাবার্তা বলতে এলাম।’
-‘বলো। কিন্তু আমার যা বলার তা তো বলেছি-’
-‘না বলেন নি। অন্তত আপনি জানেন না যে আপনি বলেন নি। এই দেখুন –’
বলে ব্রতীন তার ল্যাজ বাড়িয়ে, সেই সুন্দর তুলির মতো ল্যাজের ডগা বাড়িয়ে তা বোলায় লাজবন্তীর বাবার পায়ে। একটু চমকে ওঠেন তিনি ‘অ্যাই –অ্যাই পায়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছ কেন?’
-‘না, না সুড়সুড়ি কেন? প্রণাম, প্রণাম করছি’ বলে সেই তুলির ডগা তুলে নিজের কপালে ছোঁয়ায়।
-‘এঃ এঃ এ –’
-‘এ-টা ল্যাজ। আমার। আমিই গবেষণা করে গজিয়েছি। তবে এবার বলুন, জামাই হিসেবে আমি কেমন?’
-‘অ্যাঁ, ল্যাজওয়ালা জামাই!! আবার ছি- ’
-‘হ্যাঁ, দেখুন আপনি হবেন পৃথিবীর শ্বশুর, যাঁর জামাইয়ের ল্যাজ আছে- ভালো হবে না? সমস্ত পৃথিবীতে আপনার খ্যাতি হবে – তাছাড়াও, যেদিন লাজবন্তীকে ওই বিছে ল্যাজ, বৃশ্চিকা বানিয়ে দিই, সেদিন তো খুব খুশি হয়েছিলেন শুনেছিলাম! তাহ’লে এবার-?’
-‘আরে সে ছিল নকল ল্যাজ-’
-‘ও, তার মানে আসলের থেকে নকলের কদর বেশি আপনার কাছে? তাহ’লে মনে করুন আমি নকল জামাই-ই হলাম না হয়, ভাবুন এতেও আপনার প্রগতিশীল বলে কত খ্যাতি হবে-’
-‘কচুপোড়া হবে। এর থেকে একটা হনুমানের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দেবো।’
-‘কিন্তু তারও ঠিকুজি কুষ্টি নেই-’
-‘না থাক। তুমি – তুমি – বেরোও – বেরোও আমার বাড়ি থেকে।’
-‘এ কিন্তু একরকমের মূঢ়তা। হনুমান কিন্তু কখনো ল্যাজ দিয়ে প্রণাম করেনি – ’
-‘তারও সেই ভদ্রতা ছিল – যাও, যাও তুমি –’
-‘মাসিমাকেও একটা প্রণাম অন্তত ক’রে –’
-‘মাসিমা! আবার মাসিমা-’
-‘আচ্ছা, চলি তবে-’ বলে ল্যাজ নাড়িয়ে টা-টা জানিয়ে নিষ্ক্রান্ত হয়েছিল ব্রতীন।
এই ঘটনার দিন দশেক পরেই, ব্রতীন লাজবন্তীকে বলে ‘এবার তোমারও ল্যাজ গজাবে।’
লাজবন্তী বাড়িতে ফিরে মা-কে বলে, ‘মা, আর দুসপ্তাহ পরে আমার ল্যাজ গজাবে।’
-‘কী?’
-‘হ্যাঁ। আজ ব্রতীন আমায় ওর আবিষ্কার করা সিরামটা ইনজেকট করেছে।’
-‘কী সব্বনাশ! ওগো আমার কী সব্বনাশ হ’ল গো – যাও আরও মরতে ওই ল্যাজওয়ালা ছেলের সঙ্গে পিরিত করো।’ মধুবন্তীও সব শুনে ভয় পেয়ে বলে –‘তাহ’লে কী হবে রে দিদি?’
-‘জানি না। সত্যি জানি না।’
ওদিকে লাজবন্তীর মা দৌড়ের মুদ্রায় গেলেন লাজবন্তীর বাবার কাছে ‘ওগো শুনছ – আজ ওই ছেলে, তোমার মেয়ের কী সব্বনাশ করেছে!’ লাজবন্তীর বাবা জিজ্ঞাসার আতঙ্কচোখে নিস্পন্দ। ‘তোমার মেয়েকে ওই সব্বনেশে ছেলে ল্যাজ গজানোর ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছে –’
-‘অ্যাঁ!’
-‘হ্যাঁ – এবার দুই সপ্তাহের মধ্যেই তার ল্যাজ গজাবে, যেমন তার নিজের –’
-‘ওকে আমি পুলিশে দেবো। গুন্ডা দিয়ে খুন করাবো। ওর নামে মামলা ঠুকবো।’
-‘সে তো করবে, কিন্তু মেয়ের কী হবে?’
-‘ওর ল্যাজ অপারেশন করাবো।’
-‘কিন্তু এতে লোক জানাজানি হবে, তায় ওই ল্যাজওয়ালা মেয়ের বিয়ে হবে আর!’
-‘তবে?’
-‘আর তবে! সভ্যসমাজে মুখ দ্যাখানো দায় হবে।’
-‘লেজুকে ডাকো-’
লাজবন্তী ঘরে এলো। বাবা সব শুনলেন। অষ্ট্রেলিয়ার কথাও। তারপর বললেন, ‘ওর বাবা ফোন নাম্বার আছে না, থাকলে দাও।’
লাজবন্তীর বাবা ফোন করলেন ব্রতীনের বাবাকে। ‘হ্যালো – হ্যালো – আমি লাজবন্তীর বাবা বলছি।’
-‘হ্যাঁ বলুন।’
-‘আপনার ছেলেকে আমার মেয়েকে বিয়ে করতে হবে।’
-‘উঁ, তা কথা এই আমার ছেলে না-হয় এসব নিয়মটিয়ম জানে না, আপনার মেয়েরও এ-বিষয়ে জ্ঞানগম্যি না-থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু আপনি তো জানেন, কন্যার পিতাকে পাত্রপক্ষের কাছে এসে গলবস্ত্র হয়ে প্রস্তাবটা করতে হয় – ’
-‘হুঃ, গলবস্ত্র, গলবস্ত্রের নিকুচি করেছে, যা ক্ষতি করেছে আপনার ছেলে, আমার মেয়ের তাতে পুলিশে খবর দিলে আপনাকে গলায় দড়ি পরিয়ে নিয়ে যাবে – ’
-‘কেন? আমার ছেলে, এইটুকু জানি, তেমন কোনো গোলমাল করার মতো এলেমদার নয়, তার ওপর সে তো শিগগির বিদেশ চলে যাচ্ছে, তাই আমরা তার বিয়ের ঠিকও করে ফেলেছি, আমাদের পালটি ঘর কুলীন বারেন্দ্র কায়স্থ, বুঝলেন কায়স্থের যে আটঘর, -’
-‘রাখুন আপনার কায়স্থের-’
-‘রাখবো কেন? জানেন তো আমরাও কুলীন কায়স্থ, উপবীত, সংস্কারও আছে-’
-‘আপনার ছেলেকে মোটকথা আমার মেয়েকেই বিয়ে করতে হবে। আপনার ওই হতভাগা বদমাশ ছেলে, মেয়ের যে সব্বনাশ করলো, তারপর-’
-‘দেখুন মেয়ের বাড়িতে কথা বলা হয়ে গেছে একরকম, আর আমার ছেলে কী সব্বনাশ-’
-‘সব্বনাশ মানে সব্বনাশ, আপনার ছেলে আমার মেয়ের ল্যাজ গজিয়ে দিয়েছে-’
-‘কী? কী গজিয়েছে?’
-‘ল্যাজ- ল্যাজ- ল্যাজ বোঝেন?’
-‘ও আবার কেউ কারো গজাতে পারে না কি? আর আপনার মেয়ের ল্যাজ গজিয়েছে? মানে গজিয়ে দিয়েছে? না কী? ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না –’
-‘ওর মধ্যে না বোঝার কি আছে? আপনার ছেলে – বুঝলেন? আমার মেয়ে – বুঝলেন? ল্যাজ গজিয়েছে – বুঝলেন? এই অপরাধে এখন আমি আপনাদের জেল খাটাতে পারি, বুঝলেন?’
-‘না। তিন নম্বর ক্লজ বুঝলাম না। আর যদি কেউ কারো ল্যাজ গজিয়ে দেয়ও। তা-ও কিন্তু কোনো পানিশেবল অফেন্স নয়।’
-‘ও সব কোনো কথা শুনবো না, যদি আমার মেয়ে ল্যাজ গজায় –’
-‘ও! এখনো গজায়নি!! তবে আর ল্যাজ গজিয়েছে বলছেন কেন?’
-‘বাজে কথা বন্ধ করুন-’
-‘বাজে কথার কি আছে! যখন আমি আপনার বাড়ি গেলাম বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে, তখন প্রায় অপমান করেই কথা বললেন না, তা খারিজ করলেন – এখন মেয়ের ল্যাজ গজাবে বলে, আমার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ানোর হুমকি দিচ্ছেন? – তা অমন ল্যাজওয়ালা মেয়ের সঙ্গে আমার ছেলের বিয়ে দেব কেন?’
-‘আপনার ছেলের জন্য আমার মেয়ের ল্যাজ গজাচ্ছে – সে তার রিসার্চের গিনিপিগ বানিয়েছে আমার মেয়েকে – আর – আর – আপনার ছেলেরও তো ল্যাজ আছে –’
-‘অ্যাঁ আমার ছেলের ল্যাজ আছে! কই- টাবুন –টাবুন এই তো – টাবুন তোমার ল্যাজ আছে?’
লাজবন্তীর বাবা শোনেন ওদিকে পিতা-পুত্র সংলাপ ‘হ্যাঁ বাবা আছে।’-‘ বলো কী! তা তোমার ল্যাজ গজালো কবে?’-‘সপ্তাহ তিনেক আগে।’ – ‘বলো নি তো।’ – ‘এর মধ্যে আবার বলার কি আছে! যদি চাও তোমারও গজিয়ে দিতে পারি – ক’দিনের মধ্যে চাও? ধরো তোমার এখন যা বয়েস –’ – ‘না, তা’তে আর ল্যাজ গজাবার দরকার নেই- তা আমরা জানলাম না, তোমার ল্যাজের কথা, ওই মেয়েটির বাবা জানলেন কেমন করে?’
-‘কে লাজবন্তীর বাবা? ও- আসলে আমি ওঁদের বাড়ি গিয়েছিলাম তো। বিয়ের কথা আরেকবার বলতে – তখন একসপেরিমেন্টালি ওনাকে ল্যাজ দিয়ে প্রণাম করেছিলাম – তোমায় করবো বাবা?’ – ‘থাক। আচ্ছা কথা বলো। নাও-’
লাজবন্তীর বাবা শোনেন ব্রতীনের কন্ঠ ‘হ্যালো-’
-‘হু – আমি লাজবন্তীর বাবা বলছি-’
-‘বলুন কী খবর? লাজবন্তীর ল্যাজ গজানো আরম্ভ হয়েছে?’
-‘তুমি একবার আমাদের বাড়ি আসবে?’ লাজবন্তীর বাবার গলায় শাসন আর আতঙ্কের যুগ্মযাত্রা।
-‘বেশ তো আসবো।’
একটা বেশ টাইট জিন্সের ট্রাউজার্স। গায়ে একটা টাইট গেঞ্জিশার্ট। কাঁধে একটা বেঢপ ঝোলা, দরজার পাল্লা খুলতেই, হুপ করে একটি কন্ঠবাদনসহ ঝুপ করে লাফিয়ে বাড়িতে ঢুকলো ব্রতীন। লাজবন্তীর বাবা তার সেই আরাম-কেদারায় আরাম মাথায় তুলে বসেছিলেন একদম সিধে। ওপরে-নীচে, ডাইনে-বাঁয়ে ল্যাজ নাড়িয়ে কণ্ঠে হুপ-হাপ, চলনে ঝুপ-ঝাপ লম্ফসহ ব্রতীন ঘরে ঢুকেই এক লাফে উঠে বসে তাঁর সেই চেয়ারের প্রশস্ত হাতলে। বসেই ল্যাজ বুলিয়ে প্রণাম নিয়ে তা ঠেকায় নিজের কপালে। অবশ্য হাত জোড় করে ‘নমস্কার’ও বলে। লাজবন্তীর মা ঘরে ঢুকলে, আরেক লাফে নেমে, দুই ধাপ লাফিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়াতেই ‘ওরে বাবারে, সুমি, ঝুমি-’ করে তাঁর ভীত চিৎকার অগ্রাহ্য করে ল্যাজ বুলিয়ে তাঁকে প্রণাম করে নেয় ব্রতীন ‘জানেন সেদিন আপনাকে তো ল্যাজ দিয়ে প্রণাম করতে পারিনি, আরেকটা করি-’
-‘না, না, থাক থাক-’
-‘ওঃ, ভেরি স্যাড, প্রণাম করতে বললেই তো না-না-থাক-থাক বলে সবাই – না-’ বলতে বলতে আবার ব্রতীন ল্যাজের ডগা বোলাতে থাকে তাঁর পদতল, ঊর্দ্ধভাগ থেকে তলদেশ। ‘ও মা – ও বাবা- বেশ বেশ’ বলতে বলতে, ঘরে ঢোকা মধুবন্তী বলে ‘এই এই ব্রতীনদা- মার খুব কাতুকুতু, আর প্রণাম ক’রো না-’
-‘আচ্ছা তবে থাক।’ খুবই কাঁচুমাচু মুখ করে ব্রতীন আরেক লাফে গিয়ে বসে সোফায়। সোফা থেকে ছিটকে ওঠা শব্দে বোঝা যায় না, সে খুশি না ভীত। ব্রতীন সোফায় উবু হয়ে বসে ল্যাজটাকে সামনে এনে ডাইনে বাঁয়ে দোলায়। আরেকটু তুলে মুখের সামনে এনে তাকে হিল্লোলিত করতে থাকে জাপানি বিলাসিনীর হাতপাখার মুদ্রায়। আর তার কাণ্ডকারখানার সামনে বাক্রুদ্ধ হয়ে থাকেন অপর তিনজন।
নীরবতা ভাঙেন লাজবন্তীর বাবা ‘তুমি আমার মেয়েকে ল্যাজ গজাবার ইঞ্জেকশন দিয়েছ?’
-‘দিয়েছি।’
-‘ল্যাজ গজাবে?’
-‘গজাবে।’
-‘যদি না গজায়?’
-‘না গজাবার কোনো কারণ নেই। এই ইনজেকশন যাদের দিয়েছি, তাদের প্রত্যেকের ল্যাজ গজিয়েছে। আপনাদের দেবো? সঙ্গে আছে।’ খুবই ভরসার ভঙ্গিতে ব্যাগের ওপর রাখে তার আদরের মোলায়েম হাত।
-‘শোনো, আমি পাঁজি দেখেছি। আগামী সপ্তাহে দিন আছে, তোমায় সুমিকে বিয়ে করতে হবে।
-‘ওর ল্যাজ গজাতে আরম্ভ করে দিয়েছে! বাঃ’ বলেই সোফা থেকে লাফিয়ে নেমে সমস্ত ঘর দুপদাপ লাফাতে থাকে ব্রতীন। ল্যাজ দিয়ে এক পাক মেরে ঝাঁকাতে থাকে লাজবন্তীর বাবার হাত। ‘ওঃ এটা না জমছে না, যদি আপনারও ল্যাজ-’
-‘বাড়াবাড়ি করবে না। তুমি অমন লাফাচ্ছো কেন?’
-‘জানেন, এটা না কন্ট্রোল করতে পারছি না। আসলে হনুমানের ডিএনএ থেকে সিরামটা বানিয়েছি তো – বোধহয় ডোজটা বেশি হয়ে গেছে।’
-‘তুমি রাস্তা দিয়ে এরকম ল্যাজ নাচিয়ে-’
-‘হ্যাঁ, এলাম। কেন?’
-‘কেউ কিছু বললো না?’
-‘কে কী বলবে? আর রাস্তার লোক,টোক আজকাল তাদের হাতের ফোনের পর্দা ছাড়া অন্য কোনো দিকে তাকায়ই না।’ বলে আবার ঝুপঝাপ লাফাতে থাকে ব্রতীন ‘একটু লাজবন্তীকে ডাকুন না, ওর ল্যাজের প্রগ্রেসটা একটু বুঝতে হবে –’ বলেই পর্দা সরিয়ে বড় বড় লাফে ঘরের ভেতরে চলে যাচ্ছিল সে। লাজবন্তীর মা আতঙ্কনিথর। বাবা ক্রোধ আর দুশ্চিন্তায় মাখামাখি। মধুবন্তী হাসি আর কৌতূহলে ভরপুর ‘ও ব্রতীনদা, দিদি একটু পরে আসবে। তুমি ওকে ডেকো না এখন।’ আবার লাফাতে লাফাতে ফিরে আসে ব্রতীন। অনেক কষ্টে লাজবন্তীর বাবা বলেন ‘সামনের সপ্তাহের সাতই, আমি তোমাদের বিয়ে দেবো।’
আরেক লাফে সোফায় বসে ল্যাজ দিয়ে একটু টেনে নেয় সেন্টার টেবিল – তার ওপরের স্লিপপ্যাডের ওপর ল্যাজের ডগা দিয়ে বল পেন আঁকতে, বেশ খানিকটা হিসেব করে ‘আচ্ছা ওটা এ-মাসে চব্বিশে করা যায় না?’
-‘কেন?’
-‘না হিসেব মতো লাজবন্তীর ল্যাজ গজাবে দশ বা বারো তারিখ। তারপর ধরুন মোটামুটি দুই বা আড়াই ফুট হয়ে যাবে কুড়ি, তাই বলছিলাম –’
-‘বেয়াদপ স্কাউন্ড্রেল ছেলে, তুমি আমার মেয়ের ল্যাজ গজাবার অঙ্ক করছো?’
-‘হ্যাঁ-’
-‘না। ল্যাজ গজাবার আগেই বিয়ে করতে হবে। আর বিয়ের দিন এসে অমন হুপহাপ করবে না হনুমানের মতো।’
-‘কেন? আমার তো জানা ছিল, আপনার আমার বিষয়ে আপত্তি। আপনি তো চেয়েছিলেন হনুমানের সঙ্গেই লাজবন্তীর বিয়ে দেবেন, এখন আবার হনুমানে আপত্তি! এরকম ইনকনসিস্টেন্সি কেন?’
-‘চুপ, একদম চুপ, ফাজলামির আর জায়গা পাওনা! বেরোও-’
-‘বেশ। কিন্তু যদি আমার স্ত্রীর ল্যাজ না-ই থাকবে তো তাকে বিয়ে করবো কেন? বাড়ি থেকে যে সম্বন্ধ করেছে, তা-তেই রাজি হয়ে যাই। তাছাড়া, আমি আমাদের এক ক্লাসমেট সন্দীপ্তাকেও এই ইনজেকশনটা দিয়েছিলাম, ওর ফুটখানেক গজিয়ে গেছে –’
-‘সন্দীপ্তা – সন্দীপ্তাকে তুমি ইনজেকশান দিলে? সে রাজি হ’ল?’ দরজার ওপাশে আত্মগোপন করে থাকা লাজবন্তী দৌড়ে আসে। তাকে দেখতে পেয়ে খুশিতে ভরে যায় ব্রতীনের মুখ ‘কোথায় ছিলে বলো তো এতক্ষণ?’
-‘তুমি সন্দীপ্তাকে ইনজেকশান দিলে কেন? আমায় তা বলোও নি কেন? লাজবন্তীর স্মৃতিতে সক্রিয় ছিল লাইব্রেরিতে ব্রতীনের দিকে সন্দীপ্তার আগ্রহী অগ্রসরতা। দুটো ছোটো ছোটো লাফ দিয়ে উত্তর দেয় ব্রতীন, ‘আর বলো কেন? অস্ট্রেলিয়ার সেই ইউনিভার্সিটি চায় একটা রিসার্চ টিম – এদিকে তোমার খোঁজ পাচ্ছি না, এই সময় সন্দীপ্তার সঙ্গে দেখা হওয়ায়, ওকে সব বললাম। সন্দীপ্তা রাজি। তারপর বলে কয়ে ও ওদের পাড়ার একটা ভ্যাবারাম ছেলেকেও নিয়ে এলো। তা অস্ট্রেলিয়ায় থাকতে পারবে শুনে তার বাড়ির লোকও রাজি – কাজেই দিয়ে দিলাম। ওদেরও ল্যাজ গজিয়ে গিয়েছে। এখন সন্দীপ্তার বাড়ি থেকেও বলছে ওকে বিয়ের জন্য – তা তোমার যদি ল্যাজ না গজায় –’
-‘না, না গজাবে গজাবে, দ্যাখো না, দ্যাখো –’ বলে পারিপার্শ্ব ভুলে লাজবন্তী ব্রতীনের সোফার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় পৃষ্ঠভাগস্থাপনায়।
‘এই-এই-এসব কী-’ লাজবন্তীর বাবা-মার আর্তনাদের ঐকতানে – ‘এই দিদি, কী হচ্ছে কী? একটা কাণ্ডজ্ঞান নেই তোর, আর ব্রতীনদা –’
-‘না, না তোমরা ভেবো না, এখনো ল্যাজ গজাবার ঠিক সময় আসেনি – ওর লেজটা-’ বলে ব্যাগে হাত ডুবিয়ে একটা খাতা বের করে দেখে বলে ‘পয়েন্ট ফোর সিক্স সিসি –’ ভুলুকে দিয়েছিলাম পয়েন্ট ফাইভ-ফাইভ – তাতে ওর আচ্ছা – সন্দীপ্তার ডোজ-’ পাতা উল্টে বলে ‘পয়েন্ট ফোর টু। তাতে ওর লেজ বেরোয় কুড়ি দিনে – কাজেই এখনো – হ্যাঁ- যা বলেছি তাই-’
-‘না, এই সাত তারিখেই আমায় বিয়ে করতে হবে। হবে। হবে। হবে।’ বলে তুড়ুক তুড়ুক করে দুটো লাফ দেয় লাজবন্তীও।
-‘আচ্ছা। বেশ। ওই কথাই রইলো। চললাম।’ বলে ল্যাজের ডগায় ব্যাগ তুলে ল্যাজ দিয়ে পাকিয়ে লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে গেল ব্রতীন।
এক সবিশেষ উদ্বিগ্ন- দম আটকানো স্নায়ুচাপ তাড়িত পরিবেশে বিয়ে হয়ে গেলো লাজবন্তী আর ব্রতীনের। ব্রতীন খুব বেশি লাফ-ঝাঁপ করেনি। কেবলমাত্র পুরুত মশায়ের পায়ে একটু ল্যাজ বুলিয়ে প্রণাম করেছিল। ব্রতীনের বাবা গম্ভীর। লাজবন্তীর বাবা গম্ভীরতর। ব্রতীনের বন্ধুদের মধ্যে ছিল তন্ময় আর শুভদীপ। এসেছিল সন্দীপ্তাও।
বিবাহপর্ব শেষে তারা যখন একত্রে বসেছে, লাজবন্তী সন্দীপ্তাকে ডেকে কানে কানে জিজ্ঞাসা করেছে ‘তোমার ল্যাজ কেমন আছে?’
-‘ভালোই। তবে এখনো তো পুরো অভ্যাস হয়নি, বেকায়দায় বসতে গেলে ব্যাথা করে।’
-‘একটু দ্যাখাবে?’
-‘উঁ –’ সবিশেষ ব্রীড়া চপল ভ্রূভঙ্গি করে সন্দীপ্তা ‘অ্যাঃই, এখন কেমন করে দ্যাখাবো? শাড়ি পরে আছি না। পরে, যেদিন স্ল্যাক্স পরে আসবো সেদিন।’
‘এই, তোমাকে একটা কথা বলবো? কিছু মনে করবে না তো?’
-‘কী?’
-‘তোমার না ল্যাজ গজাবে না। মানে এখনই না।’
-‘মানে?’
-‘মানে কিছু না। সেদিন তোমায় একটা এটিএস–ই দিয়েছিলাম।’
-‘তার মানে?’
-‘এর আবার মানে কি! যদি তোমার ল্যাজ গজাবার কথা না বলতাম, বিয়ে হ’ত তোমার সঙ্গে?’
-‘আর তোমার ল্যাজ?’
-‘আমারও গজায় নি।’
-‘তবে, ওটা?’
-‘এটাও সিন্থেটিক, টেডিবিয়ারওয়ালাদের দিয়ে করানো। হাই পোটেনশিয়াল ব্যাটারি আর তার বসানো ভেতরে। একটা বাটন সেন্টার, আর পকেটে রিমোট কন্ট্রোল’ বলে পাঞ্জাবির পকেট থেকে বার ক’রে লাজবন্তীর হাতে দেয় ব্রতীন ‘এই নাও। আমার ল্যাজের অধিকার তোমার হাতে। যদিদং লাঙ্গুলং মম, তদিদং লাঙ্গুলং তব।’
-‘তবে? তবে তোমার রিসার্চ, অস্ট্রেলিয়া-’
-‘চিন্তা নেই। কাল ল্যাবে নিয়ে যাবো, শুয়োরের ওপর অ্যাপ্লাই করেছি, হনুমানের মতো ল্যাজ হয়েছে। শিম্পাঞ্জিরও – মানুষের ওপর প্রয়োগ করবার স্কোপটাই তো –’
-‘সন্দীপ্তা-?’
-‘ওরও আমার মতন- নকল ল্যাজ- আচ্ছা নাও – এবার ল্যাজটা খুলি?’
-‘না- না পরে থাকো, পরে থাকো। এখন মনে হচ্ছে ল্যাজ ছাড়া তোমায় মানায় না।’
-‘অ্যাঁঃ!’ সত্যি সত্যিই একটু ক্ষুণ্ণ ব্রতীন হ’ল বটে, কিন্তু তারপরেই হাসতে হাসতে প্রবলের অশেষে জড়িয়ে ধরে লাজবন্তীকে। লাজবন্তী বোঝে, শুধুই ব্রতীনের দুই হাত নয়, তার একটু একটু ক’রে খোলা পিঠে, একটু একটু করে আদরে মাতছে, ব্রতীনের সেই ল্যাজও।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন