সুস্মিতা নাথ
ট্রেনে উঠে স্বস্তির শ্বাস ফেলল বিদিশা। ভেবেছিল ট্রেনটা বোধ হয় মিসই হয়ে গেল। উত্তম বলল, “নাও, এবার শান্তি তো? ওহ! এত টেনশন করো না তুমি!”
“কী ভয়ানক জ্যামে আটকেছিলাম বলো? ভাগ্যিস সরু গলিটায় গাড়িটা ঢুকিয়েছিল বাদল। নইলে আর দেখতে হতো না।”
“সে ঠিকই। আজকের জ্যামটা অস্বাভাবিক ছিল।” ঢাউস ট্রলিটাকে সিটের নীচে রাখতে রাখতে উত্তম বলল, “কিন্তু তুমি একটু বেশিই টেনশন করো, বিদিশা। এমন ছটফটানি শুরু করলে যে…!”
“তা করব না? স্টেশনের কাছাকাছি এসে এভাবে আটকে গেছি, এদিকে ঘড়ির কাঁটা লাফিয়ে এগোচ্ছে! নাকের উপর দিয়ে ট্রেনটা বেরিয়ে গেলে কী হত?”
“কী আবার হত? না-হয় দু’দিন পরে যেতে। তৎকাল টিকিটের ব্যবস্থা তো করাই যেত। তাই বলে এমন উত্তেজিত হয়ে লাভ আছে?”
বিদিশা এবারে নীরব থাকে। হ্যান্ডব্যাগটা কোলের উপরে রেখে জানলার কাছে ঘেঁষে বসল সে। ট্রলিটাকে সিটের নীচে রেখে উঠে দাঁড়িয়েছে উত্তম। বিদিশা বলল, “এবার তুমি নেমে যাও।”
রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে উত্তম বলল, “আহ যাচ্ছি। ব্যস্ত হবে না তো।”
“আরে ট্রেন ছেড়ে দেবে যে।”
উত্তম কবজি উল্টিয়ে ঘড়ির দিকে তাকাল, “এখনও তিন মিনিট দেরি আছে।”
“তবু নেমে যাও। ট্রেন ছেড়ে দিলে হুড়োহুড়ি করে নামা রিস্কি।”
“ও-হোওও!” বিরক্ত হয় উত্তম, “এই তো আবার শুরু করছ। তিন মিনিট অনেকটা সময়। নিশ্চিন্তে নামা যাবে।”
“তো এখনই আগেই নেমে যাও। আমার ভয় করে।”
“আচ্ছা বাবা যাচ্ছি। তবে যা বললাম, কোনও ব্যাপারে ফালতু টেনশন করবে না। কিছু অসুবিধা হলে ফোন করবে। আর ফুল তো স্টেশনে থাকবেই।”
ঘাড় কাঁত করে উত্তমকে নিশ্চিত করে বিদিশা। উত্তম যাওয়ার জন্যে রওনা হয়। বিদিশা ওর হাতটা আলগোছে ধরে বলে, “মনে করে সুগার ও প্রেসারের ওষুধগুলো খেয়ো কিন্তু। আর একদম অনিয়ম করবে না।”
মাথা ঝাঁকাল উত্তম। বলল, “সে ঠিক আছে। তুমি সাবধানে থেকো।”
তখনই ট্রেনের হুইসেল শোনা গেল। দ্রুত দরজার দিকে এগোল উত্তম। পেছন পেছন এগিয়ে গেল বিদিশাও। উত্তমকে নির্বিঘ্নে নামতে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে তবেই নিজের সিটে ফিরল।
ট্রেন ছাড়ারও একটুক্ষণ পরে একজন মাঝ বয়সী ভদ্রলোক এসে বিদিশার পাশে বসল। সঙ্গী এক ছেলে তাঁর ব্যাগপ্যাকটা উপরে তুলে রাখল। সম্ভবত উপরের বার্থটা তাঁরই। উলটো দিকের সিটে এতক্ষণ এক যুবক বসেছিল। বোঝা যাচ্ছে তারও ওটার উপরের বার্থ। তাই এখনই ওখানে উঠে গেছে। গুছিয়ে বসে ল্যাপটপ খুলছে সে। নীচের বার্থে এখনও কেউ আসেনি। এটা তো আসলে উত্তমেরই ছিল। পাশাপাশি নীচের দু’টো বার্থ বুক করেছিল উত্তম। সময়মতো অনলাইনে টিকিট করার এই এক সুবিধে। পছন্দমতো জায়গা বেছে নেওয়া যায়। সে জন্যে দু’জনেরই নীচের বার্থ হয়েছিল। এক সঙ্গেই যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মূহূর্তে কীসের একটা উটকো কাজে ফেঁসে টিকিট ক্যান্সেল করতে হল উত্তমকে। অগত্যা বিদিশার একা যাওয়া।
প্লাটফর্ম পেরিয়ে গেছে ট্রেনটা। বিদিশা চটি খুলে পা তুলে বসল। ব্যাগের থেকে মোবাইল ফোন বের করে শুরুতেই একটা মেসেজ করল মেয়েকে। তারপর উত্তমকে রিং করল, “গাড়িতে বসে গেছো?”
“হ্যাঁ, বাড়ি রওনা হয়ে গেছি।”
“বাড়ি ফিরে ঠিক মতো খেয়ে নিও কিন্তু। সন্ধ্যাকে বলে এসেছি চালকুমড়োর বড়াগুলো গরম গরম ভেজে দিতে।”
“আচ্ছা, সে হবে। তুমি এত ভেবো না তো। আর… তোমাদের জলটল দিয়েছে?”
“এখনও দেয়নি। তোমার বার্থটা এখনও ফাঁকা, জানো?”
“তাই নাকি? তবে বেশিক্ষণ থাকবে না। আর. এ. সি-তে প্রচুর লোক থাকে। তারা কেউ এসে পড়বে।”
“কে জানে! এমনিও কম্পার্টমেন্টটা বেশ খালি। তোমার মতো হয়তো অনেকেই টিকিট করেও যাচ্ছে না।”
“তেমন কেস তো দু’-চারটে সব সময়ই থাকে। …তবে এই ট্রেনে প্রচুর রাশ। কাজেই একটা সিটও খালি যাবে না, দেখো। হয়তো পরের স্টেশনগুলোর কোটাও কিছু থাকবে।
“ইশ! তাই যেন হয়।”
“কেন, ভয় পাচ্ছ নাকি?”
“ভয় না, কিন্তু এমন ফাঁকা ফাঁকা গাড়িতে যেতে ভালো লাগে?”
হাসল উত্তম। বলল, “এই মুশকিল। ভিড় হলেও জ্বালা, ফাঁকা থাকলেও জ্বালা!”
কথায় কথায় কামাখ্যা স্টেশন পেরিয়ে গেল ট্রেন। পুরু বাদামি কাচের এপার থেকে বাইরের প্রকৃতির দিকে চোখ ফেরাল বিদিশা। সবে সকাল। এর মধ্যেই এপ্রিলের রোদ অনমনীয়। তবে দিল্লীর অবস্থা নাকি আরও খারাপ। গরমে হাঁসফাঁস করছে লোকে। মেয়ে তাই বলে দিয়েছে হালকা সুতির পোশাক বেশি করে আনতে। আর শাড়ি একেবারেই নয়। যদিও মেয়ের কথা অমান্য করেই গোটা চারেক শাড়ি সঙ্গে নিয়েছে বিদিশা। বলা তো যায় না, কোথায় কখন দরকার পড়ে।
শহর ছাড়িয়ে এখন অনুচ্চ টিলা ও ঝোপ জঙ্গলের মাঝ দিয়ে ছুটছে ট্রেন। একদম মসৃণ চলন। একটুও ঝাঁকুনি টের পাওয়া যাচ্ছে না। সেই যে ছোটবেলায় ট্রেন বলতেই ‘কু-উউ-ঝিকঝিক’ একটা ব্যাপার ছিল, ভেতর-বাইরে ঝাঁকুনি তুলে দুলকিচালে ট্রেনগুলো চলত, সেটা এখনকার ট্রেনজার্নিতে বিশেষ বোঝা যায় না। এ-সি কম্পার্টমেন্টগুলোতে উঠলে তো আরও নয়। সেগুলো শব্দ নিরোধকই শুধু নয়, কম্পন নিরোধকও বটে।
ছোটবেলার কথা মনে পড়তেই মায়ের সঙ্গে ট্রেনে চেপে মামারবাড়ি যাওয়ার কথা মনে পড়ে বিদিশার। তখন একমাত্র এ উপলক্ষেই ট্রেনে চড়া হত। তাও আবার মিটার গেজ। কারণ ছোট্ট ঐ মফঃস্বল শহরে একটাই মাত্র ট্রেন থামত। প্রায় প্রতি স্টেশনে বিরতি দিতে দিতে এগোত। ট্রেনে যে কতক্ষণে গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছবে, এর কোনও ঠিক ঠিকানা থাকত না। তবু তখন কোনও বিরক্তিই আসত না। মামার বাড়ি যাওয়ার আনন্দ আর ট্রেনে চড়ার আনন্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। বিদিশার মনে হয়, ছোটবেলার সেই সময়টুকুই জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়। এমন চিন্তাহীন, ভাবনাহীন, ভয়হীন সময় জীবনে দ্বিতীয়বার ফিরে আসে না।
এখনের কথাই ধরা যাক। এই যে আজকে যাবে বলে গত কয়েক দিন থেকে যে টেনশন চলছে, সেই সঙ্গে চলেছে প্রস্তুতিও, এসবের ঝামেলা কি ছোটবেলায় ছিল? কী কী সঙ্গে নেবে, কী নেবে না ইত্যাদির ভাবনা, গোছগাছের ঝক্কি, নিজের জিনিস তো বটেই উত্তমের জামাকাপড়ও গুছিয়ে আসা, আরও কত কী। কাজের কি শেষ আছে? ভাবনারও শেষ নেই। তারমধ্যে আবার মেয়ের একগুচ্ছ বায়নাও রয়েছে। দু’-তিন দিন বেরিয়ে সে সবও কেনাকাটা করতে হয়েছে। এর ফাঁকেই মেয়ের পছন্দের নারকেলের তক্তি, শুকনো কচুরি তৈরি করা, বাজার থেকে অসমীয়া তিলপিঠে কিনে নেওয়া, এগুলোও রয়েছে। অর্থাৎ গাড়িতে ওঠার আগে পর্যন্ত একটুও বিশ্রাম পায়নি।
উপরন্তু জুড়েছে উটকো এক টেনশনও। এতটা দূর যে একা জার্নি করতে হবে, সেটা কে ভেবেছিল? এমন একা একা চলাফেরায় তো অভ্যস্ত নয় সে। যখন যেখানে যাওয়ার উত্তমের সঙ্গেই গিয়েছে। শুধু নিজের জন্যে কোথাও কখনও যাওয়ার প্রয়োজনই হয়নি। এবারও ব্যতিক্রম হত না। শুধু অফিসের ঝামেলাটা আচমকা চলে এল বলেই শেষ মুহূর্তে নিজের টিকিট ক্যান্সেল করতে বাধ্য হয়েছে উত্তম।
প্যান্ট্রি কার থেকে একজন এসে জলের বোতল দিয়ে গেল। আরও একজন লাঞ্চে কী নেবে জেনে গেল। বিদিশা নিরামিষই বলল। আমিষের প্রতি বিরাগ না-থাকলেও ট্রেনের খাবারের বেলায় আমিষে বিশেষ ভরসা হয় না ওর। সুতরাং নিরামিষ।
শনশন করে পূর্ণ গতি তুলে ছুটছে ট্রেন। সেই সঙ্গে ছুটছে সময়ও। সুপারফার্স্ট এই ট্রেনটার সুবিধে হল, এর স্টপেজ খুব কম। তাই অন্য ট্রেনের চেয়ে অনেক কম সময়ে পোঁছে দেবে দিল্লী। চোখের পলকে ছোট ছোট ক’টা স্টেশন পেরিয়ে গেল। বাইরের চলমান দৃশ্যাবলির দিকে তাকিয়ে এলোমেলো নানা ভাবনায় ডুবে যেতে থাকে বিদিশা। মেয়ের চাকরি হওয়ার পরে এ নিয়ে দ্বিতীয়বার দিল্লী যাচ্ছে। তবে ট্রেনে এই প্রথম। ওর যেহেতু প্লেনে চড়তে ভয়, তাই পারতপক্ষে প্লেন এড়িয়েই চলে। একান্তই দায়ে না-পড়লে দূরের জার্নিতেও ট্রেন জিন্দাবাদ। বাধ্য হয়ে উত্তমকেও ওর সঙ্গে ট্রেনেই বেশি যাতায়াত করতে হয়। কিন্তু কে জানত এত দীর্ঘ জার্নি শেষ পর্যন্ত একাই করতে হবে!
পরমের খাঁড়া নাকটা দু’হাতে ধরে ঈষৎ নাড়িয়ে দিয়ে তিথি বলল, “মশাই, আজই যা ফুর্তি করার করে নাও। এরপর এভাবে আর দেখা করা যাবে না, বুঝলে?”
“তবে আমি বাঁচব কী করে?”
“উহ্! যেন আমার জন্যে ইনি মরে যাচ্ছেন!” বলেই খিল খিল করে হেসে ওঠে তিথি।
পরম মুখটা তিথির মুখের কাছে আরও নামিয়ে এনে বলে, “সত্যি মরে যাব।”
ছাঁচে গড়া নিখুদ মুখের গড়ন পরমের। টানা উজ্জ্বল দু’টি চোখ। কিন্তু সেই চোখে এখন কামের লেশমাত্র দেখল না তিথি। তার বদলে অদ্ভুত এক আর্তি। তিথি অস্ফুটে বলল, “এত ভালোবাসো?”
“বাসি তো। খুব ভালোবাসি।”
পরমকে জড়িয়ে ধরে আরও কাছে টেনে নেয় তিথি। তারপর আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে থাকে। পরম আকুল স্বরে বলে, “দেখাও করা যাবে না?”
“হ্যাঁ, সে তো যাবে। কিন্তু এই এখনের মতো হবে না, …”
“কই বাত নেহি, তোমাকে শুধু মন ভরে একবার দেখে নিলেই আমি পুরো সপ্তাহের জন্যে রিচার্জড হয়ে যাব।”
“গ্র্যান্টেড। পাগল কোথাকার।” পরমের কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল তিথি।
তিথির ওয়ান বেড রুম ফ্ল্যাটের ছিমছাম বেডরুমে শুয়ে আছে দু’জন। আজ রবিবার। পরম আজ সারাদিন এখানেই কাটাবে। হয়তো বিকেলের দিকে কোথাও বেড়াতে যাবে। ঘোরাঘুরি করে রাতের খাওয়া সেরে আবার ফিরবে এখানেই। সোমবার সকালে দুজনেই স্নান খাওয়া সেরে একসঙ্গে বেরিয়ে পড়বে। দু’জনের দুই গন্তব্যে। আবার পরের সপ্তাহে আসবে পরম। এভাবেই চলে আসছে অন্তত বছর খানেক হল।
দিল্লীর দুই প্রান্তে দু’জনের বাস। ফলে ইচ্ছে করলেই রোজ রোজ দেখা করা সম্ভব হয় না। পরম যদিও-বা কাজ শেষে বিকেলের দিকে হালকা হতে পারে, কিন্তু তিথির এমন চাকরি যে, তার কোনও সময়ের ঠিক-ঠিকানা নেই। তা ছাড়া একবার অফিসে ঢুকে গেলে অন্য কিছু ভাবারও সময় পাওয়া যায় না। চোখ ধাঁধানো পে-প্যাকেজ দেয় ঠিকই, কিন্তু বিনিময়ে সেটা উশলও করে নেয় কোম্পানি।
এক বহুজাতিক সংস্থায় কাজ করে তিথি। এম-বি-এ পড়তে পড়তেই চাকরিটা হয়ে যায়। আড়াই বছর হতে চলল চাকরির বয়স। এর মধ্যে একটা বাইরের চাকরির সুযোগও এসেছিল। দুবাইতে। প্যাকেজ প্রায় তিনগুন বেশি ছিল। কিন্তু তিথি যায়নি। এর মূল কারণ পরম। পরমকে ছেড়ে থাকার কথা এখন ভাবতেই পারে না তিথি।
যদিও পরমের সঙ্গে সম্পর্কটা সে হিসেবে খুবই নতুন। অন্তত রাতুলের সঙ্গে দীর্ঘ সাত বছরের সম্পর্কের চেয়ে তো বটেই। ফেসবুকের বন্ধু ছিল পরম। মেসেঞ্জারে টুকটাক আলাপ হয়েছিল। সে খুব নগন্যই। কিন্তু এক দিন আকস্মিক ভাবেই ওদের দেখা হয়ে গেল এক শপিং মলে। পরমই ঠিক চিনে এগিয়ে এসেছিল। লাঞ্চ আওয়ারে একগুচ্ছ অফিস কলিগের সঙ্গে মলে এসেছিল তিথি। তাদের সামনেই পরমের সঙ্গে প্রথম মুখোমুখি আলাপ। এরপর কাহিনি জমে ক্ষীর হতে সময় লাগেনি।
প্রায় ছ’ফুট লম্বা সুপুরুষ পরমের মধ্যে যে এক্স ফ্যাক্টরটা আছে, সেটা কোনও মেয়েই এড়িয়ে যেতে পারে না। কিন্তু তিথিকে সবচেয়ে বেশি টেনেছিল ওর কাজলকালো চোখ জোড়া। কোনও ছেলের প্রসাধনহীন চোখ যে এত সুন্দর হতে পারে, পরমকে না-দেখলে হয়তো জানাই হত না তিথির। সব সময়ই যেন এক অসীম আকুতি ফুটে থাকে ওগুলোতে। একই সঙ্গে কী নমনীয়, আর কী গভীর! ধীরে ধীরে তিথি আবিষ্কার করেছে ভেতর থেকেও পরম সেরকমই গভীর ও অনুভূতিপ্রবণ এক মানুষ। যে সবটুকু দিয়ে ভালোবাসতে জানে।
পরমের সঙ্গে ওর সম্পর্কের কথা বাড়িতে জানাতে দেরি করেনি। এই ব্যাপারে মা ও বাবার যে প্রতিক্রিয়া পেয়েছিল, সেটা ওর অনুমানের বাইরেই ছিল। চিরকাল রক্ষণশীল স্বভাবের মা একটুও সময় না-নিয়ে বলেছিল, “তুই যদি ওকে নিয়ে সুখে থাকিস তা হলে আমার একটুও আপত্তি নেই। রাতুলের ব্যাপারেও তো আমাদের আপত্তি ছিল না।”
কিন্তু যার থেকে আশা করেনি, বিরোধটা এসেছিল সেই বাবার থেকেই। বাবা সব শুনে একদম চুপ করে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, সপ্তাহ খানেকের মধ্যে একেবারে দিল্লী চলে এসেছিল ওকে বোঝাতে। বলেছিল, “তুমি আরও অনেক বেটার ম্যাচ ডিজার্ভ করো, ফুল। আরও প্রতিষ্ঠিত কোনও ছেলে, অন্তত যে তোমার থেকে অনেক বেশি উপার্জন করে বা করতে সক্ষম, তেমন কেউ। এই ছেলেটির মধ্যে তেমন সম্ভাবনা কিন্তু দেখছি না।”
“আমি ওকে ভালোবাসি, পাপা। আর ভালোবাসার সঙ্গে উপার্জনের কী সম্পর্ক?” বলেছিল তিথি।
“সম্পর্ক আছে। এবং সেটা খুব গভীর। এ দেশের দাম্পত্য জীবন এবং মেল ইগো দু’টোই পুরুষ সঙ্গীটির উপার্জনের উপরে ভীষণভাবে নির্ভর করে। স্বামীর উপার্জনের উপর ভিত্তি করে স্ত্রীর অহংকার ওঠানামা করে। কিন্তু স্বামীর ক্ষেত্রে বিষয়টা ঠিক উলটো। অর্থাৎ নিজের থেকে স্ত্রী বেশি উপার্জন করে, এটা কোনও পুরুষই মনের থেকে মেনে নিতে পারে না। কাজেই এখন সাময়িক ভালো লাগার বশে হয়তো মনে করছ যে, এ ছেলেই তোমার আদর্শ সঙ্গী। কিন্তু জীবন অনেক জটিল, ফুল। এই তুমিই যখন সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে আরও অনেক উঁচুতে উঠবে, তখন হয়তো এই ছেলেকে তোমার নিজেরই যোগ্য মনে হবে না। কিংবা যে ছেলে এখন তোমার জন্যে সব উজাড় করে দিতে প্রস্তুত, সেই হয়তো তোমার সাফল্যে ঈর্ষাকাতর হয়ে তোমার জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে। তা ছাড়া…” এটুকু বলেই থেমে গিয়েছিল ওর বাবা।
তিথি জিজ্ঞেস করেছিল, “তা ছাড়া কী?”
“তা ছাড়া…” মুচকি হেসে বাবা বলেছিল, “তোমার উপার্জনহীন বেকার মায়ের যদি আমার মতো একজন সুচাকুরে পাত্র জুটে যায়, তবে তুমি কি আরও অনেক বেশি ডিজার্ভ করো না? …ভেবে দেখো। এ ব্যাপারে চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তোমার আরও একবার ভেবে দেখা উচিত।”
“মা কিন্তু ইচ্ছে করলেই কোনও চাকরি করতে পারত। হয়তো ভালো চাকরিই পেত। গ্র্যাজুয়েশনে তো মা বেশ ভালো রেজাল্ট করেছিল। কিন্তু তুমি নাকি ঘরোয়া মেয়েই চেয়েছিলে…।”
“সে তোমার মা কী পারত না-পারত সেটা কথা নয়। কিন্তু তুমি তো রীতিমতো স্বাবলম্বী। উপার্জনশীল এবং অনেক বেশি যোগ্য। কাজেই তোমার যে কোনও সিদ্ধান্ত অনেক বেশি ভেবেচিন্তে নেওয়া উচিত।”
বাবার সঙ্গে আর তর্ক করেনি তিথি। তবে তাঁর কথা সে মানতেও পারেনি। কেন কে জানে, এই বাবাকে ওর বড় অচেনা ঠেকছিল। তাই প্রসঙ্গ এড়াতে আলগোছে শুধু বলেছিল, “ঠিক আছে, ভেবে দেখব, পাপা।”
কিন্তু নতুন করে যে ভেবে দেখেনি, সে তো বলাই বাহুল্য। ছেলেদের চেনার জন্যে মেয়েদের এক ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজ করে। সেই বাড়তি ইন্দ্রিয়টাই ওকে আশ্বস্ত করেছিল যে পরমের উপরে আস্থা রাখা যায়।
আর এতে যে বাবা বেশ অখুশি, সেটা বেশ বোঝে তিথি।
ট্রেনের দুলুনিতে ক্ষণিকের জন্যে তন্দ্রামতো এসে গিয়েছিল বিদিশার। ট্রেন থামতেই সেটা কেটে গেল। তাকিয়ে দেখে একেবারে ছোট্ট একটা স্টেশনে থেমেছে ট্রেন। এটা কোন স্টেশন? জানলা দিয়ে স্টেশনের নাম দেখার চেষ্টা করে ও। কিন্তু নাহ, দেখা যাচ্ছে না। যেমন ছোট স্টেশন, তেমনই নির্জন। লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে। অবাক লাগল বিদিশার। এত ছোট স্টেশনে তো এই ট্রেনের থামার কথা নয়।
জিজ্ঞেস করার মতোও কাউকে দেখল না। পাশের সহযাত্রীর দিকে তাকাল বিদিশা। ভদ্রলোক বসে বসেই ঘুমোচ্ছেন। মুখ সামান্য হাঁ হয়ে আছে। ঠিক যেমন ঘুমন্ত উত্তমের থাকে। দেখে মনে মনে হাসি পেল ওর। চোখ সরিয়ে মুখোমুখি উপরের বাঙ্কে তাকাল। ছেলেটি কানে ইয়ারফোন গুঁজে এখনও মগ্ন হয়ে আছে ল্যাপটপের স্ক্রিনে। সাইডের বার্থে বসেছে পাহাড়ি চেহারার দুই যুবক যুবতী। তারাও কেউ ফোনে চোখ রেখে তো কেউ গান শুনতে মশগুল। ট্রেনটা যে থেমেছে, তাতে কারোরই যেন ভ্রুক্ষেপ নেই।
বিদিশা আবার বাইরে তাকাল। গাছগাছালিতে ঘেরা স্টেশন চত্বর দেখেই ওর মন ভরে গেল। কী অদ্ভুত মায়াময় জায়গা! কী অপার শান্তি চারপাশে! চারদিক সবুজে ভরা। রেল লাইনের ওপাশে একটা সরু মেঠো পথ বাঁশবনের মাঝ দিয়ে কোথায় যেন চলে গেছে। ছায়াঘেরা সেই পথে আলপনা আঁকছে বাঁশ গাছের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে আসা ঝিরিঝিরি রোদ। আলো ও ছায়ার জাফরি-কাটা এমন আলপনা, এমন কাব্যিক মেলবন্ধন বড় একটা দেখা যায় না। যেন এ পৃথিবীর বাইরের কোনও দৃশ্যপট। বিদিশার মনে হয়, ইশ! যদি ঐ আঁকাবাঁকা পথটায় একটু হেঁটে আসা যেত!
তেমনই ছিমছাম মায়াময় এই প্লাটফর্ম। ঝকঝকে পরিস্কারই শুধু নয়, রীতিমতো সাজানো গোছানো। টবে টবে গাছগুলোই এর প্রমাণ। প্লাটফর্ম শেষের খোলা জায়গাটায় ঝাঁকরা ডালপালা ছড়িয়ে দিয়েছে এক কৃষ্ণচূড়া গাছ। ফুলে ফুলে রাঙ্গানো গাছটাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন টকটকে লাল ওড়না মাথায় জড়িয়েছে। নীচেও ইতিউতি ছড়িয়ে আছে লালের সম্ভার। গাছের গোড়া সিমেন্টের চাতাল দিয়ে বাঁধানো। ওটাও রঙিন হয়ে আছে ঝরা ফুলের প্রাচুর্যে। বিদিশার খুব ইচ্ছে করছে, ট্রেন থেকে নেমে ওই ছায়াশীতল চাতালটায় গিয়ে একটু বসে।
দু’-চার জন যাত্রী নেমেও গিয়েছে। তারা ইতস্তত ঘোরাঘুরি করছে। কেউ-বা অলস ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। খুব দূরে কেউ যাচ্ছে না। ট্রেনের হুইসেল বাজলেই যাতে ছুটে আসতে পারে, এমন নিরাপদ দূরত্বেই আছে সবাই। গাছটাও নাগালের মধ্যেই। ইচ্ছে করলেই গিয়ে ঐ চাতালে বসা যায়। আবার ট্রেন ছাড়ার ইঙ্গিত পেলে ফিরেও আসা যাবে। তবু বিদিশার সাহস হচ্ছে না। ইচ্ছেটাকে চেপে দিচ্ছে একটা ভয়। যদি আচমকা ট্রেন ছেড়ে দেয়, আর যদি ছুটে এসে উঠতে না-পারে, তবে? তবে কী হবে? পুরো প্রোগ্রাম তছনছ হয়ে যাবে! ভাবতেই গায়ে কাঁপুনি দিল ওর। ভেতর থেকে অসহ্য একটা অস্থিরতা ওকে চেপে ধরল যেন।
কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে শান্ত করে বিদিশা। মনে মনে ভাবার চেষ্টা করে, সত্যি যদি প্লাটফর্মে নেমে যায়, এবং তার পর আর ট্রেনে উঠতে না-পারে, তা হলে কী কী হতে পারে। এমন হলে প্রথমে নিশ্চয়ই ফোন করে মেয়েকে এবং উত্তমকে জানাবে। ওরা দু’জনেই অবধারিতভাবে খুব রেগে যাবে। বেজায় বকাঝকাও হয়তো করবে। এর পর উত্তম যে করে হোক এখান থেকে ওকে বাড়ি ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করবে। হয়তো মেয়ের কাছে এ যাত্রায় আর যাওয়া হবে না। কিন্তু এর চেয়ে বেশি তো মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। আর হ্যাঁ, ওর জিনিসপত্র ভরা লাগেজ চলে যাবে নিরুদ্দেশের উদ্দেশে। সেটা হয়তো হারিয়েই যাবে। আর পাওয়া যাবে না। কিন্তু ওতেও তো কাপড়চোপড় ছাড়া এমন অমূল্য কিছু নেই, যা ছাড়া জীবন অচল। যদিও এতগুলো জিনিস হারালে খারাপ লাগবেই। কিন্তু এর বেশি আর কিছু তো নয়। খুব বড় কোনও ক্ষতি তো তাতে হবে না। তা হলে এত কীসের ভয় ওর?
ট্রেন এখনও থেমেই আছে। নড়ার নামগন্ধ নেই। এখন পাশের ভদ্রলোকের ঘুম কেটে গেছে। উপরের ছেলেটিও ল্যাপি বন্ধ করে নীচে নেমে এসেছে। একবার দরজার সামনে থেকে ঘুরেও এল সে। ট্রেন কেন থেমে আছে, সে খবর সেও বলতে পারল না। বিদিশা লক্ষ করল, সব যাত্রীদের মধ্যেই বিরক্তি জমা বাঁধছে। উশখুশ করছে প্রায় সকলেই। পাশের ভদ্রলোক ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই বলে উঠলেন, “এখানেই দেখি লেট করে দিচ্ছে।”
কিন্তু আশ্চর্যের হলেও বিদিশার তেমন কোনও হেলদোল হচ্ছে না। ওর বরং বাইরের প্লাটফর্ম আর তার চারপাশে তাকিয়ে থাকতে বেশ ভালোই লাগছিল। চোখ ও মন দু’টোকেই আরাম দেওয়া দৃশ্যপট। এমন সময় কোচ অ্যাটেন্ডেন্ট ছেলেটি কোনও বার্থে বেডরোল দিতে এল। ওকেই ছেঁকে ধরল সবাই। যেন ট্রেনের সমস্ত হালহকিকত জানার দায় তারই। কেন যেখানে থামার নয় সেখানে থামল ট্রেন, আর থামলও যদি এতক্ষণ ধরে থেমে আছে কেন, কখন ছাড়বে, এমন লেট করার মানে কী, সুপারফাস্ট ট্রেনের এমন হাল হলে কী করে হয়, ইত্যাদি একশ গণ্ডা প্রশ্ন ভেসে এল। এসবের উত্তরে ছেলেটি মাত্র দু’টি শব্দ উচ্চারণ করল, ‘ক্রসিং আছে।’
এটুকুই যথেষ্ট ছিল। অন্য সহযাত্রীদের মতো বিদিশাও বুঝে গেল, উলটো দিক থেকে কোনও ট্রেন আসছে, যেটা না-যাওয়া পর্যন্ত এই ট্রেনকে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। এর কারণও ওর জানা। উত্তমই কখনও বলেছিল। এ অঞ্চলে মূলত একটাই বিজি ট্র্যাক। ফলে একাধিক ট্রেনের বা একই সঙ্গে উভয় দিক থেকেই ট্রেন এলে তখন যেকোনও একটিকে কাছের কোনও স্টেশন, যেখানে একাধিক ট্র্যাক থাকে, সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে অন্যটিকে পার হয়ে যেতে দিতে হয়। সুতরাং অন্য ট্রেনটির না-আসা পর্যন্ত এ ট্রেনেরও নড়ার সম্ভাবনা নেই।
বাইরে তাকিয়ে আবার সেই ইচ্ছেটাকে ফিরিয়ে আনল বিদিশা। ঐ অচেনা মেঠো পথে হাঁটার ইচ্ছে, কিংবা গাছের নীচে বসার ইচ্ছেটাকে। কী হয় যদি এখানেই দু’টো দিন থেকে যাওয়া যায়? থাকলে কোনও মহাভারত অশুদ্ধ হবে কি? হলই-বা একদম অজানা অচেনা জনপদ, খোঁজ করলে নিশ্চয়ই থাকার মতো একটা জায়গাও জুটে যাবে। তারপর দু’টো দিন নির্ভেজাল শান্তিতে সব রকম ভাবনা চিন্তা ও টেনশন মুক্ত হয়ে থাকা কি যায় না? মনের আরাম হয় এমন নির্মল শান্তির জায়গার যে বড় অভাব এখন।
কিন্তু বিদিশা ভালো করেই জানে, বাস্তবে তা সম্ভব নয়। জীবন এখন খুঁটিতে বেঁধে রাখা গবাদি পশুর মতো হয়ে গেছে। সংসার নামের এই খুঁটি ছেড়ে নড়াচড়ার উপায় নেই। একা চলতে, একা সিদ্ধান্ত নিতে, এমনকি নিজের ইচ্ছের কথা প্রকাশ করতেও সে অক্ষম। ওর সুখ দুঃখ হাসি কান্না সব কিছুই স্বামী সন্তান এবং সংসারকে ঘিরে। আক্ষরিক অর্থেই ও পরজীবী লতানো গাছের মতো হয়ে উঠেছে। অথচ এমন তো সবসময় ছিল না! মনে পড়ে, ক্লাস নাইনে পড়ার সময় ইস্কুলের জেনারেল সেক্রেটারি হয়েছিল সে। কলেজ বা পাড়ার বন্ধু মহলকে রীতিমতো নেতৃত্ব দিত সে-ই। যে কোনও জমায়েতে ওর মতামতের একটা গুরুত্ব থাকত। অথচ সে মেয়েই যে কবে থেকে এমন জবুথবু আর পরনির্ভরশীল হয়ে উঠল, বিদিশা নিজেই বুঝতে পারেনি।
এলোমেলো নানা ভাবনায় ডুবে গিয়েছিল বিদিশা। আচমকা জানলায় ছায়া ফেলে কিছু ছুটে যাওয়ার অনুভূতিতে ঘোর কাটে ওর। উল্টোদিক থেকে একটা ট্রেন রীতিমতো ঝড়ের বেগে চলে যাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সেটা চোখের আড়াল হয়ে গেল। নড়েচড়ে বসল বিদিশা। এ বার তা হলে ওদের ট্রেনও ছাড়বে। খেয়াল করল, এতক্ষণ যে ক’জন প্লাটফর্মে নেমে ঘোরাঘুরি করছিল, তারা আর কেউ নেই সেখানে। অর্থাৎ ট্রেনে ফিরে এসেছে। ইশ! সেও কি তেমনই পারত না? নিশ্চয়ই পারত। একটুক্ষণ মনের সাধ মিটিয়ে স্টেশন চত্বরটা ঘুরে দেখে আবার অনায়াসে ফিরে আসতে পারত। জড় কিংবা অথর্ব তো সে নয়। হাবাগোবা বুদ্ধিহীনও নয়। তা হলে? কেন গেল না ভেবে ক্ষোভ হয় বিদিশার। নিজের উপরে অদ্ভুত এক বিরক্তিও জন্মায়।
সামান্য ঝাঁকুনি দিয়ে নড়ে উঠল ট্রেন। খুব ধীরে যাত্রা শুরু করল আবার। জানলা দিয়ে উদাস চোখে তাকিয়ে পলকের স্বর্গটাকে মিলিয়ে যেতে দেখে বিদিশা।
ওর মনে হয়, এমন এক বা একাধিক স্টেশন হয়তো সবার জীবনেই আসে। এগুলো আসলে ছোট ছোট সুখের ঠিকানা। কিংবা দিকশূন্যপুরে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ। আচম্বিতে, আগাম কোনও ইঙ্গিত না দিয়েই হাজির হয়। আর সেখানে ট্রেনও থেমে যায়। প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিয়ে বলে, ‘নেমে যাও। এই তো তোমার আরাধ্য ঠিকানা।”
যারা নামতে পারে, তারা নতুন করে বাঁচে। আর যারা পারে না, তারা হেরে যায়। গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যাওয়াই তাদের নিয়তি। সে নিজেও তাই এক হেরো।
লাঞ্চের অর্ডার নিয়ে গেল। বারোটার মধ্যেই সার্ভ করে দেবে বলল। এত তাড়াতাড়ি বিদিশার খাওয়ার অভ্যেস নেই। তবে উত্তম সকাল দশটার মধ্যেই লাঞ্চ সেরে নেয়। একদম অফিস টাইম মেনে। এটাকে উত্তম বলে ব্রাঞ্চ। অর্থাৎ ব্রেকফাস্ট ও লাঞ্চ-দুইয়ের মিশ্রণ। সময়ের ব্যাপারে উত্তম অত্যন্ত নিয়মনিষ্ঠ।
ব্যাগ থেকে ফোন বের করল বিদিশা। উত্তম খেলো কিনা জিজ্ঞেস করবে। সন্ধ্যা ঠিক মতো গুছিয়ে দিতে পারছে কিনা, সেটাও জানা দরকার। এমনিতে রান্নাটা সন্ধ্যা করলেও উত্তমকে নিজের হাতেই খাবার বেড়ে দেয় বিদিশা। এর কখনও অন্যথা হয় না। তা ছাড়া খাবারের ব্যাপারে উত্তম বরাবরই বেশ খুঁতখুঁতে স্বভাবের। খুব মেপে খায়। কতটা শাকসবজি, কতটা প্রোটিন বা মিনারেলের অনুপাতে কতখানি কার্বোহাইড্রেড উত্তম খায়, কিংবা কোন খাবার হাতে গরম আর কোনটা ঈষৎ উষ্ণ অবস্থায় খেতে পছন্দ করে, এ সবের হিসেব বিদিশা যে ভাবে বোঝে সে কি কাজের লোকের দ্বারা সম্ভব? এই একটা জায়গায় বিদিশা নিজেও কাউকে ঘেঁসতে দেয় না। কিন্তু এখন নিরুপায় হয়েই সন্ধ্যাকে সব বুঝিয়ে আসতে হয়েছে। ও দিল্লী থেকে না-ফেরা পর্যন্ত ক’টাদিন সন্ধ্যাই ওর গৃহস্থালি চালাবে।
ট্রেন এসে এক স্টেশনে ঢুকছে। হলুদ বোর্ডে কালো কালিতে ‘নিউ বঙ্গাইগাঁও’ নামটা দেখেই মনের ভেতরে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা টের পেল বিদিশা। ট্রেন যেন স্টেশনে নয়, ওকে এক লহমায় নিয়ে গেল অতীতের কোনও সময়কালে। সে কোন সুদূর অতীত। যেন গত জন্মের কথা। বাবা বদলি হয়ে এল বঙ্গাইগাওতে। এক প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি বাবার। নতুন পাড়ায় এক বাড়িতে ভাড়া উঠল ওরা। সে বাড়িতে সাকুল্যে দুটো থাকার ঘর। যার বাড়ি তিনি একটা ঘরে থাকেন, অন্যটায় মা ও ভাই সহ ওরা চারজন।
বাড়িটার থেকে কলেজটা ছিল হাঁটা পথেই। এ কলেজেই পলিটিকাল সাইন্সে মেজোর নিয়ে ভর্তি হয়েছিল বিদিশা। ভাই ভর্তি হয়েছিল রেলের ইশকুলে। উঠোন থাকা ছোট একটা বাড়ি। তারও মাত্র একটি ঘরে ওদের থাকা। তবে সে ঘরটা যথেষ্ট বড় হওয়ায় বিশেষ অসুবিধা হত না। তবু প্রথম প্রথম বিলাসীপাড়ায় ছেড়ে আসা ওদের খোলামেলা বাড়িটার কথা খুব মনে পড়ত। তবে সেও একদিন অতীত হল। বঙ্গাইগাঁও হয়ে উঠল আপন। বিয়ের আগে পর্যন্ত তো এ শহরেই কাটানো। কত সুখ দুঃখের স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই জায়গাকে ঘিরে! কত কথা, কত ঘটনা…
স্টেশন চলে এসেছে। বেগ কমিয়ে স্থিত হচ্ছে অজগরের মতো দীর্ঘকায় যানটা। জানলার বাদামি কাচের ওপারে ফুটে উঠছে কর্মব্যস্ত ভিড়ে ভরা প্লাটফর্ম, লাগেজ নিয়ে লোকজনের ছুটোছুটি, হরেক পণ্য নিয়ে হকারদের তৎপরতা। এই চঞ্চল দৃশ্যপটই দুম করে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনল বিদিশাকে। সিটের উপরে গুটিয়ে রাখা পা দু’টো নামিয়ে বসল সে। এতক্ষণ একভাবে বসে থেকে পা দু’টো ধরে গেছে। এখন বেশ আরাম বোধ হল। তবে যেভাবেই বসুক, চোখ থাকল জানলার ওপাশেই।
অনেক যাত্রী হড়বড় করে কম্পার্টমেন্টে উঠছে। কিন্তু তেমন কেউ নামছে না। সবাই উঠছে। এটাই স্বাভাবিক। দূরপাল্লার ট্রেনে সচরাচর কাছের যাত্রীরা চাপে না। বিদিশা বুঝল, যে ক’টা বার্থ খালি আছে, এক ঝটকায় এখানেই হয়তো ভরে যাবে।
রোগা ছিমছাম চেহারার একটি মেয়ে এসে সাইডের সিটে বসল। পাহাড়ি চেহারার ছেলেটি উঠে গিয়ে মেয়েটিকে বসতে দিল। এর পর সিটের নীচ থেকে ছোট্ট কিটব্যাগটা বের করে নিয়ে সে ভেতরের দিকে কোথাও চলে গেল। বিদিশা বুঝল, ছেলেটি এতক্ষণ নিজের জায়গা ছেড়ে বান্ধবীকে সঙ্গ দিচ্ছিল।
আরও বেশ কয়েকজন উঠে এসেছে এই কম্পার্টমেন্টে। কিন্তু আশ্চর্য, ওর সামনের বার্থে এখনও কেউ এল না! ট্রেন থামতেই উপরের ছেলেটি নেমে এসেছিল। প্লাটফর্ম থেকে একটা সফট ড্রিঙ্কসের বোতল কিনে ফিরে এসেছে। সে-ই এখন একা বসে আছে ঐ সিটে। পাশে বসা ভদ্রলোক কখন যে উপরে উঠে গিয়েছেন, বিদিশা খেয়ালই করেনি। এখন দু’দিকের দুই বার্থে মাত্র ওরা দু’জন বসে আছে। এ-সি টু টায়ার বলে প্রতি সিটে বসার দাবীদার এমনিতেই কম। এর মধ্যেও কেউ না-এলে তো কথাই নেই। আরও ফাঁকা লাগে।
যাত্রীরা যে যার জায়গায় বসে গেলেও ট্রেন এখনও ছাড়েনি। জানলা দিয়ে বহু দিনের চেনা স্টেশনটাকে মন ভরে দেখে নিচ্ছিল বিদিশা। একই সঙ্গে স্মৃতির খেয়াও ভাসিয়ে দিয়েছিল। তাই খেয়াল করেনি কেউ যে ওর বার্থে এসে বসেছে। হঠাৎ এক আকুল আর্তি কানে যেতেই ঝটকে পাশ ফিরে তাকাল সে। দেখে, ওর দিকে পিছন ফিরে বসে আছে এক যুবক। সাইডের বার্থে সদ্য ওঠা তরুণীটির একদম মুখোমুখি। সে-ই বলছে, “প্লিজ নিকি তুই যাস না। আমাকে বোঝার চেষ্টা কর। আমি…”
যুবকের কথা শেষ হতে দিল না মেয়েটি। থমথমে স্বরে সে বলল, “যাওয়ার সময় সিন ক্রিয়েট করিস না অনি। এই ডিসিশন তো অনেক আগেই নেওয়া হয়ে গেছে। তুই নেমে যা।”
বিদিশা দেখল, বেশ সুপুরুষ চেহারা ছেলেটার। চওড়া কাঁধ, হাতের বাইসেপ দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় জিমে যাওয়া শরীর। পেছন থেকে মুখ দেখা না গেলেও একটা তরুণ মুখ অনুমান করে নিল সে। ছেলেটি এবারে সেই মেয়েটার হাত নিজের মুঠিতে নিয়ে বলছে, “প্লিজ নিকি, তুই একটা সেকেন্ড থট দে। আমি যে একদম নিরুপায়। ব্যাপারটা প্লিজ বোঝার চেষ্টা কর।”
মেয়েটি আলগোছে হাসল। হাসিটা যতটা না আন্তরিক, তার চেয়ে বেশি শ্লেষের মনে হল বিদিশার। তার পর মুখে ঐ যান্ত্রিক হাসিটাই ধরে রেখে বলল, “আমি বুঝেছি। বুঝেছি বলেই এই ডিসিশন নিয়েছি। আমার জন্যে তুই কোনও অসুবিধায় পড়িস সেটা আমি কখনও চাই না। কাজেই আমার জন্যে কোনও দ্বিধায় ভূগিস না। আমার তরফ থেকে তুই মুক্ত।”
“না না। প্লিজ এভাবে বলিস না তুই…”
ছেলেটির কথার মাঝেই ট্রেনের হুইসেল শোনা গেল। উশখুশ করে উঠল সে। মেয়েটি তাড়া দিল, “নেমে যা অনি। ট্রেন ছাড়ছে।”
যাওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়াল তরুণ। এবার পাশ থেকে ওর বিধ্বস্ত মুখখানা দেখল বিদিশা। শ্যামল চেহারা, বুদ্ধিদীপ্ত চোখমুখ। কিন্তু এখন তার অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট একটা বিভ্রান্তি ফুটে আছে। ছেলেটি নামার জন্যে এগোল। কিন্তু কিছুটা গিয়ে ভারী কাচের দরজাটা খোলার আগে আবার মেয়েটির দিকে ফিরল সে। হাত মুঠি করে কানের সামনে ধরে বলল, “ফোন করিস নিকি। আমার নম্বরটা আনব্লক করে দে প্লিজ।”
কথাটা কানে বাজল বিদিশার। মেয়েটি কি তরুণের নম্বর ব্লক করে রেখেছে? কিন্তু কেন? এবার যেন অনুসন্ধানী চোখেই মেয়েটির দিকে ফিরল বিদিশা। সে আগের মতোই যান্ত্রিক হেসে হাত নাড়ছে। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। ছেলেটি তড়িঘড়ি স্টেশনে নেমে গিয়েছে।
তবে স্টেশনে নেমেও সে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। নিস্পলক তাকিয়ে আছে চলে যাওয়া ট্রেনের দিকে। বড় অসহায় সে দৃষ্টি। এ দৃষ্টির উল্টোদিকে মেয়েটির যান্ত্রিক হাসিমাখা মুখখানা বড় নিষ্ঠুর বোধ হয় বিদিশার। কে জানে কেন, ওর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল।
নানা সম্ভাবনা মুহূর্তেই জন্ম নিল ওর মনে। ছেলেটি ও মেয়েটির মধ্যে কী ঘটেছে সেটা ওর জানা নেই, জানার কথাও নয়। কিন্তু দু’জনের সম্পর্কটা যে স্বাভাবিক নেই, এটা স্পষ্ট। কোথাও একটা ফাটল ধরেছে। বিদিশার মনে হল, মেয়েটি নিশ্চয়ই খুব অন্যায় করছে ছেলেটির সঙ্গে। নিষ্ঠুরভাবে সম্পর্ক ভেঙ্গে দিয়ে চলে যাচ্ছে। তরুণের আকুল আর্তি সে গ্রাহ্যই করল না!
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দীর্ঘ প্লাটফর্ম পেরিয়ে গেল ট্রেন। অমনি হুড়মুড় করে রোদ এসে পড়ল বিদিশার মুখে। রোদ থেকে বাঁচতে সঙ্গে সঙ্গে জানলার ধার থেকে ভেতর দিকে সরে এল বিদিশা। আর তখনই মেয়েটির দিকে চোখ পড়ল ওর।
দুই হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে আছে মেয়েটি। কিন্তু এ কী! সে তো ভীষণভাবে কাঁদছে! সরবে নয়, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। কেঁপে কেঁপে উঠছে ওর নরম তন্বী শরীরটা। ওর মুখোমুখি বসা পাহাড়ি মেয়েটি সহ অনেকের চোখ এখন ঐ কম্পমান ক্রন্দনশীল সহযাত্রীটির দিকে। কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। কেউ এগিয়ে এসে কিছু জিজ্ঞেসও করছে না। যদিও সবার চোখেই অল্পবিস্তর কৌতূহল জমেছে।
আজকাল আর কেউ অন্যের ব্যাপার নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না। আশপাশের মানুষজন সম্পর্কে নিঃস্পৃহ থাকাটাই এখন ভদ্রতার মাপকাঠি। কিন্তু কেন কে জানে বিদিশার অস্থির লাগেছে। বড় ধন্দে পড়ে যায় সে। এতক্ষণ কাঠিন্য দেখানো মেয়েটা ভেতরে ভেতরে এত ক্ষয়ে ছিল! গাড়ি ছেড়ে দিতেই তাই এভাবে ভেঙ্গে পড়ল? কতই বা বয়স হবে মেয়েটার? ফুলের চেয়ে খানিক ছোটই হবে। এই বয়সেই প্রেম ঘটিত এত চাপ নিতে হচ্ছে বেচারাকে!
একমাত্র মেয়ে ফুলের মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিদিশার। স্কুলবেলার থেকে যে ছেলের সঙ্গে প্রেম ছিল, সেই রাতুলের সঙ্গে যখন ব্রেক-আপ হয়ে গেল, তখন এমনই ভেঙ্গে পড়েছিল ফুল। কে ঠিক আর কে ভুল, সেটা পরের কথা, কিন্তু এই ব্রেক-আপ একটা ঝড় এনে দিয়েছিল ওদের আপাত সুখের পরিবারে। একমাত্র যে এতে খুশি হয়েছিল, সে হল উত্তম। উত্তম বরাবরই বড় উচ্চাকাঙ্ক্ষী। মেয়ের ব্যাপারেও তাই। রাতুলকে ওর কোনও দিনেই বিশেষ পছন্দ ছিল না। তাই যখন জানল যে মেয়ের সঙ্গে রাতুলের ব্রেক-আপ হয়ে গেছে, তখন অদ্ভুত এক হাসি হেসেছিল উত্তম।
রাতুলকে যে বিদিশারও খুব পছন্দ ছিল তা নয়। ছেলেটাকে বড় উপরচালাক গোছের মনে হত ওর। কিন্তু মেয়ের পছন্দে কখনও বাধা দেয়নি। ভালোবাসার সম্পর্কে দেওয়াল উঠে গেলে যে কী যন্ত্রণা সেটা বিদিশার চেয়ে আর কে বেশি বুঝবে? কিন্তু সেটাই যখন মেয়ের সঙ্গে ঘটল, ভালোবাসার পাত্রটিই যখন আচমকা সরে গেল, তখন মেয়েকে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া ওর কীই-বা করার ছিল? কিছুদিন একেবারে ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিল ফুল। আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিল একবার। সে যে কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি, এখনও ভাবলে শিউরে ওঠে বিদিশা। অবশেষে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রীতিমতো কাউন্সিলিং-এর সাহায্য নিয়ে মেয়েকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পেরেছে। ঈশ্বরের আশীর্বাদে এখন সব ঠিক আছে। সহযাত্রী মেয়েটির কান্না সেই ভয়াবহ দিনগুলো নতুন করে মনে করিয়ে দিল বিদিশাকে।
মেয়েটির পিঠে আলতো হাত রাখতেই সে চমকে মাথা তুলে তাকাল। মায়ের মতোই ভরসার হাসি হাসল বিদিশা। বলল, “জানি খুব কষ্ট পেয়েছ বলেই এভাবে কাঁদছ। ঠিক কী ঘটেছে জানতে চাইব না। শুধু বলব, কেঁদো না। সবার জীবনেই নানা রকম ঝড়ঝাপটা ও বিপর্যয় আসে। তাতে ভেঙ্গে পড়লে কি চলে? মনে রেখো, সব ঝড়ই খুব সাময়িক।”
মেয়েটি খানিক অপ্রস্তুত বোধ করে। হয়তো এত অচেনা মানুষদের সামনে এভাবে কেঁদে ফেলার জন্যেই। রুমাল দিয়ে চোখমুখ মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু পারছে না। না-চাইতেও অনবরত চোখ দিয়ে জল পড়ছে। কেঁপে কেঁপে উঠছে শরীর। বিদিশা এবারে ওর পাশেই বসে পড়ল। ওর মাথায়, পিঠে সান্ত্বনার হাত বুলিয়ে বলল, “কেন এত কষ্ট পাচ্ছ, আমি জানি না। কিন্তু এটা জানি, খারাপ সময়ও স্থায়ী নয়। দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে এক সময়। শুধু নিজেকে শক্ত রেখো, আর শান্ত থেকো।”
বিদিশার কথার যুক্তি, কিংবা ওর স্বরের আন্তরিকতা, অথবা হয়তো দু’টোই কিছুটা প্রভাব ফেলল। মেয়েটি নিজেকে সামলে নিল। কান্না থামিয়ে নিজেকে সংযত করে। তারপর নীরবে মাথা ঝুঁকিয়ে রাখে।
বিদিশা তখনও ওর পাশেই বসে আছে। এ কথা সে কথায় মেয়েটিকে স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করছে। সেই সঙ্গে জেনে নিতে চাইছে ওর পরিচয়। সঙ্গে ওর কষ্টের কথাও।
ট্রেন সবেগে ছুটছে। ঘর-বাড়ি গাছপালা মাঠ-ঘাট নদী-পাহাড় গ্রাম-শহর সব পিছনে ফেলে দ্রুত এগিয়ে চলছে যানটা। আপাতত কোথাও থামার নেই এর। ছুটছে সময়ও। মেয়েটি প্রথমটায় আড়ষ্ট থাকলেও বিদিশার আন্তরিকতার কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানে। এখন সদ্য খোলা লকগেটের মতো হুড়মুড়িয়ে বের করে দিচ্ছে সমস্ত আবেগ, অভিমান, অভিযোগ।
বিদিশা শুনতে শুনতে ভাবে, মানুষের জীবনের সমস্যাগুলো কতই না বিচিত্র। কারও সঙ্গে কারও মিল নেই। যদি মিল থাকত, তা হলে হয়তো বুদ্ধিজীবীরা সেগুলোর সমাধানের বই লিখত। স্কুল কলেজে এসব পড়ানো হত। কোনও সমস্যায় পড়লে মানুষ টুক করে বই খুলে সেই নির্দিষ্ট সমস্যার সুলভ সমাধানটা দেখে নিত। ফলে সমাজে কোন সমস্যাই টিকত না। সমস্যা না-থাকলে মানুষের দুঃখকষ্টও অনেক কমে যেত।
কিন্তু তা তো নয়। প্রতিটা মানুষের আলাদা আলাদা সমস্যা। কিছুর সমাধান থাকলে, অনেক সমস্যার কোনও সমাধানও নেই। সেক্ষেত্রে মানুষ নিরুপায়। জীবনের সঙ্গে সমঝোতা করেই বাঁচতে হয় তখন। মেয়েটির সমস্যাও কি তেমনই সমাধানহীন কিছু? সত্যি বলতে কী, মেয়েটির থেকে সব শুনে সঙ্গে সঙ্গে বিদিশাও এর থেকে বেরোবার কোনও পথ দেখতে পায় না।
মেয়েটির নাম নিকিতা, ছেলেটির অনির্বাণ। দু’জনেই স্কুল থেকে একসঙ্গে পড়ে। একসঙ্গেই ওরা ম্যানেজমেন্ট পড়তে দিল্লিতে গিয়েছিল। তখনই ওদের ছেলেবেলার বন্ধুত্ব প্রেমে গড়ায়। সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয় দু’জনের। এর পর দিল্লীতেই চাকরি হয় ছেলেটির। কিছুদিন পরে মেয়েটিরও কর্মসংস্থান হয়। ওরা ঠিক করে এবার বিয়ে করে সংসার পাতবে। দু’পক্ষের বাড়িতেই ওরা নিজেদের সম্পর্কের কথা জানায়। এবং দু’পক্ষই সেটা মেনেও নয়। এ পর্যন্ত মসৃণভাবেই এগিয়েছিল সব কিছু।
কিন্তু গোল বাঁধে কিছুদিন আগে। আকস্মিক পক্ষাঘাতে ছেলেটির বাবা বিছানা নেয়। খবর পেয়ে ছেলেটি ছুটে আসে। যেহেতু একই শহরে দু’জনের বাড়ি, তাই মেয়েটিও সঙ্গে আসে। ইচ্ছে ছিল অনির্বাণের বাবা সুস্থ হয়ে উঠলে ওদের বিয়ের কথা পাকা করে যাবে।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর-এক। কথাতেই আছে, ম্যান প্রোপোজেস অ্যান্ড গড ডিস্পোজেস। এক্ষেত্রেও সেটাই হল। সমস্ত প্ল্যান প্রোগ্রামকে নস্যাৎ করে কাহিনি অপ্রত্যাশিত বাঁক নিল। সময়মতো চিকিৎ্সার ফলে অনির্বাণের বাবাকে বাঁচানো গেলেও পুরোপুরি সুস্থ করা গেল না। দেহের বাঁ দিকটা প্রায় বিকল হয়ে তিনি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। এই অবস্থায় এক মহা সংকট দেখা দেয় ওদের পরিবারে।
অনির্বাণদের ব্যবসায়ী পরিবার। ঠাকুরদার আমল থেকে একটা সাবান ফ্যাক্টরি আছে। সেটাই পরিবারের আয়ের মূল উৎস। শুধু ওদের পরিবারই নয়, ফ্যাক্টরিতে কর্মরত প্রায় আধ শতক লোকের সংসারও এর উপরে নির্ভরশীল। এতদিন ওর বাবাই এই ফ্যাক্টরিটা দেখাশোনা করে চালিয়ে এসেছেন। কিন্তু এখন স্বাভাবিকভাবেই এর দায়িত্ব এসে পড়ে অনির্বাণের উপরে। সে দিল্লীর চাকরিতে ইস্তফা দিতে একপ্রকার বাধ্য হয়। ব্যাস, এর পর থেকেই গোলযোগের শুরু।
এত দিন যে স্বপ্ন দেখে এসেছিল দু’জন, যে ভাবে জীবনটাকে গুছিয়ে নিতে চেয়েছিল ওরা, সব মুহূর্তে এলোমেলো হয়ে গেল। এখন অনির্বাণের মা ও বাবা চান, সম্ভবত অনির্বাণ নিজেও চায় যে নিকিতা দিল্লীর চাকরিটা ছেড়ে এখানেই কাছেপিঠে কোনও কাজ নিক। যাতে একসঙ্গে থাকাও যায়, আবার চাকরিও করা যায়। কিন্তু নিকিতার কাছে এটা রীতিমতো অলীক প্রস্তাব। এত পড়াশোনা করে, এত সংগ্রাম করে নিজেকে তৈরি করার পরে এবং এত কাঠখড় কুড়িয়ে ভালো একটা চাকরি জুটোবার পরে শুধুমাত্র বিয়ে করে সংসারী হওয়ার জন্যে সব বিসর্জন দেওয়া কি সহজ? সবচেয়ে বড় কথা, বঙ্গাইগাও কোনও মেট্রো শহর নয়। এমনকি তেমন উল্লেখযোগ্য শহরও নয় যে চাইলেই ওর যোগ্যতার প্রতি সুবিচার হয়, তেমন কাজ পেয়ে যাবে।
এর আগেও নাকি ব্যাঙ্গালোরে আরও ভালো চাকরির অফার শুধুমাত্র অনির্বাণের সঙ্গে দিল্লীতে থাকার জন্যেই ত্যাগ করেছিল নিকিতা। কিন্তু এখন সেটাও অনির্বাণ ছেড়ে দেওয়ার কথা বলায়, নিকিতা বিধ্বস্ত। বিয়ে এবং নিজের কেরিয়ারের মধ্যে দ্বিতীয়টাকেই বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। আর সে জন্যেই অনির্বাণের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক চুকিয়ে সে দিল্লী ফিরে যাচ্ছে। অনির্বাণের ফোন নম্বরও ব্লক করে দিয়েছে নিকিতা। কিন্তু কাজটা করে যে অসীম যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে মেয়েটি, এও সত্যি।
সব শুনে বিদিশাও বড় ধন্দে পড়ে যায়। কী বলবে নিজেও বুঝতে পারে না। এটুকু বোঝে, নিকিতা ও অনির্বাণ কাউকেই দোষারোপ করা যায় না। দু’জনেই পরিস্থিতির শিকার। কিন্তু এর থেকে বেরিয়ে আসার পথই বা কী? এই কচি বয়সেই যে কী অপরিসীম মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে দু’টি ছেলেমেয়ে যাচ্ছে, বেশ অনুভব করতে পারে বিদিশা। কিন্তু সে নিজেও কোনও সমাধান দেখতে পায় না। ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার পরে ছেলেটির অসহায় মুখখানা বার বার ওর চোখে ভেসে ওঠে। কানে বাজতে থাকে ওর করুণ আর্তি, “…প্লিজ নিকি, আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা কর…”
নিকিতার পিঠে হাত রেখে স্তব্ধ বসে থাকে বিদিশা। মেয়েটির কান্না থেমেছে ঠিকই, কিন্তু মাঝে মধ্যেই রুমাল দিয়ে মুছে নিচ্ছে অবাধ্য চোখের জল। চোখের পাতা দু’টি ভারী হয়ে আছে, চোখের ভেতরটা রক্তলাল। মুখখানাও ফ্যাকাশে বিবর্ণ। বোঝাই যাচ্ছে, বেশ ক’টি নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে সে। কিছুক্ষণ কারও মুখেই কোনও কথা নেই। অবশেষে বিদিশাই মুখ খোলে, “এ ব্যাপারে তোমার বাবা-মায়ের কী মতামত?”
“ওঁরা বলেছে, আমার সিদ্ধান্তই ওঁদের সিদ্ধান্ত।” অস্ফুটে বলল মেয়েটি।
বিদিশা বলে, “আমি একটা কথা বলি? রাখবে?”
মেয়েটি মুখে কিছু না-বলে ওর দিকে তাকাল। বিদিশা বলল, “অনির্বাণের নম্বরটা আনব্লক করে দাও। এখনই সব পথ বন্ধ করে দিও না। তোমরা দুজনেই আরও একটু ভাবো। আলোচনা করো। এবং কিছুটা সময়ের হাতেও ছেড়ে দাও। তার পরে দেখোই না কী হয়।”
মেয়েটা আরও একবার চোখ মুছল। তার পর থেমে থেমে বলল, “আনব্লক করে লাভ নেই আন্টি। অনির সঙ্গে অনেক বার কথা হয়েছে। ওর শুধু একই কথা, দিল্লীর থেকে চলে আসতে হবে…”
“এমনও তো হতে পারে, অনি হয়তো মনের থেকে আদৌ তেমনটা চায় না। কিন্তু বাড়ির পরিস্থিতি ওকে দিশেহারা করে রেখেছে। তাই এর বাইরে সে ভাবতেই পারছে না। হতেও তো পারে। দ্যাখো, তুমি আমার মেয়ের মতো। তোমার জায়গায় আমার নিজের মেয়ে হলেও আমি একই কথা বলতাম। একটা সম্পর্ক গড়তে কত বছর লেগে যায়। কিন্তু ভেঙ্গে ফেলতে তো মুহূর্ত লাগে। কাজেই এর আগে একটু সময় নেবে না?”
প্রত্যুত্তরে মাথা নীচু করে নীরব বসে থাকে নিকিতা। বিদিশা এবার উঠে দাঁড়ায়। মেয়েটার মাথায় আরও একবার স্নেহের হাত রেখে বলে, “তুমি ভেবে দেখো। আমি নিশ্চিন্ত তুমি যেমন কষ্ট পাচ্ছো, অনির্বাণও তেমনই কষ্টে আছে। তাই কোনও বড় ভুল হওয়ার আগে কথা বলার পথটা বন্ধ করে দিও না। …আমি একটু শোবো এখন। তুমিও বিশ্রাম নাও কেমন?”
নিকিতা ঘাড় কাঁত করে সহমত জানায়। বিদিশা নিজের বার্থে ফিরে আসে।
বিদিশার ঘুম ভাঙ্গল কথপোকথনের আওয়াজে। চোখ মেলতেই দেখে প্যান্ট্রিকারের ইউনিফর্ম পরা এক তরুণ যাতায়াতের প্যাসেজটায় দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরের আলো জ্বলে উঠেছে। জানলার বাইরেটা অন্ধকার। পরনের সালোয়ার সামলে হড়বড় করে উঠে বসে বিদিশা। মনে মনে ভাবে, ইশ! এতক্ষণ ঘুমিয়েছে!
সেই তরুণ যেন এরই অপেক্ষায় ছিল। ওকে উঠে বসতে দেখেই জিজ্ঞেস করল, “ম্যাডাম চা খেয়ে নিয়েছেন?”
বিদিশা খেয়াল করে দুই বার্থের মাঝের ছোট্ট টেবিলের মতো র্যাকটায় স্ন্যাক্সের প্যাকেট ও ট্রেতে ফ্লাক্স সহ চায়ের সরঞ্জাম রাখা। সেগুলোই ফিরিয়ে নিতে এসেছে ছেলেটি। বিদিশা ওকে কিছুক্ষণ পরে আসতে বলল। তখনই সামনের সিটে চোখ পড়ল ওর। আর অমনি চমকে উঠল বিদিশা। চরম বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেল সে। বহমান সময়ও যেন স্থির হয়ে গেল মুহূর্তেই। ঠিক দেখছে তো সে! নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না বিদিশার। সেই একই চেহারা, সেই ছাঁচে গড়া নাক, ঠোঁট, দীঘল কালো চোখ, ধনুক বাঁকা ভুরু। বুদ্ধিদীপ্ত মুখমণ্ডল জুড়ে সেই অদ্ভুত প্রশান্তি। যেন সুদূর অতীতের দরজা খুলে সে পালিয়ে এসেছে বর্তমানে। এতগুলো বছর পরেও তাই চিনতে একটুও দেরি হল না। বিদিশার মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে আসে, “সুখ!”
একই ভাবে হতবাক সামনের মানুষটিও। সুখবিন্দর সিং। এতক্ষণ বিদিশা ঘুমিয়েছিল বলে ঘুমন্ত মহিলা সহযাত্রীর দিকে সে তেমন করে তাকায়নি। কিন্তু এখন বিদিশাকে দেখে সেও পলক ফেলতে ভুলে গেছে। বিদিশাই সাময়িক বিহ্বলতা কাটিয়ে বলল, “সুখ তুমি! তুমি এখানে?”
ধাতস্ত হতে সময় লাগে সুখবিন্দরের। মুখে কথা আটকে যায়। তার পর থেমে থেমে বলে, “আমি… আমি দিল্লী যাচ্ছি। আর তুমি?”
“আমিও ওখানেই। তুমি কোথায় আছো এখন? কী করছ?” এক সঙ্গে একাধিক প্রশ্ন করে ফেলল বিদিশা। কত কিছু যে জানার আছে ওর। রীতিমতো উচ্ছ্বসিত সে।
প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে নিজেকে সামলে নিয়েছে সুখবিন্দর। যদিও মনের ভেতরে প্রবল উথাল পাতাল চলছে তারও। কিন্তু সেসব বাইরে প্রকাশ না-করে শান্ত ভাবে বলল, “আমি বঙ্গাইগাওতেই আছি। ওখানেই মোটামুটি সেটেল্ড হয়ে গেছি। কিন্তু তুমি কোথায় থাকো?”
সুখবিন্দরের জবাব শুনে বিস্ময় বেড়ে গেল বিদিশার। এখনও বঙ্গাইওগাওতেই আছে সুখ! ওর এত কাছাকাছিই! অথচ দীর্ঘ এত কাল পর দু’জনের দেখা হল! প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তাই বলে ওঠে, “তুমি বঙ্গাইগাওতেই আছো! এখনও! কিন্তু নিউবঙ্গাই থেকে তো তোমাকে উঠতে দেখলাম না?”
“ওখান থেকেই উঠেছি।” বলল বছর ছাপ্পান্নর সুখবিন্দর, “পাশের কম্পার্টমেন্টে ছিলাম, আর-এ-সিতে। রিজার্ভেশন কন্ফার্মড ছিল না। এই বার্থটা খালি ছিল বলে কিছুক্ষণ আগে এটা আমার ভাগ্যে জুটেছে। আর ভাগ্যিস জুটেছিল! তোমার দেখা পেয়ে গেলাম।”
সুখবিন্দরের স্বর নরম, শান্ত, অনুচ্চ। ঠিক আগে যেমনভাবে কথা বলত, এখনও অবিকল সেভাবেই বলছে সে। বিদিশার মনে হয়, এই সুখবিন্দর এবং আগের সুখবিন্দরের মাঝে বিন্দুমাত্র তফাৎ নেই। সময় যেন সামান্য আঁচড়ও কাটতে পারেনি ওর উপরে। অথচ নিজে কত বদলে গেছে সে! শরীরে, মনে, মানসিকতায় সবেতেই আজকের ওর সঙ্গে ত্রিশ বছর আগের বিদিশার আকাশ পাতাল পার্থক্য। মনের কথা চেপেই বিদিশা বলল, “উফ! কত দিন পরে দেখা হল, বলো তো?”
“পাক্কা উনত্রিশ বছর পাঁচ মাস এগারো দিন পর।” মুচকি হেসে বলল সুখবিন্দর।
বিস্ফোরিত চোখে তাকায় বিদিশা। “এর মধ্যেই এত হিসেব করে ফেললে!”
হাসল সুখবিন্দর। সেই আগের মতোই মন ছুঁয়ে যাওয়া হাসি। বিদিশাকে পাগল করে দেওয়া হাসি। বিদিশার মনে পড়ে, সুখবিন্দর বরাবরই ছিল এমন প্রত্যুৎপন্ন মস্তিষ্কের। যেমন ক্ষুরধার উপস্থিত বুদ্ধি, তেমনই রসবোধ। ওর সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটালেও বোর হত না কেউ। বরং সময় যেন ডানা মেলে উড়ত। হাসিতে, মজায় মাতিয়ে রাখতে ওর জুড়ি ছিল না। অথচ হইহুল্লোড় বা চিৎকার চেঁচামেচি তো দূর, উঁচু স্বরেও কথা বলত না কখনও। তবু সবাই কান পেতে ওর কথা শুনত।
“তিনিই বুঝি তোমার সঙ্গী? আই মিন জীবনসঙ্গী?” বিদিশার উপরের বার্থটির দিকে ইশারা করে বলল সুখবিন্দর।
বিদিশার কপালে সাময়িক ভাঁজ পড়ে। কৌতূহলে ঘাড় ঘুরিয়ে উপরের বার্থের দিকে তাকাল ও। মাঝবয়সী সেই লোকটি মৃদু নাসিকা গর্জন সহ ঘুমে অচেতন। দেখেই হেসে ফেলল বিদিশা। বলল, “উঁহু, তোমার অনুমান মিলল না। ইনি আমার তিনি নন। আমার তিনি সঙ্গে আসেননি। আমি একাই যাচ্ছি।”
একটা কপট স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সুখবিন্দর বলল, “যাক নিশ্চিন্ত হলাম।”
“মানে!” তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলে উঠল বিদিশা।
“না, মানে…” সুখবিন্দর রীতিমতো অপ্রস্তুত। অবশ্য সেটা পলকের জন্যেই। এর পরেই স্বর আরও একটু নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল, “মিস্টার কুম্ভকর্ণকে তোমার সঙ্গী হিসেবে ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল। ইনি সেই জন নয় জেনে ভালো লাগল। তা তিনি কোথায়?”
“ও আসতে পারেনি। হঠাৎ একটা কাজে আটকে গেল।”
“যাক সুন্দরী স্ত্রীকে একা যার্ণি করতে দিলেন তিনি। শুনেছিলাম, তিনি নাকি তোমার ব্যাপারে খুব প্রোটেক্টিভ? একেবারেই একা ছাড়েন না?”
“আচ্ছা! এমন শুনেছিলে বুঝি! তা কোথায় শুনেছিলে? আমার খবর তুমি রাখতে?” ভুরুতে ভাঁজ ফেলে বলল বিদিশা।
মাথা ঝাঁকিয়ে মৃদু হাসল সুখবিন্দর। বলল, “রাখতাম বইকি। প্রথম প্রথম তো রাখার চেষ্টা করেছিই।”
“কত দিন রেখেছ?”
জবাবে কিছু না-বলে শুধু হেসে ফেলল সুখবিন্দর। তার পর বিদিশার মুখের দিকে একবার গভীর ভাবে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে ভেতর থেকে কেঁপে উঠল বিদিশা। সুখবিন্দর ছাড়া আর কেউ কখনও এত গভীর ভাবে দেখেনি ওকে। উত্তমও নয়। বিয়ের এত দিন পরেও দমকা হাওয়ার মতো অদ্ভুত এক শূন্যতা ছুঁয়ে গেল ওকে।
উত্তমের কথা মনে আসতেই খেয়াল হল, অনেকক্ষণ হল উত্তমকে একটাও ফোন করা হয়নি। একবার রিং করতে গিয়েও কানেকটিভিটির সমস্যার দরুন পারেনি। দুপুরে ঠিক মতো খেল কি না উত্তম, ওষুধ খেতে ভোলেনি তো? যা ভুলে যায়! বিকেলে তরমুজের জুশ সন্ধ্যা সময়মতো দিয়েছে কি না কে জানে। কিছুই জিজ্ঞেস করা হয়নি।
ইতিমধ্যে কালো কোট পরা এক টিকিট চেকার হাজির। এই নিয়ে তৃতীয় জন। ইনি অবশ্য টিকিট দেখতে চাইলেন না। কেবল চার্ট মিলিয়ে দেখলেন, নির্দিষ্ট বার্থে নির্দিষ্ট লোকেরা আছে কিনা। তবে সুখবিন্দর নতুন বলেই হয়তো ওর টিকিট চাইলেন। সুখবিন্দর ওর মোবাইল খুলে মেলে ধরল। এতেই আছে ই-টিকিট। আজকাল আর কাগজপত্রের দরকার পড়ে না। টিকিট কাটতে কাঠখড় কুড়িয়ে রেলের কাউন্টারে না গেলেও হয়। ঘরে বসে স্মার্টফোনে খুটখাট করেই ট্রেনের টিকিট, প্লেনের টিকিট, অ্যাপ ক্যাব, -সব বুক হয়ে যায়। কত সহজ হয়ে গেছে সব!
সুখবিন্দরের পেশা কী জানা হয়নি। বিদিশা ভাবে, ধরাবাঁধা চাকরি করার কথা তো ওর নয়। হয় বাবার ব্যবসায় নেমেছে, নইলে নিজের মতো আলাদা কিছু করছে নিশ্চয়ই। কমার্সের মেধাবী ছাত্র ছিল সে। বঙ্গাইগাও কলেজ থেকে বি-কমে খুব ভালো রেজাল্ট করেছিল। বিদিশার যখন বিয়ে হয়, তখন সুখবিন্দর কলকাতায় থেকে চার্টার্ড একাউন্টেন্সি পড়ছে। এর পরের খবর অবশ্য আর জানা এই ওর।
রেজাল্ট যে বিদিশারও খুব খারাপ হয়েছিল, তা নয়। খুব ইচ্ছে ছিল পড়াশোনাটা চালিয়ে নেওয়ার। মাস্টার্সে ভর্তি হওয়ার মতো মার্কসও ছিল। কিন্তু, বাবা কিছুতেই চাইল না। কিংবা হয়তো মায়ের ইচ্ছে ছিল না বলেই বাবার মত ছিল না। বি-এ ফাইনাল পরীক্ষায় বসার আগে থেকেই তাই ওর জন্যে পাত্র দেখা শুরু হয়ে গিয়েছিল। আর পরীক্ষা শেষ হতে না-হতেই পাত্রস্থ হয়ে গেল।
এসব ভাবতে ভাবতেই নিজের মুঠোফোনটা ব্যাগের থেকে বের করল বিদিশা। যাক, এবারে নেটওয়ার্ক সিগনাল দেখাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে তাই উত্তমের নম্বরে রিং করল সে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ বেজে ওটা থেমে গেল। ভেতর থেকে যান্ত্রিক আওয়াজ ভেসে এল, “আপনি যাকে ফোন করছেন, তিনি এই মুহূর্তে আপনার কলটি ধরতে পারছেন না।”
বিদিশার চিন্তা হয়ে গেল, ফোন ধরল না কেন উত্তম? সব ঠিক আছে তো? এখন তো বাড়িতেই থাকার কথা ওর। তবে?
মুহূর্তেই নানা রকম ভাবনা এসে জড়ো হয় মনে। এবার সন্ধ্যাকে ফোন করল বিদিশা। সন্ধ্যা অনেক দিন থেকেই ওদের বাড়িতে কাজ করে। রাত দিন থাকে। ফ্ল্যাটে যে সার্ভেন্ট রুম আছে, সেটাতেই থাকে সে। বয়স পয়ত্রিশের আশেপাশে। কাজকর্মও বেশ শিখে গেছে। বিজনির কাছে কোনও গ্রামে ওর বাবার বাড়ি। কখনও বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু স্বামী পরিত্যাক্তা হয়ে দাদার গলগ্রহ হয়ে পড়ে ছিল। বছর ছ’-সাতেক আগে উত্তমের অফিসের কেউ ওকে নিয়ে আসে। সেই থেকে সন্ধ্যা এখানেই আছে। সন্ধ্যা ছাড়া এখন বিদিশার সংসার প্রায় অচল।
দু’-চার বার রিং হতেই রিসিভ করল সন্ধ্যা, “হ্যাঁ, বলো বৌদি।”
“তোর দাদাবাবু কোথায়, রে?” জিজ্ঞেস করে বিদিশা।
“এই তো ঘরেই।”
“ওহ, ফোন ধরল না যে! আমাকে কল ব্যাক করতে বল তো। আর, বিকেলে জুশ বানিয়ে দিয়েছিলি ওঁকে?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ দিয়েছি।”
“ঠিক আছে। রাতের তরকারিতে আলু আর তেল দু’টোই কম দিস কিন্তু।”
“হ্যাঁ বৌদি। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।”
“আচ্ছা, রাখি তা হলে?”
“আচ্ছা।”
ফোন কেটে আধ সেকেন্ড সময় থম হয়ে বসে থাকে বিদিশা। সন্ধ্যা ওকে নিশ্চিন্ত থাকতে বলল ঠিকই, কিন্তু নিশ্চিন্ত কি ওর আদৌ কখনও হওয়া সম্ভব? মানুষ না চাইলেও বেনো জলের মতো এলোমেলো শতেক ভাবনা ছেয়ে রাখে মনোজগৎ। কিছু ভাবনা হয়তো ভিত্তিহীন। কিন্তু কিছুর তো যথেষ্ট কারণও থাকে। সেগুলোর থেকে বেরিয়ে আসা সহজ নয়। বিদিশার মনে হয়, এই পৃথিবীতে একমাত্র তারাই সুখী, যারা চিন্তাহীন জীবন কাটাতে পারে।
তখনই বিদিশা খেয়াল করল সুখবিন্দর জুতো পরছে। ওর দিকে তাকাতেই হালকা হাসল সুখবিন্দর। বলল, “বাবাকে দেখে আসছি। পাশের কম্পার্টমেন্টে বাবা আছেন।”
“ওহ! তোমার বাবাও সঙ্গে যাচ্ছেন? জানি না তো! …অবশ্য আমিও তো জিজ্ঞেস করিনি।”
“হ্যাঁ, বাবাকে কিছু দিনের জন্যে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি। আমার ছোটকাকু কানাডা থেকে এসেছেন। তাঁর আসার কথা ছিল আমাদের এখানে। কিন্তু আকস্মিক শরীর বিগড়ে যাওয়ায় তাঁর প্রোগ্রাম ক্যান্সেল হয়। তাই বাবাকেই দেখা করাতে নিয়ে যাচ্ছি। হঠাতই প্রোগ্রাম।”
“আর আন্টি, মানে তোমার মা কেমন আছেন?”
মুখে ঈষৎ মেঘ ঘনাল সুখবিন্দরের। দু’পাশে মাথা দুলিয়ে বলল, “মা নেই। দু’হাজার চৌদ্দয় চলে গেছেন।”
“আন্টি নেই!” পলকেই ভেতরে এক অদ্ভুত শূন্যতা টের পায় বিদিশা। এক সুন্দর, হাসিখুশি ও স্নেহময়ী মুখ বিদিশার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বড় ভালোবাসতেন ওকে। আর কী প্রাণচঞ্চল ও খোলামেলা স্বভাবেরই না ছিলেন! শুধু নিজের ছেলে নয়, ছেলের বন্ধুদের সঙ্গেও বন্ধুর মতো মিশতেন। তাঁকে দেখে প্রায়ই বিদিশার মনে হত, ইশ যদি ওর মাও এমন খোলামেলা হতেন! সুখবিন্দর চেহারায় বাবার মতো ধারালো হলেও স্বভাবে অনেকটাই মায়ের মতো হয়েছে।
“মা চলে যাওয়ার পরেই বাবা একেবারে ভেঙ্গে পড়েছেন।” সুখবিন্দরের কথা শুনে ঘোর কাটল বিদিশার। সুখবিন্দর বলে চলেছে, “মায়ের অভাব খুব বোধ করেন বাবা। আমি ও আমার পরিবার যদ্দুর সম্ভব চেষ্টা করি বাবাকে খুশি রাখতে। দেখি এভাবেই কত দিন…”
জুতো পরা হয়ে গেছে। উঠে দাঁড়াল সুখবিন্দর। সিটের উপরে ব্যাগটা দেখিয়ে বলল, “ওটা থাকল। আমি আসছি তা হলে?”
বিদিশা ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বোঝাল। সুখবিন্দর চলে গেল। বিদিশা ওর যাওয়ার দিকে অপলক তাকিয়ে রইল। মনে মনে ভাবে, কে জানত এভাবে কখনও সুখবিন্দরের সঙ্গে আবার দেখা হবে? আর কী অদ্ভুত সংযোগ! পাশের কম্পার্টমেন্ট ছেড়ে এখানেই বার্থ পেল সুখবিন্দর! আবার এবারই ওকেও একা যেতে হচ্ছে! এ সংযোগ নয় তো কী? সত্যি, জীবন যে কখন কোথায় এনে দাঁড় করায়, কেউ জানে না। নইলে যাকে ভুলেই ছিল, যাকে এতদিন কোনও ভাবনা চিন্তাতেও মনে আনেনি, গোপন নিষিদ্ধ সম্পদের মতো যাকে স্মৃতির গোপন কক্ষে তালাবন্ধ করে রেখেছিল, সেই এমন আচমকা সামনে এসে উদয় হবে?
সাইডের বার্থে ঘুরে তাকাল বিদিশা। নিকিতা মেয়েটি এখন ঘুমোচ্ছে। সাদা চাদরে গা ঢেকে অঘোরে ঘুমাচ্ছে সে। বিদিশা মনে মনে বলল, ঘুমোক। একটু ঘুমোলে মেয়েটার মন শান্ত হবে।
হাত বাড়িয়ে এবার চায়ের ট্রে-টা নিল সে। কাগজের কাপে গরম জল ঢেলে সবে টি-ব্যাগ ডুবিয়েছে, অমনি ফোন বেজে উঠল। উত্তমের ফোন। কাপ নামিয়ে তড়িঘড়ি ফোন রিসিভ করে বিদিশা। ওপাশ থেকে উত্তম বলে ওঠে, “হ্যাঁ বলো, ফোন করতে কেন বলেছো? কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?”
“না কোনও অসুবিধা নয়,” বলল বিদিশা, “তোমাকে ফোন করলাম কিন্তু ধরলে না বলে চিন্তা হচ্ছিল। তাই সন্ধ্যাকে বললাম।”
“ও হো, আবার চিন্তা!” উত্তমের স্বরে বিরক্তি, “তোমাকে বলেছি না কথায় কথায় টেনশন করবে না।”
“তবে ফোন ধরলে না কেন?”
“আরে বাবা টি-ভি দেখছিলাম। তাই ফোনটা খেয়াল করিনি।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। ওষুধগুলো সময়মতো খেয়ো।”
“খাব। তুমি একদম ভেবো না। …আর কিছু বলবে?”
“নাহ, রাখছি।”
ফোনটা ব্যাগের মধ্যে রাখতে রাখতে বিদিশা টের পায়, মনটা কেমন যেন বিষাদে ভরে উঠেছে। উত্তম এমন বিরক্তি নিয়ে কথা বলল কেন? ওর জন্যে যে বিদিশার ভাবনা হয়, সেটা সে কেন বোঝে না?
চা প্রায় জুড়িয়ে গেছে। ওতেই চুমুক দিল বিদিশা। মাথার ভেতরে অজস্র হিজিবিজি কথা ভিড় জমাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি করে আসছে সুখবিন্দরের কথা। এত দিন যাকে প্রায় ভুলেই ছিল, সেই এখন ওর সমস্তটা জুড়ে বসছে যেন।
সুখবিন্দরের সঙ্গে আলাপ কলেজে এসে। দু’বছরের সিনিয়র ছিল সে। মাথায় পাগড়ি বাঁধলেও বাংলা এমন সুন্দর বলত যে, প্রথম পরিচয়ে চমকেই উঠেছিল বিদিশা। পরে জেনেছিল, সুখের বাবা পঞ্জাবী হলেও মা বাঙালি। বাবাও বহু বছর বাংলায় অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে ছিলেন। সুখবিন্দরের জন্ম কলকাতায়। সেখানেই কৈশরের অনেকটা সময় থেকেছে। পরে বাবার ব্যবসার খাতিরে অসমে চলে আসা।
সুখবিন্দর ছিল কমার্সের ছাত্র। বিদিশা আর্টসের। সাধারণত আলাদা বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মেলামেশা বা বন্ধুত্ব খুব একটা হত না। কিন্তু ওদের হয়েছিল। এর একটা কারণ হল গল্পের বইয়ের নেশা। দু’জনেই বই পড়তে অসম্ভব ভালোবাসত। ফি হপ্তাহে বই বদলাতে কলেজের লাইব্রেরিতে হাজির হতো দু’জনই। আর দু’জনেই বাংলা উপন্যাস বা গল্পের বইয়ের খোঁজ করত। সুখবিন্দর অবশ্য কবিতার বইয়েরও পাঠক ছিল। সমসাময়িক বাংলা সাহিত্য প্রায় গুলে খেয়েছিল ও। বিদিশার অবাক লাগত। একে তো কমার্সের মতো নীরস বিষয়ের ছাত্র, উপরন্তু পঞ্জাবি হয়েও বাংলা পড়তে কী ভীষণ ভালোবাসে! অনেক বাংলা মেজোরের ছাত্রছাত্রীর চেয়েও বাংলা সাহিত্য ভালো বুঝত সুখবিন্দর।
তবে শুধু গল্পের বইয়ের নেশাই নয়, পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল আরও নানা কারণেই।
“ম্যাডাম, ডিনারে ভেজ না ননভেজ?” রাতের খাবারের কথা জিজ্ঞেস করতে চলে এসেছে। কথাগুলো কানে যেতেই ঘোর কাটে বিদিশার। আজকে মুহূর্মুহ আনমনা হয়ে উঠছে সে। হয়তো এটাই স্বাভাবিক। বিধি যে এমন এক সন্ধিক্ষণেই ওকে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
ঘড়িতে সবে পৌনে সাতটা এখন। সুখবিন্দর এখনও ফেরেনি। নিজের পছন্দের কথা জানিয়েই বিদিশা আগ বাড়িয়ে বলল, “এই সামনের বার্থে লোক আছে। সে এখন অন্য কোথাও গেছে। এই অর্ডারটা পরে এসে নিয়ে যেও।” ছেলেটি মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল।
কিন্তু সুখবিন্দর এখনও আসছে না কেন? বিদিশার মনে চিন্তার হালকা মেঘ ঘনায়।
নিকিতা মেয়েটির ঘুম ভেঙ্গেছে। বিদিশা দেখল, সে এখন চুপচাপ বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। এভাবে চুপটি করে কী ভাবছে মেয়েটা? যে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ওরা, সামলে উঠতে পারবে তো? অনির্বাণ ছেলেটার কথা ভেবেও কষ্ট হয় বিদিশার। এক দিকে অসুস্থ বাবা এবং পারিবারিক ব্যবসায়, অন্যদিকে নিকিতাকে নিয়ে একটা সুখী জীবনের স্বপ্ন। দু’টোকেই মেলাতে গিয়ে হাঁসফাঁস খাচ্ছে বেচারা। নিজের অজান্তেই যেন অপরিচিত এই ছেলে-মেয়ে দু’টির সমস্যা এবং পরিস্থিতির সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে বিদিশা। ওদের মনের অবস্থা তাই ভীষণ ভাবে অনুভব করতে পারছে। ওর নিজেরও তো অনেকটা এমনই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে এক সময়। পার্থক্য শুধু এই যে, বিদিশা অসহায় ছিল। ভাগ্যের হাতে নিজেকে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া ওর অন্য উপায় ছিল না। কিন্তু নিকিতা তা নয়। ওর নিজস্ব একটা চাকরি আছে, মনে সাহস আছে, একা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে।
পাহাড়ি মেয়েটিও উপর থেকে নেমে নিকিতার মুখোমুখি সিটটায় বসে আছে। চুপচাপ ফোন ঘাঁটছে সে। মাঝে মাঝে ওর সঙ্গী ছেলেটি এসে দেখা করে যাচ্ছে। ওরা কি ভাইবোন, নাকি প্রেমিক প্রেমিকা? নাকি নিছক সহপাঠী বা বন্ধু? বিদিশা বোঝে না। চারপাশের সহযাত্রীদের কৌতূহল নিয়ে দেখে চলে বিদিশা। কিন্তু সুখবিন্দর আসছে না দেখে ভেতরটা উশখুশ করছে। তা হলে কি ওর স্ত্রীও সঙ্গে যাচ্ছে? সেজন্যেই ওখানে বেশি সময় কাটাচ্ছে? হয়তো সেটাই। পাশের কম্পার্টমেন্টে বাবার সঙ্গে হয়তো স্ত্রীকেও রেখে এসেছে সে। হতেই পারে। জিজ্ঞেস করা হয়নি বিদিশার। কিছুই তো জানা হয়নি এখনও। সুখবিন্দরের স্ত্রী, সন্তান, কারও কথাই নয়।
খুচরো পয়সা পড়ার মতো শব্দ করে একটা মেসেজ ঢুকল ফোনে। বিদিশা দেখে, মেয়ের মেসেজ। যার্নিতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে কি না, সহযাত্রীরা ঠিক কিনা, খাবার-দাবার ভালো কিনা, ইত্যাদি জানতে চেয়ে মেসেজ। বিদিশা মেয়েকে সঙ্গে সঙ্গে জবাব পাঠায়। মেয়ে অনলাইনেই আছে। মায়ের মেসেজ পেতেই আর মেসেজ না-পাঠিয়ে সরাসরি ফোন করে সে, “মা খেয়েছো?”
“এত তাড়াতাড়ি!”
“বাহ্ রে, ট্রেনে তো আটটার মধ্যেই ডিনার দিয়ে দেয়।”
“হ্যাঁ, অর্ডার নিয়ে গেছে। এখনও দেয়নি।”
“বাবাকে এখনই ফোন করেছিলাম। বাবা দেখি আজকে সাত-তাড়াতাড়ি ডিনার করে নিয়েছে।”
“তাই নাকি! সন্ধ্যা এত তাড়াতাড়ি দিল কেন? ওকে যে বলে এসেছি, একদম সময় মতো দিতে। তোর বাবা খাওয়ার আগে ওষুধটা খেল কিনা কে জানে। রোজই তো ভুলে যায়।”
“ওফ মা! ছাড়ো তো বাবার চিন্তা। সন্ধ্যা মাসি ঠিক সামলে নেবে। তুমি তোমার যার্নি এনজয় করো, কেমন?”
হাসল বিদিশা। কিন্তু হাসিটা মন থেকে এল না। মেকি হাসি হেসেই মেয়েকে আশ্বস্ত করে কথা শেষ করল। মেয়ে যতই বলুক, সন্ধ্যা সব সামলে নেবে, কিন্তু সেটা কি এতই সহজ? সন্ধ্যাকে এত বিশ্বাস করা কি যায়? কাউকে কখনও না-বললেও মাঝেমধ্যেই একটা কাঁটা ওর ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত করে চলে। বড় অসহায় লাগে তখন। এর কোনও নিরাময় নেই, এর সমাধানও পাওয়া কঠিন। কিংবা হয়তো কঠিন নয়। কেবল বিদিশারই সাহস নেই সেই সমাধানে পৌঁছানোর। সন্ধ্যাকে ছাড়া ওর সংসার অচল। এই শহরে এমন একজন রাত-দিনের কাজের লোক পাওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। এই কয়েক বছরে সন্ধ্যার উপরে বড় নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে সেও। সুতরাং এমন কিছু সে নিজেও করতে চায় না, যাতে সন্ধ্যাকে হারাতে হয়।
তথাপি গলায় একটা কাঁটা প্রায়ই অনুভব করে বিদিশা। এ এমন এক কাঁটা যা না পারা যায় সইতে, না পারা যায় বহন করতে। এমনকি কাউকে বলে যে হালকা হবে, এ উপায়ও নেই।
খাবার নিয়ে চলে এসেছে। চৌকো ঢাকা দেওয়া থালায় যার যার পছন্দের খাবার দিয়ে গেল প্যান্ট্রি কারের লোক। কিন্তু সুখবিন্দর তো এখনও এল না! এবারে কপালে ভাঁজ পড়ে বিদিশার। চিন্তার মেঘ গাঢ় হয়। সেই যে গেছে তো গেছেই। আর ফেরার নামই নেই! ফোন নম্বরটাও বিদিশার জানা নেই যে, ফোন করে জানবে এত দেরির কারণ। ছটফট করে বিদিশা।
উপরের দুই বার্থ থেকে দুই সহযাত্রী নীচে নেমে এসেছে। সামনের তরুণ কোলের উপরে খাবারের থালা তুলে খেতেও শুরু করে দিয়েছে। এই এতক্ষণ পরে ছেলেটিকে ল্যাপটপ ছেড়ে উঠতে দেখল বিদিশা। নইলে আসার পর থেকে সেই যে উপরের বার্থে উঠে ল্যাপটপে কাজ শুরু করেছিল সে, তার পর একটুও বিরতি দিতে দেখেনি। শুধু একবার একটা কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল কিনতে এক স্টেশনে নেমেছিল। সেও তো অনেক আগে। এখন খেতে নেমেছে দেখেই কানের ইয়ারফোন আর ল্যাপটপ সঙ্গে নেই। বিদিশা ছেলেটির দিকে ভালো করে তাকালো। রোগা পাতলা নিরীহ চেহারা। পোশাকআশাক বাহুল্যহীন।
পাশের ভদ্রলোকও সিটের উপরে খবরের কাগজ পেতে খাবার তুলে নিয়েছে। বিদিশার দিকে তাকিয়ে কিছুটা অনভ্যস্ত হিন্দিতে বলল, “বহেনজী, আপ খানা নেহি খায়েঙ্গে?”
কথা শুনেই বোঝা যায় ভদ্রলোক অসমীয়াভাষী। তাই বিদিশা আলতো হেসে অসমিয়াতেই উত্তর দিল। বলল, “মই অলপ পিছত খাম। আপুনি খাওক।”
বিদিশার ভেতরটা এখন উশখুশ করছে। সুখবিন্দর এখনও এল না কেন ভেবে অস্থির হয়ে উঠছে সে। এমন সময়ে কেবল খারাপ ভাবনাই মনে আসে ওর। ঠিক আছে তো সুখবিন্দর? পাশাপাশি অন্য একটা সম্ভাবনাও দেখা দেয় মনে। আচ্ছা, এমন তো নয় যে সুখবিন্দর ওকে এড়াতে চাইছে। তাই ফিরতে দেরি করছে। কিছুই বুঝতে পারছে না বিদিশা। কেবল অস্থির হয়ে যাতায়াতের প্যাসেজটার উঁকি দিচ্ছে বার বার।
এমন সময় সামনের তরুণের ফোন বেজে উঠল। খাওয়া থামিয়ে বাঁ হাত দিয়ে ফোন তুলল সে। কানের কাছে ধরে বলল, “বলো।”
ও পাশ থেকে ঝরঝর করে কেঁদে উঠল একটি মেয়ে। কাঁদতে কাঁদতেই বলতে লাগল, “তোমার মা-বোনেরা আমাকে কী মনে করে বলো তো? আমি কি দাসী? নিজেরা তো পায়ের উপরে পা তুলে বসে থাকবে, আর হুকুম চালাবে। সারা দিন খাটিয়ে মারবে আমাকে, এর পরেও বাপ-মা তুলে গালাগাল দেবে?” এ নাগাড়ে বলে চলে মেয়েটি। ভাষা শুনে মনে হল ভোজপুরী হিন্দি। যদিও সবই বুঝতে পারা গেল।
তরুণ যদ্দুর সম্ভব স্বর চেপে বলল, “শান্ত হও মধু। কী হয়েছে খুলে বলো আমাকে।”
“কী হয়নি সেটাই জিজ্ঞেস করো। তোমার মা বোনেরা মনে করে তুমি হচ্ছ টাকা কামাইয়ের মেশিন, আর আমি হচ্ছি তাদের দাসী। সারাদিন হাভাতের মতো শুধু খাবে, আবার উল্টে আমাকেই কথা শোনাবে।”
“আহ, মধু! লিমিট ছাড়িও না। কথায় কথায় আমার মা-বোনেদের দোষ না-দিয়ে কী হয়েছে সেটা বলো।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিই তো শুধু দোষ দিই। তারা তো সব ধোয়া তুলসীপাতা।” মেয়েটির স্বর উঁচু হয় আরও।
ছেলেটি বলল, “তুমি এভাবে কথা বললে কিন্তু ফোন কেটে দেব।”
“তা তো কাটবেই। আমি যে সামনে মিষ্টি মিষ্টি বলে পেছনে সর্বনাশ করতে পারি না। উচিত কথা বলি তো, তাই খারাপ লাগে তোমার। শোনো, দশ-বারো দিন আগে আমার বাবা এসে আধ টিন গাওয়া ঘি দিয়ে গিয়েছিল। এর পর থেকে তোমার মা-বোনেদের রোজ ঘিয়ে ভাজা পরোটা ছাড়া রোচে না। রুটিতে ঘি, সব্জিতে ঘি, ডালে ঘি, সবেতেই তাদের ঘি লাগে। তাই আমি একটা বয়ামে তোমার জন্যে একটু ঘি তুলে রেখেছিলাম। আজকে দেখি তোমার জন্যে রাখা ঘি-টাও ওরা বের করে নিয়েছে। আমি কিছু বলতেই তিনজনে মিলে হামলে পড়ল আমার উপরে। বলে কিনা ‘কাঙ্গাল বাড়ির মেয়ে’, তাই সামান্য ঘি নিয়ে কথা শোনাচ্ছি। তার পর যা নয় তাই শুনিয়ে গেল।”
“তুমিই বা এ নিয়ে কথা বলতে গেলে কেন? সামান্য একটু ঘি-ই তো। তা ছাড়া ঘি আমার এমন কিছু প্রিয় নয়।”
“মানলাম সামান্য ঘি। কিন্তু বাবা তো তোমার জন্যে আদর করে এনেছিলেন। তা ছাড়া তোমার মা-বোনেদের কি তোমার জন্যে একটুও ফিলিংস নেই? বোনেদের কথা ছেড়েই দাও, মায়েরও নেই! তারও একবার মনে হল না যে, ছেলেটা সারা মাস বাইরে বাইরে খেটে মরছে, ভালোমন্দ খাওয়াও জুটছে কিনা কে জানে, তার জন্যে কিছুটা ঘি তোলা থাক? কেমন মা সে?”
“আমার মা যেমনই হোক, সেটা তোমার বিচার্য নয়। তুমি তাঁকে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই বলতে পারো না মধু। আর হ্যাঁ, আমার মা ও বোনেরা যেমন খুশি চায়, তেমনই থাকতে দাও। এর পরেও কিছু হলে জানিও।”
“জানতাম, তুমি এমনই বলবে। যার জন্যে করি চুরি সেই বলে চোর। এমন অন্ধ তুমি।”
মেয়েটি ফোন কেটে দিয়েছে। তখনও কাঁদছিল সে। তরুণ ফোন রেখে আধ সেকেন্ড মতো থম মেরে বসে রইল। তার পর আবার ধীর গতিতে খাওয়া শুরু করল।
কিন্তু বিদিশা দেখল, ছেলেটি আর ঠিক মতো খাচ্ছে না। সামান্য আধখ্যাঁচরা খেয়েই থালা নামিয়ে রাখল। খারাপ লাগল বিদিশার। এ সময়ে ফোনটা না-এলে হয়তো গুছিয়ে পেট ভরেই খেত সে। কিন্তু বৌটারই বা কী দোষ? সেও তো মরিয়া হয়েই ফোনটা করেছিল। বিদিশা ভাবে, সত্যি বিচিত্র এই পৃথিবী। এখানে সমস্যা জ্বালা যন্ত্রণা ছাড়া কেউ নেই। অদ্ভুত সমস্যা এই তরুণ এবং তার স্ত্রীর মাঝেও। অথচ তারা কেউই এর জন্যে দায়ী নয়। দায়ী যারা, অর্থাৎ ছেলেটির মা ও বোনেরা, যারা শোষণের পাহাড়ে পা দুলিয়ে বসে আছে, তারা থেকে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরেই। কেবল ফাটল ধরছে দু’টি ভালো মনের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। ছেলেটি যে তাদের প্রতি নিজের দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে শুধু সচেতনই নয়, রীতমতো অন্ধও, সেটা স্পষ্ট। আবার বৌটি যে স্বামীকে খুব ভালোবাসে, তার প্রতি অন্যায় হলে রুখে দাঁড়ায়, এও বোঝা যাচ্ছে। কেবল ছেলেটিই সেটা বুঝছে না। হয়তো স্ত্রীকে সেও ভালোবাসে। কিন্তু এই ভালোবাসায় বিশ্বাস জিনিসটা নেই। সমস্যার মূল এখানেই।
“কী এত ভাবছ বলো তো? হাজবেন্ডের কথা?” আচমকা সুখবিন্দরের কথায় সম্বিৎ ফিরল বিদিশার। এলোপাথারি ভাবনায় কিছুটা আনমনাই হয়ে উঠেছিল সে। এখন সুখবিন্দরকে দেখে স্বস্তি ফিরল কছুটা। বলল, “এত দেরি করলে যে?”
“বাবাকে একেবারে খাইয়ে এলাম।”
“আর তুমি? আমি তো তোমার জন্যে অপেক্ষা করে আছি। তোমার খাবারের কথা বলেছ? এখানে তো দিয়ে গেল না!”
“এহ্ হে! তুমি মিছেমিছি অপেক্ষা করছ কেন? আমি তো ওখানেই খেয়ে নিয়েছি। নাও নাও, এখন খেয়ে নাও তা হলে।”
হাসল বিদিশা। অকারণেই হয়তো একটু ধাক্কাও খেল। সত্যিই তো, ওর তো অপেক্ষা করার কথা নয়। তবে কেন করছিল?
বুকের ভেতরটা সামান্য চিনচিন করে ওঠে ওর। কিন্তু সেটাকে উপেক্ষা করতে চেষ্টা করে। ঢাকনা দেওয়া নিজের খাবারটা কোলে তুলে নিল সে। তার পর খেতে শুরু করল।
পরোটা, ভাত, পনিরের তরকারি, ডাল, ইত্যাদি সবই ঠান্ডা হয়ে গেছে। গলা দিয়ে নামছে না যেন। সঙ্গের মিষ্টিটা দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে একখানা পরোটা খেল কেবল। দইটা খেতে চেয়েছিল। কিন্তু এত টক যে খাওয়া গেল না। ওইটুকু খেয়েই থালা নামিয়ে রাখল নীচে। সুখবিন্দর বলল, “কিছুই তো খেলে না দেখছি। এখনও আগের মতো পাখির খাওয়া খাও!”
হাসল বিদিশা। “আগের কথা এত মনে আছে তোমার?” জলের বোতলের ছিপি খুলতে খুলতে বলল সে।
সুখবিন্দরও হেসে ফেলল। বলল, “সে সব কি ভোলার কথা?”
উত্তরে কিছু বলল না বিদিশা। কী-ই বা বলার আছে? কিন্তু পলকেই বহু যুগের ওপার থেকে একটা রোদ ঝলমলে দিন ওর মনের মণিকোঠায় হাজির হল।
সেবার কলেজ থেকে পিকনিকে যাওয়া হয়েছিল। বঙ্গাইগাঁও থেকে খুব কাছেই ভূটান। গন্তব্য ছিল সেখানেই। এখন ইচ্ছে করলেই বর্ডার পেরিয়ে এদেশ ওদেশ করা যায় কিনা, বিদিশা জানে না। কিন্তু ত্রিশ-পয়ত্রিশ বছর আগে এটা খুব সহজ ব্যাপার ছিল। শীত এলে দলে দলে পিকিনিক পার্টি ভূটানে যেত। এমনকি ঘোর গরমেও খানিক পাহাড়ি ঠান্ডার আমেজ নিতে হলে লোকে ভূটান রওনা দিত। সারাটা দিন পাহাড় নদী দেখে, কখনও কাছাকাছি জনপদগুলির পথেঘাটে ঘুরে বেড়িয়ে, মন ভরে চাউমিন আর মোমো খেয়ে সন্ধের পরে বাড়ি ফিরে আসত।
বড় একটা বাস বোঝাই করে পিকনিকে যাওয়া হয়েছিল। ছাত্রদের সংখ্যা বেশি হলেও ছাত্রীরাও নেহাত কম ছিল না। বিদিশার মনে আছে, বাড়িতে রীতিমতো কান্নাকাটি করে অনুমতি আদায় করতে হয়েছিল ওর। এমন নয় যে পিকনিকে যাওয়ার জন্যে উতলা ছিল, আসলে আগ্রহের মূল কারণ ছিল সুখবিন্দর। তখন সবে ওদের প্রেমে পাক ধরছে। দু’জন দু’জনকে চোখে হারায়। একটু দেখা পাওয়া কিংবা সামান্য কথা বলার জন্যে মুখিয়ে থাকে দুজনেই। কিন্তু ছোট এই শহরটায় প্রেমিক যুগলদের মেলামেশার মোটেই তেমন সুবিধা ছিল না। শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স বা বিনোদন পার্ক তো দূর, পরস্পরের সঙ্গ উপভোগ করার মতো নিরিবিলি একটা বসার জায়গাও ছিল না তখন। উপরন্তু ছোট শহর হলে যা হয়। যেখানেই যাও, কোনও না কোনও পরিচিত মুখ থাকবেই। ফলে সুখবিন্দরের সঙ্গে দেখা সাক্ষাতের একমাত্র জায়গা ছিল কলেজই।
কিন্তু কলেজেরও তো সীমাবদ্ধতা আছে। লোকচক্ষু এড়িয়ে দু’দণ্ড পরস্পরের সঙ্গ উপভোগ করার উপায় এখানেও নেই। তাই পিকনিকের আয়োজন হতেই দু’জনে লাফিয়ে উঠেছিল। অন্তত এই ছুতোয় যদি একটা দিন ভয়হীন, দ্বিধাহীন, বাধনহীন ভাবে দুজনে একসঙ্গে কাটানো যায়।
মনে আছে, সকাল সাতটা নাগাত বাস ছেড়েছিল। তখনও চরাচর কুয়াশায় মোড়া। আর কী প্রচণ্ড শীত পড়েছিল সেবার! ঢালিগাঁও পেরিয়ে হাইওয়ে ধরে যখন যাচ্ছিল, তখনও রাস্তাঘাট ধোঁয়ার মতো কুয়াশায় ঢেকে আছে। বাস তাই খুব বেগে যেতে পারছিল না। এর পর অবশ্য ভূটান ঢোকার বেশ আগেই ঝকঝকে রোদের দেখা মিলেছিল।
ভূটান বর্ডারের আগে এক জায়গায় বাস থেমেছিল। ভারী মনোরম সে জায়গা। চারদিকে সবুজ বনানী আর নরম রোদের ঝিকিমিকি। সবাই নীচে নেমে এসেছিল। এখানেই ব্রেকফাস্টের জন্যে পাউরুটি কলা আর ডিমসেদ্ধ ইত্যাদি সার্ভ করা হয়। রোদে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে গল্প করতে করতে খাচ্ছিল ওরা। সুখবিন্দরও সেখানে ছিল। মিনিট কয়েকের মধ্যেই সবার খাওয়া হয়ে গেলেও বিদিশা কেবল ডিম আর জ্যাম মাখানো এক টুকরো পাউরুটিই খেতে পেরেছে তখন। বস্তুত বিদিশা বরাবরের স্বল্পাহারী। এত খাবার সে একসঙ্গে খেতে অভ্যস্ত হয়। তাই বাকি খাবারগুলো একে-তাকে গছিয়ে দিচ্ছিল। সুখবিন্দর অবাক চোখে তাকিয়ে বলেছিল, “এই তোমার খাওয়া? তোমার চেয়ে তো পাখিরাও বেশি খায়!”
চারপাশে এখন ঘুমের তোড়জোর চলছে। ট্রেনের ভেতরটা এক আশ্চর্য জগৎ। এখানে ঘড়ির কাঁটা নিজস্ব নিয়মে চলে। সবে রাত ন’টা পেরিয়েছে কিনা, এখনই সবাই নিজের নিজের বেডরোল নিয়ে বিছোতে শুরু করেছে। সাইডের দুই মেয়ে, উপরের পাহাড়ি চেহারার মেয়েটি এবং নীচের বার্থের নিকিতা, দু’জনেই পর্দা টেনে রীতিমতো শুয়ে পড়েছে। মুখোমুখি বসা তরুণও উঠে গেছে নিজের বার্থে। এখন আর ল্যাপটপ খোলেনি সে। শুয়ে শুয়ে মোবাইল দেখছে। কানে ইয়ারফোন।
তবে বিদিশার উপরের বার্থের সহযাত্রী এখনও পাশেই বসে আছেন। ট্রেনে চাপার পর থেকে ডিনারের আগ পর্যন্ত অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছেন তিনি। তাই এখন চাঙ্গা হয়ে আছেন।
ঘুমিয়েছে বিদিশাও। দিনে এত ঘুমোবার অভ্যাস নেই ওর। তথাপী ট্রেনের দুলুনির জন্যেই হোক, কিংবা আগের রাতে ঠিকমতো ঘুম না-হওয়ার কারণেই হোক, গভীর ভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কাজেই রাতে যে ঘুম আসতে দেরি হবে, সেটা নিশ্চিন্ত। চপ্পল পায়ে গলিয়ে টয়লেটের দিকে গেল বিদিশা। সুখবিন্দর আছে দেখে ব্যাগটা সিটের উপরেই ছেড়ে গেল।
ফিরে এল মুখচোখ ভালো করে ধুয়ে। দেখে, এক মনে মোবাইল ঘাঁটছে সুখবিন্দর।
বিদিশা টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছে নাইট ক্রিম লাগাল। চুলের ক্লিপ খুলে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল। ছোট আয়নাটা বাঁ হাতে ধরে ডান হাত দিয়ে খোলা চুল আঁচড়ে নিতে লাগল।
“কত সুন্দর লম্বা চুল ছিল তোমার, কেটে ফেলেছ?”
হঠাৎ সুখবিন্দরের কথা ভেসে আসে। আয়নার থেকে মুখ সরিয়ে ওর দিকে তাকাল বিদিশা। সুখবিন্দর ওর দিকেই অপলক তাকিয়ে আছে। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত বোধ করে বিদিশা। অপ্রস্তুত সুখবিন্দর নিজেও। মুহূর্তেই চোখ নামিয়ে নিল সে। তারপর হেসে বলল, “না…, মানে, ছোট চুলেও তোমাকে ভালো লাগছে।”
“তোমার স্ত্রীর নিশ্চয়ই লম্বা চুল?”
“কিছুটা। তবে তোমার যেমন ছিল, তেমন লম্বা নয়।”
“তার কথা কিছু বলো। সে কোথাকার মেয়ে? সেও কি বাঙালি?”
“নাহ, আমার বাবার মতো ভাগ্য আমার নেই।” বলেই সরবে হেসে ফেলল সুখবিন্দর। যোগ করল, “সে চণ্ডীগড়ের মেয়ে। আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের মধ্যেই বিয়েটা হয়েছে।”
“পঞ্জাবী মেয়েরা দেখতে সাধারণত খুব সুন্দর হয়। তোমার স্ত্রীও নিশ্চয়ই সুন্দরী।”
এর উত্তরে শুধু হাসল সুখবিন্দর। একটুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠল, “দাঁড়াও তোমাকে ওর ফটো দেখাচ্ছি।” বলেই নিজের ফোনটা এগিয়ে দিল সুখবিন্দর। বিদিশা দেখল, ফোনের ডিসপ্লে স্ক্রিনেই স্ত্রী এবং এক তরুণের ছবি দিয়ে রেখেছে সুখবিন্দর।
ছবির দিকে তাকিয়ে বিদিশা বলল, “সঙ্গে বুঝি ছেলে?”
“হ্যাঁ।”
“তোমার গিন্নি তো ভারী সুন্দর। তোমার সঙ্গে মানানসই।”
হাসল সুখবিন্দর। বলল, “আসলে কী জানো, সৌন্দর্য্য বিষয়টা সব সময়ই আপেক্ষিক। তোমার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে আমার যখন প্রায় পাগল পাগল অবস্থা, তখন এক প্রকার ধরে বেঁধেই আমার বিয়ে দিয়ে দিল মা ও বাবা। বিয়ের প্রথম প্রথম প্রীতমকে আমার মোটেই তেমন ভালো লাগত না। আমার চোখ আসলে ওর মধ্যে তোমাকে খুঁজত। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন প্রীতমের ভালোবাসা অনুভব করতে লাগলাম, ওর রূপের মাধুর্য্যও আবিষ্কার করা শুরু করলাম। প্রীতম সত্যি খুব ভালো মেয়ে। ভীষণ নরম মনের, এবং সহজ সরল। আর এটাই ওর সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য্য।”
কোথাও কি বিঁধল বিদিশার? ভেতরে একটা শূন্যতা খাঁ খাঁ করে উঠল যেন। দীর্ঘশাস চাপল সে। বলল, “বাহ, ভালো লাগছে শুনে। আর ছেলে কী করছে?”
“সে হয়েছে আমার মতোই। সাহিত্য প্রেমী। মোটেই উচ্চাকাঙ্খী নয়। কেরিয়ার সম্পর্কেও উদাসীন। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত বিজ্ঞান নিয়ে পড়ল। রেজাল্টও খুব ভালো করল। কিন্তু এর পরেই গোঁ ধরল, আর বিজ্ঞান পড়বে না। অর্থাৎ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার মোটেই তার ইচ্ছে নেই। সে সাহিত্য নিয়ে পড়তে চায়। তার মায়ের খুব শখ ছিল, ছেলে ডাক্তার হোক। তাই প্রথমটায় কিছুটা আপত্তি করেছিল। শেষ পর্যন্ত ছেলের জেদের কাছে হার মানে। আমি অবশ্য তার ইচ্ছেতে কখনওই কোনও বাধা দিইনি। যাইহোক, ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে মাস্টার্স করেছে সে। এখন পি-এইচ-ডি করছে জে-এন-ইউতে। আর একটা প্রাইভেট কলেজে পার্টটাইম পড়াচ্ছে। নিজের খরচটা উঠে যায় এতে।”
“বাহ, বেশ তো। তা হলে বাপকা বেটাই হয়েছে।”
“তা বলতে পারো।” সুখবিন্দরের মুখে এখন গর্বের হাসি। জিজ্ঞেস করল, “আর তোমার ছেলেমেয়ে?”
“ছেলে নেই। একটিই মেয়ে। সে ইঞ্জিনিয়ারিং করে এম-বি-এ করেছে। এখন একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ করছে। দিল্লীতে। ওর ওখানেই যাচ্ছি।”
“বাহ, বাহ। খুব ভালো। মেয়েও তোমার স্বাবলম্বী হয়ে গেছে। আমাদের তা হলে বয়স কম হয়নি, কী বলো?”
“সে তো বটেই। সত্যি দিন যে কীকরে পেরোয়!”
বিদিশা খেয়াল করল, পুরো কম্পার্টমেন্ট ঘুমিয়ে পড়েছে। অন্তত বিছানা করে শুয়ে পড়েছে সবাই। কেবল ওরা দু’জনই জেগে বসে আছে। সুখবিন্দর বলল, “রাত হচ্ছে, শুয়ে পড়া যাক। বাকি গল্প কাল হবে।”
বিদিশা জবাবে শুধু মাথা ঝাঁকাল। তার পর দু’জনের বেডরোল খুলে নিজের নিজের বিছানা পেতে নিল। বিদিশা গায়ে চাদর টেনে শুয়ে পড়ার সময় দেখল, সুখবিন্দর ফোনে কথা বলছে। মৃদু এবং মধুর আবেগী স্বরে। পঞ্জাবী ভাষায় বলছে সে। কিন্তু বিদিশা স্পষ্ট বুঝল, স্ত্রীর সঙ্গেই কথা বলছে সুখবিন্দর। গল্প করছে, খোঁজখবর নিচ্ছে, ঠাট্টা করছে। বিদিশার বুকের ভেতরের পুরোনো এক শূন্যতা আবার উজিয়ে উঠল। কই, উত্তম তো কখনও এভাবে ওকে ফোন করে না!
এই যে এতক্ষণ ধরে জার্নি করছে, তাও আবার প্রথম একা একা যাচ্ছে, উত্তম তো একবারও ফোন করে খবর নিল না ওর! নিজেই ফোন নিয়ে উত্তমকে মেসেজ করতে হোয়াটস অ্যাপ খুলল সে। দেখে উত্তম অনলাইনেই আছে। অর্থাৎ কারও সঙ্গে কিংবা অনেকের সঙ্গেই হয়তো বার্তা চালাচালি করছে সে। তবে সে লিস্টে বিদিশা যে নেই, সে তো বোঝাই যাচ্ছে। খুব কান্না পাচ্ছে বিদিশার। আর কোনও মেসেজ না করে ফোন রেখে দিল সে।
ঘুম যে সহজে আসবে না আজকে, সে তো আগেই অনুমান করেছিল, কিন্তু সে যে একেবারেই ধরা দেবে না সেটা বিদিশা ভাবতে পারেনি। রাত অনেক হলেও তাই চোখ বুজে নির্ঘুম শুয়ে আছে ও। বেশ কিছুক্ষণ স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার পরে সুখবিন্দরও ফোন রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। সামনের পর্দা টেনে দেওয়াতে ভেতরটা পুরো অন্ধকার। সেই অন্ধকারেই চোখ মেলে শুয়ে আছে বিদিশা। অজস্র ভাবনা জড়ো হচ্ছে মনে। চাড়া দিয়ে উঠেছে স্মৃতির পাহাড়। …সুখবিন্দরের মা ও বাবা দু’জনেই খুব পছন্দ করতেন বিদিশাকে। মনে মনে ওকে তাঁরা পুত্রবধু হিসেবে মেনেও নিয়েছিলেন যেন। সুখবিন্দরের সঙ্গে বহুবার ওদের বাড়িতে গিয়েছে বিদিশা। অবশ্যই বাড়িতে না-জানিয়ে, গোপনে। বেশিরভাগই কলেজ থেকে। আর যতবার গিয়েছে প্রতিবারই উষ্ণ আপ্যায়নে ভরিয়ে দিয়েছেন ওর মা বাবা দুজনেই।
সুখবিন্দরদের বাড়ির সবচেয়ে বেশি যেটা ভালো লাগত বিদিশার, সেটা হল খোলামেলা পরিবেশ। সবার সঙ্গে সবাই বড় সহজ। কারও আচরণেই কোনও জটিলতা দেখেনি সে। বাবা মা ও ছেলে যেন তিন বন্ধু। পরস্পরকে নির্দ্বিধায় নিজেদের মনের কথা বলছে, সমস্যার কথা জানাচ্ছে, হাসি আনন্দ করছে। কোথাও কোনও অতিরিক্ত শাসন, আদেশ, নির্দেশের ঘনঘটা ছিল না। ফলে কোনও গোপনীয়তারও প্রয়োজন হত না। সুখবিন্দর সহজেই তাই বিদিশার কথা বাড়িতে জানাতে পেরেছিল।
এর ঠিক উল্টোটা ছিল বিদিশাদের বাড়িতে। বাবা ছিলেন রগচটা স্বভাবের। তাঁর সঙ্গে কথা বলতেই ভয় হত। তুলনায় মা ছিল সহজ। মাকেই তাই অকপটে সব বলত বিদিশা। যে কথা বাবাকে বলার, সেটাও মায়ের মাধ্যমেই পৌঁছাতে চাইত। কিন্তু মা যে খুব সূক্ষ্ম ভাবে এক দ্বৈত ভূমিকা পালন করে আসছিল, সেটা বুঝতে অনেকটা সময় লেগেছে ওদের ভাইবোনের। সময়মতো বুঝতে পারলে হয়তো জীবনটা আজকে অন্যরকম হতেও পারত।
অনেক পরে ধীরে ধীরে বুঝেছে, ওদের সংসারটা আসলে চলে মায়ের ইচ্ছে মতোই। মা সরাসরি কোনও কথার বিরোধিতা করত না। সব কেবল শুনে যেত শান্ত হয়ে, বন্ধুর মতো। কিন্তু বাবার কাছে সেগুলোই পৌঁছে দিত নিজের মতো করে রং মিশিয়ে। আর বাবা সেটাকেই সত্য মেনে প্রতিক্রিয়া জানাত। অর্থাৎ বাবার সমস্ত বকাঝকা, আদেশ, নির্দেশের পিছনে কাজ করত মায়েরই ইচ্ছে। বাবার রাগ কিংবা বিরোধকে উস্কে দিত মা-ই।
আগে বুঝত না, কিন্তু কালে কালে বিদিশা বুঝেছে, বাবার কঠোর দাম্ভিক মানুষটার ভিতরে বাস করত একজন বোকা হেরো মানুষ। যে নিজের গুরুত্ব বোঝাতে অদ্ভুত এক ইগোর কস্টিউম পরে থাকত। অন্যদিকে মা ছিল অত্যন্ত চতুর। এক সহজ সরল ছাপোষা মহিলার ছদ্মবেশে বাবার সেই ইগোকেই তুষ্ট করে গেছে মা। আর এভাবেই তাঁকে একেবারে বশীভূত করে পুরো সংসারে নিজের ইচ্ছেকেই বহাল রেখে গেছে।
এই পঞ্চাশ পেরনো বয়েসে এসে বিদিশা জানে, ঘরে ঘরে এমন কিছু মানুষ থাকে, যাদের আপাত চোখে যা দেখায়, আদতে তাঁরা সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। বিদিশার ভাইয়ের বৌ রাই বলে, ‘মা এমনিতে লেখাপড়া না জানলে কী হবে, সাংসারিক বুদ্ধিতে পি-এইচ-ডি করেছেন।’ মা সম্পর্কে ভাইবৌ-এর পর্যবেক্ষণটাই একদম যথাযত মনে হয় ওরও। ওরা ভাই বোনের কেউই মায়ের মতো হতে পারেনি। ছক কষে, হিসেব মেপে চলতে শেখেনি। সে জন্যেই হয়তো প্রতি পদক্ষেপে হোঁচট খেতে হয়।
তখনও ডিগ্রির ফাইনাল পরীক্ষা হয়নি, এরই মধ্যে ছোটমামা হঠাৎ এক বিয়ের সমন্ধ নিয়ে হাজির। নিজের বাবার বাড়ি সম্পর্কে মা বরাবরই অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর। বাবার বাড়ি ও শ্বশুরবাড়িকে মা অদ্ভুত সাদা-কালোয় দেখত। তার বাবার বাড়ির সবই ভালো, কিন্তু শ্বশুরবাড়ির সবই খারাপ। এই মনোভাব দুই দশকের বেশি সংসার করেও একটুও বদলায়নি। সুতরাং ছোটমামার যে কোনও প্রস্তাবই যে সে গুরুত্ব দিয়ে দেখবে সেটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হল না। পাত্র কেমন, তার পরিবার কেমন, ইত্যাদি সব গৌণ হয়ে গেল। ‘ছোটদা’ সমন্ধ এনেছে, সেটাই মায়ের কাছে বড় কথা।
বিদিশা তখন রীতিমতো বিপাকে। সুখবিন্দরের সঙ্গে প্রেমে ডুবে আছে সে। কিন্তু বাড়িতে বলার সাহস হয়নি এখনও। বাবাকে বলবে সে সাহস তো নেইই, যা বলার মাকেই বলতে হবে। নইলে দেখাশোনা শুরু হয়ে গেলে অবস্থা আরও জটিল হয়ে উঠবে।
অগত্যা এক বিকেলে, বাবা তখনও কাজ সেরে ফেরেনি, অনেক দ্বিধা ও সঙ্কোচ নিয়ে মাকে সব খুলে বলেছিল সে। সব শুনে মা জিজ্ঞেস করেছিল, “কী করে ছেলেটা?”
“এত দিন যখন এখানে ছিল, তখন পড়াশোনার পাশাপাশি ওর বাবার ব্যাবসাও দেখত। কিন্তু এখন কলকাতায় থেকে চার্টার্ড একাউন্টেন্সি পড়ছে। এর পর নিজের ফার্ম খোলার ইচ্ছে আছে ওর।”
মা আপাতভাবে কোনও বিরাগ দেখায়নি। বন্ধুর মতোই শান্ত স্বরে বলেছিল, “সব তো বুঝলাম, কিন্তু এখন তোর ছোটমামা জানলে কী ভাববে বলতো? সে এত সাধ করে ভালো একটা সমন্ধ আনল ভাগ্নীর জন্যে, আর সেই ভাগনি কিনা বেজাতের কোনও ছেলের সঙ্গে ভালোবাসা করে বসে আছে!”
“প্লিজ মা, মামাকে আর বাবাকে বুঝিয়ে বোলো। সুখ খুব ভালো ছেলে।”
মা মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল, “ঠিক আছে। দেখি কী হয়।”
মাকে বোঝাতে পেড়েছে ভেবে, এবং মায়ের সাহায্য পাবে ভেবে আশায় বুক বেঁধেছিল বিদিশা। তখনও কি একবারও ভাবতে পেরেছিল, পুরো বিষয়টাই বিকৃত হয়ে পৌঁছে যাবে আগে বাবা, তার পর মামার কাছেও! এর পরেই প্রথম মায়ের আসল রূপটা স্পষ্ট হয়েছিল ওর কাছে। কিন্তু তখন আর করার কিছুই ছিল না।
অন্ধকারে নিঃসাড় পড়ে অতীতচারণে মগ্ন হয়ে ছিল বিদিশা, তখনই বাঁ দিক থেকে হঠাৎ একটা হইহট্টগোল ভেসে আসে। এক নারীকন্ঠের আকুল কান্নার আওয়াজও শোনা যায়। দেখা গেল কমবেশি সবাই জেগে গেছে। আওয়াজের উৎসের দিকে দু’-এক জন ছুটে গেল। সুখবিন্দরও উঠে পড়েছে। উঠেই ছুটল সেদিকে। বিদিশা উঠে বসে ওদিকে যাবে কিনা ভাবছিল, তখনই একজন হাঁক পাড়তে পাড়তে এদিকে এগিয়ে এল, “এখানে কোনও ডাক্তার আছেন, প্লিজ একবার আসুন। ইমার্জেন্সি আছে…।”
এক জনকে বলতে শোনা গেল, “পাশের কম্পার্টমেন্টে একজন আছেন। ওখানে খবর নিন।”
উঠে পড়ল বিদিশাও। মাঝের একটা কুপ পরেই ভিড় জমেছে। বিদিশারই বয়সী এক মহিলা কেঁদে কেঁদে সাহায্য প্রর্থানা করছে। একটা বার্থে শোওয়ানো জ্ঞানহীন এক জন। ভদ্রমহিলার স্বামী। জানা গেল, প্রৌঢ় ভদ্রলোক আপাতভাবে সুস্থই ছিলেন। রাতের খাবার খেয়ে শুয়েও পড়েছিলেন। এর পর একবার উঠে টয়লেটে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখান থেকে ফিরে নিজের বার্থে ওঠার সময়ই হঠাৎ পড়ে যান। কীকরে পড়লেন সেটা কেউ দেখেনি। তবে পড়ে যাওয়ার শব্দে ওঁর স্ত্রী এবং আরও দু’-এক জন জেগে ওঠে। তাঁরা দেখেন, ভদ্রলোক জ্ঞান হারিয়েছেন। লোকে বলাবলি করছে, সম্ভবত স্ট্রোক করে গেছে। যেটাই হোক, চূড়ান্ত অসহায় অবস্থা ভদ্রমহিলার।
বিদিশা ভদ্রমহিলাকে ধরে শান্ত হতে বলে। যদিও শায়িত ভদ্রলোককে দেখে ওর ঠিক ভালো মনে হচ্ছে না। তবু এই মুহূর্তে ওঁর স্ত্রীকে মানসিক জোর জোগানো আবশ্যক ভেবে সে সেটাই করতে চেষ্টা করে। ভদ্রমহিলার পাশে বসে বলে, “এত ভেঙ্গে পড়বেন না দিদি। সব ঠিক হয়ে যাবে। এত বড় ট্রেনে নিশ্চয়ই কোনও ডাক্তার পাওয়া যাবে।”
দেখা গেল, এখনও মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব বেঁচে আছে। কম্পার্টমেন্টের অনেকেই ছুটে এসেছেন তাঁর সাহায্যে। ইতিমধ্যে এক জন নয়, দু’জন চিকিৎসক যাত্রীরও সন্ধান পাওয়া গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে তারাও চলে এলেন।
এর পরের কয়েক ঘণ্টা ভয়ানক উৎকণ্ঠায় কাটল। ভদ্রলোক নিথর পড়ে আছেন। ডাক্তার দু’জন চেষ্টা করেও অবস্থার বিশেষ উন্নতি করতে পারেননি। কানপুর বা এর আশেপাশে কোথাও ওঁদের কোনও আত্মীয় আছে। ভদ্রমহিলার থেকে জেনে তাঁদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হয়েছে। তাঁরা সম্ভবত চিকিৎসার জোগাড়যন্ত্র করে কানপুর স্টেশনে ভদ্রলোককে এবং ওঁর স্ত্রীকে নামিয়ে নেবেন। কানপুর আসতে আরও কিছুটা দেরি আছে। বিদিশা মনে মনে প্রার্থনা করে, ততক্ষণ যেন ভদ্রলোককে ঠিক রাখেন ঈশ্বর।
কানপুরের ব্যবস্থা হওয়ার পরে সেখানের ভিড়টা ধীরে ধীরে সরে গেল। ডাক্তার দু’জনও চলে গেলেন। তবে দরকার হলেই আসবেন, কথা দিয়ে গেলেন। ভদ্রমহিলাকেও শুতে বলল সবাই। যদিও তিনি না শুয়ে স্বামীর মাথাটি কোলে তুলে হেলান দিয়ে বসে রইলেন। বিদিশাকে নিজের বার্থে পাঠিয়ে দিল সুখবিন্দর। তবে সে নিজে বসে রইল ভদ্রমহিলার ফাঁকা সিটে। সুখবিন্দরের সঙ্গে আরও একটি ছেলে জেগে রইল।
বার্থে এসে শুলেও বাকি রাতটায় একেবারেই ঘুম হল না বিদিশার। বার বার অসহায় ভদ্রমহিলা এবং ওর স্বামীর কথা মনে পড়ছিল। সুখবিন্দর তো প্রায় সারাক্ষণ ওখানেই বসে রইল। সেই আগের মতোই এখনও ওর পরপোকারী স্বভাবটা আছে। ভদ্রমহিলার হয়ে তাঁর থেকে নম্বর নিয়ে পরিচিতদের ফোন করা, চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, সব সেই করছে। আরও দু’-একজন লোকও অবশ্য সাহায্য করছে।
শুয়ে শুয়ে নানা এতাল বেতাল ভাবনায় কেবল এপাশ ওপাশ করে চলল বিদিশা। এই ভদ্রলোকের জন্যে ভাবনা তো আছেই, সেই সঙ্গে দুশ্চিন্তা হচ্ছে উত্তমের কথা ভেবেও। ভদ্রলোক উত্তমের সমবয়সীই হবে। এই বয়সটা খুব বিপজ্জনক। শরীরে কখন কী সমস্যা যে দুম করে হাজির হয়, তার ঠিক নেই। উত্তমকে তাই একা রেখে আসতে ওর মন চায়নি। খাওয়া-দাওয়া-ঘুমে একটু অনিয়ম হলেই উত্তমের অসুবিধে হয়। তাই সন্ধ্যাকে পইপই করে সব বুঝিয়ে আসতে হয়েছে। কিন্তু তাতেও কি চিন্তা যায়? কাজের লোকের উপরে কতটাই বা ভরসা করা যায়?
এ সব নানা ভাবনা এবং অস্থিরতার মধ্যেই কখন যে ভোর হয়ে গেল খেয়ালই করেনি। মোবাইল তুলে দেখে পৌনে পাঁচটা বাজে। এ সময়ে উত্তম উঠে পড়ে। ঠিক সাড়ে পাঁচটা নাগাত মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে পড়া ওর অভ্যাস। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা যেটাই হোক, উত্তমের রুটিনের সাধারণত নড়চড় হয় না। তাই উত্তমকে ফোন করল বিদিশা।
দু’-চারবার রিং হওয়ার পরেই ঘুম জড়ানো স্বরে জবাব এল, “হ্যালো…”
আওয়াজটা চিনতে আধ সেকেন্ড সময় লাগে বিদিশার। পর মুহূর্তেই সারা শরীর কেঁপে ওঠে। সন্ধ্যা! সন্ধ্যা উত্তমের ফোন ধরল কেন? সন্ধ্যার তো এখন নিজের ঘরে থাকার কথা। সাড়ে সাতটা-আটটার আগে সন্ধ্যা কখনও ওর ঘর ছেড়ে বেরোয় না। যদিও ফ্ল্যাটের সঙ্গে লাগোয়া সার্ভেন্ট কোয়ার্টার, সন্ধ্যার থাকার ঘর, কিন্তু সেটা বাইরের দিকে খোলে। তাই ঘুম থেকে উঠে একেবারে মুখটুখ ধুয়ে স্নান সেরে কাপড় পাল্টে তবেই সন্ধ্যাকে কাজে আসতে বলে বিদিশা। এর আগে সকালের চা-টা নিজেই করে নেয়। তা হলে এই ভোরে সন্ধ্যা ওদের বেডরুমে কী করছে?
তড়িতাহতের মতো শোওয়া থেকে উঠে বসে বিদিশা। মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, “তুই আমাদের বেডরুমে কী করছিস সন্ধ্যা? তোর দাদা কোথায়?”
ইতিমধ্যে সজাগ হয়েছে সন্ধ্যাও। ঘুমের ঘোরে ফোনটা ধরে ফেলে যে মস্ত বিপাকে পড়েছে, সেটা বুঝতে পারছে সে। তাই আমতা আমতা করে কিছু বলতেই যাচ্ছিল, এর আগেই ফোন নিয়ে নিয়েছে উত্তম। কোনও ভূমিকা ছাড়াই সে বলে উঠল, “কী ব্যাপার বলো? সাত সকালে ফোন করলে কেন?” উত্তমের স্বর রুক্ষ। প্রতিটা শব্দে অসন্তোষ ঝরে পড়ছে।
এই প্রশ্নের সামনে এখন কথা হারায় বিদিশা। একটুক্ষণ থমকে থাকে। তার পরে বলে, “সন্ধ্যা আমাদের ঘরে কী করছে?”
“আহ! তুমি কি এই জাসুসি করার জন্যে ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফোন করছ নাকি?” খিঁচিয়ে ওঠে উত্তম। অসীম বিরক্তি নিয়ে বলে চলে, “ওফ! হেল করে দিল জীবনটা। কেবল সন্দহ! এত সন্দেহবাতিক মেয়েছেলের সঙ্গে ঘর করা যায়? …আরে! সন্ধ্যাকে আমি ডেকে এনেছি গরম জল করে দেওয়ার জন্যে। সেটাও করতে মানা নাকি?” রেগে গেলে উত্তমের গা থেকে আপাত শালীনতার মোড়কটা খসে খসে পড়ে। তাই স্ত্রীকে কাজের লোকের সামনে অনায়াসে মেয়েছেলে বলে ফেলে।
বিদিশা অস্ফুটে শুধু বলে, “গরম জল! কীসের জন্যে? তুমি তো গরম জল খাও না?”
“খাই না বলে কি দরকারেও খাব না? ঠান্ডা লেগে গলাটা বসেছে বলেই ওকে গরম জলের কথা বলে আমি বাথরুমে ঢুকেছিলাম। অমনি তোমার ফোন। তাই সন্ধ্যা ধরেছে। তাতে কী এমন অশুদ্ধ হল? নিজের মনটাকে পরিষ্কার করো বুঝলে? তা হলে নিজেও শান্তিতে থাকবে, আমাকেও শান্তি দেবে।” বলেই ফোন কেটে দিল উত্তম।
ফোন হাতে থ হয়ে হয়ে বসে থাকে বিদিশা।
কতক্ষণ পাষাণ প্রতিমার মতো বসে আছে কে জানে, সম্বিৎ ফেরে দমকা কান্নার আওয়াজে। বিদিশা বোঝে পাশের সেই ভদ্রলোক আর নেই। কানপুর আসা পর্যন্ত সময় দিলেন না তিনি। ট্রেন যাত্রাতেই পারি দিয়েছেন অনন্ত যাত্রার পথে। ভদ্রমহিলার বুকফাটা কান্না অনুরণন ঘটিয়ে চলে পুরো কম্পার্টপমেন্টের ভিতরে।
ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে বিদিশাও। ভেতরের সমস্ত দহন নিংড়ে দমকে দমকে কেঁদে চলে সে। এক জনের স্বজন হারানোর কান্না এবং ওর বিশ্বাস হারানোর কান্না মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
পিঠে নরম স্পর্শ পেয়ে কান্না থামিয়ে ঈষৎ মুখ তোলে বিদিশা। দেখে নিকিতা মেয়েটি সান্ত্বনার হাত রেখে পাশে এসে বসেছে। সামনে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে সুখবিন্দর। অপ্রস্তুত বোধ করে বিদিশা। কী বলবে ভেবে পায় না। সালোয়ারের ওড়না দিয়ে চোখ মুছে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পারছে কই? ভেতর থেকে দলা দলা কষ্ট হু হু করে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সুখবিন্দর আলতো করে ওর হাতে হাত রেখে বলে, “তুমি বদলাওনি দিশা। এখনও সেই আগের মতো নরম মনের আছো।”
নিকিতা একটু অবাক হল যেন। বলল, “আপনারা পরস্পরকে চেনেন?”
ওর জিজ্ঞাসু মুখের দিকে তাকিয়ে সুখবিন্দর ওকে বলল, “হুম। আমরা একে অপরকে বহু আগের থেকে চিনি। একই কলেজে পড়েছি। এবং দু’জন দু’জনের খুব ভালো বন্ধু।”
‘বন্ধু’ শব্দটা যেন কানে বাজে বিদিশার। পরক্ষণেই অবশ্য ভাবে, বন্ধু ছাড়া আর কীই বা বলতে পারত সুখবিন্দর? কথার পিঠে কথা রেখে নিকিতা বলে, “ও আচ্ছা, আপনারা তা হলে একসঙ্গেই রিজার্ভেশন করেছেন?”
“উহু।” স্মিত হেসে বলল সুখবিন্দর, “ইন ফ্যাক্ট আমরা জানতামই না যে আমরা একই ট্রেনে যাচ্ছি। আরও মজার কথা হল, ওর স্বামী টিকিট ক্যান্সেল করেছিলেন বলেই আমি এই বার্থটা পেয়েছি।”
ইতিমধ্যে প্যান্ট্রি থেকে সবার জন্যে চায়ের সরঞ্জাম রেখে গিয়েছে। নিকিতা জিজ্ঞেস করল, “আন্টি আপনাদের চা-টা সার্ভ করব? চা খেয়ে দেখুন ভালো লাগবে। কাল তো আপনারা কেউ ঘুমোতে পারেননি।”
সুখবিন্দর হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। খুব ক্লান্ত সেও। রাতে ঠায় বসেছিল ওই ভদ্রলোকের ওখানে। মাঝে দু’বার উঠে শুধু পাশের কম্পার্টমেন্টে গিয়ে ঘুমন্ত বাবাকে দেখে এসেছে। বাকি সময় ভদ্রমহিলাকে সঙ্গ দিয়ে তাঁর স্বামীর কাছে বসে থেকেছে। একটু এদিক ওদিক বুঝলেই ফোন করেছে ডাক্তারদের কাউকে। তা সত্ত্বেও শেষ রক্ষা হল কৈ? মনটা বড় বিষণ্ণ হয়ে আছে তারও।
ঐ ভদ্রমহিলার কান্নার আওয়াজ এখনও আসছে। এখন সেটা গোঙ্গানির মতো শোনাচ্ছে। পুরো কম্পার্টমেন্টেই শক প্রবাহ চলছে। চারপাশে থমথমে ভাব। বিদিশার খুব ইচ্ছে করছে ভদ্রমহিলার কাছে যায়। কিন্তু গিয়েই বা কি করবে? কতটুকু সান্ত্বনা দিতে পারবে? তা ছাড়া নিজেই যে বড় ভেঙ্গেচুড়ে আছে এখন। এমন অবস্থায় অন্যকে সান্ত্বনা দেওয়ার শক্তি ওর নেই।
বিদিশা এবং সুখবিন্দরকে চা সাজিয়ে দিয়ে নিজেও চা নিল নিকিতা। সে বসে আছে বিদিশার পাশেই। বিদিশার অন্য পাশে সুখবিন্দর। ট্রেন কানপুর ঢুকি ঢুকি করছে। আর দশ পনেরো মিনিটের মধ্যেই স্টেশন পেয়ে যাবে। হয়তো পরিবেশ একটু স্বাভাবিক করতেই নিকিতা আলাপ জুড়ল। সুখবিন্দরকে উদ্দেশ করে বলল, “কত দিন পরে আপনাদের দেখা হল আঙ্কেল?”
একটু আনমনা ছিল সুখবিন্দর। তাই প্রশ্নের খেই ধরতে না-পেরে বলল, “কাদের দেখা হওয়ার কথা বলছ?”
“আপনার এবং এই আন্টির। আপনি যে বললেন আপনারা বহু পুরোনো বন্ধু, তাই জিজ্ঞেস করলাম কতদিন পরে আবার আপনাদের দেখা হল?”
“এগজাক্টলি উনত্রিশ বছর পাঁচ মাস এগারো দিন পর।” বলল সুখবিন্দর।
জবাব শুনে নিকিতার দুই চোখ কপালে উঠেছে। মুহূর্তের জন্যে বাক্যহারা সে। তার পরেই চোখেমুখে বিস্ময়ভাব ধরে রেখেই বলে উঠল, “এত হিসেব করে রেখেছেন, আঙ্কেল!”
সুখবিন্দরও হাসে। বলে, “কিছু কিছু সম্পর্ক এমনই হয়। সব মনে থাকে।”
নিকিতা কী বুঝল কে জানে! একই বিস্ময়ভাব নিয়ে সে এবার বিদিশার দিকে তাকাল। বিদিশার চোখ ছলছল করছে। তবু সে হাসার চেষ্টা করে।
ঠিক তখনই সুখবিন্দরের ফোন বেজে ওঠে। ওর স্ত্রীর ফোন। ফোন কানের সামনে ধরে সুখবিন্দর উঠে গিয়ে এবার নিজের বার্থে বসল। বিদিশা দেখল কী আবেগ নিয়ে কত স্বাভাবিক ভাবে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছে সুখবিন্দর। কোনও তাড়া দেখাচ্ছে না, বরং নিজেই সময় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব খবর নিচ্ছে। স্ত্রীর খবর তো বটেই পোষ্যদের খবর, কাজের লোকেদের খবর, এমনকি বাড়ির বাগানের গাছেদের খবর পর্যন্ত! কিছুই বাদ যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ বার্তালাপ করে সুখবিন্দর উঠে দাঁড়াল। নিকিতার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি একটু পাশের কম্পার্টমেন্টে যাচ্ছি। তুমি আন্টির সঙ্গেই বোসো, কেমন?”
এর পরে বিদিশার দিকে ঘুরে বলল, “বাবা আমাকে ডাকছেন। আমাকে ফোনে না পেয়ে প্রীতমকে ফোন করেছিলেন। আমি একটু গিয়ে আসছি।”
বিদিশা হাত উঠিয়ে ওকে যেতে বলে।
নিকিতা যেন এরই অপেক্ষায় ছিল। সুখবিন্দর চলে যেতেই বিদিশার দিকে আরও একটু সরে এল সে। তারপর লাজুক মুখে বলল, “আমি অনির্বাণের ফোন নম্বরটা আনব্লক করে দিয়েছি অ্যান্টি।”
বিদিশার মুখে ঈষৎ হাসি ফোটে। বলে, “খুব ভালো করেছ। সম্ভাবনার সব পথ রুদ্ধ করে দিতে নেই।”
বাধ্য মেয়ের মতো মাথা ঝাঁকাল নিকিতা। বলল, “হ্যাঁ, কাল আপনি বলার পরে আমিও এটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। অনির্বাণের প্রস্তাব মানা কঠিন ঠিকই, তবু ভেবে দেখলাম, একটা ব্যাপারে তো আমি নিশ্চিত যে অনির্বাণ আমাকে সত্যি খুব ভালোবাসে। ও কখনও ধোঁকা দেবে না। ওকে আমি ছোটবেলার থেকে চিনি, অনেক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আমরা গিয়েছি, অনেক মনোমালিন্য ঝগড়াঝাটিও হয়েছে, কিন্তু যত খারাপ পরিস্থিতিই হোক, ও আমাকে কখনও ফাঁকি দেয়নি, মিথ্যে বলেনি। সেটা তো কম বড় কথা নয়। দেখলাম, সম্পর্কে সবচেয়ে বড় জিনিস হল পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস। সেটা না থাকলে, কিংবা কেউ সেটার মর্যাদা না-দিলে সব ফাঁকা। সব অর্থহীন হয়ে যায়। তাই একটু আগেই ওকে আনব্লক করে দিলাম।”
একটু যেন আঁতকে উঠল বিদিশা। নিকিতা কি তা হলে ওর আর উত্তমের কথোপকথন শুনেছে? সে জন্যেই কি সম্পর্কের ধোঁকা এবং বিশ্বাসের অমর্যাদার প্রসঙ্গ আনল? এবং এর পরেই তা হলে অনির্বাণের নম্বর আনব্লক করেছে? কে জানে! বুঝতে পারে না বিদিশা। তবে মনের মধ্যে খটকা বিঁধে রয়। যদিও সেটা প্রকাশ করল না। শুধু বলল, “খুব ভালো করেছ। পারলে একটা ফোন করে খবর নিও ছেলেটার। বেচারা হয়তো তোমাকে ফোন করে করে ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে।”
হাসল নিকিতা। বলল, “করব। তবে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। দেখি ওর ফোন আগে আসে কিনা। না-এলে আমিই করব।”
ট্রেন এখন কানপুর স্টেশনে। জানলা দিয়ে ভদ্রলোকের মরদেহ নামানো দেখছে বিদিশা। ইচ্ছে করেই আর ভদ্রমহিলার কাছে যায়নি বিদিশা। গিয়েই-বা কী করত? কোনও উপকারে তো আসতে পারত না। যা অঘটন ঘটার তো ঘটেই গেছে। তা ছাড়া এমন পরিস্থিতিতে বড় অসহায় বোধ করে বিদিশা। কী করবে না-করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। নারী পুরুষ মিলিয়ে বেশ ক’জন এসেছে ওঁদের নিতে। ভদ্রমহিলা উথালিপাথালি কাঁদছে। তাঁকে সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে কয়েক জন। স্বজনবান্ধবদের দেখে আরও ভেঙ্গে পড়েছেন তিনি। এটাই স্বাভাবিক।
নিকিতাও নিজের সিট ছেড়ে বিদিশার মুখোমুখি জানলার ধারে এসে বসেছে। সুখবিন্দরের সিটে। সেই পাহাড়ি মেয়েটিও এসে ওর পাশ থেকে উঁকি দিচ্ছে। সবারই মন ভার। এমন একটা ঘটনার যে সম্মুখীন হবে, কে ভাবতে পেরেছিল! সত্যি, মানুষের জীবন যে কত অনিশ্চিত! দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বিদিশার বুকের গভীর থেকে। নিকিতা আনমনে বলে ওঠে, “কোথায় যাওয়ার ছিল, আর কোথায় চলে গেলেন! এমন জায়গায় যেখান থেকে আর কখনও ফেরা যায় না। তাই না আন্টি?”
বিদিশাকে উদ্দেশ করে কথাটা বললেও নীরব থাকে বিদিশা। কেবল নিস্পলক বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। কম্পার্টমেন্টের অনেকেই প্লাটফর্মে নেমে পড়েছে। সুখবিন্দরও আছে। ভদ্রমহিলার লাগেজগুলো কোনও আত্মীয়কে বুঝিয়ে দিচ্ছে সে। সমস্ত বিষয়েই সুখবিন্দরের নজর আছে। এমন দায়িত্ববান এবং সংবেদনশীল মানুষ খুব কম দেখেছে বিদিশা। সম্ভবত নিকিতাও সেটা লক্ষ করেছে। তাই আবার বলে ওঠে, “আঙ্কেল, অর্থাৎ আপনার বন্ধু কিন্তু সত্যি ভীষণ ভালো মানুষ আন্টি। এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কাল সারা রাত আঙ্কেল ওঁদের পাশে জেগে থেকেছে। ভাবুন? নিজের ঘুম-আরাম বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ অপরিচিত কারও জন্যে এতটা কেউ করে! এমনটা অনেক নিজের লোকও করত কিনা সন্দেহ।”
এবারও নীরব থাকে বিদিশা। প্রত্যুত্তরে কিছুই বলে না। তবে সুখবিন্দরের জন্যে গর্বে ভরে ওঠে সে। একই সঙ্গে বুকের ভেতরটা অদ্ভুত খাঁ খাঁ করে ওঠে। এই সুখবিন্দরেরই তো ওর সবচেয়ে কাছের মানুষটি হওয়ার কথা ছিল। প্রেমে ভালোবাসায় জড়িয়ে থাকার কথা ছিল। যদি সেই সময় মায়ের জেদের শিকার হতে না-হত, তা হলে ওর জীবনটাই অন্যরকম হত। কিন্তু শুধুই কি মায়ের দোষ? সে নিজেও কি দায় এড়াতে পারে? আজ এত দিন পরে এসে নিজের নির্বুদ্ধিতা এবং ভীত চরিত্রকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায় বিদিশা।
ওদের সংসারে বাবার কোনও নিজস্ব মতামত কোনও কালেই ছিল না। বাবার যত হম্বিতম্বি, সবটার পেছনে মূল ইন্ধন থাকত মায়েরই। যদিও সেটা বুঝতে অনেক সময় লেগেছে বিদিশার। সুখবিন্দরের সঙ্গে ওর সম্পর্কের কথা জেনে এর বিরুদ্ধে বাবাকে মা-ই বিষিয়ে দিয়েছিল। ফলে বাবা কোনও কথাই শুনতে চায়নি। তাঁর কেবল একটাই কথা, “সমাজে আমার মান সম্মান কিছু নেই? বেজাতির সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়ে নিজের হাতে নাক-কান কাটি আরকি!”
সুখবিন্দররা শিখ ধর্মাবলম্বী। তবে ওর মা বাঙালি হিন্দু। বিদিশা দেখেছে নিয়ম করে গুরুদুয়ারা যাওয়া ছাড়াও ওদের বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো, কালীপূজো থেকে শুরু করে হিন্দুদের বারো মাসে তেরো পার্বণও লেগে থাকত। বস্তুত ধর্ম ওঁদের যাপনচিত্রে ভীষণভাবে থাকলেও, ধর্ম বিভেদের কোনও অস্তিত্বই ছিল না। ওদের বাড়িতে গেলে ধর্মাচারের এই অপূর্ব সহবস্থান মুগ্ধ হয়ে দেখত বিদিশা। অথচ বাবা এটাকেই হাতিয়ার করে এই সম্পর্কের বিরোধ করে গেছে। যদিও পুরোটাই ছিল মায়ের সূক্ষ্ম চাল।
নিজের মান সম্মানের কথা ভেবে মেয়ের ইচ্ছে-অনিচ্ছের টুঁটি চেপে মারতে একটুও বাঁধেনি বাবার। মা সেই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। নিজের ভাইয়ের দেখা পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগে গেল। বাবাকে বোঝাল, তাড়াতাড়ি মেয়েকে পাত্রস্থ না করলে, ভবিষ্যতে মুখ পোড়াবে এই মেয়ে। বিদিশা তখন সবে বি-এ ফাইনাল দিয়েছে। চোখে স্বপ্ন মাস্টার্স করবে, পি-এইচ-ডি করবে। তারপর অধ্যাপনা কিংবা শিক্ষকতার চাকরি করবে। আর অবশ্যই বিয়ে করবে সুখবিন্দরকে।
বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হতেই অশনি সঙ্কেত দেখল বিদিশা। সুখবিন্দর তখন কলকাতায় থাকে। চার্টার্ড একাউন্টেন্সি পড়ছে। এখনের মতো মুঠোফোনের জমানা নয় সেটা। তবু ল্যান্ডফোনে যোগাযোগ ছিল। কিন্তু বিদিশাদের বাড়ির থেকে ফোন করা সম্ভব ছিল না। যা ফোন করার সেটা সুখবিন্দরই করত। এবং সেটাও ওদের বাড়িতে নয়, সহপাঠী তমালীদের বাড়িতে। কিন্তু সম্মুখে বিপদ দেখে সেবার বিদিশাই ফোন করল। তমালীদের বাড়ি যাওয়ার নাম করে রাস্তার পিসিও থেকে ফোন করে সব জানাল সুখবিন্দরকে।
সুখবিন্দর বলেছিল, “একদম ভেবো না তুমি। আমি চলে আসছি। দু’জনে পালিয়ে যাব কোথাও। তারপর নিজেরাই বিয়ে করে নেব।”
সত্যি সত্যি চলেও এসেছিল সুখবিন্দর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পালাতে ভয় পেল বিদিশা। পিছিয়ে গেল সে। বাবার উগ্র মূর্তি, লোকলজ্জার অলীক আশঙ্কা, মায়ের চাপা ক্রোধ, চেনা পরিচিতদের নিন্দের ভয়, সব একত্রে চেপে ধরল ওকে। তা ছাড়া সুখবিন্দর তখনও ছাত্র। বিয়ে করে সংসার চালাবে কী করে? এই প্রশ্নও যে অজ্ঞাতসারে মনের ভেতরে আস্তানা গাড়েনি, সেটাও অস্বীকার করা যায় না। অগত্যা যা হওয়ার তাই হল। না-চাইলেও উত্তমের সঙ্গে বিয়েটা হয়ে গেল সে বছরই।
আপাতচোখে সুপাত্রের যেসব গুণাবলি থাকা দরকার, উত্তমের প্রায় সব ক’টিই ছিল। সুপুরুষ, সুচাকুরে, ছিমছাম পরিবার, ইত্যাদি সবই ছকে ছকে বসানো যায়। কিন্তু কথায় আছে, ‘যে করে ঘর, সে-ই চেনে বর।’ বিদিশাও ধীরে ধীরে চিনল চরম আত্মকেন্দ্রিক প্রেমহীন ভালোবাসাহীন উত্তমকে। বারংবার বিশ্বাসভঙ্গের দরুন ক্ষতবিক্ষতও হল। কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই। সংসারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে ততদিনে। সুতরাং মেনে নিল, মানিয়ে নিল নিজেকে।
মৃদু একটা ধাক্কা দিয়ে ট্রেন আবার চলতে শুরু করেছে। প্লাটফর্ম থেকে হুড়মুড়িয়ে সবাই ট্রেনে উঠে এল। বিদিশা উদ্বিগ্ন হয়ে চারপাশে তাকায়, সুখবিন্দর উঠতে পারল তো? জানলার থেকে এবারে কম্পার্টমেন্টের দিকে নজর ফেরাল সে। সুখবিন্দর ঠিকভাবে উঠেছে কিনা জানার জন্যে অধীর সে। জানলার বাইরে প্লাটফর্মে পড়ে থাকে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়া মানুষটি, এবং তাঁর সঙ্গহারা স্ত্রী ও আত্মীয়রা। সব ছেড়ে ট্রেন এগোয় তার গন্তব্যের দিকে।
এক-দেড় মিনিটের মধ্যেই সুখবিন্দর স্বস্থানে ফিরে এসেছে। ওকে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলে বিদিশা। বিদিশা দেখল, মুখোমুখি উপরের বার্থে থাকা ছেলেটিও ফিরে এসেছে। সেও প্লাটফর্মে নেমেছিল। আগের রাতে সেও অনেকক্ষণ সুখবিন্দরের সঙ্গে বসে ছিল মুমূর্ষু মানুষটির পাশে। সুখবিন্দরের বার্থে নিকিতা বসে আছে দেখে, ছেলেটি এসে বিদিশার পাশটিতে বসল। এসি টু টায়ার। বসার জায়গার অভাব নেই। বিদিশার পাশের লোকটি এখনও উপরের বাঙ্কে শুয়ে। কত যে ঘুমোতে পারে একজন! অবাক লাগে বিদিশার।
ছেলেটির কানে এখনও ইয়ারফোন লাগানো। ফোন বুকপকেটে। এখনও সে কারও সঙ্গে কথা বলে চলেছে। বলছে কম, শুনছে বেশি। খুব কোমল ভাবে কাউকে কিছু বোঝাচ্ছে যেন। স্ত্রীকে কি?
কৌতূহল হয় বিদিশার। কাল রাতে স্ত্রীর সঙ্গে মনোমালিন্য হয়েছিল ছেলেটির। এর পরে বেচারা ঠিকমতো খায়নি। ফোনের ওপাশে বৌটিও খুব কাঁদছিল। এবং সেটা ন্যায্য কারণেই। সেই মন কষাকষি মিটল কিনা জানতে উৎসুক হয় বিদিশা। কৌতূহলে আড়ি পাতে সে।
সুপারফাস্ট ট্রেনের শীততাপনিয়ন্ত্রিত কম্পার্টমেন্টগুলি ভীষণভাবে শব্দ নিরোধকও বটে। বাইরের আওয়াজ যেমন ভেতরে আসতে দেয় না। তেমনই ভেতরে থাকলে বোঝাই যায় না যে ট্রেন চলছে, এবং সবাই ট্রেনের ভিতরে আছে। পরস্পরের সঙ্গে সাবলীল ভাবে কথা বলা যায়। ফিসফিসে কথাও স্পষ্ট শোনা যায়। এখনও যেমন ছেলেটির কথা শুনতে পারছে বিদিশা। যদিও ফোনের ওপারে যে বা যিনি আছেন, তাঁর কথা শোনার উপায় নেই। ছেলেটির কানে ইয়ারপ্লাগ গোঁজা।
দু’-একটি কথা শুনেই বিদিশা বুঝল, মায়ের সঙ্গে কথা বলছে ছেলেটি। ভোজপুরি হিন্দি হলেও বেশ বোঝা যাচ্ছে। খুব নরম স্বরে ছেলেটি বলছে, “একটু বোঝার চেষ্টা করো মা। সে তো অন্য বাড়ি থেকে সম্পূর্ণ নতুন একটা সংসারে এসেছে। ওকে আপন করে নিতে হবে আমাদেরই। ওকে ভালোবাসা দিয়ে বোঝাতে হবে যে, আমরা ওর শত্রু বা পর নই। বরং একদম আপনজন। ও নিজেও আপ্রাণ চেষ্টা করছে সবার সঙ্গে মানিয়ে নিতে। …আমি জানি তুমিও ওকে ভালোবাসো মা। কিন্তু ওকে হয়তো বোঝাতে পারছ না। একটু চেষ্টা করো না মা। বোনদেরও বুঝিয়ে বলো। পারলে তুমিই পারবে মা…।”
শুনতে শুনতে মনটা ভালো হয়ে যায় বিদিশার। ছেলেটা যে স্ত্রী এবং মা-বোনেদের মাঝে সেতু তৈরি করতে চাইছে, সেটা বুঝে বড় আনন্দ হয় ওর। কতই বা বয়স হবে ছেলেটার? বড়জোর আঠাশ-ত্রিশ। এর কমও হতে পারে। অথচ কত পরিণত বুদ্ধির! কত বোঝদার ও বিচক্ষণ!
এমন সময় ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেল। যে যার ট্রে তুলে নিয়েছে হাতে। কম্পার্টমেন্টের ভেতরটা ভরে উঠেছে মৃদু গুঞ্জনে। একটু তফাতেই কোথাও খুব হাসাহাসি চলছে। একটা ছোট বাচ্চা মা কিংবা বাবার স্মার্টফোন খুলে জোরে জোরে গান চালিয়ে খুব হুল্লোড় করছে। বাকি যাত্রীরাও যে যার গল্প আড্ডায় মেতে উঠেছে। আবার যেন স্বাভাবিক হয়ে আসছে পরিবেশ। যেন কোনও অঘটন কোথাও ঘটেনি। সেই মৃত মানুষটি আর কারও স্মৃতিতে নেই। বিদিশা মনে মনে ভাবে, এই তো জীবন! যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে, তখন চারপাশে অজস্র বলয় ঘিরে থাকে আমাদের। কিন্তু সেই প্রাণ চলে যেতেই সব শেষ। খুব আপনজন হলে দিন কয়েক মনে রাখে, শোক ভোগ করে, কিন্তু অন্যরা তো তাও করে না।
ট্রের মধ্যে থাকা পদগুলির মোড়ক খোলে বিদিশা। ব্রেড, বাটার এবং জ্যামের প্যাকেট, অমলেট আর একটা ছোট্ট কাটলেটের মতো জিনিস। সঙ্গে দু’-চার কুচি গাজর আর শসা। উল্টোদিকে বসা নিকিতা এবং সুখবিন্দরও খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিদিশার উপরের ব্যাংকের ভদ্রলোক এখন নীচে এসে বসেছেন। তিনি যথারীতি খাওয়া শুরু করে দিয়েছেন। কেবলমাত্র পাশে বসা ছেলেটি এখনও খাবার হাতে নেয়নি। সে এখনও ফোনে। মাথা নীচু করে স্বর নামিয়ে জগৎ সংসার ভুলে মায়ের সঙ্গেই কথা বলে চলেছে। বিদিশা মনে মনে ভাবে, এমন সংবেদনশীল এবং বোঝদার ছেলে যার, সেই মা কীকরে এত পাষাণ হতে পারে!
কাঠি চামচ দিয়ে সবে ব্রেডে জ্যাম মাখাচ্ছিল বিদিশা, তখনই আরও একটা জ্যামের প্যাকেট টুপ করে ওর ট্রেতে রাখল সুখবিন্দর। ওর নিজের প্যাকেটখানা। বিদিশা হতবাক হয়ে তাকাতেই মুচকি হেসে সুখবিন্দর বলল, “এটা তো তোমার খুব পছন্দের জিনিস। তাই না?”
বিদিশা বাক্যহারা। মুহূর্তেই একরাশ ভালো লাগায় ভরে উঠেছে সে। এত মনে রেখেছে সুখবিন্দর! এতটাই! আবার সেই কলেজবেলার পিকনিকের কথা মনে পড়ছে। পিকনিকের ব্রেকফাস্টেও এমন ছোট ছোট জ্যামের প্যাকেট দেওয়া হয়েছিল। যারা জ্যাম খায় না, তাদের জন্যে অবশ্য বাটার ছিল। কিন্তু এই ধরনের ছোট প্যাকেটের বাটার নয়, বড় বড় প্যাকেট নেওয়া হয়েছিল। ফলে অনেকেই বাটার ও জ্যাম দুটোই মাখিয়ে নিচ্ছিল রুটিতে। বিদিশার জ্যাম বা জেলি জাতীয় খাবার ভারী পছন্দের। তাই সে বাটারের ধারেকাছেও যায়নি। কেবল জ্যাম মাখিয়ে পরম তৃপ্তিতে খেয়েছিল। এর অনেক পরে সুখবিন্দর একটা কাগজের ঠোঙ্গা ওর হাতে দিয়ে বলেছিল, “এই নাও এগুলো ব্যাগে ভরে নাও। এগুলো বেঁচে গিয়েছিল, তাই আমি তোমার জন্যে নিয়ে এলাম।”
ঠোঙ্গা খুলে বিদিশা অবাক বিস্ময়ে দেখেছিল, ওটার মধ্যে জ্যামের প্যাকেট ভর্তি। আরও অনেক পরে অন্যদের থেকে শুনেছিল, রীতিমতো লড়াই করে সেগুলো নিয়েছিল সুখবিন্দর। সুখবিন্দরের সহপাঠী অমলদা অর্থাৎ অমল মুন্সী তো প্রায় হাঁটে হাঁড়ি ভেঙ্গে দিয়েছিল। ওর ব্যাগ হাতড়ে জ্যামের হদিশ না পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “ওগুলো কোথায় রেখেছিস?”
“খেয়ে ফেলেছি।” নির্বিকার ভাবে বলেছিল সুখবিন্দর।
দুই চোখ কপালে তুলে অমল বলেছিল, “খেয়ে ফেলেছিস? এতগুলি প্যাকেটের জ্যাম সব খেয়ে ফেলেছিস!”
মাথা ঝাঁকিয়ে অবলীলায় মিথ্যেটায় শিলমোহর দিয়েছিল সুখবিন্দর।
তখন সবার বিস্ময় দেখে কে! অমল বলে উঠেছিল, “শুধু শুধু জ্যামগুলি খেয়ে নিলি? কী আশ্চর্য ছেলেরে তুই!” এর পরে যখন দুপুরের খাওয়ার আয়োজন হচ্ছে, তখন সমস্ত শিক্ষক ও ছাত্রদের সামনে অমল চেঁচিয়ে বলে উঠেছিল, “সুখবিন্দরকে কেউ লাঞ্চ দিস না। ও জ্যাম খেয়ে পেট ভর্তি করে ফেলেছে।”
পল-সাইন্সের বরুয়া স্যার অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন, “জ্যাম খেয়ে পেট ভরিয়েছে মানে?”
অমল মুন্সী বলেছিল, “ব্রেকফাস্টের জন্যে আনা প্রায় কুড়ি-পঁচিশটা জ্যামের প্যাকেট বাড়তি হয়েছিল স্যার। সব কটা কাড়াকাড়ি করে সুখবিন্দর নিয়ে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, সেগুলো খেয়ে সাবারও করে দিয়েছে।”
“ওহ তাই বল।” হেসে উঠেছিলেন বরুয়া স্যার। ভাগ্য ভালো, সুখবিন্দরকে সবাই ভালবাসত। সে জন্যে স্যার মোটেই রাগ করেননি। বাকিরাও কেউ এ নিয়ে কিছু বলেনি। বরং প্রশ্রয়ের হাসি ফুটে উঠেছিল সবার অভিব্যক্তিতে। অথচ কেউ জানতেও পারেনি, জ্যামের প্যাকেটগুলি যে আদতে বিদিশার ব্যাগে আছে। সবার সমস্ত কৌতূহল, বন্ধুদের বিরূপ মন্তব্য মাথায় নিয়ে শুধু বিদিশা ভালোবাসে বলে রীতিমতো অন্যদের সঙ্গে কাড়াকাড়ি করে ওগুলি সংগ্রহ করেছিল সুখবিন্দর!
দিল্লী ঢোকার আগে মেয়ের ফোন এল, -“মা তৈরি হও। আধঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবে ট্রেন। আমি স্টেশনের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছি।”
আজকাল এই এক সুবিধে। ঘরে বসে ফোনেই ট্রেনের গতিবিধি দেখে নেওয়া যায়। বিদিশা বলে, “চিন্তা করিস না, আমি তৈরি আছি। তুই সাবধানে আয়।”
ফোনটা ব্যাগের ভেতরে ঢোকাতে ঢোকাতে হঠাতই মনটা ভার হয়ে আসে বিদিশার। তা হলে শেষ হয়ে এল যাত্রাপথ? শেষ হয়ে এল সুখবিন্দরের সুখসঙ্গ! আর কি কখনও দেখা হবে দু’জনের? বিদিশার চোখ ফেটে জল আসে। প্রাণপণে নিজেকে সামলে রাখতে চেষ্টা করে।
খেয়াল হল, আর একবারও ফোন করেনি উত্তম। এর আগেও যে দু’বার কথা হয়েছে, বিদিশাই ফোন করেছে। নিজের থেকে কখনও খোঁজ নেয়নি উত্তম। এখন আর অভিমান নয়, নিজেকে একটা হেরো মানুষ মনে হয় বিদিশার। এমন একটা মানুষ যে পরশপাথর ছেড়ে একটা ভুল লোকের জন্যে প্রাণপাত করে এল এতটা কাল।
এমন সময় সুখবিন্দর ওর পাশে এসে বসে। বলে, “তাহলে এবার আসি, দিশা? এখন বাবার ওখানে যেতে হয়। বড় ভালো লাগল এত দিন পরে তোমাকে কিছুক্ষণের জন্যে পেয়ে।”
এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না বিদিশা। ঝর ঝর করে জল বেরিয়ে আসে দু’চোখ দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলে উঠতে পারে না। সুখবিন্দর বিদিশার হাত দু’খানা নিজের মুঠোয় নিয়ে আশ্বস্ত করে, “পাগলি। এভাবে কাঁদতে হয় বুঝি? এখন তো ফোন নম্বর পেয়ে গেছি আমরা। কথা হবে। আর বাড়ি ফিরে তোমার সঙ্গে প্রীতমেরও আলাপ করিয়ে দেব। আমাদের যোগাযোগ থাকবে।”
বিদিশা লক্ষ্য করল, সুখবিন্দরের সমস্ত কিছুতেই যেন ওঁর স্ত্রী প্রীতম জড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করে, “দিল্লীতে আবার আমাদের দেখা হতে পারে কি?”
“উহু,” মাথা ঝাঁকাল সুখবিন্দর, “কালই চলে যাব চণ্ডীগড়।”
প্লাটফর্মে ঢুকছে ট্রেন। উঠে দাঁড়াল সুখবিন্দর। নিজের ছোট্ট ব্যাগটা নিয়ে চলে গেল পাশের কম্পার্টমেন্টে, যেখানে ওর বাবা রয়েছেন।
বিদিশা ওঁর যাওয়ার দিকে স্থির তাকিয়ে থাকে। তখনই নিকিতা এসে খুশি খুশি মুখে বলল, “আন্টি, ভালো খবরটা আছে। অনির সঙ্গে কথা হয়েছে। আমাদের আবার ভাব হয়ে গেছে।”
সুখবিন্দর চলে যাওয়ার শূন্যতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টাই করছিল বিদিশা, এখন ক্ষণিকের চেনা মেয়েটির আনন্দ সংবাদ শুনে মনটা খানিক ভালো হয়ে গেল। বলল, “তাই? বড় আনন্দের খবর। ভালো থেকো তোমরা দু’জনে।”
“ক্রেডিট গোজ টু ইউ আন্টি। আপনি ওভাবে না বোঝালে হয়তো এটা কখনও হত না। আমি আমার অভিমান নিয়েই থাকতাম আর অনিকে দূরে ঠেলে দিতাম।”
মৃদু হাসে বিদিশা। নিকিতা হঠাৎ ওর হাতটা ধরে বলে, “একটা কথা বলব আন্টি? মানে ছোট মুখে বড় কথা তো, তাই পারমিশন চাইছি।”
প্রশ্ন চোখে তাকায় বিদিশা, “কী এমন কথা যে এত দ্বিধা করছ?”
“কথাটাই এমন। আপনি যদি রাগ করেন, সেজন্যে ভয় পাচ্ছি।”
কৌতূহল বাড়ে বিদিশার। তবে বুঝতে না-দিয়ে বলল, “নির্ভয়ে বলো। রাগ করব না।”
নিকিতা নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার বিরতি নিয়ে শুরু করল, “আমি একটা জিনিস লক্ষ করেছি আন্টি, যারা সহজেই সব পেয়ে যায়, তারা সেসবের মর্যাদা দেয় না। এই যেমন কত লোক হয়তো অনেক চেষ্টা করেও রিজার্ভেশন পায়নি বলে এই ট্রেনে উঠতেই পারেনি। কিন্তু আপনার হাজবেন্ড এত ভালো লোওয়ার বার্থ পেয়েও এলেন না। হতে পারে তাঁর কোনও বিশেষ কারণ থাকবে। কিন্তু এর জন্যে আপনাকে তো একা যেতে হচ্ছে।…” এতটুকু বলে একটু থামে সে। বিদিশার মুখের দিকে তাকিয়ে ওর প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করে।
বিদিশা এখনও ধন্দে। মেয়েটা কী বলতে চাইছে, বোধগম্য হচ্ছে না ওর। উৎসুক হয়ে তাকিয়ে থাকে। নিকিতা বলে চলে, “আরও একটা জিনিস দেখেছি, যারা ভালো মনের মানুষ, তাদের শূন্যতা ভগবানই পূরণ করে দেন। এই যেমন আপনার স্বামীর খালি সিটে পেয়ে গেলেন কিনা পুরোনো বন্ধুকে! কী ভালো হল বলুন?”
“হ্যাঁ, সে ঠিকই বলেছ,” এবার বিদিশা মুখ খোলে, “এত দিন পরে সুখবিন্দরকে দেখে আমারও বড় ভালো লেগেছে।”
“তাই আমি বলছি কী,” নিকিতা বলে, “মনের মতো কেউ শূন্যতা ভরাতে এলে তাঁকে সরিয়ে দেবেন না, আন্টি। বরং ওয়েলকাম করবেন। ধরে রাখবেন। কে জানে, ঈশ্বরের হয়তো তেমনই ইচ্ছে।”
চমকে ওঠে বিদিশা। কী বলতে চাইছে এ মেয়ে! পলকের জন্যে কথা হারায় সে। পরক্ষণেই অবশ্য নিজেকে সামলে নেয়। মুখে হাসি এনে বলে, “ধরে রাখার কথা বললেই কি তা সম্ভব হয়? আমার বন্ধুটিরই কত পিছুটান দেখো। সে কি আমার সঙ্গে টানা বসে থাকতে পেরেছে? বারংবারই ওঁকে উঠে যেতে হল অন্য কম্পার্টমেন্টে। তাই নয় কি?”
“সে ঠিকই। তবু যতক্ষণ কাছে পেলেন, বা যতটুকু কাছে পাওয়া যায়, সেও কি কম?”
কী বলবে ভেবে পায় না বিদিশা। কেবল একটা ম্লান হাসি হাসে। মুখে কিছু না বললেও নিকিতার সঙ্গে মনে মনে সহমত হয়। হয়তো পুরোপুরি সুখবিন্দরকে পাওয়া আর সম্ভব নয়, কিন্তু এই যে যোগাযোগ হল, সেটাই বিদিশার কাছে অমূল্য। ওর নিঃসঙ্গ অবহেলিত জীবনে সুখবিন্দর যেন এক ছায়াতরু হয়ে এসেছে। আর ওঁকে হারাতে চায় না বিদিশা।
নিকিতা বলে, “জানেন আন্টি, ছোটবেলায় আমার জেঠুকে একটা গান গাইতে শুনতাম, -জীবনটা ভাই রেলের গাড়ি আমরা সবাই যাত্রী। কে জানে চলেছি কোন ঠিকানায়…’ তখন বুঝতাম না। এখন ভাবছি, গানটা কত সত্যি! আমরা সবাই আলাদা গল্প, আলাদা গন্তব্য নিয়ে একই ট্রেনে সওয়ার হয়েছি। কিছুক্ষণের জন্যে শুধু একসঙ্গে কাটানো। তাই না আন্টি?”
উত্তরে শুধু হাসল নিদিশা।
ইতিমধ্যে প্লাটফর্মে স্থিত হয়েছে ট্রেন। উঠে দাঁড়িয়েছে নিকিতা। ল্যাপটপের ব্যাগটা পিঠে ঝুলিয়ে নিতে নিতে বলে, “বাই আন্টি। বেষ্ট অব লাক।”
নিজের ট্রলি নিয়ে দরজার দিকে এগোয় সে। থম হয়ে বসে থাকে বিদিশা। কীকরে ওর মনের কথাটা এভাবে বলে দিল অচেনা মেয়েটা! বিদিশার অবাক লাগে। নিশ্চয়ই সুখবিন্দরের সঙ্গে ওর আগের সম্পর্ক আঁচ করে ফেলেছে সে। এমনকী উত্তমের সঙ্গে ফোনের কথাবার্তাও হয়তো কিছু শুনেছে, বা অনুমান করেছে। কে জানে! বিদিশা ভেবে পায় না। আজকালকার ছেলেমেয়েরা এমনিতেই বড় স্মার্ট। মুখ খোলার আগেই বুঝে যায় সামনের লোক কী বলতে চাইছে। নিজের মেয়েকেই তো দেখেছে বিদিশা। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়টা সাঙ্ঘাতিক চৌখস এদের।
ভুল বলেনি মেয়েটা। ওর নিজের মনেও তো একই ইচ্ছে খেলছে। একই সঙ্গে উত্তমের দীর্ঘ দিনের অবহেলা এবং অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার সুবর্ণ সুযোগটা লুফে নেওয়ার জন্যেও উন্মুখ হয়ে উঠেছে। সুখবিন্দর যেন এক অসীম সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। এখন মোবাইল নম্বর আছে। যোগাযোগ রাখা এবং পুরোনো সম্পর্ককে পুনর্জীবিত করা কোনও ব্যাপারই নয়।
কম্পার্টমেন্ট খালি করে সকলে নেমে পড়ছে। বিদিশার যেন কোনও তাড়া নেই। সে ধীরেসুস্থে এগোয়।
প্লাটফর্মে প্রবল ভিড়। চারদিকে তাকায় বিদিশা। মেয়েকে খোঁজে। তখনই মেয়ের ফোন চলে আসে, “মা পৌঁছে গেছো? নেমে পড়েছ কি? প্লাটফর্মেই একটু অপেক্ষা করো। ঘাবড়িও না কিন্তু। জ্যামে আটকে গিয়েছিলাম বলে আমার সামান্য দেরি হচ্ছে। মিনিট দশেকেই পৌঁছে যাব।”
বিদিশা ফোন ব্যাগে ঢুকিয়ে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে দাঁড়াল। যাত্রীর ঢল কিছুটা কমতেই দেখে, সুখবিন্দর ওর বাবাকে নিয়ে এ দিকেই আসছে। বিদিশা এগিয়ে গিয়ে ওর বাবাকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। সুখবিন্দর একটা খালি বেঞ্চে ওর বাবাকে বসিয়ে বলল, “কী ব্যাপার? মেয়েকে পাওনি?”
“পৌঁছায়নি এখনও। আসছে। ফোন করেছিল।”
তখনই সুখবিন্দর বলে, “ঐ যে আমার ছেলে আসছে। পাশে ওর প্রেমিকা। ভালোই হল তোমাকে দু’জনের সঙ্গেই পরিচয় করিয়ে দেব।”
সুখবিন্দরের ইশারা অনুসরণ করে তাকায় বিদিশা। আর অমনি পাথর হয়ে গেল। অস্ফুটে বলে ওঠে, “সুখ! ও তো আমার মেয়ে!”
“কী বলছ দিশা! তিথি তোমার মেয়ে!” বিস্ময়ে স্তম্ভিত সুখবিন্দর।
একই অবস্থা বিদিশারও। কিছু বলার ভাষা হারিয়েছে সে। সুখবিন্দরই বলে ওঠে, “ওফ! কী সমাপতন! ভালোবাসাও এমন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হয়!”
বিদিশার দুই চোখ ছলছল করছে। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে, “এবার আর ভালোবাসাকে হারতে দেব না। তুমি সরে দাঁড়াও সুখ। ওরা যেন ভাবে আমরা অপরিচিত। ওরাই আমাদের পরিচয় করাক। আর হ্যাঁ, আমার ফোন নম্বরটাও ডিলিট করে দিও।”
হতভম্ব সুখবিন্দর। বলে, “কী বলছ দিশা!”
“হ্যাঁ, সন্তানদের মুখ চেয়েই আমাদের এই ত্যাগটা করতে হবে। ওরা দু’টিতে যাতে একে অপরকে নিয়ে সুখে থাকে, এর জন্যে আমরা নাহয় নতুন করেই পরিচিত হলাম।”
হেসে ফেলল সুখবিন্দর। বলল, “ভয় নেই দিশা, ভালোবাসা খাঁটি হলে ওরা জুড়ে থাকবেই। তাছাড়া আমাদের পথ তো বহু আগেই আলাদা হয়ে গেছে। তাহলে কেন আর অযথা গোপনীয়তা? বরং এখনের যা সত্য, তা ওরাও জানুক। স্বচ্ছতার মধ্যেই ওদের সম্পর্কটা বিকশিত হোক। তাই নয় কি?”
কী জবাব দেবে ভেবে পায় না বিদিশা। কিন্তু ওর বুকের গভীর থেকে যে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল, সেটার সাক্ষী থাকল কেবল জনাকীর্ণ রেলওয়ে প্লাটফর্ম।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন