prabandho-nabanita

নবনীতা : বেঁচে আছো আনন্দে

জয়তী রায়

আজ বসেছি তর্পণ করতে, এমন একজনের উদ্দেশ্যে যাঁর শারীরিক মৃত্যু মেনে নিতে হলেও, তিনি বেঁচে থাকবেন মানুষের মননে।
তর্পণ শব্দের অর্থ তৃপ্তি সাধন। এর মন্ত্রগুলো ভীষণ সুন্দর। মৃত্যুর নিষ্ঠুরতা মুছে ফেলে কেমন এক মায়াময় সম্পর্ক রচনা করে দেয়।‌ বিগতের সঙ্গে বর্তমানের , জীবনের সঙ্গে মরণের অপরিমেয় দূরত্ব আর থাকে না। জীবন আর মৃত্যু দুটিকেই সমান জরুরি আর সমান আপন করে নিতে মন্ত্রশক্তি যেন আমাদের সান্ত্বনা দেয়।
তাই, তর্পণ কেবল মাত্র সংস্কার নয়, এক অর্থবহ শক্তি। এ সমস্ত কথা নবনীতা দিদির কথা। বলে গেছেন , ‘ভালোবাসার বারান্দা’ নামক বইটিতে। গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো করার মত , তাঁর কথা দিয়েই শুরু করলাম।
চলে গেছেন। আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হয়। একটা আলো জ্বলছিল, ঝপ করে নিভে গেল। নিভু নিভু করলেও, সতেজ হাসি আর প্রবল জীবনীশক্তি দিয়ে তাকে নিভতে দিচ্ছিলেন না। মৃত্যু নিয়ে ঘর করে মৃত্যুকে তুচ্ছ করার নাম , নবনীতা।

নবনীতা নামটি রবীন্দ্রনাথের দেওয়া, এ তথ্য সকলের জানা। রাধারাণী দেবী / নরেন্দ্র দেব – বিখ্যাত বাবা মায়ের সন্তান তিনি। দক্ষিণ কলকাতায় , ভালো-বাসা বাড়িতে, প্রসিদ্ধ মানুষজনের আসা যাওয়া, গান কবিতা গল্প নিয়ে ব্যস্ত জীবন সকলের, নবনীতা একলা একলা বেড়ে ওঠেন। তবে , একাকীত্বে ভোগেন না। কারণ, সঙ্গী ছিল কল্পনার জগৎ। চারপাশের মানুষ জন। নিজস্ব লেখালিখির মধ্যে দিয়ে বড় হয়ে উঠছিলেন, সুন্দর করে। খেলছেন বাস্কেটবল, কাটছেন সাঁতার, করছেন ডিবেট। বন্ধুরা কারা? প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়,অরুণ মিত্র, অমিয় দেব। সেই মত আছেন মাস্টারমশাই।

নিজেই বলেছেন:
কবিতে ও কবিতায়, কথাশিল্পে , সমালোচনায়, অনুবাদে, সদাসাহিত্যপরিবৃত হয়ে নিরাপদে আছি আমি।
সে তো বটেই। সৃষ্টির চারাগাছ বেড়ে ওঠার সময় এমন জ্ঞানী-গুণী সঙ্গ বৃষ্টিধারার মত ঝরে পড়া মহা সৌভাগ্যের ঘটনা।
১৯৩৮ থেকে ২০১৯ দীর্ঘ জীবনের বাঁকে বাঁকে অনেক গল্প। অনেক ঘাত প্রতিঘাত। নবনীতার জীবন খোলা পাতার মত। তুচ্ছ থেকে তুচ্ছ কথা বলতে দ্বিধা করেন নি। আনন্দ দুঃখ সব কিছুই উজাড় করে দিয়েছেন নিজের স্টাইলে। নিজস্ব সরস বাচন ভঙ্গি দিয়ে। দুঃখের উত্তাল নদী হাসতে হাসতে পার করে যে মাঝি, সে কুর্নিশ পাবার যোগ্য বটে।
একজন অধ্যাপক , ভাষা শিল্পী, ভাষা কর্মী হিসেবে তাঁর খ্যাতি আন্তর্জাতিক মানের। এই সমস্ত তথ্য দেবার জন্যে লিখতে বসিনি। প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা তাঁর সঙ্গে আলাদা আলাদা। আমি তেমন কিছু মুহূর্ত তুলে ধরব, যেখানে খুঁজে পেয়েছি আমার প্রিয় সাহিত্যিককে, একান্ত এক আলাদা ভঙ্গিতে।
:দুই:
মানুষটা ভারি সহজ সরল ছিলেন এ কথা নতুন করে বলে আর কি হবে! দুঃখের কথা তো থাকেই, কিন্তু যে মানুষটা দুঃখকে মোটে আমল দিলেন না, তাঁর কথা তেমন করেই লিখি বরং। মজাদার চাট মশলার মত। উপরে ঝালঝাল টকটক নোনতা, ভিতরে গভীর জীবন বোধ।
ঝাল ঝাল টক টক স্মৃতি বলতে মনে পড়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে বেড়ে উঠেছিল তাঁর সৃষ্টির চারাগাছ। যাদবপুর আমাদের প্রাণের জায়গা। সেখানকার আর্টস বিভাগে , পয়লা এপ্রিল বেরুত এপ্রিল লিস্ট। কাউকে ছাড়া হত না সে লিস্টে। প্রফেসর সব শঙ্কিত। কি যেন কি লেখে! নবনীতা দেবসেনের নামের আগে লেখা হল:
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই…
অসুখে ভুগতেন। তারপর কনফারেন্সে যাওয়া কামাই হত ক্লাস। তাই এমন লেখা! নবনীতা এমনই তো। শিক্ষিকা তো কি হল!
ফুচকা চরিত ( ২৬/০৭/২০০৮) লিখছেন , গুণগান করছেন ফুচকার। ছেলেমানুষী খুশিতে মেতে উঠছেন বলতে বলতে। ফুচকাওয়ালার কাছ থেকে চুরমুর কিনে, তাঁর ঘরে পৌঁছে দিত ছাত্রীরা। একটু আড়াল করে মদ্যপান করার মত চুপিচুপি টিফিনে চুরমুর খেতেন!
এমন ছেলেমানুষী তাকেই শোভা পায়, যার অন্তরে আছে জ্ঞানের সাগর।
আরো আছে। একবার ক্লাসে ঢুকছেন, দেখছেন দেওয়াল লিখন:
” একো ফুকো দেরিদা লকাঁ / চার বিহনে মগজ ফাঁকা।
নবনীতা গম্ভীর। এই কে লিখেছে রে এই শ্লোগান? ছাত্ররা এক গাল হেসে বলল:
ওমা দিদি! এটা তো খুব চালু স্লোগান। মনে হয়, শিবাজীর লেখা।
নবনীতা আরো গম্ভীর। ওটা ওঁর লেখা। আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধের অংশ ছিল।

নবনীতা মানেই জীবন নিয়ে গপ্পো।নিজেই বলেছেন:
এদিকে আমার চরিত্রের একটা প্রবল দুর্বলতা আছে, আমি পজিটিভ থিংকিং বিশ্বাস করি। … তাই জীবনের প্রবলতম বিশ্বাস হননের মুহূর্তেও আমি কবির বাক্য ইষ্ট মন্ত্রের মত জপ করি। মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। তাতে মাথার উপর আকাশটা সব সময় উন্মুক্ত থাকে। “
সংসারের চোখে যা কিছু তুচ্ছ , যা কিছু ঘটছে চারদিকে, তাই নিয়ে নবনীতা লেখেজোখে। যাই লিখুন না কেন , মনে হয় এ যেন আমাদের কথা। নবনীতার কথাশিল্পের বারান্দায় বসলে উঠতে ইচ্ছে করে না। উন্মুক্ত হয় নতুন চিন্তার দুয়ার। আপাতদৃষ্টিতে হাল্কা চালে চলা সরস রচনার মধ্যেও রয়েছে গভীর জীবনবোধ।

:তিন:

এমন একজন মানুষকে দেখবার সৌভাগ্য যখন হল, তখন মারণরোগ ঘিরে ধরেছে তাঁকে। অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল আমার। এক সন্ধ্যাবেলা, একলা পৌঁছে গেলাম। ঠিক একলা নয়। এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া সমান কন্যা আমাকে নিয়ে গেল , তাঁর সামনে। শুয়ে ছিলেন। কপালে বড় টিপ। পরিপাটি শাড়ী। শরীর ভালো না।
আমি বললাম:
চলে যাচ্ছি দিদি।
একদমই চেনেন না আমাকে।
তবু বললেন:
কেন রে? বোস। কি এনেছিস হাতে করে? তোর বই? দে।
: না দিদি। থাক।
: বোস। এই দেখ। আমার বন্ধু
এসেছে। গান করে খুব সুন্দর।
তাকিয়ে দেখলাম, মোমের পুতুলের মত সুন্দর আরো এক দিদি। গান গাইলেন। তক্ষুনি চলে আসতাম, সে আলাপ গড়িয়ে গেল চা আর সিঙ্গাড়া পযর্ন্ত। স্বভাবত লাজুক আমি, বিশেষ কথা বলিনি। শুধু শুনে গেছি। কান ভরে। প্রাণ ভরে।
এরপরে সৌভাগ্য হল , বিখ্যাত সই সংগঠনের অংশীদার হবার। সে সৌভাগ্য এসেছিল একজন ভালো মানুষের হাত ধরে। সই , পশ্চিমবঙ্গর একমাত্র লেখিকাগোষ্ঠি । সই মানে স্বাক্ষর। সই মানে সখী। সই এর প্রাণভোমরা নবনীতা দিকে দেখেছিলাম, মিষ্টি হাসি আর প্রাণের প্রাচুর্য নিয়ে বসে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। এক একটা বাক্য যেন মণিমুক্তার মত:

আমাদের প্রত্যেকেরই সেই কাঠবিড়ালির মতো কিছু পাথর বহন করে আনার শক্তি আছে, সমুদ্র লঙ্ঘন যাতে অসম্ভব থাকে না।
স্তব্ধ হয়ে যাই। মনে হয়, পারি। সীমিত ক্ষমতা নিয়ে হলেও পার হতে পারি সঙ্কট সাগর। গোটা দুই বার গেছি , সই এর অধিবেশনে। মুগ্ধ চোখে দেখেছি তাঁকে। মন দিয়ে শুনেছি কথা।
২০০০ -এ ভালো-বাসা বাড়িতে সই নির্মিত হয়েছিল। এ যেন একটা জায়গা মেয়েদের জন্য, মন প্রাণ খুলে মেলবার জায়গা। খুব ভালো লেগেছিল সেই দুই দিন। যিনি নিয়ে গেছিলেন সঙ্গে করে, কত যে কৃতজ্ঞ তাঁর কাছে। অনন্য অভিজ্ঞতা। মানুষের শরীর থেকে ওমন দ্যুতি বার হতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস হয় না। মানুষের ভিতরের বিশ্বাস আর বাইরের আচরণ যদি সমান হয়, তবে আলো জ্বলে হৃদয়ে। সে আলো ঠিকরে পড়ে আলোকিত করে অন্ধকার। নবনীতা এমন একজন মানুষ, যাঁর সামনে গেলে দেখতে পাই আলো। সে আলো যেমন শিক্ষার, যেমন বিদগ্ধতার তেমনি সততার। সরলতার। সহজতার।

তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, নবনীতা দিদি সবচেয়ে বেশি ধরা পড়েন তাঁর রচনায়। প্রত্যেক সাহিত্যিকই তাই। সাহিত্যিককে খুঁজতে নেই জীবনচরিতে। একথা বলেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তাই, নবনীতা আছেন। তাঁর সমস্ত রচনার মধ্যে ছড়িয়ে আছেন। হেসে উঠছেন। বকুনি দিচ্ছেন। পথ ভুল করে চলে যাচ্ছেন অন্য কোথাও। নিজেকে নিয়ে অজস্র হাসি কৌতুক করছেন। লেখা পড়লেই যেন ছুঁতে পারি তাঁকে।
এই প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে, দিদির এই রচনাটির কথা মনে হয়। রচনাটির নাম :
জন্মদিনের কবিতা ২০০৮: সেখানকার কিছু লাইন পড়লে মনে হয় , এমন কথা কেবল তিনিই বলতে পারেন:
বয়সকে ভয় পেতে নেই। ভয় পেলেই তা চেপে ধরে। ….. আয়ু আমাদের হাতে নেই, কিন্তু ভালো করে বাঁচা অনেকখানিই আমাদের হাতে। যদিও জানি, ক্ষণে ক্ষণে মৃত্যু আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে, তবু যতদিন বাঁচব ততদিন ভালো করে বাঁচতে চাইব। … যে যত ভালো করে বাঁচব, সে তত বেশি করে বাঁচব।

ভালো থেকো । ভালো থাকা যায়।

ইচ্ছের মুঠোতে রাখো

ভালো থাকা এবং না থাকা।

সময় ফুরায়।
তবুও অশোকফুল লাল হয়ে ফোটে।
কিন্তু কবিরা মরে না।

_____________________
প্রণাম নবনীতা দিদি।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *