onubad-val-paraiso

ভালপারাইসো এবং লিলি হোয়াইট
(ডাচ আমেরিকান লোক-কথা)
সংগ্রহ ও ভাষান্তর : রাখী নাথ কর্মকার


একদা এক সময়, উত্তর মেরুর কাছাকাছি কোনও এক জায়গায় মি. বারবাব নামের এক বুড়ো কৃপণ বাস করত। তার ঘরের কাজকর্ম করার জন্য কয়েকজন চাকরের প্রয়োজন ছিল, তাই লিলি হোয়াইট নামের একটি মেয়েকে তাদের ঘরে চাকর হিসেবে বহাল করা হল। লিলি হোয়াইট বুড়ো বারবাবের বাড়িতে কাজে যোগ দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বুড়োর স্ত্রী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল এবং এত বড় বাড়িতে পড়ে রইল বুড়ো বারবাব একা। তার ঘরের মধ্যে, চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে নানা দামী জিনিসপত্র, সোনার ব্যাগ, এবং এরকমই অনেক দামী বস্তুটস্তু … কিন্তু গুছিয়ে রাখার মতো কেউ নেই যে! বুড়ো বারবাবের তখন মনে হতে লাগল, তার বয়স হচ্ছে, এবার তাকে বাড়ির বিভিন্ন কাজে সাহায্য করার জন্যে একটি ছেলের প্রয়োজন। সুতরাং খুব শিগগিরি ভালপারাইসো নামের একটি ছেলেকে বুড়ো বারবাব তার ঘরের কাজে নিযুক্ত করল এবং তাকে নির্দেশ দিয়ে দিল এই যে, তার বাড়ি তো বটেই, বাড়ির চারপাশের সমস্ত কাজই ছেলেটিকে করতে হবে। একদিন সকালবেলা, বারবাব ছেলেটিকে ডেকে পাঠাল তার আস্তাবলে আস্তাবল পরিষ্কার করার জন্যে। সেই সঙ্গে ছেলেটির বিশ্বাসযোগ্যতা পরীক্ষা করার জন্যে ছেলেটিকে বলল – “আমার স্ত্রী মারা যাওয়ার বেশ কিছু দিন আগে আস্তাবলে তার একটি আংটি হারিয়ে গিয়েছিল, আস্তাবল পরিষ্কার করা হলে সেটি তোমাকে খুঁজে বের করে আনতে হবে।” মনিবের আদেশ শুনে একটা বিরাট বেলচা নিয়ে ভালপারাইসো আস্তাবল পরিষ্কার করতে গেল। কিন্তু মুশকিল হল, আস্তাবলটা এতটাই নোংরায় পরিপূর্ণ হয়ে ছিল যে ভাইপারাইসো আস্তাবলটা যতই পরিষ্কার করুক না কেন নোংরা যেন থেকেই যায়। ভালপারাইসো পাগলের মতো পরিষ্কার করে চলে, কিন্তু আস্তাবলের চেহারা এতটুকু বদলায় না! মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খেটেও সারাদিনে সিকি ভাগও পরিষ্কার করে উঠতে পারে না! এদিকে বুড়ো বারবাব ভালপারাইসোকে বারবার বলে দিয়েছে, আংটি না নিয়ে সে যেন বাড়িতে না ফেরে। অথচ সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল… আংটি খুঁজে পেল না। দুপুর বেলা লিলি হোয়াইট খাবারের জন্য ভেঁপু বাজাল, কিন্তু ভালপারাইসোর খেতে যাওয়ার সাহসই হল না। বেশ কয়েকবার ভেঁপু বাজানোর পরেও যখন ভালপারাইসো এল না, লিলি হোয়াইট তখন কৌতূহলী হয়ে আস্তাবলের সামনে এসে হাজির হল। আস্তাবলে ঢুকে উঁকি মেরে লিলি দেখল, ভালপারাইসো এক কোণে বসে কাঁদছে। লিলিকে দেখে তার কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেল, সে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল- “আমি যতই পরিষ্কার করছি, কোন জাদুবলে আস্তাবল ততই যেন নোংরা হয়ে যাচ্ছে। ফলে আমার কিছুই করার থাকছে না।”

ভালপারাইসোর কথা শুনে লিলি হোয়াইটের মায়া হল। লিলির কিছু জাদুক্ষমতা ছিল। সে ভালপারাইসোকে শান্ত করার জন্য বলল –

“কেঁদো না হে, ভালপারাইসো।

উপায় আছে, খুঁজি এসো!

তুমি চিন্তা কোরো না ভালপারাইসো, আমার একটি জাদু আংটি আছে, এটাকে আঙুল দিয়ে ঘষলে আমি যা চাই এ তাই করে দেবে।”

সুতরাং জাদু আংটিটা আঙুল দিয়ে ঘষে নিয়ে লিলি বেলচা হাতে আস্তাবল পরিষ্কার করতে লেগে গেল, এবং কী আশ্চর্য! দেখা গেল, কিছুক্ষণের মধ্যেই আস্তাবল পুরো ঝকঝকে তকতকে হয়ে গেছে। এমনকি আস্তাবলের নোংরার মাঝে বহুদিন আগে মনিব-গিন্নীর হারিয়ে যাওয়া সোনার আংটিটিও খুঁজে পাওয়া গেল। এবার ওদের আনন্দ দেখে কে! অতএব এবার তারা দু’জনে নিশ্চিন্ত হয়ে দুপুরের খাবার খেতে বাড়িতে গেল। বুড়ো বারবাব তো আংটিটা পেয়ে খুব খুশি হল, এবং ভালপারাইসোকে বলল –“যদি তুমি এমন মন দিয়ে কাজ করো ও বিশ্বাসী হয়ে থাক, তাহলে আমি তোমাকে কাজে রেখে দেব, ভাল মাইনেও দেব। কিন্তু যদি কখনো আমার কথার অমান্য করেছ, তাহলে তোমাকে আর প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে না!”

সেদিন ভালপারাইসো সারাদিন ধরে আস্তাবলে বুড়োর তিনটে ঘোড়া – বুড়ো ব্ল্যাকি, হোয়াইটি আর ব্রাউনির পরিচর্যা করল, বুড়োর দুই হিংস্র কুকুর বিঙ্গো আর বাঙ্গোকে খেতে দিল, বিকেলবেলা কাঠ কেটে টুকরো করে রাখল, সন্ধেবেলা ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বালাল, আর তারপর রাতে সবাই শুয়ে পড়ার পর দরজা বন্ধ করে তবে সে শুতে গেল।

পরের দিন সকাল হতে না হতেই বুড়ো বারবাব ভালপারাইসোকে ডেকে পাঠাল –“শোন ভালপারাইসো, আজ তোমাকে আমি আরেকটা কাজ দেব। যদি তুমি আস্থা সহকারে এই কাজটি সম্পন্ন করতে পার, তাহলে তোমায় উপযুক্ত পুরস্কার দেব। কিন্তু যদি না পারো, তাহলে আমার কুকুরদুটো তোমার মাথা চিবিয়ে খেয়ে নেবে!”

ভালপারাইসোকে বাড়ির পিছনের তৃণভূমিতে পাঠানো হল সেখানকার ঘাস নিড়িয়ে তা পরিষ্কার করার জন্য। সেই সঙ্গে বুড়ো বারবাব ভালপারাইসোকে এটাও বলে দিল, ওই তৃণভূমিতে বহুদিন আগে তার স্ত্রীর একটা সোনার চেন হারিয়ে গিয়েছিল। তৃণভূমির আগাছা আর ঘাস পরিষ্কার করে সেই চেনটিকে খুঁজে নিয়ে আসতে হবে তার কাছে।

সুতরাং সকালবেলাতেই ভালপারাইসো বাড়ির পিছনের পশুচারণভূমিতে গিয়ে কাজ শুরু করে দিল। কিন্তু এ তো মহা মুশকিল হল! সে যতই ঘাস নিড়ায়, যতই ঘাস নিড়ায়, ততই যে ঘাস আর আগাছার জঙ্গল তরতরিয়ে বেড়ে ওঠে। সোনার চেন তো দূরের কথা, ঘন ঘাসের স্তূপের মধ্য দিয়ে মাটির দেখাই যে সে পাচ্ছে না!

এদিকে, বাড়ির নানা কাজের ফাঁকে টুক করে সেদিন লিলি বেরিয়ে পড়েছে বাইরে, ভালপারাইসো কতটা কী করতে পেরেছে দেখার জন্যে। কিন্তু তৃণভূমিতে এসে লিলি দেখে, বিস্তীর্ণ প্রান্তরজুড়ে জঙ্গল যেমনকার তেমন আছে, আর সেই ঘাস-আগাছার জঙ্গলের মধ্যে বসে বসে ভালপারাইসো হতাশ হয়ে বসে বসে কাঁদছে। লিলিকে দেখে ভালপারাইসো কাঁদতে কাঁদতে বলল –“খিদেয় যে আমার পেট জ্বলে যাচ্ছে লিলি, কিন্তু আজ আমি চেন না নিয়ে ফিরলে মনিব বলেছে আমার পিছনে কুকুর লেলিয়ে দেবে!”

ভালপারাইসোর সততা, সরলতা লিলিকে মুগ্ধ করেছিল, তাই ওকে কাঁদতে দেখে লিলির সত্যি খুব কষ্ট হল। ভালপারাইসোকে ডেকে লিলি বলল –

“কেঁদো না হে ভালপারাইসো।

উপায় আছে, দেখছি রোসো!

তুমি এবার খানিকক্ষণ বিশ্রাম নাও দেখি। আমি দেখছি কী করা যায়!”

বলেই লিলি লেগে পড়ল কাজে, মাটিতে একটা করে সে কোপ দেয় আর ঘাসের চাঙড় জমতে থাকে, একটা করে কোপ দেয় আর ঘাসের চাঙড় উপড়ে উঠে আসে। দেখতে দেখতে কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত তৃণভূমি একেবারে পরিষ্কার করে ফেলল লিলি, বলাই বাহুল্য, মনিব গিন্নীর সেই হারিয়ে যাওয়া সোনার চেনটাও খুঁজে পাওয়া গেল। আহা, সেই মুহূর্তে কী আনন্দই না হল দুজনের! ভালপারাইসোর তো মনে হতে লাগল, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষ হল এই লিলি! সে হয়ত সারা জীবনেও লিলির ঋণ শোধ করতে পারবে না। লিলি কিন্তু তাকে বারবার সাবধান করে দিল, খবরদার যেন বুড়ো মনিব জানতে না পারে লিলি ওকে সাহায্য করেছে, তাহলে কিন্তু বুড়ো ওদের দুজনের কাউকেই আর আস্ত রাখবে না।

বাড়ি ফিরে ভালপারাইসো চেনটা বুড়োর হাতে তুলে দিতেই বুড়ো খুব খুশি হল, কিন্তু ভালপারাইসোকে ‘কর্মঠ’, ‘বিশ্বাসী’ ইত্যাদি নানা বিশেষণে বিশেষিত করেও বুড়ো বারবার সাবধান করে দিল –“যাই করো বাপু, মিথ্যে কথা বোলো না! মিথ্যে বললে কিন্তু আমার কুকুরেরা তোমার মাথা চিবিয়ে খাবে।”

তার কিছু পরেই, বুড়ো আবার ভালপারাইসোকে ডেকে পাঠাল –“শোনো হে ভালপারাইসো, আমার আর একটি কাজ কাল তোমায় করে দিতে হবে। সামনের জঙ্গলে কিছুদূর গিয়েই দেখতে পাবে একটা অদ্ভুত বুড়ো গাছ আছে। গাছটার কান্ডের ছাল ছাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে, এবং নিচের অংশে ডালপালা কিচ্ছুটি নেই। কিন্তু গাছটার মগডালে এক বিরল প্রজাতির পাখির বাসা আছে, আর সেই বাসায় আছে সেই পাখির সুস্বাদু ডিম। আমার সকালের জলখাবারের জন্য ওই ডিম তোমাকে এনে দিতে হবে।”

পরের দিন সকাল হতেই তাই ভালপারাইসো সেই জঙ্গলের পথে রওনা হল। জঙ্গলের গভীরে গিয়েই দেখতে পেল সেই অদ্ভুত গাছটাকে। গাছটার কান্ডে ছাল বলতে কিছু নেই। একেবারে মসৃণ। যা বাব্বা! এই গাছে ওঠা তো একেবারেই অসম্ভব! কিন্তু তা সত্ত্বেও ভালপারাইসো সারা দিন ধরে গাছে ওঠার চেষ্টা করে যেতে লাগল, কিন্তু গাছের পিচ্ছিল, মসৃণ কান্ডে আঁকড়ে ধরার কিছু না পেয়ে বারবার পিছলে পড়ে যেতে লাগল। সত্যি বলতে কী, ভালপারাইসো সেই সময় মনেপ্রাণে চাইছিল, লিলি হোয়াইট যেন একটিবার এখানে আসে। এত বার লিলি তাঁকে সাহায্য করেছে, এবং ভালপারাইসোর মনে ধারণাই হয়ে গিয়েছে, যে এই পরিস্থিতি থেকে তাকে কেউ যদি উদ্ধার করতে পারে তো সে একমাত্র লিলি! কিন্তু সেদিন লিলি ঘরের কাজে এতটাই ব্যস্ত ছিল, যে কিছুতেই সময় বের করে উঠতে পারছিল না! শুধু তাই নয়, কোনো কারণে বুড়ো বারবাবের মনে কিছু সন্দেহের উদ্রেক হয়েছিল, তাই সে সারাদিন লিলিকে নজরে নজরে রেখেছিল, যাতে লিলি বাইরে বেরোতে না পারে।

লিলি কিন্তু তক্কে তক্কে ছিল, কাজের ফাঁকে বাইরে থেকে জল আনতে যাওয়ার ছুতোয় একবার টুক করে বেরিয়ে পড়েই সে ছুট দিল জঙ্গলের দিকে। ছুটতে ছুটতে সেই গভীর জঙ্গলের মধ্যে এসে লিলি দেখল সেই বুড়ো গাছটার নিচে বসে ভালপারাইসো অঝোরে কেঁদে চলেছে। লিলিকে দেখে ভালপারাইসো প্রবল হতাশা ও আশঙ্কার মাঝেও যেন হাতে চাঁদ পেল। কিন্তু তবুও কাঁদতে কাঁদতে বলল –“লিলি, ভাগ্যিস তুমি এসেছ। দেখ, এবার কোনও উপায় বার করতে পারো কিনা। আমি সারাদিন চেষ্টা করেও মগডাল থেকে ডিম পাড়া তো দূরের কথা, গাছেই উঠতে পারিনি। এবার আর মনিবের হাত থেকে আমার নিস্তার নেই!”

লিলি কিন্তু তার উপস্থিত বুদ্ধি হারাল না। শান্ত স্বরে ভালপারাইসোকে ডেকে বলল –

“কেঁদো না হে, ভালপারাইসো।

একটু ভাবি, একটু বোসো!”

ভাবতে ভাবতে এবার সে তার শেষ জাদুবিদ্যেটা প্রয়োগ করার মনস্থির করে বসল। লিলি ভালপারাইসোর হাতে তার হাতের একটি একটি করে আঙুল খুলে দিয়ে বলল –“ভালপারাইসো, আমার এই আঙুলগুলোকে তুমি গাছের গুঁড়িতে একটা একটা করে গুঁজে দাও। এই গোঁজগুলোতে পা দিয়ে তুমি নিশ্চয়ই মগডালে উঠে যেতে পারবে। কিন্তু দেখো … সাবধান, খুব বেশি চাপ দিও না যেন। আমার আঙুল কিন্তু বেশি চাপ নিতে পারবে না।”

সুতরাং ভালপারাইসো অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে লিলির আঙুলগুলোকে একটা একটা করে গুঁজে দিতে লাগল গাছের কান্ডে আর তারপর তা বেয়ে গাছের ওপরে উঠতে শুরু করল। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই পাখির বাসা অবধি পৌঁছে গিয়ে পাখির ডিমগুলো নিয়ে নিজের জামার মধ্যে ভরে ফেলল। এই পর্যন্ত সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু মুশকিল হল গাছ থেকে নামার সময়। গাছ থেকে প্রায় নেমেই এসেছিল ভালপারাইসো, কিন্তু একেবারে শেষ ধাপে এসেই তার পা পিছলে গেল, এবং তার পায়ের চাপে শেষ গোঁজটা অর্থাৎ লিলির বাঁ হাতের কড়ে আঙুলটা ভেঙে গেল। ভালপারাইসোর যে কী ভীষণ দুঃখ হল তা আর বলার নয়। সেই সঙ্গে লিলি আর ভালপারাইসো দু’জনেই কিন্তু এরপর কী হবে ভেবে ভয়ে কুঁকড়ে গেল।

বাড়ি ফেরার পথে হাঁটতে হাঁটতে লিলি অনেক অনেক করে ভালপারাইসোকে বোঝাল, এর জন্যে যেন সে একদম দুঃখ না করে, লিলির কিন্তু মোটেই সেরকম ব্যথা হচ্ছে না। তবে একমাত্র ভয়ের বিষয় হল এটাই যে, ভাঙা আঙুলটা যেন বুড়ো মনিবের নজরে না পড়ে। নাহলে আর চিন্তার কিছু নেই!

বুড়ো বারবাব তো ডিমগুলো পেয়ে ভারি খুশি হল। সে এবারও আগের বারের মতোই ভালপারাইসোর কর্মপরায়ণতার প্রশংসা করল, এবং সেই সঙ্গে সেই কথাগুলোই বলে তাকে আবার সাবধান করে দিল যা সে প্রতিবার ভালপারাইসোকে বলে এসেছে –“যাই করো বাপু, মিথ্যে কথা কিন্তু বোলো না! মিথ্যে বললে কিন্তু আমার কুকুরেরা তোমার মাথা চিবিয়ে খাবে।”

সারা দিনের পরিশ্রমে তখন সন্ধে হয়ে এসেছিল। তাই রাতের খাবারে সেই পাখির ডিম ভেজে মনিবকে পরিবেশন করতে এল লিলি। কিন্তু একী! লিলির হাতে গ্লাভস পরা কেন? বুড়ো বারবাবের সন্দেহ তীব্র থেকে তীব্রতর হল। বুড়ো লিলিকে ডেকে জিজ্ঞেস কলল –“কী হয়েছে তোমার হাতে?”

লিলি এতটুকুও না বিচলিত হয়ে উত্তর দিল –“রান্না করতে গিয়ে আঙুল পুড়ে গিয়েছে।”

কিন্তু বুড়ো বারবাব এই উত্তরে মোটেই সন্তুষ্ট হল না। সে লিলিকে জোর করতে লাগল হাতের গ্লাভসটা খুলে তাকে দেখানোর জন্য। লিলি বাধ্য হয়ে গ্লাভসটা খুলতেই বুড়ো লিলির ভাঙা আঙুল দেখে চিৎকার করে উঠল –“হ্যাঁ, আমি এটাই সন্দেহ করছিলাম! এইবার তোমরা দুজনে ধরা পড়ে গিয়েছ। মিথ্যেবাদী ডাইনী লিলি আর মিথ্যুক ভালপারাইসো – তোমরা দুজনেই আমাকে ঠকিয়েছ। এবং তার ফলস্বরূপ আজ তোমাদের দুজনকেই মরতে হবে।”

লিলি বেচারী তো প্রচন্ড ভয়ে কেঁদেই ফেলল, কাঁদতে কাঁদতে বুড়ো মনিবের হাতেপায়ে ধরে প্রাণভিক্ষা চাইতে লাগল। কাতর অনুরোধ জানাতে লাগল তাদের ছেড়ে দেওয়ার জন্যে। কিন্তু নিষ্ঠুর ও কৃপণ বুড়ো বারবাবের শরীরে মায়াদয়ার লেশমাত্র ছিল না। লিলির হাজার কান্নাকাটিতেও তাই বুড়োর মন গলল না, নির্বিকার চিত্তে বলল বুড়ো–

“আমাকে মিথ্যে বলার জন্যে আজ তোমাদের মরতেই হবে!” বুড়ো তো বটেই, বুড়োর কুকুর দুটোও যেন লিলি আর ভালপারাইসোকে দেখে দাঁতে দাঁত চেপে নিষ্ঠুর হাসি হাসতে লাগল।

রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ হওয়ার পর শুরু হল বাসনপত্র ধোয়ার পালা। সে পর্বও শেষ হলে বুড়ো ওদের দুজনকে তার বাড়ির নিচে, সেলারে পাঠাল সেখান থেকে দুটো বিরাট সাবান তৈরির কেটলি নিয়ে আসার জন্য। তারপর তাদের আদেশ দিল, ওই কেটলি দুটোকে তরল ক্ষারে ভর্তি করে তা স্টোভে বসাতে। বুড়ো তার দুই হিংস্র কুকুরকে তাদের দুজনের ওপর নজর রাখার দায়িত্ব দিয়ে গেল, যাতে লিলি আর ভালপারাইসো কোনও ভাবেই পালাতে না পারে।

প্রতি রাতে খাওয়াদাওয়ার শেষ হওয়ার পর ঘুমোতে যাওয়ার আগে অবধি বুড়ো নিশ্চিন্তে তার ঘরে বসে সুরাপান করে। এবং বরাবরের মতো আজ রাতেও বুড়ো বারবাব লিলিকে ডেকে তার জন্যে পানীয় নিয়ে আসার আদেশ করল। লিলি তখন বুড়োর অজান্তেই বুড়োকে আজ বেশ কড়া একটা পানীয় তৈরি করে দিল।

পানীয়ের গ্লাসে তৃপ্তির চুমুক দিয়ে বুড়ো বারবাব লিলিকে এবার আদেশ করল –“যাও, নিচে সেলারে গিয়ে দুজনে ফুটন্ত ক্ষারে ভর্তি দুই কেটলিতে গিয়ে ঝাঁপ দাও। আমি যেন গিয়ে দেখতে পাই, তোমরা দুজনে দুটো কেটলিতে গলে পুড়ে সাবানে পরিণত হয়ে গিয়েছ!”

বুড়োর আদেশ শুনে ভালপারাইসো তো প্রাণভয়ে ঠকঠকিয়ে কাঁপতে শুরু করে দিল। নাহ, এবার আর বুড়োর হাত থেকে পরিত্রাণ নেই ওদের কারোর! বুড়োর কুকুরদুটো যে বাঘের মতো থাবা গেড়ে বসে আছে ওদের সামনে। সামান্য বেচাল দেখলেই ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের টুঁটি ছিঁড়ে নেবে!

লিলি কিন্তু বরাবরের মতোই নিজের ওপর বিশ্বাস হারাল না। সে জানে, ওই কড়া পানীয়ের প্রভাবে বুড়ো এখন বেশ কিছুক্ষণ নেশার ঘোরে ডুবে থাকবে। লিলি তাই ঠাণ্ডা মাথায় ভালপারাইসোকে ইশারায় বলল –“বুড়ো যা যা বলেছে এখন আমাদের তাই করার ভান করতে হবে।” ভালপারাইসোর সঙ্গে লিলি চুপিসারে নেমে এল নিচে, সেলারে। তারপর তরল ক্ষারে ভর্তি করে বিশাল সাবানের কেটলি দুটিকে স্টোভে চাপিয়ে দিল। লিলিকে মাঝে মাঝেই বুড়োর কুকুরদুটোকে খাবার দিতে হত। লিলি জানত, কুকুরদুটো খরগোশের মাংস ভালবাসে। লিলি এই ফাঁকে সবার অলক্ষ্যে কয়েক টুকরো খরগোশের মাংসে বিষ মিশিয়ে তা কুকুরদুটোকে খেতে দিল। বলাই বাহুল্য, কুকুরদুটো বেশ তারিয়ে তারিয়ে সেই মাংস খেল। তারপর…সব শান্ত! লিলি এইবার ভালপারাইসোর সাহায্যে একটা কুকুরকে তুলে কেটলিতে ছুঁড়ে ফেলল আর ভালপারাইসোকে ইশারায় বলল –“এমন ভাবে চিৎকার করো যাতে বুড়ো ভাবে এই কেটলিতে তোমাকেই ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে!”

এই বলে অন্য কেটলিটাতেও দ্বিতীয় কুকুরটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে লিলি নিজেও মরণাপন্ন মানুষের মতো আর্ত চিৎকার করে উঠল!

এদিকে, সত্যি বলতে কী, বুড়ো বারবাবের নেশাটা সত্যি আজ রাতে একটু বেশিই হয়ে গিয়েছে। এতটাই যে, তার এখন আর নড়াচড়ার ক্ষমতাটুকুও নেই। এই মুহূর্তে নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভালপারাইসো আর লিলির আর্ত চিৎকার শুনতে শুনতে নিষ্ঠুর হাসি হাসল বুড়ো। যাক, দুই মিথ্যেবাদীর উচিৎ সাজা হয়েছে! এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হল বুড়ো বারবাব, তারপর নিজের অজান্তেই এক গভীর ঘুমের ঘোরে তলিয়ে গেল…

আর অন্যদিকে, লিলি আর ভালপারাইসো দুজনেই অপেক্ষা করেছিল এই মুহূর্তটার জন্য। বুড়ো বারবাবের ঘুম এখন আর সহজে ভাঙবে না বুঝতে পেরেই লিলি নিঃশব্দে উঠে এল উপরে। এই বাড়ির চাবি বুড়ো কোথায় রাখে তা লিলি জানত, তাই সুযোগ বুঝে সেই চাবির গোছা নিয়ে বুড়োর সিন্দুক খুলে টাকাপয়সা, গয়নাগাঁটি সব নিয়ে দুটো ব্যাগে পুরে ফেলল। তারপর দুইজনে আস্তাবলে গিয়ে বুড়োর সবচেয়ে সেরা, সবচেয়ে দ্রুতগামী, সবচেয়ে ভাল, সাদা হোয়াইটির পিঠে চেপে বসে টগবগিয়ে ঘোড়া ছোটাল এক অজানাপুরীর দিকে…!

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

2 thoughts on “onubad-val-paraiso

  1. চমৎকার লোককথা। ধন্যবাদ রাখী এমন সুন্দর গল্প পড়ানোর জন্য।

  2. লিল সিস, সেই কবে থেকে তোমার গল্প পড়ে আসছি। আজকের গল্পটা পড়ে যেন শৈশব ফিরে পেলাম। খুব ভাল লেগেছে। লিখে যাও।
    পার্থ রায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *