novel-nona-jol-3-of-5

নোনা জল
অনিন্দিতা গোস্বামী

সতেরো

খবর এসে পৌঁছাল ক্যাপ্টেন অ্যানসানের কাছে। মখমলের মতো নরম সবুজ গলফের কোর্টে বাঁকানো দণ্ডের আলতো ছোঁয়ায় ছোট্ট বলটাকে তিনি এগিয়ে দিলেন সামনে। বলটা গড়াতে গড়াতে গর্তের মুখে ঘাসের মধ্যে গিয়ে থেমে গেল। মনটা খচখচ করল অ্যানসানের, ইস, কেন গিয়ে পড়ল না গর্তে, জোরটা তো তিনি ঠিকই দিয়েছিলেন। গলফের মজাই তাই। ওই ছোট্ট অতটুকু গর্ত, একেবারে নিখুঁত হিসাবের প্রয়োজন। না হলেই লক্ষ্য ফসকে যাবে।

এই তাজা হাওয়ায় শরীরটা যেন ধীরে ধীরে সতেজ হয়ে উঠছে। যুদ্ধ! যুদ্ধ! কিছুদিন ধরে খুব ক্লান্তি লাগছিল ভেতরে ভেতরে। কী পায় যে এই মানুষগুলো খামোখা অশান্তি করে। আগে তো গ্রামে গঞ্জে না খেতে পেয়ে মরতিস আর জমিদারদের চাবুকের বাড়ি খেতিস। কোম্পানি তুলে এনে খাবার দিল, বেতন দিল, শান্তি মতো সব চললে আরও উন্নতি হত অবস্থার। তা না বিদ্রোহ করব, জাত গেল, ধর্ম গেল। আরে জাত ধর্ম কি যাওয়ার জিনিস, ও তো মানুষের বিশ্বাস।

তবে ডাক যখন এসেছে, যেতে তখন হবেই। এই মুহূর্তে পাহাড় ছেড়ে সমতলে নামার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই জেনারেল অ্যানসানের। তবু তিনি চিঠিটা আর একবার পড়লেন। রথ যখন এসে দুয়ারে প্রস্তুত তখন তিনি ঠেকাবেন কী করে।

ঘরে ফিরে রেনকোটটা হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখলেন তিনি। ফিরবার সময় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। আঙুলের টোকায় দু’-এক ফোঁটা জল ঝাড়লেন পোশাক থেকে। পরিস্থিতি গুরুতর। পঞ্জাব রাজ্যের এতটা সহায়তা পেয়েও কোম্পানি বাগে আনতে পারছে না বিদ্রোহীদের। যদিও সেনা শিবিরে যতটা সম্ভব ভুয়ো খবরই ছড়ানো হচ্ছে, বিদ্রোহী সেনারা কোম্পানির সৈন্যদের কাছে পরাস্ত। বিদ্রোহ শেষ হবার মুখে, ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ ঘটনাপ্রবাহ অনেকটাই উল্টো। বিদ্রোহী সেনারা সাধারণ ইউরোপিয়ানদেরও নির্বিচারে হত্যা করছে। সবচেয়ে বড় কথা ব্রিটিশ কোষাগার আর অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করায় প্রচুর টাকাপয়সা আর অস্ত্র এখন বিদ্রোহীদের হাতে। শুধু মাত্র ওদের একজন সুনির্দিষ্ট নেতা নেই বলে ওরা সংগঠিত নয়, একজন নেতা নির্বাচন করে ফেলতে পারলে ওদের আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। কমিশনার অব আম্বালা ডিভিশন মিস্টার বারনেসের কূটনৈতিক জ্ঞানের কিন্তু বাহবা দিতেই হয়। পঞ্জাবের তিন-তিনটে রাজবংশের সেনাবাহিনী নাকি গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডে কুচকাওয়াজ করছে শুধুমাত্র ইউরোপীয় সেনা শিবিরগুলোর সুরক্ষার্থে। সিস্‌ সুটলে রাজত্বের রাজকুমার ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর উদ্দেশে খাদ্য পাঠিয়েছেন, ফরিদকোটের রাজাও একটা ছোট্ট বাহিনী পাঠিয়েছেন ফিরোজপুরে। এছাড়াও ঘোড়া, উট, গোরুর গাড়ি, খচ্চর, সবদিক দিয়েই সাহায্য করেছেন তাঁরা।

ক্যাপ্টেন অ্যানডু কারনাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে পঞ্জাব ছেড়েছেন। বিদ্রোহী সেনাদের এক অংশ দিল্লি ছেড়ে পঞ্জাবের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। মুখোমুখি সংঘর্ষে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে এইবার। কোমরে বকলেস আঁটতে আঁটতে মনে মনে প্রস্তুতি নিলেন অ্যানসান।

পাহাড়ি পাকদণ্ডী বেয়ে সার সার নেমে আসছিল ঘোড়া, উট আর খচ্চরের বাহিনী, পিঠে তাদের আজ্ঞাবহ ভৃত্যের দল আর সেনা প্রভু। ক্লান্ত, স্খলিত। জন নিকলসন, পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, খুব বড় যোদ্ধা, ওঁর নির্দেশে পোশোয়াতে কামানের গোলায় একসঙ্গে চল্লিশ জন ভারতীয় বিদ্রোহী সেনাকে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাকেও এই রকম কিছু একটা ভেবে রাখতে হবে। মিছিলের শেষে চলতে চলতে অ্যানসান ভাবছিলেন, এই রকম একটা পরিস্থিতিতে একটু দূর থেকে সামান্য উঁচু জায়গায় কামানের অবস্থান যুদ্ধক্ষেত্রে সবচেয়ে সুবিধাজনক পরিস্থিতি। বিশৃঙ্খল জনতার মধ্যে গিয়ে পড়লে সব পরিকল্পনা এলোমেলো হয়ে যায়। কাজের মতো কাজ করতে পারলে সে-ও এবার ক’দিন ছুটি নিয়ে দেশ থেকে ঘুরে আসবে, গনগনে ক্রোধের আগুনে যেন তপ্ত হয়ে আছে তার গা। বিদ্রোহী প্রজারা বোঝে না ব্রিটিশ অফিসাররাও বেতনভুক, কোম্পানির দাস, তারা চাইলেও যুদ্ধ থামানোর ক্ষমতা তাদের নেই।

ইউরোপিয়ান রেজিমেন্ট সিমলা থেকে আগেই নেমে এসেছে সমতলে। ১০ মে মিরাটের সেনা ছাউনিতে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। দেশীয় সেনারা এনফিল্ড রাইফেলের টোটা দাঁতে কাটতে অস্বীকার করেন। নির্বিচারে ইউরোপিয়ানদের হত্যা করা হয়, তাদের বাংলো পোড়ানো হয়, উন্মত্ত ক্রোধে সাধারণ মানুষের জমা ক্ষোভ যেন ফেটে পড়ে। এরিয়া কমান্ডার হেউট ভীত হয়ে পিছু হঠেন, বিদ্রোহীদের বাধা দেবার কোনো চেষ্টাই আর তিনি করেন না। মেজর জেনারেল হিডসন এবং লেফটেন্যান্ট বগ আহত হন। পলাতক ইউরোপীয় সেনারা রাজপুর সেনা ছাউনিতে আশ্রয় নেয়। বিদ্রোহীরা রওনা হয় দিল্লির উদ্দেশে। দিল্লির সম্রাট মহম্মদ বাহাদুর শাহ-কে তারা নেতা হিসাবে ঘোষণা করে এবং সম্রাট বাহাদুর শাহ বদলি কি সরাই অর্থাৎ পাল্টা যুদ্ধের ডাক দেন। সমস্ত দেশীয় রাজাকে এই মর্মে চিঠি পাঠান এবং ঐক্যবদ্ধ ভাবে লড়াই করার অনুরোধ জানান।

ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তোপের মুখে পড়লেন মিরাটের এরিয়া কমান্ডার হেউট। তিনি নাকি বিদ্রোহীদের বাধা দেবার কোনো চেষ্টাই করেননি। উল্টে অনেককে পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দিয়েছেন। তাঁর চাকরি যায় যায়, সুতরাং মিরাট কেন্দ্রের কমান্ডার হেউট-এর এমন কিছু একটা করা খুবই জরুরি হয়ে পড়ে যাতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুনজরে আসা যায়। তিনি খবর পেলেন বিদ্রোহী সেনারা দিল্লি দখল করে পঞ্জাবের উদ্দেশে যাত্রা করবে। অতএব পঞ্জাবে এখন সেনার প্রয়োজন, তিনি জিন্দের মহারাজের কাছে দূত প্রেরণ করলেন এই মর্মে সাহায্য চেয়ে যাতে একজন সুদক্ষ ঘোড়সওয়ারকে তিনি পাঠান, এই অঞ্চলের পথঘাট যার নখদর্পণে।

চি হি হি হি শব্দ তুলে ঘোড়সওয়ার এসে দাঁড়াল কমান্ডার হেউট-এর দরজায়। অশ্বারোহী ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে বলল, সেলাম সাহেব। পত্রপ্রেরক হিসাবে জিন্দের মহারাজ আমাকে পাঠিয়েছেন। মহারাজের দ্রুত খবর প্রেরণের কাজ আমিই করে থাকি। হেউট লেফটেন্যান্ট হাডসনকে একটি পত্র দিয়ে ওই অশ্বারোহীর সঙ্গে প্রেরণ করলেন পঞ্জাবের মুখ্য আধিকারিক জন লরেন্সের কাছে। জানালেন, কিছু ইউরোপীয় সৈন্য এখনই তিনি পাঠানোর ব্যবস্থা করছেন পঞ্জাবে। তীর বেগে ঘোড়া ছুটল লক্ষ্যের অভিমুখে।

সবদিক থেকে প্রতিশ্রুতি পেয়ে জন লরেন্স দিল্লি যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। ছুটি অর্ধসমাপ্ত রেখে নেমে আসতে হয়েছে বলে যারপরনাই বিরক্ত বিধ্বস্ত কমান্ডার ইন চিফ অব বেঙ্গল আর্মি, জেনারেল অ্যানসান টালবাহানা করতে করতে শেষ পর্যন্ত ষোলই মে আম্বালায় এসে পৌঁছলেন। মহাসমরের চক্রব্যূহ রচনা সম্পন্ন হল। জন লরেন্স মনে মনে ছকে ফেললেন চারদিক থেকে বিদ্রোহী সেনাদের ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা।

কিন্তু অ্যানসানের ছোট্ট সেনাবাহিনী তখন খাদ্য, গরুরগাড়ি, খচ্চরের অভাবে ধুঁকছে। সেনাবাহিনীকে চাঙ্গা করতে পঞ্জাবের প্রশাসক ফের পঞ্জাবের রাজাদের কাছে সাহায্য চাইলেন। পাঁচশো গরুর গাড়ি, দুহাজার উট, দুহাজার খচ্চর এছাড়া একশো কুড়ি টনের মতো খাদ্যশস্য এনে জমা করা হল আম্বালায়। চব্বিশে মে নাগাদ জেনারেল অ্যানসান তাঁর পদাতিক বাহিনী নিয়ে আম্বালা ছাড়লেন। এবং পঁচিশে মে সকালে কারনালে এসে পৌঁছলেন। কিন্তু শীতের পরিবেশ থেকে হঠাৎ করে এই অস্বাভাবিক গরমের মধ্যে এসে পড়ায় খুবই দুর্বল বোধ করছিলেন অ্যানসান। কারনালের সেনা ছাউনিতে তিনি একদিন বিশ্রাম নেবেন বলে ঠিক করলেন। স্থির করলেন এরই মধ্যে তিনি গুছিয়ে ফেলবেন দিল্লি আক্রমণের পরিকল্পনা।

ছাউনিতে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন অ্যানসান। গাটা বমি বমি করছিল সকাল থেকে, হঠাৎ পেটে মোচড় দিয়ে উঠল। তিনি ছুটলেন। পাতলা জলের মতো ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এল মল ত্যাগের বেগ। ওহ মাই গড, ককিয়ে উঠলেন অ্যানসান। কিন্তু পরিষ্কার হয়ে ফিরে আসার আগেই আবার। দু একবার যেতে না যেতেই শুরু হল বমি। হড় হড় করে বমি। নেটিভ ল্যান্ড থেকে গ্রহণ করা শেষ জলকণাটুকুও যেন সাহেব বের করে দিতে চান শরীর থেকে। কিন্তু এখানে অনেকে তো তাঁকে সম্মান করত। ভয়ে হোক ভক্তিতে হোক এখানে তাঁকে সাধারণ মানুষ অনেক মান্যগণ্য করে, নিজের দেশে তাকে কে পুছত? কিন্তু শরীরের জল শুকিয়ে আসছে, জল খেলেও উগরে দিতে হচ্ছে সেই জল। তলব পড়ল আর্মি ডাক্তারের, কিন্তু ডাক্তারের বড়ি শরীরে রাখাই যাচ্ছিল না, অ্যানসান ক্রমশ নেতিয়ে পড়ছিলেন।

শুধু তাদের নেতা নয়, পুরো পদাতিক বাহিনীটাই যেন ধুঁকছে। আম্বালা থেকে কারনাল মাত্র একান্ন-বাহান্ন মাইল পথ আসতেই তাদের সব শক্তি যেন ফুরিয়ে গিয়েছে, আর লড়াই তারা কীভাবে করবে? কিন্তু তারা জানে, লড়াই করে জিততে না পারলে তাদের মুক্তি নেই। মুক্তি পেতে গেলেও লড়াইয়ের পথ পেরতে হবে।

শাহু বলল, বুধা, তোর সাহেব তো হাগছে।

বুধা বলল, সাহেবের আর দোষ কী বল, সাহেবরা ঠান্ডা দেশের মানুষ, আমাদের মতো মাঠে ঘাটে কাজ করা মানুষরাই কেলসে যাচ্ছে। শাহু দেশি মদের তলানিটুকু ভাঁড় উঁচু করে গলায় ঢেলে বলল, কিন্তু লড়াই করার সাধ তো মিটছে না। শুনছি সাহেবকে কলেরায় ধরেছে, সাহেব আর টিকবে না।

বুধা বলল, তাতে আর আমাদের কী বল, এক সাহেব যাবে তো আর এক সাহেব আসবে। শুনছি বার্নাড স্যার আমাদের পদাতিক বাহিনীর দায়িত্ব নিতে পারেন। ও শালা তো আরো হারামি। প্যারেড করিয়ে করিয়ে টেংরি খুলে নেবে।

চলে গেলেন জেনারেল অ্যানসান। দেশের হয়ে লড়লে তবু লোকে শহিদ বলে। কোম্পানির হয়ে লড়লে টাকা ছাড়া কিছুই জোটে না। গান স্যালুটের শব্দ যুদ্ধদামামার মধ্যে কোথায় মিলিয়ে যায়। বাড়ি ঘর দেশ ছেড়ে, সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে এসে যে মানুষগুলো প্রাণপণ লড়তে বাধ্য হয়, অর্থ বিনিময় তাদের আত্মত্যাগকে মামুলি করে তোলে। তাদের জন্য গান বাঁধা হয় না, জ্বলে না কোন হিরণ্ময় জ্যোতিও, বরং অত্যাচারী শাসকের তকমা নিয়ে, একরাশ মানুষের ঘৃণা নিয়ে, শেষ শয্যায় শায়িত হতে হয়। তার জন্য চোখের জল ফেলারও বিশেষ কাউকে পাওয়া যায় না অনেক সময়।

অতিরিক্ত দায়িত্ব সামলাতে তৎপর হয়ে উঠলেন জেনারেল বার্নাড। সৈন্যদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে বাহিনীর নাম দিলেন আর্মি অব রিট্রিবিউশন। বললেন, আমরা যত তাড়াতাড়ি দিল্লির দখল নেব তত তাড়াতাড়ি ছুটি পাব আমরা। বিশ্রামই আমাদের দৌড় শেষের লাল রিবন। দৌড় যখন শুরু করেছি তখন ওই লাল ফিতেটা ছোঁয়া পর্যন্ত দৌড়াতেই হবে আমাদের। থামলে চলবে না, দম হারালে চলবে না।

ফের সৈন্যবাহিনী যাত্রা করল দিল্লির উদ্দেশে, কমান্ডিয়ারিং অফিসার কর্নেল যৌগুসব্যান্ড গলার শিরা ফুলিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, তে চল। গম গম গম, গম গম গম— বাহিনীর বুটের আওয়াজে ধ্বনিত হচ্ছিল এক ছন্দ, চলার ছন্দ। মৃত্যুর অবসাদ আর ভয় কোন ভাবে যেন গ্রাস করতে না পারে তার বাহিনীকে সেদিকে সর্বদা দৃষ্টি রাখছিলেন পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনীর প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নিকলসন। তারা হাঁটছিল। দু’পাশের বন জঙ্গল গ্রাম ঘর বাড়ি পেরিয়ে লম্বা পথ ধরে তারা হাঁটছিল, কখনও এত দ্রুত যে সে হাঁটা ছোটার সামিল। তবু তারা থামছিল না। দশ হাজার সৈন্যের মহামিছিল চলেছিল মাঠ ঘাট পেরিয়ে। রণে চলেছিল তারা। ব্রিটিশ বাহিনী দিল্লি থেকে চল্লিশ মাইল দূরে যে গ্যারিশন শহর তৈরি করা হয়েছিলো তার কাছে পৌঁছতেই বিদ্রোহী সেনাদের সঙ্গে শুরু হল সম্মুখসমর। শিখ রাজাদের অনুগত সৈন্যবাহিনী এবং স্যার হাডসনের অধীনস্থ অশ্বারোহী বাহিনীর সঙ্গে তুমুল লড়াই শুরু হল বিদ্রোহী সেনার এবং ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ক্রমশ পিছু হঠতে থাকল।

ভাইয়ের সঙ্গে ভাই কখনও লড়ে? পলাশীর যুদ্ধের একশো বছর পূর্ণ হতে চলল। কোম্পানি ভারতে একশো বছর রাজত্ব করবে, এই তো সবাই জানত। এবার পালাও। বিদ্রোহী সিপাহিরা ওই বিশ্বাসে আক্রমণ করল ব্রিটিশ সেনা ছাউনি, কিন্তু মেজর অলফ্রেটের অধীনস্থ শিখ সেনাবাহিনী লাঠি-পেটা করে বিদ্রোহী সেনাদের ছত্রভঙ্গ করল। সেদিন নেটিভ ইনফ্যান্ট্রিতে গোপন বৈঠক বসল। ঠিক হল, নেওয়া হবে পলাশীর যুদ্ধের নীতিই। লড়াইয়ের ময়দানে তারা নীরব থাকবে। নিষ্ক্রিয় থাকবে। বন্দুকের নল এদিক থেকে ওদিক ঘুরতে কতক্ষণ। সন্দেহ তার মনে অনেকদিন থেকেই ঢুকেছিল, এই ঘটনায় আরও সুদৃঢ় হল ধারণাটা। পরিকল্পনা মতো পঁয়ত্রিশ নম্বর বার্মা নেটিভ ইনফ্যান্ট্রি ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডে ঢুকে গেলেই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নিকলসন কমান্ডিয়ারিং অফিসারকে নির্দেশ দিলেন তাঁর অধীনস্থ সৈন্যরা যেন অস্ত্রসমর্পণ করে। মাস্ট গিভ আপ দেয়ার আর্মস। ভয়ে ঠকঠক করে হাঁটুর কাছটা কাঁপতে লাগল বুধার। একই অবস্থা হল শত শত দেশীয় সেনারও। যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার আগেই তারা পরিণত হল এক-একটা কাঠপুতলিতে। বুধা বুঝল মৃত্যু আসন্ন।

সে ভোর রাতে সেনা ছাউনির পর্দা উঠিয়ে চার হাত পায়ে হামা দিয়ে চতুষ্পদের মতো পিছন দিকটায় এল, তারপর নিজের গামছা দিয়ে পিছন থেকে বেঁধে ফেলল পাহারারত এক ইউরোপিয়ান সৈন্যের চোখ-মুখ, আর তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিল দীর্ঘ একনলা বন্দুক। তারপর ছাউনিতে ফিরে এসে জামাকাপড়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখল অস্ত্রটা। হইহই করে উঠল ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। সকলেই ধারণা করল রাতে বিদ্রোহী সেনারা শিবির আক্রমণের চেষ্টা করেছিল। প্রচুর ইউরোপীয় সেনা মারা গিয়েছে এই ক’দিনে। তাদের মনোবলও কমে আসছে। তারা যেন বুঝতে পেরে গেছে বিদ্রোহী সেনাদের দমন করা অত সহজ না। যে মনোবল জেনারেল অ্যানসানের মৃত্যুতে তাদের ভাঙেনি, সেই মনোবল দু’দিনের পরাজয়ে ভেঙে পড়ল। সম্রাট বাহাদুর শাহ বেরেলির নেটিভ অফিসার ভক্ত খানকে সমগ্র বিদ্রোহী সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ ঘোষণা করলেন।

বার্নাড সাহেব মারা গেলেন, কর্নেল চেস্টারকে হত্যা করল বিদ্রোহীরা, ৭ জুলাই দেশীয় বিদ্রোহী সেনা পঞ্জাবের ঝিলম পঁয়ত্রিশ নম্বর ব্রিটিশ পদাতিক বাহিনীকে আক্রমণ করে ক্যাপ্টেন ফ্রান্সিস স্প্রিং ও তার বড় ছেলে উইলিয়ম স্প্রিং সহ পঁয়ত্রিশ জন ব্রিটিশ সৈন্যকে হত্যা করল। শেয়ালকোটে ফের বেশির ভাগ সৈন্যই বিদ্রোহী হয়ে গোরা সেপাইদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে দিল্লির উদ্দেশে যাত্রা করলে রাভী নদী পেরনোর সময় এগারেশো সিপাইকে জেনারেল নিকলসন কামানের গোলায় উড়িয়ে দিলেন।

ডামাডোল চূড়ান্তে উঠল। অস্ত্রবিহীন সৈন্যদলের হাতে দেওয়া হল কেবল মাত্র লাঠি। অর্ডার। ঢাল নেই তরোয়াল নেই, লড়াইয়ের মাঠে নামিয়ে দেওয়া হল নিধিরাম সর্দারদের।

বুধা দেখল এই সুযোগ। সে লড়াইয়ের ময়দান থেকে পিঠটান দিয়ে শুরু করল দৌড়। ওই ওই ধর ধর। চোখ এড়াল না ব্রিটিশ সেনার। সকলেই অনুমান করল বুধনাথ রাতারাতি বিদ্রোহী সেনাদলে নাম লিখিয়েছে। ওকে ধরতে পারলে পদোন্নতি নিশ্চিত, অতএব পিছন পিছন ছুটতে লাগল সাদা চামড়ার ব্রিটিশ সেপাইরা।


আঠারো

এক ঝাঁক শিকারি কুকুর ঝাঁপিয়ে পড়ল বুধনাথের ঘাড়ের উপরে। ক্যাচ কট কট। হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে যেতে পাদ্রি সাহেবের কাছে শেখা এই ইংরেজি ধাতুর রূপটাই মনে এল বুধনাথের। আসলে ওটা ট্রিগার টেপার শব্দ। ফাঁকা ট্রিগার। গুলি থাকলে বুধনাথের বুকের দিকেই ছুড়ত। কোম্পানি এখন মরা সিপাইয়ের থেকে জ্যান্ত সেপাই ধরে দিলে দাম দিচ্ছে বেশি। কারণ জ্যান্ত ধরা পড়েছ কি তুমি দাস বনে গেলে কোম্পানির। জেলে ভরবে আর গলায় দড়ি বেঁধে বলদের মতো খাটাবে।

সে ঘুরে গিয়ে একজন গোরা সেপাইয়ের পা জড়িয়ে ধরে বলল, ছেড়ে দাও বন্ধু, আমার কোনো রাগ নেই তোমাদের উপরে, আমি শুধু বাড়ি যেতে চাই। এক গোরা সেপাই বুটের ধাক্কায় বুধনাথকে কাত করে দিয়ে বলল, বন্ধু! স্যার বল, স্যার। বুধনাথ বলল, হ্যাঁ স্যার, ছেড়ে দিন স্যার, আমি বাড়ি যাব। কতদিন মাকে দেখিনি। ফুলফুলে সাদা চালের ভাত খাইনি, পুঁই ডাঁটার চচ্চড়ি।

—হে হে হে চচ্চড়ি! বলে তারা দুলে দুলে হাসতে লাগল বুধনাথকে ঘিরে। তারপর বলল, চল চচ্চড়ি, তোকে আজ গরম তেলের কড়াইয়ের মধ্যে ফেলে দেওয়া হবে। ডিপ ফ্রাই। ওরে বাবা, বাবা রে, বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল বুধনাথ। কিন্তু গোরা সেপাইরা বুধনাথের আকুলি বিকুলিকে পাত্তা না দিয়ে ওকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে চলল তাদের অফিসারের কাছে। জেল হয়ে গেল বুধনাথের।

জেলগুলোর অবস্থা অবর্ণনীয় তবু ঠাসাঠাসি গাদাগাদি করে শুয়ে থাকত সবাই, তখন বুধনাথের মনে একটা অহংকার জন্মাত। সাদা কুত্তাগুলোর হয়ে লড়তে লড়তে মরমে যেন মরে যাচ্ছিল বুধনাথ। তার দেশ গাঁয়ের ভাইরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়ছে আর তাকে কিনা তার ভাইদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে হচ্ছে! সে কিছু করুক না করুক, তবু তো আজ গৌরবে বহুবচন। সবাই তো তাকে বিদ্রোহী সেপাই ভাবছে। ভাবছে তো সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে শিরদাঁড়া সোজা করে লড়াই করতে গিয়েছিল। সত্যিই তো সে মনে মনে চেয়েছে, কিন্তু সুযোগটা যেন কিছুতেই পাচ্ছিল না, কী একটা দোলাচল তাকে পিছন থেকে টেনে ধরছিল সর্বদা।

তবে এখন সত্যি সত্যিই এক অসম্ভব বিদ্বেষ তৈরি হয়েছে গোরা সেপাইদের প্রতি বুধনাথের মনে। সমবেত বিদ্রোহী প্রজা এবং সিপাহিদের গুঞ্জনে জানতে পারছে সে অনেক ঘটনা। রক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে তার। তাদেরকে তো বিচ্ছিন্ন করে রেখে কোনো সত্যিই জানতে দেওয়া হত না।

এলাহাবাদের চৌরিচৌরা, বেনারসের মতো পুণ্য তীর্থক্ষেত্রে কীভাবে নির্বিচার সাধারণ মানুষ হত্যা করেছে কোম্পানির সেনা। সাধারণ মানুষের চাষবাস সব লাটে তুলে দিয়ে শুধু মাত্র নীল চাষ করতে হবে বলে বাধ্য করছে। মানুষ খাবে কী? ধান চাষ বন্ধ রেখে কৃষক যদি নীল চাষ করে তবে একদিন চাষিদের না খেতে পেয়ে মরতে হবে। কারণ লাভের বেশিটাই তো চলে যায় ইংরাজ প্রভুর হাতে। তবে ইংরেজ আর বেশি দিন এদেশে থাকতে পারবে না। কত লোককে মারবে তারা? সকলেই তো বিদ্রোহী হয়ে উঠছে। তাছাড়া জেলগুলোও তো আর ওদের নিয়ন্ত্রণে নেই, সর্বত্র হেরে যাচ্ছে ওরা। সর্বত্র জেল ভেঙে কয়েদিদের মুক্ত করে দিচ্ছে বিদ্রোহীরা। মিরাট, মজফফরপুর, আলিগড়, বিজনোর, মোরাদাবাদ, বেরিলি, বুদুয়ান, শাহজাহানপুর, আগ্রা, এটোয়া, ফতেগড়, কানপুর, এলাহাবাদ, আজিমগড়, গোরখপুর, জোনপুর, বাংলা, বিহার, গয়া, সব জায়গায় জেল থেকে কয়েদিদের মুক্ত করে দিচ্ছে বিদ্রোহীরা। কোনো কোনো জায়গায় তো বিনা সংঘর্ষে জেলের রক্ষীরাও সহায়তা করছে বিদ্রোহীদের। জেলখানার দরজা ভাঙলেই প্রাণভয়ে প্রকোষ্ঠের চাবি তুলে দিচ্ছে বিদ্রোহীদের হাতে, তারপর রাতভর ঝমঝম শিকলে শব্দ তুলে নিঃশব্দে বেরিয়ে চলে যাচ্ছে কয়েদিরা। হাজারে হাজারে কয়েদি মুক্ত হয়ে যোগ দিচ্ছে বিদ্রোহে, ডাকাতিতে।

খবর এল মুক্ত করা হবে বুধনাথদেরও। সেদিন রাতে উৎকর্ণ হয়ে তৈরি ছিল ওরা, রাতের অন্ধকারে যখন ইংরেজ প্রভুরা নিদ্রামগ্ন তখন নিঃশব্দে পেরিয়ে যেতে হবে পথ। খবর এসেছে হাওয়ায়। যাবজ্জীবন কারাদাণ্ডে দণ্ডিত আসামী বুধনাথ বসে প্রহর গুনছিল মুক্তির। এল, মুক্তির খবর এল। সে মুক্তির নাম শমন। দ্বীপান্তরের শমন। জেলার সাহেব এসে গড়গড় করে পড়ে দিয়ে গেলেন কয়েকটা নাম, যাদের তৈরি থাকতে হবে, তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হবে মুক্ত খোলা আকাশের নীচে এক অপূর্ব বিস্তীর্ণ ভূমিতে, যেখানে থাকবে না চার দেওয়ালের ঘেরাটোপ, ঘোরাফেরা করা যাবে ইচ্ছে মতো, এমনকি চাষবাসও করা যাবে চাইলে। প্রাথমিক ভাবে গুটিকয় মানুষের ভাগ্যেই এই সুযোগ জুটেছে, তবে ধীরে ধীরে তার সংখ্যা বাড়ানো হবে। আপাতত তাদের একটি অন্য আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, তারপর দলে দলে ভাগ করে তাদের পাঠানো হবে সেখানে। কী সেই দেশের নাম? আন্দামান।

আ-আ-আ… আতঙ্ক যেন ফিস ফিস করতে লাগল জেলের দেওয়ালে দেওয়ালে। বুকের ভেতর থেকে সব বাতাস যেন উড়ে গেল বুধনাথের, কালাপানি পার হতে হবে তাকে। দেশধর্ম চ্যুত হয়ে এক মহাপাপে নিমজ্জিত হতে হবে তাকে। অথচ সে অর্থে সে তো তেমন কোনো অন্যায়ই করেনি। হ্যাঁ, মনে মনে করতে চেয়েছিল বিদ্রোহ, কিন্তু করে ওঠা তো হয়নি। তার আগেই তো সে ধরা পড়ে গেল। এমনকি জেলের অন্দরে নানা উষ্মায় সে যোগ না দিয়ে একটু পিছিয়েই থাকত সর্বদা। তার থেকে অনেক বড় দাগী আসামী রয়েছে এই জেলে, তবে তার ভাগ্যেই কেন এল এমন অভূতপূর্ব মুক্তি!

শুরু হল গুঞ্জন, এ যে আমাদের ধর্ম লঙ্ঘনের সামিল। এই সব ওদের চক্রান্ত, কালাপানি কিছুতেই পার হব না আমরা। আমাদের দেশ থেকে আমাদেরই তাড়িয়ে দিতে চায় গোরারা। এ অন্যায় আমরা কিছুতেই মানব না। প্রয়োজন হলে প্রাণ দেব কিন্তু জান থাকতে মান দেব না। সকলে মিলে চিৎকার করে উঠল, ইনক্লাব জিন্দাবাদ। বুধার তখন চোখ ঝাপসা, গোরা সেপাইদের মাথায় যখন ঢুকেছে এ কথা, তা যেন তেন প্রকারেণ করেই ছাড়বে তারা। আর এখন তো তাদের কাছ থেকে সব অস্ত্রও ছিনিয়ে নিয়েছে ওরা। এখন তো তারা ঢোঁড়া সাপ। সে যদি বা একটা অস্ত্র ছিনতাই করেছিল কিন্তু তা সঙ্গে নিয়ে আসারও সুযোগ পায়নি। তার সেই ছিনতাই করা একনলা বন্দুক তারই কম্বলের তলায় ঘুমোচ্ছে। এই বিপ্লবের মানে কী! এই বিপ্লবের মানেও তো সেই বন্দুকের সামনে বুক পেতে দাঁড়ানো। মৃত্যুকে সবাই এত মহান বলে মানে কেন? মৃত্যু মানে জীবনের শেষ। জীবন কত সুন্দর। আহা কতকাল সে পদাবলী গায়নি। তিলক চন্দনের টিকা পড়েনি তার কপালে। তবুও সে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে সকলের মধ্যে থেকে মুঠি তুলে বলল, ইনক্লাব জিন্দাবাদ।

তবু বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। বুধনাথের অশ্রুসিক্ত গণ্ডদেশে আঁকা হোক খুব সাধারণ খেটে খাওয়া, সামান্য স্বপ্ন নিয়ে শান্তিতে বেঁচে থাকতে চাওয়া মানুষের স্বপ্ন। যে স্বপ্ন পূরণের জন্য পৃথিবীকে হয়তো অপেক্ষা করতে হয় অনন্ত কাল। আর অপেক্ষা করতে করতে মানুষগুলো ভাবতে শুরু করে এই অপেক্ষাই জীবন। ভাবতে শুরু করে জীবন মানেই তো অনন্ত সংগ্রাম। না, তারা হয়তো এ সমস্ত ঠিক মতো ভাবতেও পারে না, লড়তে লড়তে তাদের মস্তিষ্কে একধরনের স্থবিরতা কাজ করে যা তাদের করে তোলে চিন্তাশক্তিহীন এক যান্ত্রিক বিকল্প।

পরিবর্তন করা হল শমন। গভর্নর জেনারেলের কাছে পৌঁছল জেলে জেলে গড়ে ওঠা অসন্তোষের খবর। এই মুহূর্তে ইউরোপিয়ান সৈন্য শিবিরের সংখ্যা খুবই আশঙ্কাজনক। দেশীয় সৈন্যরাও অধিকাংশই বিদ্রোহী। জেল ভেঙে প্রায় তিন হাজারের ওপরে কয়েদিকে মুক্ত করে নিয়েছে তারা। ইংরেজ সরকারের পক্ষে বোঝা মুশকিল কে কয়েদি, কে বিদ্রোহী আর কে কেবল মাত্র সাধারণ সেপাই। অতএব এখন যা করতে হবে তা বুদ্ধিবলে আর প্রযুক্তিবলে। ‘অস্ত্র’বলে কথাটাও আর ভাবতে পারলেন না লর্ড ক্যানিং, কারণ বহু অস্ত্র লুঠ হয়ে গিয়েছে তাদের। চালাকির অস্ত্র নেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই। মনটা খচখচ করছিল লর্ড ক্যানিং-এর। এই দেশটাকে একটু একটু করে ভালোবাসতে শুরু করেছে তার স্ত্রী। কিছু কিছু দেশীয় প্রজার ভালোবাসা আর সম্মান তাকে নাকি আপ্লুত করছে। কিন্তু ও বোঝে না প্রশাসনে থাকতে গেলে প্রথমেই বিসর্জন দিতে হয় আবেগ। কারণ আবেগ মানুষকে বহু ভুল সিদ্ধান্তের দিকে চালিত করে। টেলিগ্রাফ প্রযুক্তি এই সময়ে কী কী ভাবে তদের সাহায্যে করছে বলার নয়। নাহলে এই বিপুল উন্মুক্ত জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করা আরোই অসম্ভব হত। তিনি শমন পরিবর্তনের ভুয়ো খবর সমস্ত কারা অধ্যক্ষের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।

পরদিন সকালে কারাধ্যক্ষ এসে সমবেত কয়েদিদের সামনে পাঠ করলেন পরিবর্তিত শমন। বললেন, কোম্পানি কোনো ভাবেই কয়েদিদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দিতে চান না। তাই সব দিক বিবেচনা করে শুধু মাত্র স্থানাভাবের কারণে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত কিছু আসামীকে তারা অন্য একটি অধিক সুরক্ষিত কারাগারে প্রেরণ করতে চান। কোম্পানি সবসময়ই কয়েদিদের প্রতি সহানুভুতিশীল থাকার প্রতিশ্রুতি দান করছে। এবং তাদের খাদ্য স্বাস্থ্য সকল পরিষেবারই উন্নতি ঘটানোর কথা বিবেচনা করছে। কোম্পানির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করলে কোম্পানি কখনোই তাদের কোনো ক্ষতি করবে না।

ফের একবার নামগুলো পড়ে দিয়ে জেলার সাহেব প্রস্থান করলেন। বুধনাথ সহ কয়েকজনকে চটের আচ্ছাদনে ঢাকা একটা গাড়ির পিছনে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হল অনেকদূরের একটা ছোট্ট কারাগারে। বুধনাথ ভেবে পেল না এই স্থানান্তরণের কারণ। সত্যিই স্থান সংকুলানের সমস্যা হলে মাত্র এই ক’জনকেই কেন? তবে এতদিন সৈন্যবাহিনীতে কাটানোর ফলে তার এই শিক্ষাটুকু হয়েছে যে অকারণে প্রশ্ন করতে নেই। প্রশ্ন করলেই হয়ে যেতে হয় টার্গেট, অফিসারের অযথা হেনস্থার শিকার।

দিন কয়েক বাদে এক সকালে তার সেলের মধ্যে ঢুকে এক কারাকর্মী তার চোখে বেঁধে দিল মোটা কালো কাপড়ের ফেট্টি, চমকে উঠল বুধনাথ, তবে কি তার ফাঁসির হুকুম হয়ে গেল! সে বলল, এ কেয়া হুয়া? এ আবার কী?

কারা কর্মী বলল, যানা হোগা।

—কাঁহা? বলল বটে কিন্তু বুধনাথের গলা দিয়ে যেন স্বরই বেরল না।

—গুম ঘর মে, বলে হা হা করে হাসল কারাকর্মী। যে যার জায়গায় ক্ষমতা উপভোগ করতে চায় সে যত ক্ষুদ্র জায়গাই হোক না কেন। নিপীড়িত বলে কোনো কথা হয় না। মানুষের ধর্মই নিপীড়ন করা। তুল্যমূল্য বিচারে মানুষ কাউকে না পেলে পিঁপড়েকে মারে। বুধনাথ সাহসে ভর করে বলল, অর্ডার দিখাও। কারাকর্মী বলল, অর্ডার তো সাহাব কা পাশ, আরে ডরো মত ম্যায় তো মজাক কর রহা থা । নেহি নেহি তুমারা ফাঁসি মাসি নেহি হোগা। সাহাব বুলা রাহা হ্যায়।

—তো চোখ মে ফেট্টি কিঁউ?

—মুঝে ক্যা পাতা? মুঝকো তো হুকুম মিলা, ব্যাস।

সাহেবের হুকুমে আর পদধ্বনিতে মালুম হল গোরা সেপাহির পাহারায় তারা মুষ্টিমেয় লোক কোথাও একটা চলেছে। মনে মনে কেমন সন্দেহ হল, হয়তো গুলি করে মারা হবে তাদের। কিন্তু বুধনাথ ভেবে পেল না তার এমন কঠিন সাজা কেন? সে তো তেমন কোনো অন্যায়ই করেনি, না একটা খুন না একটা লুণ্ঠন। শুধু সে পালাতে চেয়েছিল, কিন্তু সে প্রশ্ন সে করবার সাহস পেল না সাহেবের কাছে। তাহলে হয়তো কালো ফেট্টির বদলে কালো ঠুলি পরিয়ে দেওয়া হবে তার মাথাতে, তারপর ওরে বাবা রে, পিঠ দিয়ে হিমস্রোত নেমে গেল বুধনাথের। তার মনে হচ্ছিল কোন এক কালো পিচ্ছিল গুহাপথের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে সে।

অনেক পথ পেরিয়ে এসে, অনেক সিঁড়ি ভেঙে এসে তারা কোথাও একটা থামল, হুকুমও পেল বসবার। ভোঁ পড়ল জাহাজে। ঝিমোতে ঝিমোতে মাথাটা খাড়া করে তুলল বুধনাথ আজ কুইনাইন দাওয়া খাওয়াবে বলে কি তাকে গোরা ডাক্তার আফিংয়ের গুলি খাইয়ে দিল, মাথাটা এমন টাল খাচ্ছে কেন? নাকি দীর্ঘক্ষণ চোখ বাঁধা থাকলে মানুষের মাথা এমনিতেই এরকম লাগে? ফের ভোঁ পড়ল, দুলে উঠল তার শরীর। সে বুঝল এ কচ্ছপের কামড়, মেঘ না ডাকলে ছাড়ে না। দ্বীপচালান হচ্ছে তাদের। সাহেবদের মাথায় একবার যে বুদ্ধি ঢুকবে তা তারা শেষ না দেখে ছাড়বে না। সে ভাবল মন্দ কী, সে এমনিও মরত, অমনিও। গুলি খেয়ে মরলে তো এক শব্দেই খেল খতম। বরং মনে হচ্ছিল জীবন থেকে মৃত্যুর যাত্রাপথটা কেমন হয় সে বুঝতে বুঝতে চলছে। এ যেন তার অগস্ত্য যাত্রা। পঞ্চপাণ্ডবের পর কেউ আর এ ভাবে স্বর্গে যায়নি। রামায়ণ গানের পুণ্যফলেই বুঝি আজ সে এ সুযোগ পেল। দোল খেতে খেতে তাদের জাহাজ চলছিল, সে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল ডেকের মেঝেতে। এখন সময় কত? কী বার? সব গুলিয়ে গিয়েছে তার। যেন এক অবিশ্রান্ত দুলুনিতে তার সারা শরীর পাকিয়ে উঠছে। এ হে হে, তার ঠোঁটের পাশ দিয়ে গড়িয়ে আসছে পিত্তজল।

সাহেব দেখে হাঁক দিলেন জাহজের সাফাই-কর্মীকে, ইধার আও। এবার চোখ খুলে দাও কয়েদিদের, আমরা এখন প্রায় মাঝসমুদ্রে চলে এসেছি। জায়গা সাফ করো আর এদের একটু লেমন ওয়াটার মতলব নিম্বু পানির ব্যবস্থা করো। হামি আচ্ছা আদমি আছে। সবার খেয়াল রাখে, দেখভাল করে। আরও অনেক কয়েদি আসবে এখানে, আগেও এসেছে। তোমরা ঘাবরাও মাত। ওখানে তোমরা চাষবাস করবে, থাকবে খাবে। কুনো চিন্তা নেই। ডাক্তার ভি আছে, অসুখ বিসুখ করলে ভি চিন্তা নাই। দাওয়াই আছে, গোলি আছে। তুমহারা তো দিমাক খুল গয়া। হাতে পায়ে শিকল-বাঁধা জন্তুর মতো মানুষগুলো ঢুলুঢুলু চোখ তুলে একবার তাকাল সাহেবের দিকে।

একটু বাদেই নিম্বু পানি নিয়ে হাজির হল সাফাই-কর্মী রঙ্গিত লাল। কয়েদিদের সামনে বসল বাবু হয়ে। বলল, নাও লেবু জল খাও। আফিমের নেশা খানিক কমবে। সমুদ্রে প্রথম প্রথম ওরকম হয়। তাই জন্যই তো সাহেব তোমাদের একটুখানি আফিম খাইয়ে আনে। আমি তো কতবার সাগরের এপার ওপার করলাম। আমার না আছে জাত, না আছে ধর্ম, দুনিয়ার লোকের বমি সাফ করছি, হাগলে তাও। সাগরের দুলুনি তো, অনেকে হেগেও ফেলে গো। রঙিতলালের কথা শুনতে শুনতে জোড়া পায়ে লাথি মেরে লেবু জলের ভাঁড় উল্টে দিল এক কয়েদি। হাসল রঙিতলাল, বলল এখনও নতুন নম্বর পড়েনি তো তাই এত তেজ। কেন, জেলখানায় মুতের পাত্রে জল খাওনি? এরপর সাগরজল যদি পেটে না সয় তবে তো মুতও খেতে হবে। আর এখন হাগা মোতার গল্প শুনেই এত খারাপ লাগছে? তালে দাঁড়াও জাগাটা পোঁছা লাগিয়ে নিয়ে এসে বসে তোমাদের নতুন জাগার গল্প শোনাই। তবে ভয় লাগে গো, সাহেব যদি দেখে আমি কয়েদিদের সঙ্গে গল্প লাগিয়েছি আমাকে টুক করে ধরে সাগরের জলে ফেলে দিতে কতক্ষণ। কত বডি জলের নীচে ওই হাঙরে খেয়েছে, আমারটাও না হয় খাবে। কালাপানি কি আর এমনি বলে, সাগর মানুষ খেতে ওস্তাদ। দেখো না ঢেউয়ের মাথায় সাদা করাতের মতো দাঁত তার সবসময় বেরিয়েই আছে।

বুধা বলল, এই, বাজে কথা রেখে তুই আগে কাজের কথা বল তো, ওই দেশটা তুই দেখেছিস? মানুষ থাকে? না শুধু বাঘ-ভাল্লুক? খিক খিক করে হাসল রঙিতলাল, বলল, বাঘ কি এত পথ সাঁতরে আসতে পারে? এ ব্যাপারে তোমরা খানিক নিশ্চিন্তি। তবে বাঘের থেকেও একটা সাংঘাতিক জিনিস আছে, সে কথা আমি বাবা বলব না, বলে সে নিজের মুখ নিজেই চাপা দেয়। সকলেই কৌতূহলী হয়ে বলে, কী রে?

—সে কিছু কথা না, বলে হাতের তেনা কাপড়টা নিয়ে সেখান থেকে দৌড় দেয়। কয়েদিরা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। বুধা একজনকে বলে, তোমরাও কি বেঙ্গল রেজিমেন্ট?

সে বলে, আমি নানা সাহেবের সিপাহি। তলোয়ার খেলায় আমরা পাক্কা হাত। হাত দুটো খোলা পেতে দাও শুধু, তারপর দাওয়ের কোপে ওদের ধড় মুন্ডু কেমন নামাই দেখো। পাশ থেকে একজন বলে, চুপ কর ভাই, বাতাসেরও কান আছে। যা করবে ওখানে গিয়ে ভাবা যাবে, ওদের হাতে ভরা বন্দুক। আমি ওয়াহাবি সৈনিক। এতগুলো মানুষ আবার ওখানে গিয়ে জড়ো হচ্ছি তখন কিছু একটা তো হবেই।

মাথা নাড়াল বুধা, ঠিক।

হাত-পা ধুয়ে এসে ওদের সামনে বাবু হয়ে গুছিয়ে বসল রঙ্গিতলাল বলল, জাহাজ যে দিন যায় সেদিন তো ফেরে না, তা এক-দু’ রাত্রি তো ওই দেশে থাকতেই হয় আমাকে। আমার অবশ্য অত কষ্ট নেই, আমার তো শোবার ব্যবস্থা জাহাজে। তা আমি পালিয়ে পুলিয়ে দিনের বেলা একটু এদিক ওদিক ঘুরি, তাতেই যা দেখেছি আমার চক্ষু তো চড়কগাছ।

নড়েচড়ে বসল বুধা, ভারী শিকল সারা দিন শরীরে বওয়া খুব কষ্ট। এখন খুব হাসি পায় বুধার, প্রথম যেদিন রাইফেল তুলেছিল কাঁধে, মনে হয়েছিল, ওরে বাবা রে কী ভারী। আর আজ দু’মন ওজনের শিকল বইছে সারাদিন। বুধার মতো একটা নিরীহ লোক, যে কিনা গান বাঁধে কীর্তন গায়, তার মতো লোকের কি বন্দুক ধরা উচিত ছিল! বলে না, লোভে পাপ, আর পাপে মৃত্যু। কোম্পানি যেই চোঙা ফুঁকল, মাসিক বেতনের লোভে সেও চলে গেল নাচতে নাচতে আগুপিছু না ভেবে। তবে প্রথম প্রথম খারাপ লাগত না, ট্রেনিংয়ের সময় চারিদিকে স্যুট বুট গুরুম গুরুম দেখে দেহ মনে বেশ জোশ আসত। মনে হত সে-ও বুঝি একটা কেউকেটা বটে। শরীর স্বাস্থ্য তো তার খারাপ ছিল না, ওই চওড়া ছাতি, ঢেউ খেলানো বাহু, কত গোপীই না তার পিছনে দৌড়েছে একদিন। তবে ওই যে খানিক রঙ্গতামাশা করল, ব্যাস, এর বেশি বুধার ভালো লাগত না। তার মনের ভেতরটা যেন কোন শ্রীরাধার খোঁজে গুমরে গুমরে কাঁদত অহর্নিশি।

নাঃ, সেই সব অনুভূতি বুধার কবেই মরে গেছে। প্রাণে ফুর্তি না থাকলে গান আসে না মনে। বিরহও তো এক ধরনের ফুর্তি। যে জানে সে জানে। বাদ দাও, সে সব কথা এখন আর মনে আনতেও ইচ্ছে করে না বুধার। সে বলল, হ্যাঁ ভাই রঙ্গিতলাল তা তুমি কী দেখেছ সত্যি করে বলো দেখি একটু আমাদের। আমাদের আগে কি সেখানে অনেক লোক গেছে?

রঙ্গিতলাল নিচু জাতের লোক। বামুন কায়েতের কাছে অচ্ছুৎ। ম্লেচ্ছদের ঝাড়ুদার হয়েই বরং তার কদর গেছে বেড়ে। সে এদের সঙ্গে এক আসনে বসছে, উল্টে এদের কাছ থেকে খাতির পাচ্ছে, তাই মনে মনে সে একটু সাহেবদের পছন্দই করে, কিন্তু সাহেবরা যখন কারণে অকারণে তাকে ভারী বুটের গুঁতো দিয়ে গায়ে কালসিটে ফেলে দেয় তখন আবার তার মনে হয়, বেশ হয়েছে গোরা সেপাইগুলো মরেছে। আরও মরুক। তাই সে তার মর্জি অনুযায়ী একবার এদের কথা ওদের বলে, আর একবার ওদের কথা এদের, তাতে দু দলের কাছেই একটু কল্কে পাওয়া যায়। রঙ্গিতলাল বলল, অনেক না, তবে গেছে। রোজই তো এদিক থেকে ওদিক থেকে জাহাজ এসে ভিড়ছে এখন। কত সব বাহারি নাম সে সব জাহাজের, প্লুটো, ডালহৌসি, সব বড়লাটের নামে নাম। হাতে পায়ে বেড়ি পড়ে খোলা আকাশের নীচে চিতপটাং হয়ে পড়ে থাকো। তা তোমার হোলে যদি কাঁকড়া কামড়ে ধরে তো তুমি মরলে।

বুধা একবার নিজের সম্পত্তিতে হাত ঠেকিয়ে দেখে নিল, থাকার মধ্যে আছে তো শুধু এইটুকুই।

পাশ থেকে একজন বলল, খেতে দেবে না?

রঙ্গিতলাল বলল, তা দশ-বারো দিন মনে হয় কিছুই পাবে না। আগে নম্বর পড়বে তারপর তো খাওয়াদাওয়া।

—এঃ অতদিন না খেয়ে থাকা? দুটো চাপাটিও দেবে না? আঁতকে উঠল একজন।

পাশ থেকে আর একজন বলল, এ শালা মিথ্যেবাদীর গল্প তোমরা শুনছ বসে বসে। যা ভাগ।

বুধা বলল, না না, থাক। ও বলুক না। সত্যি মিথ্যে আমরা তো পরে দেখতেই পারব। বল বল রঙ্গিতলাল, তুই বল তুই আর কী কী জানিস। তালে বলছিস ওখানে মানুষ থাকে, আমরা একাই না?

রঙ্গিতলাল হাতে ভর দিয়ে পিঠটা বেঁকিয়ে দিল পিছনের দিকে, তারপর হাই তুলে বলল, তা থাকে। অনেক অনেক রকমের মানুষ থাকে।

রঙ্গিতের অনেকের ওপর অতিরিক্ত জোর কয়েদিদের মনে রহস্য ঘনীভূত করল। কিন্তু রঙ্গিতের ভ্যানতাড়া দেখে সকলেরই মনে মনে অসহ্য লাগছিল বলে কেউ আর কিছু প্রশ্ন করল না। বেশি পাত্তা না পেয়ে রঙ্গিতলাল ফের খাড়া হয়ে বসল। বলল, প্রথম জাহাজেই ছিলাম আমি। কিন্তু কয়েদিদের সঙ্গে সেই যে নামাল আমায়, চারপাঁচ দিন ধরে আর ফেরত নিল না। বলল তুই এখানে অপেক্ষা কর, দরকার মতো তোকে ফিরিয়ে নেব। সেই জাহাজ বোধ হয় রেঙ্গুন যাচ্ছিল। কেউ তো ছিল না জাহাজে, তাই বিনা সাফাইওয়ালাতেই বোধ হয় কাজ চলে গেল।

—তা এখন তো শুধু গাছ কাটা হচ্ছে। ঘর নেই বাড়ি নেই মানুষ থাকবে কোথায়? তাঁবুতে থাকো আর ঘপ ঘপ জঙ্গল কেটে সাফ করো। ওরে বাপ রে বাপ, কী বড় বড় আর কী শক্ত শক্ত কাঠের সব গাছ। খুব নাকি দাম সে কাঠের। এই কাঠও নাকি আবার জাহাজ ভর্তি হয়ে বিলেতে রানিমার প্রাসাদে যাবে। এই জন্যই তো খুব শিগগিরি এখানে একটা কাঠচেরাই কল বসবে।

বুধা বলল, গাছ কাটব যে, হাত খুলে দেবে?

রঙ্গিত লাল বলল, হুঁ হুঁ বাবা, সেটি হচ্ছে না, ওই হাতে বেড়ি পরেই গাছে কুড়ুল মারতে হবে।

গলার কাছটা যেন শুকিয়ে গেল বুধার, চারপাশে তাকিয়ে জল খুঁজল। তাই দেখে রঙ্গিতলাল ফের খিক খিক করে হাসল, বলল শুনেই গলা শুকিয়ে গেল? সারা দিনে তো এক ফেরো জল পাবে খাবার। তা ওই কষ্ট সইতে পারল না গো ছেলেটা, কী যেন নাম, নারাইন না কী। কুড়ুলের কোপে পায়ের শিকল কেটে দে ছুট।

—পালাল? সমস্ত কয়েদি যেন এক যোগে উৎফুল্ল হয়ে উঠল।

বড় একটা শ্বাস ছেড়ে রঙ্গিতলাল বলল, পারল না। এক ধাক্কায় যেন চুপসে গেল সব কয়েদিদের আশার ফানুস। বুধা খুব ম্লান ভাবে বলল, ধরা পড়ে গেল?

ঘাড় নাড়ল রঙ্গিতলাল, হ্যাঁ, ওহ তারপর যা দৃশ্য!

কী দৃশ্য? সপ্রশ্ন হল ফের কয়েদিরা। রঙ্গিতলাল চোখ বড় বড় করে বলল ব্রিটিশ গুলাগ, সে যেন একটা জ্যান্ত বাঘ। এক হাতে নারাইনের টুঁটি চিপে ধরে শূন্যে তুলে দিল। তারপর সব কয়েদিকে ঘণ্টা বাজিয়ে ডেকে সকলের সামনে ব্যাটাকে দাঁড় করিয়ে একবারে মাঝ কপালে গুরুম! গুলি খেয়ে গলা দিয়ে আঁক করে একটা শব্দ বার করারও সময় পায়নি ছেলেটা গো। চারদিক নিঃশব্দ। শুধু ব্রিটিশ গুলাগ চিৎকার করে উঠল, সাবধান কয়েদিরা, আমার চোখকে কেউ ফাঁকি দেবার চেষ্টা করবে না। তার ফল কিন্তু ভালো হবে না।

জাহাজের ডেকেও কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সবার। দম বন্ধ করে সবাই তাকিয়ে ছিল রঙ্গিতলালের দিকে। কিন্তু রঙ্গিতলাল আর ওদের দিকে না তাকিয়ে ধীরে ধীরে মুখ গুঁজে দিল দু’হাঁটুর মধ্যে। তারপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল। অনেকক্ষণ কাঁদার পর হাঁটুর ওপর কাত করে মাথা রেখে ফিস ফিস করে বলল, ওই দিশ্য দেখে সহ্য করতে না পেরে তার দু’দিন বাদেই আর এক কাণ্ড। কয়েদিদের চেঁচামেচিতে আমরা দৌড়ে গেছি সবাই, দেখি আর একটা কয়েদি, গলায় ছেচল্লিশ নম্বর চাকতি, নিরঞ্জন সিং। গাছ বাধাঁর দড়ি দিয়ে গাছের ডালের সঙ্গেই গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েছে। আহা গো। ওকে নাকি আগের রাতে খুব চাবুক পেটা করেছিল গুলাগ, শালা গোরা ডাক্তারটা বহুৎ হারামি, পাক্কা একটা জল্লাদ, ওই জঙ্গলের তেনারা ওই জল্লাদটাকে একদিন মারতে পারে না!

বুধা বলল, মানে ভূত?

রঙ্গিতলাল ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলল, জানি না, আমি কিছু জানি না। এটা আমি সত্যিই কিছু জানি না, আমি দূর থেকে একদিন দেখেছিলাম অনেকটা মানুষের মতোই।

বুধার গাটা কেমন বমি বমি করছিল, ভয়ে, নাকি সমুদ্রের দুলুনিতে নাকি অনাহারে, পিত্তিতে তা ঠিক বুঝতে পারছিল না, তবে সে বুঝতে পারছিল পঞ্চপাণ্ডবদের সঙ্গে তার তফাত একটাই। তারা পাহাড়ের পথ ধরে উঁচুতে উঠেছিল, স্বর্গে গিয়েছিল, আর সে নামছে পাতালে, নরকে। তার মুক্তির পথ এখনও অনেক দূর। শুধু একটাই কথা তার মনের আনাচেকানাচে উঁকি দিচ্ছে, চার দেওয়ালের ঘেরাটোপ থাকবে না, মানে তো কিছুটা মুক্তিই। খোলা বাতাসটুকু তো নিশ্চয়ই আছে সেখানে শ্বাস নেবার মতো। কিন্তু রঙ্গিতলালের অমন পিঙ্গল বিবর্ণ মুখচ্ছবি দেখে সেই স্বস্তিটুকুও যেন স্থির ভাবে দাঁড়াচ্ছে না তার বুকের ভেতরে।

রঙ্গিতলাল বলল, যাই বেশিক্ষণ তোমাদের সঙ্গে বক্‌বক্‌ করছি দেখলে সাহেব আবার লাথি ঝাড়বে। বাব্বা বুটগুলো কী ভারী, পাছা জ্বলে যায়। তারপর ইচ্ছে করে বুধনাথের কাঁধে একটা চাপড় মেরে বলল তেওয়ারি জি, সাহেবরা এই দেশে এসে সবাইকে ধরে কয়েদি বানিয়ে বামুন কায়েতের আর জাত ধর্ম কিছু রাখলে না গো, বলে মুখ দিয়ে চুক্‌ চুক্‌ করে শব্দ করতে করতে পিঠটান দিল।

দাঁতে দাঁত পিষে পাশ থেকে একজন বলল, শালা অ্যাং উঠল ব্যাং উঠল খলসে বলে আমিও উঠি। বুধনাথ মাথা নিচু করে পাটাতনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছিল, এই লোকটাই কিছুক্ষণ আগে কয়েদির মৃত্যুশোকে কেমন শিশুর মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল আর এখন তাদের দেখে যেন মজা পাচ্ছে! মানুষের আত্মায় বুঝি পাশাপাশি ঘুমিয়ে থাকে শয়তান আর ভগবান। কে কখন জেগে উঠবে বলা মুশকিল।

জাহাজ এসে থামল। চারিদিকে নীল জলরাশির মধ্যে একখণ্ড সবুজ বনভূমি। বুধনাথের কবিমন মুহূর্তে আলো হয়ে উঠল। ভারী শিকল টেনে কাঠের সিঁড়ি থেকে মৃত্তিকা স্পর্শ করতেই মৃদু শব্দ হল, ঝন্‌। পাড়ে এসে লাগা জলের ধাক্কার মতোই সেই শব্দে তন্দ্রা কেটে গেল বুধনাথের। দূরে চোখে পড়ল ক’টা পাতার ছাউনি দেওয়া মাটির বাড়ি। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে পায়ে চলা পথ আর পথের দু’পাশে গুটিকয় উর্দিধারী গোরা সেপাই। তবু যেন তাজা বাতাসে একবার প্রাণভরে শ্বাস নিল বুধনাথ। তারপর গিয়ে সার দিয়ে দাঁড়াল আগত কয়েকজন কয়েদি। অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে এল একজন গোরা সিপাহি। সামনে এসে পা ফাঁক করে দাঁড়াল। ডাকল, হেই তুম্‌ ইধার আও। এগিয়ে গেল বুধনাথ, সপাং করে তার পায়ের ওপর একটা চাবুকের বাড়ি মেরে বলল, শয়তানের ভূমিতে তোমাদের স্বাগত, হেই ইসবার তুমারা ও নেঙ্গট উতারো। মেনল্যান্ডের কোনো জিনিস এখানে থাকবে না। ফেকো ফেকো ইধার।

চোখ বড় বড় করে বুধনাথ বলল, কেয়া?

পাশ থেকে আর এক গোরা সেপাই হি হি করে হেসে বলল, মতলব নেহি সামঝা? বলে সে সামান্য পোশাকটুকুও টান মেরে খুলে নিল বুধনাথের পরনের থেকে, তারপর হি হি করে হাসতে হাসতে বলল, একটা একটা করে সব মুরগারই ছাল ছাড়ানো হবে।

বুধনাথ চিৎকার করে উঠল, চুতিয়া।

ফের সপাং করে তার খোলা পশ্চাদদেশের ওপর এসে পড়ল শঙ্কর মাছের চাবুক। —আ আ আ ককিয়ে উঠল বুধনাথ। খ্যাক খ্যাক করে হেসে সে ব্যাটা বলল, সাহেবের তো এখনও ঘুম ভাঙেনি। উঠলে তোর পাছায় মলম লাগিয়ে দেবে রে, এখন উধার যাকে চুপচাপ খাড়া রহো। নেক্সট। ইধার আও। চিন্তা মাত করো দো তিন দিন বাদ তোমারা নম্বর মিলেগা তব্‌ খানা মানা পোশাক সবকুছ মিল যায়েগা। অব দো তিন দিন বিশ্রাম করো। উধার যাকে চুপচাপ শো যাও। সাহেব যব বুলায়েঙ্গে তব্‌ আনা। বুধনাথ প্রস্তরবৎ দাঁড়িয়ে রইল সেখানে, নড়বার ক্ষমতাও যেন হারিয়ে গেল তার পা দুটো থেকে।


উনিশ

মস্ত বড় চাঁদ উঠেছিল। মূল ভুখণ্ড থেকে অতবড় চাঁদ দেখা যায় না, আদিমতা সব সময়ই সুন্দর। মানুষ তার চুড়ান্ত ভালোবাসার মুহূর্তেও তো আদিমই হতে চায়। অথচ ঘন অরণ্যানির বুকে পাতার বিছানায় শুয়ে খিদে তেষ্টায় ক্লান্ত, সরীসৃপের সরসর চলাফেরায় ত্রস্ত, বেত্রাঘাতের যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট মানুষগুলো তাদের নগ্ন সুঠাম শরীরে বুকে হেঁটে গোরা সেপাইদের কাছ থেকে আফিমের গুলি ভিক্ষা করছিল তাদের পা চেটে দেবার শর্তে। শুধুমাত্র ক্ষণিক চেতনালুপ্তির আকাঙ্ক্ষায়। হ্যাঁ, মানবসভ্যতার ইতিহাসে এও ঘটেছিল, আর ঘটেছিল বলেই মানুষ জেনেছিল সভ্যতা শব্দটাকে বেশির ভাগ সময় মানুষ ভুল প্রয়োগ করে এসেছে।

গোরা সেপাইরা অপ্রত্যাশিত প্রভুত্বের আস্বাদনে ত্বরিতে চোরাপথে সংগৃহীত ওপিয়াম জোব্বার পকেট থেকে সন্তর্পণে তুলে দিয়েছিল ওই বিপর্যস্ত মানুষগুলোর হাতে।

তখনও বিকেল। পাগলাঘন্টির শব্দে ধড়মড় করে উঠে বসেছিল ওরা। দুড়দাড় দুড়দাড় শব্দ পেয়েছিল ছুটোছুটির। কিছু জিজ্ঞাসা করবার মতো চারপাশে কাউকেই দেখতে পেল না ওরা। ওরা দেখল পরস্পরকে। স্পষ্ট দিবালোকে। আনত। অপমানে অধোবদন হতে গিয়েও হো হো করে হেসে ফেলল। অপমানকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেবার প্রচেষ্টায় ওদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠল, চল লাঙ্গুল মাপি। কার কত বিঘত। আমার নাম মহাবীর, আমার লাঙ্গুল এক বিঘত তিন আঙ্গুল। বুধা বলল, এই শালা টেনে মাপলি না ছেড়ে? একটু বয়স্ক ভঞ্জ সিং বলল, আর টানাটানি করে কাজ নেই, চল ছাল-পাতা খুঁজি একটু লজ্জা ঢাকার। মহাবীর বলল, কাকা এখানে তোমার লজ্জা দেখার জন্য আছে কে বা? যাও বা কাল দু’চার জনকে দেখলাম, আজ কী বা একটা পাগলাঘন্টি বাজল তো চোখ মেলে দেখি সব ফর্সা। মনে হয় আমাদের কজনকে এই দ্বীপে ফেলে রেখে জাহাজ করে সব রাতারাতি কেটে পড়েছে। এ কথায় সবার মুখই রক্তশূন্য হয়ে গেল। ঘাড় ফিরিয়ে শূন্য জেটির দিকে তাকিয়ে তাদের মনে হল পায়ের নীচের মাটিটুকু ছাড়া সারা পৃথিবীটাই বুঝি জল।

বেশ কিছুক্ষণ বাদে তাদের নজরে পড়ল একজন হাতে পায়ে লোহার বেড়ি পরে গলায় নম্বরের লকেট ঝুলিয়ে ঘষটাতে ঘষটাতে এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। কাছাকাছি পৌঁছে সে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলল, এখনও নম্বর পড়েনি। বেঁচে আছো। নম্বর পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়া ডাক্তারের খপ্পরে। ওহ্‌ যেন জ্যান্ত রাক্ষস একটা।

বুধা ভয়ে ভয়ে বলল, সেটা কে গো?

লোকটা কয়েদি নম্বর ছত্রিশ বলল, ডাক্তার ওয়াকার, ব্রিটিশ গুলাগ।

মহাবীর বলল, তবু তো একটা পোশাক পেয়েছ। লোকটা খিঁচিয়ে উঠল, এটা একটা পোশাক? এটা তো মোটা চটের বস্তা। এটায় ঘষা লেগে নোনা বাতাসে আর ঘামে দেখো গায়ের কী অবস্থা। তবু আমি বেশি চালাকি করি না বলে সবচেয়ে সহজ কাজ রান্না করা আর বাড়ি ধোয়ার ভার পড়েছে আমার। অন্যদের যে কী কষ্ট। তার মধ্যে সকাল থেকে এক কাণ্ড।

—কী গো? প্রশ্ন করল ওরা। ঘণ্টা বাজছিল কেন? কেউ পালিয়েছে?

লোকটা ম্লান হেসে বলল, কেউ নয়, প্রায় সবাই।

মানে! উৎফুল্ল হয়ে উঠল বুধারা, সবাই পালিয়েছে? বেশ হয়েছে। কিন্তু পালাল কোথায়?

ছত্রিশ নম্বর বলল, সেটাই তো। ডাহা নির্বুদ্ধিতার ফল। আসলে অত্যাচারে বুদ্ধিনাশ। বেচারারা পালিয়ে কোথাও যেতে পারবে না, আবার এখানেই ফিরে আসতে হবে। চারদিকে গভীর জঙ্গল। আর জঙ্গল ঘিরে রয়েছে সাগর। ওদের কাছে না আছে খাবারদাবার, না আছে টাকাপয়সা। আর ভাবছে সাঁতরে সাগর পার হবে? জানেই না জল এখানে কত গভীর। আমি তো জলে ছিলাম, জলের ঢেউ দেখলে, রং দেখলে বলে দিতে পারি জলের কত তল। তাছাড়া এখানে হাঙর কুমির কি নেই! আর তাছাড়া জঙ্গলে আছে তেনারা।

বুধা বলল, তেনারা কারা গো? ভূত?

ভয়ার্ত মুখে ছত্রিশ নম্বর জবাব দিল, ঠিক জানি না, ভয়ঙ্কর একরকম জিনিস, যারা সামনে পেলে মানুষের বুকের রক্ত চুষে খায়।

মহাবীর বলল, কিন্তু তারা কি মানুষ?

ঘাড় নাড়ল ছত্রিশ নম্বর, তারা বুনো। বুনো মানুষ।

বুধা বলল, মানুষ কখনও মানুষের রক্ত খায়? যতসব আজগুবি।

ছত্রিশ নম্বর ঘন ঘন মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেল অন্য দিকে। বলল, জানি না, যা শুনেছি তাই বললাম। কিন্তু আজকালের মধ্যেই ভয়ঙ্কর একটা কিছু ঘটবে।

ভঞ্জ বলল, তা আজ আমরা খাবার পাব না?

মাথা নাড়ল ছত্রিশ। উঁহু, নম্বর পড়েনি। আগে নম্বর পড়ুক।

ঠেঁচিয়ে উঠল ভঞ্জ, মগের মুলুক নাকি? দু’-তিন দিন ধরে না খেয়ে থাকা যায়? তা সাহেবের ঘর থেকে তোমার মতো একটা নম্বরের লকেট এনে না হয় ঝুলিয়েই দাও আমাদের গলায়।

লোকটা বলল, বাব্বা, নম্বর দেওয়া কি আমার কাজ! আগে সাহেব আসুক।

বুধা বলল, ভাবখানা এমন করছ যেন তোমার সাহেব আমাদের মেডেল দেবে।

লোকটা বলল, তা মেডেল বই কি। এই নম্বরের ভিত্তিতেই না তুমি খাবার পাবে, পোশাক পাবে, এমনকি শোবার জন্য একটা তাঁবুও পাবে। নইলে ওই জঙ্গলে কতজনকে সাপে কাটল, কতজনকে বিছে কাটল, টুঁটি ছিঁড়ে দিল কাঁকড়ার দাড়ায়। আ হা হা।

বুধা বলল, বাব্বা একে তো দেখছি কলের পুতুল বানিয়ে দিয়েছে কোম্পানি।

মহাবীর বলল, তেড়িবেড়ি করে লাভ কী। শুনেছি দাসানুদাস হয়ে থাকলে সাজা কমে যায়। এখান থেকে পালানো অতই সোজা? লোকগুলোর কি একটু বুদ্ধিও নেই?

ভঞ্জ বলল, চুপ কর, আমিও পালানোর ধান্দা খুঁজছি, শুধু সুযোগের অপেক্ষা। আমার মতো পাকা সাঁতারুর আবার ভয় কী। আমি কুমিরের পিঠেও চাপতে পারি। গঙ্গা এপার ওপার করেছি এবার সাগর এপার ওপার করব।

মহাবীর বলল, বল কী কাকা, গঙ্গা আর সাগর কি এক হল?

ভঞ্জ বলল, এক কেন হবে, এক হলে কি আমি এতক্ষণ এখানে বসে বসে ল্যাজ নাড়তাম, কখন কিরি ধাঁ, মানে এক ডুবে ধাঁ। ব্যাপারটা অত সহজ না বলেই তো বুদ্ধি আঁটছি। দাঁড়া, ভাবতে ভাবতে একটা কিছু বুদ্ধি বার করবই। চার দেওয়ালের বাইরে যখন এসেছি তখন আমায় আর কেউ আটকে রাখতে পারবে না।

মহাবীর দু’চোখে জ্বলজ্বলে আশা নিয়ে ভঞ্জর দিকে তাকিয়ে বলল, তাহলে আশা আছে বলছ কাকা?

ভঞ্জ বলল, আলবাত আছে।

বুধা এসব কোনো কথা না বলে চারপাশটা খুব ভালো করে লক্ষ করছিল। যদি একটা গাছে একটা কলার কাঁদিও চোখে পড়ে তবে ছোঁ মেরে গিয়ে সে সেটা তুলে নেবে। কিন্তু চারিদিকে সবই কেমন অচেনা গাছ, চেনা গাছ তার খুব একটা চোখেই পড়ছে না। ফল অনেক রকম ঝুলে আছে, কমলা, সবুজ। কিন্তু কোন ফল মুখে দেবে, তা যদি বিষ ফল হয়, তখন কী হবে! এত কষ্ট সহ্য করার পরেও বেঘোরে প্রাণটা দিতে যেন ইচ্ছে করে না। যতদূর চোখ যায় গাঢ় নীল জলের অবিশ্রান্ত ঢেউ বুকে এসে লাগে। এখানে ঢেউ খুব মৃদু, তটভূমি দীর্ঘ না হলে তরঙ্গ কূলে এসে আছড়ে পড়ে না। শুধু ঝোড়ো বাতাস ছাড়া এখানে উত্তাল হয় না সমুদ্র। যেন মৃদু গুঞ্জনে বুকের ভেতরে ফিসফিস করে বলে, সুন্দর।

ওরেব্বাস হঠাৎ হুহুঙ্কার। বন থেকে বেরল বাঘ। মাথায় কালো টুপি, হাতে দীর্ঘ চাবুক, গায়ে লাল উর্দি। এ মাথা ও মাথা গটগটিয়ে ফুঁসতে লাগল সে, আর তার চাবুক আছড়াতে লাগল মাটিতে। তার পিছে পিছে আর দুটো লালমুখো মেনি বেড়াল স্যার স্যার করে ঘুরতে লাগল মুখ চুন করে। যেন তাদেরও এন্তেকাল ঘনিয়ে এসেছে।

গ্রামের জমিদার একবার রামনবমীর মেলায় সাহেবদের সার্কাস এনেছিল। এক্কেবারে যেন সেই দৃশ্য। শুধু এখানে বাঘের হাতেই যেন চাবুক।

দীর্ঘদিন সেনাবাহিনীতে চাকরি করার সুবাদে ইংরেজি তারা এখন বেশ ভালোই বোঝে। সাহেবের গর্জন থেকে তারা যা মর্ম উদ্ধার করল তা হল, সাহেবের মান মর্যাদা ইজ্জৎ সব চলে গেছে। কোম্পানি এত টাকা লস কিছুতেই মেনে নেবে না। আর হারামি শুয়ার নেটিভগুলো এটুকু বোঝে না এখানে থাকলে অন্তত বেঁচে থাকত। জঙ্গলে মরবে না হলে সমুদ্রে মরবে। সে নেটিভগুলো বাঁচবে কি মরবে তা নিয়ে সাহেবের অত মাথাব্যথা নেই। কিন্তু এতগুলো ফ্রি ওয়ার্কারের লস সাহেবের ফেস লসের সামিল। চিৎকার করে উঠল সাহেব, আজ নতুন জাহাজ আসবে লাহোর থেকে, তাছাড়া ওখানে নম্বর না পড়া নেটিভগুলোও আছে, ওরা যেন এ খবর জানতে না পারে আর ওগুলোকে তাড়াতাড়ি নম্বর লাগানোর ব্যবস্থা করে দু’দিনের মধ্যেই জঙ্গল সাফা করতে পাঠাও। বর্ষা নামার আগে আমার এখানকার জঙ্গল পুরো সাফা করা চাই। ডঃ জেমস ওয়াকার ইনএফিসিয়েন্ট এই মন্তব্য সে কিছুতেই টলারেট করবে না।

পিছনে মেনি বেড়ালদুটো ক্ষণে ক্ষণে কপালে সেলাম ঠুকে ইয়েস স্যার, ইয়েস স্যার করে বেড়াতে লাগল।

বুধা খানিক নিশ্চিন্ত হল এই ভেবে যে, যাক এবার তাহলে তাদের নম্বর পড়বে, জুটবে খাবার আর পোশাকও।

সাহেব চলে যেতেই মেনি বেড়ালের গোঁফ বড় হল, লেজ হয়ে উঠল মোটা। তারা ধীরে ধীরে প্রথমে হুলো হল, তারপর হাতে চাবুক ধরতেই হয়ে উঠল চিতা। এগিয়ে এল তাদের কাছে। বলল, কী! দিমাগ তো তোমাদের খুলে গেল। জলদি জলদি নম্বর পড়ে গেল তোমাদের। নাও নাচো। নাচ কি আর এমনি আসবে, একটু তাল দি। ওই ধিন তাক্, কেটে ধা, কেমন যেন ড্রাম বাজাও না তোমরা।

আর একজন পাশ থেকে বলল, খোল খোল, দে আর কলড, খোল। প্রথমজন বলল, নাও শুরু করা যাক, বলেই চাবুক নিয়ে সপাং সপাং করে এলোপাথাড়ি পেটাতে আরম্ভ করল তাদের কয়েকজনকে। তারা ওরে বাবারে মারে বলে সত্যিই যখন লাফাতে আরম্ভ করল, লালমুখো বলল, হা হা দে হ্যাভ বিগান টু ডান্স। এই ডান্সকে কী বলে জানিস? পার্টি ডান্স। পার্টি শুরু হবার আগে এই ডান্স শুরু হয়। আজ রাতে খাবার পাবি না? তোদের পার্টি শুরু হবে। চাঁদের আলোয়। ও হো মুনলাইট ডিনার।

ঠিক সন্ধ্যের মুখেই ঘটল ঘটনাটা। পাখিরা বাসায় ফিরছিল। সাদা ডানা মেলে শেষ একবার জলের ওপর চক্কর খেয়ে নিচ্ছিল সমুদ্রচিল। ওদের এনে দাঁড় করানো হয়েছিল রসুই ছাউনির সামনে। সামান্য চাল ডাল মরিচ নুনের গন্ধ আমোদিত করছিল ওদের আড়াই দিনের ভুখা শরীর। অমনি হাউ মাউ করতে করতে সেখানে এসে আছড়ে পড়ল কতকগুলো লোক। কারও বুকে হাতে পায়ে বিঁধে আছে তীর। রক্ত ঝরছে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে লোকগুলো। লোকগুলো ভয়ার্ত, তৃষ্ণার্ত। লোকগুলো চিৎকার করছিল, ডাক্তার ডাক্তার, বাঁচাও, তুমি বাঁচাও। যে ডাক্তারকে ওরা জল্লাদ বলে গালি দিত, প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে ওরা সেই ডাক্তারকেই আকুল ভাবে ডাকছিল। টিনের থালার ওপরে দেওয়া গরম লাপসির ধোঁয়াতে চোখের সামনেটা তখন ঝাপসা হয়ে গেল বুধাদের। দৌড়ে এল সেই পিশাচ লালমুখো। ক্রূর হেসে বলল, দেন? পালালে না? যাও পালাও। লোকগুলো ছটফট করতে করতে হাত জোড় করে কাতর প্রার্থনায় বার বার বলছিল, ডাক্তার তীর বের করে দাও, যন্ত্রণা, যন্ত্রণা। বের করে দাও এই বিষতীর। একটু ওষুধ দাও, একটু ওষুধ।

ওয়াকার সাহেব বললেন, সেবাই একজন ডাক্তারের ধর্ম। আমি সেই কাজ করতেই এখানে এসেছি। তোমরা মানবে না তো এই রকম ভাবেই মরবে। আজ সকালে এখান দিয়ে একটা জাহাজ কলকাতায় ঢুকছিল আমি সেই জাহাজে তোমাদের ডিসমিসের খবর পাঠিয়ে দিয়েছি। ডেথ অ্যারাউন্ড এইট্টি মেন ফর জংলি মেনস অ্যাটাক। আমার ওষুধ আমার স্লেভদের জন্য। তোমরা এখন আইডেনটিটি লেস। গো টু হেল। ডাক্তারের পায়ের ওপর গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল লোকগুলো। ডাক্তার মাফ করো। বাঁচাও।

মহাবীর বুধাকে কনুইয়ের ধাক্কা দিয়ে বলল, খা, খেয়ে নে। না জানি কখন হাত থেকে আবার থালাটা কেড়ে নেবে। সম্বিত ফিরে পেয়ে বুধা গবগব করে খেতে লাগল গরম খিচুড়ি। একটা গ্যাসলাইট জ্বালানো হল খুঁটির ওপরে।


কুড়ি

তীর বের করার পর হাতে পায়ে বুকে ব্যান্ডেজ পড়ল লোকগুলোর। ওষুধও পড়ল ক্ষতে। ব্যথা উপশমের ওষুধ পেয়ে লোকগুলো বার বার সেলাম ঠুকতে লাগল ব্রিটিশ গুলাগকে। বুধা ফিসফিস করে মহাবীরকে বলল, এই লোকগুলোর কপালে দুঃখ আছে, এই ব্যথা নিয়েই আবার কাল সকালে কাজে যেতে হবে। তবে আমি এতক্ষণে বুঝেছি ব্যাপারটা, এখানে চারিদিকে খুব জংলি বুনো মানুষ আছে যেগুলো বাঘের থেকেও ভয়ঙ্কর। এই লোকগুলোর কথাই বলছিল রঙ্গিতলাল।

ভঞ্জ বলল, এ তো জলে কুমির ডাঙায় বাঘের মতো অবস্থা রে ভাই, কী জানি কী অপেক্ষা করে আছে কাল থেকে আমাদের কপালে। তবে ডাক্তার এত সেলাম পেয়েছে আজ যে কাল মনে হয় কিছুটা নরমই থাকবে। বুঝলি বুধনাথ প্রথম ক’দিন গায়ে জোর লাগিয়ে খুব কাজ তুলে দিতে হবে, যাতে আগেভাগেই সাহেবের মন পাওয়া যায়। সাহেবের নেকনজরে পড়তে পারলে বেশ কিছু সুযোগসুবিধা পাওয়া যাবে বলে মনে হয়। আগে সবকিছু বুঝে নিতে হবে। হুটোপাটা করে কোনো কাজ করতে গেলে এদের মতোই অবস্থা হবে।

ঠিক। ঘাড় নাড়ল বুধা। ভাবিয়া করিয়ো কাজ করিয়া ভাবিও না। কাকা তুমি বয়স্ক লোক, আমাদের জাহাজে আসা লোকেরা আমরা তোমাকেই নেতা বানালাম। দল বেঁধে না থাকলে এখানে বাঁচা যাবে না।

মহাবীর বলল, তুই একদম ঠিক বলেছিস বুধনাথ, তবে আমরা তো মাত্র ক’জন। দল যত বড় হবে শক্তি বাড়বে ততই। আসতে আসতে মিশতেও হবে কিন্তু সবার সঙ্গে।

ভঞ্জ বলল, এটা জেল পাওনি, কাল থেকে ওসব কোনো কিছুরই সময় পাওয়া যাবে না। এগুলো তো শুয়ে শুয়ে কাতরাবে। এগুলোর সব কাজ এসে আমাদের ঘাড়ে চাপবে। মহাবীর বলল, যা বলেছ কাকা, আজ খাবার জুটেছে, বরং পারি যদি একটু ঘুমিয়ে নি। পাশ ফিরে শুতে শুতে বুধনাথ বলল, আমরা কী পেলাম বলো তো কাকা? জীবনটা কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে, লন্ডভন্ড হয়ে গেল সব।

ভঞ্জ বলল, হুম্‌ লাভের লাভ আমাদের কিছুই হল না, যা লাভ হল তা বরং ওদেরই। তবে কী জানিস, আমি প্রায় মুখ্যসুখ্য মানুষ, সেপাই দলে যোগ দিয়েই বরং কিছু জ্ঞানগম্যি বেড়েছে। তাতে আমি যা বুঝি, বড় লাভ খুব তাড়াতাড়ি জোটে না। অনেক সময় লাভ হল কি ক্ষতি হল তা বুঝতে বুঝতে জীবনটাও চলে যায়। নোঙরের শব্দে সচকিত হল ওরা। লাহোরের জাহাজ এল। স্বস্তির শ্বাস ফেলে মহাবীর বলল, তবু সঙ্গী বাড়ল। বুধনাথ বলল, সংখ্যা দিয়ে কী করবে, এখানেও তো অনেক জন আছে, যে যার মতো দল পাকিয়েছে।

হাওয়া বিপথগামী,

রাত্রিরও অন্ধকার গাঢ়

সমুদ্র ঝঞ্ঝায় ক্ষুব্ধ;

নোঙর ছিন্ন, ভাঙা।

কান্ডারি, তবু তুমি এখনও ঘুমিয়ে!

চমকে উঠল ওরা। মহাবীর বলল, এখানে শায়েরি বলে কে? বুধনাথ বলল, ওসব এত্তেলবাজ বেত্তেলবাজ বড় লোকদের ব্যাপার, ওসব শায়েরি মায়েরি আমি বুঝি না।

মহাবীর উঠে বসে বলল, আমিও বুঝি না, তবে যারা বলে বা লেখে তাদের আমার খুব ভালো লাগে। তারা দিলদরিয়া মানুষ হয়, যাই একটু পটিয়ে আসি লোকটাকে, ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে। বিদ্যেবুদ্ধি জানা লোক তো।

ভঞ্জ খ্যানখ্যানে গলায় বলল, মহা খ্যাপার সঙ্গ কোরো না, তরী নিয়ে মাঝসাগরে ডুববে, ওসব লোকরা খ্যাপা হয়। না হলে কি এই নরকে এসে মাঝরাতে কেউ শায়েরি বলে।

বুধনাথ বলল, তা যদি বলো কাকা, সে স্বর্গ হোক আর নরক, আকাশে যদি অমন চাঁদ থাকে আর নীচে যদি অমন সাগর, তা পরানটা এমনিই খলবলিয়ে ওঠে, নেহাত সুর ধরলে যদি আবার চাবুকের বাড়ি খাই তাই ভয়ে আমি গুনগুনাচ্ছি না।

মহাবীর বলল, আজ রাতে তো আর ওদের নম্বর টম্বর পড়বে না, এখনই যা একটু কথা বলার সুযোগ, বুধা চল না।

বুধা বলল, আমার গায়ে বড় বেদনা, তবু চলো অমন লোকের সঙ্গে কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না।

কোঁকাতে কোঁকাতে উঠল বুধনাথ, ওই যেখানে সার দিয়ে কয়েদিরা ঢুকছে, সেখানে গিয়ে দাঁড়াল দু’জনে, একটা ঝাঁকড়া গাছের আড়াল নিয়ে। একটা লালমুখো গুনতি করছে কয়েদিদের। যেন দেখছে ক’টা বলির পাঁঠা এল। লাইন একটু বাঁক নিতেই মহাবীর ফিসফিস করে বলল, কবিবর আপনার শায়েরি আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে।

লোকটা যেন তন্দ্রা ভেঙে জেগে উঠে বলল, কে?

বুধনাথ বলল, আমরা আজ সকালে এসেছি, এটা একটা নরক, কবিয়াল। তোমার মতো শায়ের এখানে কী করে বাঁচবে?

লোকটা বলল, কে চায় বাঁচতে? কুক্কুরের মতো জীবন বাঁচাতে কে চায় এখানে? এ মাটির বুকে যদি দিয়ে যাই রক্ত, তাও তো থাকবে।

মহাবীর বলল, তওবা, তওবা। শুনেছি গুণী মানুষের কদর করে সাহেবরা, তবে ওই, শুধু তাদের গুণগান গাইতে হবে।

বড় করে শ্বাস ছেড়ে কবি বলল, ওটাই তো পারলাম না ভায়া। আপোস, খ্যাতির লোভে নিজেকে বিক্রি করে দিল আমার বন্ধু, আর আমি আমার মাটির জন্য রক্ত দিলাম। দুটোই কিন্তু থাকবে, জানো। আমার বন্ধুর কবিতাও থাকবে, হতে পারে সে বেইমান, স্তুতিকার, তল্পিবাহক। কিন্তু সে পাক্কা কবি। কাব্যের বিচার কালের কাছে। তার কবিতা কালজয়ী। এখন হয়তো সে সামনে এলে আমি তার মুখ দেখব না, কিন্তু ওর কবিতা আমাকে বাঁচিয়ে রাখে।

বুধনাথ বলল, কে আপনার বন্ধু কবিবর?

কবি বুক ফুলিয়ে বললেন, মির্জা মহম্মদ আসাদুল্লাহ খান গালিব।

মহাবীর বলল, এই! ওই হারামি গালিব? ও তো লরেন্সের জন্য স্তুতি লিখেছিল, আমি জানি। আমার সঙ্গে জেলে এক আকবর ভাই ছিল, ও বলেছে।

—হেই। চেঁচিয়ে উঠলেন কবি, আমার বন্ধুকে গালি দেবে না বলছি। যে কবিতা ভালো লেগেছে বলে ছুটে এসেছিলে তোমরা, ওটা তো তারই কবিতা ছিল।

মহাবীর বলল, কিন্তু গালিব সাব আমাদের বিদ্রোহের আগাগোড়া বিরোধিতা করেছেন।

কবি বললেন, সে তো ওপরে। অন্নের জন্য মানুষকে কত কিছুই করতে হয়। সবারই কি সমান মনের জোর থাকে? আর সবাই তো এক কাজ করার জন্য জন্মায়ওনি। আমার নাম মজনু করিম। আমি দেশের জন্য প্রাণ দিলেও আমার নাম লোকে মনে রাখবে না, গালিব মিঞার নাম একশত বছর পরেও লোকে মনে রাখবে। সে যে আমাকে সভায় বসতে দিত, বন্ধু বলে মান দিত, তাতেই আমার গর্বে বুক যেত ভরে। মহাবীর বুধার হাত টেনে ধরে বলল, চল এখান থেকে কেটে পড়, কাকার কথাই ঠিক, এ লোক খিটকেল আছে।

ঘুমিয়ে পড়ল ওরা। যেন নেতিয়ে কাদার মধ্যে ডুবে গেল ক্লান্তিতে। রাতে আগত কয়েদিদের কী হল না হল যেন টেরই পেল না। খ্যাং খ্যাং খ্যাং খ্যাং ভাঙা কাঁসির শব্দে ঘুম ভাঙল ওদের। ভোর হচ্ছে। ভীত অবিন্যস্ত পাখির ডাকাডাকিতে ছন্দপতনের আভাস। সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়াতেই নির্দেশ এল মার্চের। নম্বর না পড়া লাহোর থেকে আগত কয়েদিদেরও যোগ দিতে হল পদযাত্রায়। জানা গেল আজ ওয়াকার সাহেব কয়েদিদের জন্য আয়োজন করেছেন বিশেষ প্রশিক্ষণের, আর প্রশিক্ষণ শেষে বিশেষ ভোজন উৎসবের। যাতে কয়েদিদের মধ্যে নতুন করে কাজের উৎসাহ সঞ্চারিত হয়। প্রত্যেকের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল দড়ি, কুড়ুল আর এক গাড়ু করে জল।

আহত কয়েদিদের প্রস্তুত হতে হল প্রশিক্ষণ দেবার জন্য। কীভাবে নিপুণ তৎপরতায় কেটে ফেলা যায় শক্ত কাঠের গাছ। যারা একটু কম আহত ছিল তাদের লাগানো হল কাজে। ছুটির ঘণ্টা বেজে গেল একটু তাড়াতাড়িই।

শোনা গেল ওয়াকার সাহেব আজ বিশেষ ব্যবস্থা করেছেন কয়েদিদের জন্য। হরিণের মাংস, ডাল সবজি আর চাপাটি। কয়েদিরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল, গুলাগের তো চাকরি যায় যায়। সবক’টা কয়েদি পালিয়েছিল। ক’টা ফিরে এসে ওয়াকার সাহেবের মান বাঁচিয়েছে, তাই সাহেব খুব খুশি। এবার থেকে মনে হয় একটু নরম যাবে, বেশ ঘাবড়িয়েও গিয়েছে মনে হয়।

মাংস খাওয়া নিয়ে কোনো জোরাজুরি নেই। যারা খাবে তারা খাবে, যারা খাবে না তারা নিরামিষ সবজি ডাল। হরিণও এখানে এসেছে তাদের মতোই জাহাজে চড়ে। সাহেবদের আজ নাকি এলাহি মদ আর মাংসের ব্যবস্থা। কাঠের জ্বালে রান্না বসেছে আজ দুপুর থেকে। বুধার তবু যেন আজ একটু ভালো লাগছে, চারিদিকে বেশ একটু খুশি খুশি উৎসব উৎসব ভাব।

প্রাণ পাখি তুমি কেন এলে না, গাছ কেটে ফিরবার পথে বুধা গানও করছিল দু এক কলি। কাল ওই পাগলা কবির সঙ্গে কথা বলে লাভের লাভ কিছু হয়নি বটে, তবে মনে একটা ভারি গর্ব ঢুকেছে শিল্পী বলে। আহা শিল্পী মানে সে ঈশ্বরের স্নেহধন্য, তার শোক-তাপে বিচলিত হলে চলবে কেন? মনের আনন্দ তার যেন কখনও চলকে না পড়ে বাইরে। এই শরীর তো অনিত্য, কিন্তু এর গায়ে লেপ্টে আছে যে প্রেম তা তো অবিনশ্বর। আহা কী সব গান, কী সব কথা নারায়ণ পাঁচালির। মহাবীর যাই ভাবুক না কেন, ওই কবিকে বুধা আবার ধরবে ঠিক। কথা বলে সুখ পাবার মানুষ বড় কম।

বেশ ঘন জঙ্গল এদিকটায়। মাটির সঙ্গে আড়াআড়ি শোয়ানো বড় বড় গাছের ডাল। মস্ত সবুজ পাতার মধ্যে কোথাও বা নীল ল্যাজ নাচিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট পাখি। অ্যাটেনশান! খাড়া হয়ে দাঁড়াল সব কয়েদি। দু’পাশে গাছের ডালের সঙ্গে বাঁধা মস্ত লাল কোম্পানির পতাকা। গটগটিয়ে এসে দাঁড়ালেন গোরা ডাক্তার জেমস ওয়াকার। —নাও আই উইল প্রেজেন্ট আ ম্যাজিক শো বিফোর ইউ। হামি তোমাদের জন্য একটা জাদুর খেলা দেখাবে। জাদু খেলা দেখানোয় আমার শখ আছে। তোমাদের মধ্যে কেউ জাদুগর আছে?

সকলেই চুপ করে রইল দেখে ডাক্তার বললেন, দেখো, এবরাকাডাবরা গিলি গিলি গে, বলে মুঠি ছুড়ে দিলেন পর্দার দিকে, দুপাশের লোক দুটো কাঠের গুঁড়ির তৈরি টুলের ওপর উঠে খুলে নিল পর্দাটা। দেখা গেল লম্বা ডালের সঙ্গে বাঁধা সার সার ছ’টা ফাঁসির ফাঁদ আর পিছনে ছ’জন ছ’জন করে সারিবদ্ধ ভাবে পিছমোড়া করে হাত মুখ বাঁধা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে গতকালের পলাতক আহত কয়েদিরা, যারা ফিরে এসেছিল শুশ্রূষার আশায়। তদের ঘিরে গোল করে দাঁড়িয়ে আছে ব্রিটিশ সেপাই।

দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠল সকলে। চিৎকার করে উঠলেন ওয়াকার সাহেব। আমার সঙ্গে গদ্দারি, আমাকে ধোঁকা দিতে গিয়েছিল সব। এই যে বজ্জাৎ কয়েদিরা সব দেখে নাও। আমার সঙ্গে বেইমানি করতে গেলে কী পরিণতি হবে। কাজ চাই কাজ। কোনো ভাবেই পালাবার কোনো পথ নেই। কাজ না করতে চাইলে মরতেই হবে। একদিনেই ঝুলাব সব কটাকে।

কয়েদিদের মুখের বাঁধন উপচে অব্যক্ত গোঙানি ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। বিনা বাক্যব্যয়ে পরপর ছ’জনকে পাঁজাকোলা করে তুলে ধরে ঝুলিয়ে দেওয়া হল ফাঁসির দড়িতে।

ঘাড় মটকে ঝুলে গেল ছয়জন। ওয়াক করে বমি করে ফেলল বুধনাথ। মহাবীর বলল, গুলি করল না কেন জানিস, শব্দ হবে যে। যদি বুনোরা তীর নিয়ে তেড়ে আসে। এরপর কয়েদিদের দিকেই নির্দেশ এল ঝটপট ওদের নামিয়ে ফেলতে। পরের ছ’জন তৈরি হয়ে আছে ঝুলবার জন্য।



নামিয়ে নিয়ে শুইয়ে দেওয়া হল ওদের মাটিতে, ঠিক একই ভাবে ফের ঝুলিয়ে দেওয়া হল আরও ছয়জনকে। হা হা করে হেসে ওয়াকার সাহেব বললেন, ম্যজিক ভালো লাগছে? আজ, আশি জন কয়েদিকে ফাঁসিতে ঝুলানো হবে। ইট ইজ আ রিয়াল ম্যাজিক শো অব এনটায়ার টাইম পিরিয়ড অব হিউম্যান সিভিলাইজেশন। নেক্সট। প্রচুর ব্রিটিশ সিভিলিয়ানকে মেরেছ তোমরা ব্লাডি সেপয়, ইউ ডিডন্ট ইভন মার্সি দ্য ইনোসেন্ট গাইস।

ভঞ্জ বলল, গাই তো আমাদের ভগবান, আমরা আবার গাই মারলাম কোথায়? বরং ওরাই তো গোমাংস খায়।

মহাবীর বলল, আরে না না, সাহেবরা মানুষকেই গাই বলে।

ফের একসার মৃতদেহকে ঢিপির মতো উঁচু করে শুইয়ে দেওয়া হল আগের মৃতদেহগুলোর ওপরেই। ওয়াকার সাহেব বললেন, দেন, ইয়োর কালাপানি বিকামস আ রিয়েল কালাপানি। ফাঁসি কমপ্লিট হলে এদের ঠ্যাং ধরে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হবে, দ্যাটস লাইক ইয়োর ফেমাস দশেরা ফেস্টিভাল, বিসর্জন।



এই বার গোঁ গোঁ করতে করতে কাত হয়ে গেলেন কবি। বলতে লাগলেন, গালিব মিঞা তুমিই ঠিক, তুমিই ঠিক। সৃষ্টিশীল মানুষকে বিক্ষুব্ধ তরঙ্গের মধ্যে এসে পড়তে নেই, তাকে দূর থেকে সব দেখতে হয়। তাদের মন বড় কোমল, বাস্তবের নৃশংসতা গ্রহণ করবার মতো শক্তি তাদের থাকে না। ওহ কী বীভৎস। কী বীভৎস।

বিসর্জনের পর মদ আর মাংসের উৎসব বসল সাহেবদের তাঁবুতে আর হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে অভুক্ত অবস্থায় জড়ামড়ি করে বসে রইল সব কয়েদিরা। যত রাত বাড়তে লাগল, লাল নীল দাগ কাটা কোম্পানির মস্ত বড় পতাকা ভয়ের চাদর হয়ে ঢেকে ফেলতে লাগল ওদের সবাইকে।


ক্লিক করুন পরের পাতায়
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *