মূল রচনা – অ্যামব্রোজ বিয়ার্স (Ambrose Bierce) গল্পের নাম “One Summer Night”
অনুবাদ – যূথিকা আচার্য্য
লেখক পরিচিতি – অ্যামব্রোজ গিনেট বিয়ার্স, জন্ম ২৪শে জুন ১৮৪২, ওহায়ো রাজ্যে, মৃত্যু ১৯১৪ সালে, স্থান মেক্সিকো। রিয়্যালিস্টিক ফিকশন অর্থাৎ বাস্তবসম্মত কাল্পনিক গল্প এবং ব্যঙ্গাত্মক বীভৎস রসের স্রষ্টা হিসেবে অ্যামব্রোজ বিয়ার্স বিশ্ব সাহিত্যের আঙিনায় অত্যন্ত সুপরিচিত একটি নাম। এছাড়া কবি ও সাংবাদিক হিসেবেও তিনি যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করেন।
অনুবাদকের তরফ থেকে – অনুবাদ নয়, লেখক অ্যামব্রোজ বিয়ার্সের লেখা “One Summer Night” গল্পটির পুননির্মাণ করার চেষ্টা করেছি এখানে। মূল গল্পটির স্বল্প পরিসরের সঙ্গে ন্যারেটিভ এবং চরিত্র চিত্রণ যোগ করে গল্পটিকে একটি নতুন রূপ দেওয়া হয়েছে। পাঠক হিসেবে আপনাদের ভালো লাগলে জানবো আমার পরিশ্রম সার্থক।
“হ্যাঁ রে রিচার্ড, কাজটা কি ঠিক হল?”
প্রশ্নকর্তা কেভিন এবং যার উদ্দেশে প্রশ্নটা করা, অর্থাৎ রিচার্ড, দুজনেই তখন মনে মনে নিজেদের মুন্ডপাত করছিল। মাঝরাত্রিতে কবরখানার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল দুই বন্ধু। সন্ধ্যের পর থেকেই এলোমেলো ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঠান্ডা হাওয়া যেন বর্ষাতি ভেদ করে গায়ের চামড়া কেটে নিচ্ছে। কবরখানার কেয়ারটেকার জেস এখনো এসে পৌছোয়নি। কখন আসবে কে জানে? টেনশনে রিচার্ডের হাত-পা কাঁপছিল। তার উপরে আবার কেভিনের ঘ্যানর ঘ্যানর। আর সহ্য হল না তার। খেঁকিয়ে উঠল রিচার্ড।
“তোর সমস্যাটা কী বলতো কেভিন? গতকাল তো খুব অ্যাডভেঞ্চার অ্যাডভেঞ্চার বলে লাফাচ্ছিলিস। তাহলে এখন আবার নাকি সুরে কাঁদছিস কেন? দেখছিসিই তো জেস এখনো আসেনি। অত ভয় তো যা হোস্টেলে ফিরে যা। যাচ্ছেতাই!”
কেভিন মিনমিন করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলো, কিন্তু রিচার্ডের মেজাজ দেখে তার মুখে আর কথা জোগালো না। বেচারা সাদাসিধে স্বভাবের ছেলে। মনের কথা মুখ ফুটে বলে ফেলেছে। রিচার্ডের অবস্থাও ছুঁচো গেলার মতোই। তবে সেকথা নিজের মুখে স্বীকার করার কোনো ইচ্ছে তার ছিল না। ডাকাবুকো স্বভাবের জন্য মেডিক্যাল কলেজের সিনিয়র-জুনিয়র সবাই বেশ খাতির করে তাকে। সিনিয়র ব্যাচের ছেলেদের সঙ্গে গতকাল সে বাজি ধরেছিল যে এক রাত্রির মধ্যে ডাইসেকশনের জন্য ফ্রেশ বডি নিয়ে আসবে। শর্ত অনুযায়ী আগামীকাল সূর্য্য ওঠার আগে লাশকাটা ঘরে বডি জমা দিতে হবে তাকে। বাজি জিতলে পুরস্কার এক বোতল সিঙ্গল মল্ট। তবে হারলে ওই বোতলের দাম রিচার্ডের পকেট থেকে যাবে।
রিচার্ড ভাবছিল যে কেভিনকে সঙ্গে আনাটাই ভুল হয়েছে। এর চাইতে নীল কিংবা ডেভিডকে নিয়ে এলে বেশি ভালো হত। অন্তত এই নাকি কান্না তাকে সহ্য করতে হত না। কিন্তু অমনি আবার মনে পড়ল যে জেসের সঙ্গে কথা বলে সব ব্যবস্থা কেভিনই করেছে। জেস কে হাত না করতে পারলে আর্মস্ট্রংদের সমাধিঘর থেকে বডি সরানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়াতো। আর্মস্ট্রং পরিবারের শেষ প্রতিনিধি বুড়ো আর্মস্ট্রং যে কাল সকালে পটল তুলেছে, এই খবরটাও কেভিনেরই আনা। কাজেই কেভিনকে চটানো ঠিক হবে না। ফিউচারে কখন আবার কাজে লাগবে কে জানে।
গলাটা একটু নরম করে রিচার্ড বলল, “তুই জেসকে সবকিছু ঠিকঠাক বুঝিয়ে বলেছিলিস তো? এখনও এল না কেন?”
কেভিন ঠান্ডায় হিহি করে কাঁপছিল। কোনোরকমে বত্রিশপাটি দাঁতের বাদ্যি বাজাতে বাজাতে সে যা বলল তার অর্থ হল এই যে, জেস যখন অ্যাডভান্স টাকা নিয়েছে তখন কাজ সে করবেই। কিন্তু লোকটা বদমেজাজী। কোনো কিছু নিয়ে জোরাজুরি করলে খামোখা বেঁকে বসতে পারে। তাই অপেক্ষা করা ছাড়া আর অন্য কোনো উপায় নেই।
রিচার্ড সমাধিঘরটার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “শালার বৃষ্টিটাও বেড়েই চলেছে। জেসের দেরী হবে জানলে আরেকটু দেরী করেই আসা যেত।”
কেভিন বলল, “একটা কাজ করি চল। গেটটা টপকে সমাধিঘরটার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। ওখানে একটু শেড আছে। ওখানে দাঁড়ালে অন্তত ভিজতে হবে না।“
জ্ঞান ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই হেনরি আর্মস্ট্রং বুঝলেন যে কোথাও মস্ত বড় একটা গন্ডগোল হয়েছে। তার চারপাশে সবকিছু জমাট অন্ধকারে ঢাকা। তিনি যে শয্যাটিতে শুয়েছিলেন সেটা অসম্ভব নরম হলেও, উঠে বসার চেষ্টা করতেই শক্ত একটা দেওয়ালে মাথা ঠুকে গেল তার। অন্ধের মতো এদিক ওদিক হাতড়ে হেনরি বুঝলেন যে বড় একটা কাঠের বাক্সে তাকে বন্দী করে রেখেছে কেউ!
ব্যাপারটা বুঝতে আরো কিছুক্ষণ সময় লাগলো তার। কাঠের বাক্সে এত নরম বিছানা এল কোথা থেকে? কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে তিনি ভাবতে শুরু করলেন যে আদতে হলটা কী। গত দু-সপ্তাহ ধরে তার শরীরের গতিক মোটেই ভালো ঠেকছিল না। আজ সকালে নিত্যদিনের অভ্যেসমতো বারান্দায় নিজের পুরোনো চেয়ারটাতে বসে ঝিমোচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ বুড়ো জনের বজ্জাত ছেলেটাকে নিজের বাগানে ঘুরঘুর করতে দেখে মাথায় রক্ত উঠে গেল তার। কাঠবাদামগুলো মাটিতে পড়তে না পড়তেই হাড়হাভাতে ছোঁড়াটা এসে নিজের পকেটে পুরে ফেলে। মানা করলে আবার বলে, দাদু তোমার তো দাঁত পড়ে গেছে। মাটিতে পড়া বাদাম নিয়ে তুমি কী করবে? তার বাদাম, তিনি যা ইচ্ছে তাই করবেন। ওই শালা চোরের তাতে কী? কপাল মন্দ। বয়স হয়ে গেছে। দৌড়ে চোর ধরবেন সেই শক্তিও আর নেই এখন তার শরীরে। অতএব চেয়ারে বসে বসেই যতটা সম্ভব নোংরা গালিগালাজ দিয়ে ছোঁড়াটার গুষ্টি উদ্ধার করছিলেন তিনি এমন সময় হঠাৎ তার চারপাশটা অন্ধকার হয়ে এল। মাটিতে গড়িয়ে পড়ার সময় শুধু শুনতে পেয়েছিলেন যে হাড়গিলে ছোঁড়াটা বাদাম টাদাম ফেলে তার দিকে দৌড়ে আসতে আসতে চেঁচিয়ে বলছে, “ও দাদু, কী হল তোমার…ও দাদু!” তারপর চোখ খুলতেই দেখেন এই অবস্থা।
আরো কিছুক্ষণ পরে মিস্টার আর্মস্ট্রং বুঝলেন যে তার আহাম্মক প্রতিবেশীরা তার অজ্ঞান অবস্থায় তাকে মৃত ভেবে কফিনে বন্দী করে কেটে পড়েছে। তার যে কেমন রাগ হল তা বুঝতেই পারছেন। বিড়বিড়িয়ে বললেন তিনি,”যত্তসব ছোটোলোকের দল!”
এ কথা সত্যি যে গোঁয়ার্তুমির জন্য পাড়ায় হেনরি বুড়োর যথেষ্ট বদনাম ছিল। নিন্দুকেরা বলে যে ওই খিটখিটে সন্দেহবাতিক স্বভাবের জন্যই নাকি বিয়েশাদিও তার করা হয়ে ওঠেনি। অমন বদরাগী মানুষের হাতে মেয়ে দেবে কে! তবে এটাও অস্বীকার করা যাবে না যে জোয়ান বয়সে ভদ্রলোক ছিলেন প্রকৃত অর্থেই কাজের মানুষ। বদমেজাজের জন্য লোকজন তাকে এড়িয়ে চলত ঠিকই, কিন্তু অতি বড় নিন্দুকেও একথা স্বীকার করতে বাধ্য হত যে হেনরির হাতে পড়লে যত কঠিনই হোক না কেন কার্যোদ্ধার হবেই হবে। কাজের দায়িত্ব নিয়ে যারা শেষ করতে পারতো না, হেনরির চোখে তারা ছিল কীটস্য কীট।
কফিনের মধ্যে শুয়েই শুয়েই হেনরি গজগজ করছিলেন। হাড়বজ্জাত লোকজন তার সম্পত্তির লোভেই যে এমন উজবুকের মতো কান্ডখানা করেছে সে ব্যাপারে তার কোনো সন্দেহ ছিল না। তার পরিবার-পরিজন নেই। কাজেই ভিটে-জমি সমেত বাড়িখানা যাবে সরকারের সেবায় সে তো জানা কথা। কিন্তু দেরাজ ভর্তি তার মায়ের গয়নাগাটি, দামী দুস্প্রাপ্য বই, খাঁটি রুপোর বাতিদান, নরম সিল্কের টেবল কভার, বিছানার চাদর রয়েছে। মর্কটগুলোর হাতে পড়ে তার সাতপুরুষের জমানো সেসব দুমূর্ল্য জিনিসগুলোর বারোটা বাজবে, সেকথা ভাবতেই তিনি আরো বেশি তিতিবিরক্ত হয়ে উঠলেন।
কফিনের ডালায় ভেতর থেকে দু-তিনবার দুম-দুম করে ঘুষি মারলেন হেনরি। তাও ভাগ্য ভালো যে তার পরিবারের নিজস্ব সমাধিগৃহ ছিল। মুর্খগুলো নিশ্চয় সেখানেই রেখেছে তার কফিনখানা। খামোখা শত্রুতা করে মাটির তলায় চাপা দিয়ে দিলে যে এতক্ষণে স্রেফ অক্সিজেনের অভাবেই তিনি চন্দ্রবিন্দু হয়ে যেতেন, সেকথা তিনি জানতেন।
রাগের মাথায় এক নাগাড়ে দশ-বারোখানা ঘুষি মারার পর হেনরির মাথা ঠান্ডা হল। প্রায় চব্বিশ ঘন্টা হয়ে গেছে পেটে একফোঁটা জল বা খাবারের একটা দানাও পড়েনি। শরীর যারপরনাই দুর্বল। তাছাড়া কফিনের ভেতরে হাওয়া ঢুকছে যৎসামান্য। কাজেই কষ্ট করে টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছিলেন তিনি। চেঁচিয়েও লাভ নেই। গলা থেকে ফ্যাঁসফ্যাঁসে আওয়াজ বেরোচ্ছে। হেনরি চুপচাপ শুয়ে ভাবছিলেন কী করা যায়, এমন সময় সমাধি ঘরের বাইরে হঠাৎ দুই জোড়া ভারী পায়ের আওয়াজ শুনে চমকে উঠলেন তিনি।
পা-জোড়াদের মালিক দুজন পুরুষ তাতে সন্দেহ নেই। দুটো অল্প বয়স্ক ছেলে। নীচু গলায় ফিসফিসিয়ে কথা বলছে তারা। কফিনের ডালাটায় কান রেখে ওদের কথোপকথন শোনার চেষ্টা করলেন হেনরি।
প্রথমজন বলল, “কী হল বল তো রিচার্ড, জেস এখনো এল না কেন?”
দ্বিতীয়জন একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “ব্রাদার তুইও যেখানে, আমিও সেখানে। আমি কী করে জানবো?”
প্রথমজন আবার নীচু গলায় বলায়, “জায়গাটা কেমন যেন ভুতুরে, তাই না?”
অপরপক্ষ থেকে তাচ্ছিল্য ভরা জবাব এল, “লে হালুয়া! আচ্ছা কেভিন, তুই কবরখানায় কী আশা করে এসেছিলিস শুনি? এত ভয় যখন বডি আনতে এলি কেন বে? যত্তসব!”
“না না মানে বৃষ্টি হচ্ছে তো। তাই একটু কেমন কেমন লাগছে…”
কফিনের ভেতর থেকে সবকিছুই শুনছিলেন হেনরি। প্রথম ছোকরাটির উপর তিনিও বড় বিরক্ত হলেন। ব্যাটা ভীতু কোথাকার! এই ধরনের ছেলেছোকরারা তার দুচক্ষের বিষ । যে কাজ করতে এসেছিস, সে কাজ করে তবে ফিরবি। ভূত-ফুত সব বাজে কথা। কাজের কাজ করার নাম নেই, ব্যাটাচ্ছেলে দেখ মেনি বেড়ালের মতো নাকি সুরে কাঁদছে!
বডি নিতে আসার কথাটা শোনা মাত্রই তিনি ছেলেদুটো কোথা থেকে এবং কী করতে এসেছে তা পরিস্কার বুঝতে পেরেছেন। কবরখানা থেকে কয়েক মাইল দূরেই মেডিক্যাল কলেজ। বোঝাই যাচ্ছে যে ছোকরাদুটো সেখান থেকেই আসছে। পড়ুয়া ডাক্তার হবে নিশ্চয়। কাটাছেঁড়া করার জন্য মৃতদেহ খুঁজছে। হেনরির মৃত্যুর খবর পেয়েই নিশ্চয় এসে জুটেছে দুই হতভাগা। জোরে জোরে দুবার শ্বাস টানলেন তিনি। একবার ডেকে দেখবেন নাকি? ছেলেগুলো হবু ডাক্তার। তার অবস্থা জানলে নিশ্চয় সাহায্য করবে ওরা। তক্ষুণি আবার মনে হল, নাহ্, জেসের জন্য চুপচাপ অপেক্ষা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ছেলেদুটো নেহাতই বাচ্চা। কফিনের ভেতর থেকে ডাকাডাকি করলে খামোখা ভয়টয় পেয়ে কেলেঙ্কারী কান্ড করতে পারে। সেই তুলনায় জেস অনেক বেশি সাহসী। সে জোয়ান ছেলে। আফ্রিকার মানুষ। যেমন অসুরের মতো শক্তি ধরে গায়ে, তেমনই সাহস। প্রায় দশ বছর ধরে এই কবরখানার দেখভাল করছে সে। মাটি খোঁড়া, মাটি চেপে চেপে কবর দেওয়া, কবরখানা পরিস্কারের কাজ সবকিছু জেস একা হাতে সামলায়। মৃতের লোকজন আর আত্মীয়স্বজন তো দুফোঁটা চোখের জল ফেলেই ভাবে চমৎকার দায়িত্বপালন করেছে তারা। আসল কাজ তো করে ওই জেস।
জেসের খোঁড়া কবর দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়, একথা হেনরি নিজেও বহুলোককে বলেছেন। তাছাড়া ছোকরা এক কথার মানুষ। যা বলে তা করে দেখায়। যদিও জেস যে তলে তলে বেআইনী বডি চালানের ব্যবসা করে সেকথা হেনরি জানলেন আজই। তবুও তাতে রাগ করার মতো কিছু দেখলেন না তিনি। জেস বেচারা গরীব। ফাঁকতালে দুটো পয়সা ইনকামের সুযোগ সেই বা ছাড়বে কেন? তাছাড়া বডি না পেলে মেডিক্যাল স্টুডেন্টদের পড়াশোনাই বা হবে কী করে?
মিনিট খানেক পরে জেসের বুট জুতোর আওয়াজ পেলেন তিনি। সাবধানে চাবি ঘুরিয়ে সমাধিঘরের দরজা খুললো সে। তারপর প্রায় নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এল। পেছনে অন্য ছেলেদুটোর পায়ের আওয়াজ।
এই সুযোগ। ভাবলেন হেনরি। জেস নিখুঁতভাবে কফিনের পেরেকগুলো তুললো একে একে। তারপর সে শক্ত হাতে ডালাটাকে তুলে ধরা মাত্রই আচ্ছন্নের মতো নিজের শয্যা ছেড়ে উঠে বসলেন তিনি। ঠিক সেই সময় কাছাকাছি বাজ পড়লো কোথাও। কান ফাটানো আওয়াজ আর ভুতুরে নীলচে আলোর ঝলকানিতে ছাত্র দুজন আর জেস হকচকিয়ে দেখল যে খোলা কফিনের মধ্যে সদ্য মৃত হেনরি আর্মস্ট্রং সটান উঠে বসে রয়েছেন।
ছেলে দুটো চীৎকার করে যে যেদিকে পারলো দৌড়ে পালালো। জেসের অবশ্য ব্যাপার আলাদা। মৃত শরীরের সঙ্গে তার নিত্যদিন ওঠাবসা। মড়া মানুষের এমন বেয়াদবি তার সহ্য হবে কেন?
ঘন্টা তিনেক পরের কথা। তুমুল ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে সাড়ে চার মাইল রাস্তা দৌড়ে রিচার্ড আর কেভিন যখন তাদের কলেজে পৌছোলো, তখন প্রায় ভোর হয় হয়। আতঙ্কে দুজনেরই মুখ তখনো কাগজের মতো ধবধবে সাদা। শরীরের এখানে সেখানে ছড়ে গেছে। দৌড়তে দৌড়তে রাস্তায় কতবার আছাড় খেয়ে পড়েছে তার ঠিক নেই। জলে ভিজে, কাদা মেখে রিচার্ডকে দেখাচ্ছিল ঠিক প্রেতের মতো। কেভিনের অবস্থা আরো খারাপ। তার ডানদিকের ভুরু কেটে ভেতরের সাদা মাংস দেখা যাচ্ছে। গালে, ঘাড়ে, জামার আস্তিনে রক্তের ছোপ।
কেভিন হাঁফাচ্ছিল, “আমরা কী ভুল দেখলাম রিচার্ড? পুরো ব্যাপারটাই দুঃসপ্ন নয়তো?”
রিচার্ডও কাঁপছিল থরথরিয়ে। সে কোনোরকমে দুপাশে মাথা নাড়িয়ে বলল, “দুঃস্বপ্ন নয়, পুরো ব্যাপারটাই সত্যি। আমিও দেখেছি।“
“জেসের কী হল? ওকে দেখেছিস?”
রিচার্ড দুপাশে মাথা নাড়ালো। “জানি না। চল ভেতরে যাই। মর্গে খবর দিতে হবে। তোর কপালে সেলাই দিতে হবে। চল তাড়াতাড়ি …“
আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে গেছিল দুজনেই। তার উপরে প্রচুর রক্ত বেরিয়ে যাওয়ার ফলে কেভিনের অবস্থা কহতব্য নয়। কোনোরকমে কেভিনের শরীরের ভার নিজের কাঁধে নিয়ে প্রায় ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে লাশকাটা ঘরের দিকে হাঁটতে শুরু করলো রিচার্ড। কিছুটা এগোতেই দুজন অবাক হয়ে দেখলো যে মর্গের বাইরে একখানা ছোটো ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির পাদানিতে রক্তের ছাপ। কেভিন কাতর স্বরে বলল, “আবার কী হল রে রিচার্ড? এত সকালে কার গাড়ি এখানে?”
রিচার্ড কী বলবে বুঝতে পারছিল না। গতকাল রাত্রে যা অভিজ্ঞতা হয়েছে তারপর নতুন করে ভয় পাওয়ার মতো মানসিক অবস্থা ওদের ছিল না। সে ভাবল যা হওয়ার হবে। এই সপ্তাহে বডি আনার দায়িত্ব ছিল ওদের দুজনের। কিন্তু কাল রাত্রে যা দেখেছে তারপর বেঁচে থাকতে আর কবরখানার দিকে পা বাড়াবে না তারা। তাতে যে যা বলে বলুক। তাছাড়া এই কাকভোরে মর্গের সামনে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে যখন, তার মানে কেউ না কেউ লাশের ব্যবস্থা করেছে। জেস না পারুক, অন্য কেউ করেছে। রিচার্ড স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমিও জানি না। চল ভেতরে গিয়ে দেখি।“
যন্ত্রের মতো লাশকাটা ঘরে ঢুকতেই চমকে উঠল দুই বন্ধু। দরজার পাশে একটা ছোটো বেঞ্চে জেস বসে আছে। পরনে বর্ষাতি। মুখে চওড়া হাসি। সে হাসিমুখেই বলল, “আমার যেমন কথা, তেমন কাজ। এখন বাকি টাকাটা বের করুন দেখি।”
রিচার্ড কোনোরকমে বলল, “তু-তু-তুমি!”
জেস হেসে ডাইসেকশন্ টেবলের উপর শুইয়ে রাখা, থ্যাত্লানো মাথা সমেত হেনরি আর্মস্ট্রং-এর উলঙ্গ শরীরখানা দেখিয়ে বলল, “ওই দেখুন আপনাদের মড়া। একদম তাজা।“
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন