স্বাধীনতা
থেইন পে মিন্ট
(প্রথম প্রকাশ ১৯৪৮। ‘ডাগন’ পত্রিকা)
ভাষান্তর- দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
১
‘কিয়াও মিয়া’ আর ‘আই নিউন’-এর বাগদানের আজ দু’বছর পেরোলো। তারা প্রতিজ্ঞা করেছিল, বর্মা স্বাধীন হবার আগে সংসারধর্ম করবে না। দেশ স্বাধীন হলে তারপর নাহয় বিয়েশাদি করে সুখে থাকা যাবে। অতএব বিয়ের বদলে বাগদান!
ব্যাপারটার একটা ইতিহাস আছে। দু’বছর আগে, শোয়েডাগন প্যাগোডার অগ্নিকোণ-এর চাতালে তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান হবার কথা ছিল। আর ওই দিনই, অনুষ্ঠানের ঠিক আগে ফ্যাসিবিরোধী জনমুক্তি মোর্চা AFPFL-এর কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হচ্ছিল প্যাগোডার মাঝখানের উঠোনে।
বিয়ে করতে এসে অনুষ্ঠানের চাতালের দিকে এগোতে এগোতেই প্যাগোডার মাঝের উঠোন থেকে বক্তৃতার রক্তে দোলা লাগানো কথাগুলো তাদের কানে আসছিল। বক্তা বলছিলেন, বার্মার মানুষের অশেষ দারিদ্র্যের জন্য দায়ী হল রক্তচোষা ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোর অনিঃশেষ শোষণ।
এই কথাগুলো কিয়াও মিয়া নিজেও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত। বম্বে-বার্মা ফ্যাক্টরির নেহাতই এক কনিষ্ঠ মেকানিক সে। অতএব, বক্তা যখন জিগির তুললেন, “এই ব্রিটিশ কোম্পানিদের মালিকানা আমরা শ্রমিকরা দখল করবই…” তখন সে সোৎসাহে হাততালি দিয়ে উঠেছিল। যেন সেই শুভদিনটা কেমন হবে তা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে সে।
কনফারেন্স নিয়ে চারপাশে মানুষজনের উৎসাহের আবহ আই নিউন-কেও ছুঁয়েছিল বইকি। দূর থেকে মঞ্চে অধিষ্ঠিত মোর্চার নেতাদের দেখে তাঁদের প্রতি বেশ একটা ভক্তিভাব জাগছিল তার মনে। স্বাধীনতা সংগ্রাম-এর তহবিলে যথাসাধ্য দান করবার জন্য মানুষের হুড়োহুড়ি দেখে তার বুকে হাতুড়ির ঘা পড়ছিল যেন। অবাধ্য চোখের জল নেমে আসছিল গাল বেয়ে। মাইকে তখন হেঁকে বলছিল, মেয়েরা নাকি দলে দলে তাদের গলার হার খুলে খুলে জেনারেল আং সান-এর হাতে তুলে দিচ্ছে স্বাধীনতার যুদ্ধের জন্য। শুনে আই নিউন-এরও ভারী ইচ্ছে হচ্ছিল, গলা থেকে হার খুলে এনে অমনভাবে তুলে দিয়ে আসে দেশের কাজে! কিন্তু দেবে কেমন করে? গলার হার তার জুটল কবে আর? গরিবের খাদ্য ‘লেট থক সোন’-এর চাঙারি মাথায় পথে পথে ফিরি করে দিনান্তে দুমুঠো ভাত জোটে কোনোমতে। গলার হার কেনবার কড়ি সে পাবে কোথা? হার দূরস্থান একসঙ্গে পাঁচটা কিয়াট দেবার অবস্থাও তার নেই। কাজেই সে মনে মনে পণ করেছিল, সেদিন থেকে, খেয়ে-না খেয়ে সে দিনে পঁচিশ পায়া জমাবেই। তাহলে দিন বিশেক বাদে পাঁচটা কিয়াট সে স্বাধীনতা-তহবিলে দান করতে পারবে। আর তারপর, মঞ্চ থেকে ভেসে এল লড়াইয়ের ডাক, “স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে নামো…” শুনে আই নিউন ঠিক করল, সে-ও যুদ্ধটায় অংশ নেবে। তাতে প্রাণ যায় যদি, তা-ও সই।
আই নিউন আর কিয়াও মিয়া তখন, সব ভুলে, জনতার সুরে সুর মিলিয়ে স্লোগান তুলেছিল, “স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ…” স্লোগান তুলেছিল “চাই স্বরাজ… এখন, আজ!”
চলতে চলতে, স্লোগান দিতে দিতে গলা ভেঙে গিয়েছিল তাদের। অবশেষে যখন তারা তাদের অনুষ্ঠানের জায়গাটায় গিয়ে পৌঁছোল, ততক্ষণে কনফারেন্স শেষ। স্লোগান-টোগান বন্ধ। লোকজন বাড়ি চলে গেছে। পড়ন্ত সূর্যের আলো এসে শোয়েডাগন প্যাগোডাকে যন গলানো সোনার আস্তরে মুড়ে দিয়েছে। কনফারেন্সের উঠোন তখন খালি।
কিন্তু স্বাধীনতার সেই মন্ত্রোচ্চারণ তখনও তাদের কানে বাজছিল। তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাচ্ছিল তাদের বুকের মধ্যে বেজে চলা ভালোবাসার সুরটা।
কাজেই সেদিন বিয়ে তাদের হল না।
পড়ন্ত বিকেলে উত্তুরে হাওয়া তাদের অবাধ্য চুল নিয়ে খেলছিল। হেমন্তের ঝরাপাতারা সোনালি আলো মেখে লুটোপুটি খাচ্ছিল তাদের ঘিরে। আর তারই মধ্যে হাতে হাত ধরে, মহান শোয়েডাগনকে সাক্ষী রেখে তারা শপথ করেছিল, বিয়ে তারা করবে, তবে আজ নয়, যেদিন বর্মা স্বাধীন হবে, সেইদিন।
এইভাবে নিজেদের বাগদানের পর্ব শেষ করে তারা দুজন আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল সেইখানে। তখন আসন্ন সন্ধ্যার মুখে কোনো অদেখা মন্দির থেকে ভেসে আসছিল একটা একাকী ঘণ্টার বিষণ্ণ সুর।
দু’দুটো বছর কেটে গেছে তারপর। নিজেদের শপথ তারা ভোলেনি। আজও তারা বড়ো ভালোবাসে একে অন্যকে। দুটো বছরের মধ্যে তাদের কথাকাটাকাটি হয়েছে ক্বচিৎ দু একবার। তাতে মন কষাকষি যেটুকু হয়েছে তাও বিশেষ ধর্তব্যের মধ্যে আসে না।
যেমন ধরো, গণ পরিষদের নির্বাচনে কিয়াও মিয়া ভোট দিতে গেল না। দেখে আই নিউন বলে, “ভোট দিলে না যে? স্বাধীনতা আসুক তাতে তোমার সায় নেই বুঝি?” তার গলার সুরে খানিক ঝাঁঝ ছিল। একটু বাঁকা রসিকতাও।
“ও কথা বোলো না আই নিউন। জানো তো ওদিন আমার ছুটি ছিল না। একটা দিন কাজে না যাওয়া মানে একটা দিনের মাইনে কাটা।”
তবে আসল কথাটা হল কিয়াও মিয়া ভোট দেয়নি কারণ সে দ্বিধায় ছিল। কাকে ভোট দেবে সে? এএফপিএফএল-কে, নাকি কমিউনিস্টদের? আই নিউনের অবশ্য সেসব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না। গণপরিষদ নির্বাচনে এএফপিএফএল-এর স্লোগানটা তার মনে ধরেছিল। স্লোগান বলেছে “আমরা জিতলে এক বছরের মধ্যে স্বাধীনতা এনে দেব।” স্বাধীনতা আসা মানে তাদের বিয়েটা হওয়া। কাজেই স্লোগানটা তাকে আশা জুগিয়েছিল। তাছাড়া জেনারেল আং সান-কে সে মনেপ্রাণে বিশ্বাসও করে। কাজেই তাঁর তোলা এহেন স্লোগানে তার ভরসা ছিল আঠারো আনা।
২
এক বছরের মধ্যে স্বাধীনতার দাবীটা শিগগিরই বদলে গেলো আরো একবগ্গা একটা দাবিতে; ডাক উঠল, এক বছর অপেক্ষা নয়, পরের জানুয়ারির মধ্যেই স্বাধীনতা দিতে হবে বার্মাকে। মানুষজনের কানে যেন অমৃত বর্ষণ করল সে ডাক! বিশেষ করে কিয়াও মিয়া আর আই নিউন তো বড়োই খুশি তাতে।
তারপর, একদিন ঘোষণা হল যে জানুয়ারির চার তারিখে ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটবে বর্মায়। খবরটা শুনে আই নিউন আশা করেছিল যে সেদিন কিয়াও মিয়া নিশ্চয় একবার তার বাড়িতে আ। আশায় আশায় সারাটা দিন সে লণ্ঠনগুলোকে সাফসুতরো করল। নিজেহাতে সবকিছু ভেজেভুজে সেই দিয়ে চা-পাতার তরকারি রাঁধল একপাত্র। যে খবরের কাগজে স্বাধীনতার ঘোষণার খবরটা বেরিয়েছিল, তার একটা কপি কিনে এনে, চৌকির পাশে কেরোসিন কাঠের বাক্সটার ওপরে সেটাকে সাজিয়ে রাখল। কিন্তু কিয়াও মিয়া এলো না।
পরদিন বিকেলে আই নিউন একবার কিয়াও মিয়া-র বাসায় গেল। বাসা বলতে বম্বে-বার্মা ফ্যাক্টরির শ্রমিক বস্তির নীচের তলায় একচিলতে ঘর একখানা। কিন্তু সেখানে তাকে পাওয়া গেল না। তার ফাঁকা ঘরের জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি মেরে আই নিউন বারকয়েক হাঁকও দিল, “কো কিয়াও মিয়া… কো কিয়াও মিয়া…” কিন্তু কেউ জবাব দিল না। আই নিউন তখন তার বন্ধ দরজার সামনে দাওয়ার ওপরেই পা ছড়িয়ে বসে অপেক্ষায় রইল।
খানিক বাদে সে শোনে বাসার পেছনদিকে কেউ একজন হাপর টানছে। শব্দটা শুনে আই নিউন ফের ডাকল, “কো কিয়াও মিয়া… কো কিয়াও মিয়া…”
এইবারে হাপরের শব্দ বন্ধ হল। তারপর কিয়াও মিয়া-র মায়ের গলাটা ভেসে এল সেখান থেকে, “কে গা?”
“আমি গো, পিসি!”
“কোন আমি?” বলতে বলতে বৃদ্ধা দাও মো ঘুরে বাসার সামনের দিকে এসে দাঁড়াতে আই নিউন তার দিকে তাকিয়ে হাসল একটুখানি।
“ওহো আই নিউন তুমি? কতক্ষণ হল এসেছ?”
“এই তো খানিক আগে। কিয়াও মিয়া কোথায় গো পিসি?”
“এখুনি ফিরবে। চাল কিনতে গেছে দোকানে।” তার মা জবাব দিল। তারপর এক হাতে দরজার কাঠটা ধরে রেখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল খানিক।
আই নিউন দাওয়ায় বসে থেকেই বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে ফের জিজ্ঞাসা করল, “কিয়াও সেইনকেও দেখছি না যে! সেও কি তার দাদার সঙ্গে গেছে?”
“কিয়াও সেইন এখন একটা কাজকম্মো খুঁজছে হন্যে হয়ে। বেরোয় কাকভোরে, ফিরতে ফিরতে রাত। ফলে সব দায় এসে পড়েছে কিয়াও মিয়ার ঘাড়ে। ফ্যাক্টরি থেকে ঘেমেনেয়ে এলো ছেলেটা! কোথায় দুদণ্ড বসে জিরোবে, তা না, থলে হাতে চাল কিনতে বেরোতে হল ফের।”
“কিয়াও মিয়া-র ফ্যাক্টরিতে কিয়াও সেইনকে কাজে নেবে না পিসি?”
“সে আর নিয়েছে। যা আছে তার থেকেই গাদা গাদা ছাঁটাই করে দেবে বলছে!”
“এ কী সব্বনেশে কথা গো!” বলে মাথা নেড়ে আই নিউন ফের প্রশ্ন করল, “মি তিন-কেও দেখছি না যে পিসি? কোথায় গেল মেয়েটা?”
“ও গেছে বাদাম বিক্কিরি করতে। একা তোমার কিয়াও মিয়ার রোজগারে সংসার কি চলে?”
“হায় কপাল!” আপনমনে জবাব দিল আই নিউন।
খানিক বাদে দাও মো রাস্তার দিকে ইশারা করে বলে, “ঐ যে আসছে।”
শুনে আই নিউন পথের দিকে চোখ ফেলল। সেখানে, চালের থলে কাঁধে বড়ো বড়ো পায়ে কিয়াও মিয়া তাদের দিকে হেঁটে আসছিল।
“কখন এলে?” চালভর্তি থলেটা মায়ের হাতে দিতে দিতে কিয়াও মিয়া আই নিউনকে জিজ্ঞাসা করল।
থলে নিয়ে বৃদ্ধার চলে যাওয়া অবধি অপেক্ষা করল আই নিউন। তারপর বলল, “এই তো খানিক আগে।”
“চালের দাম যা বেড়েছে! হাত ছোঁয়ানো যাচ্ছে না!” বলতে বলতে কিয়াও মিয়া আই নিউনের পাশে বসে পড়ল, “আর, শুধু চাল কেন? সবকিছুর দামই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। পেঁয়াজে হাত দিলে আঙুল পুড়ে যাবার দশা। কী যে হবে এরপর সেই ভেবে…”
দুজনেই চুপচাপ এবারে। কিয়াও মিয়ার দুশ্চিন্তা, তার ফ্যাক্টরির সামান্য মজুরি দিয়ে এই আক্রার বাজারে চলবে কেমন করে? ওদিকে আই নিউন ভাবে, পেঁয়াজের দাম চড়লে তার ‘লেট থক সন’ খাবারটা সে বেচবে কেমন করে? পেঁয়াজ ছাড়া খদ্দের ও জিনিস নেবে না যে!”
“তা হঠাৎ এখানে এলে যে?”
“তোমার সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছে হল। তাই…”
“ইচ্ছে হল? হঠাৎ?”
“না… মানে, গতকাল সন্ধেবেলা তুমি একবার আমার ওখানে আসবে ভেবেছিলাম…”
“তা, শুধুমুদু তোমার ওখানে যেতে যাব কেন? কিছু হয়েছে?” কিয়াও মিয়া এত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কথাগুলো ছুড়ে দিল যে আই নিউন ভারী রেগে উঠল তাতে।
“…হয়েছে! হাঃ!” মুখটা গোমড়া করে কথাটুকু বলেই মুখে কুলুপ আঁটল সে। এবারে কিয়াও মিয়া আন্দাজ করল, কিছু একটা গড়বড় হয়ে গিয়েছে। তবে সেটা যে কী তা সে তখনও ধরতে পারেনি। চালের দামটামের দুশ্চিন্তা তখন তার মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। আই নিউন কেন রেগে উঠল সেটা তার তখন আগে জানা দরকার। কাজেই সে সাবধানে, আদর ঢালা গলায় বলল, “আহা মা নিউন, কী হয়েছে সেটা ভেঙে বলবে তো!”
“খবরের কাগজ দেখোনি কাল তুমি? কী বলেছে সেখানে?”
“কোন খবরটা, বলো? কাগজে তো কত খবরই বেরোয়!”
আই নিউনের শরীরটা রাগে জ্বলছিল। এ লোক ছোটো বাচ্চা হলে এতক্ষণে তার কানদুটো ধরে আচ্ছা করে ঝাঁকিয়ে দিত সে।
“আমি ওসব ‘কতো খবর’-এর কথা বলছি না। আমি একটা খবরের কথাই বলছি। তাতে লিখেছে আমরা স্বাধীনতা পেতে চলেছি।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ। বলেছে তো। গতকাল রাতে আমাদের একটা ওয়ার্কার্স মিটিং-এও সে নিয়ে অনেক আলোচনা হল।”
“কীসের মিটিং?”
“একটা প্রতিবাদ সভা। ফ্যাক্টরি আরো তেইশ জনকে ছাঁটাই করতে চলেছে। আমাকে শুদ্ধু।”
শুনে আই নিউনের সব রাগ গোঁসা উবে গেল। মানুষটার জন্য ভারী সহানুভূতি হচ্ছিল তার এবারে।
“কিন্তু, সে কী করে হবে?”
“এভাবেই তো হয় আই নিউন! স্বাধীনতা দেবে বলল। আর, তার সঙ্গে সঙ্গেই তেইশটা লোককে কাজ থেকে তাড়িয়ে দিল। স্বাধীনতা নিয়ে একটু যে আনন্দ করব তার জো রাখল না।”
“কিন্তু… এবার তুমি কী করবে?”
“আমাদের ইউনিয়ন ঠিক করেছে, ব্যাপারটা নিয়ে লড়াই করবে। আজ ‘এএফপিএফএল’ থেকে শ্রমিক শাখার নেতারাও এসেছিলেন আমাদের সঙ্গে ঐ নিয়ে কথা বলতে।”
“কী বলল? তোমাদের পাশেই আছে তারা, তাইতো?”
“হুঁ, তা আছে। তবে এখুনি লড়াই-ঝগড়াটা শুরু না করবার পরামর্শ দিল ওরা। বলল, প্রথমে সুপারভাইজারের সঙ্গে কথা বলে ব্যাপারটা মেটাবার চেষ্টা করবে। তাতে কাজ না হলে শ্রম মন্ত্রীর দফতরে যাবে। এছাড়া যাদের চাকরি যাবে তাদের জন্য অন্য কাজ খুঁজে দেবার চেষ্টাও করবে ওরা, তবে কাজ যে জুটিয়ে দিতে পারবেই এমন কোনো গ্যারান্টি ওরা দেয়নি। তবে ওরা যা-ই বলুক, আমাদের ছাঁটাই করলে আমরা শ্রমিকরা তা মেনে নেব না। হাতে হাত মিলিয়ে এ লড়াই লড়ব আমরা…”
আই নিউন আশ্চর্য হয়ে শুনছিল। এ যেন এক সম্পূর্ণ আলাদা কিয়াও মিয়া! তার প্রতিটি শব্দে আবেগের ঘন উষ্ণতা। শুনতে শুনতে রোমাঞ্চ হচ্ছিল তার।
“সেক্ষেত্রে কোম্পানি বোধহয় তোমাদের ছাঁটাই করবার সাহস করবে না, তাই না?”
“শুনছি তো কোম্পানি ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত কিছুদিনের জন্য মুলতুবি রাখবার কথা ভাবছে। ইউনিয়নের কড়া স্ট্যান্ড দেখে খানিক ঘাবড়েছে। দেখা যাক। আর তারপর কোম্পানি যদি শ্রমিকদের দখলে নিয়ে আসা যায় তাহলে এইজাতের সমস্যা কতো শান্তিপূর্ণভাবে মেটানো হবে দেখে নিও!”
“শ্রমিকরা কোম্পানির দখল… নিতে পারবে?”
“দেশ স্বাধীন হলে নিতে পারবে বইকি।”
“হবে হয়তো!”
খানিকক্ষণ দুজনেই চুপচাপ সামনের দিকে তাকিয়ে রইল। ফ্যাক্টরিটা অবশ্য তাদের দেশের মালিকানায় নেই। তাছাড়া শ্রমিকরা এখনও তার দখল নিয়ে নেয়নি। ফলে ছাঁটাইয়ের ভয়টাকে চট করে ঝেড়ে ফেলাও তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। সন্ধে নামছিল। ঘরে ঘরে আলোজ্বলে উঠছে একে একে। আই নিউন এবারে পিঠটা সিধে করল। তারপর হাতদুটো উদ্বিগ্নভাবে মোচড়াতে মোচড়াতে প্রশ্ন করল, “তেমন কিছু হলে… আমাদের কী হবে?”
“কী হবে আবার? যেদিন দেশ স্বাধীন হবে সেদিন আমাদের বিয়ে হবে।”
“ব্যস। ওইটুকুই জানবার ছিল আমার। যাই এবারে আমি। রাত হয়ে যাচ্ছে…” বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল আই নিউন।
“চলো আমিও যাই …” বলতে বলতে কিয়াও মিয়া-ও উঠে পড়ল।
“দাঁড়াও। আমি একটু…” বলতে বলতে আই নিউন বাসার ভেতরে মাথা গলিয়ে বলে, “যাই গো পিসি…”
“হ্যাঁ এসো। ওকে এগিয়ে দিয়ে আয় কিয়াও মিয়া…”
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে তারা তাদের আসন্ন বিয়ের স্বপ্নে মজে ছিল। দু বছর আগে যখন তারা বাগদান করল, তখন ভেবেছিল, ভারী উৎসব হবে তাদের বিয়ের সময়। অতিথিদের জন্য থাকবে ‘কাউক সোয়ে’-র ভোজ। তাতে মুরগির মাংস, ডিম আর নুডল যেমন থাকে থাকবে, কেবল নারকেলের দুধের বদলে দেয়া হবে ঘন ক্ষীর! আর, ভোজ চলবে যখন, তখন গানবাজনার জন্য বাজনদারের একটা দলও ভাড়া করা হবে। তবে সে তো ছিল পুরোনো স্বপ্ন। তারপর দুটো বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। টাকাপয়সার হাল দুজনেরই খারাপ। তবে তাই বলে একেবারে কিছু না খাওয়ালেও চলবে না। বিয়ে বলে কথা! সে তো আর বারবার আসবে না জীবনে! না হয় কিয়াও মিয়া-র ফ্যাক্টরির লোকজন আর আই নিউন-এর বাজারের অন্য হকারদের জন্য খানিক কফি আর হালুয়া… বা ওইরকম কিছু একটা…
তাছাড়া, বিয়ের দিন দুজনের জন্যই নতুন জামাকাপড় কিনতে হয় বরকে। নতুন কম্বল, বালিশ এগুলোও কিনতে হয়। সব মিলিয়ে কম করেও দুশো কিয়াট খরচ আছে।
কিয়াও মিয়াকে বাড়িতে এনে আই নিউম তাকে আগের দিন কিনে আনা খবরের কাগজটা দেখাল। তারপর দুজন মিলে একত্রে আই নিউমের মা ‘দাও সু’-র কাছে গিয়ে সুখবরটা জানাল তাঁকে। মায়ের সঙ্গে কথাবার্তা শেষ করে ফের দুজন ফিরে এসে আই নিউনের ঘরে গিয়ে বসল বিয়ের জোগাড়যন্ত্র নিয়ে পরামর্শ করতে। দাও সু ভারী খুশি হয়েছে খবরটা শুনে। বলে দিয়েছে, বিয়ের খাওয়াদাওয়ার জন্যে বেশ খানিক ‘জিন থোক’ রেঁধে দেবে সে। তার তরফে ওই হল যৌতুক।
“আর শোনো,” আই নিউন বলল, “আমি টুক টুক করে পঞ্চাশ কিয়াট মতো জমিয়েছি। সেটাও নাহয়…”
“উঁহু, একদম নয়,” কিয়াও মিয়া ঘন ঘন মাথা নাড়ল, “ও তোমার কাছেই জমা থাকা। খরচ খর্চার বন্দোবস্ত আমি যে করে হোক করে নেব।”
শুনে মাথা নেড়ে হাসল আই নিউন, “তোমার পকেটের দশা আমি জানি না ভেবেছ নাকি, অ্যাঁ? এইটুকু খরচ আমাকে করতে দাও।”
“না। দেবো না।”
অবশ্য মুখে না না করলেও সাহায্যটুকু না নেবার অবস্থায় ছিল না কিয়াও মিয়া। এমনকি আই নিউনের পঞ্চাশ কিয়াট যদি সে নেয়ও তাহলেও বাকি একশো কিয়াট জোগাড় করতেও তার নাভিশ্বাস উঠবে। ওদিকে কোপানির ছাটাইয়ের লিস্টে তার নাম উঠেছে, কাজেই টাকাটা কেউ তাকে এখন ধার দিতেও রাজি হবে না।
বিয়ের দিন যত এগিয়ে আসছিল ততই কিয়াও মিয়া আরো বেশি দিশেহারা হয়ে উঠছিল। টাকাটা কোত্থেকে জোগাড় করবে সে? মজুরি যেটুকু পায় তাতে তো নুন আনতে পান্তা ফুরোবার দশা। বন্ধুবান্ধব বলো, কারখানার অন্য সহকর্মীরা বলো, সবারই দশা তথৈবচ। তবে হ্যাঁ, প্রতিজ্ঞা যখন সে করেছে তখন বিয়েটা সে ওই স্বাধীনতা পাবার দিনই করবে। নিজের দেয়া কথা সে ফিরিয়ে নেবে না।
***
আজ সেই শুভ দিন। বিকেল চারটের পর কিয়াও মিয়া আর আই নিউন স্বামী-স্ত্রী হয়ে গেল।
সকালে কিয়াও মিয়ার ঘুম ভেঙেছিল হাজার বন্দুকের ধমকে। গান স্যালুটের শব্দে স্বাধীনতাকে বরণ করে নেয়া হচ্ছিল তখন। ওদিকে আই নিউনের ঘুম ভেঙেছিল ঘরের ভেতর তার সখীদের গলার শব্দে। তাকে ডেকে তুলেছিল তারা। তারপর আই নিউন আর কিয়াও মিয়া, আরো হাজারো মানুষের সঙ্গে স্বাধীনতার মিছিলে পা মিলিয়েছিল। গলায় তুলে নিয়েছিল কত না দেশভক্তির স্লোগান! মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে কিয়াও মিয়া আর তার কারখানার কর্মী বন্ধুরা মিলে গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিচ্ছিল, “ইংরেজদের ফ্যাক্টরির দখল চাই… দখল নাও…”
বিকেল চারটের সময় আই নিউনের বাড়িতে বিয়ের আসর বসেছিল। সেখানে ট্রেড ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হ্লা মং খোদ হাজির। তিনিই আই নিউন আর কিয়াও মিয়া-র বিয়ের পুরুত হলেন। গুটিকয়েক গণ্যমান্য সহ প্রায় শ’খানেক নিমন্ত্রিত ছিল বিয়ের আসরে। তাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে সে সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। ভোজ খেয়ে তারা ভারী খুশি। হালুয়া, কফি, ঝাল-টক ‘জিন থোক’ এই সবকিছুরই প্রশংসায় পঞ্চমুখ সবাই।
সন্ধে ছ’টার পর অতিথিরা একে একে বিদায় নিলে দাও মো-কে ডেকে দাও সু বলে, “চলো বেয়ান, তোমাতে-আমাতে স্বাধীনতার উৎসব-টুৎসব দেখে আসি।”
“আমরাও সঙ্গে গেলে ভালো হত না কো মিয়া?” কিয়াও মিয়াকে বলল আই নিউন।
“নাঃ! সারাটা দিন যা খাটাখাটুনি গেল! একটু বসি বরং এবারে।”
শুনে দাও মো তড়িঘড়ি বাকি দুই ছেলেমেয়ে, বেয়ান-টেয়ান সবাইকে জড়ো করে নিয়ে তড়িঘড়ি বাড়ি ফাঁকা করে রওনা দিল।
বাড়িতে তখন তারা একলা দুজন। কিয়াও মিয়া খোলা দরজা দিয়ে বাইরের রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল চুপ করে। মাঝে মাঝে হাইও তুলছিল।
“কী হয়েছে বলো তো তোমার কো মিয়া?” স্বামীর দিকে চোখ ফেলে প্রশ্ন করল আই নিউন, “আজ স্বাধীনতার দিন, আজ আমাদের বিয়ের দিন, কিন্তু তোমার মনে কোনো ফুর্তি নেই কেন?”
“কী যে বলো মা নিউন! তুমি পাশে থাকতে দুঃখটা কীসের হবে আবার? আসলে, খুব ভোরে উঠেছি তো আজ…”
“জিন থোক’ খাবে একটু? আদার স্যালাড তো! মুখে ভালো লাগবে।”
“হুঁ। দাও। সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি। হালুয়া বেঁচে থাকলে সেটাও খানিক দিও।”
আই নিউন খাবারাদাবারগুলো সাজাচ্ছে তখন বাইরে থেকে হাঁক উঠল, “কো কিয়াও মিয়া”
“কে ও? হ্লা মং নাকি? এসো এসো…”
“উঁহু। এখন সময় নেই। শোনো কাল সকাল পাঁচটায় ফ্যাক্টরিতে ইউনিয়নের মিটিং আছে। আমি বেরিয়েছি সবাইকে খবর দিতে।”
“কী নিয়ে মিটিং?”
“তোমার কেসটা নিয়ে কথা হবে।” হ্লা মং-এর গলা ভেসে এল।
“কো মিয়া, ও বলল তোমার কেস! কী ব্যাপার?”
“ও কিছু না, মা নিউন।”
আই নিউনকে জবাব দিতে গিয়ে মুখে শান্ত ভাবটা ধরে রাখলেও মনে মনে একটা অশান্তিতে ভুগছিল কিয়াও মিয়া।
“কিছু না হলে মিটিং ডাকবে কেন? কো মিয়া, আমার কাছে লুকিও না তুমি! কী হয়েছে সত্যি করে বলো।”
“আদার স্যালাডের বাটিটা এখানে এনে রাখো দেখি! রেখে বোসো একটু কাছে।”
আই নিউন স্যালাডের বাটিতে আঙুল দিয়ে ঘাঁটতে ঘাঁটতেই তার পাশে এসে বসল। তারপর বলে, “আমি তোমার বউ তো! বউকে সব বলা যায়। বলো না কী হয়েছে?”
“হুঁ। বলব। আগে বলিনি। বললে দুঃখু পেতে। ওরা আমায় ছাঁটাই করে দিয়েছে।”
আই নিউনের আঙুলগুলো তার অজান্তে স্যালাডটার গায়ে ছুরির ফলার মত গেঁথে যাচ্ছিল বারংবার। তার বুকের ভেতর তোলপাড়।
“কবে?”
“পরশুদিনের আগের দিন। তোমায় বলিনি। বললে ঘাবড়ে যেতে।”
“ঘাবড়ে যেতাম? কেন? এত দুঃখু পাবার কিছু নেই কো মিয়া। বাজারে আমি যেটুকু রোজগার করি তাতে দুটো মুখের চলে যাবে ঠিক।”
কিয়াও মিয়া বাঁহাতের তালু দিয়ে আই নিউনের চিবুকটাকে তুলে ধরল। তারপর তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে গালে চুমু খেল একটা, “আমার ভালো বউ! এমন নইলে সামনের যুদ্ধটায় আমাকে শক্তি জোগাত কে? হ্যাঁ লড়াই একটা হবেই। শ্রমিকরা এ অন্যায় মেনে নেবে না।”
“যাও তবে। লড়াইটা করো। আমরা স্ত্রীরাও আমাদের স্বামীদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই দেব। আর একটা কথা… দুঃখ পাব ভেবে আর কোনোদিন, কোনো কথা আমার থেকে লুকোবে না। কথা দাও…”
কোনো জবাব না দিয়ে কিয়াও মিয়া স্যালাডের বটিটা হাতে তুলে খেতে শুরু করল।
আই নিউন তাকে ভরসা দিয়েছিল, সব কথা তাকে বলতে পারে কিয়াও মিয়া। কিন্তু তবু, একটা কথা সে তার স্ত্রীকে বলেনি। সে হল বিয়ের খরচের একশো কিয়াট রোজগারের গল্পটা। কারো কাছে কোনোভাবে ধার না পেয়ে সে শেষমেষ কারখানার ফোরম্যানের কাছে গিয়ে সেখানে একটা মুচলেকা সই করে দিয়ে এসেছে যে টাকাটা সে ধার পেলে তার বদলে যেকোনো শর্তে সে রাজি। আর তারপর, কোনো কাজটাজ পেলে তার প্রথম মাসের মাইনে সে তুলে দেবে ফোরম্যানের হাতে। তার পর থেকে মাসে পনেরো কিয়াট হারে ধার শোধ করে চলবে।
কথাটা সে আই নিউনকে জানায়নি। সত্যি বলতে কী, কাউকেই জানায়নি সে কথাটা। কী হবে জানিয়ে? আই নিউনকে জানালে তার দুঃখের অবধি থাকবে না। আর অন্য লোকজন জানলে বলবে, “স্বাধীনতা পাবার দিনই একগাদা টাকা ধার করে বসল! ছ্যা ছ্যা! এই না হলে বার্মার লোক!”
আবার কেউ কেউ হয়তো এ-ও বলতে পারে যে স্বাধীন বর্মাকে লজ্জা দেবার জন্য বদমাশটা ইচ্ছে করে নিজেকে ঋণের জালে জড়িয়ে নিয়েছে…
কিয়াও মিয়া তাই এ কথা কাউকে বলবে না। কাউকে না!
লেখক পরিচিতি-থেইন পে মিন্ট
উ থেইন পে মিন্ট ১৯১৪ সালের ১০ জুলাই বর্মার (অধুনা মায়ানমার)-র নিম্ন ছিন্দুইন জেলার বুদালিন-এ জন্মেছিলেন। মান্দালয়ে কলেজছাত্র থাকাকালীনই ছাত্র রাজনীতিতে যোগদান। সাইমন কমিশনের প্রস্তাবমত বার্মাকে ভারতের থেকে আলাদা করে নেবার সপক্ষে ১৯৩২-৩৩-এ ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে মার্ক্সিয় দর্শনে হাতেখড়ি এবং একাধারে মার্ক্সিয় ও জাতীয়তাবাদি দর্শনের মিশেলে নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন গড়ে তোলা। এই নতুন ধারার রাজনৈতিক আন্দোলনের সদস্যরা একে অন্যকে এঁরা ‘তাকিন’ (Master) বলে সম্বোধন করতেন। আন সাঙ – সহ তাঁর এই সময়কার একাধিক ছাত্র সহযোদ্ধা পরবর্তীকালে বর্মার জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন।
স্নাতক হবার আগেই পেশাদার লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি। এরপর আইন নিয়ে স্নাতকোত্তর অধ্যয়ন শুরু করেও, ছাত্র রাজনীতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় সে শিক্ষা শেষ হল না। উ থেইন চলে এলেন সাংবাদিকতায়। একাধিক স্থানীয় ভাষার কাগজে কিছুদিন কাজ করে অবশেষে ‘নিউ লাইট অব বার্মা’ সংবাদপত্রে যোগ দিয়ে ১৯৩৬ সালে তিনি ভারতে আসেন। উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় কংগ্রেসের লখনউ সম্মেলনের খবর করা। এদেশে এসে তিনি ‘নিউ লাইট’ এর সাংবাদিকতার পাশাপাশি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পাঠ নেন দু’বছর ধরে। আর, এই সময়টা সন্ধেগুলো চলত আইন পড়ার পালা। ১৯৩৮ সালে ডিগ্রি না নিয়েই ভারত ছেড়ে বার্মায় ফেরা, সেখানকার জাতীয়তাবাদি আন্দোলনে যোগ দেবার উদ্দেশে। সঙ্গে গেলেন মার্কসবাদি নীরেন্দু দত্ত। আন্দোলন, সাংবাদিকতা এই সবকিছুর পাশাপাশি সাহিত্যিক হিসেবে তখন তাঁর গ্রাফ ক্রমশই ঊর্ধ্বগামী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনায় বর্মায় জাতীয়তাবাদি আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ল। ‘তাকিন’রা অনেকেই ডঃ বা ম’-এর সিনিয়েথা পার্টিতে যোগ দিলেন। এঁদের মধ্যে আন সাং, উ থেইন সহ তাঁর ছাত্রজীবনের অনেক সহযোদ্ধাই ছিলেন। সেখান থেকে ‘তাকিন’ ও কমিউনিস্ট সেল এর সদস্যদের নিয়ে চূড়ান্ত স্বাধীনতার লক্ষ্যে গড়ে উঠল বর্মা রেভোলিউশনারি পার্টি। দুটো দলই তখন ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে মুক্তির জন্য বিদেশি সাহায্যের, বিশেষ করে জাপানিদের সাহায্য নেবার কথা ভাবছিল। এরপর ডিফেন্স অব বার্মা আইন-এর সহায়তায় আন সাং সু কি, ই থেইন সহ অনেকেই ১৯৪০ সালে জেলে যান। ১৯৪১ এ এসে বিআরপি ও কমিউনিস্ট সেল (এককথায় জাতীয়তাবাদি আন্দোলনের বামপন্থী গোষ্ঠী) সিদ্ধান্ত নিল, জাপান এক ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তারাই প্রধান শত্রু। তাদের মোকাবিলার জন্য দরকারে ব্রিটিশদের সঙ্গেও হাত মেলাতে তাঁরা রাজি। তবে ততদিনে আন সাং, ত্রিশজন কমরেডসহ জাপানে পৌঁছে গিয়েছেন এবং বর্মাতেও জনতার পছন্দও জাপানের দিকেই ঢলেছে। এরপর জাপানি হানা শুরু হলে উ থেইন ভারতে পালাবার সিদ্ধান্ত নেন। দীর্ঘ ও নাটকীয় ঘটনাবলির পর ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে ভারতবর্ষে এসে তিনি ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। নিজের জাপান বিরোধীতার কথা বলা সত্ত্বেও এরপর কলকাতা ও দিল্লিতে বেশ কিছুকাল কারাবাস করেন তিনি। এই কারাবাসকালে লেখা হয় তাঁর বিখ্যাত বই ‘বার্মায় কী ঘটেছিল।’ তাঁর কারাবাসের খবর চীন সরকারের কাছে পৌঁছোলে, তাদের অনুরোধে ব্রিটিশরা তাঁকে মুক্তি দেয় ও তিনি ভারত ছেড়ে চুংকিং শহরে পৌঁছোন। বর্মায় ফ্যাসিস্ট বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলবার জন্য চীন সরকারের সহায়তা চান তিনি। কয়েক মাস সেখানে ব্যর্থ চেষ্টা করে ফের দিল্লিতে ফিরলেন উ থেইন। এবারে ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভারতে বসেই বর্মায় জাপানবিরোধী প্রতিরোধগোষ্ঠীদের সাহায্য করা শুরু করলেন তিনি। এরপর ১৯৪৫ সালে বার্মিজ কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান হিসেবে বার্মায় ফেরেন তিনি। কিন্তু নীতিগত মতবিরোধের কারণে এরপর পার্টির সঙ্গে তাঁর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। ১৯৪৮-এ বার্মার স্বাধীনতা (৪ জানুয়ারি) পাবার আট মাসের মধ্যে গ্রেফতার হয়ে জেলে যান তিনি। সেই এক বছরের জেলবাসকালে লেখা হয় তাঁর বিখ্যাত বই “দ্য ওয়ে আউট” এবং “দ্য টিচিংস অব মাও সেতুং।” জেল থেকে বেরিয়ে ফের রাজনৈতিক আন্দোলনে ঝাঁপ দিলেন তিনি। ১৯৫৬ সালে বামপন্থী কোয়ালিশন ন্যাশনাল ইউনাইটেড ফ্রন্ট-এর হয়ে নির্বাচনে জিতে তিনি সেদেশের পার্লামেন্ট প্রবেশ করেন। এই পর্বে চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সফর রাজনৈতিক মিশন নিয়ে করেছেন তিনি।সেই অভিজ্ঞতাদের নিয়ে লেখা হয়ছে স্মরণীয় সব বই- “Bewildering Paris and the Traveller of Peace”, “The World as I’ve seen it”, “Setting off to the West, but coming home from the East”, এবং “The Goodwill Traveller”. বার্মিজ ভাষার মূলত কাব্যপ্রধান সাহিত্যে ছোটোগল্পের আবির্ভাব হয় ১৯৩০ এর দশকে। উ থেইন তার অন্যতম কারিগরও ছিলেন। এর আগেকার বার্মিজ সাহিত্যের প্রকৃতি ও রাজতন্ত্র নির্ভরতা থেকে তাকে বের করে এনে সাধারণ মানুষের গল্প বলবার হাতিয়ার হিসেবে তাকে দাঁড় করাবার পেছনে উ থেইনের গভীর ভূমিকা ছিল। আজীবন বামপন্থী রাজনীতিতে মগ্ন থাকা, গভীর পড়াশোনা এবং দেশের সমাজের বিষয়ে গভীর জ্ঞান এই তিন মিলে তাঁর সাহিত্য সেদেশের মাটির ঘ্রাণ বহন করে। সঙ্গের গল্পটায় এক মোহভঙ্গ হওয়া লেখক স্বাধীনতার মূল্যায়ন করেছেন দেশের দরিদ্রতম মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে। সে মূল্যায়ন দেখায়, গরিবের কাছে স্বাধীনতা কোনো মুক্তির আলো বয়ে আনে না।
এ লেখায় উল্লিখিত রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিজ্ঞ-
AFPFL- Anti-Fascist People’s Freedom League- ১৯৪৪ সালে বর্মায় জাপানি দখলদারদের বিরুদ্ধে অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট লিগ নামে এক প্রতিরোধ গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। বর্মা কমিউনিস্ট পার্টি, বর্মা ন্যাশনাল আর্মি ও পিপল্স্ রেভোল্যুশনারি পার্টি একত্র হয়ে এই AFL-এর জন্ম। ১৯৪৫ সালে তা নাম বদলে AFPFL বা (ফ্যাসিবিরোধী জনমুক্তি মোর্চা) হয়ে যায়। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বর্মা স্বাধীন হয়। তার আগে ১৯৪৭ সালে বর্মার সংবিধান তৈরির জন্য যে গণ পরিষদ-এর নির্বাচন হয় তাতে জয় পায় AFPFL. বর্মার স্বাধীনতার পর সেদেশের শাসনভারও এই রাজনৈতিক দলের হাতে আসে।
জেনারেল আং সান- ১৯১৫ সালে জন্ম। ইউনিভার্সিটিতে আইনের পাঠ নিতে নিতেই পড়া ছেড়ে রাজনীতিতে আসেন। বর্মায় জাপানি দখলদারির শুরুতে ব্রিটিশবিরোধী ও জাপানপন্থী বার্মা ন্যাশনাল আর্মির প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে বর্মার অ্যান্টি ফ্যাসিট লিগে যোগ দেন ও তা থেকে AFPFL তৈরি হলে তার জনপ্রিয় নেতা হয়ে ওঠেন। ব্রিটিশের শাসন থেকে বর্মার মুক্তির অগ্রদূত হিসেবে তাঁকে জানে বর্মার মানুষ। দুর্ভাগ্যক্রমে বর্মার স্বাধীনতা পাবার কিছুদিন আগে তিনি খুন হন। বর্মায় জাতির পিতা হিসেবে তাঁকে অনেকে চিহ্নিত করেন। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তহ বার্মিজ রাজনীতিবিদ ও লেখক আন সাং সু কি তাঁর যোগ্য কন্যা।
লেখায় ব্যবহৃত বিভিন্ন বার্মিজ খাবার ও তাদের রেসিপি
লেট থক সোন (let thohk sohn)- [আক্ষরিক অর্থ: হাতে মেশানো সবকিছু।]
উপকরণ-
ভাত, নুডল, শুঁটকি চিংড়ির পাউডার, আলুসেদ্ধ, মজানো সয়াবিনের টুকরো, পেঁয়াজকুঁচি, ধনেপাতা, অঙ্কুরিত মুগ, তেলে ভাজা বাদাম, শুকনো তাওয়ায় ভাজা ছোলার ছাতু, তেঁতুলের জল, লঙ্কাগুঁড়ো, সামান্য সর্ষের তেল ও ফিশ অয়েল।
প্রক্রিয়া-
বর্মার পথেঘাটে বাজারে মাথায় এই সমস্ত উপকরণ চাঙাড়িতে সাজিয়ে লেট থক সন-এর পসারিনীরা ঘুরে বেড়ান। ডেকে দাঁড় করালে হাতে হাতে বিভিন্ন উপকরণদের মিশিয়ে আপনাকে বানিয়ে দেবেন এই সুস্বাদু খাবার। বানাবার সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোনটা বেশি, কোনটা কম পড়বে দেখিয়ে দিন, নিজের মতো করে কাস্টমাইজ করে নিন তাকে। বিক্রেতা খুশি মনে আপনার ইচ্ছেকে সম্মান করবেন। সাহেবরা এর নাম রেখেছে রামধনু স্যালাড। বাড়িতে বানানো সহজ। উপকরণে অদল-বদল আনতেই পারেন। তবে মজা সয়াবিন, শুঁটকি চিংড়ির গুঁড়ো ও ফিশ অয়েল এই তিনটে উপকরণ বাদ দিলে বস্তুটাকে আর লেট থক সোন বলে চেনা যাবে না।
চা-পাতার তরকারি, বা, লাপেট থক (lahpet thoke)- বর্মা, থাইল্যান্ড ইত্যাদি দেশের জনপ্রিয় খাবার।
উপকরণ-
মজানো চা পাতা (fermented tea leaves), সেদ্ধ মটরশুঁটি, ভাজা তিল, রসুন, কুঁচো চিংড়ি ভাজা, টোম্যাটো, বাঁধাকপির কুঁচোসেদ্ধ, সর্ষের তেল। গার্নিশিং-এর জন্য ফিশ অয়েল কিংবা লেবুর রস দিয়ে গার্নিশিং।
প্রক্রিয়া-
বর্মায় বাড়িতে অতিথি এলে, কিংবা বিয়ে, বাগদান, শ্রাদ্ধ ইত্যাদি হরেক অনুষ্ঠানে মূল ভোজের পর একটা ট্রে-তে লাপেট থক-এর সব উপাদান সাজিয়ে অতিথির সামনে ধরে দেয়া হয়। তাঁরা সেগুলোকে নিজের নিজের মত করে তুলে নিয়ে মিশিয়ে লাপেট থক বানিয়ে খান।
ট্র্যাডিশনাল লাপেট থক-এ সেদ্ধ চা পাতাকে বাঁশের চোঙায় ভরে দুই থেকে তিন মাস অবধি মজিয়ে মজা চা পাতা বা ‘লাপেট’ বানানো হয়। বাড়িতে লাপেট থক বানাতে চাইলে অত কসরৎ লাগবে না। খানিক গ্রিন টি বানিয়ে সেটা খেয়ে ফেলুন। তার ছাঁকটাকে ঠান্ডা জলে দু ঘন্টা ভিজিয়ে রাখুন। এরপর সেগুলো হাতের মুঠো করে তুলে চেপে চেপে যথাসম্ভব জল ঝড়িয়ে নিন। এই পর্যায়ে দু একটা পাতা মুখে দিয়ে দেখে নিন তিতোভাবটা কমেছে কি না। না কমলে ফের কিছুক্ষণ জলে রাখুন। এরপর তাকে তুলে চিপে জল ঝরিয়ে তাকে ব্লেন্ডারে ফেলে পিষে নিন। এরপর, বস্তুটাকে ইস্ট বা ল্যাকটিক অ্যাসিড ব্যাকটিরিয়া ব্যবহার করে একদিন/দুদিন ফার্মেন্ট করে নিন। ব্যস। লাপেট তৈরি। পরিমাণমতো লাপটের সঙ্গে অন্যান্য উপকরণ মিশিয়ে সামান্য তেলে হালকা সাঁতলে নিয়ে পরিবেশন করুন। নুন ও ঝাল রুচিমতো।
আদার স্যালাড, বা, জিন থক (Jin Thoke)- তীক্ষ্ণস্বাদযুক্ত সাইড ডিশ।
উপকরণ-
আদা (নতুন আদা হলে ভালো। আঁশ কম হয়), লেবুর রস, বাদাম তেল, রসুন কয়েক কোয়া, সাদা তিল, নুন, কাঁচা লঙ্কা, বাঁধাকপি বা গাজর।
পদ্ধতি-
খোসা ছাড়ানো আদা দেশলাই কাঠির মতো সরু সরু করে কেটে নুন ও লেবুর রসে ডুবিয়ে রেখে এক ঘণ্টা মতো ম্যারিনেট করুন।
লঙ্কা কুঁচিয়ে বা ফালি করে রাখুন।
বাঁধাকপি কুঁচিয়ে নিন। গাজর ব্যবহার করলে তাকে সেটাও কুঁচিয়ে রাখুন।
বাদামের তেল গরম করে তাতে ফালি ফালি করে কাটা রসুন সোনালি করে ভেজে তুলে, তারপর তেলটা ঝরিয়ে বা পেপার ন্যাপকিনে শুকিয়ে তাকে ঝরঝরে করে একপাশে রাখুন।
শুকনো খোলায় সাদা তিল বাদামি ও কুড়মুড়ে করে ভেজে নিন।
বাঁধাকপির কুঁচি বা গাজর সামান্য নুন দিয়ে ভাপিয়ে নিন ও তার জল ঝড়িয়ে নিন।
এবারে ম্যারিনেট হয়ে যাওয়া আদার টুকরোগুলো তুলে এনে তার সঙ্গে বাকি উপকরণগুলো মিশিয়ে ভালোকরে নাড়িয়ে নিন।
একটা ট্রেতে মিশ্রণটা রেখে গ্যাস ওভেনে হালকা টস করে মিশিয়ে নিলেই রান্না শেষ।
