onubad-tar-mukhe-hasi

তাঁর মুখে হাসি
মূল: শিখা হেলাওয়ি (প্যালেস্টাইনের গল্প)
অনুবাদ: ফজল হাসান
এক মাস আগে শেষ বারের মতো আমাদের মহল্লায় বিমান হামলার সময় একটা বোমা এসে আমাদের রাস্তায় পড়ে। বিস্ফোরিত বোমার অংশ গিয়ে আঘাত করে পাখি-মানব আবু আল-তিরের ঘরের ছাদে। প্রতিবার বোমা হামলার সময় তিনি খাঁচায় বন্দি পাখিদের শান্ত করতে যান। তখন পাখিরা তাঁর মাথার ঝুড়ি থেকে শস্যদানা খুটে খায়। সেদিনও তিনি তাই করেছেন। কিন্তু সেদিন বোমার আঘাতে পাখির খাঁচাটি সম্পূর্ণ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। সব জায়গায় পাখির ছিন্নভিন্ন দেহ, ঝরা পালক এবং রক্ত ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে পড়েছিল। কিন্তু আমরা তাঁকে, এমনকি তাঁর মস্তকও খুঁজে পাইনি। একজন পড়শী খুবই সাদামাটা ভাবে মন্তব্য করেছে, ‘তিনি অনেক আগেই তাঁর মস্তক হারিয়েছেন, যেদিন থেকে তিনি মানুষের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে পাখিদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেছেন।’

আবু আল-তির আমার সঙ্গেও কথা বলেছেন, অথবা (নির্দিষ্ট করে বলতে হয়) তাঁর সঙ্গে আমি কথা বলা বন্ধ করিনি এবং তিনি অত্যন্ত কম কথা বলেছেন। যখন তিনি খাঁচার পাখিগুলোকে খাবার দিতেন এবং ওদের বিষ্টা পরিস্কার করতেন, তখন তাকে হ্যালো বলার জন্য আমি ছাদে যেতাম। তবে তিনি আমার দিকে কদাচিৎ মনোযোগ দিতেন। আমি তাঁর কুশলাদি জিজ্ঞেস করতাম এবং তারপর দৈনন্দিন যুদ্ধের পরিস্থিতি এবং আমার ভয়-আতঙ্ক নিয়ে তাঁর সঙ্গে গল্প করতাম।

‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে, ভয় যেন গা শিরশির করে হৃদয় ও আত্মার মধ্যে প্রবেশ না করে। ভয় হলো যুদ্ধের দানব। ভয় যখন গা শিরশির করে আত্মার মধ্যে প্রবেশ করে, তখন পুরোটাই দখল করে নেয়। সেই সময় দেখার চোখও তেমনই হয় ওঠে’, খাঁচার ভেতর থেকে পাখিদের বিষ্ঠা বের করে আনার সময় তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন। কিন্তু আমি ভীত ছিলাম। আসলে আমার ভয়ের কারণ ছিল জনমানবহীন পথঘাট, বিষণ্ণ পানশালা, প্রয়াতদের মুখমন্ডল এবং মৃতদের হাসি ।

আয়নায় আমার প্রতিবিম্ব দেখে আমি ভয় পেয়েছি। কেননা প্রতিবিম্বটি আমার মুখমন্ডলের বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলেছে। আমি যখন তাঁর কাছে আমার প্রয়াত বন্ধু-বান্ধবদের গল্প বলি, তখন তিনি বলেন, ‘চলো, যারা বেঁচে আছে, তাদের তালিকা তৈরি করি।’ নিরাপত্তা চেকপয়েন্টে আমার আতঙ্কিত হওয়ার ঘটনা বলার সময় তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘সামরিক চেকপয়েন্টের কথা ভুলে যাও এবং ভয়ের সকল বাঁধা অতিক্রম করো।’ আমি আমার নতুন বান্ধবীর কথা বলার সময় তিনি বলেছেন, ‘তুমি মিথ্যা বলছো। আমি এখনও তোমার চোখের গভীরে প্রথমজনকে দেখতে পাচ্ছি।’

আমার মুখের জন্য হাসির মুখোশ তৈরি করার আগে এসব কথাবার্তা হয়েছিল।

তিন বছর ধরে চলমান যুদ্ধের এক সকালে আমি আবিস্কার করেছি যে, আগের বছর গুলোতে আমার মুখে যে ধরনের হাসি প্রস্ফুটিত হতো, তা এখন আর আমাকে মেনে চলে না। এখন আমার মুখের পেশী প্রসারিত এবং ঠোঁট আলাদা, অথচ সেই অভিব্যক্তি মোটেও হাসির মতো লাগে না। একধরণের সঙ্কর অভিব্যক্তি, যা আমার মুখমন্ডলে স্থির হয়ে আটকে থাকা ভয়ার্ত ভাবের সঙ্গে মোটেও যায় না।

আমাকে অনেকটা বিষণ্ণ ক্লাউনের মত দেখাচ্ছিল।

নিজের জন্য আমি আমার মতো দেখতে একটা নমনীয় মুখোশ বানিয়েছি, যার মাঝখানে নিশ্চল হাসি। অনন্ত হাসির সঙ্গে একটি নিষ্প্রাণ মুখোশ।

আমি কথা শুরু করার আগে আবু আল-তির, যিনি কদাচিৎ আমাকে খেয়াল করতেন, বলেন, ‘মুখোশের আড়ালে মুখ ঢেকে আমার সঙ্গে কথা বলো না, হে পুরুষ! তোমাকে হাস্যকর এবং শোচনীয় দেখাচ্ছে।

আমি মুখোশ খুলে ফেলি এবং আমার আসল অবয়ব বেরিয়ে আসে, যা যুদ্ধের প্রতি থুথু ফেলা এবং ভয়কে উপহাস করার মতো। আমি গান করি, নাচি এবং ছাদের কিনারে দাঁড়িয়ে উড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে দু’হাত প্রসারিত করি। আমি নিচের ধ্বংসস্তুপের দিকে তাকাই এবং অনবরত হাসতে থাকি, যতক্ষণ না পর্যন্ত আমার চোখ অশ্রুতে ভিজে ওঠে।

আবু আল-তির আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ান এবং বলেন, ‘একদিন আমরা এসব ধ্বংসস্তূপকে অতিক্রম করতে পারবো, যদি মন থেকে ভয়কে দূর করতে পারি।’

আমি ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য আবু আল-তিরের বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যাই। অবহেলিত কোণা থেকে গুটিসুটি পায়ে ভয় বেরিয়ে আসে এবং আমাকে অনুসরণ করে। ভয় আমার এতটাই কাছে ছিল যে, একসময় আমার কাঁধ প্রায় স্পর্শ করেছিল। আমি হাস্যোজ্জ্বল মুখোশ নামিয়ে রাখি এবং চাকার মতো ঘুরে তাঁর দিকে এগিয়ে যাই। তিনি নির্দিষ্ট জায়গাতেই ছিলেন, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সরু গলির অন্ধকারের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যান।

আমি আবু আল-তিরের ভাগ্যের উপর নির্ভরশীল নই। দিনগুলো ছিল একই ধরনের, শুধু একজন পাগলের উপস্থিতি ছিল না। যুদ্ধ একই ছিল এবং তখনও অবশিষ্ট ক্ষতের স্বাদ নিচ্ছিল। এছাড়া মানুষজন পরিচয়হীন অবয়বের চতুর্দিকে চলাফেরা করছিল।

কিছু অজানা চাহিদা পূরণ করার জন্য আমি খাঁচা মেরামত করা আরম্ভ করি, যতক্ষণ না পর্যন্ত পুনরায় বিমান হামলা পার্শ্ববর্তী এলাকায় আঘাত হানতে শুরু করে।

আমি হাস্যোজ্জ্বল মুখোশ পড়ি এবং এক বোতল ‘অ্যারাক’ নিয়ে ছাদে যাই। আমি খাঁচার ভেতর প্রবেশ করি, যেখানে হত্যাযজ্ঞের কবল থেকে বেঁচে যাওয়া একটা ঘুঘু ছাড়া আর কিছুই ছিল না। মাঝে মাঝে পাখিটি আমার মাথায় ঠোকর দেয় এবং অন্য সময় আমার গ্লাস থেকে ‘অ্যারাক’ পান করে।

‘এসো, নিঃসঙ্গ ঘুঘু। তোমাকে আমার সর্বশেষ বান্ধবীর খবরাখবর শোনাই।’

ডানা ঝাপটিয়ে পাখিটি দৃষ্টির সীমানা ছাড়িয়ে উড়ে চলে যায়।

আমি মুখোশ খুলি এবং তড়িৎ বেগে ধ্বংসস্তূপের উপর উঠে দাঁড়াই।

আমি দৃষ্টির সীমানায় আবু আল-তিরকে আবিস্কার করি। দালানের ভুগর্ভস্থ থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন মস্তক নিয়ে উঠে আসছেন।



[পাদটীকা: মূল গল্পে ‘অ্যারাক’-এর ব্যাখ্যা নেই, কিন্তু পাঠকের সুবিধার্থে দেওয়া হলো। অ্যারাক হচ্ছে পশ্চিম এশিয়ার, বিশেষ করে পূর্ব ভূমধ্যসাগর এলাকা, সিরিয়া, ইজরায়েল, ফিলিস্তিন, জর্ডান এবং লেবানন, একধরনের ঐতিহ্যবাহী মদিরা, যা আপেল এবং মৌরি থেকে উৎপন্ন করা হয় – অনুবাদক ।]

লেখক পরিচিতি: প্যালেস্টাইনের ছোটগল্প লেখক, কবি এবং শিক্ষিকা শিখা হেলাওয়ি (পুরো নাম শিখা হুসেইন হেলাওয়ি) হাইফার সন্নিকটে এক বেদুঈন গ্রামে ১৯৬৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। হাইফার নাজারেথ নানস্ হাই স্কুলে পড়াশুনা সমাপ্ত করে তিনি তেল আবিব ইউনিভার্সিটি থেকে আরবী ও হিব্রু ভাষায় বিএ এবং আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজে এমএ ডিগ্রী অর্জণ করেন। পরবর্তীতে তিনি পিএইডি শুরু করেন, কিন্তু ছেলের অসুস্থতার জন্য শেষপর্যন্ত সম্পন্ন করতে পারেননি।

ছেলের অসুস্থতা শিখা হেলাওয়ির জীবন পাল্টে দেয়। অসুস্থ ছেলের সেবা-শ্বশ্রুষার সময় তিনি একঘেঁয়েমীর জীবন থেকে খানিকটা মুক্তির আশায় সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ছেচল্লিশ বছর। তিনি আরবীতে লেখালেখি করেন। এ পর্য্ন্ত তাঁর চারটি ছোটগল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে । এগুলো হলো Sayidat El-Atma (The Ladies of Twilight, 2015), Kharij Al-Fesool (Outside Seasons, ২০১৫), Al-Nawafidh Kotob Radi’a (Windows are Bad Books, ২০১৬) এবং Al-Talabiyya C345 (The Order C345, ২০১৮)। উল্লেখ্য, ‘Order C345’ গল্পগ্রন্থটি ২০১৯ সালে ‘Almultaga Prize for Arabic Short Story’ পুরস্কার লাভ করে। এছাড়া Kharij Al-Foosul Ta’alamtu Attayaran (Outside the Seasons I Learned to Fly) তাঁর একমাত্র প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। তিনি কবিতার জন্য ইজরায়েলের সম্মানিত ‘Teva Prize’ লাভ করেন। সম্প্রতি তাঁর কবিতা Consequence Magazine, Boston Review এবং Billingham Review-তে ছাপা হয়েছে। এ পর্যন্ত তাঁর সাহিত্যকর্ম ইংরেজি, জার্মান, ফরাসী এবং বুলগেরীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিগত কুড়ি বছর ধরে তিনি পূর্ব জেরুজালেমের রামালা শহরের জাফায় অবস্থিত টেরা সান্টা মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতা করছেন ।

গল্পসূত্র: ‘তাঁর মুখে হাসি’ গল্পটি শিখা হেলাওয়ির ইংরেজিতে ‘অ্যা স্মাইল ইন হিজ ফেইস’ গল্পের অনুবাদ। গল্পটি আরবী থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন রাফায়েল কোহেন এবং ‘Order C345’ ছোটগল্প সংকলনে অন্তর্ভুক্ত। পরবর্তীতে ২০২০ সালের গ্রীষ্ম সংখ্যা বৃটেনের ‘Banipal’ ম্যাগাজিনে পুনঃপ্রকাশিত হয় এবং সেখান থেকে নেওয়া হয়েছে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *