onubad-khela

খেলা
গল্পের নাম “The Most Dangerous Game”
অনুবাদ – যূথিকা আচার্য্য
মূল রচনা – রিচার্ড কনেল (Richard Edward Connell)

চিত্র সৌজন্যে - উইকিপিডিয়া

লেখক পরিচিতি – রিচার্ড এডওয়ার্ড কনেল, জন্ম ১৭ই অক্টোবর ১৮৯৩, নিউইয়র্কে, মৃত্যু ২২শে নভেম্বর ১৯৪৯ এ। রিচার্ড কনেল মাত্র তেরো বছর বয়স থেকেই তার পিতার পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে লিখতে শুরু করেন। পরবর্তীকালে তিনি আমেরিকার অন্যতম বিখ্যাত লেখক, সাংবাদিক ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

“ডানদিকে দেখুন স্যাঞ্জার, এখান থেকে প্রায় মাইল চারেক দূরে। আইল্যান্ডটা ঠিক এইখানেই কোথাও আছে।“

ম্যাপে হুইটনির দেখানো জায়গাটাতে বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখলেন স্যাঞ্জার রেইনসফোর্ড। তারপর ইয়টের জানালার বাইরে তাকালেন।

“হুইটনি, দ্বীপের নামটা যেন কী বলেছিলে?”

হুইটনি মুচকি হাসল,“নামটা বেশ ইন্টারেস্টিং, ফাঁদ-জাহাজী আইল্যান্ড।“

বাইরের জমাট বাঁধা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে স্যাঞ্জার বললেন, “বাইরে কিছুই দেখা যাচ্ছে না!”

হুইটনি আর হাসি আটকাতে পারল না, “ইউ নো হোয়াট, আপনার দৃষ্টিশক্তিটা বাড়াবাড়ি রকমের ভালো সে খবর আমি জানি। প্রায় তিনশো মিটার দূর থেকেও এক গুলিতে আপনাকে হরিণ শিকার করতে দেখেছি। কিন্তু প্লিজ, অমাবস্যার রাতে চার মাইল দূরের ওই একচিলতে দ্বীপ দেখতে পাওয়া সম্ভব নয়। আপনার চোখের জায়গায় একজোড়া দুরবীন বসানো থাকলেও নয়।“

স্যাঞ্জার মাথা ঝাঁকালেন।

“চার মাইল দূরের কথা ছাড়ো, চার মিটার দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। আলকাতরার মতো জমাট অন্ধকার বাইরে।“

“ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের মধ্যিখানে এটাই স্বাভাবিক। একবার রিওতে পৌছে গেলে আর চিন্তা নেই। আর মাত্র কয়েকটা দিন ব্যস্।“

স্যাঞ্জার কিছু একটা ভাবছিলেন। অন্যমনস্কভাবে তিনি বললেন, “ফাঁদ-জাহাজী দ্বীপ! এরকম অদ্ভুত নামের পেছনে কোনো বিশেষ কারণ রয়েছে কী?”

হুইটনি বলল, “নিশ্চিত করে বলতে পারবো না, নাবিকদের কুসংস্কারও হতে পারে। তবে আজ সকালে আমি লক্ষ্য করেছি যে ইয়াটের ক্যাপ্টেন নীলসনকেও বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিল।“

স্যাঞ্জার রেইনসফোর্ড ভুরুদুটোকে কপালের ওপর তুলে বললেন,“সিরিয়াসলি!”

এবার তিনিও ভাবতে বাধ্য হলেন। অন্যান্য ছেলেছোকরাদের কথা না ধরলেও চলে। কিন্তু ক্যাপ্টেন নীলসন যথেষ্ট পোড় খাওয়া নাবিক। পাক্কা সাড়ে ছ ফুট লম্বা বিশালদেহী ক্যাপ্টেন নীলসনের সঙ্গে ভয় শব্দটাকে কিছুতেই পাশাপাশি বসানো যায় না। কোনো কারণ ছাড়াই ওই দৈত্যাকার সুইডিশ লোকটা ভয় পাচ্ছে, এটাও সম্ভব নয়। রেইনসফোর্ডের কপালে একটা ভাঁজ পড়লো।

“হুইটনি, তোমার কী মনে হয়? দ্বীপটার এমন বদনামের কারণ কী হতে পারে? নরখাদক কিছু উপজাতি আছে শুনেছি এদিকে, সেইরকম কিছু…”

হুইটনি দু’পাশে মাথা নাড়ালো।

“নরখাদক উপজাতিও মানুষ। যতদূর জানি ওখানে তারাও টিকতে পারেনি। লোকাল লোকজন বলে ফাঁদ-জাহাজী দ্বীপ হতভাগ্য জাহাজ আর তার নাবিকদের গিলে খায়। বোধহয় হিংস্র কোনো পশু রয়েছে। কিন্তু সবটাই অনুমান, আই অ্যাম নট শিওর।“

আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন স্যাঞ্জার। শান্ত সমুদ্রের ওপর ভেজা কালো ভেলভেটের মতো মিশমিশে গাঢ় জমাট বাঁধা অন্ধকার। মনে হচ্ছে ছুরি চালালে একটুকরো কেকের মতো কেটে ফেলা যাবে অনায়াসে। তার চোখেও মেঘ ঘনিয়ে এল। সমুদ্রের সঙ্গে কোনো চালাকি চলে না। কুহকিনী ক্যারিবিয়ান সাগরের এই অংশটুকু সম্পর্কে সভ্য জগতের মানুষ এখনও তেমন কিছুই জানে না। ওই দ্বীপে কী এমন রহস্য লুকিয়ে রয়েছে কে জানে!

হুইটনি ম্যাপখানা গুটিয়ে শেল্ফে তুলে রাখল। তারপর খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে বলল,“চিন্তা করবেন না স্যাঞ্জার, আর আধঘন্টার মধ্যেই ওই বিশ্রী দ্বীপের জায়গাটা আমরা পেরিয়ে যাব। ইয়টের টীম খুব সাবধানে কাজ করছে।“

স্যাঞ্জার বললেন, “চিন্তা নয় হুইটনি। চোখের সামনে এতবড় একটা রহস্য রয়েছে, অথচ জানার উপায় নেই। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়। বলে বোঝানো যাবে না।“

হুইটনি হাসল।

স্যাঞ্জার পকেট থেকে পাইপখানা বের করে তাতে খুব মনোযোগ সহকারে গুঁড়োনো তামাক ভরে বললেন, “জাগুয়ার গানগুলো কি রিওতে পৌছে গেছে?”

হুইটনি একটু ভেবে বলল, “পার্ডে থেকে বন্দুকের সাপ্লাই আসার কথা। চলে আসাই স্বাভাবিক। তবে চিন্তা করবেন না, আমাজনের জঙ্গলে শিকারের ট্রিপটা আপনি খুব এনজয় করবেন। সে ব্যাপারে আপনাকে গ্যারান্টি দিতে পারি আমি। গাইড হিসেবে আমি এর আগেও ওদিকে গিয়েছি কয়েকবার। যদিও শিকার খুব একটা ভালো লাগে না, কিন্তু আমাজনের জঙ্গল আমার বড় প্রিয়।“

স্যাঞ্জারের মুখে একটা চওড়া হাসি দেখা দিল এবার।

“স্যরি হুইটনি। শিকারের আকর্ষণ তুমি বুঝবে না আর ওটা বোঝানো সম্ভব নয়। ওর মতো খেলা আর কিচ্ছু হয় না। ইট ইজ দ্যি বেস্ট স্পোর্ট ইন দি ওয়ার্ল্ড!”

হুইটনি মৃদু স্বরে বলল, “হ্যাঁ, শিকারীর জন্য খেলা তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু যাকে শিকার করবে সেই জাগুয়ারটা এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করতেই পারে।“

স্যাঞ্জার মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন তার সহযাত্রিণীটির দিকে। এসব দার্শনিকের মতো কথাবার্তা তার কোনো কালেই পছন্দ নয়। সোজা কথার মানুষ। অনর্থক ইমোশন তার কাছে স্রেফ ন্যাকামো। তিনি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “একটা কথা মনে রেখো হুইটনি, পৃথিবীতে শুধুমাত্র দু’ধরনের জীব থাকে। শিকার এবং শিকারী! যে শিকার করতে পারে না, সে অন্য কারোর শিকারে পরিণত হয়। জাগুয়ারটা কে আমি শিকার না করলে সে হরিণ শিকার করবে। ওই হরিণটার জন্য কষ্ট হয় না তোমার?”

“জাগুয়ার শিকার করে তার পেটের দায় মেটাতে, আর আপনারা শিকার করেন কয়েক মিনিটের উত্তেজনার খোরাক জোটাতে। দুটো এক জিনিস নয়।“

স্যাঞ্জার একখানা যুৎসই জবাব দিতে যাচ্ছিলেন। হুইটনি তার আগেই মুখ ঘুরিয়ে নিল, “গুড নাইট স্যাঞ্জার। আমি ঘুমোতে যাচ্ছি। কাল সকালে কথা হবে।“

হুইটনি বেরিয়ে গেলে স্যাঞ্জার কিছুক্ষণ বিরক্ত মুখে কেবিনের দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন। যত্তসব মেয়েলি বুদ্ধি! শিকারের আবার ইমোশন কীসের! ধুস্। পাইপটাকে ধরিয়ে তিনি লোহার সরু সিঁড়ি বেয়ে মেইন ডেকে উঠে এলেন। একটা ডেক চেয়ারে বসে পাফ নিলেন বুক ভরে। অদ্ভুত একটা রাত্রি। জমাট বাঁধা রক্তের মতো কালো। কনট্রোল রুমে টিমটিমে একটা আলো জ্বলছে। মৃত পশুর চোখের মতোর ঘোলাটে হলুদ রং তার। স্যাঞ্জারের মনে হল যে এই অন্ধকারটাই যেন সেই আলোর ঔজ্জ্বল্যকেই গ্রাস করে ফেলেছে। ইঞ্জিনের আর প্রপেলারের আওয়াজ একসঙ্গে যুগপৎ ঝিম ধরানো আফ্রিকান রণ দামামার মতো শোনাচ্ছিল। অজান্তেই তার চোখ দুটো বুজে এল।

গুডুম্-গুড়ুম্-গুড়ুম্… ধড়মড়িয়ে উঠলেন স্যাঞ্জার। গুলির আওয়াজ! ভুল শোনেননি। ওখানেই তো, ফাঁদ-জাহাজী দ্বীপ। ওদিক থেকেই এল আওয়াজটা। পর পর তিনবার! গুলির আওয়াজ যখন আছে, মানুষও নিশ্চয় থাকে ওখানে। তবে যে হুইটনি বলল…

উত্তেজনার বশে ইয়টের রেলিং-এর ওপর চড়লেন তিনি। রেলিং আর মাস্তুলের মধ্যে বাঁধা একটা শেকল শক্ত করে ধরে উত্তরদিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন। শেকলটা আলগোছে আটকে ছিল এতক্ষণ রেলিং-এর সঙ্গে। ওপরে চাপ পড়তেই সেটা রেলিং থেকে সরে গেল। ব্যাপারটা কী হল বোঝার আগেই ভারসাম্য হারিয়ে জলে গিয়ে পড়লেন স্যাঞ্জার।

প্রথমে খানিকটা হতভম্ব হয়ে গেলেও কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সম্বিৎ ফিরে পেলেন তিনি। মন্দের ভালো যে, ক্যারিবিয়ানের জল রক্তের মতো উষ্ণ। তাছাড়া হাঙরের উৎপাতও নেই তেমন। স্রেফ হাইপোথার্মিয়া হয়ে মরার বা হাঙরের পেটে যাওয়ার সম্ভবনা অন্তত নেই। নাকে মুখে বেশ খানিকটা নোনা জল ঢুকেছে। গলা আর নাকের জ্বলুনি উপেক্ষা করে ঠোঁটের সামনে হাতদুটো জড়ো করে চীৎকার করলেন তিনি,

“হেল্প মী! হেই হেই…নীলসন, হুইটনি… হেল্প মী!”

লাভ নেই। হাওয়ার বিপরীতে চেঁচিয়ে কোনো লাভ নেই। পাকা শিকারীর মতোই পুরো ব্যাপারটাকে তৎক্ষণাৎ ছকে ফেললেন তিনি। ইনস্টিংক্ট অনুযায়ী তার ইচ্ছে করছে ইয়টের পেছনের সাঁতার কেটে যেতে। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলছে অন্য কথা। তিনি খুব ভালো করেই জানেন ইয়টের ভেতর থেকে সাহায্য না পেলে সাঁতরে ইয়টে পৌছোনো প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া ইয়ট ফুল স্পীডে চলছে। খুব কাছাকাছি চলে গেলে প্রপেলরের টানে পড়েই মৃত্যু হওয়াও অসম্ভব নয়। প্রপেলারের ব্লেডে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলেও লোকজন কিছুই টের পাবে না। দুমিনিটের মধ্যে সামুদ্রিক জীবজন্তুরা তার ছেঁড়াখোড়া শরীরখানা খেয়ে সাবাড় করে দেবে।

দ্বিতীয় রাস্তা রয়েছে দক্ষিণ দিকে। ফাঁদ-জাহাজী দ্বীপ। সময়ের হিসেব করে দেখলেন। মোটামুটি মাইল খানেকের মধ্যেই রয়েছে দ্বীপটা। ইয়টের পেছনে সাঁতরে লাভ নেই। ও দশ পনেরো মিনিটের মধ্যেই নাগালের বাইরে চলে যাবে। তার চাইতে বরং সাঁতরে ওই দ্বীপে ওঠাই ভালো। একটু আগেই গুলির আওয়াজ শুনেছেন। কাজেই সভ্য মানুষ ওখানে আছেই। আর মানুষ যখন আছে, তখন জল আর খাদ্য দুটোই পাওয়া যাবে। অন্তত খিদেয় বা তেষ্টায় শুকিয়ে মরতে হবে না। মনস্থির করে দ্বীপের দিকে সাঁতার কাটতে লাগলেন তিনি।

প্রায় আধঘন্টা সাঁতার কাটার পর সমুদ্রতটে ঢেউ ভাঙার আওয়াজ পাওয়া গেল। আবার একটা গুলির আওয়াজ, সঙ্গে কোনো একটা পশুর মরণ চীৎকার। পরিস্কার বোঝা গেল না যদিও কী পশু। কিন্তু গুলির শব্দ শুনে স্যাঞ্জার বুঝলেন যে শিকারী খুব পাকা হাতে পিস্তল চালিয়েছে। পিস্তল চালিয়ে প্রমাণ সাইজের শিকার করা মুখের কথা নয়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সমুদ্রতটে এসে পৌছলেন তিনি। একটা চওড়া পাথরের ওপর চড়ে রাতটা কাটলো। ভোরের দিকে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুম যখন ভাঙলো তখন সূর্য্য আকাশের মাঝখানে। খিদেয় পেটে মোচড় দিলেও, টানা ঘুমের ফলে ক্লান্তি অনেকটাই কমেছিল তার। শরীরে নুনজল বালি লেগে আছে এখানে সেখানে। চামড়া কেটে ছড়ে গেছে কয়েক জায়গায়। সেই জ্বলুনিও রয়েছে।

গতরাত্রিটা পুরোটাই দুঃস্বপ্ন বলে মনে হচ্ছিল তার। কিন্তু পরমুহুর্তেই আবার মনে পড়ল যে পিস্তলের আওয়াজ শুনেছেন গতরাত্রে এখানে। কেউ বা কারা শিকারে বেরিয়ে ছিল। এখন প্রশ্নটা হল যে কী ধরনের মানুষ তারা। আড়মোড়া ভেঙে পাথরটার ওপর উঠে দাঁড়ালেন তিনি।

পাথরটার গড়নটা বেশ অদ্ভুত। প্রায় একশো মিটার লম্বা। যে পাশে জঙ্গল সেদিকটা বেশ খাড়া। অন্যদিকটা পাথরের তৈরী জিভের মতো সমুদ্রের ওপর ঝুলে রয়েছে। জঙ্গল আর সমুদ্রের মাঝখানে এবড়ো খেবড়ো কিছুটা অংশ ঢালু হয়ে সমুদ্রতটে ওপর এসে মিশেছে। ফাঁদ-জাহাজী নামখানা বোধহয় এই পাথরটার জন্যই হয়েছে, ভাবলেন স্যাঞ্জার। কোনোভাবে এই জিভের খাঁজে আটকে গেলে জাহাজের পক্ষে বেরোনো প্রায় অসম্ভব। ওটুকু ছাড়া বাকি জঙ্গলটা বেশ সাধারণ বলেই মনে হল তার। তাছাড়া অন্য মানুষ রয়েছে আশেপাশে। সেরকম ভয়ানক কিছু থাকলে তারাও বেঁচে থাকত না নিশ্চয়। ঢালু দিকটা বেয়ে সাবধানে নীচে বালিতে এসে নামলেন তিনি। নাবিকদের কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়। লোকমুখে তিল থেকে তাল হয়ে খবর ছড়িয়েছে।

জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে কিছুক্ষণ এলোপাথারি ঘোরার পর এক জায়গায় তিনি দেখলেন প্রায় পঞ্চাশ মিটার জায়গা জুড়ে মোটামুটি ভারী পশু শরীরের বুকে হেঁটে চলার দাগ। দুয়েক জায়গায় মসের ওপর রক্তের দাগ শুকিয়ে আছে। ভাঙা ঝোপঝাড়, থ্যাঁতলানো ফার্ন, মসের ওপর লেগে থাকা কাদামাটির দাগ আর ভারী বুটের ছাপ দেখে মানশ্চক্ষে পুরো ব্যাপারটা সহজেই আন্দাজ করলেন তিনি। শিকারি একাই ছিল। শিকারের ওজন প্রায় আশি থেকে নব্বই কেজির মধ্যে। জন্তুটা তাড়া খেয়ে পালিয়ে এসেছিল সমুদ্র তটের দিকে। সেদিক থেকে পালানোর উপায় নেই বুঝতে পেরে জঙ্গলে ফিরে শিকারিকে আক্রমণ করার চেষ্টা করেছিল ওটা। শিকারি বেশ ক্লোজ রেঞ্জ থেকে তিনটে গুলি পর পর চালায়। জন্তুটা আহত হয়ে পালানোর চেষ্টা করেছিল। হাঁটার শক্তি ছিল না। সামনের পা দুটোতে ভর দিয়ে শরীরটাকে ছেঁচড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল জানোয়ারটা। তারপর রোজউড ঝোপের পাশে শেষ গুলিতে শিকার সম্পূর্ণ হয়। ঝোপের পাশে মাটিতে ধাতব চকচকে কিছু একটা পড়ে ছিল। মাটিতে ঝুঁকে সেটাকে হাতে তুলে নিলেন স্যাঞ্জার। কার্তুজের খোলস। 22 ক্যালিবার পিস্তল। ক্লোজ শট! স্যাঞ্জার মুগ্ধ চোখে সেটার দিকে তাকিয়ে বললেন,“ব্রিলিয়ান্ট!!”

শিকারীর সাহসে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। একা, এত ক্লোজ রেঞ্জে শিকার করতে কী পরিমাণ পারফেকশনের দরকার তা তার বেশ জানা আছে। যে মানুষটি শিকার করছেন তিনি শুধু শিকারী নন, হি ইজ্ অ্যান আর্টিস্ট। শিকার ব্যাপারটা তার কাছে আসলে খেলা। এবং খেলাটাকে তিনি রীতিমতো উপভোগ করেন। পাকা শিকারী, ইচ্ছে করলে এক গুলিতেই শিকারকে শেষ করে দিতে পারতেন। কিন্তু এখানে খেলাটাকে আরও অ্যাডভেঞ্চারাস করে তুলতে গিয়ে জন্তুটাকে একটু একটু করে শেষ করেছেন। যদিও একটা জিনিস অদ্ভুত লাগল তার। পশুটার থাবার ছাপ দেখতে পাওয়া গেল না কোথাও।

পরমুহুর্তেই আবার ভাবলেন রেইনসফোর্ড, নিকুচি করেছে। আপাতত একটা আশ্রয় খুঁজে বের করতে হবে। জঙ্গলের স্যাঁতস্যাতে মসে ঢাকা ভেজা মাটির ওপর ভারী বুটের ছাপগুলোকে অনুসরণ করলেন তিনি। অবশেষে ঘন্টা চারেক হাঁটার পর জঙ্গলের আবছায়া আলোআঁধারি-র মধ্যেও বেশ কিছুটা দূরে তিনি একটা প্রাসাদের মতো বাড়ি দেখতে পেলেন।

এই জঙ্গলের মধ্যে এমন রাজপ্রাসাদ! নিজের মনে মনেই বিড়বিড় করে বললেন স্যাঞ্জার। পরমুহূর্তেই ভাবলেন সব চোখের ভূল। ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত মস্তিস্ক মিথ্যে মরীচিকা দেখাচ্ছে তাকে। মানুষ অসহায় অবস্থায় পড়লে সবই সম্ভব। মাঝসমুদ্রে হারানো নাবিকের দল যেমন দেখে সবুজে ঢাকা দ্বীপ, আবার পথ হারানো মরুযাত্রী দেখে খেজুর গাছে ঘেরা টলটলে স্বচ্ছ জলের দিঘী। বিপদে পড়লে মস্তিস্ক নিজেই মিথ্যে মায়াজাল তৈরী করে। আর সেই জালে একবার পা দিলে আর রক্ষে নেই।

আঙুল দিয়ে মাথার দু’পাশের রগদুটোকে চেপে ধরলেন স্যাঞ্জার। চোখ দুটো বন্ধ করে নিজেই নিজেকে কড়া গলায় বললেন, থিঙ্ক স্ট্রেইট রেইনসফোর্ড। এর চাইতে অনেক বেশি বিপদের মোকাবেলা করেছ তুমি আগে। তাহলে এত সহজে হার মানবে কেন?

মিনিট পাঁচেক পর চোখ খুললেন তিনি। আশ্চর্য! প্রাসাদটা এবার আরো পরিস্কার দেখাচ্ছে। ওটা মরীচিকা তবে কিছুতেই নয়। এদিকে আকাশে আলো কমে এসেছে। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই সন্ধ্যা নেমে আসবে। মনস্থির করে প্রাসাদের দিকে পা বাড়ালেন স্যাঞ্জার। পনেরো মিনিট জোর কদমে হাঁটার পর প্রাসাদের গেটের সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি।

দূর থেকে রাজপ্রাসাদের মতো দেখালেও কাছে আসার পর বুঝলেন বিল্ডিংটার স্থাপত্য সত্যিই বড় অদ্ভুত। ফ্রেঞ্চ প্রমোদভবন এবং ব্রিটিশ দূর্গ, দুইয়েরই প্রভাব রয়েছে, ঔদ্ধত্য এবং সৌন্দর্য্যের একদম পারফেক্ট কম্বিনেশন। প্রাসাদের চারপাশে প্রায় দু’মানুষ উঁচু পাথরের প্রাচীর। মানানসই রাজকীয় গেটখানাও ঢালাই করা লোহার তৈরী। কে বা কারা থাকে এই প্রাসাদে সেসব কিছুই না জেনে ভেতরে ঢোকাটা বোধহয় মস্ত বড় বোকামো হতে পারে; কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে পড়লো যে বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে একটিই। খালিপেটে, অন্ধকার জঙ্গলে রাত কাটানো। রাত নামতে বেশি দেরী নেই। কাজেই মনস্থির করতে বেশি সময় লাগলো না তার। শক্ত হাতে গেট খুলে, মেহগনি কাঠের তৈরী প্রাসাদের সদর দরজার কড়া নাড়লেন তিনি।

কড়াটা নাড়তেই অদ্ভুত “ক্যাঁচ” করে শব্দ হল। যেন এর আগে কেউ কখনো ওটাকে স্পর্শ করেনি। প্রথমবার কারোর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। দ্বিতীয়বার কড়া নাড়তেই অতবড় দরজার পাল্লাদুটো হঠাৎ স্প্রিং-এর মতো ছিটকে ভেতরের দিকে খুলে গেল।

দরজা খুলতেই ঝাড়বাতির সোনালী আলো এসে পড়লো প্রাসাদের ভেতর থেকে। এতক্ষণ জঙ্গলের ভেতরের আলো-আঁধারীতে অভ্যস্ত স্যাঞ্জার বাধ্য হলেন চোখ দুটো বন্ধ করতে। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরে চোখ খুলতেই চমকে উঠলেন তিনি। সদর দরজার ফ্রেমখানা জুড়ে পিস্তল হাতে যে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাকে দৈত্যাকার কাঠের দরজাটির সামনে চমৎকার মানিয়েছে, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। অন্তত ষোলোখানা দেশ ঘোরা স্যাঞ্জার রেইনসফোর্ড স্বীকার করতে বাধ্য হলেন যে মানব শরীরে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের এমন অদ্ভুত মানানসই সঙ্গত তিনি আগে কখনো দেখেননি। লোকটা মাথায় প্রায় সাড়ে সাতফুট উঁচু, এবং বুনো বাইসনের মতো তার স্বাস্থ্য। ভাবলেশহীন মুখে পিস্তলের নলখানা তার হৃৎপিন্ডের দিকে তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। স্যাঞ্জার দু’হাত মাথার দু’পাশে তুলে বললেন, “ভয় পাবেন না। আমি নিরস্ত্র। চোর-ডাকাত নই। আমার নাম স্যাঞ্জার রেইনসফোর্ড। নিউইয়র্কে থাকি। দুর্ঘটনাবশত এই দ্বীপে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছি। জাস্ট আজ রাত্রিটুকুর জন্য আশ্রয় চাই।“

দানবাকৃতি মানুষটির চোখে মুখে কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না। কালো ইউনিফর্ম আর ধূসর পশমের জ্যাকেটে ঢাকা তার শরীরের একটি পেশীও নড়লো না। পিস্তলখানা হাতে নিয়ে সে আগের মতোই ভাবলেশহীন মুখে দাঁড়িয়ে রইল।

স্যাঞ্জার কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে আবার বললেন, “এক্সকিউজ মী, আমি স্যাঞ্জার রেইনসফোর্ড। নিউইয়র্কে থাকি। আমি আশ্রয় চাই।”

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি এবার হঠাৎ নড়ে উঠলো। মিলেটারী কায়দায় সেলাম ঠুকে দরজার একপাশে সরে দাঁড়ালো সে। স্যাঞ্জার প্রথমে হতবাক হয়ে গেলেও পরক্ষণেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসা অন্য একটি মানুষকে দেখে খানিকটা ধাতস্থ বোধ করলেন। তিনি আন্দাজে বুঝলেন যে নবাগত মানুষটিই হল ওই দানবটির মনিব এবং সেলামখানা তাঁর উদ্দেশেই ঠোকা হয়েছিল।

নবাগত মানুষটির দিকে তাকালে সবচাইতে আগে চোখে পড়ে তার দীর্ঘ, মেদহীন, সুঠাম চেহারা। ভদ্রলোক মধ্যবয়সী, অথচ মাথার সবকটি চুল ধবধবে সাদা। আবার চোখের ওপরে ভুরু এবং ঠোঁটের ওপরে পাকানো গোঁফজোড়া কুচকুচে কালো। দৃঢ় চোয়াল এবং স্থির চোখদুটো দেখলে মনে হয় মানুষটি নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল।

“আমেরিকার স্বনামধন্য শিকারী স্যাঞ্জার রেইনসফোর্ড আজ এই গরীবের কুঁড়েতে পা দিয়েছেন! অবিশ্বাস্য। আসুন, আসুন। স্বাগতম্। অধমের নাম জেনারেল জারোভ।“

নবাগত ভদ্রলোক অর্থাৎ জেনারেল জারোভ এমন নাটকীয় ভাবে বললেন কথাগুলো যে স্যাঞ্জার হকচকিয়ে গেলেন। তিনি যে স্বনামধন্য সে ব্যাপারে তার কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু এমন পান্ডববর্জিত জঙ্গলে রাজকীয় প্রাসাদ ও দানবীয় দেহরক্ষীর রহস্যময় মালিক ভদ্রলোকটি তার কুষ্টি-ঠিকুজী সব জেনে বসে আছেন, এ ব্যাপারটা জেনে তার বড়ো অস্বস্তি হল। পাকা শিকারীর ষষ্ঠেন্দ্রিয় যেন কোনো অনাগত বিপদের আশংকায় ছটফটিয়ে উঠলো, অথচ আপাত দৃষ্টিতে দেখলে সেরকম আশংকার কোনো কারণ নেই।

স্যাঞ্জার কিছু বলার আগেই সামনের মানুষটি আবার বললেন, “অবাক হলেন বুঝি? আমি আপনাকে খুব ভালো করেই চিনি। ইনফ্যাক্ট আমি আপনার অ্যাডমায়ারার। তিব্বতে স্নো লেপার্ড হান্টিং-এর লেখা আপনার সবকটি বই আমার সংগ্রহে আছে।“

স্যাঞ্জার জোর করে হেসে বললেন, “ধন্যবাদ জেনারেল। আপনাকে এভাবে বিব্রত করার জন্য ক্ষমা চাইছি। গতরাত্রে দুর্ঘটনাবশত…”

জেনারেল জারোভ তাকে মাঝপথে থামিয়ে বললেন “আপনি যে এখানে এসেছেন সে আমার সৌভাগ্য। কেন, কীভাবে, কখন, সেসব অ্যাডভেঞ্চারের গল্প না হয় ডিনারের টেবিলে হবে। আপনি ক্লান্ত, আসুন গেস্টরুমটা আপনাকে দেখিয়ে দিই। স্নান সেরে নিন। আহার, আশ্রয় বা আচ্ছাদন, তিনটের কোনেটারই অভাব হবে না এখানে।“

অতিথি ভেতরে ঢুকতেই জেনারেলের বশংবদ দৈত্যটি দরজা ভালো করে লাগিয়ে জেনারেলের পাশে এসে দাঁড়ালো। জারোভ সেদিকে তাকিয়ে বললেন, “ইভানের শরীরে ওপরওয়ালা শক্তি দিয়েছেন দানবের মতো, অথচ বেচারাকে মূক-বধির করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তার ওপরে আবার জাতের দোষে বুনো, বুদ্ধিহীন।“

স্যাঞ্জার এবার মুচকি হাসলেন, “রাশিয়ান?”

“রাশিয়ান তো তবুও মন্দের ভালো । ইভান ককেশাসের মানুষ। কসাক। আমারই জাতভাই।“

স্যাঞ্জার বাক্যহারা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। নিজের জাতের এহেন কৃতিত্বের গৌরব জেনারেল নিজে হয়তো করতেই পারেন, কিন্তু তার অতিথি হিসেবে এমন রসিকতার রসগ্রহণ করা তার স্বভাববিরুদ্ধ। স্যাঞ্জার বিব্রত হয়ে তার হাতের ওপরের ক্ষতস্থান থেকে ঘষে ঘষে নোনা বালি সরাতে লাগলেন।

জেনারেল জারোভ হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে বললেন, “কী আশ্চর্য, আপনাকে এখনো বৈঠকখানায় দাঁড় করিয়ে রেখেছি! এ হল জঙ্গলে একা থাকার ফল বুঝলেন। সামাজিকতা, সৌজন্যতা সব ভুলে গেছি। কী কান্ড, দেখুন দেখি!”

স্যাঞ্জার বললেন, “আপনি ব্যস্ত হবেন না। আজকের রাতটুকু কাটানোর মতো জায়গা পেয়েছি, এই অনেক।“

জেনারেল তার কথায় কর্ণপাত করলেন না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বৈঠকখানার দরজায় ইভান এসে দাঁড়ালো। জেনারেল জারোভ সেদিকে তাকিয়ে শুধুমাত্র ঠোঁট নাড়িয়ে নিঃশব্দে কিছু নির্দেশ দিলেন। তারপর তিনি স্যাঞ্জারের দিকে ঘুরে বললেন, “ইভান আপনাকে গেস্টরুমটা দেখিয়ে দেবে। আপনার জন্য ইভিনিং স্যুট বিছানায় রেডি করা আছে। আমার পোশাক, তবে আপনার শরীরে চমৎকার ফিট করবে। বাথ টাবে গরম জল ভর্তি করে রেখেছে ইভান। ভালো করে স্নান করে নিন। আমি ডাইনিং রুমে আপনার জন্য অপেক্ষা করবো।“

গেস্টরুমে ঢুকে কিছুক্ষণের জন্য বাক্যহারা হয়ে তাকিয়ে রইলেন রেইনসফোর্ড। কালো মেহগনি কাঠের উঁচু সিলিং থেকে দামী সিল্কের পর্দা ঝুলছে জানালা জুড়ে। ঘরের মাঝখানে রাখা দামী পালঙ্কটি এতটাই বড় যে অন্তত ছ’জন মানুষ অনায়াসে হাত-পা ছড়িয়ে একসঙ্গে ঘুমোতে পারে। পালঙ্কের ওপরে সাজিয়ে স্যুটটাকে হাতে নিয়ে কলারের ভেতরে সেলাই করা লেবেলটা ভালো করে দেখলেন স্যাঞ্জার। লন্ডনের এক অত্যন্ত নামী ডিজাইনারের তৈরী থ্রি-পিস স্যুট। সাধারণত ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের লোকজন ছাড়া অন্য কারোর পোশাক সচরাচর তৈরী করেন না সেই ডিজাইনার।

স্নানের শেষে তৈরী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইভান তাকে ডাইনিং রুমে নিয়ে গেল। খাওয়ার ঘরে পা রাখার পরই স্যাঞ্জার বুঝতে পারলেন যে মস্ত বড় ডাইনিং হলটিকে রুম বলাটা জেনারেল জারোভের নিছক বিনয় ছাড়া আর কিছুই নয়। অথবা এমনও হতে পারে যে তিনি বিলাসব্যাসনে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন যে এই সমস্ত ছোটোখাটো ব্যাপার সম্পর্কে তিনি হয়তো ওয়াকিবহালই নন।

ডাইনিং হলটি পুরোনো ফরাসী ধাঁচের। ওক কাঠের তৈরী শক্তপোক্ত সিলিং থেকে ঝুলছে ক্রিস্টালের তৈরী ঝাড়বাতি। দু’দিকের দেওয়ালে সার দিয়ে টাঙানো রয়েছে বাঘ, সিংহ, হাতি, হরিণ এবং আরো অন্যান্য পশুর মাথা। স্যাঞ্জার নিজের মনে মনেই স্বীকার করলেন যে এমন বিশাল পশু তিনি নিজেও হয়তো খুব কমই শিকার করতে পেরেছেন।

জেনারেল জারোভ ডাইনিং হলের মাঝামাঝি রাখা ঝকঝকে বিশাল টেবিলটির একপ্রান্তে বসে ছিলেন। স্যাঞ্জার ভেতরে প্রবেশ করতেই তিনি বললেন, “আসুন মিস্টার রেইনসফোর্ড, আপনার জন্য ককটেল অর্ডার করেছি।“

ডিনারের শুরুতেই ছিল হল বীট ও আলু দিয়ে তৈরী টকটকে লাল রঙের রাশিয়ান স্যুপ বর্শ এবং সঙ্গে ফরাসী রুটি ও মাখন। খাবারের স্বাদটি সম্পূর্ণ ডাইনিং হলটির মতোই রাজকীয়।

খাওয়ার সময় জেনারেল জারোভ অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললেন, “আপনার অসুবিধে হচ্ছে জানি, তবে আমি নিরূপায়। এই জঙ্গলে এর চাইতে বেশি আয়োজন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি আমার পক্ষে। আশা করি শ্যাম্পেনটা এখনো ঠিক আছে।“

বলাইবাহুল্য যে শ্যাম্পেন ও জেনারেল জারোভের আতিথেয়তা, দুইই ছিল নিখুঁত। কিন্তু সমস্যাটা হল অন্য জায়গায় এবং স্যাঞ্জার সেই কারণে রীতিমতো অস্বস্তি বোধ করছিলেন। যতবারই তিনি জেনারেলের দিকে তাকিয়েছেন ততবার লক্ষ্য করেছেন যে জেনারেল খুব নিবিষ্ট চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। যেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করে দেখছেন তাকে।

কিছুক্ষণ পর জেনারেল আবার বললেন,“আপনি নিশ্চয় ভাবছেন যে আমি আপনার সম্পর্কে এতকিছু কী করে জানলাম, তাই না? আসলে আমার নেশা ও পেশা বহুদিন ধরে ওই একটিই, শিকার। ইংরিজি, রাশিয়ান এবং ফ্রেঞ্চে লেখা প্রায় প্রত্যেকটি শিকারের বই আমি পড়েছি এবং পৃথিবীর প্রত্যেকটি বিখ্যাত শিকারীকে আমি চিনি।“

স্যাঞ্জার নিখুঁত ভাবে রান্না করা মাছের একটি টুকরো কাঁটা চামচে গেঁথে বললেন, “শিকার যে আপনার নেশা এবং ও ব্যাপারটাকে যে আপনি রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তা দেওয়ালে সাজিয়ে রাখা ওই মাথাগুলো দেখলেই বোঝা যায়। বিশেষ করে ওই বুনো মহিষের মাথাটা। সত্যি বলতে কী, এতবড় মোষ আমি কখনো দেখেছি বলেও মনে হয় না।“

“হ্যাঁ, তা সত্যিই। রীতিমতো রাক্ষসের মতো তেড়ে এসেছিল ওই পশুটা। আমার এখনও মনে আছে।“

“তারপর?”

“ আরেকটু হলেই দ্বন্দ্বযুদ্ধে ওই দানবটা জিতে যেত, বুঝলেন। আমাকে একটা বুড়ো গাছের গুঁড়িতে শিং দিয়ে চেপে ধরছিল পশুটা। আমার মাথার খুলির এক জায়গায় চিড় ধরে গিয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত আমিই জিতেছি।“ তীক্ষ্ণ চোখে মহিষের মাথাটার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললেন জেনারেল।

স্যাঞ্জার সম্মতি জানিয়ে বললেন, “জানি যে এ ব্যাপারে নানা মুনির নানা মত রয়েছে, তবে এ আমার নিজের উপলব্ধি যে শিকার হিসেবে সবচাইতে হিংস্র পশু হল ওই বুনো মহিষ।“

জেনারেল এ কথার উত্তরে কিছুই বললেন না। চোখ নামিয়ে অত্যন্ত রহস্যময় ভাবে হাসলেন শুধু। তারপর দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে, শান্ত স্বরে বললেন, “আপনি ভুল জানেন মিস্টার রেইনসফোর্ড। বুনো মহিষ নয়। ওর চাইতে অনেক অনেক বেশী হিংস্র পশুর শিকার আমি এখন করি। আমার এই দ্বীপেই থাকে তারা।“

স্যাঞ্জার অবাক হয়ে বললেন, “এখানে! এই দ্বীপে! এখানে শিকার করার মতো হিংস্র জন্তু আছে!”

জেনারেল সম্মতি জানিয়ে বললেন, “হিংস্র নয়। হিংস্রতম শিকার রয়েছে এই ফাঁদজাহাজী দ্বীপে।“

“আর ইউ সিরিয়াস?”

“একদম সিরিয়াস। বুঝতেই পারছেন যে, ন্যাচারালি এখানে বড় কোনো শিকার পাওয়া সম্ভব নয় তবে আমি পৃথিবীর অন্যান্য জায়গা থেকে আমদানী করি তাদের।“

স্যাঞ্জার চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে বললেন, “মাই গড! আমি নিশ্চয় বাঘ বা সিংহ আমদানী করেছেন তবে!”

জেনারেল হাসলেন।

“বাঘ বা সিংহ শিকারের স্পৃহা বেশ কয়েক বছর আগেই আমার মিটে গেছে।“

নৈশাহার শেষ করে নিজের সোনার সিগারেট কেস থেকে কালো রঙের দুটি সিগারেট বের করলেন জেনারেল। তারপর একটি নিজের ঠোঁটে চেপে ধরে অন্যটি অতিথির দিকে এগিয়ে দিলেন তিনি। স্যাঞ্জার লক্ষ্য করলেন যে অগ্নিস্পর্শ করা মাত্রই সিগারেট দুটি থেকে প্রায় ধূপকাঠির মতো সুগন্ধী তামাকের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল সম্পূর্ণ ডাইনিং হলে।

বাতাসে সিগারেটের সুগন্ধী ধোঁয়ার কয়েকখানা রিং ছেড়ে জেনারেল খুব নির্লিপ্ত সুরে বললেন, “দেখুন মিস্টার রেইনসফোর্ড, আমার জন্য শিকারের উত্তেজনাটাই হল আসল। ওটাই আমার বেঁচে থাকার রসদ বলতে পারেন। বাঘ বা সিংহ যতই হিংস্র হোক না কেন, আসলে তো তারা পশুই। তাদের শুধু শক্তিটুকুই সম্বল। পাকা শিকারীর বুদ্ধির সঙ্গে পাঞ্জা কষালে তারা বেশিক্ষণ টিকতে পারে না। তাছাড়া আমার প্রতিপক্ষ হিসেবে শুধুই পাশবিক শক্তি যথেষ্ট নয়।“

“কিন্তু শিকারের পশুর মধ্যে পাশবিকতা থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক জেনারেল। শিকারী হিসেবে এর চাইতে বেশি আশা করলে তো মুশকিল।“

“হ্যাঁ মানছি যে মুশকিল, তবে অসম্ভব তো নয়।“

স্যাঞ্জার ভুরু কুঁচকে বললেন, “তার মানে?”

“আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না স্যাঞ্জার, তবে আমি একদম নতুন একটি অ্যাডভেঞ্চার আবিষ্কার করেছি। জানেন নিশ্চয়, সাধ আর সাধ্য একজায়গায় থাকলে মানুষ অসাধ্যসাধন করতে পারে।“

“মাফ করবেন, কিন্তু আমি ঠিক বুঝলাম না।“

জেনারেল ভারী নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে বললেন, “একটা ব্যাপার আপনি নিশ্চয় মানবেন যে প্রত্যেক শিল্পীর শৈল্পিক ক্ষমতা ঈশ্বরের দান। ভগবান কাউকে কবি বানিয়েছেন, কাউকে গায়ক, কাউকে অভিনেতা। ঠিক তেমনি তিনি আমাকে শিকারী হিসেবেই এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। শিকারের সাধ ও সাধ্য, আমার ক্ষেত্রে দুইই ঈশ্বরপ্রদত্ত। আমার বয়স তখন মাত্র পাঁচ বছর। বাবা মস্কো থেকে একখানা ছোটো বন্দুক কিনে দিয়েছিলেন আমাকে। উনি ভেবেছিলেন যে আমি হয়তো চড়াই পাখি বা ব্যাঙ শিকার করবো, কিন্তু বন্দুক হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি শিকার করেছিলাম বাবার অত্যন্ত প্রিয় একটি পুরুষ টার্কি। তবে বাবা তাতে রাগ করেননি। বরং আমার বন্দুক ধরার কায়দা দেখে বলেছিলেন যে আমার আঙুলগুলো বন্দুকের ট্রিগার চেপে ধরার জন্যই তৈরী হয়েছে। তারপর মাত্র দশ বছর বয়সে আমি ভল্লুক শিকার করেছিলাম। একটু বড় হওয়ার পর অন্যান্য অভিজাত বংশের পুরুষদের মতোই আমিও সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলাম। কসাক ক্যাভালরীর একটা বড় ডিভিশনের দায়িত্ব সামলেছি বেশ কয়েক বছর। কিন্তু শিকারের আনন্দ বা উত্তেজনা আমি যুদ্ধের ময়দানেও কখনো অনুভব করিনি।“

এরপর জেনারেল কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্যাঞ্জারের দিকে তাকিয়ে বললেন, “রুশ বিপ্লবের ব্যাপারে আপনি নিশ্চয় জানেন মিস্টার রেইনসফোর্ড?”

স্যাঞ্জার বললেন, “হ্যাঁ, অবশ্যই। নিউজ পেপারে পড়েছি, তবে প্রত্যক্ষ কোনো অভিজ্ঞতা হয়নি সে ব্যাপারে।“

জেনারেল আরেকখানা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, “প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা যে হয়নি সেটা আপনার সৌভাগ্য। রাশিয়ার সম্রাট অর্থাৎ জারের পতনের পর অভিজাতদের জন্য ওদেশে থাকার অর্থ ছিল সপরিবারে আত্মহত্যা করা। ইনফ্যাক্ট সেইসময় সসম্মানে আত্মহত্যা করার সুযোগ পাওয়াটাও একটা বিরল সৌভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। যারা রাতারাতি রাশিয়া ছেড়ে পালাতে পেরেছিল, তারা অন্তত প্রাণে বেঁচেছিল। অন্যান্যদের অবস্থা হল পথের কুকুরদের মতো। দামী শ্যাম্পেন আর ফ্রেঞ্চ পারফিউমের সুগন্ধে চিরঅভ্যস্ত মানুষগুলির কাছে তখন এক টুকরো রুটিই হয়ে দাঁড়ালো বিরাট বড়ো প্রাপ্তি। সৌভাগ্যবশত এই দুর্ঘটনার কয়েক বছর আগেই আমি আমেরিকায় বেশ কয়েকটা এস্টেট কিনে রেখেছিলাম। কাজেই রাতারাতি রাশিয়ার সম্পত্তি হারালেও খুব বেশি সমস্যা আমার কখনোই হয়নি। তবে অপমানের জ্বালা তো ছিলই। পৈতৃক সম্পত্তি ও সম্মান, দুটোই একসঙ্গে হারানোর যন্ত্রণা ভুলতে নিজেকে শিকারের নেশায় ডুবিয়ে দিয়েছিলাম আমি। আফ্রিকার গন্ডার, ইন্ডিয়ায় হাতি, আমেরিকার গ্রিজলি ভল্লুক, একের পর এক বিভিন্ন শিকারের মাথা দিয়ে সাজিয়ে তুলছিলাম আমার বসার ঘর। কিন্তু জানেন স্যাঞ্জার, বছর দুয়েকের মধ্যেই একঘেয়েমি লেগে গেল সবকিছুতে।“

“শিকারে একঘেয়েমি!” স্যাঞ্জার অবাক হয়ে বললেন।

“হ্যাঁ, আমার মনের মতো শিকার আমি পাচ্ছিলাম না কিছুতেই। আফ্রিকার ওই বুনো মহিষটার ব্যাপারে তো আপনাকে আগেই বলেছি। সেরে উঠতে পুরো ছ’মাস সময় লেগে ছিল সেবার। সুস্থ হয়ে ওঠার পরই শিকারের টানে গেলাম আমাজনের জঙ্গলে।“

স্যাঞ্জার হাসলেন, “জাগুয়ার?”

জেনারেল সম্মতি জানিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। বেশ কয়েকজন নামজাদা শিকারীর মুখে শুনেছিলাম যে জাগুয়ার শিকার করা নাকি মুখের কথা নয়। অন্যান্য পশুদের তুলনায় অনেক বেশি ধূর্ত হয় ওরা। কিন্তু রণভূমিতে দেখা গেল যে জাগুয়ারও এই অধমের যোগ্য জানোয়ার নয়।“

নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠলেন জেনারেল। তারপর বললেন, “সেদিন রাত্রিবেলায় অসহ্য মাথা ব্যথা নিয়ে জঙ্গলে, আমার তাঁবুর মধ্যে শুয়েছিলাম। হঠাৎ অদ্ভুত একটা চিন্তা এল মাথায়। আমার বেঁচে থাকার রসদ ওই একটাই, শিকার। সেই শিকারে বিরক্তি ধরে গেলে আমি বাঁচবো কী নিয়ে! আমেরিকার বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী বন্ধুবান্ধব ছিল আমার। তাদের মধ্যে অন্তত তিনজনকে দেখেছি জীবন উপভোগ করবে বলে ব্যবসাপত্র গুটিয়ে অবসর নিল। তারপরই হতাশা আর একঘেয়েমির ফাঁদে পড়ে দু’জন আত্মহত্যা করল, আরেক জনের জায়গা হল মেন্টাল হসপিটালে।

স্যাঞ্জার মাথা নাড়িয়ে বললেন, “হ্যাঁ, এমনটা হওয়া কিছু অস্বাভাবিক নয়। এমন ঘটনার কথা আমিও অনেক শুনেছি।“

“তখনই ঠিক করলাম যে নতুন রকমের শিকার আবিষ্কার করতে হবে। কারণ পাগল হওয়া বা আত্মহত্যা করা, দুটোর কোনোটাই আমার জন্য নয়।“

“সে কথা আমিও বিশ্বাস করি জেনারেল। আত্মহত্যা কোনো সমস্যার সমাধান কখনোই হতে পারে না।“

“ঠিক সেই মুহুর্তে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম আমি। তাহলে উপায় কী? জাগুয়ার শিকার করার পর একটা জিনিষ স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলাম যে কোনো পশুই পাশবিকতার উর্ধ্বে নয়। তারা প্রবৃত্তির দাস। প্রকৃতির ওপর নির্ভর করেই তারা বেঁচে থাকে। আহার-নিদ্রা-মৈথুনের বাইরে তারা অন্য কিছু ভাবতে শেখেনি। অথচ শিকার হল অঙ্কের মতো। যুক্তি দিয়ে মাপতে হয় প্রত্যেকটি ধাপ। যুক্তির সামনে প্রবৃত্তি যে হার মানবে এতো জানা কথা। তাহলে উপায় কী?”

স্যাঞ্জার প্রতিধ্বনির মতো বললেন, “উপায় কী?”

জেনারেল খুব সাবধানে, প্রায় ফিসফিসিয়ে বললেন, “দেয়ার ইজ ওনলি ওয়ান সল্যুশন, কান্ট ইউ সী? শিকার হিসেবে এমন একখানা প্রজাতি বেছে নেওয়া যাদের পক্ষে শিকারীর মতো চিন্তাভাবনাও করা সম্ভব।“

স্যাঞ্জার শিউরে উঠলেন, “হোয়্যাট ডু ইউ মীন? ইউ কান্ট মীন দ্যাট!”

জেনারেল হাসি মুখে বললেন, “কেন নয়? মানুষকে আমরা যতই জীবশ্রেষ্ঠ বলি না কেন, আসলে তো আমরা সমাজবদ্ধ পশু মাত্র। তাহলে শিকার হিসেবে মানুষ কেন নয়?”

“কারণ শিকার আর মার্ডার এক জিনিস নয়। আপনি শিক্ষিত, সভ্যমানুষ হয়েও…”

“ওহ্ প্লিজ স্যাঞ্জার! আপনি একটু বেশই বাড়াবাড়ি করছেন। যুদ্ধে যখন আমরা অন্য দেশের মানুষকে বিনা কারণে কচুকাটা করি, তখন কোথায় থাকে আপনাদের এইসব নীতিবাক্য?”

“সেটা যুদ্ধ! দ্যাটস্ ডিফারেন্ট জেনারেল!”

জেনারেল তিন নম্বর সিগারেটটা জ্বালিয়ে, খুব শান্ত স্বরে বললেন, “আই বেগ টু ডিফার। ইনফ্যাক্ট আমি আপনাকে চ্যালেঞ্জ করছি। শুধু আজকের একটা রাত আমার সঙ্গে শিকারে বেরোন, তাহলেই বুঝবেন অ্যাডভেঞ্চার কাকে বলে!“

“ধন্যবাদ! আমি শিকারী, হত্যাকারী নই।“

“হত্যা, মার্ডার, এমন শব্দগুলো বারবার কেন ব্যবহার করছেন স্যাঞ্জার? ইটস্ আ স্পোর্ট! শিকার ও শিকারীর মধ্যে বুদ্ধির খেলা। সমাজের বকলমে সভ্য পৃথিবীতে এই খেলাটাই তো খেলছি আমরা সবসময়। দেখুন, পৃথিবীতে শুধু দুই প্রজাতির জীব থাকে। শিকার এবং শিকারী। সমাজ মানুষের হোক বা পশুর, শিকারটাই সেখানে নিয়ম; আর সেই নিয়মের উর্ধ্বে আমরা কেউই নই।“

সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছিল স্যাঞ্জারের। তিনি এখনো আশা করছিলেন যে, যে কোনো মুহুর্তে জেনারেল অট্টহাস্য হেসে বলবেন, আপনাকে বোকা বানানো এত সোজা তা আমি ভাবতেও পারিনি। অথচ বাস্তবে তেমন কিছুই ঘটলো না। মরীয়া হয়ে স্যাঞ্জার বললেন, “শিকারের জন্য আপনি মানুষ পান কী করে?”

প্রশ্নটা শুনে জেনারেল ভারী সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “আপনি বুদ্ধিমান, তার ওপরে অভিজ্ঞ শিকারী। জানতাম আপনি ঠিক এই প্রশ্নটাই করবেন। নিশ্চয় ভেবেছেন যে একটা মিথ্যে চমক তৈরী করার জন্য আমি পুরো ব্যাপারটাই বানিয়ে বলেছি, তাই তো!”

স্যাঞ্জার কোনো উত্তর দিলেন না। তিনি স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন জেনারেলের দিকে। জেনারেল জারোভ মুচকি হাসলেন। তারপর ডাইনিং হলের দক্ষিণ দিকের জানালাটি খুলে বললেন, “এই দ্বীপটার নাম আপনি নিশ্চয় শুনেছেন স্যাঞ্জার। ফাঁদজাহাজী দ্বীপ। বেশির ভাগ অশিক্ষিত নাবিকদের ধারণা যে সমুদ্র নিজেই রাক্ষসের মতো এখানে জাহাজ ধরে গিলে খায়। কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজ নয়। আসলে পুরোটাই বিজ্ঞান। ওদিকে দেখুন। জাহাজ ধরার ফাঁদ দেখতে পাচ্ছেন?”

জেনারেল যেদিকে দেখাচ্ছিলেন সেদিকে তাকিয়ে দেখলেন স্যাঞ্জার। কিন্তু আলকাতরার মতো ঘন অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়লো না তার। জেনারেল এবার জানালার নীচে একটি বোতাম টিপে বললেন, “এবার দেখুন, স্পষ্ট বুঝতে পারবেন।“

স্যাঞ্জার দেখলেন সমুদ্রের ওই অংশে একসারি আলো বার দুয়েক জ্বলে আবার নিভে গেল। জেনারেল বাচ্চা ছেলের মতো খিলখিলিয়ে হাসছিলেন।

“অভিজ্ঞ নাবিকদের কাছে ওই দু’সারি আলোর অর্থ হল এই অংশ থেকে বেরিয়ে মূল সমুদ্রে ফেরার চ্যানেল। অথচ ওই জায়গায় লুকিয়ে আছে বেশ কয়েকখানা ডুবো পাহাড়। জাহাজ ওখানে যাওয়া মাত্র বুঝতেই পারছেন। ডুবো পাহাড়গুলো প্রকৃতির দেওয়া উপহার, তবে আলোর ব্যবস্থাটা আমিই করেছি। ওহ্ ইলেকট্রিসিটি না থাকলে যে কী হত!”

“আপনার লজ্জা করে না জেনারেল? দিনের পর দিন জল্লাদের মতো একের পর এক জাহাজগুলোকে ধ্বংস করে যাচ্ছেন। বিবেকে বাঁধে না আপনার?”

জেনারেলের চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠল এবার। কিন্তু পর মূহুর্তেই তিনি সামলে নিলেন। নরম সুরে বললেন, “শুধু হাত-পা-মাথা থাকলেই মানুষ হয় না স্যাঞ্জার। আমি যাদের শিকার করি তারা অশিক্ষিত, অসভ্য জাহাজী। নরপশুর সমান। পশুদের মতোই ওরা আহার-নিদ্রা-মৈথুন ছাড়া অন্য কিছু বোঝে না। সুযোগ পেলেই ওরা একে অন্যের গলায় ছুরি বসাতে দ্বিধা বোধ করে না। আমার আপনার বাড়ির পোষা কুকুর বা ঘোড়াগুলোও ওই অসভ্যগুলোর থেকে অনেক বেশী আদবকায়দা জানে।“

জেনারেলের এহেন যুক্তি শুনে স্যাঞ্জার বিরক্ত হয়ে বললেন, “অশিক্ষিত হোক, আদবকায়দা না জানুক। তবুও ওরা মানুষ!”

“এগজ্যাক্টলি স্যাঞ্জার। আর ঠিক সেই কারণেই ওরা আমার জন্য পারফেক্ট শিকার। পশুর মতো অশিক্ষিত, অথচ মানুষের মতো চিন্তাভাবনা করতে সক্ষম। তাছাড়া এমন নয় যে আমি ওদের বেঁধে রেখে কুকুরের মতো গুলি করে মারি। আমি শিক্ষিত,সভ্য মানুষ। অমন নৃশংস কাজ আমি কখনোই করবো না। আমি ওদের জন্য ভালো খাবার, পোশাক পরিচ্ছদ, এমনকি এক্সারসাইজেরও ব্যবস্থা করে রেখেছি। এই বাড়ির বেসমেন্টে ট্রেনিং স্কুল আছে ওদের। বিশ্বাস না হলে কাল সকালে আসুন আমার সঙ্গে। নিজের চোখে দেখে নিন।“

“ট্রেনিং স্কুল! কীসের ট্রেনিং?”

“পারফেক্ট শিকার হওয়ার জন্যও তো ট্রেনিং-এর দরকার মিস্টার রেইনসফোর্ড। ওরা শারীরিক এবং মানসিক ভাবে সুস্থ না হলে চলবে কী করে? তবে এবারে যে আফ্রিকান জাহাজের নাবিকগুলোকে পেয়েছি তাদের থেকে বেশি কিছু আশা করতে পারবো না। ব্যাটাদের চেহারা যেমন গরিলার মতো তেমনি তাদের বুদ্ধির বহর। আপনি আগামীকাল নিজের চোখে এসে দেখুন, তাহলেই বুঝবেন। তাছাড়া আমি কখনো কারোর ওপর জোরজবরদস্তি করি না। আগেই বলেছি যে শিকারটা হল আমার কাছে স্রেফ খেলা। আমি ওদের কে পরিস্কার জানাই যে হয় আমার সঙ্গে এসে শিকার খেলো, আর…”

“নাহলে?”

“নাহলে ইভানের হাতে ওদের ছেড়ে দেওয়া হবে।“ জেনারেল ইভানের দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করলেন। “রাশিয়ার শেষ জারের শাসনকালে ইভান রাজপরিবারের বেতনভুক জল্লাদ হিসেবে কাজ করতো। আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না। ইভানের হাতে একটা ধারালো ছুরি দিয়ে দেখুন। ও মাত্র আধ ঘন্টার মধ্যে একটা জীবন্ত মানুষের শরীরের চামড়া ছাড়িয়ে দিতে পারে। প্রাণে মারবে না অথচ শরীরে একটুকরো চামড়াও লেগে থাকবে না । ইভানের কাজ দেখলে যেন চোখ জুড়িয়ে যায়।“

স্যাঞ্জার চুপ করে বসে রইলেন। জেনারেলের সঙ্গে আলোচনায় যোগ দেওয়ার মতো ইচ্ছে বা রুচি কোনোটাই তার ছিল না। জেনারেল সেদিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি যেমন ভাবছেন তেমন মানুষ আমি নই। আমি যথেষ্ট পরিমাণে খাবার দিই ওদের। বড় ছোরা সঙ্গে দিই আত্মরক্ষার জন্য। এমনকি আমি নিজে শিকার শুরু করার তিন ঘন্টা আগে ওদের জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসি, যাতে পালানোর যথেষ্ট সুযোগ পায় ওরা। আমার কাছে অস্ত্র বলতে থাকে ছোটো ক্যালিবারের শুধু একটা পিস্তল। খেলার নিয়ম সোজা। তিনদিন পর্যন্ত যদি কেউ আমার চোখে ধূলো দিয়ে বেঁচে থাকতে পারে, তাহলে সে জিতবে। আর যদি তাকে আমি ধরে ফেলি তাহলে আমি জিতে গেলাম। বলাইবাহুল্য, ইভানের হাতে পড়ার চেয়ে জঙ্গলের মধ্যে চোর-পুলিশ খেলা অনেক ভালো। অ্যাটলিস্ট আমার সঙ্গে খেলায় ওরা পালিয়ে যাওয়ার সম্পূর্ণ সুযোগ পায়, ইভানের হাতে পড়লে বুঝতেই পারছেন।“

“আর যদি কেউ জিতে যায় তাহলে?”

জেনারেল মুচকি হাসলেন, “জানি সত্যি কথা বললে আপনি ভাববেন আমি বাড়িয়ে বলছি, কিন্তু এখনও পর্যন্ত আমার সঙ্গে এই খেলায় অন্য কেউ জেতেনি। কখনো সখনো বুদ্ধিমান প্রতিপক্ষ পাই ঠিকই, তবে তেমন প্রতিদিন হয় না। শুধুমাত্র একবারই মনে হয়েছিল হেরে যাব। সেবার বাধ্য হয়ে আমার গ্রে-হাউন্ডগুলোর সাহায্য নিয়েছিলাম। ওই তো বাইরে দেখুন না, ওরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাত্রিবেলাটা ওরা ছাড়াই থাকে। মানুষকে বিশ্বাস নেই, কে যে কোথা থেকে পালানোর চেষ্টা করবে, তা তো জানি না, তাই আগে থেকে সাবধান হয়ে থাকা, এই আর কী!“

জানালার বাইরে অন্ধকারে, প্রাসাদের প্রাচীরের চারপাশে দুঃস্বপ্নের মতো কয়েকটা কালো ছায়া ঘুরে বেড়াতে দেখলেন স্যাঞ্জার। হতবাক হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা উন্মাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। জেনারেল তার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললেন, “মাই অ্যাপোলোজিস্ মিস্টার রেইনসফোর্ড। রাত্রি দশটা বেজে গেছে। আপনি ক্লান্ত। নিশ্চয় ঘুম পেয়েছে। আমাকেও শিকারে বেরোতে হবে। তবে যাওয়ার আগে আপনাকে আমার রিসেন্ট শিকারের মাথাগুলো দেখাতে চাই। আসুন, আমার লাইব্রেরীতে…”

স্যাঞ্জার কোনোক্রমে দাঁত দাঁত চেপে নিজেকে সংযত করে বললেন, “ক্ষমা করবেন জেনারেল। আমি সত্যিই খুব ক্লান্ত। শুভরাত্রি। কাল দেখা হবে।“

সেকথা শুনে জেনারেল খুব আন্তরিক ভাবে বললেন, “নিশ্চয়, নিশ্চয়। আপনাকে এতক্ষণ জাগিয়ে রাখাটা আমারি অন্যায় হয়েছে। সারাদিন এত পরিশ্রম করেছেন, ক্লান্তি আসাটাই তো স্বাভাবিক। আশা করছি আগামী কাল আপনি অনেক সুস্থ বোধ করবেন। কাল আমি আর আপনি একসঙ্গে শিকার করতে বেরোবো, কেমন? শুভরাত্রি।“

স্যাঞ্জার জেনারেলের প্রস্তাবের কোনো উত্তর না দিয়েই তার জন্য বরাদ্দ শোওয়ার ঘরটিতে ফিরে এলেন। বিছানায় পায়ের দিকে সিল্কের স্লীপিং স্যুট সযত্নে সাজিয়ে রাখা আছে। পোশাক পালটে, রাজকীয় সেই বিছানায় বসে রইলেন তিনি। নৈশাহারের আগে যে ঘরখানার আভিজাত্য তাকে এত মুগ্ধ করেছিল, এখন সেই ঘরের ভেতরেই দমবন্ধ হয়ে আসছিল তার। স্যাঞ্জার ভাবলেন, আশ্চর্য! পৃথিবীর সবচাইতে দামী বিছানায়, পালকের মতো নরম রেশমের রাতপোশাক পরে শুয়ে আছেন তিনি; শরীর ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে, অথচ ঘুমের লেশমাত্র নেই তার চোখে। এই উন্মাদের প্রাসাদে শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোনো শুধু আরেক উন্মাদের পক্ষেই সম্ভব।

প্রায় আধঘন্টা পর তার ঘরের বাইরে করিডোরে ভারী বুট পরে হাঁটার শব্দ পেয়ে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন স্যাঞ্জার। দরজাটা খুলে দেখার চেষ্টা করলেন বাইরে কে হাঁটছে? কিন্তু কিছু লাভ হল না। ভারী কাঠের দরজা বাইরে থেকে এঁটে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। শরীরের সবটুকু শক্তি প্রয়োগ করেও দরজার পাল্লাদুটো একচুলও নাড়ানো গেল না। তখন জানালায় গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। প্রাসাদের সবকটি আলো নিভিয়ে রাখা হয়েছে। রাতের আকাশে একফালি চাঁদের মরা আলোতে প্রাসাদের উঠোন এবং প্রাচীরের বাইরে জঙ্গল দুইই ভূতুরে দেখাচ্ছিল। উঠোনের সামনে জেনারেলের পোষা গ্রে-হাউন্ডগুলো হঠাৎ তার উপস্থিতি টের পেয়ে জানালার দিকে মুখ তুলে তাকালো। অন্ধকারে তাদের সবুজ চোখজোড়া ধিকধিকে আগুনের মতো জ্বলতে লাগল। স্যাঞ্জার জানালা থেকে সরে নিজের বিছানায় গিয়ে বসলেন। শেষ রাত্রের দিকে ক্লান্তিতে তার চোখ জুড়ে এসেছিল, হঠাৎ জঙ্গলের দিক থেকে আসা পিস্তলের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল তার।

পরদিন সকালে জেনারেল জারোভ যখন নীচে নামলেন তখন প্রায় বেলা বারোটা বাজে। স্যাঞ্জার দেখলেন জেনারেল বড় ভালো মেজাজে রয়েছেন। পরনে হাল্কা রঙের ট্যুইডের জ্যাকেট ও প্যান্ট। কয়েক মুহুর্তেই পুরুষালি পারফিউমের গন্ধে ডাইনিং হলটি ভরে গেল। নীচে নেমেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “গুড আফটারনুন মিস্টার রেইনসফোর্ড। আশা করি এখন সুস্থবোধ করছেন আপনি। আনফরচুনেটলি আমার রাত্রিটা অত্যন্ত জঘন্য কেটেছে।“

ইভানকে ডেকে ইঙ্গিতে লাঞ্চের অর্ডার করলেন জেনারেল। স্যাঞ্জারের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি খেয়েছেন?”

স্যাঞ্জার সম্মতি জানাতেই তিনি ইভানকে চলে যেতে বললেন। তারপর অত্যন্ত বিরক্তি সহকারে জানালেন, “কাল রাত্রে নিগারটা সোজা রাস্তা ধরে পালিয়েছিল। জাস্ট রিডিকিউলাস! অ্যাবসলিউট ডিজাস্টার! ক্যান ইউ বিলিভ ইট? পুরো তিন ঘন্টা সময় দেওয়ার পরও কেউ কী করে এতটা বোকামো করতে পারে, সেটা কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছে না। আপনার জন্য একগ্লাস শাবলি আনতে বলি?“

“জেনারেল”, স্যাঞ্জার খুব দৃঢ় স্বরে বললেন।

জেনারেল হাসি মুখে বললেন, “বলুন, স্যাঞ্জার।“

“আমি যথেষ্ট সুস্থ বোধ করছি এখন। আপনি একটু সাহায্য করলে আমি আজকেই পার্ডের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যেতে চাই। এখন বেরোলে আগামী কাল নাগাদ পৌছে যাব।“

জেনারেল খুব আশ্চর্য হয়ে বললেন, “সে কী! কাল রাত্রেই তো আপনার সঙ্গে কথা হল যে আমরা একসঙ্গে শিকারে বেরোবো, তাহলে…”

“ক্ষমা করবেন, কিন্তু আজকে না বেরোলেই নয়।“

জেনারেল খুব চিন্তিত মুখে ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন, “তা হয় না। আমি ঠিক করে রেখেছি। আজকে রাতে আমি আর আপনি শিকারে বেরোবো।“

স্যাঞ্জার জেনারেলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “আমি কী করবো তা ঠিক করার দায়িত্ব আমি আপনাকে দিইনি। আপনার সঙ্গে শিকার করারও কোনো ইচ্ছে আমার নেই। তাই আবার বলছি, আমি আজকেই মেইন ল্যান্ডের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যেতে চাই।“

জেনারেল খুব হতাশ হয়ে বললেন, “আপনি যখন শিকারে বেরোবেন না ঠিকই করে নিয়েছেন, তখন আপনাকে ইভানের হাতে তুলে দেওয়া ছাড়া আমি আর কীই বা করতে পারি!”

স্যাঞ্জার রুদ্ধশ্বাসে বললেন, “আপনি… আপনি আমাকে শিকার করতে চান?”

“হ্যাঁ। হোয়াই নট? আপনি কী নিজেকে আমার শিকার হওয়ার যোগ্য বলে মনে করেন না। কাম অন ইয়ং ম্যান! নিজেকে এতটাও আন্ডারএস্টিমেট করবেন না। আমি ফাইনালি আমার যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়েছি। আমাদের তো ব্যাপারটাকে সেলিব্রেট করা উচিত।“

রেইনসফোর্ড বাক্যহারা হয়ে তাকিয়ে ছিলেন জেনারেলের দিকে। পুরো ব্যাপারটাই তার অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছিল। জেনারেল অন্য আরেকখানা গ্লাসে খানিকটা শাবলি ঢেলে তার অতিথির সামনে গ্লাসখানা রেখে বললেন, “আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না মিস্টার রেইনসফোর্ড যে আপনি এত বিরক্ত কেন হচ্ছেন? ব্যাপারটাকে আউটডোর দাবা হিসেবে ভাবুন না। প্রাণের বাজি রেখে খেলার মতো এক্সাইটিং কী অন্য কিছু কখনো হতে পারে? আমার তো অন্তত জানা নেই।“

“আর যদি আমি জিতে যাই?”

জেনারেল হাসলেন।

“আজ থেকে তৃতীয় দিনের রাত্রি বারোটার মধ্যে যদি আমি আপনাকে খুঁজে না পাই তাহলে আমি নিজেই হার স্বীকার করে নেব। সেক্ষেত্রে আমি নিজে আপনাকে পার্ডে সিটিতে ছেড়ে আসবো। তবে হ্যাঁ, আপনাকে একটা কথা দিতে হবে যে এই ফাঁদ-জাহাজী দ্বীপ ভ্রমণের ব্যাপারে আপনি কাউকে কিচ্ছু জানাতে পারবেন না।“

স্যাঞ্জার মৃদু হেসে দু’পাশে মাথা নাড়ালেন। “স্যরি জেনারেল, এমন কোনো কথা আমি আপনাকে দিচ্ছি না।“

“সেক্ষেত্রে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে। আজ থেকে তিনদিন পর একটা শ্যাম্পেন সহযোগে আমরা দুই বন্ধু একসঙ্গে বসে কথা বলে নেব।“

এরপর জেনারেল খুব ব্যস্ত হয়ে বললেন, “ঠিক আছে, তাহলে সেই কথাই থাকলো। ইভানকে অলরেডি জানিয়ে রেখেছি আমি। ও আপনার জন্য একটা ব্যাগে ছোরা, জল, খাবার, জঙ্গলে পরার মতো উপযুক্ত পোশাক আর মোকাসিন জুতো গুছিয়ে রেখেছে। জুতোগুলো অবশ্যই বদলে নেবেন। জঙ্গলে পরার জন্য মোকাসিন আদর্শ। পরেও আরাম আবার জঙ্গলের মাটিতে পায়ের ছাপও সহজে পড়ে না। আর হ্যাঁ, এই দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্বদিকে একটা জলা জায়গা আছে। আর যাই করুন, ভুলেও ওদিকে যাবেন না। জায়গাটা চোরাবালিতে ভরা। একটা গর্দভ একবার ওপথে পালানোর চেষ্টা করেছিল। তাকে ধরতে গিয়ে খামোখা আমার গ্রে-হাউন্ড লাজারাস নিজের প্রাণ খুইয়ে বসলো। বড় ভালোবাসতাম লাজারাসকে। ক’টাদিন যে কী কষ্টে কাটিয়েছিলাম তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়।“ জেনারেল মস্ত বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “যাই হোক, আপনি তৈরী হয়ে নিন। আমার আবার দুপুরে খাওয়ার পর একটু ঘুমোনোর অভ্যাস আছে। ইনফ্যাক্ট আপত্তি না থাকলে আপনি এখনই বেরিয়ে পড়ুন। আমি সূর্যাস্তের পরে বেরোবো। আপনার হাতে প্রায় ঘন্টা চারেক মতো সময় আছে। সাবধানে থাকবেন। আবার দেখা হবে।“

ডাইনিং হলের দরজা দিয়ে জেনারেল বেরিয়ে যেতেই স্যাঞ্জার দেখলেন ইভান অন্য একটা দরজা দিয়ে ডাইনিং টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ালো। ওর হাতে একখানা চামড়ার ব্যাগ। ঠোঁটে মুচকি হাসি।

প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে জঙ্গলের সীমানায় এসে কয়েক মিনিটের জন্য স্থির হয়ে দাঁড়ালেন রেইনসফোর্ড। চোয়াল শক্ত করে চেপে নিজেই নিজেকে বললেন, আর যাই হোক, এই উন্মাদের হাতে আমি প্রাণ হারাবো না। গত পরশু থেকে একের পর এক যেসব ঘটনা ঘটছিল সেটা এতক্ষণ পর্যন্ত একটা দুঃস্বপ্ন বলে মনে হচ্ছিল তার। তবে জারোভের ওই নরককুন্ড থেকে বেরিয়ে, জঙ্গলের বুকে খোলা হাওয়ায় দাঁড়িয়ে অনেকটা সুস্থ বোধ করছিলেন স্যাঞ্জার। এরপর দ্রুত নিজের কর্তব্য ঠিক করে নিলেন। একটা জিনিষ তিনি স্পষ্ট বুঝেছিলেন যে সোজা পথে হেঁটে কোনো লাভ নেই। সোজা রাস্তায় গেলে কিছু দূর পরই সমুদ্র শুরু হবে। সেক্ষেত্রে তার পক্ষে বেশি দূর এগোনো অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। তার চাইতে বরং ভ্রান্ত ট্র্যাক তৈরী করে এগিয়ে যাওয়া ভালো।

স্যাঞ্জার ইচ্ছে করেই দুটো ফলস্ ট্র্যাক তৈরী করলেন। মসের ওপর ইচ্ছে করে জুতোর দাগ ফেললেন। শেয়াল শিকারের সময় শেখা বিদ্যেকে কাজে লাগিয়ে চলার পথের ছোট ঝোপঝাড়ের ডালপাতা ভেঙে যতখানি সম্ভব নিখুঁত দুখানা ট্র্যাক তৈরী করলেন তিনি। সন্ধ্যে নামার সঙ্গে সঙ্গে ক্লান্তিতে প্রায় শরীর ভেঙে পড়ছিল তার। পরপর প্রায় দু’রাত্রি ঘুমোনো সম্ভব হয়নি। খাবার খেয়েছেন নিতান্ত অনিচ্ছায়, শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে। এছাড়া ভয়-বিরক্তি-মানসিক যন্ত্রণা তো ছিলই। এতক্ষণ উত্তেজনার বশে শরীর অনেক কিছু সহ্য করে নিয়েছে। কিন্তু সূর্য্যের আলো নিভে যাওয়া মাত্রই তার শরীর বিদ্রোহ ঘোষণা করল। থামলেন স্যাঞ্জার। শিকারী হিসেবে এর আগেও বহুবার তিনি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন, আর সেই কারণেই খুব ভালো করে জানতেন যে জেনারেল নয়, বরং এইমুহুর্তে তার সবচাইতে বড় শত্রুর নাম ক্লান্তি। জঙ্গলের প্রায় মাঝামাঝি একটা চওড়া গুঁড়ির বড় কাপক গাছে খুব সাবধানে, কোনো চিহ্ণ না রেখে ধীরে ধীরে চড়ে বসলেন তিনি। আরো খানিকটা ওপরে ওঠার পর একটা বড়, বাঁকানো ডালের ওপর শুয়ে প্রায় ঘন্টাখানেক ঘুমিয়ে নিলেন নির্বিঘ্নে।

ঘুম ভাঙার পর অনেকটা সুস্থবোধ করছিলেন রেইনসফোর্ড। খানিকক্ষণ নিঃশ্বাস বন্ধ করে চুপচাপ কান পেতে আশেপাশের আওয়াজ শুনলেন তিনি। ঘন অন্ধকারের চাদরে ঢেকে রয়েছে সম্পূর্ণ বনভূমি। নিঃসন্দেহে এই অবস্থায় অন্ধকার তার পরম মিত্র। তাছাড়া নিজের ট্র্যাক তৈরীর ক্ষমতার ওপর যথেষ্ট বিশ্বাস ছিল তার। এই অন্ধকারে এমন জটিল ট্র্যাকের রহস্য ভেদ করে তার সন্ধান পাওয়া শয়তানের পক্ষেই সম্ভব। কিন্তু আবার পরক্ষণেই মনে হল যে জেনারেল জারোভ হয়তো সত্যিই সাক্ষাৎ শয়তান। অতএব গাছের ডালে শুয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগলেন স্যাঞ্জার।

সম্পূর্ণ রাত নির্বিঘ্নে কেটে গেল। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলের বুকে জমে থাকা পাতার রাশের ওপর ভারী বুটজুতোর আওয়াজে চমকে উঠলেন স্যাঞ্জার। নীচে ছোট কাঁটা ঝোপের পেছন থেকে যে মানুষটি কাপক গাছের নীচে এসে দাঁড়ালো, সে জেনারেল জারোভ ছাড়া অন্য কেউ নন। গাছের ডালের সঙ্গে নিজেকে প্রায় মিশিয়ে দিয়ে পাতার আড়াল থেকে জেনারেলের গতিবিধি লক্ষ্য করতে শুরু করলেন স্যাঞ্জার।

জেনারেল জারোভ কাপক গাছের চারপাশের মাটি খুব মন দিয়ে পরীক্ষা করে ধীরে ধীরে গাছের গুঁড়ির ওপরে সাবধানে আঙুল বুলিয়ে কিছু একটা দেখে হতাশ হয়ে দু’পাশে মাথা নাড়ালেন। তারপর ধীরেসুস্থে একটা সিগারেট ধরালেন তিনি।

গাছের ওপরে স্যাঞ্জার একবার ভাবলেন যে জেনারেলের অসাবধানতার সুযোগে তাকে আক্রমণ করবেন; কিন্তু পরক্ষণেই জেনারেলের হাতের মুঠোয় রাখা পিস্তলটার ওপর চোখ পড়লো তার। তিনি ঠান্ডা মাথায় হিসেব করে দেখলেন যে কাপক গাছ থেকে অত্যন্ত দ্রুত নামলেও কমপক্ষে দেড় মিনিট সময় লাগবে জেনারেলের কাছে পৌছতে। সেই সময়টুকু যথেষ্ট জেনারেলের জন্য। অতএব চুপচাপ নিস্ক্রিয় হয়ে শুয়ে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। তবে শিকারী হিসেবে জেনারেলের ক্ষমতা অসাধারণ সেকথা তিনি স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। অন্ধকারে ওই ট্রাকের ধাঁধার সমাধান করে কাপক গাছ অবধি পৌছতে যতখানি সময় লাগার কথা, তার চাইতে অনেক কম সময়ে তিনি সেই অসাধ্য সাধন করেছেন।

কয়েক মিনিট পরে জ্বলন্ত সিগারেটখানা নিভিয়ে শিষ দিয়ে একটা চেনা গানের সুর ভাঁজতে ভাঁজতে জঙ্গল থেকে বিদায় নিলেন জেনারেল।

প্রায় আধঘন্টা পর বেড়ালের মতো নরম পায়ে সাবধানে মাটিতে নামলেন স্যাঞ্জার। জেনারেল তাকে খুঁজে পেয়েছিলেন এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত ছিলেন। ওই হতাশ ভঙ্গীতে মাথা নাড়ানোর অর্থ একটাই, জারোভ আশা করেননি যে এত সহজে তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে তিনি ধরে ফেলবেন। কিন্তু তাহলে নিজের শিকার শেষ না করেই কেন ফিরে গেলেন জেনারেল? কিছুক্ষণ ভাবার পর স্যাঞ্জার বুঝলেন যে জেনারেল ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতো তাকে মারতে চান। একবারে নয়, ধীরে ধীরে, একটু একটু করে। এই মুহুর্তে নিজেকে শিকারের পশু বলেই মনে হচ্ছিল তার। এতদিন পর্যন্ত শুধু শিকারী হিসেবে শিকারে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি। এবার ভূমিকা বদলে যাওয়ায় দু’চোখে অন্ধকার দেখছেন। বোটে থাকাকালীন হুইটনির সঙ্গে যে কথপোকথন হয়েছিল, তা এই মুহুর্তে হঠাৎ মনে পড়লো তার। শিকার শুধু শিকারীর জন্যই খেলা, কিন্তু শিকার হিসেবে যে হতভাগ্য পশুটির নির্বাচন হয়, তার কাছে শিকারের অর্থ কী!

স্যাঞ্জার আবার হাঁটতে শুরু করলেন। শুধু ট্র্যাক তৈরী করে লাভ নেই, সেটা তিনি এতক্ষণে বেশ ভালোভাবে বুঝে গিয়েছিলেন। বরং ফাঁদ তৈরী করলে হয়তো এ যাত্রা রক্ষা পাবেন তিনি। প্রায় তিনশ ফুট দূরে একটা মরা গাছের গুঁড়ির ওপর চোখ পড়ল তার। একদম পারফেক্ট। বড়সড় মৃতপ্রায় গাছখানা পাশের একটা ছোট গাছের ওপর ভর দিয়ে কোনোক্রমে দাঁড়িয়ে আছে।

স্যাঞ্জার চটপট নিজের ব্যাগ থেকে ছোরাখানা বের করে ফাঁদ তৈরীর কাজে লেগে পড়লেন। ঠিক আধ ঘন্টা পর তার কাজ শেষ হল, এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় একশো হাত দূরে একখানা উঁচু মাটির ঢিপির পেছনে গা-ঢাকা দিলেন তিনি।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। কুড়ি মিনিটের মধ্যেই শিকারী কুকুরের মতো দক্ষতায় পথ চিনে হাজির হলেন জেনারেল। স্যাঞ্জার যা ভেবেছিলেন ঠিক তেমনই হল। তার ট্র্যাক খুঁজে বের করার চেষ্টায় প্রায় অন্ধের মতো ফাঁদে পা দিলেন জেনারেল। শুকনো একটা লতা দিয়ে ছোট গাছের গুঁড়ির কাটা অংশটা বেঁধে রাখা ছিল। জেনারেলের পায়ের চাপে লতাটা ছিঁড়ে যেতেই ছোট গাছের কাটা গুঁড়িখানা গড়িয়ে পড়লো একপাশে, আর মরা গাছের বড় গুঁড়িটা ভারসাম্য হারিয়ে এসে পড়লো জেনারেলের ওপর।

তবুও শেষ মুহুর্তে অসামান্য ক্ষিপ্র গতিতে লাফিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচালেন জেনারেল। মাথার পরিবর্তে মরা গুঁড়িখানা পড়লো তার ঘাড়ে। স্যাঞ্জার অবাক হয়ে দেখলেন যে অতবড় আঘাত পাওয়ার পরও জেনারেল দিব্যি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। একহাতে রিভলভারটা তাক করে রেখে, অন্য হাতখানা নিজের ঘাড়ে বোলাতে বোলাতে তিনি বেশ খুশি হয়ে বললেন, “ওয়েল ডান রেইনফোর্ড! তোমাকে অভিনন্দন জানাই। আমি জানি তুমি কাছাকাছিই কোথাও লুকিয়ে আছো। এত পটু হাতে মালেয়শিয়ার মানুষ-ধরা ফাঁদ যে কেউ তৈরী করতে পারে না। সৌভাগ্যক্রমে ওই দেশটির জঙ্গলে বেশ কয়েকবার শিকার করেছি আমি। তাই শেষ মুহুর্তে হলেও নিজেকে বাঁচাতে পেরেছি। কিন্তু তাতে তোমার কৃতিত্ব খাটো হয়ে যায় না। ওয়েল ডান ইনডীড। আমি এখন ফিরে যাচ্ছি। কাঁধে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো।“

জেনারেল ফিরে যাওয়ার পর স্যাঞ্জার আবার দৌড়তে শুরু করলেন। প্রায় মাইল দুয়েক দৌড়োনোর পর সন্ধ্যা নাগাদ তিনি জঙ্গলের যে অংশে এসে পৌছোলেন সেখানে জঙ্গল আরো অনেক বেশি ঘন এবং মাটি বেশ নরম ও ভেজা। আরো কুড়ি মিনিট হাঁটার পর হঠাৎ তার পা নরম কিছুর ভেতরে অনেকখানি ঢুকে গেল। তিনি বহু কষ্টে পা বের করার চেষ্টা করতেই পাকের মতো নরম মাটির বুকে গলা অবধি ডুবে গেলেন তিনি। এই তবে জঙ্গলের ভেতরের চোরাবালি। মাথা ঠান্ডা রেখে মস্ত বড় একটা শ্বাস নিলেন স্যাঞ্জার। তারপর নিজের শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে সাবধানে চোরাবালির অংশটি থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। চোরাবালির অংশে বিপদ লুকিয়ে ছিল ঠিকই কিন্তু রেইনসফোর্ড ঠিক করলেন যে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলবেন তিনি। এক বিপদের মোকাবেলা করতে অন্য বিপদ ব্যবহার করবেন। সেই মতো চটপট খুব দ্রুত হাতে আগাছা আর গাছের লতাপাতা একসঙ্গে বুনে একখানা ঘন কার্পেট তৈরী করলেন তিনি। তারপর চোরাবালির শুরুর হওয়ার একটু আগে থেকে চোরাবালির ও পাকের মাঝামাঝি পর্যন্ত কার্পেটটিকে বিছিয়ে রেখে একটু দূরে অন্য একটা ঝোপের আড়ালে তিনি লুকিয়ে রইলেন ।

সন্ধ্যে নামার একটু পরেই জেনারেলের সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ পেলেন স্যাঞ্জার। কয়েক মিনিট অপেক্ষা করার পরই ভারী কিছু পাঁকে পরার আওয়াজ এবং একই সঙ্গে কুকুরের ও মানুষের গলার আর্তনাদ শুনে স্যাঞ্জারের ইচ্ছে করলো আনন্দে নাচতে। কিন্তু বহু কষ্টে নিজেকে সংবরণ করলেন তিনি। কয়েক মিনিট পরেই জেনারেলের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল, “বার্মিজ বাঘ ধরার ফাঁদ! আপনার মতো প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়ে সত্যিই আমি গর্ব বোধ করছি মিস্টার রেইনসফোর্ড। আপনি অত্যন্ত সফল ভাবে আমার সবচাইতে হিংস্র হাউন্ডটাকে শিকার করেছেন। আশা করছি আমার অন্যান্য হাউন্ডগুলোর সঙ্গে মোকাবেলাও আপনি ঠিক একই ভাবে করবেন। অভিনন্দন প্রিয় শিকারী। আমি এখন ফিরছি। খুব তাড়াতাড়ি আবার দেখা হবে।“

তৃতীয় দিন দুপুরে স্যাঞ্জার বুঝলেন যে তার শরীর ক্লান্তির শেষ সীমানায় এসে দাঁড়িয়েছে। উঠে দৌড়ে পালানোর ক্ষমতাটুকুও আর তার শরীরে ছিল না। বিকেলের একটু আগে পরিচিত ভারী পায়ের বুটজুতোর আওয়াজের সঙ্গে আরো কিছু অপরিচিত আওয়াজ পেলেন তিনি। ব্যাপারটা কী দেখার জন্য নিজের শরীরের সবটুকু শক্তি ব্যয় করে কাছাকাছি একটা গাছের ডালে চড়ে বসলেন তিনি।

প্রায় এক কিলোমিটার দূরে জেনারেল জারোভ এবং তিনজোড়া কুকুরসহ ইভানকে এগিয়ে আসতে দেখে তার মনে পড়ল তৃতীয় দিনের সন্ধ্যে নামতে আর বেশি দেরী নেই। জেনারেল এবার আর বৃথা সময় নষ্ট করতে রাজি নন। তাই নিজের সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে দ্বিধাবোধ করবেন না তিনি। কোমর থেকে ছোরাটা খুলে নিলেন তিনি। খুব বেশিক্ষণ দৌড়োনোর মতো ক্ষমতা নেই তার শরীরে। তাছাড়া জেনারেল এবং তার চতুরঙ্গ বাহিনীর সামনে পড়লে ওই ছোরাটা তার হাতে থাকা বা না থাকা দুটোই সমান। কাজেই শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে কোনোরকমে মাটিতে এসে নামলেন স্যাঞ্জার।

জঙ্গলের এই অংশ থেকে সমুদ্র খুব কাছে। তবে সৈকতের বিলাসিতা তার কপালে জুটবে বলে মনে হল না। জঙ্গল শেষ হয়েছে একটা খাদের মুখে। সেখান থেকে সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়ার ফলে মৃত্যু হওয়াটাও কিছু অসম্ভব নয়। তবে কয়েকশো মিটার দূর থেকে ভেসে আসা ক্ষুধার্ত কুকুরগুলির ডাক শুনে রেইনসফোর্ডের মনে হল যে কুকুরের খাদ্য হওয়ার চাইতে সমুদ্রে ডুবে মরা অনেক ভালো, অনেক বেশি সম্মানের। অতএব শেষ কামড় দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন তিনি।

উগান্ডার এক স্থানীয় শিকারী শিখিয়েছিলেন তাকে নিজের ক্ষতি না করে অনেক বেশি শক্তিশালী শত্রুকে ঘায়েল করার এই উপায়। একখানা অল্পবয়সী, নরম কান্ডের গাছ বেছে নিলেন তিনি। তারপর তার ডাল ও পাতা ছেঁটে ফেলে, নিজের ছোরাটাকে গাছের মাথায় নব্বই ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে শক্ত করে বাঁধলেন। এরপর গাছটাকে নুইয়ে একটুকরো লতা দিয়ে বেঁধে দিলেন পাশের ঝোপের সঙ্গে। তারপর অন্ধের মতো সামনের দিকে দৌড়তে শুরু করলেন রেইনসফোর্ড।

কিছুক্ষণ পর স্যাঞ্জার দম নেওয়ার জন্য থামতে বাধ্য হলেন । সেই অবস্থাতেই পেছনে ঘুরে দেখলেন যে ছোরার আঘাত ভুল মানুষের শরীরে লাগলেও বৃথা যায়নি। জেনারেল তার হাউন্ডদের সঙ্গে তার দিকে ছুটে এলেও তাদের দলে ইভানের দৈত্যাকার শরীরটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। দৌড়তে দৌড়তে প্রায় খাদের কিনারায় এসে পৌছলেন রেইনসফোর্ড। প্রায় একমাইল দূরে, উত্তরদিকে জেনারেলের প্রাসাদের ধূসর দেওয়ালগুলি দেখে আতঙ্কে শিউরে উঠলেন তিনি। কুড়ি ফিট নীচে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে দাঁড়ালেন স্যাঞ্জার। কিন্তু পরমুহুর্তেই তিন জোড়া ক্ষুধার্ত কুকুরের ডাকে তার ঘোর কাটলো। একশো মিটার দূরে ছুটতে থাকা হাউন্ডগুলোর ধারালো দাঁতের সারির দিকে চোখ পড়তেই তিনি চোখ বন্ধ করে খাদের ওপর থেকে সমুদ্রে ঝাপিয়ে পড়লেন।

সে রাত্রে ডিনার টেবিলে বসে জেনারেল জারোভ ভাবছিলেন যে আমেরিকান ভদ্রলোকটি একজন উন্নত শ্রেণীর শিকার এবং শিকীরী ছিলেন এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, তবে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারলেন না এই যা। কী আর করা যাবে? উৎকৃষ্ট শ্যাম্পেন এবং অর্ধেক বোতল শ্যাম্বারটিন দিয়ে খুব পরিপাটি করে ডিনার শেষ করলেন তিনি। ইভানের অনুপস্থিতি যেমন বোধ করছিলেন তিনি তেমনি এটাও ভাবলেন যে শিকারটা এত তাড়াতাড়ি শেষ না করলেই বোধহয় ভালো হত। এর আগে তার হাত ফস্কে কোনো শিকার কখনো পালাতে পারেনি। জেনারেল হতাশ হয়ে স্বগোতোক্তি করলেন, পালিয়ে গেলে হে তুমি রেইনসফোর্ড। নইলে দেখতে শিকার কাকে বলে…”

রাত্রিবেলা নিজের শোওয়ার ঘরের জানালা দিয়ে পোষা হাউন্ডগুলোর দিকে তাকিয়ে জেনারেল বললেন, “কথা দিয়েছিলাম আজকে তোদের পেট ভরে খাওয়াবো। কিন্তু কথা রাখতে পারলাম না। এখন কাল অবধি অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।“

হঠাৎ পাশ থেকে পুরুষালি গলার আওয়াজ এল, “তার বোধহয় প্রয়োজন পড়বে না জেনারেল জারোভ। আমাদের শিকার এখনো শেষ হয়নি।“

“রেইনফোর্ড আপনি! এখানে, এই ঘরে এসে পৌছলেন কী করে?” জেনারেল চমকে উঠলেন।

“সাঁতরে। গতবারের মতো পায়ে হেঁটে আসার ভুল এবার আমি করিনি। আপনি বোধহয় ভেবেছিলেন যে সমুদ্র শুধু আপনার শিকারেরই যোগান দেয়, তাই ওপথে শিকারীর আপ্যায়নের ব্যবস্থা আপনি রাখেননি জেনারেল। মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছেন।“

জেনারেল জারোভ বাক্যহারা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বেশ নাটকীয় কায়দায় অভিবাদন জানিয়ে বললেন, “আমি এককথার মানুষ স্যাঞ্জার। আপনাকে অভিনন্দন জানাই। এই খেলায় আপনি সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতায় জিতেছেন।“

স্যাঞ্জার হাসলেন না। তিনি খুব লঘু স্বরে বললেন, “তা কী করে হয় জেনারেল! গতকালও আমি ছিলাম আপনার শিকারের পশু। এত তাড়াতাড়ি সেই পশুত্ব আমার অস্তিত্ব থেকে বিদায় নেবে তা আপনি ভাবলেন কী করে? তাছাড়া আপনি ভুলে যাচ্ছেন যে, আপনার পোষা গ্রে-হাউন্ড গুলো গত তিনদিন ধরে কিচ্ছু খায়নি। আপনার চোখে আমিও পশু, ওরাও পশু। তাই ওদের খিদের কথা আপনি ভুলে গেলেও আমি ভুলতে পারিনি।“

জেনারেলের গলা কেঁপে উঠল, “নিশ্চয়, নিশ্চয়। সে তো বটেই। সে তো বটেই…”

স্যাঞ্জার মৃদু স্বরে বললেন, “গুডবাই জেনারেল।“

হাউন্ডদের খাইয়ে রেইনসফোর্ড সে রাত্রে বড় নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিলেন…

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *