onubad-sahajjer-haat

সাহায্যের হাত

আর্নল্ড মারমর

ভাষান্তরঃ ঝুমকি বসু

রিসিভারটা যথাস্থানে নামিয়ে রেখে দ্রুত হাতে ওয়ার্ডরোব খুলে ওভারকোটটা টেনে নিলাম। নীচে হলঘরের রেকর্ডপ্লেয়ারে তখন সবেমাত্র নাচের বাজনা শুরু হয়েছে।
সিঁড়ির নীচেই স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমার জন্যেই অপেক্ষা করছিল ও। আমাকে ধরাচূড়া-পরা দেখে ভ্রূ কোঁচকাল।
—তুমি নিশ্চয় এখন বাইরে বেরুবে না?
—আমি নিরুপায়। ওর গালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে হতাশ গলায় বললাম, ফিরতে কত দেরি হবে বলতে পারি না।
—গোমেজ?
—ওই শয়তানটা ছাড়া আর জ্বালাবার কে আছে?
—ওহ…জিম, আজ রাতেও তুমি বাইরে যাবে? তোমার কি না গেলেই নয়?
—তুমি জানো, যেতে আমি মোটেই চাই না। আজকের এই পার্টিটা আমরা দু’জনে একসঙ্গে জমিয়ে উপভোগ করব বলে ভেবেছিলাম। কিন্তু ভাগ্যে লেখা না থাকলে আর কী হবে! এখন তুমি একা গিয়ে ওদের সঙ্গে যোগ দাও ওর গালে আর একটা চুমো এঁকে দিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম।
সিটি-হল পুলিশে-পুলিশে ছয়লাপ। আমাকে সসম্ভ্রমে ভেতরে যাবার পথ করে দেওয়া হল। লিফটে সোজা পাঁচতলায় উঠে এলাম। ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির অফিস-ঘরের বাইরে একজন পাহারাদার মোতায়েন ছিল। আমাকে দেখে সেলাম করে ভেজানো দরজাটা খুলে ধরল সে। অফিস-ঘরের পেছনে মাইলস লার্সনের খাস কামরায় গিয়ে হাজির হলাম আমি।
লার্সন তখন ফোনে কার সঙ্গে কথা বলছিলেন। ইঙ্গিতে একটা খালি চেয়ার দেখিয়ে দিলেন আমাকে।
কথাবার্তা শেষ হবার পর রিসিভার নামিয়ে রেখে আমাকে একটা সিগারেট অফার করলেন।
—না, ধন্যবাদ। আমি মাথা নাড়লাম। কিন্তু ব্যাপ্লারটা কি?
—বিল ও’হারা। আবার বেঁকে বসেছে ও। লাইটার বের করে সিগারেট ধরালেন লার্সন। ভদ্রলোকের বয়স এখন সাতচল্লিশ। মাথার চুলের রং মরিচ-গুঁড়োর মতো। মুখের চামড়া বেশ টানটান। খাঁটি লোক হিসেবে বেশ একটা নাম-ডাক আছে তাঁর। —আমি ওকে শক্ত প্যাচে জড়িয়ে ফেলতে চাই। লার্সন বললেন। এই ব্যাপারটা যেন আমার কাছে অনেক দিনের দূষিত ক্ষতের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভেবেছিলাম ইলেকট্রিক চেয়ারের ভয়ে ও মুখ খুলতে রাজি হবে। কিন্তু এখন দেখছি গোমেজের ভয় তার চেয়ে অনেক বেশি।
বললাম, আমি শুনেছিলাম ও’হারা কথা বলতে রাজি হয়েছে।
—প্রথমে আমারও তাই মনে হয়েছিল। কিন্তু ঘণ্টাখানেক আগে ও জানিয়ে দিয়েছে কিছুতেই সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়াবে না।
—ওর সাহায্য ছাড়া কি আমরা গোমেজের নাগাল পেতে পারি না?
—তা যে পারি না, সেটা আপনি ভালোই জানেন। ও’হারা-ই এখন আমাদের প্রধান আশাভরসা। একমাত্র ওর সাহায্যেই আমাদের পক্ষে গোমেজের নাগাল পাওয়া সম্ভব। একা একটা লোক সারা শহর জুড়ে
শয়তানির কারখানা খুলে বসেছে। গোটা শহরটাকে কলুষিত করে তুলছে। এই গোমেজ লোকটা কে? তাকে দেখতেই বা কেমন?
—আপনার বিশ্বাস ও’হারা তা জানে?
—সে-বিষয়ে আমারও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। গোমেজের মতো গভীর জলের মাছেরা কখনও ও’হারার মতো চুনোপুঁটিদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখে না। তবে এই খুদে শয়তানটা গোমেজের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনতে পারে। আর একবার তার নাগাল পেলে আইনও আমাদের পক্ষে এসে দাঁড়াবে। ও যদি গোমেজের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করে তবে সেই তথ্যের ভিত্তিতে আমরা এই মহারথীর পুরোনো রেকর্ডগুলো ঘেঁটে দেখতে পারি। এবং তারফলে এই শহরটাকেও শয়তানের কবল থেকে মুক্ত করা যাবে।
ভেজানো দরজা ঠেলে একজন ডিটেকটিভ অফিসার ভেতরে ঢুকলেন। মুখ তুলে অফিসারের দিকে ফিরে তাকালেন লার্সন।—ও’হারাকে এখানে নিয়ে আসুন।
—আনছি, স্যার। মাথা নেড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন অফিসার। আমি বললাম, কিন্তু ওর পেট থেকে কি কথা বের করা সম্ভব হবে?
লার্সন বিব্রত ভঙ্গিতে মাথার চুলে আঙুল চালালেন।—তা হলে আমরা এখন কি করব? হাত গুটিয়ে বসে থাকব? গোমেজের হাতে শহরটাকে তুলে দেব? আপনি কি তাই চান?
—আমার চেয়ে আপনিই ভালো জানেন। আমরা শুধু নিরেট পাথরের দেওয়ালে কিল মেরে হাত ব্যথা করছি। অসম্ভব পুরু এই দেওয়াল। এ ক্ষেত্রে ও’হারাই এখন আমাদের একমাত্র আশাভরসা।
দরজা ঠেলে দু’জন ডিটেকটিভ ও’হারাকে সঙ্গে করে ভেতরে এলেন। ও’হারার বয়স বেশি নয়, পঁচিশ-ছাব্বিশর মধ্যেই হবে। দু’গালে এক হপ্তার দাড়ি জমেছে ঘন হয়ে।
—আপনার ততক্ষণ বাইরে ঘরে অপেক্ষা করুন।—ডিটেকটিভ দু’জনকে উদ্দেশ্য করে লার্সন বললেন।
অফিস-ঘরের মধ্যে দিয়ে দু’জনে বাইরে বেরিয়ে যাবার পর লার্সন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে লম্বা টেবিল ঘুরে ও’হারার মুখোমুখি দাঁড়ালেন।—তুমি তো আগে কথা বলতে রাজি হয়েছিলে। এখন আবার মত পালটালে কেন?
—গোমেজের ভয়ে। ছোট্ট করে জবাব দিলো ও’হারা।
—গোমেজ তোমার নাগাল পাবে না। ভরসা দেবার ভঙ্গিতে মৃদু হাসলেন লার্সন।—কিছুতেই পাবে না।
—সেদিকটাও আমি ভেবে দেখেছি। ও’হারা আগের মতোই অবিচল।
—ওর তো ফাঁসি হবে। একজন মৃত-ব্যক্তি নিশ্চয় তোমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।
—মরার আগেই ও আমার ওপর প্রতিশোধ নিয়ে যাবে। ওর হাত অনেক বেশি লম্বা। আমার হাড়-পাঁজরা সব টুকরো-টুকরো করে ছাড়বে।
—আমরা তোমাকে নিরাপদে রাখব। তোমার নিরাপত্তার যাবতীয় দায়-দায়িত্ব সব আমাদের।
—গোমেজকে আপনি চেনেন না বলেই এ-কথা বলতে পারলেন।
—শোনো…ও’হারা, তোমাকে তা হলে সরল সত্য কথাটা জানিয়ে দিই। লার্সন জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ও’হারার চোখে চোখ রাখলেন—তুমি যদি গোমেজের ব্যাপারে আমাদের সাহায্য না করো, তবে তোমার জন্যে ইলেকট্রিক চেয়ারের ব্যবস্থা করব। মনে রেখো, আমার কথার কোনও নড়চড় হয় না।
—গোমেজের থাবার আঘাতে ছিঁড়েখুঁড়ে টুকরো-টুকরো হওয়ার চেয়ে ইলেকট্রিক চেয়ারে বসে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া অনেক বেশি স্বস্তিদায়ক।
সজোরে ও’হারার গালে এক চড় কষালেন লার্সন।—সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তোমাকে সবকিছু খুলে বলতে হবে! যা জানো, সব। লার্সন আবার চড় মারলেন ওর গালে।
—তার আগে আমায় বরং আপনি মেরে ফেলুন। ও’হারার কণ্ঠস্বর শান্ত, সংযত।
এবারে লার্সন বলিষ্ঠ হাতে প্রচণ্ড একটা ঘুষি ছুঁড়লেন ও’হারার তলপেট লক্ষ করে। যন্ত্রণায় কুঁজো হয়ে গেল বেচারি। দু’হাত দিয়ে খামচে ধরল আহত জায়গাটা। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আবার ঘুষি চলালেন লার্সন।
লার্সনের হাবভাবে বুঝতে পারছি আজ তাঁর মাথায় রক্ত চড়ে গেছে। দু’চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরোচ্ছে। সারা মুখে বন্য হিংস্রতার ছাপ।
—ও’হারা? ধীরেসুস্থে আমি এবার পরিস্থিতির হাল ধরার চেষ্টা করলাম। ও আমার মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাল।
—কি চাও তুমি? জানতে চাইলাম আমি। কি হলে তুমি মুখ খুলবে?
—কিছুই আমি চাই না। মুখও আমি খুলৰ না।
—তোমাকে যদি অ্যারিজোনা বা মেকসিকোর বিমানের টিকিট কেটে দেওয়া হয়?
—না, ওসব কিছুর দরকার নেই আমার।
—ওর সঙ্গে দর কষাকষি করে কোনও লাভ হবে না। ব্যাজার মুখে লার্সন মন্তব্য করলেন।
—তা জানি। আমি মাথা ঝাঁকালাম। তবু একবার চেষ্টা করে দেখেছিলাম।
—এ-রোগের দাওয়াই আমার জানা আছে। পুনরায় প্রস্তুত হয়ে এগিয়ে এলেন লার্সন।—মুখ না-খোলা পর্যন্ত এ-দাওয়াই আমি চালিয়ে যাব। ওর দেহের একটা হাড়ও আর আস্ত রাখব না।
লার্সন বেছে-বেছে ওর শরীরের বিশেষ বিশেষ জায়গায় আঘাত হানতে শুরু করলেন। এ-সমস্তই সুচিন্তিত পুলিশি-পদ্ধতি। তিনি জানেন কোথায় কতখানি আঘাত করলে শরীরের মধ্যে তার কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়। কোনও মানুষ যে এই দৈহিক নিপীড়ন বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারে না, তাও আমি জানতাম।
মার খেতে-খেতে আচমকাই রুখে দাঁড়াল ও’হারা। মরিয়া হয়ে ও এবার ভীষণ জোরে একটা আঘাত হানল লার্সনের মুখের ওপর। আঘাতটা সোজাসুজি লার্সনের চোয়ালে গিয়ে পড়ল। বাণবিদ্ধ হরিণের মতোই মুখ থুবড়ে উলটে পড়লেন তিনি।
ও’হারা বিস্ফারিত দৃষ্টিতে আধ মিনিট আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপরই বিদ্যুৎবেগে পেছন দিকে গরাদ-হীন কাচের জানলাটার দিকে ছুটে গেল। এক ঝটকায় খুলে ফেলল শার্সির পাল্লা। এবং পলক ফেলতে-না-ফেলতে জানলা টপকে বাইরের সরু কার্নিশের ওপর লাফিয়ে পড়ল।
সমস্তই লক্ষ করছিলাম আমি। তাড়া-খাওয়া আহত জন্তুর মতোই এখন ওর অবস্থা। প্রচণ্ড ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ধীর পায়ের জানলার দিকে এগিয়ে গেলাম। পাঁচতলার কার্নিশে দাঁড়িয়ে ও তখন থরথর করে কাঁপছে। ওর পিঠ দেওয়ালের দিকে ফেরানো।
খোলা জানলা দিয়ে মুখ বের করে ওর দিকে তাকালাম।—এভাবে তুমি পালাতে পারবে না। ফিরে এসো।
ও আমার মুখের দিকে তাকাল। ওর চোখে-মুখে আতঙ্কের পাণ্ডুর ছায়া।
—লার্সন এখন তোমায় কিছু বলবেন না। কথা দিচ্ছি, সে-ব্যাপারটা আমি দেখব। আর একটু ঝুঁকে ওর দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিলাম।—হাতটা শক্ত করে চেপে ধরো। দেখো, সাবধান! বেশি একটা তাড়াহুড়ো করতে যেও না।
ও হাত বাড়াতেই আমি ওর হাতের পাঞ্জাটা দৃঢ় মুষ্টিতে চেপে ধরলাম।—খুব আস্তে-আস্তে এগিয়ে এসো। সতর্ক করলাম ওকে।
ওর পা কিন্তু হড়কে গেল, সেইসঙ্গে একটা আর্ত চিৎকার উঠে এল ওর গলা চিরে। ও এখন অসহায়ভাবে দেওয়ালের গায়ে ঝুলে আছে। হঠাৎ এই ঝাঁকানিতে আমার প্রায় উলটে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে নীচের দিকে তাকালাম। আমি শুধু ওর একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরে আছি। তা ছাড়া আর কোনও অবলম্বন নেই ওর।
লার্সনের কথাটাও আমার তখন মনে পড়ে গেল। এই খুদে শয়তানটা গোমেজকে অভিযুক্ত করতে পারে। আর একবার গোমেজকে নাগালে পেলে তার সাঙ্গোপাঙ্গদের কবজায় আনতে বিশেষ অসুবিধা হবে না। এবং ভেতর-ভেতর ক্রমশই ও যে দুর্বল হয়ে পড়ছিল, তাও আমি বুঝতে পেরেছিলাম। ও যদি আচমকা লার্সনের ওপর ঝাঁপিয়ে না পড়ত তা হলে লার্সন ওর পেট থেকে কথা বের না-করে ছাড়তেন না।
আবার আমি ঝুঁকে পড়ে ওর দিকে তাকালাম। ধীরে ধীরে আমার ঠোঁটের ফাঁকে একটা ক্রূর হাসি ছড়িয়ে পড়ল। আমি-ই যে স্বয়ং গোমেজ ও’হারা তা জানে।
একটু একটু করে হাতের মুঠো আলগা করলাম আমি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *