ভূল শংসোধন
(সুজয় দত্ত)
কী মনে হচ্ছে এ-লেখার শিরোনামটা দেখে? এই পত্রিকার অন্যত্র যা যা ছাপার ভুল-টুল আছে তার তালিকা? নাকি আমি অতীতে যতরকম ভুলভ্রান্তি করেছি সেগুলো নিয়ে অনুতাপ-পরিতাপের তেলে চুপচুপে করে ভাজা আর নস্টালজিয়ার চিনির রসে ডোবানো করুণ কাহিনী? কিংবা হয়তো মানুষ তার নশ্বর জীবনে যেসব বেঠিক কাজকর্ম করে বা বেচাল চালে সে-বিষয়ে লম্বা গুরুগম্ভীর লেকচার আর একগাদা অযাচিত উপদেশ? নাঃ, হলো না, ডাহা ফেল। এক্কেবারে গোল্লা। এবং এ-থেকে বোঝা যাচ্ছে আপনি আর যাই হন, মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের খাতা দেখা বাংলার মাস্টারমশাই (বা দিদিমণি) নন। তা যদি হতেন, ওপরের ঐ শিরোনামে যে দুখানা জলজ্যান্ত বানান ভুল রয়েছে সেদুটো আপনার “লাল পেন্সিল” চোখে প্রথমেই নজরে পড়তো আর বুঝতে পারতেন এ-লেখার আসল বিষয়বস্তু ভুল বানান।
হ্যাঁ, ভুল বানান। কী বলছেন, আপনার ওসব হয় না? ছি ছি, মিথ্যে বললে আবার স্বর্গ-নরকের হিসেবরক্ষক চিত্রগুপ্তের খাতায় লাল দাগ পড়বে যে ! অবশ্য জানিনা চিত্রগুপ্ত আজকাল লাল পেন্সিল ব্যবহার করে, না তার ল্যাপটপের ওয়ার্ড প্রসেসরের অটোমেটিক হাইলাইটার। যাইহোক, পৃথিবীতে যেমন একটাও মানুষ নেই যে হামাগুড়ি থেকে হাঁটতে শেখার সময় একবারও আছাড় খায় নি বা বয়ঃসন্ধিতে বিপরীত লিঙ্গের কারোর দিকে একবারও আড়চোখে তাকায় নি, তেমনি একটা অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ খুঁজে দিন তো আমায় দেখি, যে জীবনে বানান ভুল করেনি? নগদ পঞ্চাশ টাকা বাজী রেখে বলতে পারি (সরি, আমার পকেটে ওর বেশী থাকে না) যে পারবেন না। ওঃ, বুঝেছি কিসের ভরসায় আপনার এতো দেমাক। দরজা বাবুর সূক্ষ্মকোমল জানালার “স্পেলচেকার” আর চাকরি বাবুর আপেলমার্কা চালাকচতুর চলভাষের “অটো-কারেক্ট”–তাই তো? কী বলছি বোঝা গেলো না বোধহয়? আরে বাবা, Bill Gates-এর Microsoft Windows আর Steve Jobs-এর Apple smart phone-এর কথা হচ্ছে। তা ওসব তো ইংরেজী বানানের জন্য। যারা জন্মাবার পর মুখে মাতৃভাষা ফোটার আগেই কম্পিউটারের প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ শিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে অথবা সোশ্যাল মিডিয়ার উৎপাতে যাদের বানানজ্ঞানের সাড়ে-বারোটা বেজে গেছে, তাদের যাতে ভুল বানানের জন্য বেইজ্জত হতে না হয়–দরজা বাবু আর চাকরি বাবু তাই ওইসব ব্যবস্থা করেছেন। ওতে আমার-আপনার, মানে ইলিশ আর রসগোল্লার দেশের লোকেদের কী উপকারটা হলো? বরং ঝামেলা আরো বেড়ে গেলো। ইমেলে বা হোয়াটস্যাপ-এ “বাংলিশ” (অর্থাৎ ইংরেজী হরফে বাংলা) লিখতে গিয়ে নিত্য নাকানিচোবানি খায় যারা, তাদের নিশ্চয়ই বলে বোঝাতে হবে না সমস্যাটা। এইতো সেদিন এক আত্মীয়ের কাছ থেকে হোয়াটস্যাপ পেলাম “Pepsi Coke Lemon Dakota Pine”। আমি মর্মোদ্ধার করতে হিমশিম খাচ্ছি, এমন সময় সে ফেসটাইম ভিডিওফোনে বললো আসলে লিখতে চেয়েছে “পিসি চোখে তেমন দেখতে পায়না”। এ তো তাও নিরীহ ব্যাপার। শুনেছি আমার এক বন্ধুর বন্ধু একবার দারুণ বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিলো “অটোকারেক্ট”-এর এই বেয়াড়াপনার জন্য (সত্যিমিথ্যে জানি না)। তাদের পাড়ায় প্রতি শনিবার আবর্জনা আর রিসাইক্লিং-এর জিনিসপত্র নিতে গাড়ী আসে, কিন্তু এক শনিবার বেচারাকে সকাল সকাল অফিসে ছুটতে হওয়ায় সে ওইসব বাইরে বার করে রেখে আসার সময় পায়নি। অতএব অফিসে বসে সে বৌকে মনে করাবার জন্য হোয়াটস্যাপ-এ লিখলো “ময়লা ভেতরে, খালি বিনটা গেটের বাইরে। শনিবার না?”। লেখার সময় খেয়াল করে নি, পরে দেখলো শ্রীমান অটোকারেক্টের পাকামিতে মেসেজ গেছে “My Love to Rekha. Living Together. Bye Roshni. Barna?”। যাচ্ছেতাই কান্ড একেবারে। কারণ রেখা যে ওর শালীর নাম, আর রোশনি ওর বৌয়ের!! ওর নিজের ডাকনাম বর্ণ (ভালো নাম সুবর্ণময়)।
মোদ্দা কথা, যতদিন না বাংলা “স্পেলচেকার” বা “অটোকারেক্ট” ঘরে ঘরে ব্লিচিং পাউডার বা ডিটারজেন্ট সাবানের মতো নিত্যব্যবহার্য হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে, ততদিন বানানভুল ছিল, আছে এবং থাকবে। ছেলেবেলার বেশ কিছু অম্লমধুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে ওই জিনিসটার সঙ্গে। ক্লাস ওয়ানে একবার শ্রুতিলিখনের পিরিয়ডে ১৬ কে সোলো আর ১৯ কে উনিস লিখে খাতায় বড় বড় দুটো লালকালির কাটাচিহ্ন পেয়েছিলাম। আমার স্কুলজীবনে বানান ভুলের ওটাই প্রথম ঘটনা যা স্পষ্ট মনে আছে। তবে যে ছেলেটা আমার পাশে একই বেঞ্চে বসত, সে “র” আর “ড়”তে বড়রকম গন্ডগোল করায় (“আমড়া গরুড় গারিতে চরে বারি গেছিলাম” ইত্যাদি) ক্লাসটিচার সবিতাদির কাছে প্রকাশ্যে বকুনি খেয়েছিলো–আমার অতটা দুর্দশা হয়নি।
অবশ্য তারও আগে মন্টেসরির আপার নার্সারিতে পড়ার সময় ইংরেজী বানান নিয়ে একটা বলার মতো ঘটনা ঘটেছিলো যার আসল মজাটা তখন ঠিক বুঝতে পারিনি। ডিসেম্বারে ছুটি পড়ার ঠিক আগে আমাদের রঙীন কাগজ কেটে ক্রিসমাস কার্ড তৈরী করা শেখানো হচ্ছিলো। বিক্রম খৈতান নামে আমার এক অবাঙালী সহপাঠী তার বানানো কার্ডে “Mary Christmas” লেখায় আন্টি যখন বললেন ভুল হয়েছে, সে ওটাকে মুছে যা লিখে আনলো তাতে উপস্থিত সব আন্টিই দেখলাম মুখ টিপে হাসছেন। কারণ এবারে ও লিখেছে “Marry Christmas”। এর চেয়েও মজার একটা গল্প শুনেছিলাম আমার কলেজজীবনের এক বন্ধুর বোনকে নিয়ে। বন্ধু তখন সবে সেকেন্ডারী স্কুলে ঢুকেছে, তার বোন প্রাইমারীতে–অনেক নীচু ক্লাসে। বইপত্র পড়ার অভিজ্ঞতা খুবই সীমিত। তবে দাদার আগ্রহে বাড়ীতে বাংলা ইন্দ্রজাল কমিক্স রাখা হয় বলে সেসব পড়ে একটু আধটু। সেই সূত্রে জাদুকর ম্যানড্রেক আর তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ‘শয়তানের’ (লুসিফারের বাংলা সংস্করণ) সঙ্গে পরিচয় ছিল। এরপর একদিন স্কুলে প্রেয়ারের সময় একটা সমবেত সংগীত শিখে এসে বাড়ীতে শোনালো যখন, দেখা গেলো ও মহা উৎসাহে গাইছে “চল রে চল সবে ভারত শয়তান”।
ওয়ার্ডরোবে যেমন কিছু কিছু জামাকাপড় দিনের পর দিন পড়েই থাকে কিন্তু ব্যবহার হয় না বা পুরোনো দিনের দালানকোঠায় যেমন কিছু কিছু ঘর সবসময় তালাচাবি বন্ধই থাকে, কোনো কাজে লাগে না, ইংরেজীতে Psychology আর Pneumonia-র P বা Knowledge আর Knife-এর K হলো সেইরকম। ওগুলোর জন্য ছোটবেলায় বানান পরীক্ষায় নম্বর কাটা গেলে কাউকে দোষ দেওয়া যায়না। বাংলায় ওই ঝামেলা নেই, কিন্তু নতুন ভাষাশিক্ষার্থীদের ল্যাজেগোবরে করে দেওয়ার জন্য রয়েছে কয়েকটা বহুরূপী। যেমন ‘ণ’ আর ‘ন’, ‘স’, ‘শ’ আর ‘ষ’ এবং ‘র’, ‘ড়’ আর ‘ঢ়’। নীচু ক্লাসে শ্রুতিলিখনের সময় ওগুলোর একটা থেকে আরেকটাকে আলাদা করে কার সাধ্যি? ‘গূঢ় রহস্য’ মানে যে ঠাকুমার হেঁসেল থেকে গুড় চুরি যাবার রহস্য নয়, কিংবা ‘আষাঢ়’ যে খুব একটা আশার মাস নয় (রাতদিন তুমুল বৃষ্টিতে নিরাশ হয়ে ঘরেই আটকে থাকতে হয়), সেটা শিশুমনে গেড়ে বসতে একটু সময় লাগে। আর ‘মূর্ধা’, ‘তালু’, ‘দন্তমূল’–এসব শব্দের আসল তাৎপর্য বুঝতে গেলে তো রীতিমতো ফিজিওলজি জানতে হবে। সুতরাং একেবারে ছোটদের বাংলা বর্ণমালা শেখানোর সময় স্কুলে বা বাড়ীতে অনেকক্ষেত্রেই ‘ষ”‘ কে ‘পেটকাটা’, ‘শ’কে ‘উঁচু তালগাছে গোলগোল ফল’, ‘ণ’কে ‘ল্যাম্পপোস্ট’ ইত্যাদি বলে সহজ করে বোঝানোর চেষ্টা হয়। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব বলার অভ্যাস ছাড়তে না পারলে কী হয়, সেটা দেখেছিলাম ক্লাস সিক্সে উঠে। আমাদের স্কুলে ক্লাস ফাইভ অবধি ছিল প্রাইমারী সেকশন, সকালে যেতে হতো। ক্লাস সিক্সে ডে সেকশনের প্রথম বছর। দিদিমণি ছেড়ে এবার স্যার। আমাদের বাংলার স্যার সুদীপ্তবাবু শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীর স্নাতক, ‘অগ্নীশ্বর’ সিনেমার উত্তমকুমারের মতো গম্ভীর। একবার ক্লাসে ‘শোষণ’ বানান জিজ্ঞেস করেছিলেন। আমার এক ভীতু-ভীতু দেখতে সহপাঠী গত পাঁচ বছরের অভ্যাসমতো “উঁচু তালগাছে গোলগোল ফল ওকার পেটকাটা ল্যাম্পপোস্ট” বলতেই উনি চটে গিয়ে “ইয়ার্কি হচ্ছে? সাহস তো কম নয়!” বলে ওকে বেঞ্চের ওপর দাঁড় করিয়ে দিলেন। তারপর থেকে আমরা কেউ আর জীবনে ওসব বলিনি।
ওই বছরেই বানান-সংক্রান্ত আরও একটা ঘটনা ঘটেছিলো যা ভোলার নয়। সুরজিৎ নামে আমাদের ক্লাসের একজন ছটফটে, অমনোযোগী ছাত্রের বানান নিয়ে যে চিরকালের সমস্যা, সেটা আমরা জানতাম। আমাদের মাস্টারমশাইরা তো তখনো জানেন না। ভূগোলের হাফইয়ার্লি পরীক্ষায় ও যথারীতি ‘নর্মদা’কে ‘নর্দমা’, ‘তোর্সা’কে ‘তোস্তা’ ইত্যাদি বানিয়ে রেখেছে যথেচ্ছ। ভূগোলের স্যার অবনীবাবু ভালোমানুষ, তিনি শুধু খুচরো কিছু নম্বর কেটেছেন ওইরকম ভুলের জন্য। কিন্তু গন্ডগোল বাঁধলো ইতিহাসে। ইতিহাস যাঁকে পড়াতে দেওয়া হয়েছিল তিনি আসলে উঁচু ক্লাসে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক। তার আগের বছর ইতিহাসের এক প্রবীণ শিক্ষক হঠাৎ অবসর নেওয়ায় কাজ চালানোর জন্য এই ব্যবস্থা। তা এই ভদ্রলোক তাঁর অনভ্যস্ত বিষয় পড়াতে গিয়ে সবসময়েই অস্বস্তিতে থাকতেন আর বোধকরি সেটা ঢাকা দেওয়ার জন্যই ছাত্রদের ওপর হম্বিতম্বিটা একটু বেশীই করতেন। যাই হোক, ব্যাবিলোনিয়ান সভ্যতা সিলেবাসে ছিল, পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছে রাজা আসুরবানিপাল, নেবুচাডনেজার আর হামুরাবির ওপর। এবং সুরজিৎও স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে বেশ কয়েক জায়গায় হামুরাবিকে লিখেছে ‘হামুরারি’। খুবই তুচ্ছ ভুল, আদৌ গুরুত্ব দেওয়ার মতো ব্যাপার নয়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, আমাদের সেই স্যারের নাম আবার মুরারি ভট্টাচার্য। অতএব জল কিছু দূর গড়ালো। সেই পরীক্ষায় অনেকেই ভালো করেনি, কিন্তু স্যারের পুরো আক্রোশটা গিয়ে পড়লো সুরজিতের ওপর। ওর খাতায় কড়া মন্তব্য লিখে সেই খাতা বাড়ীতে বাবা-মাকে দিয়ে সই করিয়ে আনতে বললেন। শেষ অবধি ওর সেটা সাহসে না কুলোনোয় হেডমাস্টারমশাইয়ের কাছেও নালিশ করেছিলেন উনি। অথচ এই ভদ্রলোকই পরে পদার্থবিজ্ঞান পড়ানোর সময় দেখতাম নিজেই মাঝেমাঝে বোর্ডে ভুল বানান লিখছেন। আসলে আমাদের বিজ্ঞানের পাঠ্যবইয়ে ছাপার দোষে সব ‘টো’গুলোকে ‘চৌ’ মনে হতো। উনিও অক্ষরে অক্ষরে সেটাই মেনে চলতেন–এভাঞ্জেলিস্তা টোরিচেল্লি-কে চৌরিচেল্লি আর অটো ফন গেরিক-কে অচৌ ফন গেরিক লিখতেন।
ক্লাস সেভেনে উঠে অবশ্য আমরা এমন একজনকে পেলাম বাংলা পড়ানোর জন্য, যিনি সত্যিই একজন রসিক মানুষ। কথায় কথায় মজা করেন আর হাসান। ব্যাকরণটা উনি দারুণ পড়াতেন, আর বানান ঠিকঠাক মনে রাখার নানারকম চমৎকার উপায় বাতলাতেন। যেমন, আমার কোনো কোনো সহপাঠী তাদের নামের বানান ‘শুভাশীষ’, ‘স্নেহাশীষ’, ‘অরুণাশীষ’ ইত্যাদি লেখে দেখে একদিন ওদের বললেন “ওরে, তোরা ধানের শীষ নোস্, পাখির শিস — এটা মনে রাখিস।” আর সেটা যাতে পাকাপাকিভাবে মনে থাকে, সেজন্য ওদের তারপর থেকে ‘শুভা whistle’, ‘স্নেহা whistle’ বলে ডাকতে আরম্ভ করলেন, যা বলাই বাহুল্য আমরা বাকিরা খুব উপভোগ করতাম। তা এই সুব্রতবাবু একবার গরমের ছুটির ঠিক আগে রচনা লিখতে দিলেন ‘তোমার প্রিয় একটি রবীন্দ্রসংগীত’। আমার এক বন্ধুর (যার রবীন্দ্রসংগীত-টঙ্গীতে মোটেই রুচি নেই, মুখে সবসময় হিন্দী সিনেমার গান) সম্ভবত কয়েকদিন আগে স্কুলের রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানে প্রাইমারী সেকশনের এক দিদিমণির গাওয়া ‘শাপমোচনের’ দুএকটা গান ছাড়া আর কিছুই মনে নেই, তাই ও সেখান থেকেই একটা বাছলো। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘র’-ও জীবনে উল্টে না দেখলে যা হয় আরকি, দেখা গেলো “মোর বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি”-র বদলে লিখেছে “মরবি না ওঠে কোন সুরে বাজি”। স্যার শুধু মুচকি হেসে খাতাখানা আমাদের সবার সামনে তুলে ধরে বললেন, “ভাগ্যিস ‘বেঁচে থাকবি ওঠে কোন সুরে’ লেখেনি।” এবং তারপরেই ওঁর অফুরন্ত মজারু গল্পের ঝুলি থেকে একটা গল্প শোনালেন। উনি যখন আমাদের মতো নীচু ক্লাসে পড়তেন আর ওঁর ভাই প্রাইমারী স্কুলে, একবার নাকি বিজ্ঞানের হোমওয়ার্কে প্রশ্ন ছিল স্বাস্থ্যদায়ক জড়িবুটি ও গাছপালা নিয়ে। উনি চিরতা গাছ নিয়ে লিখলেন, যা থেকে একধরণের তেতো ওষুধ তৈরী হয়। রাতে শুতে যাবার ঠিক আগে বই খুলে মেলাতে গিয়ে দেখেন চিরতার বদলে ভুল করে কালমেঘের (অন্য একরকম তেতো ওষধি) বর্ণনা লিখে ফেলেছেন। ঘুমজড়ানো চোখে ভাইকে বললেন ওই খাতায় যেখানে যেখানে ‘চিরতা’ লেখা আছে, রাবার দিয়ে মুছে ‘কালমেঘ’ করে দিতে। পরদিন সকালে খাতা খুলে দেখেন ওখানে বিজ্ঞানের হোমওয়ার্কের ঠিক পরেই যে বাংলা কবিতা মুখস্থ লিখতে দেওয়া ছিল, তাতে রবীন্দ্রনাথের ‘ওরা অকারণে চঞ্চল’ কবিতার “চির তাপসিনী ধরণীর ওরা শ্যামশিখা হোমানল” লাইনটাতেও ভাই ‘চিরতা’ মুছে ‘কালমেঘ’ করে দিয়েছে!
বাংলা ভাষায় বানান ভুল মানেই কিন্তু শুধু ‘আকাঙ্ক্ষা’, ‘পুঙ্খানুপুঙ্খ’ বা ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ লিখতে গিয়ে অসহায় আত্মসমর্পণ নয়। কোন শব্দের বানানে ‘ন’ হবে আর কোথায় ‘ণ’, অথবা স-শ-ষ এই তিনটের মধ্যে কোনটা কখন ঠিক, সে বিষয়েও বিভ্রান্তি কম নয়। ব্যাকরণ বইয়ে ‘ণত্ববিধান’ আর ‘ষত্ববিধান’ বলে দুটো অধ্যায় থাকে। ব্যাকরণের ‘ব্যা’ও যারা কোনোদিন ছুঁয়ে দেখেনি তাদের কথা আলাদা, কিন্তু যারা ওদুটো একটু আধটু পড়েছে তাদের অতটা হিমশিম খাওয়ার কথা নয়। অন্ততঃ ‘স্যামবাজারের সসীবাবু’ বা ‘শশাগরা পৃথিবী’ ধরণের ভুল তাদের হবে না, যদিও ‘সর্বশেষ’ বা ‘সংশ্লেষ’ লিখতে গিয়ে তারাও হোঁচট খেতে পারে। ‘র’, ‘ড়’ আর ‘ঢ়’-র জন্য ওইরকম কোনো অধ্যায় না থাকলেও মানুষের উচ্চারণ শুনে প্রথমটা আর পরের দুটোর মধ্যে তফাৎ করা যায় (অবশ্য ‘ড়’ আর ‘ঢ়’-এর ফারাক বোঝানোর মতো শুদ্ধ উচ্চারণ খুব কম লোকেরই আছে)। তবু ‘র’, ‘ড়’ আর ‘ঢ়’-এর গন্ডগোল-জনিত মজার অভিজ্ঞতা বোধহয় আমাদের সবার জীবনেই হয়েছে। মনে আছে অনেক ছোটবেলায় একবার আমার দিদিমার নির্দেশে তাঁর জবানীতে আমার বীরভূম-নিবাসী বড়মাসীকে চিঠি লিখেছিলাম তখনকার দিনের সেই একচিলতে ঘিয়ে-ঘিয়ে রঙের পোস্টকার্ডে। তাতে আমার মামা তাঁর বাড়ী থেকে ট্যাক্সি পেতে দেরী হওয়ায় দেরী করে বেরিয়ে হাওড়া স্টেশনে ট্রেন মিস করেছেন সেই খবরটা দিতে গিয়ে লিখেছিলাম “মামা পড়ে গেছে তাই ট্রেন ধরতে পারেনি।” বলাই বাহুল্য কথাটা ‘পরে’ হবে, ‘পড়ে’ নয়। সেই চিঠি পেয়ে মাসীর বাড়ী থেকে উদ্বিগ্ন টেলিগ্রাম এসেছিলো কোথায় লেগেছে, হাড়গোড় ভেঙেছে কিনা জানতে। এর উল্টো গল্পটা শুনেছিলাম আমার এক মাসতুতো দাদার কাছে। হাইস্কুলে নীচু ক্লাসে ওর এক চূড়ান্ত ফাঁকিবাজ সহপাঠী নাকি একবার পরীক্ষায় সাদা খাতা জমা দেয়, তাতে শুধু লেখা “স্যার, আমি আজ কিছু না পরেই পরীক্ষা দিতে এসেছি, কাল আমার দাদু মোড়ে গেছেন।” ঐ খাতা পেয়ে ‘স্যারের’ প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল, সেই কৌতূহল আমার আজও যায়নি।
আমি প্রাইমারী স্কুলে পড়ার সময় দেখতাম পাড়ার কচিকাঁচারা বিকেলে লুকোচুরি খেলার সময় দরজা খোলা পেয়ে আমাদের পাশের বাড়ীতে ঢুকে খাটের তলায় বা আলমারীর পিছনে লুকোলেই ওই বাড়ীতে যিনি কাজ করতেন তিনি উচ্চৈঃস্বরে “এই, বেড়িয়ে আয়, বেড়িয়ে আয়, সন্ধ্যেবেলা অন্ধকারে খুব মশা কামরায়” বলে চেঁচাতেন। বোঝাই যাচ্ছে আসলে কী বলতে চাইতেন। এখনও প্রায়ই অনেককে লিখতে দেখি “অমুকে এখন বেরাতে বেড়িয়েছেন”। এক্ষেত্রে ‘র’ আর ‘ড়’-এর যে জায়গাবদল দরকার সেটা বলে দেওয়ার বোধহয় ওঁদের কেউ নেই। এই প্রসঙ্গ শেষ করি একটা স্বীকারোক্তি দিয়ে। আমিও ছোটবেলায় যখন প্রাইমারী স্কুলের গানের দিদিমণি ‘তাসের দেশের’ সেই বহুশ্রুত রবীন্দ্রসংগীতটি প্রথম তুলিয়েছিলেন, গানের খাতায় লিখেছিলাম “খড়বায়ু বয় বেগে।”
একে তো ব্যঞ্জনবর্ণের এই গোলকধাঁধায় মানুষ নাজেহাল, তার ওপর আবার আছে স্বরবর্ণের ফাঁদ। একেবারে বিতত বিতংস। এবং পরিস্থিতি আরো জটিল করে দিয়েছেন জোড়াসাঁকোর নোবেল লরিয়েট। আমরা সেই কোন ছোটবেলা থেকে ‘দেরি’, ‘ভারি’, ‘তরকারি’ এসব লিখলে খাতায় ঘ্যাঁচঘ্যাঁচ লালকালির দাগ আর পিঠে স্কেলের বাড়ির দাগ পেয়ে পেয়ে ‘দীর্ঘ ঈ’-র মাহাত্ম্য বুঝতে শিখেছি, আর উনি কিনা ‘সহজপাঠে’ এইসব বানানে হ্রস্ব-ই লিখে দিব্যি পার পেয়ে যান! ‘ভারি’ অন্যায় তো!! জানিনা, আমাদের মতো ওঁরও হয়তো ‘বিভীষিকা’কে বিভীষিকা মনে হতো বা ‘মরীচিকা’র ভুলের ফাঁদে উনিও বারবার জড়িয়েছেন। তারই শোধ তুলেছেন ‘সহজপাঠে’। কিন্তু একা রামে রক্ষা নেই, সঙ্গে সুগ্রীব দোসর–’হ্রস্ব উ’ আর ‘দীর্ঘ উ’। সত্যি কথা বলুন তো, ‘মুমূর্ষু’ আর ‘শুশ্রূষা’ বানানে হ্রস্ব-উ আর দীর্ঘ-উ ঠিকঠাক মনে রাখতে গিয়ে আপনি কি কখনো মুমূর্ষু হয়ে পড়েছিলেন বা আপনার শুশ্রূষা দরকার হয়েছিল? হলে অবাক হবো না। ‘মুহূর্ত’ আর ‘মুহুর্মুহু’ নিয়েও হয়তো মাঝেমধ্যে ধাঁধায় পড়তে হয়েছে। পাড়ায় দুর্গাপুজোর চাঁদা চাইতে গিয়ে বড়দের কাছে কখনো না কখনো নিশ্চয়ই শুনতে হয়েছে “একী? চাঁদার বিলবইয়ে ‘দূর্গা’ লেখা কেন? আগে বানান ঠিক কর তারপর চাঁদা পাবি।” আর “ভুল”কে “ভূল” লেখার জন্যও হয়তো হাস্যাস্পদ হতে হয়েছে এক বা একাধিকবার। এসব ভাবলে যদি বিরক্তিতে বলে উঠতে ইচ্ছে করে “দূর ছাই! কোন দুঃখে বাংলা মিডিয়ামে পড়তে গিয়েছিলাম? ইংরেজী কত ঝামেলাহীন”, তাহলে এমনিতে আপত্তি নেই, কিন্তু ‘দূর’-এ দীর্ঘ উ আর ‘দুঃখে’ হ্রস্ব উ–সেটা যেন খেয়াল থাকে। নাহলে অদূর ভবিষ্যতে দুঃখ পেতে হতে পারে। মনে আছে তো বিদ্যাসাগরের সেই গল্পটা–একজন কী একটা সমস্যায় পড়ে তাঁকে চিঠি লিখেছিল “আমার খুব দুরাবস্থা” আর তিনি উত্তরে লিখেছিলেন “সেটা আপনার ‘আকার’ দেখেই বোঝা যাচ্ছে”। অর্থাৎ ‘দুরবস্থা’কে ‘দুরাবস্থা’ লেখার জন্য বিদ্যাসাগরীয় ভঙ্গীতে একটু বকুনি আর কি!
অবশ্য দুর্ভাগ্যক্রমে এমন শব্দও আছে যাদের লিখিত আকার না দেখলে শুধু উচ্চারণ শুনে বোঝার উপায় নেই যে তাদের আসলে কোনো ‘আকার’ নেই। কাজেই শ্রুতিলিখনের সময় ওগুলোর সঠিক বানান লিখতে ‘ব্যর্থ’ হলে সেই ‘ব্যথা’ উপশমের ‘ব্যবস্থা’ আপনাকেই করে রাখতে হবে।
অ-কার আর ও-কারের মধ্যে গুলিয়ে ফেলাটাও খুব স্বাভাবিক, বিশেষত আমাদের যখন অনেক অ-কারান্ত শব্দকেই ‘ও’-এর মতো উচ্চারণ করার রীতি। আমাদের উচ্চারণ নিয়ে আমার এক হিন্দীভাষী বন্ধু একবার ঠাট্টা করে বলেছিল,”তোরা সবসময় মুখে রসগোল্লা নিয়ে কথা বলিস।” তবে একদা পশ্চিমবঙ্গের এক ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্বাক্ষরতা অভিযান নিয়ে কলকাতার দেওয়ালে দেওয়ালে যে মাঝেমাঝেই লেখা থাকত “চলো পোড়াই, কিছু করে দেখাই”, সেটা খুব সম্ভবত ওই কারণে নয়। যারা ওগুলো লিখতো তারা নিজেরা ছোটবেলা থেকে পড়াশোনার বদলে ‘পোড়াশোনা’ করেছে হয়তো–তাই ওই হাল। আমার ছোটবেলায় যখন খবরের কাগজে পড়তাম “অসমে বড়োদের আন্দোলন ও বিক্ষোভ”, মনে মনে ভাবতাম ওই রাজ্যে বড়দের বুঝি ছোটদের মতোই কড়া শাসনে রাখা হয়, কলকাতায় আমার দেখা বড়দের মতো যা খুশী তাই করতে পারেনা তারা–তাই এতো রাগ। তখন তো আর জানতাম না ‘বড়ো’ (যাদের অনেকসময় ‘বোড়ো’ও লেখা হয়) অসমের একটা জনগোষ্ঠীর নাম।
আমার এক খুড়তুতো বোন কচিবয়সে প্রথম যখন রবীন্দ্রসংগীত শিখতে শুরু করে,”আমার পরাণ যাহা চায়” বা “আমি চঞ্চল হে”কে কিছুতেই প্রথা মেনে “আমারো পরানো যাহা চায়” বা “আমি চঞ্চলো হে” এভাবে গাইতে চাইতো না, বলতো হলুদ মলাটের বইটায় (মানে গীতবিতানে) তো ওরকম লেখা নেই। ওই বোনই একবার পাড়ার রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করেছিল “ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে/ জলসিঞ্চিত ক্ষিতি সৈরভ রভসে/ ঘনগৈরবে নব জৈবনা বরষা” ইত্যাদি। শব্দগুলোর মানে জানলে ও হয়তো বুঝতো যে এই লাইনকটায় কবির আসল উদ্দেশ্য ‘ঐ’-এর অনুপ্রাস তৈরী করা নয়। এ-কার নিয়েও মাঝেমাঝে মজার পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আমাদের কলেজের হোস্টেলে আমরাই পালা করে মেস-ম্যানেজার হতাম, অর্থাৎ এক-এক মাসে এক-একজন মাসকাবারি আর দৈনিক বাজারের হিসেবে রাখতাম। সে বাজার আমাদের করতে হতোনা, একজন লোক এসে দিয়ে যেত। শুধু সপ্তাহে যে ক’দিন মাছমাংস হতো, ম্যানেজারের নির্দেশ অনুযায়ী তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে অন্য কোনো একজন ছাত্র সেটা এনে দিতো দোকান থেকে সকালবেলা। একদিন কী একটা উপলক্ষ্যে আমাদের বিশেষ খাওয়াদাওয়া–যাকে বলে গ্র্যান্ড ডিনার। সেদিন চুনো মাছ আনার কথা নয়, কিন্তু যে নবাগত অনভিজ্ঞ ছেলেটির ওপর দায়িত্ব পড়েছিল সে ভুল করে ট্যাংরা আর বাটামাছ এনে রেখে গেছে রান্নাঘরে। রাঁধুনীদের কাছে খবর পেয়ে ম্যানেজার ছেলেটির ঘরে ঢুকে (সে তখন ঘরে ছিলনা, বাথরুমে ছিল) টেবিলে একটা চিরকুট রাখলো “আজ তো স্পেশ্যাল রান্না, ছোট মাছ কেন”। স্নান-টান সেরে ঘরে এসে ওই চিরকুট পেয়ে বেচারা আবার তড়িঘড়ি বাজারে ছুটলো, এবার নিয়ে এলো মৌরলা! ছেলেটাকে দোষ দেওয়া যায়না, ও বুঝবে কী করে যে ম্যানেজার আসলে কৈফিয়ত চেয়েছে, আবার কিনতে যেতে বলেনি? আর ম্যানেজারকেও কি অভিযুক্ত করা ঠিক হবে ‘ক্যানো?’ না লিখে ‘কেন’ লেখার জন্য? আমরা তো ওরকমই লিখি।
সব স্বরবর্ণকে ধরে ধরে খলনায়ক বানালাম, ঋ-কারই বা বাদ যায় কেন? আমার হাইস্কুলের এক সহপাঠীর দৌলতে স্মরণীয় হয়ে আছে এই ঋ-কার। একবার কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘হাট’ কবিতাটির সেই বিখ্যাত পংক্তি “বিকালবেলায় বিকায় হেলায় সহিয়া নীরব ব্যথা” র তাৎপর্য্য লিখতে গিয়ে ও বোধহয় ‘অবিক্রীত পণ্য’র বদলে লিখেছিলো ‘অবিকৃত পণ্য’। তাতে বাংলার টিচার যে নম্বর কেটেছিলেন, সেটা নিশ্চয়ই ওর মনে বেশ ভালোরকম দাগ কেটে থাকবে। কারণ তারপর ও জীবনবিজ্ঞানে ‘যকৃৎ’কে ‘যক্রীত’ আর ‘কৃমি’কে ‘ক্রীমি’ লেখা শুরু করলো। ওর বানানের বহর দেখে আমাদের জীবনবিজ্ঞানের টিচার ওকে ইংরেজীতে পরীক্ষা দেওয়ার পরামর্শ দিলেন (আমাদের বাংলা-মাধ্যম স্কুল হলেও বিজ্ঞানের বিষয়গুলো বোর্ডের পরীক্ষায় দুটো ভাষাতেই দেওয়া যেত), কিন্তু তাতে আবার উল্টো বিপত্তি। এবার শুনলাম ও জীবন্ত জীবাশ্মকে living fossil না লিখে alive fossil আর heart muscle-কে hurt mussel লিখেছে।
তাহলে শেষমেষ কী দাঁড়ালো? দাঁড়ালো এটাই যে, ‘বানান ভুল’ জিনিসটা অনেক লাঞ্ছনা, পিটুনি, উপহাস-পরিহাস আর বিড়ম্বনার স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকলেও দিনের শেষে ওটা আমাদের জীবনে এক অফুরন্ত মজার উৎস। ভাবুন তো–বাংলা সাহিত্যে সব মজারুর সেরা মজারু সুকুমার রায়ের সেই অনবদ্য ‘খিচুড়ি’ পানসে হয়ে যেতো না বানান ভুল না থাকলে? তার প্রথম লাইনটাই যে “হাঁস ছিল সজারু, ব্যাকারণ মানি না…।”
This is very attention-grabbing, You are an excessively professional blogger. I have joined your rss feed and stay up for searching for more of your great post. Additionally, I have shared your site in my social networks| а