কবিতা সমগ্র

তোমার সর্ব-অঙ্গ থেকে টুপটাপ তারা ঝরে পড়ে যখন,
আমার দিকে একবারও না তাকিয়ে, এগিয়ে যাও।
হেঁটে পার হও দ্বীপ, উপদ্বীপ…
তোমার গা থেকে নেমে আসা তারারা ছড়িয়ে পড়ে
পথে-জলস্রোতে।
আমাদের সেতুতে ওরা জ্বলে সারাক্ষণ
আমি নিয়মিত ফুলগাছ লাগাই সেখানে
তোমার চোখেও পড়ে না ফুটন্ত ফুল ও পত্রাবলী !
তুমি একান্তে ফোন দেখো
আলো দেখো
পাখির জন্যে হন্যে হয়ে নাম দেখো
আমার দিন যায় তোমাকে না-পেয়ে
তুমিও খোঁজো না আমাকে
আহুতি-সম্ভব প্রাণ নাও না তুমি
আমিও ভুলে যাই রাহুদোষ, গ্রহণের কাল।
তোমার তারারা চুমু খেতে আসে আমার পাড়ায়…

+কবিতা ও আমি কাজী জহিরুল ইসলাম

কবিতা আমাকে লিখে রাখে
কালের খাতায়
হেমন্তের ধূসর পাতায়
সে আমাকে সবুজ-গহনে আঁকে…
এখনো বোঝোনি তুমি সারারাত আমাকে জাগিয়ে রাখে কোন পরী
সাধ্য কী আমার লিখি তার নখের আঁচড়
কুন্তল কবরী
পৃথিবী পাবে না বুঝি কলিকাল পার হয়ে আবার দাপর?
সেই যুগে খুলে খুলে
আমাকে পড়বে ওরা,
বাতাসের এলোচুলে
গাছের শাখায় দুলে দুলে
গাইবে আমার
প্রেমানুভূতিপ্রবণ অপাপবিদ্ধ হৃদয়।
আমাকে লিখছে রোজ প্রেমহীন কবিতার বিষণ্ণ বিস্ময়;
মানুষের ভিড় থেকে কে আমাকে তুলে আনে,
কে আমাকে সাজায় রঙিন অক্ষরের বর্ণবিভায়,
ভবিষ্যপথযাত্রী বাতাসের কানে কানে
যে শ্লোক পঠিত হয় সূর্যপ্রণামে, শ্রদ্ধায়…
কে সে আমি ছাড়া
আমি এই বহমান পৃথিবীর অন্ধকার স্রোতধারা।
হলিসউড, নিউ ইয়র্ক। ৩০ জুলাই ২০১৯।

+আকাঙ্ক্ষার পিলসুজ জেগে থাকে আমরন উদয় শংকর দুর্জয়

ব্রাউনিশ মেঘফুল টানিয়ে রাখা দেয়াল থেকে উড়ে যায় শীতপ্রবাহের পাখি সমগ্র।
এখনো ট্রোগোনের সেইসব বৈঠকী বেহালায়, রোদ্দুর পুড়ে যায় অনাদরে। আর্য-অনার্য
খেলা শেষ হলে সত্যযুগের নদী-কল্লোল থেকে উঠে আসে পাতার প্রবাহ। আর যারা
খোঁজে অপাতিজা শহরের পালক মোড়া শতাব্দী, তাদের জন্য জমা থাক
ইউকা মাউণ্টেনের জমাট নিস্তব্ধতা আর সামুদ্রিক পৃষ্ঠা থেকে জ্বলে ওঠা আলোক তরঙ্গ।
এরোমেটিকা থেকে যতবার হারানোর সুগন্ধী খুলে দিয়েছে বুকের নকশী বোতাম,
ততবার গৃহত্যাগী অক্ষিগোলক পড়ে নিয়েছে জাহাজের কম্পাস। ওয়াইল্ড ফায়ারে
নিভে যাওয়া সেসব ফায়ারপ্লেসের আগুন, চুপচাপ আকাঙ্ক্ষার পিলসুজ
লুকিয়ে রাখে। লুকিয়ে রাখে ভাংগনের কক্ষপথে লেখা পতনের অতৃপ্ত সংসার।
এখন ট্রোজান-অশ্বপালের গল্প শুনতে শুনতে নিঃসঙ্গ প্লানেট খুলে বসে ছায়া পথের
অরণ্যদিন। মন সেই কবে ছেড়ে গ্যাছে ছায়াকাশের কার্নিভাল তবু ব্র‍্যাক আইল্যান্ডের
সেইসব জীবন্ত জল শুয়ে থাকে নিস্তব্ধতা পুষে। ভেতর দেয়াল যতটা নকশা পালটে গেথে রাখে।

+ছাড়া পোশাকের ভাঁজে ঋজুরেখ চক্রবর্তী

ছাড়া পোশাকের ভাঁজে
চোরা চাহনির মতো কখনও কখনও
কারুর হাতের ছাপ থেকে যায়।
আমাদের মায়াজন্মে এইসব মাদকতা মহার্ঘ সঞ্চয়─
এইসব অনাবিল পাপ,
দিনগত ক্ষয় নেই যার,
নেই যার মহনীয়তার কোনও গূঢ়ার্থ গরিমা,
ব্যাহত ব্যাখ্যার বিষে সচেতনতার ক্ষোভও নেই;
শুধু এক আত্মগত বিহ্বলতা আছে,
আর আছে ক্রমশ অভ্যস্ত হতে হতে
নিকট নিকটতর নক্ষত্রের আয়ুর আধার হতে পারা,
যে আধার সহজ সত্যের মতো অখণ্ড অলীক অবিরল।
ছাড়া পোশাকের ভাঁজে
গোপন স্পর্শের মতো কখনও কখনও
থেকে যায় কারুর দৃষ্টির গহীনতা।

+নিঃসঙ্গ নদীছায়া শিহাব শাহরিয়ার

অর্ধ-মৃত পিঁপড়ার মতো শুয়ে থেকে রাস্তার তে-মাথায় দেখি নিঃসঙ্গ এক নদীছায়াকে এই নদীছায়া কাকের সাথে মিলেছিল মধ্যরাতের মল্লযুধ্যে অথচ এই যুদ্ধ হওয়ার কথা ছিল-আমার নাসিকার সাথে তোমার স্তনের অগ্রভাগের; এরপর মৌসুমের পরিবর্তনকে মনে হলো-কিশোরীর দুঃসময়; ঋতুস্রাব ঋতুস্রাব শেষে কিশোরী-নারীরা ওড়না উড়িয়ে দেয় যেন নক্ষত্রের দিকে। জয় হোক বাঁলিহাঁসের-কারণ তাদের ঠোঁটে ঠোঁটে ভারী হয়েছিল নদী-স্রোত। অথচ কিনারের ঘাসগুলি শুধুই সন্ধ্যার নিঃসঙ্গ ডানা। মেঘের মুখে বরফ এঁকে দিয়ে চলো আমরা হুগলির ঝুলন্ত সেতু হয়ে যাই… আমি কী পারবো লেবানিজ নারীদের শরীরের সিঁড়ি ভাঙতে?

+ফেলে আসা মুহূর্তের কথা শ্যামশ্রী রায় কর্মকার

এখন বিকেল শেষ প্রায়
কয়েকটি তরুণ বক কচুরিপানার গায়ে
বসে আছে নাতিদীর্ঘ কবিতার মতো,
অনিঃশেষ ছায়া ফেলছে মৎস্যকন্যাদের শরীরে,
উদাসীন ঠোঁটের আড়ালে
ঢেকে রাখছে ক্ষুৎচিহ্ন,লোভের রক্তিম
মনখারাপের উরু বেয়ে নেমে আসা সূর্যাস্তের আলো
বাঁক নিয়ে চলে যাচ্ছে পুরনো গানের দিকে
সংসারের দানা মুখে ফিরে আসছে গৃহস্থ পাখিরা
সাইকেল রিকশা থেকে উড়ে যাওয়া নক্ষত্র আঁচল
স্বহস্তে বিলিয়ে দিলো প্রায়সন্ধ্যার কিছু অলৌকিক গুঁড়ো
আমার হাতের পাতা জুড়ে
এইসব আলোছায়া, মোহ-দ্বেষ, জন্ম-মৃত্যু দাগ
প্রেমিকার ওড়নার নিখিল থেকে মুখ তুলে তুমি তাকাতেই
বেজে উঠলো অলৌকিক গং
শূন্যতা ছড়িয়ে গেলো দিকচক্রবালে
আমার অতীতপৃষ্ঠা মুক্তো হয়ে গ্যাছে, শরীর ঝিনুক
আমাদের মাঝখানে স্মৃতিভষ্ট হয়ে যাওয়া ঘাস
ছেড়ে আসা মধুকর, চাঁদের যৌবন
তোমার সোনালি গ্রীবাদেশ
সমস্ত অতৃপ্ত শব্দ সেখানেই থমকে আছে, এগোতে পারেনি

+স্বগতোক্তি সুধীর দত্ত

এই তবে শেষ কথা,
কথাদের সারা গায়ে অভ্যাসের চিহ্ন লেগে আছে।
চলো তবে কথাপারে, নিজেদের মুখোমুখি বসি,
যেখানে চুপঘর আছে,
পরস্পরের দিকে দুটো পাখি নিঃশব্দে তাকিয়ে রয়েছে।
ওই তো কাঙাল এক পাখি
ডানা ঝেড়ে এইমাত্র ঠুকরে খেল পিপ্পলের শাঁস।
আর ডালে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো
কী রকম ভেঙে পড়ছে দেখতে দেখতে
ভাসিয়েছি হাওয়ায় পালক।
নিরস্তকুহক, সারা গায়ে
সুনিবিড় ভালোবাসা আরও।
মিথ্যার ধূসর দেশে মাপা চালে পা-তোলা ও পা-ফেলার শব্দ শোনা যায়।
বাদুড় ও পাখিগুলো ডানা ঝাপটে উড়ে যায় মেগালিথ পাথরচূড়ায়।
সমঝোতা এক্সপ্রেসের মতো
আমাদের শব্দগুলি ঢুকে পড়ছে ক্রমাগত মেঘেদের অন্ধগলিপথে।
ওখানে চড়ুইভাতি হবে?
দ্বৈত আর অদ্বৈতের ঢের কথা হল।
এবার দাঁড়াই মুখোমুখি।
লুকনো বরফও গলে যায়,
গলে যায় চৌম্বক প্রবাহ, তার তড়িৎমোক্ষণ। বলি এসো,
বিম্ব হই, মায়াকাচ ভাঙি।

বড্ডো গুমোট কদিন
ফ্যানের হাওয়া গায়ে লাগছে না
বস্তাবোঝাই ট্রাক, মিনিবাসের যাত্রী
সবাই দাঁড়িয়ে ।
নদীর হা-কঙ্কাল সার
শেষ বিকেলে পাঁজরে বাতাস লাগলে
চিক চিক করে ওঠে বালি
ঠিকরে বেরিয়ে আসে
ছেঁড়া জুতো, প্লাষ্টিক ব্যাগের জরা।
হয়তো চাঁদের উত্তর গোলার্ধে
বইছে টলটলে সকাল,
হয়তো কেউ ভাঙছে তালা,
সাদা চুনকামের নিচে
আবঝা হয়ে আসছে দেয়াললিখন,
সেই গতবারের দেবীপক্ষে বন্ধ হয়েছিল
আমাদের চটকল,
তবু আজও কেমন যেন সচল
আগাছায় সরে সরে যায় সরীসৃপের প্রবাহ ..


মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে গেলে
আমি ভগবানকে ডাকি–“ভগবান?
ভগবান? ও ভগবান?”
আমি ডাকি তাঁকে, শিশুরা যেমন
নামের নেশায় ডাকে মাকে।
আমি ডাকের উত্তর না পেয়ে ভাবি,
ভগবান কি আমাকে চেনেন?
তিনি কি বোঝেন আমার ভাষা?
আস্তিক আর নাস্তিক সংকটে
এ-ও এক বড়ো প্রশ্ন বটে।
কে জানে? আমি কোন ছার?
ভগবান নিজেই কি জানেন–
তিনি কে?
তিনি কী?
তিনি কার?
আমি তো দেখিনি কোনোদিন
ভগবান দেখতে কেমন।
মানুষের নাম কি
মানুষের গায়ে লেখা থাকে?
অথবা ফুলের নাম ফুলের পরাগে?
না, থাকে না। না, থাকে না।
তাই, এমনও তো হতে পারে,
আমি তাঁরে দেখেও চিনিনি।
অন্য-কেউ, অন্য-কিছু ভেবে
আমি তাঁরে পাশ কেটে
গিয়েছি এড়িয়ে।
মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে, পৃথিবীতে এসে
কোনো দৈবদুর্বিপাকে বিচ্ছিন্ন সন্তান
কীভাবে চিনবে তার জনক-জননীকে?
জনক-জননীইবা চিনবে কী ক’রে,
তাদের সন্তান যদি ক্রমে-ক্রমে বড় হয়
আদরে বা অনাদরে, অন্য কারও ঘরে?
মনে হয় আমার হয়েছে সেই দশা।
ভগবানও চিনেন না আমারে।
আমিও চিনি না তাঁরে।
এভাবেই পৃথিবীটা স্থির হয়ে ছিলো।
আজ রাতে কী যে হলো?
মনে হলো আমি তাঁরে দেখেছি সহসা।

নয়াগাঁও
২৬/০৫/১৯

+আঁধারশীলা পিয়াস মজিদ

আঁধার-
কৃষ্ণজাতিকা

আঁধারই আমার সাজবাহার

আলো-

তুমি অন্ধকার হলে গন্ধরাজ,

সে আঁধার অধিক আলোর

আঁধার-

তুমি দিবাবতী

আমি সন্ধ্যার সওয়ারি

আলো-

উজিয়ে তোমার কালো বীণাপাহাড়

জমা আছে যা কিছু বলার আমার

আঁধার-

তোমার গীতবাস্তবে

আমার স্বপ্নও মেলায় অসুরে

আলো-

তবু কেন টের পাই স্পর্শের স্পর্শ!

অন্ধের স্পর্শের মতো…

আঁধার-

সব অন্ধকার ফুলগাছ

আমার জীবন তোমার

মরণের অনুপ্রাস

আলো-

শূন্য সব আমার

তবু তুমি

শূন্যের কৃষ্ণতায় ভরাট

আঁধার-

আলো আসবেই

দিকে দিকে

বৃদ্ধ মৃত্যুরও চলে নবীনবরণ

আলো-

এসো আঁধার এসো

জাগিয়ে জাও জীবন কালকৃষ্ণ…

+স্পর্শে যত প্রেম আসে রুদ্রশংকর

স্পর্শে যত প্রেম আসে, তত বিক্ষোভ আসে মনে
কিছু ইচ্ছে স্মৃতি হয় চেনা আর অচেনা জীবনে

একশ বার প্রেমে পড়ি যেমন গায়ে পড়ে লোক

এতে যদি ভুল থাকে, তীব্র সমালোচনা হোক

প্রতিটি মুহূর্ত নিয়ে বাঁচি, প্রতিটি মুহূর্তে ভাঙে দল

এটুকু কবিতা হয়ে আসে, আমার এটুকুই সম্বল!

+সাদা সোফা আর দোল রং তাপস কুমার রায়

সাদা সোফা কেনার পর থেকে
আমার আর দোল খেলা হয়না

কোনোদিন আগ বাড়িয়ে কাউকে

রং মাখিয়েছি মনেও পড়েনা

তবে তুমি আমায় মাখাতে এলে

তোমার শরীর আমি ক্যানভাস ভেবে

শিল্পীর নিমগ্নতায় রং লেপে দিয়েছি

ঠিক যেখানে যেমন পেরেছি।

facebook-এ এতো রঙিন ছবি দেখে এখন

ফাঁকা লাগে; জলসাঘরের জমিদারের মতো

সাদা সোফায় গিয়ে বসি। দামি সোফার ওম

নিতে নিতে নিজেকে

রাবণের সভায় হনুমান ভাবি।

গ্রে ইন্টেরিয়র, শুকনো কাঠের আসবাব,

হরিণের মৃত শিং – প্রাণহীন নিথর চারপাশ

আর ঢাউস কাঁচের জানালার ওপাশে

এক বসন্ত বৌড়ি হঠাৎ থেমে আমাকে দেখে

ভাবে; -পাথর-মানুষ শিব সেজে

কণ্ঠে করেছি গরল ধারণ।

আসলেই আমার সাদা সোফায় রং লাগানো বারণ।



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Copyright © 2023 অপারবাংলা