onubad-pretini

প্রেতিনী
গী দ্য মঁপাসা
অনুবাদ – অনুষ্টুপ শেঠ


>রু দ্য গ্রেনেলের একটা বেজায় পুরোনো, প্রাসাদের মতো বড়ো বাড়িতে বসে ছিলাম আমরা। সন্ধ্যা অতিক্রান্ত। সদ্য ঘটা একটা মামলা বেশ সাড়া ফেলেছে, সেটার প্রসঙ্গেই অদ্ভুত অলৌকিক সব ঘটনা নিয়ে আড্ডা জমে উঠেছিল। অনেকেরই কিছু না কিছু গল্প মনে পড়ছিল, আর প্রত্যেকেই জোর গলায় বলছিল সে সবই নাকি আসলে সত্যি ঘটনা।
এমন সময়ে বিরাশি বছরের মার্কুইস দে লা টুর-সামুয়েল ধীরে ধীরে উঠে এসে ফায়ারপ্লেসের উপরের তাকটায় ভর দিয়ে দাঁড়ালেন। বৃদ্ধ এ বাবদ কিছু বলতে চান বুঝে সকলে উৎসুক হল, তিনি মৃদু কাঁপা গলায় এই গল্পটি শুরু করলেন।

“আমিও একটা অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী, জানেন! আমার জীবনে সে এক ভয়াল দুঃস্বপ্ন! ঘটনাটা ঘটেছিল ছাপ্পান্ন বছর আগে, কিন্তু আজও এমন একটা মাস যায় না যাতে আমার স্বপ্নে সে ব্যাপার ভেসে না আসে! সেই দিনটি থেকে আমার মনের মধ্যে একটা আতঙ্ক সব সময়ে জেগে আছে – বুঝলেন?

মাত্র মিনিট দশেকের জন্য সেই মারাত্মক অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার, অথচ সেটা এমনই সাংঘাতিক যে আজও আমার ভয় যায়নি! আচমকা কোনো আওয়াজ শুনলেই বুক ধড়াস করে ওঠে; কম আলোয় এমন কিছু যদি দেখি যা চোখে স্পষ্ট ধরা দিচ্ছে না – ছুটে পালাতে মন চায়! রাত ঘনালেই আমার ভয় করে। অন্ধকারকে ভয় করে।

এর আগে কখনো এ কথা কারো সামনে বলিনি। কিন্তু এই বয়সে এসে আর এই ভয় নিয়ে কথা বলতে দ্বিধা নেই। তবে হ্যাঁ, জানাশোনা সত্যিকারের বিপজ্জনক কোনো কিছুর সামনে আমি কোনোদিনই ভয় পাইনি, মনে রাখবেন।

আসলে, ব্যাপারটা আমায় এতটাই নাড়িয়ে দিয়েছিল যে সেটা ইচ্ছে করেই ভুলে থেকেছি মনে হয়। জীবনের সব দুঃখ, কষ্ট, লজ্জা যেভাবে আমরা নিজেদের মধ্যে লুকিয়ে রাখি।

যাকগে, আসল কথা বলি। যেভাবে ঘটেছিল তাই বলছি। ব্যাখ্যা-ট্যাখ্যা দিতে পারব না। ব্যাখ্যা হয় কিনা জানিও না, এক যদি না ওই এক ঘন্টা আমি পাগল-টাগল হয়ে গিয়ে থাকি। সেটা যাইনি, আমি জানি অবশ্য। যাই হোক, কার্যকারণ নিজেরা ভেবে নেবেন যা পারেন। আমি শুধু ঘটনাটা বলি।

১৮২৭ সালের জুলাই মাস। আমি তখন আমার সৈন্যদল নিয়ে ফ্রান্সের রুয়ান শহরে। একদিন জলের ধারে জেটিতে পায়চারি করছি, একটা লোককে দেখে চেনা চেনা লাগল। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না তাকে কোথায় দেখেছি। হাঁটার গতি কমিয়ে তাকে চেয়ে চেয়ে দেখছি, সেও আমার দিকে ফিরে চাইল।

“দেখামাত্র সে লাফিয়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরল। আমারও মনে পড়ে গেল কম বয়সে সে আমার খুব প্রিয় এক বন্ধু ছিল। কিন্তু এ কী দশা তার! মাত্র পাঁচ বছরের অদর্শনের মধ্যেই সে যেন পঞ্চাশ বছর বুড়িয়ে গেছে! চুল সব পেকে গেছে; হাঁটছে সামনে ঝুঁকে, বিধ্বস্ত ভঙ্গিতে। আমায় অবাক হতে দেখে সে সব কথা খুলে বলল।

তার জীবনে চরম দুর্ভাগ্য এসেছিল। এক অল্পবয়সী সুন্দরীর প্রেমে পড়েছিল সে, বিয়েও করেছিল। সুখের সাগরে ভেলা ভাসিয়েছিল দুজনে মিলে। এক বছর অতি সুখে, যৌবনের আনন্দে ডুবে থেকে কাটানোর পর মেয়েটি আচমকা হার্টের গোলযোগে মারা যায়। অত উত্তেজনা তার দুর্বল হৃদয় নিতে পারেনি হয়তো।

স্ত্রীর সৎকারের দিনই আমার বন্ধু তার ভিটে ছেড়ে এই শহরের একটা হোটেলে চলে আসে, আর সেই থেকে এখানেই রয়েছে। শোকে, দুঃখে কাতর দিনগুলো তার এতই একলা, এতই হতাশায় কাটছে যে সে আজকাল মাঝে মাঝেই আত্মহত্যার কথা ভাবে।

‘তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে খুব ভালো হল।’ সে বলল, ‘একটা উপকার করতে হবে বন্ধু! আমার গ্রামের বাড়ি থেকে কিছু কাগজপত্র আনা বড্ড দরকার। আমার – আমাদের ঘরের লেখার টেবিলের ড্রয়ারেই আছে সেগুলো। চাকরবাকর বা উকিল কাউকে পাঠাতে চাই না। কারণ কাগজগুলো বড্ড গোপনীয়। তাই খুবই বিশ্বস্ত কাউকে খুঁজছিলাম।

তোমাকে আমি ঘরের আর ওই টেবিলের ড্রয়ারের চাবি দিয়ে দেব। ওসব আমি চলে আসার আগে নিজের হাতে বন্ধ করে এসেছিলাম। মালিকে একটা চিঠিও লিখে দেব যাতে তোমায় সে বাড়িতে ঢুকতে দেয়। কাল সকালে আমার সঙ্গে জলখাবার খেতে এসো, তখন সব বুঝিয়ে দেব।‘

বলা বাহুল্য, আমি কাজটা করে দেব বলেছিলাম। আমার জন্য ব্যাপারটা গ্রামের দিকে খোলামেলায় খানিক বেরিয়ে আসা বই তো নয়! ওর গ্রামটা রুয়ান থেকে মেরেকেটে ৫ মাইল হবে, ঘোড়ার পিঠে আরামসে এক ঘন্টায় পৌঁছে যাব।

পরদিন দশটা নাগাদ গেলাম বন্ধুর ওখানে। দু’জনে মিলে প্রাতরাশ সারলাম। কিন্তু সে একেবারে মিইয়ে ছিল, কথাবার্তা বলছিলই না। খোঁচাতে বলল, আমি ওদের সেই ঘরে যাব আজ, ভেবেই সে অস্থির হয়ে যাচ্ছে স্মৃতির জ্বালায়। সত্যি বলতে কি ওকে দেখে আমারও মনে হচ্ছিল বেচারার মনের মধ্যে যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে, এত অশান্ত, এত চিন্তিত দেখাচ্ছিল।

যাই হোক, শেষ অবধি সে ঠিকঠাকই বুঝিয়ে দিল আমায় কী কী করতে হবে। খুবই সহজ কাজ, দুটো বাক্স আর কিছু কাগজের একটা প্যাকেট নিয়ে আসতে হবে। টেবিলের ডানদিকের প্রথম ড্রয়ারের চাবিও দিয়ে দিল আমায়। দিয়ে বলল, ‘জিনিসগুলো খুলে না দেখার কথা তো আর তোমায় আলাদা করে বলতে হবে না…’ এ কথাটায় আমার মনে খুবই আঘাত লাগল। বললামও সেটা, বেশ কড়াভাবেই। তাতে সে ভারি লজ্জা পেয়ে বলল, ‘কিছু মনে কোরো না ভাই, শোকে দুঃখে মাথার ঠিক নেই আর আমার!’

বেচারার চোখে জল এসে গেছে দেখে আর কথা বাড়ালাম না। দুপুর একটা নাগাদ আমি সেখান থেকে রওনা দিলাম। ঝকঝকে দিন, সবুজ ঘাসজমির মধ্যে দিয়ে ঘোড়া ছোটাতে ছোটাতে শুনছিলাম পাখিরা গাইছে, আর আমার কোমরের তরোয়ালের বুটজুতোয় ঠোকার আওয়াজ তার সঙ্গে তাল দিচ্ছে।

জঙ্গলে ঢুকে পড়ার পর অবশ্য আর ঘোড়া ছোটানো যাচ্ছিল না। দুলকিচালে ঘোড়া চালিয়ে চলার ফাঁকে ফাঁকে গাছের ডাল মুখে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। এক আধবার পাতা ছিঁড়ে নিয়ে দাঁতে কেটে ফেলে দিচ্ছিলাম – এমনিই, মনে ফুর্তি থাকলে লোকে যেমন অকারণে আনন্দ করে।

বাড়িটার কাছাকাছি এসে মালির জন্য চিঠিটা বার করলাম। তখন চোখে পড়ল, আর দেখে থ হয়ে গেলাম যে সে চিঠিটাও আঠা দিয়ে মুখ আটকানো। এইসা বিরক্ত লাগল যে একবার ভেবেছিলাম ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে ফিরে যাই! এ কেমন অপমান! তারপর মনে হল সেটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। বন্ধু বেচারা অতটা ভেঙে পড়েছিল, হয়তো কিছু না ভেবেই অভ্যাসবশে চিঠিটা আটকে ফেলেছে।

বিশাল বাড়ি। মনে হচ্ছিল কম করে কুড়ি বছর ধরে সেটা ব্যবহার না হয়ে পড়ে আছে। গেট হাঁ করে খোলা, মরচে যা ধরেছে তাতে ভেঙে পড়ে যায়নি এই আশ্চর্য! পথ জুড়ে ঘাস গজিয়েছে, বাগানে কোথায় ফুলগাছ আর কোথায় লন বোঝা যায় না এত আগাছা! আমার গেটে লাথি মারার শব্দে ধারের একটা দরজা খুলে এক বুড়ো বেরিয়ে এল। এসে সে ব্যাটা হাঁ করে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখে নিজেই নেমে পড়লাম ঘোড়া থেকে, চিঠিটা এগিয়ে ধরলাম। সেটা দুবার উলটেপালটে পড়ে, সন্দেহের চোখে আমার দিকে চেয়ে সে বলল, ‘তো, আপনি কী চাইছেন?’

আমি বিরক্তভাবে বললাম, ‘পড়লে তো চিঠিতে। তোমার মনিব যা বলেছেন, আমি বাড়িতে ঢুকতে চাই।‘

লোকটা কেমন হতবুদ্ধি হয়ে চেয়ে বলল, ‘মানে— বলছেন, যে আপনি, মনিবের ঘরে যাবেন?’ আমার মাথা গরম হচ্ছিল, ‘আচ্ছা জ্বালা তো! তোমার কি আমাকে বিশ্বাস হচ্ছে না নাকি?’
সে তোতলাতে লেগে গেল, ‘না বাবু। তা না। আসলে, ঘরটা তো সেই থেকে খোলাই হয়নি— সেই মৃত্যুর দিন থেকে! আপনি পাঁচ মিনিট দাঁড়াবেন? আমি গিয়ে দেখে আসি কী অবস্থা—’ বাজে বকা আর পোষাচ্ছিল না, কথার মধ্যেই ধমকে উঠলাম, ‘ইয়ার্কি হচ্ছে? ঘরের চাবি আমার কাছে, তুমি গিয়ে কী ঘন্টা দেখবে হে!”

লোকটা তখন ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, আমি আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি।’

’কিস্যু করতে হবে না। সিঁড়িটা কোনদিকে বলে দাও, ব্যস। আমি বাকি দেখে নিচ্ছি।’

’কিন্তু বাবু—’

এবার আমি না চেঁচিয়ে পারলাম না, ‘বাজে বকা থামাও তো! নইলে খুব খারাপ হবে!’ বলে, এক ধাক্কায় লোকটাকে ঠেলে সামনে থেকে সরিয়ে গটগট করে ওই দরজা দিয়ে ঢুকে গেলাম। প্রথমে রান্নাঘর, সেটা পেরিয়ে দুটো ঘর যাতে এ লোকটা আর তার বৌ থাকে, তারপর একটা বড়ো হলঘর। সিঁড়িটা সামনেই, উঠে গিয়ে ঘরের দরজাটাও চিনতে পারলাম কারণ বন্ধু বেশ বিশদে বুঝিয়ে বলেছিল। চাবি দিয়ে খুলতেও কোনো অসুবিধা হল না, ঢুকে পড়লাম। এতই অন্ধকার, ঢুকে প্রথমে কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। বন্ধ ফেলে রাখা সব ঘরের মতো এখানেও ভ্যাপসা ছাতাপড়া গন্ধ ভাসছিল। আস্তে আস্তে চোখ সয়ে এল, তখন দেখলাম বড়ো ঘরটা একদা সুন্দর সাজানো ছিল বটে। এখন সব কেমন ওলটপালট দশা। বিছানায় চাদর পাতা নেই, কিন্তু গদি আর বালিশ আছে। একটা বালিশ এমন দেবে আছে যেন কেউ তাতে একটু আগেও শুয়েছিল। চেয়ারগুলো এলোমেলো, একটা দরজা — মনে হয় আলমারির, ফাঁক হয়ে আছে।

জানলা খোলার অনেক চেষ্টা করলাম, কিন্তু জোড়গুলো সব মর্চে-টর্চে ধরে এমন এঁটে গেছিল যে খুলল না। এমনকী তরোয়াল দিয়ে খোঁচাখুঁচি করেও কিছু লাভ হল না। ততক্ষণে কম আলোতে মোটামুটি পরিষ্কারই দেখতে পাচ্ছি। কাজেই হাল ছেড়ে দিয়ে জানলার বদলে লেখার টেবিলেই মনোনিবেশ করলাম। চেয়ার ছিল একটা সামনে, বসে টেবিলের ঢাকা তুলে ড্রয়ারটা খুললাম। কানায় কানায় ঠেসে ভর্তি জিনিসে। তিনটে প্যাকেট বার করতে হবে, সেগুলো কেমন দেখতে সেটাও বন্ধু বলে দিয়েছিল, কাজেই এক এক করে জিনিস সরিয়ে সে তিনটেকে খুঁজতে লেগে গেলাম। চোখ পাকিয়ে হাতের প্যাকেটের গায়ের লেখা পড়ছি, মনে হল পিছনে খসখস করে কাপড়ের আওয়াজ পেলাম যেন। হাওয়ায় কোনো পর্দা নড়া খেয়েছে নিশ্চয় — ভেবে আর মাথা ঘামাইনি তখন। কিন্তু আবার মিনিটখানেক পরে শুনি কীসের যেন নড়াচড়ার আওয়াজ। এইটে আমার একদমই ভালো লাগল না, কেমন একটা অস্বস্তিতে গা শিউরে উঠল। তারপর এত অল্পে ঘাবড়াচ্ছি ভেবে নিজেরই লজ্জা লাগল, তাই ঘুরে আর তাকাইনি। ততক্ষণে দুটো প্যাকেট নেওয়া হয়ে গেছে, তিন নম্বরটাও সবে নিতে যাচ্ছি… এমন সময়ে আমার কাঁধের ঠিক পিছনেই কে যেন সশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

আমি তো একলাফে দুই পা পিছিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছি অমনি! হাত চলে গেছে কোমরে থাকা তরোয়ালের বাঁটে। সত্যি বলছি, সেদিন তরোয়ালটা না থাকলে আমি ততক্ষণে ভীতুর মতো ভাগলবা হয়ে যেতাম।

দেখি, এক সাদা পোশাক পরা লম্বা মহিলা চেয়ারটার ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে।

আমার সারা গায়ে এমন কাঁপুনি দিচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল পড়েই যাব। জানি শুনতে অবাস্তব লাগছে, কিন্তু ওইরকম ভয় যে নিজে একবারও পেয়েছে, সেই একমাত্র বুঝবে কেমন লাগে! মনে হয় হার্ট থেমেই গেছে বুঝি, আত্মারাম খাঁচাছাড়া হতে চলেছে এবার; সারা শরীরে যেন আর একটুও বল নেই, ভিতর থেকে সব ধ্বসে গেছে। আমার ভূতপ্রেতে বিশ্বাস নেই; তাও ওই ঘরে, ওই কয়েক মিনিট ধরে যে চরম আতঙ্কে কাঠ হয়ে গেছিলাম, তেমন ভয় আমার বাকি সারা জীবনে আর কখনো পাইনি! মহিলা যদি তখন কথা বলে না উঠত, আমি হয়তো মরেই যেতাম ভয়ের চোটে। কিন্তু সে কথা বলে উঠল; নরম আর দুঃখী গলায় ভেসে আসা কথাগুলো আমার স্নায়ুকে কিছুটা যেন চাগিয়ে তুলল। ভয় কেটে গেছিল বললে মিথ্যা বলা হবে, কিন্তু আমার পৌরুষের অহংকার আর মিলিটারি ট্রেনিং মিলিয়ে কিছুটা অন্তত ধাতে ফিরতে পেরেছিলাম বলা যায়। যদিও এসব কিছুই আমি তখন ভাবার অবস্থায় ছিলাম না, কী যে করছি সেটাই ভাবার অবস্থা ছিল না – পরে বুঝেছিলাম ওই… ওই… জানি না কী বলব, মহিলা বা প্রেতিনী যাই হোক – তার জন্য নিজেকে কিছুটা সামলে নিতে পেরেছিলাম। তবে তখন আমি স্রেফ ভয়ে কাঁটা হয়ে ছিলাম। সে বলল, ‘আমার একটা কাজ করে দেবেন? খুব উপকার হয়…’

উত্তর দেবার হাল আমার ছিল না। গলা দিয়ে একটা অর্থহীন শব্দ বেরোল খালি। সে আবার বলল, ‘দেবেন? বেঁচে যাই তবে। সেরে উঠি। নইলে আমার এত কষ্ট হয়! সবসময়ে কষ্ট হয় জানেন! উঃ, সে কী কষ্ট!’ বলতে বলতে চেয়ারটায় বসে পড়ে মুখ তুলে চাইল সে আমার দিকে, ‘করবেন?’ মুখ দিয়ে তখনো কথা বেরোচ্ছিল না, ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম।

সে আমায় একটা বাহারি মেয়েদের চিরুণি দিয়ে বলল, ‘আমার চুলটা আঁচড়ে দিন না! তাহলে আমি সেরে যাই! দেখুন— আমার মাথাটা দেখলেই বুঝবেন! আর আমার চুল – কী ব্যথাই না করে!’ তার খোলা লম্বা চুল চেয়ারের পিঠের উপর দিয়ে মাটি ছুঁয়ে ফেলেছিল। কালো কুচকুচে একঢাল চুল।

কেন করলাম? কেন কাঁপা হাতে সেই চিরুণিটা নিলাম, কেন সেই লম্বা চুলের গোছা অন্যহাতে ধরলাম? হিমেল পিচ্ছিল সে চুল… যেন সাপের গায়ে হাত দিয়ে ফেলেছি! কেন? জানি না। জানি না।

“মাঝে মাঝে মনে হয় ওই ভয়ানক ছোঁয়া এখনো আমার আঙুলে জড়িয়ে আছে। মনে পড়লেই শরীর কাঁপে।

ওই জিনিস কীভাবে যেন আঁচড়ে, ভাগ ভাগ করে ঘোড়ার কেশরের মতো করে বিনুনি করে দিলাম। সে ঘাড় কাত করে এমন একটা নিঃশ্বাস ফেলল, মনে হল খুশি হয়েছে। তারপর আচমকাই আমায় ধন্যবাদ দিয়ে, আমার হাত থেকে চিরুণিটা ছোঁ মেরে নিয়ে সেই আধখোলা দরজাটা দিয়ে দৌড়ে চলে গেল।

কিছুক্ষণ নির্বোধের মতো একা দাঁড়িয়ে ছিলাম। তারপর যেন হুঁশ ফিরল। ঝাঁপিয়ে পড়ে ঝাঁকুনি আর ধাক্কা মেরে জানলার একটা খড়খড়ি ভেঙেই দিলাম। ঘরে এক ঝলক আলো এসে পড়ল। ছুটে গিয়ে দেখলাম, যে দরজা দিয়ে সে চলে গেল, সেটা এদিক থেকে তালাবন্ধ, হাজার টানাটানিতেও খোলে না।

তারপর আর দাঁড়ানো অসম্ভব ছিল। সে যে কী আতঙ্ক… সেই অনুভূতি… যখন সৈন্যেরা বোঝে এবার যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালাতেই হবে। কোনোরকমে বেছে রাখা প্যাকেট তিনটে তুলে নিয়েই দৌড়ে বেরিয়ে এলাম সে ঘর থেকে। সিঁড়ি দিয়ে নামলাম তো না, চার চার ধাপ লাফিয়ে পেরোলাম। কীভাবে যে বাইরে এলাম আমিও জানি না, এসেই দেখি আমার ঘোড়াটা সামনে! এক লাফে তার পিঠে উঠে পড়ে দুদ্দাড় করে তাকে ছোটালাম ফেরার পথে।

রুয়ানে নিজের বাড়ির সামনে না পৌঁছনো অবধি একবারও থামিনি। আর্দালি এসে দাঁড়িয়েছিল, তার হাতে লাগাম ধরিয়ে দিয়ে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম।

পাক্কা এক ঘন্টা বসে বসে ভাবলাম, এমন হ্যালুসিনেশন ঘটার কারণ কী! নিশ্চয় আমার কিছু একটা নার্ভের অসুখ হয়েছে, নয়তো ব্রেনে কিছু গণ্ডগোল হয়েছে যার জন্য এইরকম সব ব্যাপার ঘটেছে মনে করেছি! না, বাস্তবে এটা ঘটে থাকতে পারে না, আমারই কিছু সমস্যা হয়েছে! কিছু একটা শক, মানসিক, নির্ঘাৎ…

মোটামুটি যখন নিশ্চিত হয়ে গেছি যে পুরোটাই আমার মনের উর্বর কল্পনা মাত্র,ঠিক তখনই পায়চারি করতে করতে জানলার সামনে এসে পৌঁছলাম আর আচমকাই নিজের জামার দিকে নজর গেল।

কী বলব? আমার জামায় চুল লেগে ছিল। জামার বোতামে জড়িয়ে যাওয়া… লম্বা লম্বা… মেয়েদের চুল! সেসব একটি একটি করে ছাড়িয়ে জানলা দিয়ে ফেলে দিলাম। হাত থরথর করে কাঁপছিল। আর্দালিকে ডেকে প্যাকেটগুলো তার হাত দিয়ে বন্ধুকে পাঠিয়ে দিলাম। নিজের তখন বাড়ির বাইরে এক পা যাওয়ারও অবস্থা ছিল না। আর, গিয়ে তাকে বলতামটাই বা কী?!

জিনিসগুলো ঠিকঠাক পেয়েছে বলে সে একটা রসিদ লিখে দিয়েছিল আর্দালিকে। আমার কথা জিজ্ঞাসা করেছিল, লোকটা বুদ্ধি করে বলেছিল আমার সানস্ট্রোক গোছের কিছু হয়েছে, তাই নিজে আসতে পারেনি। তার কথামতো, এটা শুনে বন্ধু খুব উদ্বিগ্ন হয়েছিল। পরদিন আমি নিজেই তাই গেলাম বন্ধুর কাছে। সকাল সকালই গেছিলাম, ইচ্ছে ছিল সব খুলে বলে দেখব সে কী বলে। কিন্তু গিয়ে শুনলাম সে আগের সন্ধ্যাতেই চলে গেছে, আর আসেনি। বেলায় আবার গেলাম খুঁজতে। না, তখনো ফেরেনি। এক সপ্তাহ ধরে রোজ খোঁজ করলাম, কিন্তু বন্ধু আর ফিরে এল না। অগত্যা পুলিশে জানালাম, তারা সর্বত্র খুঁজল, কিন্তু আমার বন্ধুর কোনো খোঁজ কোথাও পাওয়া গেল না।

সেই গ্রামের বাড়িটাতেও আগাপাশতলা খানাতল্লাসি করা হয়েছিল। কিছুই বলার মতো পাওয়া যায়নি।

বিশেষ করে, কোনো মহিলার সেখানে লুকিয়ে থাকার কোনও চিহ্নই ছিল না।

কিছুই পাওয়া না যাওয়ায় খোঁজাখুঁজি একসময়ে বন্ধ হয়ে গেল।

তারপর ছাপ্পান্ন বছর কেটে গেছে, কিছুই আর খবর পাওয়া যায়নি। আমি আজও জানি না, ব্যাপারটা কী ছিল আসলে!”

(গী দ্য মঁপাসা (১৮৫০-১৮৯৩) – ছোটোগল্পের জগতে ফরাসী লেখক গী দ্য মঁপাসা এক বহুখ্যাত নাম। চেখভের সঙ্গে মঁপাসাকেও আধুনিক ছোটোগল্পের জনক হিসাবে ভাবা হয়। তিনি প্রায় ৩০০ ছোটো গল্প, ছটি উপন্যাস এবং একটি কবিতার বই লিখেছেন। এই অনুবাদটি তাঁর ‘The Ghost’ গল্পের, মূল গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৮৩ সালে।)

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *