মূলকাহিনীঃ গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মারকেজ
(রচনা কাল – ১৯৫৫)
অনুবাদঃ বৈশাখী ঠাকুর
বৃষ্টির তৃতীয় দিনে তারা ঘরের ভেতর এত কাঁকড়া মেরেছে যে পেলায়ওকে সেগুলো জড় করে ভিজে উঠোন পেরিয়ে সমুদ্রে ফেলে আসতে হয়েছে কারণ তাঁদের সদ্যোজাত শিশুটির সারা রাত গায়ে জ্বর ছিল এবং তাঁদের মনে হয়েছে ওই তুমুল দুর্গন্ধই তার মূল কারণ। মঙ্গলবার থেকেই বসুন্ধরা যেন বিষণ্ণতায় ডুবে রয়েছে। সমুদ্র এবং আকাশ একই ধূসর রেখায় বিলীন আর মার্চ মাসের রাতে যে সমুদ্রসৈকত ঝিকিমিকি করত তাকে দেখে মনে হবে এখন কাদা আর পচা শামুকের স্টু বুঝি! বিকেলের দিকে আলো এত ক্ষীণ ছিল যে পেলায়ও যখন সব কাঁকড়া ফেলে বাড়ি ফিরছিল তখন তার পক্ষে দেখা সম্ভব ছিল না যে উঠোনের পেছনে ওটা কি নড়াচড়া করছে বা গোঙানির মত আওয়াজটা কোথা থেকে আসছিল। তাকে কাছে যেতে হয়েছিল। খুব কাছে। তবেই সে দেখতে পেয়েছিল এক বৃদ্ধ। অতি বৃদ্ধ এক ব্যক্তি মুখ থুবড়ে মাটিতে পরেছিল। প্রবল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তার বিরাট ডানাগুলোর জন্য তিনি উঠে দাঁড়াতে পারছিলেন না।
কোন দুঃস্বপ্ন ভেবে ভীত পেলায়ও ছুটে তার স্ত্রী, এলিসেন্ডার কাছে গেল। এলিসেন্ডা অসুস্থ বাচ্চাটাকে তখন জলপট্টি দিচ্ছিল। তাকে নিয়ে সে উঠোনে এল। তারা হতভম্ব হয়ে পতিত মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। তার পোশাক আশাক ছিল ঠিক আবর্জনা কুড়ুনিদের মতন। ইতস্ততঃ দু একটা চুল তার টাক মাথায় দেখা যাচ্ছিল এবং মুখে গোনাগুনতি দু তিনটে দাঁত। তার মুমূর্ষু অবস্থা শ্রদ্ধেয় গুরুজন হবার সব মহিমাই যেন কেড়ে নিয়েছিল। ওনার বিশাল হাস্যস্পদ দুটো ডানা, তায় আবার নোংরা এবং কতক খোবলানো মাটিতে জড়িয়ে পরে ছিল। এত সময় ধরে ওনাকে দেখেছিল এবং নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল যে অচিরেই আশ্চর্যজনকভাবে পেলায়ও আর এলিসেন্ডার মনে হল যে ইনি তাদের বেশ পরিচিত। তারপর তারা সাহস সঞ্চয় করে ওনার সাথে কথা বলল। তিনি নাবিকদের ভাষায় উত্তর দিলেন। এক বর্ণও তাঁদের বোধগম্য হল না। ঠিক এইজন্যই তারা ওই ডানা দুটোকে উপেক্ষা করে অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত ভাবে এই ভাবনায় উপনীত হল যে তিনি নিশ্চয়ই ঝড়ের কবলে পরা কোন বিদেশী জাহাজের একাকী নিক্ষেপিত যাত্রী। তারপরেও অবশ্য তারা তাঁদের প্রতিবেশী মহিলাকে ডেকে এনেছিলেন যিনি বলতে গেলে জন্ম মৃত্যু সম্বন্ধে সবকিছুই জানেন। তিনি এসেই তাঁদের ভুলটা ধরিয়ে দিয়েছিলেন।
—-“ ইনি একজন দেবদূত” সেই মহিলা বললেন, “ইনি নিশ্চয়ই তোমাদের বাচ্চাটার জন্য এসেছেন কিন্তু বেচারা এত বৃদ্ধ যে এই দুর্যোগময় আবহাওয়া তাকে এই বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে”।
পরের দিন এলাকার সকলেরই প্রায় জানা হয়ে গিয়েছে যে রক্ত মাংসের এক দেবদূত পেলায়ওদের বাড়িতে বন্দী হয়ে রয়েছে। যদিও ওই জ্ঞানী প্রতিবেশী মহিলা জানিয়েছিলেন যে তখনকার দিনে পলাতক দেবদূতরা ছিল স্বর্গলোকের ষড়যন্ত্রের শিকার তবুও তারা তাকে মেরে ফেলার কথা মনে আনেনি। পেলায়ও সারাদিন হাতে একটা ডাণ্ডা নিয়ে রান্নাঘর থেকে ওনার ওপর নজর রেখেছে। রাতে শুতে যাবার আগে মাটি থেকে ওনাকে টানতে টানতে পেলায়ও ওনাকে নিয়ে এসেছে। মুরগীদের সাথে ঐ তার দিয়ে বাঁধানো ঘরে তালা দিয়ে বন্ধ করে থাকতে দেওয়া হয়েছে ওনাকে। মাঝ রাতে যখন বৃষ্টি থেমে গেছে তখনও পেলায়ও এলিসেন্ডা কাঁকড়া মেরে চলেছিল। খানিক বাদে ওদের শিশুটি জেগে উঠল। তখন গায়ে জ্বর নেই আর খিদেতে সে আনচান করছিল। আনন্দে তারা ঔদার্যপূর্বক ঠিক করল যে দেবদূতকে তারা তিনদিনের খাদ্য পানীয় দিয়ে একটা ভেলায় চড়িয়ে দেবে। কিন্তু আকাশ একটু ফর্সা হতেই যখন তারা উঠোনে গেল দেখল সারা পাড়া তাঁদের মুরগীর ঘরের সামনে উপচে পরেছে। সকলে দেবদূতের সাথে মজা করতে ব্যস্ত। কারুর মনে সামান্যতম শ্রদ্ধা নেই স্বর্গলোকের দেবদূত বলে। বরঞ্চ পাড়া পড়শীর দল সার্কাসের প্রাণীদের মত তারের ফাঁক দিয়ে খাবার ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছিল ওনার দিকে।
ফাদার গঞ্জাগা এই অদ্ভুত খবরে অত্যাশ্চর্য হয়ে ভোর সাতটার আগেই এসেছিলেন। ইতিমধ্যে আরও অনেক পথচারী এসে উপস্থিত হয়েছে যারা কিনা ওই ঊষাকালের পড়শীদের মত অতটাও বাজে ব্যবহার করছিল না তবে এরা বন্দী দেবদূতের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানারকম বার্তালাপ চালাচ্ছিল। সবচেয়ে সাধারণ মনোভাবের ব্যক্তি যিনি ছিলেন তিনি প্রস্তাব দিলেন যে ওনাকে পৃথিবীর মেয়র নামে অভিহিত করা হোক। বাকি যারা একটু কঠোর মনোভাবাপন্ন তাঁদের মনে হল ওনাকে পাঁচতারাযুক্ত কোন সেনাধ্যক্ষ হিসেবে উন্নীত করা হোক যাতে সব প্রকার যুদ্ধ জেতা সম্ভব হয়। অন্য কিছু দূরদর্শী লোকের মনে আশা ছিল যে ওনার সাহায্যে পৃথিবীতে এক ডানাওয়ালা জ্ঞানী মানুষের প্রজাতির আবির্ভাব হবে যারা এই বিশ্বজগতকে নিয়ন্ত্রণ করবে। কিন্তু ফাদার গঞ্জাগা পাদ্রী হবার আগে এক বলিষ্ঠ কাঠুরিয়া ছিলেন। তিনি মনে মনে নানা প্রশ্নোত্তর সাজিয়ে দরজাটা খুলতে বললেন যাতে তিনি খুব ভাল করে কাছ থেকে এই বিপর্যস্ত মানুষটাকে দেখতে পারেন। ওই ফুটফুটে মুরগিছানাদের মাঝে তখন ওনাকে এক বিকৃত মুরগি ছাড়া অন্য কিছু মনে হচ্ছিল না। তবে দেবদূত আপনমনে এক কোণায় প্রভাতচারীদের খাবারের উচ্ছিষ্ট এবং খোলার মাঝে শুয়ে রোদে ওনার পাখাগুলো শোকাচ্ছিলেন। ফাদার গঞ্জাগা মুরগীর ঘরের ভেতর ঢুকে লাতিন ভাষায় দেবদূতকে সুপ্রভাত জানালেন। পৃথিবীর নৈরব্যাক্তিকতা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে তিনি নিজের চোখ দুটো মেলে বিড়বিড় করে নিজের ভাষায় যেন কি সব বললেন। প্রথমেই পাদ্রীর মনে হল এ ব্যাক্তি কোন ভন্ড না হয়ে যায় না, নাহলে ভগবানের ভাষায় কথা বললে বোঝে না, আবার ভগবানের সেবকদের কিভাবে অভিবাদন করতে হয় তাও জানে না! আরও নিবিড়ভাবে কাছে গিয়ে দেখে ফাদার গঞ্জাগার মনে হল এ যেন বড্ড বেশী রক্ত মাংসের মানুষ। একটা উৎকট গন্ধ তার গায়ে, পেছনের ডানাগুলো পোকাদের দ্বারা জর্জরিত আর ডানার মূল পালকগুলো হাওয়ার দ্বারা অবিন্যস্ত। ওনার চেহারার কোন কিছুই স্বর্গলোকের দেবদূতের গর্বিত মর্যাদার সাথে খাপ খায় না। এরপর উনি বেরিয়ে এলেন মুরগির খোপ থেকে। কৌতূহলী জনতার উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত উপদেশে জানালেন কোন ভন্ড লোককে প্রশ্রয় দেবার ঝুঁকি কতখানি। তিনি তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিলেন যে শয়তানের বদ অভ্যাস আছে কৌশলে অচেতন মানুষকে বিভ্রান্ত করা। তিনি যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে ডানাই কিন্তু একমাত্র জরুরি জিনিস নয় একটি বায়ূযান এবং বাজপাখির মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করার জন্যে। তেমনি একটি দেবদূতকে সনাক্ত করার ক্ষেত্রে ডানাই শেষ কথা নয়। তথাপি উনি কথা দিলেন যে উনি বিশপকে চিঠি লিখবেন যাতে উনি ওনার ঊর্ধ্বতনকে চিঠি লেখেন এবং অনুরূপভাবে যেন সুপ্রিম পন্টিফের কাছে চিঠি যায় যাতে সর্বোচ্চ আদালত থেকে চূড়ান্ত রায় পাওয়া সম্ভবপর হয় অচিরেই। পাদ্রীর বিচক্ষণতায় সকলেই দ্রব হয়ে গেল। বন্দী দেবদূতের খবর চারিদিকে এত দ্রুত ছড়িয়ে পরল যে কিছু ঘন্টার মধ্যেই উঠোনটি বাজার এলাকার মত হই হট্টগোল আর লোকে গিজগিজ করতে থাকল। তারা বাধ্য হল পুলিশ ডাকতে যারা টুপি মাথায় ভিড় হালকা করার কাজে ভাগ্যিস লেগে পরেছিল নাহলে ঘরটা উপচে পরা ভিড়ে আর একটু হলেই ভেঙে পরত। এদিকে এলিসেন্ডার মেরুদন্ড বেঁকে যেতে বসেছে ক্রমাগত ওই লোকজনের নোংরা পরিষ্কার করতে করতে। সে ঠিক করল তার উঠোনের এলাকাটায় পুরো বেড়া বসিয়ে দেবে আর পাঁচ সেন্ট ধার্য করবে দেবদূতকে দেখার জন্য।
অত্যুৎসাহী লোকজন অনেক দূরদূরান্ত থেকে এসেছে। এমনকি একটি ভ্রাম্যমাণ কার্নিভালও উপস্থিত হয়েছিল একটি উড়ন্ত মানুষ নিয়ে। কিন্তু তাকে কেউ মনোযোগ দিল না কারণ তার পাখাগুলো দেবদূতের মত সত্যিকারের ছিল না। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার যেটা হল বহু অসুস্থ মানুষ এসেছে সুস্থতার আশা নিয়ে। এক গরীব মহিলা যিনি ছোটবেলা থেকে হৃদস্পন্দন গুনছেন কিন্তু আর এখন গুনতে পারছেন না। এক পর্তুগীজ ভদ্রলোক যিনি ঘুমোতে পারছেন না কিছুতেই রাতে আকাশের তারাদের শোরগোলের কারণে। একজন যিনি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাঁটেন তিনি রাতে উঠে যে সব কাজ সকালে সমাপ্ত করেছিলেন সেগুলোকে আবার পূর্বাস্থায় নিয়ে যান। এছাড়াও আরও অনেকে এসেছিলেন কিন্তু তাঁদের অসুখ অতটাও গভীর ছিল না। কিন্তু ওই জাহাজ-ডুবির বিপর্যয়ের মাঝেই পেলায়ও এবং এলিসেন্ডা বিপুল ক্লান্তিতেও খুশি ছিল কারণ এক হপ্তাও হয়নি তাঁদের ঘর টাকায় ভরে গেছে। এদিকে এখনও দিগন্ত রেখার ওপারেও তীর্থযাত্রীরা দাঁড়িয়ে তাঁদের দর্শনের সুযোগ আসার অপেক্ষায়। তবে সেই দেবদূত কোন সক্রিয় ভূমিকা নেননি ওনাকে দেখতে আসার হুড়োহুড়িতে। তিনি মুরগিদের সাথে ভাগ করা ঘরে স্বচ্ছন্দ হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।তিনি যারপরনাই বিস্মিত এবং উত্তপ্ত তারের ধারে ধারে রাখা তেল প্রদীপ এবং পবিত্র মোমের ভয়ানক উত্তাপে।
উৎসাহী জনগণ প্রথমে চেষ্টা করল কিছু ন্যাপথলিনের বল খাওয়াতে দেবদূতকে কারণ সেই জ্ঞানী মহিলার জ্ঞান অনুযায়ী এইগুলোই হচ্ছে ফেরেশতাদের নির্ধারিত খাদ্য। কিন্তু তিনি সেগুলো যেমন খাননি তেমন পাদ্রীদের উপযোগী মধ্যাহ্নভোজনও প্রত্যাখান করেছেন। তবে সেটা তিনি অতি বৃদ্ধ বলে নাকি তিনি দেবদূত বলে তা জনতা বুঝতে পারেনি এবং শেষ পর্যন্ত তিনি বেগুনের ঘ্যাঁট খেয়ে নিজের ভোজন সমাপ্ত করেছেন। ওনার একমাত্র অলৌকিক গুণ হল ওনার অসীম ধৈর্য। বিশেষ করে সেইসব প্রথমদিকের দিনগুলোতে যখন মুরগিরা তাকে ঠুকরে দিত তার ডানায় বাসা বাঁধা পোকাগুলোর খোঁজে এবং পঙ্গুরা ওনার পালক ছিঁড়ে নিত তাঁদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গতে ছোঁওয়াবে বলে এবং সবচেয়ে দয়ালু ব্যাক্তিরা যখন পাথর ছুঁড়ত তাক করে যাতে উনি গাত্রোত্থান করেন এবং তারা দাঁড়ানো অবস্থায় দেবদূতকে দেখতে পায়! একমাত্র তারা সফল হয়েছিল ওনাকে একটু সচল করতে যখন তারা গরম লোহার শিক দিয়ে ওনার ধারগুলো পুড়িয়ে দিচ্ছিল কারণ উনি এত দীর্ঘদিন নিশ্চল হয়ে পরেছিলেন যে আপামর জনতা ভেবেছিল ওনার বুঝি মৃত্যু ঘটেছে।