আমি কালীর দিকে তাকালে মস্তিষ্কে মধ্যযুগের বর্বরতা এসে ঘর বাঁধে, আর কালী আমার দিকে তাকালে রাশি রাশি মেঘের মধ্যে দেখতে পাই চেনা অচেনা মেয়েদের অফুরন্ত জেগে ওঠা। ছোটবেলায় আ-সমুদ্র পাওনার লম্বা ফিরিস্তি নিয়ে যখন কালীর কাছে যেতাম; তার রক্তে ভেজা কঠিন জিভ, গলায় পরাজিত পৃথিবীর অন্ধকার মাথা দেখে মানুষের জল-দেখা ভয় হতো আমার … সেবার যখন যুদ্ধে-হারা সৈনিকের কাটা মাথা নিয়ে উল্লাস করেছিল প্রতিপক্ষ; সমস্ত সংবাদপত্রে উঠেছিল প্রতিবাদের ঢেউ, পাড়ার অতি সামান্য গলি, তার অতি সামান্য চায়ের দোকানে উঠেছিল প্রাসঙ্গিক ঝড়। স্কুল জীবনে যে মেয়েটি মেঘ-কালো ত্বকের সৌন্দর্য নিয়ে ঘুরে বেড়াত তাকে মুহুর্তের তাচ্ছিল্যে কালী বলে ডাকত বন্ধুরা। সেই অসহায় অসতর্ক অবস্থায় আমি প্রথম বর্ণবাদের ব্যাকরণ শিখেছি। যতটা জ্ঞানী হলে নিজেকে মানুষ বলা যায় ততটা হতে পারিনি আমি, তবু কোন এক বিশাল গাছের নিচে দাঁড়ালে তার ছায়ায় মানুষের মুখ দেখি। জীবন ও জীবনের অর্থ নিয়ে কাটাকুটি খেলতে গিয়ে কোন বর্বরতা নয়, কোন ছদ্ম-আধুনিকতা নয় পৃথিবীর প্রতি ঘরে আলো জ্বলুক, প্রতি ঘরে মেয়েরা মানুষ হোক।
আজকাল পুরনো দুঃখগুলো ফিরে আসে সুখের মতন। সেই মুখোমুখি সময়ে আমার সঙ্গে যেসব মানুষ ভাইয়েরা দু’পায়ে হাঁটতে শিখেছিল তারা এখন বন জঙ্গল ছেড়ে নিজেদের আকাঙ্ক্ষার বাড়িতে বাস করে। নিজেদের তৈরি উজ্জ্বল ঈশ্বর ও ধর্ম নিয়ে বোবা কালা অন্ধকারে নিজের প্রজাতির সঙ্গে মারামারি করে তারা। মাঝে মধ্যে লজ্জা হয়, মাঝে মধ্যে অচেনা ভয় আসে আমার, এখনো আধুনিক মানুষের শরীরে উল্লাসের অভিমানে ঘুমোয় আমার থেকে ছিটকে যাওয়া অসংখ্য জিন। আমার যৌবনে আমি যতদূর লাফিয়েছি, খাবারের খোঁজে যতদূর দৌড়াতে হয়েছে আমায়, ঠিক ততদূর স্নায়ুতন্ত্রে কবরের মতো ঢুকে গেছে চ্যাপ্টা পৃথিবী। প্রতিদিন গোলাপিয়া লাল চোখে দেখতাম ছাদের মতো আকাশের কিনারা ধরে হাঁটছে প্রকৃতির আশ্চর্য আলো নিয়ম করে পূর্ব দিকে ওঠে আবার নিয়ম করে পশ্চিম আকাশে ক্লান্তি লুকোয়, বিশ্রাম নেয়। এ’সব কথা আমি বলে যাইনি, লিখে যাইনি কোথাও কারণ আমার কাছে বলার মতো কোন ভাষা, লেখার মতো কোন অক্ষর ছিল না। তার জন্য আমার কোন পলাতক দুঃখ নেই, কোন অভিমান নেই; আমার এই ভুল ধারণাগুলো সযত্নে লিখে রেখেছে সমস্ত ধর্মগ্রন্থ। তবু মানুষের অজ্ঞতা দেখে আমি অবাক হই, আমাকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে ভারতীয় উপমহাদেশের ঈশ্বর চার বর্ণের মানুষ বানালেন, আরব উপত্যকার ঈশ্বর আদম থেকে তৈরি করলেন আদমি। বলো, এই বিপুল মূর্খতার পুঁজ আর কত উপেক্ষা করতে পারি! আর কতদূর গেলে মানুষের বিবর্তন স্বীকার করবে মানুষ!
দিন দিন বাড়ে ঘরবন্দীর খেলা দিন দিন বাড়ে ভাইরাস রাস্তায় বেঁচে থাকা মানে কান্না মর্মভেদী আমাদের বাঁচা উত্তাল হতাশায় কি জানি, কি হবে ছাড়াছাড়ি যদি হয়! ভালোবাসা ভাঙে চিরজন্মের আড়ি বলতো আমার কতটুকু জুড়ে আছো? কতটুকু হলে চলে কারফিউ জারি? আমাদের নেই দিন ও রাতের মানে কালের ব্যাধিরা চেপে ধরে ফুসফুস আমাদের হাতে নেমে আসে নীরবতা গ্রামে ও শহরে ধূসর মহিলা পুরুষ লোকজন নেই গির্জায় প্যাগোডায় লোকজন নেই মন্দিরে মসজিদে চারদিকে ওড়ে বয়সের কথকথা গড়াগড়ি খায় গরিব লোকের খিদে এখনো মানুষ বিপদের দিন গোনে দিন শেষে তার থাকবে না মহামারী দু’দিকে আমার দুই জীবনের প্রেম দু’পাশে আমার দুই জীবনের বাড়ি।
Superb
সতেজ ৩খানি কবিতা পড়ার সুযোগ হলো। খুব ভালো লাগলো।
খুব ভালো কবিতা। জীবন ও জগৎ খুঁজে পাওয়া যায় রুদ্র শংকরের এমন সব কবিতায়।