সেরে ওঠো তুমি
বিনোদ ঘোষাল
প্লেনের চাকা রানওয়ের মাটি স্পর্শ করার সময় মৃদু ঝাঁকুনি খেল। রিনা শেখরের বাঁহাতটা আবার শক্ত করে ধরলেন। শেখর রিনার সেই হাতের ওপর হাত রেখে বললেন, কী হল ভয় করছে? নামার সময়ে এমনটা হয়। ভয়ের কিছু নেই।
রিনা কোনও কথা বললেন না। শেখরের মুখের দিকে তাকালেন শুধু।
শেখর বললেন, এই দেখো পৌঁছে গেলাম।
কলকাতা-জয়পুরগামী প্লেন জয়পুরের রানওয়েতে বেশ কিছুটা ছুটে চলার পর একসময় থেমে গেল। যাত্রীদের মধ্যে হ্যান্ডলাগেজ নামানোর হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। শেখরের বরাবর এই ব্যাপারটা অত্যন্ত বিরক্তিকর লাগে। ফ্লাইটের বেশিরভাগ যাত্রীই ল্যান্ড করার সঙ্গে সঙ্গে এমনভাবে লাগেজ টানাটানি শুরু করে দেন যেন এখনই তাকে দৌড়ে বেরিয়ে বাইরে অটো বা বাসের লাইনে আগে দাঁড়াতে হবে, অথচ সকলেরই জানা যে ফ্লাইট থামলেও তার দরজা খুলতে এবং বেরোতে যথেষ্ট সময় লাগে, এবং প্লেনের ভেতরে কেউ কারও পাশ দিয়ে যেতে পারে না, অথচ তারা এমনটা করবেই। শেখর কোনওদিনই এমন হড়বড় করেন না। সবাই উঠে দাঁড়ালেও তিনি চুপচাপ নিজের সিটে বসে থাকেন। পেশাগত কারণে তিনি জীবনে অনেকবার ফ্লাইটে যাতায়াত করেছেন। কোনওদিনই বেরোনোর সময় উঠে দাঁড়িয়ে তাড়াহুড়ো করেননি। রিনার এই প্রথম প্লেনযাত্রা। আগে দু’জন ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে ঘুরেছেন একসঙ্গে, কিন্তু কোনওবারই প্লেনে নয়, ট্রেনে। তার কারণ রিনার ভয়। চিরকালই প্লেনে ভীতি রিনার। মনে ভয় যদি আকাশ থেকে ভেঙে পড়ে। দুর্ঘটনা যে ট্রেনেই বেশি হয় সেটা আর ওকে কে বোঝাবে!
ভয় কমল তোমার? শেখর জিজ্ঞাসা করলেন রিনাকে।
হুঁ।
দেখলে তো টেরই পেলে না কেমন চট করে কলকাতা থেকে রাজস্থান পৌঁছে গেলাম। ট্রেনে এলে টানা দুইদিন বসে থাকতে হত।
রিনা বললেন, তবু আমার ট্রেনই ভাল বাবা!
শেখর রিনার কথায় মৃদু হাসলেন।
রিনা বললেন, সবাই তো নেমে যাচ্ছে, এবার নামো।
আরে কেউ নামেনি, ডোরই ওপেন হয়নি, এদের সবেতেই তাড়া। চুপ করে এখন বসে থাকো, নইলে ফালতু ঠেলাঠেলি করে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
রিনা বসেছিলেন উইন্ডোসিটে, তার পাশে শেখর। তারপাশে একজন যুবক। পুরো রাস্তাটাই সে মোবাইলে সিনেমা দেখে কাটিয়েছে। ছেলেটি বাঙালি, নাম অরিত্র ঘোষ। রবীন্দ্রভারতী ইউনিভার্সিটিতে ড্রামা নিয়ে পড়ছে, যাচ্ছে রাজস্থান ঘুরতে।
শেখর অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, একা?
হ্যাঁ আঙ্কল। সোলো ট্রিপ।
ভাল লাগে একা ঘুরতে?
হ্যাঁ আমার একা ঘুরতেই ভাল লাগে। বছরে দু-তিনটে ট্রিপ করি, একাই।
তোমার মা-বাবা কিছু বলেন না!
মা বাবা…বলে থমকে গেছিল ছেলেটা, তারপর বলেছিল, না বলে না। দে আর ডাইভোর্সড। আমি পিজিতে থাকি।
ওহ সরি!
নিড নট টু সরি স্যর, ইটস ওকে। দে আর হ্যাপি, মি অলসো হ্যাপি, দ্যাটস অল। বলে আবার কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে নিয়েছিল।
রিনাও শুনেছিলেন ছেলেটির কথা। অবাক হয়েছিলেন। আজকালকার ছেলে-মেয়েরা যেন কেমন, রিনার মনে পড়েছিল বুকানের কথা। রিনা আর শেখরের একমাত্র ছেলে। থাকে ক্যালিফর্নিয়ায়। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়র। দুই -তিন বছর পর একবার করে বাড়ি আসে, ওখানেই সেটল। বুকান বিয়ে করেনি, অনেক আগেই মা-বাবাকে জানিয়ে দিয়েছিল তার বিয়ে করার কোনও ইচ্ছা নেই। রিনা এই কথা শুনে অবাক হয়েছিলেন, একটা সুস্থ স্বাভাবিক আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ছেলে বিয়ে করবে না এটা শুনে এটাকে অস্বাভাবিক মনে করেছিলেন, শেখর কিন্তু বলেছিলেন ছেলে বড় হয়েছে, এখন ওর জীবনের সিদ্ধান্ত ওকেই নিতে দাও। রিনা তবু দুই একবার ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করে দেখেছিলেন, পারেননি। আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। এখন বুকানের বয়সও প্রায় চল্লিশ। প্রায় অনেক বছর হয়ে গেল ও ইউএসএ-তে সেটলড। মাঝেমাঝে ফোনে কথা হয়। এইটুকুই যোগাযোগ। চাকরি পাবার পর বুকান বাড়িতে টাকা পাঠানো শুরু করেছিল, শেখর বারণ করে দিয়েছিলেন, ছেলেকে বলেছিলেন, কোনও দরকার নেই, তুই সেভিংস কর, যখন দরকার লাগবে চেয়ে নেব। এটা কোনও অভিমান নয়, শেখরের টাকার সত্যিই প্রয়োজন ছিল না, একটি বড় কোম্পানির পারচেজম্যানেজার ছিলেন তিনি। মাসে স্যালারি যথেষ্ট ভাল, তাই ছেলের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কোনও প্রয়োজন ছিল না। বুকান বাবার কথা শুনেছিল, তবে পুজোতে একটা টাকা পাঠায় প্রতিবছর। এক বছরও তা মিস হয়নি। এত বছরে শুধু বার দুয়েক পুজোয় এসেছিল, আর আসেনি। বুকানের ইচ্ছা ছিল মা-বাবাকে একবার ক্যালিফর্নিয়ায় নিয়ে আসার, ঘোরানোর। শেখরের বিশেষ আপত্তি ছিল না, কিন্তু রিনা রাজি হয়নি। কারণ ওই এরোপ্লেন, অতক্ষণ প্লেনে চাপতে হবে আবার সেই প্লেন সাগরের ওপর দিয়ে যাবে তা শুনেই উনি ভয়ে অস্থির। যদি প্লেন মাঝসমুদ্রে ভেঙে পড়ে তখন কী হবে! বুকান আর শেখর কেউই রাজি করাতে পারেনি রিনাকে। তাই আর যাওয়া হয়নি। এবারের প্লেনসফরও হত না, শেখর যে কত কষ্ট করে এই প্রথমবার স্ত্রীকে রাজি করিয়েছেন তা একমাত্র তিনিই জানেন।
প্লেনের দরজা খোলা হল। যাত্রীরা বেরোতে শুরু করলেন। কিছুটা হাল্কা হওয়ার পর শেখর উঠলেন। পাশের ছেলেটিও উঠে দাঁড়িয়েছে। ওর ল্যাপটপ ব্যাগটা নামিয়েছে। শেখরকে জিজ্ঞাসা করল, আপনার হ্যান্ডব্যাগ নামিয়ে দেব?
শেখর বললেন, না থাক, আমি নিয়ে নেব।
ওক্কে স্যর। বেরোনোর সময় বাই স্যর, বলে একবার হাত নাড়ল ছেলেটা, তারপর গুনগুন করতে করতে এগিয়ে গেল। রিনার মাথাটা অল্প ঘুরছে। প্লেনটা যখন আচমকাই মাটি ছেড়ে আকাশে উঠে গেছিল তখন মাটির সবকিছুকে হঠাৎ শোঁও করে নিচে চলে যেতে দেখে প্রবল ভয় পেয়ে শেখরের হাত খামচে ধরেছিলেন রিনা। শেখর হেসে বলেছিলেন আরে কিচ্ছু ভয়ের নেই। নিচে দেখো একবার জানলা দিয়ে।
না বাবা আমি কিছু দেখব না। রিনা মুখ ফিরিয়ে ছিলেন, তার কিছুক্ষণ পর আবার যখন জানলা থেকে বাইরে তাকিয়েছিলেন চোখের সামনে ঝকঝকে মেঘগুলিকে দেখে তার মন শিশুর মত উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল, শেখরকে বলেছিলেন, এই দেখো দেখো কী সুন্দর!
শেখর বলেছিলেন, তুমি দেখো। এখন মেঘেদের সঙ্গে তুমি যাচ্ছ।
উফফ কী অপূর্ব লাগছে। দুপুরবেলার ঝকঝকে রোদে মেঘগুলিকে উজ্জ্বল সাদা রাজহাঁসের মত মনে হচ্ছিল। রিনার মনে হয়েছিল তিনিও ওই মেঘগুলির সঙ্গেই ভেসে চলেছেন। এমন অভিজ্ঞতা তার আগে কখনও হয়নি। ভারি সুন্দর লাগছিল। প্লেন এত উঁচুতে ছিল যে নিচের কিছুই দেখা যাচ্ছিল না, তাই ভয়টা কেটে গেছিল। মাঝে একবার কফিও খেয়েছেন। যদিও কফির দাম শুনে রিনা সেটা কিনতে আপত্তি করেছিলেন, কিন্তু শেখর রিনার আপত্তি শোনেননি। তোমার খেতে ইচ্ছা হয়েছে, খাও। অত ভাবতে হবে না। দুটো কুকিজের প্যাকেট আর দুটো ব্ল্যাক কফি নিয়েছিলেন শেখর।
চমৎকার প্লেনজার্নিটি সেরে কিয়স্ক পেরিয়ে এয়ারপোর্টের লাগেজবেল্ট থেকে লাগেজ নিয়ে দুজনে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলেন কথামত একজন লোক হাতে শেখর ব্যানার্জি লেখা কাগজ ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। শেখর হাত নাড়লেন। লোকটি এগিয়ে এসে বলল, নমস্তে স্যর, ওয়েলকাম টু জয়পুর।
রিনা আর শেখর প্রতিনমস্কার করলেন। লোকটি বলল, লাগেজ হামকো দিজিয়ে স্যর। বলে শেখরের হাত থেকে ট্রলি ব্যাগ আর কাঁধে নেওয়ার ব্যাগটি নিয়ে বলল আইয়ে স্যর কার পার্কিং মে হ্যায়। সামনেই পার্কিং। শেখর দেখলেন অজস্র গাড়ির মধ্যে দুধসাদা একটি ডিজায়ার তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। লাগেজ গাড়ির মাথায় তুলে দেওয়ার পর এয়ারপোর্ট ছাড়ল। চলতে থাকল সুন্দর ঝকঝকে রাস্তা দিয়ে। গাড়িতে এসি চলছে। রিনা দেখছিলেন বাইরেটা। অনেকদিন পর ঘরের চারদেওয়াল ছেড়ে বেরিয়েছেন তিনি। মন বড়ই খুশি। শেখর তার স্ত্রীর মনের উৎফুল্লতা বুঝতে পারছিলেন। জয়পুরকে পিঙ্কসিটি বলা হয় কিন্তু আশপাশের কোনও বাড়িই গোলাপীরঙের দেখা যাচ্ছিল না। রিনা একসময় ড্রাইভারকে ভাঙা হিন্দীতে জিজ্ঞাসা করেই ফেললেন, ভাইসাব, শুনেছিলাম যে জয়পুরকে পিঙ্কসিটি বলা হয় কিন্তু একটাও তো পিংক কালারের বাড়ি দেখতে পাচ্ছি না।
ড্রাইভার হেসে উত্তর দিলেন, ম্যাডাম আমরা এখনও মূল শহরে ঢুকিনি, এখনও পুরনো সিটির বাইরে রয়েছি, ভেতরে ঢুকলে দেখতে পাবেন।
কতক্ষণে ঢুকব?
এই তো ম্যাডাম আর কিছুক্ষণের মধ্যেই।
আচ্ছা আমাদের সাইটসিইং কি আজ থেকেই শুরু হবে?
সেটা আমি বলতে পারব না ম্যাডাম। আমার ডিউটি শুধু আপনাদের ড্রপ করে দেওয়া।
ও আচ্ছা। বলে রিনা শেখরের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী গো আমাদের কি আজ থেকে বেড়ানো শুরু?
শেখর বললেন, না না আজ রেস্ট ডে। যারা ট্রেনে এসেছেন অপারেটরের সঙ্গে তারাও আজ সকালেই পৌঁছেছেন। আজ সম্ভবত সন্ধের দিকে নিজেদের মত শহর ঘোরার ব্যাপার। কাল থেকে ট্যুর শুরু।
তাহলে আমরা সন্ধেবেলা নিজেরা বেরোব?
হ্যাঁ তোমার শরীর ঠিক থাকলে বেরোতেই পারি।
আমার আবার শরীরের কী? বেড়াতে এসে হোটেলে বসে থাকব নাকি?
শেখর হাসলেন। রিনা মাঝেমাঝে বাচ্চাদের মত হয়ে যান। এতবছরের বিবাহিত জীবন কাটানোর পর একে অপরের নিঃশ্বাসটুকুও চেনেন তারা। কারও মনের কোণে জমে ওঠা ইচ্ছা তো বুঝবেনই। শেখর বললেন, আমি দেখেছি হোটেলটার কাছেই রয়েছে হাওয়ামহল। সন্ধের পর ওখানে লোক ভিড় করে। খুব সুন্দর লাগে নাকি দেখতে।
তাই! তাহলে যাব।
হুঁ আগে চলো হোটেলে উঠি।
পৌঁছতে আরও আধঘন্টা সময় লাগল। গাড়ি উঠল বেশ সুন্দর একটি হোটেলের পোর্টিকোতে। লাগেজ নামিয়ে রিসেপশনে রেখে চলে গেল ড্রাইভার। শেখর রিসেপশনে গিয়ে বললেন, জগন্নাথ ট্র্যাভেলস।
রিসেপশনিস্ট তখনই বলল, হ্যাঁ স্যর। আপনার নামটা বলবেন?
শেখর নিজের নাম বললেন, কম্পিউটার থেকে শেখরের নাম খুঁজে বার করে রিসেপশনিস্ট বললেন, স্যর আপনার রুম নাম্বার দুইশো সাত। আপনি প্লিজ একটু ফর্মালিটিজটা সেরে নিন। লাগেজ আমরা রুমে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
আচ্ছা, আমাদের ট্যুর অপারেটর কোথায়?
রিসেপশনিস্ট বললেন, সেটা আপনি একবার কল করে নিতে পারেন, স্যর। আমি ঠিক বলতে পারব না। আর স্যর লাঞ্চ কি রুমে পাঠিয়ে দেব নাকি ডাইনিং রুমে খাবেন?
আচ্ছা রুমেই পাঠিয়ে দেবেন।
আচ্ছা স্যর। লাঞ্চের মেনু আপনাদের ট্যুর অপারেটর ঠিক করে দিয়েছেন, তার বাইরে যদি কিছু নিতে চান এক্সট্রা চার্জ পড়বে।
আচ্ছা।
স্যর, ভেজ না ননভেজ?
শেখর রিনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী গো ভেজ না ননভেজ?
না না বাইরে মাছ মাংস খাবার দরকার নেই। কীসের না কীসের মাংস দেবে!
শেখর বললেন, আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে।
ভেজ অর্ডার করে শেখর ফর্মালিটিজ কমপ্লিট করে রুমে গেলেন। হোটেলটা ছিমছাম সুন্দর। রুমটা বেশ ভাল। শেখর জীবনে এই প্রথম কোনও ট্যুর অপারেটরের মাধ্যমে বেড়াতে এসেছেন। এর একটা কারণ রয়েছে। বছর দুয়েক আগে শেখরের একটা এ্যাটাক হয়ে গেছে। বুকে স্টেইন্ট বসানো। তাই তিনি একা বেড়ানোর রিস্ক নেননি। বুকানও বারণ করেছিল, বাবা কোনও ভাল ট্যুর অপারেটরের সঙ্গে যাও সেফলি ঘুরতে পারবে। শেখরের এই পরামর্শ যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল। বেশ কিছুদিন ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করে জগন্নাথ ট্যুরস এ্যান্ড ট্রাভেলসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন তিনি। ভাল প্যাকেজ। একটু কস্টলি কিন্তু রিভিউ ভাল, তাই এখানেই বুকিং করেছিলেন শেখর। প্যকেজে ট্রেনের জেনারেল স্লিপারক্লাস ইনক্লুডেড ছিল কিন্তু শেখর ট্রেনজার্নি করতে চাননি। এত লং জার্নি জেনারেল স্লিপারে খুবই হেকটিক ব্যাপার। তাই শেখর আলাদাভাবে ফ্লাইটের টিকিট কেটেছিলেন। এয়ারপোর্ট পিকআপ এবং ড্রপ এর দায়িত্ব অপারেটরের। সেইমত জয়পুরের হোটেলে পৌঁছেছেন দুইজন।
রিনা বললেন, আমার মাথাটা এখনও যেন একটু ঘুরছে।
সে কী এখনও ঘুরছে!
হুঁ।
ওটা মনের ব্যাপার, ভাল করে স্নান করে ভাত খেয়ে একটু ঘুম লাগাও দেখবে ঠিক হয়ে যাবে।
তাই যাই। হ্যাঁ গো বিছানার চাদরগুলো সব কাচা তো?
আরে হ্যাঁ, দেখে বুঝতে পারছ না এটা যথেষ্ট ভাল হোটেল। থ্রিস্টার ক্যাটাগরি।
আচ্ছা। বলে রিনা তার হ্যান্ডব্যাগ থেকে গঙ্গাজলের শিশি বার করলেন, তারপর রুমের মেঝে আসবাব এবং বিছানায় ছড়িয়ে দিলেন। তারপর স্যানিটাইজার স্প্রে করলেন। শেখর হাসলেন, রিনার এই স্বভাব আর গেল না, শেখর যেমন নাস্তিক রিনা ততটাই আস্তিক বরং ততোধিক খুঁতখুঁতে। বয়স যত বাড়ছে ততই যেন এসব চর্চা বাড়ছে রিনার। আগে শুধু প্রতি বৃহষ্পতিবার লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়া ছোট সিংহাসনে মাকালী, বাবা লোকনাথের ফটোতে ফুলমালা নকুলদানা জল দেওয়া সন্ধেবেলা শাঁখবাজানোর মধ্যেই ছিল কিন্তু দিন যত এগিয়েছে রিনার পুজো আচ্চার ধুম ততই বেড়েছে, বিশেষ করে বুকান বাইরে যাওয়ার পর থেকে আরও নতুন নতুন পুজো উপোস ব্রত ইত্যাদি বেড়েছে। শেখর এই নিয়ে মাঝেমাঝে ব্যঙ্গ করতেন, রিনার রাগ হত, পরে শেখর ভেবে দেখেছেন প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব কিছু ভাবনা-চিন্তা বিশ্বাস রয়েছে। সেগুলো অন্যের কোনও ক্ষতি না করলে তাতে হস্তক্ষেপ করা বা তাই নিয়ে হ্যাটা করা ঠিক নয়, বরং মেনে নেওয়া উচিত। শেখর তারপর থেকে আর কিছু বলেন না। কিছুদিন আগে রিনা এক গুরুদেবের কাছে দীক্ষাও নিয়েছেন। পাশের পাড়াতেই সেই গুরুদেবের আশ্রম রয়েছে সেখানে প্রতিদিন সন্ধেবেলা নাম-গান পাঠ ইত্যাদি হয়, রিনা নিয়মিত সেখানে যান। একটা বয়সের পর সকলেই নিজের নিজের জায়গা খুঁজে নেন, কারণ একটা সময়ের পর মানুষকে একা হতেই হয়।
ঘরের সর্বত্র গঙ্গাজল ছেটানোর পর রিনা বললেন, বাথরুমটা দেখো তো পরিষ্কার তো?
শেখর হাসলেন, রিনার এই পিটপিটে স্বভাব দিনে দিনে বাড়ছে। বললেন, আরে বাবা বললাম যে এটা থ্রিস্টার ক্যাটাগরির হোটেল, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হতে বাধ্য। ঘর দেখে বুঝতে পারছ না?
হুঁ তা পারছি, তবু তুমি একবার দেখে নাও, তারপর আমি যাব।
আচ্ছা। বলে শেখর টয়লেটটা চেক করে নিলেন, যেমনটি হওয়ার তেমনই, ঝকঝকে। অপারেটর আগেই তাদের ভ্রমণসূচীতে জানিয়ে দিয়েছিল কোন শহরে কোন হোটেলে রাখা হবে, আর শেখর ইন্টারনেটে দেখে নিয়েছেন। সবকটা হোটেলই স্ট্যান্ডার্ড।
রিনা ট্রলিব্যাগ থেকে নিজের জামাকাপড় বার করে টয়লেট গেলেন। এই ফাঁকে শেখর নিজের জামাকাপড় বদলে ফেললেন। ডিসেম্বর মাসের শেষ বলে গরম নেই, আর তা ছাড়া ফ্লাইট থেকে গাড়ি এবং হোটেল সর্বত্রই এসি থাকায় দিনের বেলা গরম থাকলেও তা টের পাওয়া যায়নি। বাইরের জামাকাপড় বিছানার ওপর রাখলেন না, রিনা দেখলেই রাগারাগি করবে। ওগুলো চেয়ারের ওপর রাখলেন। একবার অপারেটরকে ফোন করা দরকার।
ট্যুর ম্যানেজারের নাম সুব্রত দাশ। আগে কয়েকবার কথা হয়েছে। কথাবার্তা বেশ ভালই, সামনে কথা বললে আরও ভালভাবে বোঝা যাবে। শেখর ফোন করলেন।
দুইবার রিং হতেই দাশবাবুর কন্ঠ, হ্যালো, হ্যাঁ মিস্টার দাশ আমি শেখর ব্যানার্জি বলছি, আমরা হোটেলে চেক ইন করে নিয়েছি।
আপনারা…মানে ফ্লাইটে এসেছেন তো?
হ্যাঁ আমি আর আমার স্ত্রী।
হ্যাঁ স্যর, বুঝেছি, কোনও অসুবিধা হয়নি তো?
না না ঠিক আছে।
আচ্ছা, আপনারা লাঞ্চ করে নিন।
হ্যাঁ অর্ডার করেছি, আচ্ছা বলছি যে বিকেলে আমরা আশপাশে একটু ঘোরাঘুরি করব ভাবছি, এখান থেকে কীভাবে করব?
কোনও ব্যাপার না, স্যর। আপনারা লাঞ্চ করে নিন, আমি কিছুক্ষণ পর আপনার রুমে গিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছি। কত নাম্বার যেন আপনাদের?
শেখর রুম নাম্বার বললেন।
দাশবাবু বললেন, ওক্কে স্যর। আপনারা লাঞ্চ করে নিন আমি তারপর আসছি।
রিনা টয়লেট থেকে বেরিয়ে বললেন, বাবা গরমজলটা কী সাংঘাতিক গরম, বুঝতে পারিনি, কল খুলে ফেলেছিলাম, হাতটা গেল পুড়ে।
ইসস একটু দেখে নেবে তো? কই দেখি? শশব্যস্ত হয়ে পড়লেন শেখর। রিনা ডানহাতের কব্জিটা তুলে দেখালেন। ফর্সা হাতটা একটু লালচে হয়ে উঠেছে।
জ্বালা করছে?
হুঁ।
ঠান্ডাজলে ডুবিয়ে রাখো। কী যে করো না! এখন যদি ফোস্কা পড়ে! দাঁড়াও দেখি কী ওষুধ দেওয়া যায়।
আবার ওষুধ কেন লাগবে? এমনিই কমে যাবে।
না তোমার আজ পর্যন্ত এমনই কিছু কমেছে? বললেন শেখর। চিরকালই রিনাকে সাবধানে সযত্নে রেখেছেন তিনি। গায়ে যেন আঁচড়টি না পড়ে সেইভাবে রিনার খেয়াল রেখেছেন। অতিরিক্ত কেয়ারের ঠেলায় রিনাই মাঝেমাঝে অস্থির হয়ে উঠতেন, বলতেন উফফ তুমি আমার কথা সবসময় ভাবা বন্ধ করো তো। একটু অন্যান্য বিষয় নিয়েও ভাবো। আমি ঠিক আছি।
কিন্তু শেখর কখনও রিনার এই কথায় কান দেননি। একজন আদর্শ স্বামীর মত তিনি বরাবর স্ত্রীর যাবতীয় বিষয়ে খেয়াল রেখেছেন। সেইদিক থেকে রিনার কোনও অভিযোগ নেই, কিন্তু…তারপরেও রিনার কখনও কখনও মনে হয়েছে শেখর কি সত্যিই সুখী? কে জানে…
শেখর রিনার কথা শুনলেন না, রিসেপশনে ফোন করে ঠান্ডা জল আনালেন। মগের মধ্যে সেই ফ্রিজের ঠান্ডা জল ঢেলে হাত ডুবিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকতে বললেন, তারমধ্যে দুপুরের খাবার এসে গেল। হাতমুখ ধুয়ে দু’জনে খেয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ বিছানায় গড়ালেন। মাঝে একবার দাশবাবু এসে দেখা করে কথা বলে গেলেন। কাল সকাল থেকে ট্রাভেল শুরু হবে, আজকের দিনটা নিজেদের ইচ্ছামত কাটাতে পারেন।
দু’জনেই ভেবেছিলেন ঘুমোবেন না, কিন্তু বয়স হয়েছে বিছানায় বেশিক্ষণ এলিয়ে থাকলে চোখ আপনিই বুজে আসে। ঘুম ভাঙল একেবারে বিকেলের পর। রিনা একটু আগেই উঠলেন, উঠেই শেখরকে ঠেলা দিতে থাকলেন, এই ওঠো…কী বেড়াতে এসে মোষের মত ভোঁসভোঁস করে ঘুমাচ্ছ বলো তো? চলো ওঠো…
শেখর রিনার কথায় উঠলেন, রুমে কেটল চায়ের পাউচ ইত্যাদি ছিল তা দিয়ে চা বানালেন, দুজনে খেলেন, তারপর সন্ধে নাগাদ বেরোলেন। এই হোটেলের সামনে দিয়ে অটো যায়। সেই অটোতে চেপে দুজনে পৌঁছে গেলেন হাওয়ামহলের কাছে। এখন বেশ ঠান্ডা, তবে আরামদায়ক ঠান্ডা। রাস্তায় যাওয়ার পথে দুইধারে গোলাপিরঙের সার সার দোকানগুলিকে দেখে রিনা বললেন, এই দেখো এগুলো সব পিংককালার। একটা মস্ত গেট পড়ল, সেটাও ফিকে গোলাপী। অটো যেখানে থামল সেটা বিশাল চওড়া একটা মোড়। চারদিকে অজস্র দোকান। অনেক মানুষের ভিড়। যেন মেলা বসেছে। ভারি সুন্দর জমজমাট চারিধার। দেখেই মন ভরে যায়। শেখর আর রিনা একটি দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করলেন হাওয়ামহল কোনদিকে। দোকানদার বাঁদিকের একটি রাস্তা দেখিয়ে দিলেন। দুজনে হাঁটতে শুরু করলেন। এই রাস্তার দুইদিকে ছোটছোট দোকান, সবই লোকাল জিনিসপত্রের। প্রতিটা দোকানেই ঢুকতে ইচ্ছা করে। হ্যান্ডিক্রাফটই বেশি। শেখরের কোনওকালেই এসব কেনাকাটির বিশেষ শখ নেই, তাই এগিয়ে যাচ্ছিলেন, রিনা প্রতিটি দোকানের সামনেই থমকে দাঁড়াচ্ছিলেন, এটা ওটা দেখছিলেন। শেখর কোনও তাগাদা দিচ্ছিলেন না। বেড়াতেই তো এসেছেন, খামোখা তাড়াহুড়োর কী দরকার। তিনি দোকানগুলোকে দেখছিলেন, মানুষের ঢল দেখছিলেন। বেশ অন্যরকম একটা অনুভূতি। রিনা এগিয়ে এসে বললেন, এত হন হন করে এগিয়ে যাচ্ছ কেন? একটু দোকানগুলো দেখতে তো পারো, কী সুন্দর সুন্দর জিনিস। কিছু কেনাকাটি করার ইচ্ছা ছিল কিন্তু তুমি নেই।
আরে তো কেনো না যা মন চায়। টাকা আছে তো তোমার কাছে, আরও লাগলে বলো।
আচ্ছা। আগে দেখি। এই তো সবে এলাম।
রিনা ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকলেন। শেখরও সঙ্গে চলতে থাকলেন। বেশ খানিকটা যাওয়ার পর রাস্তার ধারেই বিশাল হাওয়ামহল। আলোতে ঝলমল করছে। সামনে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে মোবাইলে ছবি তুলছে। রিনা মাথা উঁচু করে দেখতে থাকলেন। শেখর বললেন, শোনো এক কাল করা যাক রাস্তার ওইফুটে চলে যাই। ওদিক থেকে পুরোটা দেখা যাবে।
কেন এখন ভেতরে ঢুকতে পারব না?
না, এখন তো বন্ধ হয়ে গেছে। কাল সকালে খুলবে, আমাদের নিয়ে আসবে, সাইটসিং-এ আছে এটা।
রিনা শেখরের হাত ধরে রাস্তার উল্টোফুটে গিয়ে দাঁড়ালেন। এইবার পুরোটা দেখা যাচ্ছে। বাপ রে কী বিশাল বিল্ডিং! অজস্র জাফরিওলা ছোটছোট জানলা। আলো দিয়ে এত সুন্দর সাজানো হয়েছে মনে হচ্ছে বড় বাজেটের দুর্গাপুজোর প্যান্ডেল। চোখ জুড়িয়ে যায়। রিনা বললেন, এই সত্যিই এখন ভেতরে ঢোকা যাবে না? একটু জিজ্ঞাসা করে দেখো না।
না গো এখন আর কোথাওই ঢোকা যাবে না। সম্ভবত বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত টাইমিং। কাল সকালেই তো আসব। আরও কত কী দেখার রয়েছে!
হুঁ। রিনা একটু মনক্ষুন্ন হলেন।
আরে বাবা এতে আবার মন খারাপের কী হল?
নাহ খারাপ কোথায় বললাম?
বলোনি, দেখে বুঝতে পারি।
হুহ জীবনে কতটুকু দেখেছ আমাকে যে এখন বুঝবে?
শেখর মাথা নেরে বললেন তা বটে।
রিনা কথাটা খুব ভুল বলেননি, শেখরকে অনেকসময়েই বাইরে থাকতে হয়েছে। বছরে সবমিলিয়ে অন্তত চার-পাঁচ বার তার ট্যুরেই কাটত। তবে শেখরের জোন ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া। তাই আসাম, মেঘালয়, মণিপুর এইসব রাজ্যগুলিতে অনেকবার করে গেছেন, ওগুলিকে চেনেন হাতের তালুর মত। তবে যতবার এসেছেন যেহেতু কাজের সূত্রেই এসেছেন তাই রিনাকে নিয়ে কখনও আসা হয়নি। প্রাইভেট কোম্পানিতে এমনিই ছুটিছাটা কম তাই যখন ছুটি পেয়েছেন বাড়িতে থাকতেই শেখরের ভাল লেগেছে, রিনারও বিশেষ কোনও অভিযোগ ছিল না, থাকলেও সেই কথা মুখে কোনওদিন প্রকাশ করেনি। শেখর বুঝতে পারছিলেন রিনা ভেতরে ভেতরে অত্যন্ত খুশি, যদিও বাইরে তার প্রকাশ কম। বেশ কিছুক্ষণ দুজনে তাকিয়ে রইলেন আলো ঝলমলে হাওয়ামহলের দিকে। মোবাইলে বেশ কয়েকটি ছবি তুললেন, রিনাকে হাওয়ামহলের দিকে পিছন করে দাঁড় করিয়ে কয়েকটা ছবি নিলেন। রিনা বললেন, শুধু আমার একার ছবি কেন নিচ্ছ? আমাদের একসঙ্গে একটা তোলো, বুকানকে পাঠাব।
শেখরের সেলফি তোলার তেমন অভ্যাস নেই, তাই মোবাইলটাকে বাগে আনতে পারছিলেন না। যে কটা তুললেন একটাও পছন্দসই হল না। তখন একটি ছেলে এসে হিন্দীতে বলল, দিন স্যর আপনাদের ছবি তুলে দিচ্ছি। শেখর থমকে গেলেন, অচেনা লোকের হাতে মোবাইল দেওয়া ঠিক হবে কি না ভাবলেন। ছেলেটি বুঝতে পেরে বলল, চিন্তা নেই স্যর, মোবাইল নিয়ে পালাব না, আমাদের এটাই কাজ। ওই যে দেখুন সবাই তোলাচ্ছে, আমার মত এখানে অনেকেই আছে, এটাই আমাদের কাজ। শেখর অবাক হলেন, পৃথিবীতে কতরকমের যে জীবিকা রয়েছে!
শেখর মোবাইলের ক্যামেরা অন করে ছেলেটির হাতে দিলেন। ছেলেটি বেশ কিছু ছবি তুলল দাঁড়িয়ে বসে, নানারকম ভঙ্গি করে। রিনা ছেলেটির অমন কান্ড দেখে হেসে বাঁচেন না। আট-দশটা ছবি তোলার পর ছেলেটা শেখরের হাতে মোবাইল দিয়ে বললেন, দেখে নিন, স্যর। ক্যামেরাটা ভাল হলে আরও ভাল ছবি আসত।
শেখরের মোবাইল বিশাল দামী নয়, ক্যামেরার কোয়ালিটি মোটামুটি। মোবাইলের জন্য একগাদা টাকা খরচ করার কোনও মানে হয় না। তবে খুব খারাপও নয়। সবকটা ছবি পছন্দ হয়নি, তবে ঠিক আছে। শেখর বলল, কত দেব তোমাকে?
ছেলেটি বলল, একশোটাকা দিন।
রিনা চমকে উঠে বললেন, কত!
একশো। দশটা ছবি তুলেছি। পার পিস দশটাকা।
শেখর বললেন, তোমাকে দশটা তুলতে কে বলেছে? আর মোবাইল আমার বলে পকেট থেকে একটা পঞ্চাশটাকার নোট বার করে দিয়ে বললেন, এই নাও।
স্যর এটা খুব কম হয়ে গেল।
রিনা বললেন, কিচ্ছু কম হয়নি। যথেষ্ট দেওয়া হয়েছে।
ছেলেটা আর কথা বাড়াল না। চলে গেল। রিনা বললেন, পঞ্চাশটাকা দেওয়ার কী দরকার ছিল? কুড়িটাকা দিলেই হত।
ধুর এত কম কাউকে দেওয়া যায়। ভিখারি নাকি? তবু তো কিছু একটা করছে।
শেখরের কথার আর উত্তর দিলেন না রিনা। দুজনের বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলেন, এই অঞ্চলটা অনেকটা ধর্মতলা এলাকার মত। বেশ লাগছিল। আর ওয়েদারটাও বেশ সুন্দর। গরম নেই। বরং সন্ধের পর থেকে অল্প ঠান্ডা। দুজনে চা খেলেন, চাট খেলেন আরও কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরলেন, রিনা একটা চামড়ার বটুয়া কিনলেন। মোড়ের মাথায় একটা মন্দির রয়েছে সেখানে দুজনে ঠাকুর দর্শন করলেন। দেখতে দেখতে রাত নটা বেজে গেল। শেখর বললেন, এই চলো এবার হোটেলে ফেরা যাক। দশটার মধ্যে লাঞ্চটাইম দাশবাবু বলে দিয়েছেন।
ওহ হ্যাঁ চলো চলো। একটা অটো ধরে হোটেলে ফিরলেন দুজন। ফেরার সময় বেশ ঠান্ডা লাগছিল। ভাল করে কান নাক চাপা দিলেন দুজনেই, বেড়াতে এসে ঠান্ডা লাগলে বিপদ হবে। হোটেলের রিসেপশনটা বেশ সুন্দর, সাজানো, মৃদু মিউজিক বাজছে। রুমের চাবি রিসেপশনে রাখা ছিল, শেখর চাইতে গেলেন, রিশেপসনিস্ট বললেন, স্যর আপনাদের ডিনার শুরু হয়ে গেছে।
আচ্ছা। চাবি নিয়ে শেখর রিনাকে বললেন, ডিনার সেরে রুমে যাবে?
হাত-মুখ কোথায় ধোব?
সে ডাইনিং রুমে থাকবে।
আচ্ছা চলো তাহলে।
দুজনে ডাইনিং হলে ঢুকলেন। বেশ বড় আর ঝকঝকে ডাইনিং হল। বুফের ব্যবস্থা। অনেকে খাচ্ছেন। ওদের দেখে দাশবাবু এগিয়ে এলেন। স্যর এসেছেন? এইমাত্র আপনাকে কল করতে যাচ্ছিলাম। প্লিজ ডিনারটা সেরে নিন এবার। অনেকটা দেরি হয়ে গেছে।
হ্যাঁ একটু বেরিয়েছিলাম।
রিনা বললেন, হাত ধোব।
ওই যে ম্যাডাম ওইদিকে বেসিন রয়েছে।
রিনা আর শেখর গেলেন, বেসিনে হাত ধুয়ে বুফের দিকে গিয়ে ডিস চামচ ইত্যাদি নিলেন, আমিষ নিরামিশ সবই আছে। শেখর আর রিনা দুজনেই রাতে রুটি খান। তিনটে রুটি আর একটু পনির নিয়ে একটা টেবিলে বসলেন। তখন দাশবাবু এসে বললেন, স্যর কাল সকাল আটটার মধ্যে আমরা ব্রেকফাস্ট করে বেরোব। প্লিজ একটু রেডি হয়ে যাবেন।
হ্যাঁ কোনও চিন্তা নেই। আচ্ছা এখানে যারা রয়েছেন তারা সকলেই কি আপনাদের মানে আমাদের সঙ্গে রয়েছেন?
হ্যাঁ স্যর। টোটাল বাইশজন রয়েছেন। কথামত ট্রাভেলবাসে ঘোরা হবে।
আচ্ছা। শেখর চোখ ঘুরিয়ে দেখলেন, বেশিরভাগই মধ্যবয়স্ক অথবা বয়স্ক দম্পতি। অল্পবয়েসি হাতে গোনা দুই তিনজন। সেটাই স্বাভাবিক। তরুণ-তরুণীরা পরের ভরসায় খামোখা কেনই বা বেড়াতে যাবেন। নিজেরা ঘুরলে যে স্বাধীনতা থাকে সেটা ট্যুর অপারেটরের সঙ্গে ঘুরতে গেলে থাকে না। সম্ভবও নয়। একটি ফাঁকাচেয়ারে বসে খাওয়া সারলেন। খাওয়ার পর বেসিনে হাত ধুতে গিয়ে খেয়াল করলেন একজন টাকমাথা লোক খাবার টেবিলে বসে তার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছেন। কে লোকটি? এইভাবে কেন তাকিয়ে রয়েছেন? শেখরকে চেনেন?
২
সকাল সাতটার মধ্যে উঠে দুজনেই দ্রুত তৈরি হয়ে গেলেন। তারপর নেমে এলেন ডাইনিং হলে। শেখর চোখ বোলালেন যারা ব্রেকফাস্ট করছেন তাদের দিকে। টাকমাথা লোকটিকে খোঁজার চেষ্টা করছিলেন। না টাকমাথা কেউ নেই, তবে গলফক্যাপ পরা একটি লোক শেখরের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। এই লোকটাই কি গতকাল রাত্রে দেখছিলেন শেখরকে? মুখটা মনে করার চেষ্টা করলেন শেখর। হতে পারে, কিন্তু স্পষ্টভাবে মনে করতে পারলেন না। লোকটির মুখোমুখি বসে রয়েছেন, একজন মহিলা। মাথার সব চুল পাকা এবং তার মাথাতেও চুল প্রায় নেই। মহিলাদের চুল উঠে গেলে সেটা বেশি নজরে আসে। মানুষ বয়স্ক হয়ে গেলে তার নিজেকে সুন্দর দেখানোর আগ্রহ কমে যায়। তখন নিজেকে সুন্দর দেখানোর থেকে বেশি সুস্থ রাখাটার প্রতি নজর বেশি হয়ে যায়। যৌবনে শেখর যথেষ্ট সুপুরুষ ছিলেন। সেই বিষয়ে তিনি যথেষ্ট সচেতনও ছিলেন, তাই নিজেকেও সুন্দর দেখানোর জন্য যাবতীয় চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখতেন না। ভাল পোশাক, শরীরচর্চা, দামী প্রসাধন ব্যবহার সবকিছুরই অভ্যাস ছিল তার। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শেখরের মানসিকতাও বদলেছে। এখন আর দামী প্রসাধন নয়, ওষুধটা কোন কম্পানির ভাল হবে সেটার দিকে বেশি নজর দেন। রিনা অবশ্য চিরকালই সাজগোজের ব্যাপারে উদাসীন। আসলে রিনা কোনওকালে প্রচলিত অর্থে সুন্দরী ছিলেন না, এবং সত্যি বলতে শেখরের পাশে তাকে মানাত না। সেটা রিনাও জানতেন, শেখরও জানতেন, তাও পাশাপাশি এতগুলো বছর পার করে ফেলার পরে এখন ওসব আর কিছুই মনে হয় না। টুপিপরা ভদ্রলোক ব্রেকফাস্ট সারছেন আর বার আড়ে আড়ে তাকাচ্ছেন, এ তো আজব লোক! এইভাবে দেখার কী রয়েছে? শেখরের মনে হল সম্ভবত কর্মজীবনে কখনও পরিচয় হয়েছিল শেখরের সঙ্গে, সেই কারণে উনি হয়ত চিনতে পেরেছেন। তবে শেখরের মনে পড়ল না। অবশ্য একধরণের লোক হয় তারা সকলের দিকেই এমন তাকিয়ে থাকেন, অকারণেই থাকেন, তিনি সেই গোত্রের কি না কে জানে…যাইহোক এত ভেবে লাভ নেই। খাওয়া শেষ করে বেসিনে হাত ধুতে গেলেন শেখর। পিছনে সেই ভদ্রলোকও এলেন। সেই অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে রয়েছেন।
শেখর আর চুপ থাকতে পারলেন না, বললেন, আপনি কিছু বলবেন?
ভদ্রলোক একটু ঘাবড়ে গেলেন, অপ্রস্তুতভাবে হেসে বললেন, না না।
হাসির সময় শেখর দেখতে পেলেন লোকটার সামনের ওপরের পাটির একটি দাঁত নেই। গালে ভর্তি বিজিবিজি দাড়ি।
শেখর হাত ধুয়ে লোকটিকে বললেন, আপনি কি জগন্নাথ ট্রাভেলসের সঙ্গে এসেছেন?
হ্যাঁ। আপনিও?
হ্যাঁ।
আচ্ছা ট্রেনে খেয়াল করিনি।
না আমরা ফ্লাইটে এসেছি।
ওহ আচ্ছা। আমরা স্লিপারে। উত্তর দিলেন ভদ্রলোক।
আচ্ছা।
এরপর আর কীই বা কথা এগোতে পারে?
বলছি আপনার নামটা জানতে পারি? জিজ্ঞাসা করলেন ভদ্রলোক।
আমার নাম শেখর ব্যানার্জি।
ভদ্রলোক, যেন নামটা শুনে একটু থেমে গেলেন, তারপর বিড়বিড় করে বললেন,…শে খ র ব্যা না র্জি…শেখর…
হ্যাঁ। আপনি?
উঁ…আমি…আমি হলাম রজত, রজত মালাকর।
রজত মালাকর! একটু চমকে উঠলেন শেখর। মুখে বললেন ওহ আচ্ছা।
দাশবাবু এসে এবার তাগাদা দিলেন। আপনাদের যদি হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে প্লিজ এবার বাসে উঠে বসুন।
আর কথা এগোল না। শেখরের খুব একটা আগ্রহও ছিল না রজতবাবুর সঙ্গে কথা এগোনোর।
রিনার কাছে গিয়ে দেখলেন রিনা তখনও খাচ্ছেন। রিনা চিরকালই খুব ধীরে খায়। রিনার টেবিলের দিকে আসার আগে শেখর আড়চোখে একবার রজতবাবুর স্ত্রী-র দিকে দেখলেন, মহিলা সম্ভবত অসুস্থ মনে হল। কিছুই খাচ্ছেন না, মাথা নিচু করে বসে খাবারগুলো নাড়াচাড়া করছেন।
এই তুমি এবার খাওয়া শেষ করো। সবাই বাসে উঠছে।
দাঁড়াও আমি অত তাড়াতাড়ি পারি না, জানো।
রিনা বাকি খাবার ফেলে রেখেই হাত ধুয়ে এলেন। তারপর দুজনে বাসের দিকে এগোলেন। হোটেলের সামনেই বাস দাঁড়িয়ে। ছোট ট্রাভেলবাস। সাদা রং। এসি চলছে। বাসের ভেতর ঢুকলেন শেখর আর রিনা। দুইদিকে ডবল সিট। বেশ কিছু সিট ফাঁকা। দাশবাবু বললেন, যেটায় ইচ্ছা বসে পড়ুন স্যর।
দরজা দিয়ে উঠে ডানদিকের সেকেন্ড রোতে রিনা আর শেখর বসলেন। শেখর বসার সময় দেখলেন বাঁদিকের পিছনের দিকের সিটে বসে রয়েছেন রজতবাবু ও তার স্ত্রী। রজতবাবু শেখরকে দেখে হাত নাড়লেন। শেখরও সামান্য হাত তুলে মৃদু হাসলেন। তারপর বসে পড়লেন। রিনা জিজ্ঞাসা করলেন, কে উনি? তোমার চেনা?
মনে করতে পারছি না। হতে পারে।
সে আবার কেমন কথা! চেনো কি না তাও জানো না! হাত ধুতেই গিয়ে দেখলাম কত কথা বলছ!
হুঁ। চিনি না।
রিনা আর কথা বাড়ালেন না।
বাস মিনিট কয়েকের মধ্যেই ছেড়ে দিল। দাশবাবু উঠে দাঁড়িয়ে সকলের উদ্দেশে বললেন, আজ আমাদের জয়পুর সাইটিসিইং। আজকের ডে ট্যুরে আমরা প্রথমে যাব হাওয়ামহল। তারপর সেখান থেকে যন্তরমন্তর, সিটিপ্যালেস, আলবার্ট হল মিউজিয়াম। এই হল মোটামুটি আজকের ট্যুর। আগামীকাল আমরা দেখব জলমহল এবং নাহারগড়কেল্লা। তারপর আমরা রওনা হব জয়শলমীরের দিকে।
খুব বেশি দূর নয়। মিনিট পনেরো পরেই বাস থামল। দাশবাবু বললেন, আপনারা প্লিজ সকলে কার্ডটা গলায় পরে নিন। বাসেই একটি করে জগন্নাথ ট্যাভেলসের লোগো দেওয়া লাল রিবনের আইডেন্টিটি কার্ড সবার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন দাশবাবু। অনেকেই গলায় পরে নিয়েছিলেন। বাকিরাও পরে নিলেন।
বাস থেকে নামলেন সবাই। দাশবাবু সকলকে বললেন, আপনাদের বলছি, প্রতিটি স্পটে আমাদের একজন গাইড বুক করা রয়েছে, তিনি আপনাদের সব বুঝিয়ে দেবেন, সেইজন্য আপনারা সকলে একসঙ্গে থাকলে ভাল হয়। তবে কেউ যদি গাইডের কথা না শুনতে চান তাহলে নিজেদের মত ঘুরে দেখতে পারেন। আমরা এখানে একঘন্টা থাকব। তারপর সবাই বেরিয়ে আসব। চেষ্টা করবেন তারমধ্যেই ঘুরে নিতে।
রিনা শেখরকে ফিসফিস করে বললেন এই এক জ্বালা, এখানে একঘন্টার বেশি থাকা যাবে না, ওখানে আধঘন্টার মধ্যে দেখে ফেলতে হবে, সব এদের নিয়ম মেনে চলতে হবে। এইটুকু সময়ের মধ্যে যদি না হয়?
শেখর বললেন, আহা আগেই রেগে যাচ্ছ কেন? দেখই না। ওরা টাইম একটু এগিয়েই বলে।
দাশবাবু আগেই টিকিটের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন, সবাই লাইন দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। একটা জায়গায় সকলে জড়ো হলেন, সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন গাইড। গাইড হিন্দীতে বোঝাতে শুরু করলেন এই বিল্ডিং-এর ইতিহাস। শেখর আর রিনা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে শুনলেন। তারপর রিনা বললেন, ধুর অতসব শুনে কী করব? চলো তো নিজেদের মত ঘুরে দেখি।
শেখর বললেন, চলো।
ওরা দুজনে, এগিয়ে গেলেন। প্রচুর পর্যটক হাওয়ামহল দেখতে এসেছেন। গতকাল রাত্রে যে আলোঝলমলে হাওয়ামহলকে দেখেছিলেন তার থেকে এ যেন পুরো আলাদা। অপূর্ব সুন্দর বটে। ধীরে ধীরে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকলেন। ওপরে ওঠার সিঁড়ি রয়েছে। শেখর আর রিনা উঠলেন। যত দেখছেন ততই ভাল লাগছে। সত্যি দেখবার মত একটা প্রাসাদ বটে, চোখ ধাঁধিয়ে যায়। মোবাইলে বেশ কিছু ছবি তুললেন শেখর। আজ আকাশ ঝলমলে। মনোরম ওয়েদার। এই সময়টা রাজস্থানে ওয়েদার ভালই থাকে। ঠান্ডা আছে, কিন্তু রোদের তেজ বেশ ভাল। সেইকারণেই টুরিস্টের ভিড় হয়। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভিড় হয় তারপর কমতে থাকে। শেখর মনোযোগ দিয়ে প্যালেসের খুঁটিনাটি দেখতে দেখতে একটু আলাদা হয়ে পড়লেন, তখনই শুনলেন পিছন থেকে কেউ বলছে, শেখরবাবু আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?
শেখর পিছন ফিরে দেখলেন রজত মালাকর। এই ভদ্রলোক ঠিক কী চান? সারাক্ষণ শেখরের পিছনে কেন লেগে রয়েছেন? শেখর গম্ভীরভাবেই বললেন, হ্যাঁ বলুন।
দেখুন মানে আমার ভুলও হতে পারে…ভুলই হবে…তবু একটা নিছক কৌতুহল, আপনাকে প্রশ্নটা করব করব করেও কিছুতেই করতে পারছি না, একটা অস্বস্তি হচ্ছে…
কী জানতে চাইছেন বলুন?
আসলে আমার মনে হচ্ছে আমরা পূর্বপরিচিত।
ওহ…হতে পারে।
এবং সেটা অনেকদিন আগের। মানে অনেককাল।
আচ্ছা, হতে পারে। তবে আমার ঠিক মনে পড়ছে না।
আচ্ছা আপনি কি নিকুঞ্জপুরে কোনও এককালে থাকতেন?
নামটা শুনে চমকে উঠলেন শেখর। মুহূর্তের মধ্যে তার ভুরু কুঁচকে গেল।
নিকুঞ্জপুর?
আজ্ঞে হ্যাঁ। হাওড়া মেইনলাইন। গোপীনাথ সাউ হাইস্কুল…
শেখর চোয়াল শক্ত করে ফেললেন। বললেন, না আমার মনে পড়ছে না। আমি এই জায়গার নাম শুনিনি।
শেখরের মুখে এই কথা শুনে রজতবাবু অনেকটাই দমে গেলেন। বললেন, ওহহ আচ্ছা!
কিন্তু কেন বলুন তো?
না মানে…আসলে আমার এক বন্ধু…শেখর… বন্ধু, কলেজে একসঙ্গে পড়েছি…তারপর আর কোনও যোগাযোগ নেই…এখন হয়ত তাকে আপনার মতই খানিকটা দেখতে…ওইজন্য আর কী…লিলি, আমার স্ত্রী।
লিলি! শেখর এবারে কেঁপে উঠলেন। কিন্তু বাইরে প্রাণপনে শক্ত ও নিস্পৃহ থাকার চেষ্টা করলেন। লিলি!…লিলি!
হ্যাঁ আমার স্ত্রী লিলি। আপনি নিকুঞ্জপুর চেনেন না তাই না?
শেখর ঢোঁক গিলে বললেন, না।
আচ্ছা। হতাশ হলেন রজতবাবু, বললেন, কিছু মনে করবেন না আপনাকে বিরক্ত করলাম। আসলে মনের ভেতর একটা খচখচ করছিল তাই কৌতুহলটা মিটিয়ে নিলাম।
ঠিক আছে। আপনার স্ত্রী কোথায়?
ও একটু বসেছে। খুব বেশি হাঁটাচলা করতে পারে না। আসলে ওর শরীরটা ভাল নেই।
কেন? কী হয়েছে?
ওই আর কী…অনেককিছুই…বলে একটা শ্বাস ফেললেন রজত। শেখর ভাবলেন রজতের সামনে থেকে সরে যাবেন, কিন্তু কে যেন ওর মুখ থেকে বলিয়ে নিল, কোথায় বসিয়ে রেখেছেন আপনার স্ত্রী-কে?
ওই তো ওইদিকে একটা চাতাল রয়েছে, ওখানেই বসে রয়েছেন। আপনি কথা বলবেন? আসুন না।
না না কথা বলব না।
অবশ্য…লিলির সঙ্গে পরিচয় করে আপনার ভাল লাগবে না।
কেন? ভাললাগবে না কেন?
ওর মনমেজাজ কখন কেমন থাকে তা আগে থেকে বলা কঠিন। এই এখন দেখলেন খুব ভাল, পরমুহূর্তেই রেগে উঠল।
ওহ আচ্ছা। শেখর টের পাচ্ছিলেন ওর নিঃশ্বাস ভারি হয়ে উঠছে। তিনি নিজেকে আড়াল করার প্রাণপন চেষ্টা করতে থাকলেন। আজ এত বছর পর আচমকা রজত এবং লিলি এই নামদুটো কেন ওর সামনে এসে দাঁড়াল? এ কী করে সম্ভব! শেখর রজতকে দেখছিলেন, এই মলিন, বুড়ো হয়ে যাওয়া চোখ-মুখের ভেতর থেকে এবার যেন বহু বহুকাল আগের একজনকে ধীরে ধীরে দেখতে পাচ্ছিলেন শেখর। বহুবছর আগে আবছা হয়ে যাওয়া একটি অবয়ব চোখের সামনে যেন ভেসে উঠল। রজত…রজত মালাকর। হ্যাঁ আর চিনতে অসুবিধা হল না শেখরের। সবকিছু যেন ছবির মত চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বহুদিনের পুরনো একটি সাদাকালো ছায়াছবি যেন চলতে শুরু করল শেখরের চোখের সামনে। লিলি…। ওই মহিলা লিলি! সেই লিলি!
রজতবাবু যেন মরিয়া হয়ে আবারও জিজ্ঞাসা করলেন শেখরকে, আপনি নিকুঞ্জপুরের নাম শোনেননি তাই না? কোনওদিন যাননি?
শেখর এবারে কোনও উত্তর দিলেন না। রজতকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার স্ত্রী কোথায়?
আসুন। ওইদিকে বসে রয়েছেন।
শেখর টের পেলেন ওর শ্বাসপ্রশ্বাস গাঢ় হয়ে উঠেছে। তিনি এগিয়ে গেলেন রজত মালাকরের সঙ্গে। এখন আরও ভিড় বেড়েছে। গিজগিজ করছে মানুষের মাথা। সবই ট্যুরিস্ট। সবার মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। রজত আঙুল তুলে বললেন, ওই যে লিলি বসে রয়েছেন, আমার স্ত্রী।
শেখর থমকে গেলেন। দেখলেন মহিলাকে। এ লিলি! সেই লিলি! মাথা নিচু করে বসে রয়েছে পক্বকেশ, যত না বয়সের ভারে ন্যুব্জ তার চেয়ে বেশিই যেন নুয়ে পড়েছেন। এ কি সেই লিলি! শেখরের লিলি! আশ্চর্য!
কথা বলবেন আমার স্ত্রী-র সঙ্গে?
উঁ…কথা? কী কথা বলব?
আপনার যা ইচ্ছা…অবশ্য লিলি কথা বলবে কি না জানি না।
শেখর একটু দূর থেকেই লিলিকে দেখতে থাকলেন। মহিলা যেন এই জগতে থেকেও নেই, সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। মাথা নিচু করে চুপ করে বসে রয়েছেন। একবার মুখ তুলে এদিক ওদিক চাইছেনও না। উনি যে নতুন একটা জায়গায় বেড়াতে এসেছেন তার কোনও লক্ষণ নেই।
আসবেন শেখরবাবু? আসুন না?
রজত মালাকরের ডাকে শেখর সবে পা বাড়িয়েছেন তখনই তার মোবাইলে ফোন এল। শেখর দেখলেন রিনা ফোন করেছেন।
হ্যালো।|
তুমি কোথায়?
এই তো দোতলায় রয়েছি। তুমি কোনদিকে?
আমিও দোতলায়। আশ্চর্য আমরা কি এখানে একা একা বেড়াতে এসেছি? তুমি একদিকে আমি একদিকে। এইভাবে ঘুরে বেড়ানোর মানে কী?
রিনার কথায় শেখর বললেন, না না আমি তোমাকে খুঁজছিলাম। কোনদিকে আছ বলো? আমি খুঁজে নিচ্ছি।
এই যে একটা একটা সরু সিঁড়ি রয়েছে, ওই মুখটায় দাঁড়িয়ে আছি।
আচ্ছা। তুমি দাঁড়াও আমি আসছি। বলে ফোন কেটে দিয়ে শেখর রজতের দিকে তাকালেন।
আপনার স্ত্রী খুঁজছেন আপনাকে?
হ্যাঁ। আমি যাচ্ছি। নমস্কার। বলে শেখর প্রায় হিঁচড়ে নিজেকে সরিয়ে আনলেন রজতের সামনে থেকে। শরীর হাঁসফাঁস করছে। এতবছর পর এ কী বিপর্যয় নেমে এল আচমকা! এবার কী হবে? হে ঈশ্বর!
শেখর পৌঁছলেন রিনার কাছে। রিনা যথেষ্ট বিরক্ত হয়েই বললেন, এইভাবে যদি একা একা ঘুরে বেড়াও তাহলে আর একসঙ্গে বেরোনোর দরকার কী?
আরে এত রাগ কেন করছ? আমি বুঝতে পারিনি। চলো চলো।
এবার একসঙ্গেই থাকছি।
শেখর রিনাকে বলেই ফেলছিলেন রজত আর লিলির কথা। কিন্তু নিজেকে আটকালেন। এসব কথা এখন বলার কোনও মানে হয় না। কিন্তু এতবছর পর আচমকা এখানে লিলি আর রজত কেন? কী করে! একটা ধুয়ে মুছে যাওয়া ইতিহাস ফের কেন এইভাবে জেগে উঠল!
তোমার আবার কী হল?
কী হবে?
অন্যমনস্ক দেখছি কেন?
না না অন্যমনস্ক আর কই?
প্রায় ঘন্টা দেড়েক হাওয়ামহলে কাটানোর পর আবার বাসে ওঠা। এবার গন্তব্য যন্তরমন্তর। বাস চলতে থাকল। মাঝে সকলকে কফি পরিবেশন করা হল।
তোমার কী হল বলো তো? এমন গুম খেয়ে গেলে কেন? শরীর ভাল আছে তো?
হ্যাঁ শরীরের আবার কী হবে ? রিনার প্রশ্নের উত্তর দিলেন শেখর।
তাহলে কী নিয়ে ভাবছ?
নাহ কিছুই না।
কিছু একটা তো হয়েছে।
আরে কিছুই না। কী আবার হবে? বলে চোখ বন্ধ করলেন শেখর। মনের ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকা কিছু এলোমেলো দৃশ্য এবারে যেন পরপর দুইচোখে নেমে এল শেখরের। বহুবছর আগের নিকুঞ্জপুর…
৩
সবে চারদিন হল কলেজে ক্লাস শুরু হয়েছে। বেশ ভাল লাগছে শেখরের। বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে কলেজ। যেতে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লেগে যায়। প্রথমে সাইকেল তারপর বাস, তারপর ট্রেনে দুটো স্টেশন, অবশেষে বাসন্তীদেবী মহাবিদ্যালয়। বড় কলেজ। ওখানে কমার্স সায়েন্স আর্টস সবই রয়েছে। শেখর ওখানেই ভর্তি হয়েছে কমার্স নিয়ে। সবে চারদিন হল ক্লাস শুরু হয়েছে। স্কুলের থেকে কলেজের পরিবেশ পড়াশোনার ধরন অনেকটাই আলাদা। এখানে স্বাধীনতা অনেক বেশি। পড়াশোনার চাপ কম। যা দায়িত্ব সবই নিজের। স্কুলের মাস্টারমশাইদের মত কেউ পড়া ধরেন না, ইউনিফর্ম পরার ঝামেলা নেই, যা ইচ্ছা তাই পরে চলে আসা যায়। দারুন আনন্দের জায়গা। উচ্চমাধ্যমিকে ভাল রেজাল্ট হয়েছে। ফার্স্ট ডিভিশন। তাই বাসন্তীদেবী কলেজে ফার্স্ট লিস্টেই নাম বেরিয়েছিল শেখরের। এই কলেজটির যথেষ্ট সুনাম। অনেক দূর দূর থেকে ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করতে আসে। শেখর ভর্তি হয়ে গেছিল। বইপত্র এখনও সব কেনা হয়ে ওঠেনি। বাবা সব বই কিনে দিতে পারেননি। অভাবের সংসার। এত টাকার বই আদৌ সব কিনে দিতে পারবেন কি না তাও জানা নেই। শেখর চেয়ে চিনতে কিছু পুরনো বই জোগার করতে পেরেছে, কিন্তু এখনো অনেক বইপত্র কেনা বাকি। সেগুলো কীভাবে কেনা হবে জানা নেই। শেখরের বাবা একটি ছোট ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। সামান্য মাইনে। ওভারটাইম ইত্যাদি করে মাসে যা আয় হয় তা দিয়ে তিনজনের দুইবেলার গ্রাসাচ্ছাদনটুকু হয়। তার বেশিকিছু নয়। অল্পবয়স থেকে শেখরের পড়াশোনার আগ্রহ প্রবল। বুদ্ধিশুদ্ধিও যথেষ্ট। প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত প্রতিক্লাসে বরাবর ভাল রেজাল্ট করে এসেছে শেখর। বাবা-মাও যথেষ্ট উৎসাহ দিয়েছেন, নিজেদের সাধ্যের বাইরে গিয়ে চেষ্টা করেছেন। কখনও শেখরকে দিয়ে সংসারের একটা কুটোও নাড়াতে দেননি। শুধু বলেছেন পড়, তুই পড়। সংসার আমরা দেখে নেব। শেখরও সবকিছু ভুলে শুধু পড়েছে। মাধ্যমিকে ভাল রেজাল্ট করার পর অনেকেই ভেবেছিলেন শেখর সায়েন্স নেবে, কিন্তু সকলকে অবাক করে দিয়ে শেখর কমার্স বেছেছিল। আসলে সায়েন্স পড়তে যে বিপুল খরচ তা শেখরের বাবার পক্ষে সামলানো যথেষ্ট কঠিন ছিল, তাই শেখর ঠিক করে নিয়েছিল ও সায়েন্স নেবে না। তবে সেটা যে অর্থের অভাবে নেবে না সেটা ও কখনও মুখ ফুটে বলেনি কারও কাছে। মা-বাবা যদি জানতেন তাহলে শত কষ্ট হলেও শেখরের সায়েন্স পড়ার ব্যবস্থা করতেন সেটা শেখর জানত, কিন্তু ও বাবা-মা কে আর চাপ দিতে চায়নি। তাই আগে থেকেই ভেবে রেখেছিল কমার্স নেবে। তারপর চার্টার্ড বা ম্যানেজমেন্টের কিছু একটা কোর্স করবে। মাধ্যমিকের পর কমার্স নেওয়ার সিদ্ধান্ত যখন সকলে জানল অনেকেই অবাক হয়েছিল। এমনকি শেখরের বাবা মাও ভাবেননি শেখর সায়েন্স ছেড়ে কমার্স পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাবা বারকয়েক জিজ্ঞাসাও করেছিলেন তুই ভেবেচিন্তে এই ডিসিশন নিচ্ছিস তো? দেখ আমার কিন্তু কোনও অসুবিধা নেই, তুই যদি সায়েন্স পড়তে চাস আমি যেভাবে হোক ব্যবস্থা করে দেব। টাকার কথা তুই ভাবিস না।
না বাবা আমার কমার্স পড়ারই ইচ্ছা।
বেশ তাহলে তাই পড়। তবু একবার ভেবে দেখিস।
শেখর ভাবেননি। কারণ আর নতুন করে ভাবতে চাননি। বাবা-মায়ের ওপর আর নতুন করে খরচের বোঝা চাপাতে চাননি। কমার্স নিয়েই ভর্তি হয়েছিলেন। এবং পুরোদমে পড়াশোনা শুরু করে দিয়েছিলেন। শেখরের স্বপ্ন ছিল চার্টার্ড অথবা কোম্পানিসেক্রেটারিশপ পড়ার। মনকে সেইমতই প্রস্তুত করে এগোতে শুরু করেছিলেন তিনি। কলেজে যাতায়াতের কিছুদিন পরেই ক্লাসে ওর সঙ্গে যার প্রথম বন্ধুত্ব হল তার নাম রজত। কলেজে কথা খুবই কম বলতেন শেখর। ক্লাস করে চুপচাপ বেরিয়ে যেতেন। তখনই পরিচয় হয়েছিল রজতের সঙ্গে। একদিন এ্যাকাউট্যান্সি ক্লাস শেষ হওয়ার পর শেখর ব্যাগ থেকে বই বার করে পড়ছিলেন, তখন পিছন থেকে একটি হাত এসে তার পিঠ স্পর্শ করেছিল। শেখর পিছনে তাকিয়ে দেখেছিল একটি ছেলে, তারই বয়সের। একগাল দাড়িগোঁফ, একমাথা চুল, পরনে পাঞ্জাবি।
খুব ব্যস্ত?
না না ব্যাস্ত নই। ওই আর কী।
তাহলে এসো, একটু কথা বলা যাক। বলে হাত বাড়িয়েছিল সেই ছেলেটি। করমর্দন করে বলেছিল, আমার নাম রজত। রজত মালাকর।
ওহ আচ্ছা। আমি শেখর ব্যানার্জি।
আচ্ছা। কোথায় বাড়ি তোমার?
এইভাবে কথা শুরু হয়েছিল দুইজনের। কথাটা বাড়তে বাড়তে ভাল বন্ধুত্ব। রজতের পড়াশোনায় যতটা না আগ্রহ ছিল তার থেকে ঢের বেশি আগ্রহ ছিল ছাত্ররাজনীতিতে। শেখরকেও মিটিং-এ মিছিলে টানার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু শেখরের কোনও আগ্রহ ছিল না। ও নিজের পড়াশোনা আর নিজের জীবনের লক্ষ নিয়েই বেশি আগ্রহী ছিল। আর রজতের শখ ছিল রাজনীতি। নেতা হওয়ার। তাই পড়াশোনার থেকে ছাত্রমহলে জনপ্রিয়তার দিকেই ছিল ওর বেশি ঝোঁক। কথা বলতে পারত ভাল, দেখতে সুপুরুষ ছিল, কন্ঠস্বর ছিল ভরাট, তাই ছাত্রনেতা হয়ে উঠতে খুব বেশি সময় লাগেনি। ফার্স্টইয়ারের শেষের দিকেই গোটা কলেজে পরিচিত হয়ে উঠেছিল রজত। আর অদ্ভুতভাবে শেখরের সঙ্গে বন্ধুত্বটাও গাঢ় হয়েছিল। রজত ছিল সত্যিই অদ্ভুত একটি ছেলে। শেখর বুঝতে পারত না রজত ওকে কেন এত পছন্দ করে। শেখর কেরিয়ারিস্ট। নিজের জীবন, ভবিষ্যত নিয়ে সিরিয়াস, কবে চাকরিবাকরি করে মা-বাবার সংসারের হাল ধরবে তাই নিয়েই বেশি চিন্তিত। পড়াশোনা, ক্লাস লাইব্রেরি ইত্যাদি সামলে মাঝে যখন কিছুটা অবসর পেত তখন শেখর কথা বলত রজতের সঙ্গে। দুইজনে দুই মেরুর অথচ বন্ধুত্ব ছিল চমৎকার। রজত ইয়ার্কি করে বলত তোকে একদিন আমি আমাদের পার্টিতে যোগ দেওয়াবই। এবং শুধু তাই নয় হোলটাইমার বানাব, তুই দেখিস।
এই কথা শুনে শেখর হাসত, বলত তোর এই স্বপ্ন আজীবন স্বপ্নই থেকে যাবে। তবে তুই একদিন মন্ত্রী হবি আর আমি হব তোদের দলের এ্যাকাউন্ট্যান্ট।
দুজনেই হাসত। দিব্বি চলছিল। ফার্স্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার কিছুদিন পর একদিন কলেজের লাইব্রেরিরুমে শেখর গেছিল একটি বইয়ের খোঁজ করতে, বইটা অনেকদিন ধরেই খুঁজছিল, কিন্তু কিছুতেই পাচ্ছিল না। সেদিনও গিয়ে খোঁজ নেওয়ার পর না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে আসছিল, তখনই পিছন থেকে কেউ একজন ডেকেছিল শেখরকে। শুনছেন।
শেখর পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখেছিলেন একটি মেয়ে। পরনে সবুজ সালোয়ার, রোগা, ফর্সা, লম্বাটে মুখ। শেখর ঘাবড়ে গিয়েছিল, কারণ কোনও মেয়ে ওর সঙ্গে আগেই কোনওদিন কথা বলেনি। আর শেখরও বলার চেষ্টা করেনি। মেয়েদের সঙ্গ শেখর বরাবর এড়িয়েই চলেছে। বয়সোচিত আগ্রহ যে নেই তা নয়, কিন্তু সংকোচ এবং তার সঙ্গে নিজের ভবিষ্যতের প্রতি অতিরিক্ত ফোকাস শেখরকে কখনও অন্যদিকে মন দিতে দেয়নি।
শেখর ঢোঁক গিলে বলেছিল, আমাকে বললেন?
হ্যাঁ, আপনাকে বলছি। আপনি কি আজও বইটা পাননি?
শেখর বলল, না।
আমি আসলে আগেও দুইদিন খেয়াল করেছি আপনি একটি বই খুঁজছেন, কিন্তু পাননি। আসলে আমিও একটা বই দুইদিন ধরে খুঁজছি পাচ্ছি না।
আপনি কি আমাদের কমার্সের?
না না আমি সোশিওলজির। কিন্তু এখানে কোনও বইই দেখছি পাওয়া যায় না।
হুঁ। বলে শেখর তাকিয়েছিল মেয়েটির দিকে। সরাসরি তকিয়েই আবার চোখ নামিয়ে নিয়েছিল।
তবে আপনি যে বইটির কথা বলছেন, আমাকে যদি লিখে দেন আমি একবার বাড়িতে খুঁজে দেখতে পারি।
বাড়িতে?
হ্যাঁ, আমার বাবা কমার্সের লোক। বাবার কাছে অনেক বই রয়েছে।
ওহ তাই! উনি কি পড়ান?
হ্যাঁ বাবা কিছু টিউশন করান। তবে শখে। কোনও স্কুল কলেজে পড়ান না।
ওহ আচ্ছা।
আপনি যদি বইটার নাম লিখে দেন তাহলে আমি বাড়িতে একবার খোঁজ নিতে পারি।
অনেক ধন্যবাদ, বলে শেখর বই আর লেখকের নাম লিখে দিয়ে বলেছিল, যদি বইটা সত্যিই থাকে আমার বড় উপকার হয়, তবে পেলে আপনাকে নিয়ে আসতে হবে না, আমি গিয়ে নিয়ে আসব?
কেন?
আসলে এ্যাকাউন্ট্যান্সির বই খুব মোটা আর ভারি হয়। ক্যারি করা কঠিন।
হুঁ সেটা অবশ্য ঠিক। আচ্ছা দেখি। আমি আসছি।
বলে চলে গিয়েছিল মেয়েটি। শেখরের পরে মনে হয়েছিল এই যাহ নামটাই তো জানা হল না।
শেখর পরদিন কলেজে গিয়ে বারবার লাইব্রেরি গেল। মেয়েটি এল না, পরেরদিন গেল। সে নেই, তারপরের দিনও না। শেখর অস্থির হয়ে উঠল। ও এমনিতে লাজুক প্রকৃতির , কিন্তু খানিকটা ব্যকুল হয়ে উঠল মেয়েটির জন্য। বইয়ের প্রতীক্ষার চাইতে মেয়েটির জন্যই মন বেশি অস্থির হয়ে উঠেছিল। কিন্তু মেয়েটি এল না। শেখর মনে মনে হতাশ হল, অতিরিক্ত ভেঙে পড়ল। একটি অচেনা, অজানা মেয়ের জন্য ও কেন এতটা উতলা হয়ে উঠল নিজেও বুঝল না, শুধু উতলা নয়, শেখর খোঁজখবর নিয়ে সোশিওলজির ক্লাসরুমের সামনে গিয়েও দিন দুয়েক ঘুরঘুর করল, যদি দেখা হয়, কিন্তু নাহ, নেই! রজত শেখরকে জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার তুই এমন ঝিমিয়ে গেলি কেন? শেখর জানত রজতকে বললে হয়ত ও ঠিক একটা খোঁজ খবর নিয়ে বার করে ফেলত, কিন্তু ওকে বলতেও অস্বস্তি হল। কী ভেবে বসবে কে জানে। শেখর মন খারাপ করে রইল। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করল, কিন্তু ঠিকঠাক পারল না। প্রায় এক সপ্তাহ পর আবারও আচমকাই একদিন দেখা হল মেয়েটির সঙ্গে।
এই যে শুনছেন।
আপনি!
হ্যাঁ, চিনতে পেরেছেন?
আপনি কোথায় ছিলেন এতদিন?
আমি খুব সরি। আপনাকে বইটা দেব বললাম, কিন্তু পরদিন থেকেই খুব জ্বরে পড়েছিলাম।
মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে শেখর বুঝেছিল মুখটা শুকনো। মেয়েটি সত্যিই জ্বরে ভুগে এসেছে।
এখন কেমন আছেন আপনি?
একটু ভাল হয়েছি। আপনি কি আমাকে খুঁজেছিলেন?
শেখর এই স্পষ্ট প্রশ্নটিতে প্রথমে একটু থমকেছিল, তারপর বলেছিল, হ্যাঁ।
আমি সরি, আসলে হঠাৎ করে জ্বর এসে যাবে আমি বুঝিনি।
এই না না সরি কেন বলছেন?
আপনার কি এখন ক্লাস রয়েছে?
শেখরের ক্লাস ছিল, তবু বলল, নাহ এখন নেই।
তাহলে আমরা ক্যান্টিনে একটু বসতে পারি?
হ্যাঁ চলুন না।
দুজনে মিলে গিয়ে বসেছিল ক্যান্টিনে। দুই ভাঁড় চা নিয়ে সেদিন দুজনে মিলে অনেকক্ষণ গল্প করেছিল। কখন যে সময় পেরিয়ে গিয়েছিল তা খেয়ালই ছিল না। একটা সময় মেয়েটিই বলেছিল, ইস আপনার অনেক দেরি করিয়ে দিলাম। ততক্ষণে শেখর মেয়েটির নাম জেনে গেছে, লিলি। পদবী বসু। আর শেখরও জানিয়েছে তার নাম, বাড়ি, সবকিছু। লিলি নামটা যেন বুকের ভেতরে একেবারে গেঁথে গেল শেখরের। লিলি বলল, বইটি আমাদের বাড়িতে রয়েছে। কিন্তু আপনি ঠিকই বলেছেন বইটা বড্ড মোটা আর ভারি। আর আমার শরীরটাও ভাল নেই। আপনি যদি এরমধ্যে একদিন কষ্ট করে আমাদের বাড়িতে…
কবে যাব বলুন? আমার অসুবিধা নেই।
আপনার যেদিন সুবিধা।
বেশ তাহলে কাল যাব?
হ্যাঁ বেশ তো চলুন।
সেইদিন আর রাতে ঘুম হল না শেখরের। সারাক্ষণ চোখের সামনে লিলির মুখ, লিলির হাসি, ওর কথা বলা মাথায় ঘুরঘুর করতে থাকল। বাড়িতে সন্ধের পর কামিনী গাছটায় এত বেশি ফুল এল যে গন্ধে পুরো বাড়ি মাখামাখি হয়ে গেল। পরের দিন সকাল হতেই শেখর চটপট তৈরি হয়ে কলেজ গেল। প্রথম দুটো ক্লাস করল কিন্তু ক্লাসে কী পড়ানো হল কিছুই মাথায় ঢুকল না। তারপরেই দেখা হল লিলির সঙ্গে। সেদিন তিনটে নাগাদ লিলির সঙ্গে শেখর ওদের বাড়ি গেল। কিছুটা বাস, তারপর রিকশা। রিকশায় পাশাপাশি দুজন। শেখরের মনে হচ্ছিল রিকশা নয় ও যেন পক্ষীরাজে চেপে যাচ্ছে। লিলির গায়ের সামান্য স্পর্শ যেন শেখরকে একটা নরম তুলোর মধ্যে ডুবিয়ে দিচ্ছিল। কী ভাল যে লাগছিল সবকিছু!
শেখরের মনে হচ্ছিল এই পথ যদি না শেষ হয়…কিন্তু বাস্তবে সব পথই কোথাও না কোথাও শেষ হয় আর পথ যদি সুন্দর মনোরম হয় তবে সেই পথ আরও দ্রুত শেষ হয়, সেই পথ এসে থেমেছিল একটি গেটওলা বাড়ির সামনে। গেটের ওপর বোগেনভেলিয়া গাছ আবিররঙা ফুলের ডালি নিয়ে সেজে ছিল। সাদা পাঁচিল, সাদা ঝকঝকে দোতলা বাড়ি, ঝুলবারান্দা। শেখরের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছিল। বাপ রে এ তো বড়লোকের বাড়ি। গলা শুকিয়ে উঠেছিল শেখরের। ভেতরে ঢুকতে অস্বস্তি হচ্ছিল। ভেতরটাও সুন্দর করে সাজানো, ড্রয়িং রুমে বসেছিল শেখর। লিলিদের বাড়িতে কাজের লোক ছিল, সে কাচের গ্লাসে অরেঞ্জ জুস আর প্লেটে করে দুটো সন্দেশ দিয়েছিল। শেখর বুঝেছিল লিলিরা বড়লোক। কিছুক্ষণ পর লিলি একটি মোটা বই নিয়ে এসে শেখরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলেছিল এই যে বইটা।
শেখর বইটা হাতে নিয়ে বলেছিল, আমি যত তাড়াতাড়ি পারব ফেরত দিয়ে দেব।
অত তাড়া নেই, বাবা বলেছে আপনি বইটা আপাতত আপনার কাছে রাখতে পারেন। সেদিন শেখর লিলির সঙ্গে ওদের বাড়ির ছাদে গিয়েছিল, বাড়ির ছাদে টবে অনেক ফুলগাছ, আর বাড়ির পিছনে মস্ত একটা পুকুর। এত ভাল লাগছিল শেখরের। এমন বাড়ি সিনেমায় দেখেছে, বাস্তবেও হয়! শেখরের মনে পড়ছিল নিজের বাড়িটা। এইটুকু ছোট বাড়িটা যেন তখন আরও ছোট মনে হচ্ছিল। লিলি সেদিন অনেক গল্প করেছিল শেখরের সঙ্গে। শেখর বাড়ি ফিরেছিল একা, কিন্তু প্রতি মুহূর্তে লিলির উপস্থিতি টের পেয়েছিল।
বেশ কয়েকদিন এমন কাটল। প্রায় প্রতিদিনই লিলির সঙ্গে দেখা হতে থাকল শেখরের। মন তখন শুধুই লিলি আর লিলি। ওদের দেখা শুধুমাত্র কলেজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল না সেটা কলেজের গেটের বাইরেও হতে থাকল। বেশ কয়েকবার লিলির সঙ্গে ওদের বাড়িও গেল শেখর। শেখরের বাবা এবং মা খুবই ভদ্র এবং সুন্দর ব্যবহার, তারা শেখরকে ভালবাসলেন, কথা বললেন, লিলিও ততদিনে শেখরের বাড়ি সম্পর্কে জেনেছে। একদিন রজত বলল, এই শেখর তোর সঙ্গে কথা আছে।
কী বল?
তুই প্রেম করছিস?
শেখর থতমত খেয়ে গেল। তুতলে বলল, কই না তো।
না তো আবার কী? আমার কাছে এই কলেজের সব খবর থাকে। কে কী কোথায় করছে সব আমার জানা। কিন্তু আমি অবাক হয়ে গেলাম তুই প্রেম করছিস সেটা আমাকে অন্যের কাছ থেকে শুনতে হল!
এই না রে ওসব কিছু না।
তাহলে কী সব কিছু? সোশিওলজির লিলি, এই নাম তো? ওদের বাড়িতেও গেছিস কয়েকবার সেই খবরও আমার জানা। কেন ভাই আমাকে লুকিয়ে কী লাভ?
তুই যে কী বলিস রজত! তোকে কেন লুকব? আসলে তুই যেমনটা ভাবছিস তেমন কিছু নয়, ওই জাস্ট বন্ধু। আমাকে একটা বই দিয়েছিল…শেখরের কান লাল হয়ে গেছিল।
থাক আর লজ্জা পেতে হবে না। অজিতবাবুর মেয়ে হচ্ছে লিলি। আমার সব জানা আছে। অজিতবাবু আমাদেরই পার্টি করেন, অনেক পুরনো মেম্বার। ভাল জায়গাতেই খুঁটি পুঁতেছিস। এবারে আমাদের পার্টি জয়েন করে নে।
ধুস কী সব যে বলিস! প্রেম আবার কী? ওসব আমার দ্বারা হবে না।
বটে! আমার কিন্তু সবদিকে চোখ রয়েছে। ভাবিস না যে রজত মালাকরের চোখ এড়িয়ে কিছু করতে পারবি। তো আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিবি না?
এই কথা শুনে আরও চমকে গেছিল শেখর। পরিচয়?
হ্যাঁ, কেন আপত্তি আছে নাকি?
এই না না আপত্তি কীসের? কিন্তু মানে…কীভাবে করাব?
যেভাবে কেউ তার বান্ধবীর সঙ্গে বন্ধুর আলাপ করিয়ে দেয়, সেইভাবে করাবি। আমি নিজেই করতে পারি কিন্তু আমি চাই কাজটা তুইই কর।
রজতের গলায় একরকমের চাপা নির্দেশ ছিল, এটা ঠিক বন্ধুর কন্ঠস্বর ছিল না, বরং ছাত্রনেতার হুকুম ছিল। শেখর অবাক হয়ে তাকিয়েছিল রজতের দিকে।
কালই আলাপ করাস বুঝলি।
শেখর বুঝেছিল রজত বিষয়টাকে সিরিয়াসলি নিয়েছে। ও গিয়ে কথা বলেছিল লিলির সঙ্গে। লিলি জানত শেখর রজতের বন্ধু। শেখর সবটাই বলেছিল লিলিকে, এমনকি রজতের বলার মধ্যে যে প্রচ্ছন্ন একটা আদেশ খেয়াল করেছে সেই কথাটাও লুকোয়নি।
লিলি হেসে বলেছিল, ধুর তা কেন হবে? ও তোমার মনের ভুল। ছাত্রনেতাদের কথার টোন কখনও এমন হয়। আর রজত তো তোমার বন্ধু। ও তোমাকে হুকুম কেন করবে?
পরদিন রজতের সঙ্গে লিলির পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল শেখর। কিছুক্ষণের মধ্যেই দিব্বি গল্প জমে উঠেছিল তিনজনের। শেখরের মধ্যে যে সামান্য অন্ধকার মেঘ জমে উঠেছিল তা কেটে গিয়েছিল, নাহ লিলিই ঠিক বলেছে রজতের শুধুমাত্র আলাপ করারই আগ্রহ ছিল, লিলির কাছে শেখরের অনেক প্রশংসা করেছিল রজত। ওর মধ্যে কী কী গুণ রয়েছে সেগুলো বেশ ফলাও করে বলেছিল, শুধু তাই নয় লিলির সঙ্গে শেখরের বন্ধুত্ব হওয়ায় রজত যে খুব খুশি সেটাও স্পষ্টভাবে জানিয়েছিল। তারপরেই দুজনে আলোচনা শুরু করেছিল রাজনীতি নিয়ে। লিলির বাবা এবং রজত যেহেতু একই রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী এবং লিলিও তার বাবার পথই অনুসরণ করে কাজেই রাজনীতি নিয়ে আলোচনা বেশ জমে উঠেছিল দুজনের মধ্যে। শেখরের রাজনীতিতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, তাই ও চুপ করে শুনছিল। ওদের দুজনের আলোচনা তুঙ্গে। মাঝে শেখর চুপ। একটা সময়ের পর রজত বলল, এই রে শেখর বেচারা পুরো চুপ করে বসে রয়েছে, ওর কোনও কথা নেই। শোন শেখর ভাল কথা বলছি এখনও সময় আছে আমাদের দলে চলে আয়, দেখ তোর বান্ধবীও কিন্তু আমাদেরই পক্ষে। তুই কেন এখনও একা থাকবি ভাই?
শেখর মৃদু হেসে বলেছিল, না ভাই ওসব আমার জন্য নয়। পলিটিক্স বর কঠিন বিষয়, আমার মত সাধারণ ছেলেদের জন্য ওসব নয়।
সেদিন গল্পের শেষে শেখর আর লিলি যখন হাঁটতে হাঁটতে ফিরছিল তখন লিলি শেখরকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার কি সত্যিই মনে হয় পলিটিক্স খুব কঠিন বিষয়? নাকি তুমি পছন্দ করো না বলে এড়িয়ে যাও?
শেখর লিলির কাছে মিথ্যে বলেনি। সোজা উত্তর দিয়েছিল, পলিটিক্স আমার ভাল লাগে না, এরমধ্যে শুধুই নোংরামো, ক্ষমতা দখলের লড়াই। আর কিছুই নেই, যে সিংহাসনে বসবে সেই যেভাবে পারবে ক্ষমতার মিসইউজ করবে।
না, এটা আমি মানতে পারলাম না, সব পলিটিকাল পার্টি এক নয়, আমার বাবা বা রজতদা যে পার্টি বিলং করে তারা আলাদা, তারা ক্ষমতালাভের জন্য শুধু পলিটিক্স করে না, একটা আদর্শের জন্য লড়ে।
শেখরের কিছু বলার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু বলল না, পলিটিক্স নিয়ে আলোচনাও ওর কাছে বিরক্তিকর। চুপ করে গেছিল।
কিন্তু লিলি নাছোড়। শেখরকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল, তুমি মনে হয় আমার কথা বিশ্বাস করতে পারলে না।
না না তা নয়, আসলে আমার আগ্রহই কম।
বেশ।
এর কিছুদিন পর লিলি কলেজের ছাত্র রাজনৈতিক দলে যোগ দিল। কলেজে দুটো দল ছিল। একটা শাসকদলের আরেকটা বিরোধী। রজতের দল হল শাসকগোষ্ঠীর। তাই দাপটও বেশি। শেখরের এই বিষয়টা পছন্দ হল না, কিন্তু লিলিকে কিছু বলল না। লিলি আর শেখরের সম্পর্কটা আরও গাঢ় হল। শেখর বেশ কয়েকবার লিলিদের বাড়ি গেল। একদিন লিলিও এল শেখরের বাড়িতে। শেখর চায়নি লিলি ওদের এই ছোট বাড়িটায় আসুক। কোথায় বসাবে কী খাওয়াবে কিছুই দিশা পাচ্ছিল না, শেখরের বাবা তখন বাড়ি ছিলেন না, মা ছিলেন, সাধ্যমত ছেলের বান্ধবীর জন্য করেছিলেন, এটা ওটা বানিয়ে দেওয়া, গল্প করা। আন্তরিকতার কোনো ত্রুটি ছিল না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে শেখর খুবই সংকোচের সঙ্গে বলেছিল, আমাদের বাড়িটা খুবই ছোট, তোমার অসুবিধা হল।
লিলি বলেছিল, না না ঠিক আছে।
শেখর ভেবেছিল লিলি বুঝি বলবে কোনও অসুবিধা হয়নি, আমার ভাল লেগেছে, কিন্তু তার বদলে এই না না ঠিক আছে বাক্যটা অনেককিছুই বুঝিয়ে দিয়েছিল। লিলি আর কখনও শেখরের বাড়ি আসার কথা বলেনি, শেখরও আর লিলির বাড়িতে যাওয়ার কথা বলত না, লিলি বললেও নানা অছিলায় এড়িয়ে যেত, আসলে ভালবাসার চাইতেও মানুষের কাছে ঢের বড় হল আত্মসম্মান। ওইটিতে যখন আঘাত পড়ে তখন অনেক হিসেবই বদলে যায়। বাইরে থেকে সবকিছু ঠিকঠাক দেখতে লাগলেও ভেতরে ঘুণপোকা বাসা বাঁধে, কুরে কুরে খেতে শুরু করে। তবে এমন নয় লিলির সঙ্গে শেখরের সম্পর্ক ক্ষীণ হয়ে গেল, যোগাযোগ কমে গেল। বরং তা একই ছন্দে চলতে থাকল, কিন্তু গভীরে কোথাও একটা খিচ থেকে গেল সেটা দুজনেই জানল কিন্তু কেউ একে অপরকে জানাল না।
শেখর ভেবেছিল এই সম্পর্ক পরিণতি পাবে, কারণ লিলির দিক থেকে সায় ছিল সবকিছুতেই। কলেজ পাশ করে যখন শেখর এমবিএ করবে ভাবল লিলি ঠিক করল মাস্টার্স করবে। ওদিকে রজত পুরোদমে রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। শেখরের সঙ্গে যোগাযোগ থাকল ঠিকই তবে আগের মত নয়, বরং লিলি আর রজতের বন্ধুত্বটা রাজনীতির কারণেই একটু বেশি কাছাকাছি চলে এল। লিলি রজতের কথা বলত, রজত লিলির কথা বলত, শেখর দুজনের কথা শুনত। কখনও বুকে অল্প জ্বালা ধরত, কখনও নিজেকে বোঝাত, এসব কিছু নয়, বৃথাই ভাবছে। কলেজে ম্যাগাজিন বেরোত। একদিন রজত শেখরকে এসে বলল লিলি কী সুন্দর কবিতাটা লিখেছে পড়েছিস?
কবিতা! কোথায়! অবাক হয়েছিল শেখর।
কোথায় আবার আমাদের কলেজ ম্যাগাজিনে। বলে রজত ওর কাঁধের ব্যাগ থেকে ম্যাগাজিন বার করে একটা পৃষ্ঠা খুলে শেখরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, এই নে পড়ে দেখ।
শেখর পড়েছিল কবিতাটি-
বৃষ্টির গান
বৃষ্টির গান শ্রাবণের মেঘ শরতের বুকে মেশে
তোমাকে চেয়েছি যেমন পেয়েছি অবিকল অবশেষে।
চোখের তারায় সিন্ধু লুকায় মুক্তোর গুঞ্জনে,
বেহিসেবি কালো এঁকে দিয়ো তুমি দু’চোখের অঞ্জনে।
সান্ধ্য হাওয়ায় শিউলি সুবাস বয়ে গেল পরিমলে
মেঘ ডোবানো আঙুল তোমার বেঁধে দিয়ো অঞ্চলে।
তারাদের মত চাঁদ জানে যত আলোর উৎস কোথা
জ্যোৎস্নার পালে জাগে যদি নদী মৃত্যুর নীরবতা।
এমনও সুখে ভেসে যায় হৃদি পদ্ম ভ্রমর কাঁপে
কে না আসে বলো কে না বাসে ভাল এমনও মনস্তাপে।
তুমি তো মাখালে আলতো আঁচলে সন্ধ্যা দীপের আলো
আমি অবশেষে সে নিরুদ্দেশে হারিয়েছি সম্বলও!
কবিতাটি দুই বার পড়ে শেখর অবাক হয়ে আবারও জিজ্ঞাসা করেছিল রজতকে এটা লিলি লিখেছে!
অফকোর্স। নাম দেখতে পাচ্ছিস না? কী ভাল লিখেছে বল?
শেখর বলেছিল, হ্যাঁ ভাল। পরে লিলিকে বলেছিল তুমি কলেজ ম্যাগাজিনে কবিতা লিখেছ আমাকে বলোনি তো?
হ্যাঁ রজত জোর করে লেখাল। বাধ্য হয়ে লিখলাম। তোমাকে কে বলল?
রজতই পড়াল।
ও আচ্ছা।
আমাকে বলতে পারতে।
তুমি কি কবিতা পড়ো নাকি? শুধু তো এ্যাকাউন্ট্যান্সি করো। বলে কী হবে?
হুঁ, আর কিছু বলেনি শেখর।
রজতের বাবা রেলে চাকরি করতেন, ঘরবাড়ি মধ্যবিত্তদের যেমনটা হয়, তবে শেখরদের থেকে অবস্থা ভাল ছিল। রজতের ইচ্ছা ছিল রাজনীতিকেই পেশা হিসেবে নেওয়া। ততদিনে যুবনেতা হয়ে উঠেছে। কলেজ-ক্যাম্পাস ছাড়াও বিভিন্ন সভায় বক্তব্য রাখতে যাচ্ছে। খুবই ব্যস্ততা। এমন সময় অঘটন ঘটল। রজতের বাবা অফিসেই আচমকা স্ট্রোক হল। রজতের বন্ধুরা, শেখর অনেক দৌড়ঝাঁপ করল, কিন্তু শেষরক্ষা হল না, তিনি মারা গেলেন। শেখর ওইসময় দুইদিন রজতের বাড়িতে গিয়েই থাকল। রজত পারলৌকিক কাজকর্মে বিশ্বাসী ছিল না, কিন্তু মায়ের জন্য সেই শ্রাদ্ধশান্তি করল রজত। শ্রাদ্ধের দিন লিলিও এল। শেখর তো ছিলই। কিন্তু এরপর যেটা হল সেটাই সবকিছুর মোড় ঘুরিয়ে দিল। বাবার চাকরিটা পেয়ে গেল রজত। আর চাকরি পাবার পর শেখরের সঙ্গে রজতের যোগাযোগ কমতে শুরু করল। শেখর অবশ্য ততদিনে এমবিএ-তে ভর্তি হয়েছে। নিজের পড়া নিয়ে যথেষ্ট চাপে ছিল। বাবা লোন করেছিল ছেলের পড়াশোনার জন্য। সেই চাপ মাথায় ছিল। লিলির সঙ্গে দেখা হত সপ্তাহে একদিন, শেখর বুঝতে পারছিল, লিলির আগ্রহ কমছে, অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না, লিলি জানত শেখর মেধাবী, এমবিএ ও ভালমতই পাশ করবে এবং তারপর চাকরিও পাবে। কিন্তু লিলি মাঝেমাঝেই একটু উলটো গাইত। শেখর নিজে থেকেই বার কয়েক বিয়ের প্রসঙ্গ তুলেছিল, বলেছিল চাকরি পাবার পরেই আমার প্রথম কাজ হবে একটা ফ্ল্যাট নেওয়া, তারপর বিয়ে।
লিলি উত্তরে বলত, এখন তোমাকে ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না, নিজের কেরিয়ারে মন দাও।
শেখর ভাবত লিলি বুঝি কথাগুলো মন থেকেই বলছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে অন্যকিছু চলছিল তা একদিন আচমকাই জানতে পারল শেখর। একদিন ইন্সটিটিউট থেকে ফেরার পথে শেখর বাসের জানলার ধারের সিটে বসেছিল। একটা সিগনালে ওর জানলার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল একটি ট্যাক্সি। শেখর দেখতে পেয়েছিল ট্যাক্সির ভেতর বসে রয়েছে লিলি। লিলিকে ডাকতে গিয়ে থমকে গেছিল শেখর। লিলির পাশে বসে রয়েছে রজত। লিলির কোলের ওপর রজতের হাত। শেখর অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। সেদিন সকাল থেকে আকাশের রঙ ছিল কালো। শেখরের নিঃশ্বাসের কষ্ট শুরু হয়েছিল। বাস থেকে নেমে পড়েছিল কলকাতা ময়দানের সামনে। তারপর হাঁটতে শুরু করেছিল উদ্দেশ্যহীনভাবে। প্রবল বৃষ্টি নেমেছিল কিছুক্ষণ পর। চারদিক ধোঁয়ার মত বৃষ্টি। ওই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে শেখর ময়দানের পাশে এসে বসেছিল, আচমকাই তীব্র কান্না পেয়েছিল ওর। শিশুর মত ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল বেশ কিছুক্ষণ। চারিপাশে কেউ ছিল ওকে দেখার মত, বৃষ্টির জল ক্রমাগত ওর অশ্রু ধুইয়ে দিচ্ছিল। অনেকক্ষণ ধরে কাঁদার পর শেখরের বুকটা একটু হাল্কা হয়েছিল, ও বোঝাতে শুরু করেছিল নিজেকে। দেখ শেখর, জীবনে অনেককিছুই ঘটে যা ঘটা উচিত নয়, অথচ ঘটে। যুগযুগ ধরে এমনটাই চলে এসেছে। প্রেম যেমন আছে, বিশ্বাসঘাতকতাও রয়েছে। ভালবাসা যেমন রয়েছে তেমনই রয়েছে ঠকানো। রজত আর লিলি দুজনে মিলে আমাকে ঠকাল। ওরা দুজনেই আমার অত্যন্ত কাছের, অথচ ওরাই এমনটা করল। করে বুঝিয়ে দিয়ে গেল এই জীবনের হৃদয়ের থেকে ঢের বড় হল আর্থিক নিরাপত্তা, সামাজিক প্রতিপত্তি। একটা বড় হৃদয়ের থেকে অনেক বেশি দরকারি হল একটা বড় বাড়ি। সুতরাং লিলি আর রজত হয়ত ঠিকই করেছে। আর শেখরকে এসব ভুলে গিয়ে আগে একটা বড় বাড়ি এবং আর্থিক উন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। লিলি আর রজতের ওপর যে রাগ, অভিমান জেগে উঠেছিল তা ম্যাজিকের মত মিলিয়ে গেল না ঠিকই কিন্তু শেখর নিজেকে গুছিয়ে নিল। লিলি আর রজত যেমন শেখরের সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় অফ করে দিল শেখরও গুটিয়ে নিল নিজেকে। ওর মাথায় তখন শুধুই এমবিএ পাশ করে একটা ভাল চাকরি করার লক্ষ্য। গ্রামের বাড়িটা ছেড়ে কলকাতা শহরে বড় বাড়ি করার স্বপ্ন।
একদিন রজত আর লিলির বিয়ে হল। রজত এসেছিল শেখরকে বলতে। ওর চোখমুখে অপরাধবোধ ছিল, শেখর নিমন্ত্রণ কার্ডটা হাতে নিয়ে বলেছিল, তোদের শুভেচ্ছা। আমার হয়ত যাওয়া হবে না। তবে তোরা ভাল থাকিস এই কামনা রইল।
রজত চলে যাওয়ার পর শেখর ওই একদিনই সন্ধেবেলা একটা বারে গিয়ে কয়েকপেগ মদ খেয়েছিল। তারপর ফেরার পথে রাস্তায় বমি করতে করতে ভেবেছিল, ফালতু শালা নিজেকে নষ্ট করে লাভ কী? তবে রজত আর লিলি দুটোই বেইমান, একদিন দেখিয়ে দেব আমিও কিছু কম যাই না।
রজত আর লিলির বিয়েতে যায়নি শেখর। তবে বিয়ের কার্ডটা ফেলে দেয়নি। লিলি আর একবারও দেখা বা কথা বলার চেষ্টা করেনি শেখরের সঙ্গে। কার্ডটা শেখরের ঘরের দেরাজে রাখা ছিল। মাঝেমাঝে উল্টেপাল্টে দেখত। একদিন শেখর চাকরি পেল। প্রথম চাকরি হিসেবে যথেষ্টই ভাল। শেখর মন দিয়ে চাকরি করতে থাকল। ধীরে ধীরে উন্নতি। মাথার ভেতর থেকে রজত আর লিলি ফিকে হতে শুরু করল। বছর কয়েকের মধ্যে শেখর প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। গ্রামের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় ফ্ল্যাট নিল। মা-বাবাকে নিয়ে এল। কিন্তু মা-বাবা পুরোপুরি এলেন না, কেউই নিজেদের গ্রামের বাড়ির পাট পুরো চুকিয়ে দিয়ে আসতে রাজি হননি। মাঝেমাঝে কলকাতায় এসে ছেলের কাছে থাকতেন দুজনে, আবার ফিরে যেতেন। এইভাবে চলল বেশ কিছুদিন। তারপর শেখরের বিয়ের তোড়জোড় শুরু করলেন। শেখরের বিয়ের প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল না, আসলে ঘা-টা শুকিয়ে গেলেও দাগ থেকে গেছিল। সেই দাগটা মাঝেমাঝে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখত শেখর। ওটা কখনও ওকে যন্ত্রণা দিত কখনও মোটিভেশন। শেখর প্রথমদিকে ভেবেছিল বিয়ে করবে না, আজীবন একাই কাটাবে। কিন্তু পরে মনে হল কেন একা থাকব? কার ওপর অভিমান করে? এসবের কোনও মূল্য নেই। বরং পরিপূর্ণ একটা জীবন কাটানোই ভাল। তবে প্রেম আর হয়নি শেখরের। ভেতর থেকে প্রেমের প্রতি আগ্রহ বা ইচ্ছা বা বিশ্বাসটাই চলে গেছিল। বাবা-মা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু মনের মত পাত্রী জুটছিল না। শেষে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হল। বেশ কিছু যোগাযোগ হল, বাছাবাছি করতে করতে শেষে রিনাকে পছন্দ হল শেখরের। সম্মন্ধ করে বিয়ে যেমন হয় তেমনভাবেই বিয়ে হল। হানিমুন হল, দুই বছর পর বুকান এল পৃথিবীতে। একসময় মা এবং বাবা দুজনেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। শেখর একজন সফল ব্যক্তি। ভাল সালারি, অফিস থেকে গাড়ি, একপ্রকার উচ্চমধ্যবিত্ত যাকে বলে। আর রিনাও ছিল আদর্শ গৃহবধু। কাজের সূত্রে প্রচুর ট্যুর করতে হত তখন রিনা একা হাতেসব সামলাতেন, ছেলের স্কুল, বাড়ির কাজ, বাইরের কাজ সবকিছু। শেখর নিশ্চিন্তে সব দায়িত্ব রিনার ওপর দিয়ে শুধু মন দিয়ে চাকরিটা করেছেন। অবশ্য রিনা এবং বুকানের প্রতি কর্তব্য বা ভালবাসায় কোনওদিনই খামতি ছিল না তার। তবে রিনার প্রতি শেখরের যেটা ছিল তা ঠিক প্রেম নয়, একটা নির্ভরতা, মায়া, পরস্পর একইসঙ্গে মন ও শরীর দিয়ে থাকলে যে বন্ডিং তৈরি হয় সেটা। শেখর কখনও টের পেতেন রিনার সঙ্গে তার সব রয়েছে কিন্তু কী যেন একটা মিসিং। আর সেই মিসিং ব্যাপারটা কোনওদিনই পূরণ হয়নি। অবশ্য তা নিয়ে কারও কোনও অভিযোগও ছিল না। রিনা নিজের সংসার নিয়ে চিরকাল খুশি, সন্তুষ্ট, শেখরও তাই। ছেলে বুকানও হয়েছিল অবিডিয়েন্ট, মেধাবী। তাই ছেলেকে নিয়েও বিশেষ চাপ নিতে হয়নি তাদের। একটি সহজ মসৃণ জীবনই কাটিয়ে এসেছেন শেখর। একটা সময়ের পর মন থেকে লিলি ও রজতের স্মৃতি মুছেই গেছিল, সেই কার্ডটার মত হারিয়ে গেছিল। কে আর অতীত ধরে আজীবন বসে থাকে?
অথচ এতবছর পর কেন হঠাৎ সেই অতীত মুখের সামনে এসে দাঁড়াল! আশ্চর্য, এমনও হয়! শেখরের ভাল লাগছে না, ওর ইচ্ছে করছে এখনই এই ট্যুর থেকে বেরিয়ে যেতে, কিন্তু বাস্তবে সেটা যথেষ্ট কঠিন, প্রথমত রিনাকে কী বলবে? রিনা এসবের কিছুই জানে না। আজ এতবছর পর যদি এইসব রিনাকে বলতে হয় সেটা অত্যন্ত অস্বস্তির ব্যাপার হবে। যে গোপন ইতিহাসের পাতা এত বছরে খোলার প্রয়োজন হয়নি, তা আর অবশিষ্ট ক’টা দিনের জন্য না খোলাই ভাল। কিছুই হয়ত হবে না, তবু একটা অস্বস্তি কাজ করবে। দ্বিতীয়ত আসল কারণটা না জানালে রিনাকে আর কোন অজুহাতে শেখর বলবেন এই গ্রুপটুরে থাকব না, চলো আমরা আলাদা ঘুরি। কারণ এখনও পর্যন্ত এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার মত কিছুই পাওয়া যায়নি।
আর এইসবের বাইরেও শেখরের মনের অনেক গভীরে একটি কৌতুহল তৈরি হয়েছে রজত আর লিলি এখন কেমন আছে? ওরা কি সুখী? ওরা কি অসুখী? ওরা কি শেখর-রিনার মত সুখে এবং শান্তিতে রয়েছে? ওদের সন্তান কি বুকানের মত প্রতিষ্ঠিত? দিন যতই পেরিয়ে যাক, মানুষ যতই সাফল্যের চূড়া স্পর্শ করুক, ফেলে আসা অতীতের অপমান, ব্যর্থতাকে সে কখনও পুরোপুরি ভোলে না, একটু খোঁচা খেলেই তা ভরভরিয়ে বেরিয়ে আসে, শেখরের ক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই হল। শেখর ঠিক করল ও লিলি আর রজতকে ওয়াচ করবে। আরও জানবে। কেন জানবে তা জানা নেই, কিন্তু জানার ইচ্ছা হচ্ছে। কিন্তু রজতকে শেখর চিনেও না চেনার ভান করেছে, সেটা কি এবার শুধরে নেওয়ার সময় হয়েছে? নাহ আরেকটু অপেক্ষা করা যাক। তারপর না হয় বলা যাবে।
৪
জয়পুর থেকে আজ অনেক সকালে বেরিয়ে পড়া হল জয়শলমীরের উদ্দেশে। অনেকটা পথ। যাওয়ার পথে বেশ কয়েকটা জায়গায় হল্ট নেওয়া হল। শেখর বারবার দেখছিলেন রজত আর লিলিলে। লিলি যেন একটু অস্বাভাবিক। রিনার চেয়ে অনেক বেশি বুড়ি মনে হয়, চুলগুলো রুক্ষ এবং সবই প্রায় সাদা, সাজগোজের কোনও বালাই নেই, সবসময়েওই একটু অন্যমনস্ক, ঝিমিয়ে থাকে, আর রজতও অনেকটা বুড়ো হয়ে গেছে, মাথায় একটাও চুল নেই, তাই বেশি বুড়ো দেখায়। একসময় রজতের একমাথা কোঁকড়া চুল আর একগাল দাড়ি। সেসব উধাও। এখন দেখলে কে বলবে একসময় কত সুপুরুষ দেখতে ছিল রজতকে। আজ সকালে রুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শার্টপ্যান্ট-শু পরে তৈরি হয়ে নিজেকে দেখছিলেন, এইভাবে নিজেকে তিনি বহুবছর দেখেন না, কিন্তু আজ ইচ্ছা করছিল। এখনও তিনি কতটা ফিট রয়েছেন? রজতের তুলনায় কতটা ইয়ং রয়েছেন সেটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে মনে মনে তৃপ্ত হচ্ছিলেন। রিনা দেখতে পেয়ে হেসে বলেছিলেন, ব্যাপার কী? আজ দেখছি আয়নার সামনে থেকে সরতেই চাইছ না? ভীমরতি ধরল নাকি?
শেখর থতমত খেয়ে আয়নার সামনে সরে গিয়ে বলেছিলেন ধ্যাত কী যে বলো শার্টটা দেখছিলাম ছোট হয়ে গেছে কি না।
হুঁ।
আর কথা হয়নি এই বিষয়ে।
বাস চলছিল। এই গ্রুপে অনেকের সঙ্গেই পরিচয় হয়ে গেছে। যেমন মিস্টার এন্ড মিসেস সেনগুপ্ত। দুজনেই সঙ্গীতশিল্পী। চমৎকার গান করেন। এখন বয়স হলেও গানের গলা দুইজনেরই দিব্বি সুন্দর। সকলের অনুরোধে তারা দুজন একের পর এক বাংলা হিন্দী গান করে চলেছেন। অনেকে তাদের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছেন। হাততালি দিচ্ছেন। স্কুল শিক্ষিকা তপতী হালদার রবিঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি করে শোনালেন। সবাই হাততালি দিলেন। বেশ জমে উঠেছে ট্যুরটা। কিন্তু শেখর দেখছিলেন লিলি আর রজত কেমন নিস্পৃহ। এই আনন্দের মধ্যে ওরা দুজন থেকেও নেই। লিলি তো জানলার বাইরেই তাকিয়ে রয়েছে, খুব কমই বাসের ভেতরে তাকাচ্ছে। শেখরের সঙ্গে একবার চোখাচুখি হল। কিন্তু লিলি শেখরকে চিনতে পারল বলে মনে হল না। তারমানে রজত লিলিকে শেখরের বিষয়ে কিছুই বলেনি। কেন বলেনি? মানুষের মন সত্যিই বেশ জটিল। সে যে কখন কী ভাবে কে জানে!
সারাদিন আজ বাসে। সকালের দিকে সকলের যতটা এনার্জি ছিল দুপুরের পর থেকে প্রায় সকলেই চুপ। কেউ ঘুমোচ্ছে বা ঝিমোচ্ছে, কেউ বা শুধুই চুপ করে রয়েছে। রাস্তা যদিও খুবই সুন্দর। কোনও ঝাঁকুনি নেই, কিন্তু এতটা পথ অতিক্রমের একটা ক্লান্তি তো রয়েছেই। জয়শলমীরে দুই রাতের প্রোগ্রাম। আজ বিকেলে পৌঁছে ট্যুর কোম্পানির ব্যবস্থা করা ক্যাম্পে থাকা, স্যাম স্যান্ডডিউনে যাওয়া। এবং কাল সকালে জয়শলমীর সিটি ট্যুর। দাশবাবু বলেছেন আজকের রাতটা নাকি স্পেশাল।
দুপুরে একটা রেস্ট্যুরেন্টে খাওয়া হল। তখন একবার রজতের সঙ্গে মুখোমুখি হলেন শেখর। শেখর ভেবেছিলেন রজত বুঝি আবার কথা বলার চেষ্টা করবে, কিন্তু এবারে রজত এড়িয়ে গেল শেখরের দিকে একবার তাকালও না। শেখর অবাক হলেন। উনি বুঝতে পারলেন রজত বুঝেছে তিনি ওকে এ্যাভয়েড করতে চাইছেন। এটা মনে হতে শেখরের একটু খারাপ লাগল, তিনি ভাবলেন তাহলে কি রজতকে গিয়ে বলবেন যে তিনি রজত আর লিলিকে চিনতে পেরেছেন? কিন্তু তারপর কী হবে? যদি কোনও সিনিক্রিয়েট হয়? মানে রিনা যদি জানতে পারে…অবশ্য এতবছর পর রিনা জানলেই বা কী? জীবনের শেষের দিকে চলে এসেছেন চারজনই। এখন কে পুরনো প্রেমিক আর কে পুরনো বন্ধু তাই নিয়ে নতুন করে ভাবার কিছু নেই।
ক্যাম্পে পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল। চারিদিক ধু ধু করছে ফাঁকা। তারই মধ্যে একটা জায়গায় অনেকগুলো সাদারঙের তাঁবু। আজ এখানেই রাত্রিবাস। বাস থেকে নামতেই জবরদস্ত ঠান্ডা অনুভব হল। ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা যদিও ঝকঝকে আলো। দাশবাবু সবাইকে বললেন, আপনারা যে যার টেন্টে গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে চলে আসুন। আমাদের জিপ এবং ক্যামেল সাফারি একটু পর থেকেই শুরু হয়ে যাবে।
প্রতিটি তাঁবুর গায়ে নাম্বার দেওয়া ছিল। দাশবাবু প্রত্যেককে তাদের নাম্বার বলে দিলেন। শেখর আর রিনার তাঁবুর নাম্বার দশ। রিনা বললেন, হ্যাঁ গো এখনই এত ঠান্ডা লাগছে রাত্রে থাকব কী করে? আর তাঁবুর ভেতর থাকা যায় নাকি?
আরে আগে ভেতরে এসই না, তাহলে তো বুঝব।
সন্দেহ শেখরেরও ছিল। কিন্তু তাঁবুর চেইন খুলে ভেতরে ঢুকেই মন ভাল হয়ে গেল। তোফা ব্যবস্থা। একটা চমৎকার গদিওলা খাট, চেয়ার টেবিল, আলনা, আয়না, সব ব্যবস্থা রয়েছে, এমনকি তাঁবুরই আরেকটা আলাদা অংশে রয়েছে বেসিন এবং কমোড। রিনার দিকে তাকিয়ে শেখর জিজ্ঞাসা করলেন, কী বুঝছ?
হ্যাঁ, এমনই ভালই।
বাইরে থেকে দেখে কিন্তু বোঝার উপায় নেই ভেতরে এত চমৎকার ব্যবস্থা।
হুঁ। কিন্তু রাতে ঠান্ডা ঢুকবে না তো?
মনে হচ্ছে না। সেইভাবেই টেন্টগুলো তৈরি। দেখছ না কাপড়গুলো আলাদারকমের।
রিনা টয়লেটে গেলেন, তারপর শেখরও গেলেন। টয়লেটে একটা কমোড ছাড়া বেসিনও রয়েছে। সবই অস্থায়ী, দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কতরকমের যে বিজনেস হয়! এগুলো সিজিনাল বিজনেস। শেখর আর রিনা দুজনেই একটা মাফলার আর টুপি নিয়ে নিলেন, তারপর বাইরে বেরিয়ে এলেন। প্রায় খান পনেরো টেন্ট ইতিউতি ছড়িয়ে। পুরো এলাকাটাই ধু ধু ফাঁকা। আকাশ নীল। কয়েকজন স্থানীয় রাজস্থানী লোক কাজে ব্যস্ত। দাশবাবু তাদের সঙ্গে কথা বলছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই একজায়গায় জড়ো হলেন। শেখর দেখলেন লিলি আর রজতও রয়েছে। লিলির গলায় মাথায় মাফলার প্যাঁচানো। এত বছর পর শেখর লিলিকে যতবার দেখছেন বুকের ভেতরটা ধক করে উঠছে, তিনি নিজেও অবাক হচ্ছেন নিজের এমন আচরণে। এই বয়সে এমন হার্টবিট বেড়ে যাওয়ার কারণ কী? লিলি কেমন অদ্ভুত হয়ে গেছে, বেশিরভাগ সময়েই মাথা নিচু করে থাকে, জগতে কী চলছে তা নিয়ে কোনও হুঁশই নেই। কেমন যেন…আদৌ মাথা ঠিক আছে তো লিলির? কথাটা ভাবতেই শেখরের বুকের ভেতরটা গুরগুর করে উঠল, না না তা কেন হবে? নিশ্চয়ই ঠিক আছে, নইলে বেড়াতে আসবে কেন…কী জানি…
এই তুমি হঠাৎ এত অনমনস্ক হয়ে পড়েছ কেন বলো তো? সত্যি বলো কী হয়েছে? আবারও জিজ্ঞাসা করলেন রিনা।
না না তো, আমার আবার কী হবে?
দেখছি কীসব ভেবে যাচ্ছ। শরীর ঠিক আছে তো?
হ্যাঁ শরীরের আবার কী হবে?
ঠিক তো?
আরে আমার শরীরখারাপ হয় নাকি? তুমি জানো না?
রিনা জানেন শেখর কথাটা ভুল বলেননি। জীবনে খুব কমই অসুস্থ হয়েছেন শেখর। একটা এ্যাটাক হয়েছে ঠিকই কিন্তু তা ছাড়া এই বয়সেও নিরোগ এবং নিজেকে সুস্থ রাখতে যথেষ্ট তৎপর এবং সচেতন। চিরকাল ভোর পাঁচটায় উঠে মর্নিং ওয়াক এবং তারপর অন্তত আধঘন্টা যোগাসন করেন। কখনও বাদ যায় না। কিন্তু স্বামীকে তিনি এতদিন ধরে দেখছেন সামান্য পরিবর্তনটুকুও নজরে আসে, সেটাই স্বাভাবিক। শেখর যে কিছু ভাবছেন এবং সেটা বলতে চাইছেন না সেটা বুঝলেন রিনা। কিন্তু না বলতে চাইলে কীই বা করার আছে?
দাশবাবু সকলের উদ্দেশে বললেন, আপনাদের আবারও জানিয়ে রাখি। আমাদের জন্য মোট চারটে জিপ রয়েছে। এই জিপে করে প্রথমে স্যান্ডডিউনে যাওয়া হবে সেখানে ক্যামেল সাফারি। জিপের সাফারিটা একটু এ্যাডভেঞ্চারাস। মানে উঁচু নিচু বালির মধ্যে দিয়ে গাড়ি যাবে, শক্ত করে ধরে বসতে হবে, যদি কেউ মনে করেন ভয় লাগতে পারে তাহলে এখানে থেকে যেতে পারেন।
দেখা গেল কেউই থেকে যেতে রাজি নয়। এখানে সকলে এসেছেনই থর মরুভূমির সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য, কাজেই কে থাকবে চারটে জিপে ভাগ করে সকলে রওনা হলেন। অনেকটাই পথ। কালোপিচের রাস্তা দিয়ে হুডখোলা জিপ চলতে থাকল। তারপর রাস্তা ছেড়ে দিয়ে জিপটা সোজা নেমে পড়ল বালিয়াড়িতে। ড্রাইভার বলল, আপনারা একটু শক্ত করে রড ধরে বসুন।
বলতে না বলতেই জিপটা হুশ করে বালির মধ্যে নেমে গেল, নেমেই আবার গোঁও করে উঠল। তারপর চলতে থাকল চড়াই উতরাই। রিনা তো কয়েকবার বাবা গো বলে উঠলেন, আরও দুজন ছিলেন তারাও ভয়ে অস্থির। ড্রাইভার বললেন, চিন্তার কিছু নেই, গাড়ি ওল্টাবে না। ড্রাইভার স্থানীয় রাজস্থানী ভাষায় বলছিলেন, অস্পষ্ট, জড়ানো গলা, মনে হচ্ছিল মদ খেয়ে রয়েছে। ড্রাইভারের পরনের পোশাকটিও জরাজীর্ণ, জিপটির মতই দৈন্যদশা। শেখরের মনে হল এরা কত পরিশ্রম করে, বিনিময়ে কটা টাকাই বা পায়। বেশ কিছুক্ষণ বালিয়াড়িতে জিপটা এমনভাবে চলল যেন উত্তাল সমুদ্রে ছোট নৌকো দুলছে, প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল এই বুঝি গাড়ি উলটে গেল। আসলে এটাই জিপ সাফারির এ্যাডভেঞ্চার। একসময় জিপ এসে থামল একটা সমতলে। সেখানে বেশ কিছু জিপ দাঁড়িয়ে রয়েছে। অনেক লোকজন, উট। এখানেই তারমানে উটসাফারি হবে।
ড্রাইভার বললেন, আপনারা ওখানে গিয়ে দাঁড়ান উট আসবে, ওতে উঠবেন।
রিনা আর শেখর গিয়ে দাঁড়ালেন। বিকেল পড়ে আসছে। এবার আকাশের রঙটা ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। বেশ ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে এখন। সূর্য পশ্চিমে ঢলছে। এখানে অনেক মানুষ ছবি তুলছেন, কেউ পায়ে হাঁটছেন কেউ উটে চড়ে ঘুরছেন আবার একধরনের স্পেশাল জিপে করেও খানিক দূরে যাচ্ছেন।
রিনা বললেন, হ্যাঁ গো ওরা যে বলেছিল মরুভূমির মাঝে নিয়ে যাবে, এটা মাঝখানে কই?
শেখর বললেন, অমন বলে, তাই বলে কি আর সত্যিই মাঝখানে নিয়ে যাওয়া যায় নাকি? এই সামনাসামনিই ঘোরায়।
রিনা যেন একটু ক্ষুন্ন হলেন, বললেন, এদের স্বভাবই এমন, এক বলে আরেক করে।
শেখর বললেন, না তা নয়, দেখচ তো সবাই এখানেই ঘুরছে।
কথা বলতে বলতেই তেরো নাম্বার উট এসে দাঁড়াল। পিঠে সওয়ারি। তারা শেখরদের সঙ্গেই এসেছেন।
উট মাটিতে বসার পর তারা নামলেন।
শেখর জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন ঘোরাল?
এই তো এইটুকু। দশ মিনিটও না, তবে মন্দ নয়। যান ঘুরে আসুন।
শেখর আগে রিনাকে ধরে বসালেন। রিনা খুবই ভয় পাচ্ছিলেন। যদিও উনি সালোয়ার পরে রয়েছেন এখানে কিন্তু পা তুলে বসাটা বেশ কঠিন, প্রথমদিকে কিছুতেই পারছিলেন না, কোনওমতে বসলেন, তার পিছনে শেখর। উটের রশিটি ধরে রয়েছে একটি কিশোর। সে ভাঙা হিন্দীতে বলল, উট যখন উঠে দাঁড়াবে তখন আপনারা একবার সামনে তারপর পিছনের দিকে ঝুঁকবেন।
উটটা উঠে দাঁড়াল যখন তখন রিনা ওরে বাবা রে বলে চিৎকার করে উঠলেন, শেখরেরও মনে হচ্ছিল এই বুঝি পড়ে গেলেন। তারপর উট ওই বালির মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করল। শেখরের ভয় কমে গেল। পকেট থেকে মোবাইল বার করে তিনি ছবি নিতে থাকলেন, এমনকি সামনে বসে থাকা রিনার সঙ্গে একটা সেলফিও তুললেন, রিনাকে বললেন, এমন ভয় ভয় মুখ করে রয়েছ কেন? একটু হাসো।
হুহ খালি মনে হচ্ছে পড়ে যাব আর তুমি আমাকে হাসতে বলছ। আমি নামতে পারলে বাঁচি বাবা আর জীবনে উটে চাপছি না আমার ঘাট হয়েছে।
অবশ্য মিনিট পাঁচেক পরে রিনারও ভয় খানিকটা কেঁটে গেল। পশ্চিমে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, লাল হয়ে উঠেছে আকাশ। শেখর এদিক ওদিক দেখছিলেন, এই ভিড়ের মধ্যে তার চোখ কাউকে খুঁজছিল। লিলি কি উটে চেপেছে? দেখতে দেখতেই নজরে এল রজত আর লিলি একটি বালির ঢিপিতে চুপ করে পাশাপাশি বসে রয়েছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওরা উটে চাপবে না। কেন? ভয় নাকি অন্য কোনও কারণ? ওরা দুজন বসে রয়েছেন বিষন্নভাবে। এত সুন্দর প্রকৃতি যেন ওদের স্পর্শই করছে না। ওরা কি অসুখী? ভাল নেই দুজন? কী হয়েছে? তাহলে বেড়াতেই বা এল কেন? ওদের ছেলে মেয়ে কোথায়? এইসব ভাবতে ভাবতে আবারও অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন শেখর। এমন সময় ছেলেটি বলল, স্যর মোবাইল আমাকে দিন আমি আপনাদের ছবি তুলে দিচ্ছি।
শেখর মোবাইলের ক্যামেরা অন করে ছেলেটির হাতে দিল। ছেলেটি বেশ কিছু ছবি তুলে দিল শেখর আর রিনার। তারপর উট এসে আবার থামল নির্দিষ্ট জায়গায়। নামার সময় আবারও সেই ভয়, এই বুঝি উলটে পড়লাম।
নামার পর রিনা বললেন, মোটে এইটুকু ঘোরাল!
শেখর হা হা করে হেসে বললেন, এই তো বলছিলে উঠবে না, এখন আবার এইটুকু হয়ে গেল!
রিনাও হাসলেন। ওদের চোখেমুখে সোনালি রোদ পড়েছে। দূরে সূর্য অস্ত হচ্ছে। মরুভূমিতে সূর্যাস্ত দেখা এই প্রথম অনেক মানুষ সেই মুহূর্তের ছবি তুলছেন। শেখরও বেশ কিছু ছবি তুলল। একটি বাচ্চা মেয়ে নাচ করছে আর একজন মধ্যবয়স্ক লোক স্থানীয় বাজনা বাজিয়ে গান করছে। বাজনাটির নাম রাবনহাত্তা। রাজস্থানী তারবাদ্য। ভাল লাগছে শুনতে। বাচ্চা মেয়েটি ভারি সুন্দর নাচ করছে। অনেকে টাকা দিচ্ছেন। রিনা আর শেখর কিছুক্ষণ দেখলেন সেই নাচ তারপর পঞ্চাশটি টাকা দিলেন বাচ্চাটির হাতে। বাচ্চাটি খুব খুশি হল। রিনা কথা বললেন ওর সঙ্গে। লোকটি মেয়েটির বাবা, গ্রামে বাড়ি। এই সিজনে প্রতিদিন এখানে আসে, নাচ গান করে টুরিস্টদের কাছ থেকে যা সামান্য কিছু পায় তাই হাসি মুখে নেয়। কিশোরী মেয়েটির কী সারল্যমাখা মুখ। রাজস্থানী পোশাক পরে কেমন ঘুরে ঘুরে নাচছিল, খুব সুন্দর লাগছিল।
সন্ধে নেমে এল। জিপওলা বলল, এবার চলুন।
রিনা আর শেখর সূর্যের পুরো ডুবে যাওয়া দেখার পর জিপে উঠলেন। এবারে সঙ্গে উঠলেন অন্য দুই ব্যক্তি। এরা দুজনে বন্ধু, বয়স পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন। দুই বন্ধুই বিয়ে থা করেননি, শুধু ঘুরে বেড়ান। আগে নিজেরাই ঘুরতেন, এখন ট্যুরকোম্পানির সঙ্গে ঘোরা শুরু করেছেন। বেশ আমুদে মানুষ, কথা বলতে ভালবাসেন দুইজনেই। জিপ আবারও সেই বালিয়ারির ঢেউতে যখন উঠতে নামতে লাগল দুইজন ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। জিপের রডটা ধরে সেই ঢেউয়ের মজা নিতে থাকলেন। শেখরকেও বললেন, আরে দাদা, বউদি বসে থাকুক, আপনি একবার উঠে দাঁড়িয়ে মজাটা নিন। এটা আলাদাই এক্সপ্রেরিয়েন্স। শেখর প্রথমে কিন্তু কিন্তু করছিলেন, রিনার দিকে তাকালেন। রিনা বললেন, আমার দিকে কী দেখছ? তোমার ইচ্ছে হলে দাঁড়াও। তবে সাবধানে।
রিনার সায় পেয়ে শেখর উঠে দাঁড়ালেন। দুই হাতে শক্ত করে রডটা ধরলেন, উফ দারুন রোমাঞ্চ। এই পয়ষট্টি বছরের শরীর যেন কয়েক মুহূর্তে তরুণের মত হয়ে গেল। মিনিট দশেক এমন চড়াই উতরাইয়ের রোমাঞ্চকর বালিয়ারি পেরিয়ে জিপ যখন সমতল রাস্তায় উঠল তখন শেখর বসে পড়লেন, উফ এবারে জব্বর ঠান্ডা লাগছে। গলার মাফলারটা নাকেও পেঁচিয়ে নিলেন শেখর। রিনা আগেই নিজেকে ভালভাবে ঢেকে নিয়েছেন। রাস্তা অন্ধকার। জিপ ছুটতে থাকল গোঁও শব্দ করে। রাস্তায় ফিরতে ফিরতে শেখরের আবার মনে পড়ল রজত আর লিলির কথা। ওরা ওইভাবে একাকী বসেছিল কেন? মনটা খারাপ হয়ে উঠল শেখরের। এমনই।
৫
জিপ যখন টেন্টে পৌঁছল ততক্ষণে চারিদিক অন্ধকার। বেশ কয়েকটি হ্যালোজেন জ্বলছে ইতিউতি। কুয়াশা পড়া শুরু হয়েছে, আর তেমনই ঠান্ডা। বাপ রে বাপ এত ঠান্ডা পড়বে এখানে ভাবে যায়নি। রিনা আর শেখর প্রায় কাঁপতে কাঁপতেই টেন্টে ঢুকলেন। চেন খুলে ভেতরে ঢুকতেই আহ ভেতরটায় বেশ আরাম। খাটে দুটো কম্বল দেওয়া রয়েছে, শেখর তখনই গায়ে কম্বল চাপা দিয়ে বসতে যাচ্ছিলেন রিনা হাউহাউ করে উঠলেন, এই এই একদম বাইরের জামা-কাপড় পরে খাটে উঠবে না। আর এই কম্বল কে না কে আগে গায়ে দিয়েছে খবরদার এইভাবে গায়ে দেবে না।
তাহলে কি এমনি শোব নাকি? দেখছ কত ঠান্ডা?
এমনই কেন শোবে আগে আমি স্প্রে করব তারপর। যাও হাত মুখ ধোও গিয়ে।
শেখর বাধ্য ছেলের মত উঠলেন। টেন্টের ভেতর একটা খুব লো পাওয়ারের এলইডি ল্যাম্প জ্বলছে। এ ছাড়া রয়েছে একটা প্লাগপয়েন্ট। ওটা শুধু মোবাইল চার্জিং-এর জন্য। আসলে এখানে ইলেক্ট্রিসিটি পুরোটাই জেনারেটরে চলছে। দাশবাবুর কাছে শেখর জেনেছেন এই অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জয়শিলমিরের থর মরুভূমির কাছে বিচ্ছিন্ন ফাঁকা জমিতে এমন টেন্ট বসে, এগুলো সবই ব্যক্তিগত জমিতে বিজনেস। পুরো প্যাকেজ। শেখর বেসিনে গিয়ে কল খুলতেই যা ঠান্ডাজল পড়ল তাতে আঙুল প্রায় বেঁকে গেল, উরিব্বাপ রে এ কী ঠান্ডা! এখন গরমজল পাওয়া যাবে না, ফ্লাস্কে খানিকটা গরমজল রয়েছে সেইটুকু বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এখানে শুধুমাত্র কাল সকালে স্নানের সময় একঘন্টা গরমজল আসবে। ব্যাস, আর গরমজলের কোনও ব্যাপার নেই।
শেখর ওয়াশরুমের চেইন টেনে ভেতরে এসে দেখলেন রিনা কম্বলে বিছানায় স্যানিটাইজার স্প্রে করে চলেছে। উনি মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন, রিনার এই পিটপিটানি আর গেল না। অবশ্য একদিকে ভালই হল। পরক্ষণেই শেখরের মনে পড়ল লিলির কথা। ও কী করছে এখন? এ এক অদ্ভুত ব্যপার হয়েছে। কিছুক্ষণ পরপরই লিলি আর রজতের কথা মনে পড়ছে। শেখর ওসব ভুলে থাকতে চাইছেন। আর তো মাত্র তিনটে দিন। কাল সকালে সিটি ট্যুর। তারপর সেখান থেকে যোধপুর। যোধপুরে দুইদিন। সেখান থেকে যারা ট্রেনে ফেরার ট্রেনে, ফ্লাইটের টিকিট যারা করেছেন ফ্লাইটে ফিরে যাবেন। আর হয়ত কখনও দেখাই হবে না। রজত আর লিলি কোথায় থাকে? কেমন আছে আর জানাই হবে না? আচ্ছা কীই-বা হবে জেনে? লিলি আর রজত শেখরের সঙ্গে যেটা করেছিল সেটা অন্যায়, বিশ্বাসঘাতকতা, কাজেই ওদের দুজনের প্রতি কোনওপ্রকার অনুভূতি থাকাই উচিত নয়। সেখানে শেখরের কেন বারবার এসব মনে পড়ছে আর রিনা এতবছর যা কখনও জানেনি, ও জানলেই বা কী মনে করবে? যতই পুরনো ঘটনা হোক স্বামীর পুরনো প্রেমিকা একই ট্যুরে রয়েছে এটা জানার পর রিনার মনে অস্বস্তি হতে বাধ্য। আর শেখরের পক্ষেও সেটা বিড়ম্বনার ব্যাপার হবে।
ফোন বেজে উঠল শেখরের। দাশবাবু ফোন করেছেন।
স্যর আপনারা চলে আসুন। এখনই প্রোগ্রাম শুরু হবে, কফি এবং স্ন্যাক্সের ব্যবস্থা এখানেই রয়েছে।
কোনদিকে?
আপনাদের টেন্টের ঠিক পশ্চিমদিকে চলে আসুন স্যর।
আচ্ছা ঠিক আছে আসছি।
ফোন রেখে দিয়ে শেখর রিনাকে বললেন, শোনো দাশবাবু ফোন করলেন, কালচারাল প্রোগ্রাম শুরু হবে, ওখানেই স্ন্যাক্স কফি ইত্যাদি দেবে।
উফফ আবার বেরোতে হবে। আমার এখন আর ইচ্ছে করছে না, সারাদিন ধরে শুধু জার্নি। আমি একটু শোব, তুমি চাইলে দেখে আসো।
তাহলে কফি স্ন্যাক্সের কী হবে?
আমি এখন স্ন্যাক্স কিছু খাব না, দুপুরের খাবারের পর আজ এখনও পেট ভার হয়ে রয়েছে। ফ্লাস্কে গরমজল আছে? তাহলে আমাকে একটু চা দাও খাই। ভীষণ টায়ার্ড লাগছে।
শেখর তাই করলেন। সঙ্গে কিছু কফি পাউচ আর টিব্যাগ নিয়ে এসেছিলেন। বিস্কুটের প্যাকেটও রয়েছে। ফ্লাস্কের জল এখনও যথেষ্ট গরম রয়েছে। কাপে জল ঢেলে একটা চায়ের ব্যাগ ওর মধ্যে দিয়ে খানিকটা নাড়াচাড়া করে রিনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন বিস্কুট খাবে?
না আর কিছু খাব না।
বেশ আমি তাহলে একটু দেখে আসি?
ভাল করে নাক মুখ চাপা দিয়ে রেখো, ঠান্ডা লাগিও না, খুব কুয়াশা।
আচ্ছা চিন্তা নেই।
চেইনটা টেনে দিও। বলে কম্বলে নিজেকে ভালভাবে ঢেকে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন রিনা।
শেখর বাইরে বেরিয়ে টেন্টের চেইনটা টেনে দিল। চারদিকে ভোঁ ভাঁ কুয়াশা। বাজনার শব্দ আসছে। এদিকে যে টেন্টগুলো রয়েছে তার ঠিক পশ্চিমে কিছুটা এগিয়েই শেখর দেখতে পেল মস্ত একটা খোলা মঞ্চ, নানারকমের আলো জ্বলছে। আর অনেক চেয়ার ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। সেখানে অনেকেই বসে রয়েছেন। টেরিফিক ঠান্ডা। বেশিক্ষণ বসে থাকা কঠিন ব্যাপার। খোলা জায়গা বলে খুব ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। মঞ্চে কয়েকজন রাজস্থানী বসেছেন, ওরাই সম্ভবত গান বাজনা করবেন। তারই প্রস্তুতি চলছে। শেখর একটি চেয়ারে বসলেন। দর্শকদের দিকে আলো আঁধারি, কারও মুখ তেমন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। একদিকে বেশ কিছু ছেলে চা পকোরা ইত্যাদি বানাচ্ছে। যারা বসে রয়েছেন তাদের সার্ভ করছে এখানে অনেক টুরিস্টই এসেছেন কম করে পঞ্চাশ ষাটজন তো বটেই। বেশ কিছু বাস, ছোট গাড়ি একেবারে বাইরে দিকে দাঁড়িয়ে। এগুলোতেই টুরিস্টরা এসেছে।
গান শুরু হল। রাজস্থানী লোকসঙ্গীত। খোলা কুয়াশাভরা মাঠে প্রবল ঠান্ডায় অন্ধকার আকাশের নিচে এই ধু ধু প্রান্তরে রাজস্থানী ভাষার গান কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিবেশটাকে বদলে দিল। একটু পরেই দুইটি ছেলে এল, একজনের হাতে পকোরার কাগজের প্লেট আরেকজনের হাতে কফির ট্রে। শেখর নিলেন। সামনের টেবিলে রাখলেন। ওর টেবিলের সামনে আরও কয়েকটি চেয়ার। সেখানে কেউই বসেনি। উনি একাই বসে পকোড়ায় কামড় দিয়ে কফির কাপে চুমুক দিলেন। লিলিরা আসেনি? এসেছে হয়ত, অন্যদিকে বসেছে। শেখর গান শোনায় মন দেওয়ার চেষ্টা করলেন। গায়ক এখন একটি গজল গাইছেন। গজলটি গুলাম আলীর। শেখরের শোনা, তবে গায়ক গাইছেন নিজস্ব ঢং এ। ভাল লাগছে।
শেখর কফি পকোরা খেতে থাকলেন।
গায়ক গাইছেন
ইয়াদ পিয়া কি আয়ে…ইয়ে দুখ যা সহে যায় হায় রাম…
তার সহ গায়ক ধুয়ো দিচ্ছেন। শেখর গুনগুন করছেন। এমন সময় দেখলেন ওর পাশের টেবিলটিতে এসে একজন বসলেন। মাথায় মাঙ্কিক্যাপ। ফুলহাতা সোয়েটার। গলায় মাফলার। শেখরকে ভদ্রলোক খেয়াল করেননি, কিন্তু শেখর একবার দেখেই চিনতে পেরে গেলেন। রজত এসে বসেছে। কিন্তু লিলি কই? আসেনি?
শেখর একবার ভাবলেন রজতকে কিছু বলবেন না, কিন্তু আচমকাই তার মনে কী যে হল, তিনি স্পষ্ট ডেকে উঠলেন, রজত।
রজত বাবুও নয়, একেবারে সরাসরি রজত।
রজত একটু চমকে শেখরের দিকে তাকালেন। তারপর মৃদু হাসলেন।
শেখর ইশারায় রজতকে ওর পাশের চেয়ারে এসে বসতে বললেন, তিনি এমন কেন করছেন তা নিজেও জানেন না, কিন্তু ইচ্ছা করছে।
রজত উঠে এসে শেখরের পাশে বসলেন। কিন্তু কিছু বললেন না।
শেখর জিজ্ঞাসা করলেন, লিলি এল না?
রজত একটুও অবাক হলেন না, শুধু বললেন, ওর শরীরটা ভাল নেই। শুয়ে আছে।
কী হয়েছে লিলির?
এমনি অনেক সমস্যা। একটু থেমে আবার বললেন, অনেক সমস্যা ওর।
শেখর শুধু বললেন, আচ্ছা।
রজত কিন্তু একবারও বললেন না, যাক তাহলে চিনতে পারলি?
শেখর কয়েক মিনিট চুপ করে গান শুনলেন। তারপর আবার মৌনতা ভেঙে জিজ্ঞাসা করলেন, তোরা কেমন আছিস?
রজত ওর কফির কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে বললেন, আছি…আছি একপ্রকার।
তোর কি শরীরটা ভাল নেই।
নাহ আমি ঠিকই আছি। লিলি একটু ভোগে।
কোনও সমস্যা রয়েছে?
হ্যাঁ…অনেকবছরের সমস্যা।
ট্রিটমেন্ট করাস নিশ্চয়ই?
হ্যাঁ অনেক করিয়েছি। এখনও নিয়মিত ওষুধ খায়।
আচ্ছা…বলে আবারও একটু পজ নিয়ে শেখর জিজ্ঞাসা করল, আর তুই কেমন আছিস?
আমি…ঠিকই আছি, চলছে। তোর স্ত্রী-র নাম কী?
ওর নাম রিনা।
আচ্ছা।
তুই রিটায়ার করে গেছিস?
হ্যাঁ অনেকদিন আগেই। ভল্যানটারি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে নিয়েছিলাম।
কেন? বলে শেখর একটু চমকে তাকালেন রজতের দিকে।
ভীষণ ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। আর বেশিক্ষণ মনে হয় বসে থাকা যাবে না। আর মোটা কুয়াশা। এখন আগের গায়ক উঠে গেছেন। নাচের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। কয়েকজন রাজস্থানী মহিলা নাচ করছেন। দর্শকরা হাততালি দিচ্ছেন।
রজত বললেন, আমার অনেক সমস্যা। অনেক কিছু ঘটে গেছে। তুই কি রিটায়ার করেছিস?
হ্যাঁ এই কয়েকবছর হল।
আচ্ছা। ভাল। কোথায় থাকিস?
সাউথ কলকাতায়। একটাই ছেলে এখন স্টেটসে থাকে। দুজনে ঝাড়া হাত-পা তাই ভাবলাম ঘুরে আসি।
বাহ খুব ভাল।
তোদের কি ছেলে না মেয়ে?
মেয়ে?
একটিই?
রজত একটু চুপ থাকলেন, তারপর থেমে থেমে বললেন, হ্যাঁ একটিই…ছিল।
ছিল? মানে?
আর নেই।
বুকের ভেতর যেন একটা ভেজিয়ে রাখা দরজা সশব্দে ধাক্কা দিয়ে খুলল কেউ। শেখর হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন রজতের দিকে। অপেক্ষা করতে থাকলেন।
রজত বললেন, শ্যামলী নাম দিয়েছিল মেয়ের লিলি। আমি ডাকতাম শ্যামা বলে। আমার বড় ন্যাওটা। পড়াশোনায় খুব ভাল। উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় একটা খারাপ ছেলের পাল্লায় পড়ল। আমি আর লিলি জানতে পেরে অনেক বোঝালাম, কিন্তু মেয়েটা আমার বড় জেদি। নিজের ভাল বুঝল না, আমাদের কথা শুনল না। লিলি একদিন রাতে খুব অশান্তি করল, আমিও বোঝালাম, মেয়েটা চলে গেল…
কথাগুলো থেমে থেমে বললেন রজত। বড় অভিমানী মেয়েটা আমার…চলেই গেল…
শেখরের গলার কাছটায় বাষ্প আটকে গেছে। আর শীত করছে না। অস্থির লাগছে।
নিজের এই হাতে আমার শ্যামামায়ের মুখে আগুন দিয়েছিলাম জানিস শেখর, এই যে এই হাতফুটো দিয়ে…দেখ হাতটা…
শেখর কী বলবেন ভেবে না পেয়ে রজতের হাতটা চেপে ধরলেন। রজত অল্প কাঁপছেন।
থাক এসব কথা…এতদিন পর…ছাড়…
হ্যাঁ সবই ছেড়ে দিয়েছি। আসলে পাপ বাপকেও ছাড়ে না, তোর কাছে হয়ত আমাদের ক্ষমা চাওয়ার ছিল…তাই এমন দেখা হয়ে গেল শেষবয়সে…
এসব কথা বলিস না রজত। অনেক সময় পেরিয়ে গেছে…আর এসব কথা বলার দরকার নেই।
সময় পেরিয়ে গেছে কিন্তু ইতিহাস তো বদলায়নি…তুই জানি না…হয়ত তুই পারবি না, কিন্তু বলি আমাদের দুজনকেই তুই ক্ষমা করিস…আসলে তখন কী থেকে যে কী হয়ে গেল…
রজত অনেকদিন পেরিয়ে গেছে। আর এসব কথা তোলার কোনও দরকার নেই। আমি কিছুই মনে রাখিনি। আর আমরা সবাই জীবনের শেষের দিকে চলে এসেছি…কী লাভ পুরনো কথা ভেবে?
সেই…তবু মাঝেমাঝে ভাবি…। আমি একটা সময় তোকে খুঁজেওছি। পাইনি…
আবার দুজনে চুপ।
কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা ভেঙে রজত বললেন, মেয়েটা মরে যাওয়ার পর লিলির মাথাটা কেমন হয়ে গেল। গোড়ার দিকে কিছুতেই সামলাতে পারতাম না, একদিকে অফিস অন্যদিকে লিলি। কিছুদিন হাসপাতালে রাখলাম, কিন্তু ডাক্তার বললেন হাসপাতালে রেখে লাভ নেই, ওর আপনার সাপোর্ট দরকার। ওকে সারাক্ষণ আগলে রাখুন। তখন আমার মাথা খারাপ অবস্থা। এদিকে রেলের চাকরি ট্রান্সফারের, তখনই এল ট্রান্সফার অর্ডার। আমার কাছে দুটো অপশন চাকরি অথবা লিলি। ছেড়ে দিলাম চাকরিটা। সারাক্ষণ লিলিকে নিয়ে পড়ে থাকলাম, অনেকদিন পর একটু সুস্থ হল, কিন্তু ডিপ্রেশনের সঙ্গে বেশ কিছু শারীরিক সমস্যাও ধরল। আমাকেও সুগার, প্রেশার এসব কাহিল করে দিল। একটা এ্যাটাকও হয়ে গেল। প্রতিবেশীরা মিলে বাঁচিয়েছিল।
তারপর?
তারপর এইইই…চলছে…শুধু দুটো ঘরের মধ্যে দুজন। বছরের পর বছর। লিলি আগে কোনও কথা বলত না, সারাদিন চুপ, অথবা কান্না। ওষুধ, কাউন্সেলিং ইত্যাদি করে এখন কিছুটা ধাতস্ত হয়েছে, কিন্তু ও বদলে গেছে…পুরো বদলে গেছে।
শেখর রজতের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখছিলেন মঞ্চের ঝকমকে আলো শেখরের দুই চোখে পড়ে চিকচিক করছে। শেখর নিজের দুই চোখ ডললেন, চারদিক একটু ঝাপসা লাগছে। চশমার কাচ ভেপে উঠছে।
বহুকাল পর ওকে নিয়ে একটু বেড়াতে বেরোলাম, অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছি। তবে শরীরে দেয় না। আমারও শরীর ভাল নেই, তবু ওর জন্যই এলাম।
শেখর বললেন, ভাল করেছিস।
লিলি অল্পেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিকেলের পর থেকেই দেখলাম হাঁচি দিচ্ছে। আবার কিছু না হয়! ভয় লাগছে আমার…এত দূরে…যদি বাড়াবাড়ি কিছু হয়ে যায়…
কিছু চিন্তা করিস না…এইটুকু বলার পর শেখর বললেন, আমি…মানে আমরা তো আছি।
হুঁ।
তোরা ভাল আছিস দেখে আমার সত্যিই ভাল লাগল শেখর।
হ্যাঁ ভাই…চলে যাচ্ছে। এই কদিন শেখরের মনে এই ভেবে আরাম হচ্ছিল যে আমি রজত আর লিলির থেকে ভাল আছি, এখন মনে হল ওরা দুজনেও ভাল থাকলে ভাল হত।
তোকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব রজত?
হ্যাঁ, বল। বলেই রজত বললেন, লিলি তোকে চিনতে পারেনি, আমিও কিছু বলিনি। ও আজকাল চেনা মানুষদেরও অনেকসময় চিনতে পারে না, আর তোকে তো এতবছর পর…নিজের মনেই থাকে বেশিরভাগ সময়টা…
ও। শেখর উত্তর পেয়ে গেলেন।
শেখর আমি চলি রে, লিলি একা রয়েছে টেন্টে। ভীষণ ঠান্ডা।
হ্যাঁ আয়।
রজত এবার শেখরের দিকে নিজের হাতটা বাড়ালেন। শেখর বহুযুগ পর রজতের হাতটা নিজের দুই হাত দিয়ে চেপে ধরলেন, বললেন, চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।
রজত চলে গেলেন। শেখর বসে রইলেন একা।
৬
রাত নটা নাগাদ এই খোলামাঠেই খাবারের ব্যবস্থা হয়েছিল। বুফে সিস্টেম। গরম পুরি, আলুর দম, আর হালুয়া। খাবার মুখে দিতে না দিতেই ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। শেখর কোনওমতে খানিকটা খাবার খেয়ে একটা থালায় রিনার জন্য খাবার নিয়ে টেন্টে ঢুকে পড়েছিলেন। রিনা কিছুতেই কম্বল থেকে বেরোতে রাজি নন। ঠান্ডায় হাত-পা সব জমে যাচ্ছে। বাপ রে বাপ এ কী ঠান্ডা। টেন্টের ভেতর হাওয়া ঢুকছে না ঠিকই কিন্তু প্রচন্ড ঠান্ডা। কম্বলে, বিছানায় মনে হচ্ছে কেউ ঠান্ডা জল ঢেলে দিয়েছে। খাওয়া সেরে অল্প গরমজল খেয়ে শেখর আর রিনার শুয়ে পড়লেন। শেখরের ঘুম আসছিল না। বারবার মনে পড়ছে রজত আর লিলির কথা। এত কষ্ট ওদের ভাবতে পারেননি। ওদের দুজনের জন্য শেখরের মনে এতকাল যে একটা চাপা ক্ষোভ, অভিমান ছিল তা যেন ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। আসলে একটা বয়সে পৌঁছনোর পর মানুষের ভেতরে রাগ, অভিমান, ইত্যাদিগুলোও ঝিমিয়ে পড়ে, তখন সবকিছুকে সে ক্ষমা করে দিতে চায়, শান্তি পেতে চায়।
রিনা জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কী হল, খালি এপাশ ওপাশ করছ কেন?
না না এমনই।
কিছু তো বলবে না ঠিকই করেছ। চুপ করে শোও। আমাকে ঘুমোতে দাও। বলে পাশ ফিরে শুলেন রিনা। শেখর ভাবতে থাকলেন। বেশ অনেকটা রাত হওয়ার পর শেখরের সবে একটু তন্দ্রা এসেছে, তার মনে হল বাইরে থেকে কেউ যেন ওর নাম ধরে ডাকছেন। শেখর…শেখর…
শেখর ভাবলেন ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু আরও কয়েকবার ডাকটা শোনার পর তিনি কম্বল সরিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসলেন। নাহ সত্যিই বাইরে কেউ ওর নাম ধরে ডাকছেন। কান খাড়া করে শুনলেন তিনি। রজতের গলা না!
বিছানা ছেড়ে তিনি উঠে টেন্টের চেনটা খুললেন, সামনে রজত দাঁড়িয়ে।
কী হয়েছে?
লিলির ভীষণ জ্বর। আমি বুঝতে পারছি না কী করব!
সে কী রে! কখন হল?
তখন ফিরলাম টেন্টে। গিয়ে দেখি গা পুড়ে যাচ্ছে।
সে কী কথা! কিছু দিয়েছিস?
প্যারাসিটামল দিয়েছিলাম, জ্বর নামেনি। আমি কী করব বুঝতে পারছি না। রজতের গলায় ভয়।
শেখর বললেন, কত জ্বর?
জানি না, থার্মোমিটার নেই।
মাথায় জল দে তাহলে।
জল নেই কলে। আমি কী করব!
চিন্তা করিস না, চল দেখি। বলে শেখর ভেতরে ঢুকে মাথায় টুপিটা পরতে যাবেন দেখলেন রিনা উঠে বসেছেন। শেখর রিনার দিকে তাকালেন।
রিনা জিজ্ঞাসা করলেন, কে এসেছে?
রজত।
রজত কে?
রজত…আমার বন্ধু…
বন্ধু…! মানে!
ওই যে সেই ভদ্রলোক…পরে বলব।
রিনা অবাক হলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন কী হয়েছে?
লিলির খুব জ্বর। নামছে না।
শেখরের গলার উৎকন্ঠা বুঝতে পারলেন রিনা। এই উদ্বেগ অন্যরকম।
লিলি কে?
লিলি…
রিনা আর কোনও কথা বাড়ালেন না। অবাক হয়ে তাকালেন তার স্বামীর দিকে। কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করলেন, তারপর বললেন, ঠিক আছে যাও। মাথায় ঢাকা দাও।
শেখর চুপ করে বেড়িয়ে গেলেন।
রজতের টেন্ট নাম্বার পাঁচ। শেখর আর রজত দ্রুতপায়ে টেন্টে এলেন। শেখর এসে দেখলেন লিলিকে। সাদা পাতলা চুলকটা ছড়িয়ে, চোখ মুখ বসা, চোখ বুজে শুয়ে রয়েছে লিলি। বুকের ভেতরটা মুহূর্তের মধ্যে দুমড়ে মুচড়ে গেল শেখরের। আজ এতবছর পর কাছ থেকে মুখোমুখি লিলিকে দেখলেন তিনি। কিন্তু এ কেমন লিলি! যেন আশি বছরের এক লোলচর্ম বৃদ্ধা। অবশ্য এত ঝড় গেছে মেয়েটার ওপর দিয়ে।
রজত বললেন, কী হবে শেখর?
ভয় পাস না। তুই জলের ব্যবস্থা কর। ঘরে কি একটুও জল নেই?
ওই জগে অল্প আছে।
জলপটি দিয়েছিস?
না…দেওয়া হয়নি।
ওটা তো আগে দরকার ছিল। বলে শেখর লিলির কপালে হাত রাখলেন, কত যুগ পর আবার স্পর্শ করলেন লিলিকে। ইসসস আগুনের মত গরম! কষ্ট হল শেখরের। রজত হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। শেখর বুঝলেন রজতের মাথা কাজ করছে না। তিনি নিজে জলের জগটা হাতে নিয়ে রজতকে বললেন, একটা রুমাল থাকলে দে। আর তুই দাশবাবুর টেন্টে যা। গিয়ে ওকে ডেকে বল এখনই একবালতি জল লাগবে, মাথা ধুয়ে দিতে হবে, নইলে জ্বর নামবে না। যা শিগগির।
দাশবাবু…
এই রো এর একএবারে প্রথম টেন্টটা দাশবাবুর। যা।
রজত বললেন আচ্ছা যাচ্ছি। বলে বেরিয়ে গেলেন। টেন্টের ভেতর লিলি আর শেখর। লিলি জ্বরে আচ্ছন্ন হয়ে এলিয়ে পড়ে রয়েছেন। শেখর পাশে বসলেন, জগের মধ্যে রুমালটা ভিজিয়ে লিলির কপালে রাখলেন। মনে মনে বললেন, সেরে ওঠো তুমি, ভয় নেই আমি আছি।
বাইরে প্রবল কুয়াশা, রজত ওই অন্ধকারে প্রথম টেন্টটা কোথায় খুঁজতে থাকলেন। রিনা কিছুক্ষণ জেগে রইলেন, তারপর চোখ বুজলেন। শেখর তেতে ওঠা রজতের রুমালটা আবার জলে ডুবিয়ে পকেট থেকে নিজের রুমালটি বার করলেন। সেটি ভিজিয়ে লিলির কপালে রাখলেন, রজত ফিরলে নিজের হাতে লিলির মাথা ধুইয়ে দেবেন তিনি। সেই জলে পৃথিবীর সব জ্বর ধুয়ে যাবে।
