অসীম সাহা

অসীম সাহা
+প্রতিবন্ধকতা


আষাঢ়ের প্রবল বর্ষণে ভেসে যাবে সমগ্র পৃথিবী —
এই ভেবে বিরহী যক্ষের মত যখন আকাশের দিকে
আকুল নয়নে তাকিয়ে রয়েছি, তখন আমাকে বিস্মিত
করে সজল-সঘন কালো মেঘ কখন যে অসভ্য ছেলের
মত চোখ ঠেরে মুহূর্তে উধাও হয়ে গেছে — আমি তা টেরও পাইনি।
তার মানে এখন আর মেঘলা-ধূসর আকাশের কোনো
অস্তিত্ব নেই — তার বদলে প্রকৃতিকে গৃহবন্দী করে
সে এখন খোশমেজাজে যত্রতত্র ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াচ্ছে।

অথচ কথা ছিল, বাদল-বরিষণে তুমি এসে বসে থাকবে
কদমতলায়, আর আমি একটি হৃদয়ের ব্যাকুল বাঁশির সুর
শুনতে পাই বা না পাই, ঝড় ও বৃষ্টির জল উপেক্ষা করে
আমার পদ্ম-কোমল পা দুটো চেপে-চেপে নিজের রক্তের
ভেতর দিয়ে প্রবল প্রত্যাশা নিয়ে ছুটে আসবো তোমার কাছে।
কিন্তু আষাঢ়ের প্রকৃতি হঠাৎ এমন করে বেয়াড়া হয়ে উঠবে,
কে তা জানতো? বর্ষাও যে কখনো কখনো এমন বেরসিক আচরণ
করতে পারে, জীবনে এই প্রথম আমি তা প্রত্যক্ষ করলাম।

অতএব কী আর করা? আবার নতুন দিনের প্রতীক্ষা ছাড়া
তোমার কিংবা আমার আর তো কিছুই করার নেই।
তাই এসো, এই অলস ও উদাস অবসরে উভয়ে উভয়কে
বহফোনে এমন কিছু বার্তা পাঠাই, যাতে প্রবল বর্ষণের
মধ্যে যে ভয়ংকর বজ্রপাত হয়, আর তাতে কেঁপে ওঠে
সহজ হৃদয়, তেমনি করে শিহরণের ছোঁয়া লেগে
দু’জনেই কেঁপে উঠি, আর তুমি যেন আমাকে কিছুতেই
ভুল বুঝে বাঁশির সুর থামিয়ে দিতে না পারো — অন্তত
যেন বুঝতে পারো, সত্যিই আমি পায়ে কাঁটা বিঁধিয়ে,
আমার কোমল দুটি পা টিপে টিপে, দুর্গম পিচ্ছিল পথ
পেরিয়ে তোমার দিকেই ছুটে আসতে চেয়েছিলাম,
তা যেন সত্যিই আমি তোমার কাছে প্রমাণ করতে পারি।

কিন্তু তুমিই বলো, প্রকৃতি যদি আমাদের সহায় না হয়, তা হলে
ইচ্ছে থাকলেও আয়ান-ঘরণী হয়ে আমি কেমন করে
প্রকাশ্য দিবালোকে তোমার দিকে আকুল হৃদয়ে ছুটে আসতে পারি?
তুমি যদি কৃষ্ণ না হয়ে আমার হাতে তুলে দিতে তোমার
মর্মহরণকারী বাঁশি, তা হলে তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারতে,
অবরুদ্ধ সংসারের প্রজাপতি-জাল ছিন্ন করে তোমার কাছে ছুটে
যেতে গিয়ে আমাকে কতোটা কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছে!

তাই বলছি, প্রয়োজনে তোমার চোখের জলে আমাকে ভাসিয়ে দাও,
তবু গোমড়া আকাশের মতো অমন মুখ ভার করে বসে থেকো না।
তুমি যদি আমার ওপর অমন অভিমান করে বসে থাকো,
তাহলে আমি বলবো, ‘এ জন্মেই কৃষ্ণ না হয়ে তুমি অন্তত একবার
আয়ান-ঘরণী হয়ে দেখো, কাজটা সত্যি সত্যিই অতটা সহজ নয়’ !

+টান


পথ দিয়ে যেতে থাকি — পাশ থেকে ডাক দেয় লতা:
” একটু দাঁড়াও ভাই, কথা আছে, কথা। ”
ডাক শুনে থমকে দাঁড়াই
লতার পরশ এসে বুকে লাগে — নাকে তার ঘ্রাণ টের পাই।
দুই চোখে নেমে আসে ঘুম
চরাচরে স্তব্ধতা — শুনশান, নীরব-নিঝুম।
তার মাঝে দিগন্তে উড়ে যায় পাখিদের দল
বাতাসের ঢেউয়ের ভেতরে ডানা শুধু চঞ্চল
ফিরে যায় নীড়ে;
পাখিদের ভিড়ে
একটি ধূসর চিল দেয়ালচিত্রের মতো হয়ে থাকে স্থির;
যেন সে নিবিড়
নীলিমায় বলে যায় করুণ সংলাপ
পথ দিয়ে যেতে যেতে বাড়ে মনস্তাপ।

ক্রমে ক্রমে ফুটে ওঠে হলুদ সকাল;
শুধু গতকাল
যা কিছু পুরনো ছিলো, যা ছিলো অতীত
ভোরের সূর্য এসে ভেঙে দিয়ে যায় তার ভিত।

প্রতিভাত হয়ে ওঠে শুধু বর্তমান
তার মাঝে পেতে থাকি কান:
শুনতে পাই পাখিদের কলরোল, কোকিলের ডাক
যা কিছু অবাক,
যা কিছু বিস্ময় আর যা কিছু সুন্দর —
চোখ মেলে আমি তাকে চেয়ে দেখি, চেয়ে দেখি পাখিদের ঘর।
শূন্য আকাশপানে উদাসীন চেয়ে থাকি একা
যা কিছু দেখতে চাই — হয় না তো দেখা;
ডাক দেয় অচেনা, অজানা কোনো পাখি
চমকে তাকিয়ে আমি থাকি
পথের কিনারে — যেন কোনো নির্বাক গাছ
অন্ধকারে মমতার মতো তারা দেখাবেই নাচ।

+প্রাথর্না


চোখ মেলে চেয়ে দেখি, সফেদ পোশাক পরে মেঘ-বালকের দোল
গোলছুট খেলছে আকাশে — কোথাও কোনো প্রতিপক্ষ নেই,
নেই কোনো খেলোয়াড়, শুধু চিরঞ্জীব বাঁশি হাতে দুঃসাহসী
মেঘনাদ রেফারীর প্রস্তুতি নিয়ে ছুতে যাচ্ছে এদিক-ওদিকে।
তাই দেখে মেঘ বালকের দল আনন্দ ও উল্লাসে নৃত্য করছে
দিগন্তের বিশাল প্রান্তরে — আর তখনই পেঁজা তুলোর মতো
মেঘের হরিণগুলো কখন প্রান্তর ছেড়ে চলে গেছে উদাসী
হাওয়ায়, অসংখ্য সতর্ক চোখও সে সবের কিছুই দেখেনি।

এখন সেই আকাশের মাঠখানি খালি পড়ে আছে, মেঘনাদও
বাঁশি রেখে চলে গেছে যজ্ঞাগারে তার — মেঘ-বালকের দল
করুণ-কাতর চোখে দিগন্তের সীমানায় তাকিয়ে রয়েছে।
বিস্ময় ঝরে পড়ছে অসংখ্য দর্শকের বিস্ফারিত চোখে।
এ কেমন আশ্চর্য খেলা, এ কেমন দুর্দান্ত ম্যাজিক —
কথা নেই-বার্তা নেই, কাউকে কিছু না জানিয়ে পৃথিবীকে
তুমুল জলের উচ্ছ্বাসে ভিজিয়ে দেয়ার বদলে তারা এখন উত্তপ্ত
হওয়ার স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিচ্ছে পৃথিবীর উদাসী হওয়ায় !

আষাঢ় বদলে গেছে, শ্রাবণেরও কোনো গান নাই, ধ্রুপদ –
ধামার নেই, এমনকি বজ্রের হুংকারে আকাশ বিদীর্ণ করে
পৃথিবীতে নেমে আসা নেই। বরুণ পালিয়ে গেছে বঙ্গভূমি ছেড়ে,
বনে বনে দাবদাহ, পরিত্যক্ত পড়ে আছে ফসলবিহীন মাঠ,
তারই মাঝে তানসেন একটানা গেয়ে যাচ্ছে বর্ষার
আগমনী গান — তার সুরে কেঁপে উঠছে, গাছপালা, সমুদ্র, পর্বত।

সে সময়েই হিমালয় পার হয়ে বরফের পিন্ডগুলো মর্ত্যভূমিতে
নেমে পথে পথে বিছিয়ে রেখেছে শত কর্তিত গাছ — অতএব
আর কখনো ফিরে আসবে না মেঘনাদ, নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে
বিভীষণ ঢুকে গেছে বিশ্বাসঘাতকের বেশে অযোধ্যার রাজপুত্র সাথে,
নিরস্ত্র মেঘনাদ নিরুপায় মরে গেছে প্রাথর্নার কালে।

এই পাপ জমেছে আকাশে, তাই উচ্ছ্বসিত বৃষ্টির বদলে
মাঝআকাশে দেখা যাচ্ছে গোলাকার অগ্নিকুন্ড, সূর্যদেব
হাঁটু গেড়ে বসেছে সেখানে। তারই তাপে দগ্ধদেহে
তৃষ্ণার্ত মানুষেরা ছুতে যাচ্ছে গঙ্গোত্রীর দিকে।
সেখানেও জল নেই, সেখানেও সব জল টুকরো টুকরো
বরফের পিন্ড হয়ে গেছে, জমে আছে চাপ চাপ রক্তের দাগ,
তারই ভেতর থেকে সচ্ছতোয়া জলধারা ফিরিয়ে আনার আগে
মৃত্যু হচ্ছে মানুষের বেদনায় আপ্লুত মহারাজ অংশুমানের।

অতএব আর কোন পথ নেই — মেঘহীন, বৃষ্টিহীন দিগন্তের
বাঁকে বাঁকে টুকরো টুকরো বরফের সন্ধানে ছুটে যাচ্ছে লক্ষ-কোটি
তৃষ্ণার্ত মানুষ। এ মুহূর্তে মেঘ-বালকের দোল সবকিছু ফেলে রেখে
ফায়ার যাচ্ছে যার যার ঘরে, আর প্রকৃতিই দুর্দান্ত আক্রোশে মাথা নেড়ে
দাবদাহ ভেদ করে ছুটে যাচ্ছে গঙ্গার তীরে, ছুটে যাচ্ছে পর্বতের পাদদেশে,
হিমালয় অভিমুখে বহমান ঝরনার খোঁজে। অথচ কোথাও ঝরনা নেই,
নেই কোন জল — তা হলে এ আষাঢ়-শ্রাবণে মানুষেরা ছুটবে কোথায়?
এই প্রশ্নে পৃথিবীও নির্বাক চোখ মেলে শূন্যতায় তাকিয়ে রয়েছে।
অতএব এখন প্রাথর্না ছাড়া তোমাদের কাছে আর অন্য কোনো পথ
খোলা নেই। তাই বলি, এক্ষুনি, এ মুহূর্তে সকলেই প্রাথর্নায় নতজানু হও,
ক্ষমা চাও বৃক্ষের কাছে, ক্ষমা চাও প্রকৃতির কাছে, সমস্বরে বলো,
” হে উদার, হে মহৎ, আবার আগের মতো সূর্যকে দূরে ঠেলে
মেঘেদের যুবতীকে গর্ভবতী করো — পৃথিবীকে পুনর্বার উপহার দাও
এক বৃষ্টির নতুন দেবতা, যেন তার আশীর্বাদে পৃথিবীর সবকিছু জলে
ভিজে যায়, মেঘেদের হল্লার ভেতর থেকে মানুষেরা যেন পায় বৃষ্টির পবিত্র জল।
পৃথিবী আবার যেন জেগে ওঠে আষাঢ় ও শ্রাবণের নবধারাজলে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *