বেহদিয়েনখ্লম উৎসব – জৈন্তিয়া জনজাতির রথযাত্রা
রাখি পুরকায়স্থ

উত্তর-পূর্ব ভারতে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এক পাহাড়ি রাজ্য মেঘালয়। সেখানে পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘ ভাসানো নীল আকাশের চাঁদোয়ার নীচে টিয়া-সবুজ রঙের পাহাড়ের সারি। সেই পাহাড়ি ঢালে সাজানো কাঠের ঘরবাড়ি ও জুম চাষক্ষেত্র। চারিপাশে মনমুগ্ধকর নিবিড় সবুজ পাইনের বনভূমি, কুয়াশাবৃত উপত্যকা, সুনীল স্বচ্ছ হ্রদ, চূনাপাথরের গভীর গুহা, প্রাণচঞ্চল বন্যপ্রাণীর দল – সব মিলিয়ে মেঘে ঢাকা মেঘালয়ের নৈসর্গিক রূপ-প্রাচুর্য আমাদের মন কেড়ে নেয় বার বার। তাই ‘মেঘেদের বাড়ি’ মেঘালয় কবিদের অনুপ্রেরণাদায়ী এক অলীক কাব্যজগৎ কিংবা চিত্রকরদের ক্যানভাসে ফুটে ওঠা সবুজ-নীল জলরঙে আঁকা এক ধ্রুপদি ছবি। তবে কেবল মনমোহিনী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই নয়, মেঘালয়ে বসবাসকারী বৈচিত্রময় জনজাতিদের ঐতিহ্যমণ্ডিত সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনও যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক।
মেঘালয়ের বহুবিধ বর্ণময় লোক উৎসবের ভিড়ে জৈন্তিয়া জনজাতির, বিশেষত নার সম্প্রদায়ের, বেহদিয়েনখ্লম উৎসব একটি অত্যন্ত ধর্মীয় তাৎপর্যপূর্ণ ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ বার্ষিক সামাজিক উদযাপন রূপে জাজ্বল্যমান। তবে কেবলমাত্র আনন্দ-উচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী উৎসব বলেই নয়, বেহদিয়েনখ্লম উৎসবের তাৎপর্য লুকিয়ে রয়েছে জৈন্তিয়া জনজাতির আধ্যাত্মিক বিশ্বাস, কৃষিভিত্তিক জীবনচর্যা এবং প্রকৃতির সঙ্গে তাঁদের গভীর সংযোগের প্রগাঢ় ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশে।
‘বেহদিয়েনখ্লম’ নামের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এই উৎসবের মূল উদ্দেশ্য। নার ভাষার দুটি শব্দ ‘বেহদিয়েন’ এবং ‘খ্লম’ থেকে ‘বেহদিয়েনখ্লম’ শব্দটির উৎপত্তি। ‘বেহদিয়েন’ অর্থ ‘বিদায় বা দূর করে দেওয়া’ এবং ‘খ্লম’ অর্থ ‘রোগ-ব্যাধি’ বা ‘মড়ক’। ফলত ‘বেহদিয়েনখ্লম’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় ‘রোগবালাই দূর করা’। তবে একদিকে যেমন এই উৎসবটির উদ্দেশ্য মহামারী, অশুভ আত্মা, অমঙ্গল ও দুর্ভাগ্য দূর করার জন্য সর্বশক্তিমান ঐশ্বরিক সত্তাকে সম্মিলিত আহ্বান জানানো, অন্যদিকে তেমনি প্রচুর ফসল এবং সাম্প্রদায়িক শ্রীবৃদ্ধির জন্য মঙ্গলময় ঐশ্বরিক শক্তির আশীর্বাদ কামনা করা।
বেহদিয়েনখ্লম উৎসবের উৎস নিমজ্জিত রয়েছে জৈন্তিয়াদের স্মৃতিবাহিত লোককাহিনি এবং প্রকৃতির প্রতি তাঁদের গভীর শ্রদ্ধার মাঝে। কিংবদন্তি অনুসারে, বেহদিয়েনখ্লম উৎসবের সূচনা ঘটে অতীতে এমন এক সময় যখন এক ভয়াবহ মহামারী জৈন্তিয়া জনজাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে উদ্যত হয়েছিল। এই বিপর্যয়কে প্রতিহত করতে জৈন্তিয়া সম্প্রদায় ঐশ্বরিক শক্তির শরণাপন্ন হয়। ফলত ইউ মুখাই, ইউ মুলং, ইউ মুরালং, ইউ মুসনিয়াং প্রমুখ রক্ষক দেবতাদের সন্তুষ্ট করতে এবং সম্প্রদায়ের মঙ্গল সুনিশ্চিত করতে কিছু পরিকল্পিত আচার-অনুষ্ঠান পালন করা শুরু হয়, সময়ের সঙ্গে যা ‘বেহদিয়েনখ্লম উৎসব’ নামে পরিচিতি পায়।
অপর একটি মৌখিক ঐতিহ্য বলে, বর্তমান মেঘালয়ের পশ্চিম জৈন্তিয়া পার্বত্য জেলার সদর শহর জোয়াই একসময় গহীন বনভূমি দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল। মানব বসতির চিহ্নমাত্র ছিল না সেখানে। অঞ্চলটি ছিল শুধুমাত্র পাঁচজন দেবতার আবাসস্থল। চারটি বিশাল পাথর ও একটি জলপরী ছিল সেই পাঁচজন দেবতা। পঞ্চদেবতাগণ কামনা করেছিলেন, মহান সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর যেন ‘মানুষ’ সৃষ্টি করেন এবং মানব বসতি স্থাপন করতে জোয়াই অঞ্চলে সেই মানুষদের প্রেরণ করেন। পঞ্চদেবতাগণের সেই পবিত্র ইচ্ছেকে মর্যাদা দিয়েছিলেন ঈশ্বর। ঘটনাক্রমে মঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠীভুক্ত এক দল যাযাবর এই অরণ্য অঞ্চলে এসে হাজির হলেন। মানুষের আগমনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পঞ্চদেবতাদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ দেবতা ইউ মুখাই মহাপ্রলয় নৃত্য আরম্ভ করেন। তাঁর নৃত্যের তালে-তালে আকাশ থেকে শুরু হয় অবিরাম বজ্রপাত। উপর্যুপরি গগনবিদারী বজ্রনির্ঘোষ শুনে নবাগত মানুষেরা ভয়ে পালিয়ে যেতে উদ্যত হন। কিন্তু সেই নৃত্যরত দেবতা তাঁদের পলায়ন পথে বাধা দিয়ে বলেছিলেন, ‘ঈশ্বরের সন্তানেরা, ভয় পেয়ো না। এই দেশে তোমরা অপার সুখ ও শান্তিতে বসবাস করবে। এ দেশ আজ থেকে তোমাদের হল’। সেই থেকে যাযাবর মানুষের দল পাকাপাকিভাবে রয়ে গেলেন সেখানে। পরবর্তীকালে এ অঞ্চলে একটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে স্থানীয় বাসিন্দারা দেবতা ইউ মুখাইয়ের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। দেবতা ইউ মোখাই তাঁদের পরামর্শ দিয়েছিলেন, বীজ বপনের ঋতুর পরে একটি বড় সামাজিক উৎসব উদযাপন করতে। ওতেই সমস্যার সমাধান মিলবে। সেদিন থেকে আজ অবধি সেই উৎসবটি ‘বেহদিয়েনখ্লম’ নামে পালন করে আসছেন জৈন্তিয়া জনজাতীয় মানুষেরা। এই পৌরাণিক প্রেক্ষাপট জৈন্তিয়া সম্প্রদায়ের উদ্বর্তন ও হিতের সঙ্গে এই উৎসবের গভীর সংযোগকে জোরালো করে তোলে।
জৈন্তিয়াদের আর্থ-সামাজিক জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব বেহদিয়েনখ্লম। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে, প্রতি বছর বৃষ্টি ভেজা জুলাই মাসে জমিতে বীজ বপন পর্বের পর এবং বর্ষা ঋতুর প্রারম্ভে পালিত হয় এই উৎসব। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত, উর্বর ভূমি ও প্রচুর ফসলের জন্য ঈশ্বরের আশীর্বাদ প্রার্থনা করা এই উৎসবের মূল উপজীব্য, যা জৈন্তিয়া সমাজের কৃষিপ্রিয় হৃদয়কে প্রতিফলিত করে। সেই সঙ্গে এই উৎসবে মূলত সুস্বাস্থ্য, সম্পদ ও সমৃদ্ধির জন্যে প্রার্থনা করা হয়। রঙিন এই উৎসব জৈন্তিয়া পার্বত্য অঞ্চলের সর্বত্র পালিত হলেও, জোয়াইতে অনুষ্ঠিত মূল উৎসবটি বিশেষভাবে দর্শনীয় ও উপভোগ্য। পরম্পরাগত ‘নিয়ামত্রে’ ধর্মাবলম্বী অ-খৃষ্টান নার সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষেরাই প্রধানত এই উৎসবটি পালন করেন। মহা ধুমধাম, জাঁকজমক ও শোভাযাত্রার মাঝে চার দিন ব্যাপী পালিত এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রদর্শিত হয় নার তথা জৈন্তিয়া সম্প্রদায়ের অনন্য আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।
বেহদিয়েনখ্লম উৎসব নানারকম ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান দ্বারা সমৃদ্ধ। তবে আচার অনুষ্ঠানের থেকেও আনন্দই এখানে প্রাধান্য পায়। ফলত উৎসবের দিনগুলিতে উদযাপনের কেন্দ্রস্থল জোয়াই শহর সাংস্কৃতিক উৎসাহ উদ্দীপনার এক প্রাণবন্ত কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়। উৎসব শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ আগে, বজ্র দেবতা ক্নিয়া পিরথাতের উদ্দেশে একটি শূকর উৎসর্গ করা হয়। ওয়াসান নামের পুরোহিতেরা এ সময় ‘চিউ চিউ’ নামে পিতলের ঘন্টা বাজিয়ে শহরের প্রধান সড়ক বরাবর জঙ্গলের সূচনা স্থল পর্যন্ত যাত্রা করেন। এসবই আসলে অশুভ শক্তিকে বিতাড়িত করবার শুভ প্রচেষ্টা।
উৎসবের মূল প্রস্তুতি শুরু হয় ‘খ্নং’ বা ‘সবচেয়ে পবিত্র বৃক্ষ’ নির্মাণ পর্ব দিয়ে। সেই উদ্দেশ্যে সংরক্ষিত পবিত্র অরণ্যে গিয়ে কয়েকটি লম্বা গাছের গুঁড়ি কেটে মসৃণ করা হয়। এক্ষেত্রে কখনওই পাইন গাছ ব্যবহার করা হয় না। কয়েক রাত বনজঙ্গলের ভেতর পড়ে থাকবার পর ঢাক-ঢোল-বাঁশি প্রভৃতি দেশী বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গাছের গুঁড়িগুলিকে মহাসমারোহে বয়ে আনা হয় লোকালয়ে। সেই সঙ্গে চলতে থাকে উদ্দাম নৃত্য ও তীব্র উল্লাস। পরে এই গাছের গুঁড়িগুলিকে প্রতিটি পল্লিতে, কখনও বা কোনও নির্দিষ্ট গৃহের সামনে, খাড়া করে স্থাপন করা হয়। এভাবেই খ্নং নির্মাণ কার্য সম্পূর্ণ হয়।

পাশাপাশি তৈরি হতে থাকে রৎ – সুউচ্চ, জটিল নকশায় সজ্জিত বাঁশের মিনার আকৃতির কাঠামো – যা প্রায়শই ৩০-৪০ ফুট উচ্চতায় পৌঁছয়। তবে রঙিন কাগজ, রাংতা, জরিদার কাপড় ও প্রতীকী নকশায় সজ্জিত নজরকাড়া রঙের সুউচ্চ এই রৎ কেবল এক অসামান্য শৈল্পিক অভিব্যক্তিই নয়, প্রায়শই বিবিধ ঐতিহাসিক ঘটনা বা পৌরাণিক কাহিনির পাশাপাশি তাতে ফুটিয়ে তোলা হয় পরিবেশ দূষণ, সামাজিক অন্যায়-অবিচার ইত্যাদির মতো সমসাময়িক সামাজিক ব্যাধিগুলির চিত্রিত রূপ। রৎ সজ্জার অমন অভিযোজ্যতা নিশ্চিত করে যে, প্রাচীন ঐতিহ্যের শেকড়কে অক্ষত রেখেও সমসাময়িক সমস্যাগুলির ওপর আলোকপাত করবার ক্ষমতা রয়েছে এই চিরগতিশীল উৎসবের। স্বাভাবিকভাবেই রৎ নির্মাণকে কেন্দ্র করে প্রতি বছরই বিভিন্ন দলের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতার সূত্রপাত হয়। সবচেয়ে উঁচু ও শিল্পরুচিসম্মত রৎ বানিয়ে প্রতিটি দলই চায় অপর দলগুলিকে প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দিতে। আর এভাবেই বেহদিয়েনখ্লম উৎসবের বিশেষ আকর্ষণ ‘রৎ’ হয়ে উঠেছে জৈন্তিয়া জনজাতির সৃজনশীল চেতনা এবং বিবর্তিত মূল্যবোধ প্রদর্শন করবার এক অভিনব মাধ্যম।
উৎসবের দিনগুলির বিবিধ প্রতীকী আচার-অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে রয়েছে এক আশ্চর্য প্রথা, যেখানে পুরোহিতদের নেতৃত্বে স্থানীয় যুবকেরা গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে যান এবং লম্বা বাঁশের লাঠি দিয়ে প্রত্যেকটি বাড়ির চালে আঘাত করেন। সঙ্গে চলতে থাকে ঢাকের বাদ্যি, ঝাঁঝরের ধ্বনি ও পুরোহিতদের মুখনিঃসৃত নার ভাষায় স্তবগান। লোকবিশ্বাস মতে, এই প্রথাটি গৃহ তথা সমাজ থেকে অশুভ আত্মা, রোগব্যাধি এবং নেতিবাচক শক্তিকে আক্ষরিক অর্থেই ‘তাড়িয়ে’ দেয়, এবং কেবলমাত্র শুভ শক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করে, যার ফলে আগামী বছরের জন্য এলাকার পরিবেশ বিশুদ্ধ হয়ে ওঠে। আরেকটি প্রতীকী আচার ‘চের ইউং ব্লাই’, যেখানে পুরুষেরা একটি খড়ের কুঁড়েঘরে প্রবেশ করে প্রতীকীভাবে বর্শা দিয়ে রাক্ষসদের হত্যা করে। সমাজকে অমঙ্গল, রোগব্যাধি ইত্যাদি রাক্ষসরূপী অশুভ শক্তির প্রভাব মুক্ত করতে পালিত এই আচারটি বেহদিয়েনখ্লম উৎসবের প্রতিরক্ষামূলক নীতি এবং আধ্যাত্মিক তাৎপর্যকে তুলে ধরে।
বেহদিয়েনখ্লম উৎসব চলাকালীন ধর্মীয় প্রধান ডালোই সমাজের সুরক্ষা ও সমৃদ্ধির কামনায় পরলোকবাসী পূর্বজ এবং ইউ মুখাই, ইউ মুলং, ইউ মুরালং, ইউ মুসনিয়াং প্রমুখ দেবতাদের উদ্দেশে নৈবেদ্য প্রদান সহ একাধিক পবিত্র আচার-অনুষ্ঠান পালন করেন। প্রতিটি এলাকায় স্থাপিত খ্নংকে কেন্দ্র করে শুরু হয় বিভিন্ন পারিবারিক লোকাচার ও জনসমারোহ। এসময় উৎসবের আনন্দে বাঁশি ও ঢাক-ঢোল সহযোগে দলে দলে পুরুষেরা পথের মাঝে নাচে মত্ত হয়ে ওঠেন। নারীরা তখন নাচে অংশগ্রহণ না করে অন্য একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তাঁরা ব্যস্ত থাকেন নিজ গৃহে পরিবার বা গোষ্ঠীর পূর্বজদের বিদেহী আত্মাকে নৈবেদ্য উৎসর্গ করতে। এই প্রথাকে ‘কা সিয়াং কা ফা’ নামে অভিহিত করা হয়। সবচাইতে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এই প্রথা জৈন্তিয়া সমাজের মাতৃকুলভিত্তিক কাঠামোর গুরুত্ব সর্বসমক্ষে তুলে ধরে।
বেহদিয়েনখ্লম উৎসবের চতুর্থ দিনে পবিত্র পুষ্করিণী ‘আইৎনার’কে কেন্দ্র করে আনন্দ-উত্তেজনা চরম সীমা ছোঁয়। হাজার-হাজার মানুষের অংশগ্রহণে পরিপূর্ণ এক অভিনব শোভাযাত্রা করে দুর্দান্ত সব রৎ এবং খ্নংগুলিকে নিয়ে আসা হয় আইৎনারের ধারে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে এই পুষ্করিণীতে বিসর্জন দেওয়া হয়। এই প্রথা ভূমির শুদ্ধিকরণ এবং দেবতাদের উদ্দেশে নৈবেদ্য প্রদানের প্রতীক। তারপরই যুবকেরা প্রচণ্ড উল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়েন আইৎনারের কর্দমাক্ত জলে। এই আনন্দ-ফুর্তির পাশাপাশি দেশী ঢোলের তালে ও বাঁশির সুরের স্পন্দনে পরম্পরাগত সমবেত নৃত্য ও স্তবগান পরিবেশিত হয় প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনায়। ঐতিহ্যবাহী রঙিন জমকালো পোশাক এবং পরম্পরাগত অলঙ্কারে সজ্জিত জৈন্তিয়া নারীদের ভিড় যেন তখন রঙবেরঙের প্রজাপতির মেলা! উৎসবের সময় বৃষ্টি হওয়া শুভ লক্ষণ বলে পরিগণিত হয়। তাই বৃষ্টি মাথায় করেই সকলে হাজির হন উৎসব প্রাঙ্গনে। ইলশে গুঁড়ি বৃষ্টিতে বিচিত্রবর্ণের ছাতার সমারোহ যেন উৎসবটিকে আরও বেশীমাত্রায় রাঙ্গিয়ে তোলে। প্রচুর হৈচৈ ও হাস্যকৌতুকে মুখোরিত হয়ে ওঠে উৎসব।
উৎসবের শেষ পর্বে আয়োজিত ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলি একই সঙ্গে তুমুল প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ ও গভীরভাবে প্রতীকী। যেমন, দাদ-লাওয়াকর নামে একপ্রকার খেলা, যাতে কাঠের গোলক নিয়ে ঠিক আধুনিক ফুটবল খেলার মতোই দুটি দল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেতে ওঠে। সাধারণত মিন্তডু নদীর উচ্চ এবং নিম্ন উপত্যকার প্রতিনিধি দুটি দলের মধ্যে এই খেলাটি সংঘটিত হয়। লোকবিশ্বাস মতে, জয়ী দলটি আগামী বছরে প্রচুর ফসল লাভ করে। আরেকটি ঐতিহ্যবাহী খেলা ‘ইয়াতান-ভাং’ হল কর্দমাক্ত আইৎনারে নেমে একটি বড় কাঠের গুঁড়ি নিয়ে টানাটানির প্রতিযোগিতা। অংশগ্রহণকারীরা মহানন্দে একে অপরের গায়ে কাদা মাখিয়ে দেন, যা তথাকথিত ভারতীয় মূল ভূখন্ডে অনুষ্ঠিত হোলি উৎসবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। জৈন্তিয়ারা বিশ্বাস করেন, বিজয়ীদের জন্য আগামী বছরগুলি বয়ে আনে অপার সুখ ও সমৃদ্ধি।
বলবার অপেক্ষা রাখে না, জৈন্তিয়া জনজাতির কাছে বেহদিয়েনখ্লম উৎসব কেবলমাত্র একটি মরশুমি উৎসব নয়, তার চাইতেও অনেক বেশি গুরুত্ববাহী। এই উৎসব জৈন্তিয়া জনজাতির প্রাণের স্পন্দন। প্রকৃতির প্রতি তাঁদের অগাধ শ্রদ্ধা, ঈশ্বর প্রদত্ত সুরক্ষার প্রতি তাঁদের অটল বিশ্বাস এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য তাঁদের সম্মিলিত আশা মূর্ত হয়ে ওঠে এই উৎসবের মধ্য দিয়ে। বিচিত্র আচার-অনুষ্ঠান, প্রাণবন্ত নৃত্য এবং উদ্দীপক ত্রীড়ার সমন্বয়ে বেহদিয়েনখ্লম উৎসব দৃশ্যত একটি অত্যাশ্চর্য সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা, যা মেঘালয়ের মেঘ-চুম্বিত পর্বতমালার অধিবাসী নার তথা জৈন্তিয়া জনজাতির বৈচিত্রময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও গণ চেতনার প্রাচীনতার সাক্ষ্যবাহী।
তবে সব শেষে একটি কথা না-বললেই নয়। মেঘালয়ের বৃষ্টি ভেজা দিনে জৈন্তিয়া পাহাড়ের হৃদয় জুড়ে যখন ঢোলের গুরুগম্ভীর আওয়াজ আর বাঁশির সুললিত সুর প্রতিধ্বনিত হয়, প্রাণচঞ্চল পাহাড়ি জীবনের নিরবধি ছন্দকে সঙ্গী করে যখন সুউচ্চ রৎ নিয়ে বেহদিয়েনখ্লম উৎসব পালিত হয়, ঠিক সে-সময় তথাকথিত ভারতীয় মূল ভূখন্ড জুড়ে উদযাপিত হয় লোকে লোকারণ্য রথযাত্রা উৎসব। স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় উৎস সত্ত্বেও বেহদিয়েনখ্লম উৎসবের রৎ এবং রথযাত্রার রথের বহিরঙ্গে আশ্চর্য মিল চোখে পড়ে। বেহদিয়েনখ্লম এবং রথযাত্রা উভয়ই পরম্পরাগত সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে আয়োজিত বিশাল গণ উৎসব, যা জনগণের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বন্ধন সুদৃঢ় করতে, সমৃদ্ধি ও সুরক্ষার জন্য ঐশ্বরিক সত্তার আশীর্বাদ পেতে এবং হৃদয়স্পর্শী শোভাযাত্রা ও সমষ্টিগত অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজ নিজ গৌরবময় ঐতিহ্যকে প্রদর্শন করতে উদযাপিত হয়। স্বাভাবিকভাবেই দুটি উৎসবের অমন বাহ্যিক সাদৃশ্য সত্যিই অবাক করে দেয় আমাদের।