অশ্রুপূর্ণ চোখে এক অপার্থিব আতঙ্কে উঠে বসেছিলেন তিনি তখন! অবোধ্য ভাষায় কিছু বিড়বিড় করে ডানা দুটো ঝাপটেছিলেন বেশ কয়েকবার যার ফলে মুরগির বিষ্ঠা আর ধুলোর ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছিল সেই তারের ঘরে। তার মুখাবয়ব দেখে মনে হয়েছিল যত না রাগের তার চেয়ে অনেক বেশী বেদনার ছিল সেই প্রতিক্রিয়া। এরপর তারা সাবধান হয়ে গেছিল তাকে বিরক্ত করার ব্যাপারে কারণ বেশীরভাগ লোকই বুঝতে পেরেছিল যে ওনার নিষ্ক্রিয়তা কোন নায়কোচিত স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না বরঞ্চ এক বিপজ্জনক নীরবতা।
বন্দীর জন্য চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষা করতে করতে ফাদার গঞ্জাগা পরিচারিকাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত ফন্দী দিয়ে কোনমতে জনতার ছেলেমানুষিকে আটকে রেখেছিলেন। কিন্তু রোম থেকে প্রেরিত পত্রে তেমন কোন গুরুত্বের আভাস টের পাওয়া গেল না। তারা সময় ব্যয় করেছিল জানতে যে বন্দীর কোন নাভি আছে কিনা, তার ভাষার সাথে অ্যারামিকের কোন সংযোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে কিনা, তার মাথার সাথে আলপিনের মাথা ঠিক খাপ খাচ্ছে কিনা অথবা তিনি কি শুধুমাত্র কোন ডানাযুক্ত নরওয়েজিয়ান নন! এই সব তুচ্ছ চিঠি হয়তো যেতে আসতেই থাকত যদি না এক দৈব ঘটনার ফলে পাদ্রীর মনের অশান্তির সমাপ্তি ঘটল।
ঘটনাটা এমন ছিল যে তখনকার দিনে নানারকম কার্নিভাল আকর্ষণের মধ্যে শহরে একটি ভ্রাম্যমাণ খেলা এল যেখানে একটি মেয়ে মাকড়সায় পরিণত হয়েছে নিজের বাবা মায়ের অবাধ্যতা করার দরুন। এই মাকড়সা মানবীকে দেখার জন্য শুধু যে পয়সাই কম লাগত দেবদূতের থেকে তা নয়, জনগণের সবরকম অনুমতি ছিল তাকে নানারকম প্রশ্ন করার যে তার কিভাবে এই পরিণতি হল এবং এই মানবীর ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে কারুর যাতে মনে সন্দেহ না থাকে তাই হাত দিয়ে ওপর নীচে পরীক্ষা করে দেখার পূর্ণ স্বাধীনতাও ছিল। ভেড়ার আকার সমান সে আদতে ছিল এক ভয়াবহ ট্যারান্টুলা কিন্তু মাথাটা এক দুঃখী মানবীর। সবচেয়ে হৃদয়বিদারক যেটা ছিল সেটা তার বিজাতীয় আকার নয় বরঞ্চ নিদারুণ কষ্ট নিয়ে যখন সে তার দুর্ভাগ্যের কাহিনী বর্ণনা করত! বাস্তবিক তখনও তাকে বাচ্চাই বলা চলে যখন সে একবার বাবা মায়ের অনুমতি ছাড়াই বাড়ির বাইরে গেছিল নাচ করতে। বাবা মায়ের বিনা অনুমতিতে সারা রাত নাচার পর সে যখন বনের মধ্যে দিয়ে বাড়ি ফিরছিল, এক ভয়াবহ বজ্রতালিতে আকাশ দু ফাঁক হয়ে গেছিল। আকাশের সেই ফাঁক থেকে বিদ্যুৎ কণা ছুটে এসে তাকে মাকড়সায় পরিণত করে। উদারমনস্ক মানুষেরা যে মাংসের বল তার মুখে ছুঁড়ে দেয় –একমাত্র তা থেকেই সে পুষ্টি গ্রহণ করে। এমন এক আশ্চর্য দ্রষ্টব্য জিনিস তায় আবার মানুষের কঠোর সত্যের সাথে ভয়ংকর শিক্ষণীয় কাহিনী হারাতে বাধ্য ওই অহংকারী দেবদূতের প্রদর্শনীর থেকে যে কিনা একবার ফিরে মানুষের দিকে দৃকপাতও করেন না। তাছাড়া দেবদূতের সাথে জড়িত কিছু অলৌকিক ক্রিয়াকলাপে মনে হয়েছিল দেবদূত বুঝি খানিকটা মানসিক ভারসাম্যহীন। যেমন সেই অন্ধ লোকটা যে দৃষ্টি ফিরে পায়নি কিন্তু নতুন তিনটে দাঁত তার গজিয়েছিল। আবার পঙ্গু লোকটা হাঁটতে হয়তো সক্ষম হয়নি কিন্তু লটারি জিতে বসেছিল। এদিকে একটা কুষ্ঠ রুগীর ঘা থেকে উজ্জ্বল সূর্যমুখী ফুল প্রস্ফুটিত হয়েছিল। এই সান্ত্বনা দেওয়ার মত অলৌকিক কীর্তিগুলো নেহাতই হাস্যস্পদ হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং তাইতে ইতিমধ্যে দেবদূতের খ্যাতি নষ্ট হয়েছে আর মাকড়সা মানবীর আবির্ভাবের পর তা একেবারেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। এইভাবে ফাদার গঞ্জাগা চিরতরে অনিদ্রা থেকে সেরে উঠেছিলেন এবং পেলায়ওর উঠোন আবার ফাঁকা হয়ে গেছিল সেই আগের মতন যখন তিন দিন ধরে বৃষ্টি পরেছিল আর কাঁকড়ার দল ঘুরে বেড়িয়েছিল তার শোওয়ার ঘর পর্যন্ত।
বাড়ির মালিকদের দুঃখ করার কিছু ছিল না কারণ যে পয়সা তারা সঞ্চয় করেছিল তাই দিয়ে দোতলা বাড়ি বানাল বাগান সমেত। বাগানে দিল উঁচু তারের বেড়া যাতে শীতের সময়ও কাঁকড়াদের উপদ্রব বন্ধ করা যায় আর জানলায় দিল লোহার পাত যাতে কোন দেবদূতের আগমন আর না ঘটে। পেলায়ও একটা খরগোশের ফাঁদও পেতে রাখল আর ভালর জন্যই কোর্টের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে এসেছিল। এলিসেন্ডা কয়েকটা সাটিনের উঁচু হিলের পামশু কিনেছিল আর অনেক অদ্ভুত দেখতে সিল্কের জামাকাপড় যা তখনকার সময়ে আকাঙ্কক্ষিত মহিলারা রবিবার পরে ঘুরে বেড়াত। একমাত্র মুরগির খোপটাই অবহেলিত পরে ছিল। তারা যে প্রায় ক্রেয়োলিন দিয়ে জায়গাটা ধুতো এবং গন্ধরস জ্বালাত তা দেবদূতকে সম্মান জানানোর জন্য নয়, বরঞ্চ স্তূপাকার বিষ্ঠার দুর্গন্ধকে ঘোচানোর জন্য যা কিনা ভূতের মতন সারা ঘরে ঘুরে বেড়াত। ফলে নতুন বাড়িকে সেই পুরনোর মত লাগত।
বাচ্চাটা যখন প্রথম হাঁটতে শিখল তখন তারা খুব সাবধানে ছিল যাতে ছোট্ট প্রাণটা মুরগির খোপের দিকে না যায়।তবে ধীরে ধীরে তাঁদের ভয় কেটে গেল এবং তারা ওই দুর্গন্ধের সাথে অভ্যস্ত হয়ে পরল। শিশুটির দ্বিতীয় দাঁত ওঠার আগেই সেও মুরগির খোপে গিয়ে খেলতে শুরু করল যেখানে তারগুলো সব খুলে খুলে পরে যাচ্ছিল। অন্যান্য নশ্বরদের ক্ষেত্রে সে যেমন নিরুত্তাপ ছিল বাচ্চাটির ক্ষেত্রেও দেবদূত নিজেকে গুটিয়ে রাখল। তবে কোন মায়া না করে কুকুরের মত ধৈর্য সহকারে তাকে সাংঘাতিক সব অপবাদ সহ্য করতে হয়েছিল। একসময় দেবদূত এবং শিশুটি –দুজনেই একসাথে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হল। যে ডাক্তার শিশুটির চিকিৎসা করতেন তিনি নিজেকে রোধ করতে পারলেন না দেবদূতের হৃদযন্ত্রের আওয়াজ শোনা থেকে এবং আশ্চর্যজনকভাবে তিনি এত শিসের শব্দ শুনলেন হৃদযন্ত্রে আর আরও কতশত আওয়াজ কিডনিতে যে তিনি অবাক হয়ে গেলেন —- এই দেবদূত বেঁচে আছেন কি করে! তবে তিনি সবচেয়ে বেশী চমৎকৃত হয়েছিলেন ডানা দুটো পরীক্ষা করে। ডানা দুটো ওই দেহে এত স্বাভাবিক ভাবে লেগে ছিল যে ডাক্তারবাবুর মনে হয়েছিল যে আর সব মানুষদের কেন নেই!
রোদ জলের প্রকোপে মুরগির ঘরটা পুরোপুরি ভেঙে যাবার কিছুদিন পর থেকে বাচ্চাটা ইস্কুলে যেতে আরম্ভ করল। দেবদূত তখন নিজেকে এধার ওধার এক মরণাপন্ন মানুষের মত টানতে টানতে নিয়ে যেতেন। তারা তাঁকে ঝাঁটা দিয়ে তাদের বেডরুম থেকে তাড়িয়ে দিত তো পরের মুহূর্তেই ওনাকে রান্নাঘরে খুঁজে পেত। একই সময়ে মনে হত উনি যেন অনেক জায়গায় উপস্থিত রয়েছেন। তাদের মনে হতে লাগল উনি নিজ সদৃশ অনেককে উৎপাদন করছিলেন সারা বাড়ি জুড়ে। হতাশ এলিসেন্ডা চেঁচাত যে এক ঘর ভর্তি ফেরেশতার সাথে থাকাটা কি আতঙ্কজনক আর বিরক্তিকর হয়ে উঠছে তার পক্ষে! তিনি প্রায় খেতেই পারতেন না আর ওনার বয়সকালের দৃষ্টি এত ঝাপসা হয়ে গেছিল যে তিনি প্রায় থামে ধাক্কা খেতে খেতে ঘুরে বেড়াতেন। শেষ সম্বল বলতে ছিল পাখনাগুলোর নগ্ন শিরা উপশিরা। পেলায়ও দয়াবশতঃ গা ঢাকতে একটা কম্বল ছুঁড়ে দিয়েছিল ওনার গায়ে আর চালাঘরে থাকতে দিয়েছিল। তখনই তারা খেয়াল করে যে রাতে দেবদূতের গা বেশ গরম এবং উনি কোন বুড়ো নরওয়েজিয়ানের মত একই কথা প্রলাপের মত বলেই চলেছেন। এইরকম সময় তারা দুজনে শঙ্কিত হয়ে পরল কারণ ওদের মনে হচ্ছিল উনি মারা যেতে পারেন! এই বিষয়ে সেই জ্ঞানী প্রতিবেশী মহিলাও তাদের বলতে পারছিলেন না যে মৃত দেবদূতদের নিয়ে ঠিক কি করা উচিৎ।
তথাপি ইনি প্রখর শীতের কামড় থেকে শুধু বাঁচলেনই না বরঞ্চ রোদ ঝলমলে দিনের সাথে উন্নতি হল দেবদূতের স্বাস্থ্যের! বহুদিন উনি নিশ্চল হয়ে পরেছিলেন অদূরে উঠোনের এক কোণে যেখানে তাঁকে কেউ দেখতে পাবে না। ডিসেম্বর মাসের শুরুতে বেশ বড় শক্ত কিছু পালক গজাতে দেখা গেল তার ডানাতে ঠিক কাকতাড়ুয়ার মতন যেন ওনার দুর্ভাগ্যের অধঃপতনের আরো এক প্রতীক! কিন্তু এই পরিবর্তনের কারণ উনি নিশ্চয়ই জেনে থাকবেন কারণ উনি খুব সচেতন ছিলেন যেন কারুর যেন এই পরিবর্তন চোখে না পরে এবং কেউ যেন তাঁকে শুনতে না পায় যখন উনি সামুদ্রিক গানগুলো আকাশ ভরা তারার নীচে গান।
একদিন সকালে যখন এলিসেন্ডা একগাদা পেঁয়াজ কাটছিল দুপুরের আহারের জন্য। ঠিক তখন তার রান্নাঘরের ভেতরে সে একটা সামুদ্রিক হাওয়া অনুভব করল। সে জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়াল এবং দেখল দেবদূত এই প্রথম ওড়বার চেষ্টা করছে। কিন্তু তিনি এত আনাড়ি ছিলেন যে ওনার নখের দ্বারাই সব্জী বাগানের একটা হলরেখা সৃষ্টি হল এবং চালাঘরের চালাটা প্রায় ডানা ঝাপটানোর ঠ্যালায় পরেই যাচ্ছিল। খুব বেশী সুবিধে উনি করতে পারছিলন না। কিন্তু যা হোক খানিক উচ্চতায় তিনি নিজেকে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। এলিসেন্ডা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখল উনি এলাকার শেষ বাড়িটার ওপর দিয়ে উড়ে গেলেন জরাগ্রস্ত বুড়ো শুকুনের মত ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে। সে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল নিজের জন্য এবং দেবদূতের জন্যও বটে ! তার পেঁয়াজ কাটা শেষ হয়ে গেলেও, সে তখনও আকাশের দিকে চেয়েই রইল যতক্ষন পর্যন্ত ওনাকে দেখা যায় কারণ ওই দেবদূত এখন আর এলিসেন্ডার জীবনে বিরক্তির কারণ নয়— বরঞ্চ সমুদ্রের দিগন্ত রেখায় এক কাল্পনিক বিন্দু মাত্র।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
বৈশাখী, তোমার অনুবাদ করা গল্পটা পড়লাম । সাবলীল স্বচ্ছন্দ অনুবাদ! কিন্তু আমি গল্পের বিষয়বস্তু বুঝে উঠতে পারিনি ! নরওয়ের মানুষদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে হয়তো ধ্যানধারণা না-থাকার জন্যেই এমনটা হল। তোমার অনুবাদ ত্রূটিহীন। শুধু বেশ কয়েক জায়গায় “পড়ে” না-লিখে লেখা হয়েছে “পরে” । নিশ্চয়ই টাইপিং মিসটেক। তোমাকে জানাই অনেক অনেক শুভেচ্ছা।