prabandho-nari-muktir-upay

নারীমুক্তির উপায় অন্বেষণ এবং রোকেয়া
অসীম বিভাকর


নিজস্ব বোধ অঙ্কুরিত হবার পর থেকে রোকেয়া নারীদের যে জীবন দেখেছেন তা যে মানুষের জীবন নয়, এটা তিনি বুঝেছিলেন বেশ স্পষ্ট করেই। উপেক্ষার আজন্ম দহন নারীর প্রাত্যহিকতাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো যে তারা কখনো ভাবতেই পারেনি তাদেরও একটি স্বতন্ত্র সত্তা আছে। তারাও নিজের মতো করে হাসতে পারে, কাঁদতে পারে।

নারী ছিলো পুরুষতান্ত্রিক ধারণার কবলে বন্দী। স্বামীর মৃত্যুর পর যখন তাকে চিতার আগুনে পুড়ে সহমরণে যেতে বাধ্য করা হয়েছে, সমাজের চিরায়ত প্রথার প্রতি আনুগত্যস্বরূপ যখন অকাল বৈধব্যের কাছে বিসর্জন দিতে হয়েছে নিজের সমগ্রজীবন, তখনো নারীকণ্ঠে উচ্চারিত হয়নি কোনো প্রতিবাদের ধ্বনি। রাজা রামমোহন রায়ের চেষ্টায় সতীদাহ প্রথার বিলোপ ঘটে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রচলন করেন বিধবাবিবাহের। সতীদাহ প্রথার বিলোপ কিংবা বিধবাবিবাহের প্রচলনে নারীর দুর্গতি খানিকটা লাঘব হয়। কিন্তু মানুষ হিসেবে নারীর সামাজিক স্বীকৃতি আদায় হয়েছিলো কতোটুকু? ফলে রোকেয়াকে নারীমুক্তির বিষয়ে ভাবতে হয়েছে নতুন করে।

তিনি নারীর মুক্তজীবনের কথা ভেবেছেন যতোটা না নারীর প্রয়োজনে, তার চেয়ে বেশি সমাজের প্রয়োজনে। তাঁর বিবেচনায় সমাজ হচ্ছে একটি গাড়ি। নারী এবং পুরুষ হচ্ছে সমাজনামক গাড়ীর দুটি চাকা। যদি গাড়ির এক চাকা ছোট এবং আরেক চাকা বড়ো হয়, তাহলে সেই গাড়ী একই স্থানে দাঁড়িয়ে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে থমকে যায় অগ্রসরমানতা।

সতীদাহ প্রথা রোধ কিংবা বিধবাবিবাহের প্রচলন নারীর জীবনকে যে আইনি সুরক্ষা দিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নারীর ব্যক্তিত্বের বিকাশ, নারীর মনে আত্মমর্যাদাবোধ জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে এই আইনী সুরক্ষা কতোটুকু ভূমিকা রেখেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। পারিপার্শ্বিক বিপদ থেকে রক্ষায় আইন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু আত্মশক্তি জাগরণের জন্য প্রয়োজন পড়ে শিক্ষার। রোকেয়া সেই দিকটির প্রতি নজর দিয়েছিলেন গভীরভাবে।

জ্ঞানের অভাব থেকেই সীমাবদ্ধতার জন্ম। রোকেয়া নারীদের জীবনে এই সীমাবদ্ধতার প্রভাব লক্ষ করেছেন বড়ো বেদনার সঙ্গে। যেমন-নারীরা যে অলঙ্কার পরিধান করে তা আসলে ক্রীতদাসকে সনাক্ত করার জন্য একধরনের নিদর্শন। পীড়নের ইতিহাস জানা নেই বলে দাসত্বের চিহ্নকেই নারীরা সৌন্দর্য বৃদ্ধির উপকরণ হিসেবে গ্রহণ করেছে। এ প্রসঙ্গে বেগম রোকেয়া মন্তব্য:

আর এই যে আমাদের অতিপ্রিয় অলঙ্কারগুলি- এ গুলি দাসত্বের নিদর্শনবিশেষ। এখন ইহা সৌন্দর্য বদ্ধর্নের আশায় ব্যবহার করা হয় বটে; কিন্তু অনেক মান্যগণ্য ব্যক্তির মতে অলঙ্কার দাসত্বের নিদর্শন।……. অভ্যাসের কি অপার মহিমা! দাসত্বে অভ্যাস হইয়াছে বলিয়া দাসত্বসূচক গহনাও ভাল লাগে। অহিফেন তিক্ত হইলেও আফিংচির অতি প্রিয় সামগ্রী।

মতিচূর ১ম খ- (৩১)

অলঙ্কারের মাধ্যমে বাহ্যিক সৌন্দর্য বৃদ্ধির চেষ্টা রোকেয়ার কাছে ছিলো চূড়ান্তরকম অপছন্দের বিষয়। এমন চেষ্টাকে তিনি মানসিক দীনতার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করতেন। তাঁর ভাষায়-

সৌন্দর্যবর্দ্ধনের চেষ্টাও কি মানসিক দুর্ব্বলতা নহে। পুরুষেরা ইহা পরাজয়ের নিদর্শন ভাবেন। তাঁহারা কোন বিষয়ে তর্ক করিতে গেলে বলেন, “আমার কথা প্রমাণিত করিতে না পারিলে আমি চুড়ি পরিব।”

মতিচূর ১ম খ- (৩২)

নারীর যে মনোবৈকল্য তার দায় কি নারীর একার? নাকি পরিকল্পিতভাবেই নারীকে এমন পরিস্থিতি মেনে নিতে বাধ্য করা হয়েছে। রোকেয়া দেখেছেন গৃহবন্দী জীবের মতো নারী ঘরে আবদ্ধ। পর্দাপ্রথার নামে তার জীবন থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে সবুজ আঙ্গিনায় পা রাখার অধিকার। স্বাস্থ্য ও শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে অবজ্ঞা করা হয়েছে পুরোপুরি। মেয়েদের জন্য ছিলো না কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ প্রসঙ্গে রোকেয়া বলেছেন-

আমাদের শয়নকক্ষে যেমন সূর্যালোক প্রবেশ করে না, তদ্রুপ মনোকক্ষেও জ্ঞানের আলোক প্রবেশ করিতে পায় না। যেহেতু আমাদের উপযুক্ত স্কুল কলেজ একেবারে নাই।

মতিচূর ১ম খ- (৩৫)

শিক্ষার উদ্দেশ্য কী, নারী কেমন শিক্ষায় শিক্ষিত হবে, সে সম্পর্কেও রোকেয়া প্রদান করেছেন সুচিন্তিত অভিমত।

যাহা হউক শিক্ষার অর্থ কোন সম্প্রদায় বা জাতি বিশেষের “অন্ধ অনুকরণ” নহে। ঈশ্বর যে স্বাভাবিক জ্ঞান বা ক্ষমতা (ভধপঁষ) দিয়াছেন, সেই ক্ষমতাকে অনুশীলন দ্বারা বৃদ্ধি (ফবাবষড়ঢ়) করাই শিক্ষা।

মতিচূর (৩৬) ১ম খ-

রোকেয়া যে সময়টায় বেড়ে উঠেছেন, সেসময় নারীর পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রটি ছিলো খুবই সঙ্কীর্ণ। মুক্ত আলো-বাতাসের আস্বাদ গ্রহণ তাদের কাছে ছিলো কল্পনারও অতীত। কোনো নারীর সঙ্গে ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে নিজের চিন্তার যৌক্তিকতাকে যে যাচাই করবে, সেই সুযোগ থেকেও নারী ছিলো বঞ্চিত। রোকেয়া এহেন অস্বাভাবিক বাস্তবতার অবসান কামনা করেছেন।

অন্তঃপুরিকাদের পরস্পর দেখাশুনা বৃদ্ধি হওয়া বাঞ্ছনীয়।……….. অবশ্য যাঁহাদিগকে আমরা ভদ্রশিষ্ট বলিয়া জানি, কেবল তাঁহাদের সঙ্গে মিশিব, – তাঁহারা যে কোন ধর্মাবলম্বী (য়িহুদী, নাসারা, বুৎপরস্ত বা যা’ই) হউন, ক্ষতি নাই।

মতিচূর ১ম খ- (৬১)

একজন নারী তাঁর সত্তায় ঐশ্বর্যের বাহুমাত্রিকতাকে ধারণ করেন। এই ঐশ্বর্যের মমতাময় স্পর্শে সন্তান জাত হয়। যে শিশুর সুষম বিকাশের মাধ্যমে গড়ে ওঠে সমাজ বা দেশের স্বপ্নের কাঠামো, সেই শিশুর বৃদ্ধিতেও থাকে মাতৃনির্ভরতা। মা যখন শিক্ষার সৌকর্য থেকে দূরবর্তী অবস্থানে থাকেন, তখন ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঋদ্ধিমান প্রজন্মের অপার সম্ভাবনা। এমন শঙ্কা থেকেই তিনি লিখেছেন-

সুশিক্ষার অভাবেই আমাদের হৃদয়বৃত্তিগুলি এমন সঙ্কুচিত হইয়াছে। ললনাকূলের ভীরুতা ক্রমে বালকদের হৃদয়ে সংক্রামিত হইতেছে। পঞ্চমবর্ষীয় বালক যখন দেখে যে তাহার মাতা পতঙ্গদর্শনে মূর্ছিতা হন, তখন কি সে ভাবে না যে পতঙ্গ বাস্তবিকই যেন ভয়ানক বস্তু।

মতিচূর ১ম খ- (৬২)

রোকেয়া যখন থেকে পৃথিবীকে চিনতে শিখেছেন, সমাজকে বুঝতে শিখেছেন, তখন থেকেই ব্যাকুল অনুসন্ধিৎসা নিয়ে সমাজ কিংবা পরিবারে নারীর অবস্থান নির্ণয় করার চেষ্টা করেছেন। তিনি দেখেছেন নারীর স্বকীয় কোনো ভিত্তি নেই। যদিও ‘মোহাম্মদী আইনে’ নারী অধিকারসম্পর্কিত সুস্পষ্ট বিধান লিপিবদ্ধ আছে, কিন্তু বাস্তবে তার কোনো প্রয়োগ নেই। সেই আক্ষেপই ব্যক্ত হয়েছে এই উদ্ধৃতিতে-

‘মহম্মদীয় আইন’ অনুসারে আমরা পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হই- আমাদের বাড়ীও হয়। কিন্তু তাহা হইলে কি হয়, -বাড়ীর প্রকৃত কর্ত্তা স্বামী, পুত্র, জামাতা, দেবর ইত্যাদি হন। তাঁহাদের অভাবে বড় আমলা বা নায়েবটি বাড়ির মালিক। গৃহকর্ত্রীটি ঐ নায়েবের ক্রীড়াপুতুল মাত্র। নায়েব কর্ত্রীকে যাহা বুঝায়, অবোধ নিরক্ষর কর্ত্রী তাহাই বুঝেন।

মতিচূর ১ম খ- (৬৮)

পুরুষতান্ত্রিক পুরুষের দলই নারীকে অন্তঃপুরে আবদ্ধ রাখার বিধান জারি করেছে। নারীর অবশ্যপ্রাপ্য মানবিক অধিকার হরণ করেছে তাঁরাই। যে পুরুষ নারীকে তাঁর ন্যায্য সম্মানটুকু দিতে কার্পণ্য প্রদর্শন করে, সেই পুরুষই নিজের ভাগেরটা বুঝে নেয় ষোলআনা। সেই পুরুষ তাহলে কেমন? রোকেয়ার বিদ্রুপাত্মক অভিব্যক্তি-

জান বৎসেগণ। কন্যা রচনার সময় আমার হস্তে কোন বস্তুই ছিল না; সুতরাং আমাকে কোন দ্রব্যের গন্ধ, কোন বস্তুর স্বাদ এবং কোন পদার্থের বাষ্পমাত্র সংগ্রহ করিতে হইয়াছিল, কিন্তু পুরুষ নির্ম্মাণের সময় আমাকে কিছুমাত্র ভাবিতে হয় নাই। আমার ভাড়ারে সকল দ্রব্য প্রচুর পরিমাণে ছিল, – হস্ত প্রসারণ করিলে যাহা হাতে ঠেকিয়াছে, তাহাই গ্রহণ করিয়াছি। যথা দন্ত নির্মাণের সময় সর্পের বিষদন্ত আমূল লইয়াছি; হস্ত পদ নখ প্রস্তুত করিতে শার্দ্দুলের সমস্ত নখর লইয়াছি; মস্তিকের কোষসমূহ (পবষষং) পূর্ণ করিবার সময় গর্দ্দভের গোটা মস্তিষ্কটাই ব্যবহার করিয়াছি। নারী সৃজনকালে আমি শুধু অনলের উত্তাপ লইয়াছিলাম; পুরুষের বেলায় একেবারে জলন্ত অঙ্গার লইয়াছি।

(সৃষ্টিতত্ত্ব-১৯৫)

রোকেয়া যে সমাজ নির্মাণ করতে চেয়েছেন, তা কোনো বিশেষ সম্প্রদায় বা গোষ্ঠির নয়, সর্বমানবের। তিনি তাঁর বিদ্যালয়কে যেন পরিকল্পিত সমাজের আদলেই গড়ে তুলেছেন।

বিদ্যালয় বিভাগে ব্রাহ্ম, হিন্দু, খ্রীষ্টান শিক্ষয়িত্রী তো ছিলেনই; ক্রমশঃ মুসলমান ছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাইলে তাহাদের ধর্মশিক্ষার জন্য দুই তিনজন মুসলমান শিক্ষয়িত্রী নিযুক্ত করা হয়। কি সুন্দর সাম্য! মুসলমান, হিন্দু, ব্রাহ্ম, খ্রীষ্টান সকলে যেন এক মাতৃগর্ভজাতা সহোদরার ন্যায় মিলিয়া মিশিয়া কার্য্য করিতেছেন।

(পদ্মরাগ-২০৫)

রোকেয়ার নারীমুক্তি সম্পর্কিত যে বক্তব্য তা নারীকেন্দ্রিক নয়, সমাজকেন্দ্রিক। নারীর অনগ্রসরতা শুধু যে নারীর জন্যই ক্ষতিকর তা নয়; বরং এর প্রত্যক্ষ প্রতিফল ভোগ করতে হয় সমাজকেই। সেজন্যই তিনি নারীর মানবিকভাবে সম্পূর্ণ হয়ে ওঠার চিন্তাকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। পুরুষতান্ত্রিক ধারণায় এটা অনেকটাই বদ্ধমূল যে, পুরুষের সহযোগিতা ছাড়া নারী অচল। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই পুরুষ নারীর সমার্থক শব্দ হিসেবে ‘অবলা’ শব্দটিকে চালু করেছে। কিন্তু রোকেয়া মনে করেন নারীরও স্বতন্ত্র শক্তি আছে। নারীরও আছে এককভাবে পথে চলার ক্ষমতা। তাই তাঁর আহ্বান-

আমিও দেখাইতে চাহি যে, দেখ, তোমাদের ঘর করা ছাড়াও আমাদের আরও পথ আছে। স্বামীর ‘ঘর করাই’ নারী জীবনের সার নহে। মানব-জীবন খোদাতালার অতি মূল্যবান দান,- তাহা শুধু ‘রাঁধা উননে ফুঁ-পাড়া, আর কাঁদার’ জন্য অপব্যয় করিবার জিনিষ নহে। সমাজের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ ঘোষণা করিতেই হইবে।

(পদ্মরাগ-২৪৮)

নারীকে অধস্তন করে রাখার যে প্রবণতা তা সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার উপজাত। নারীকে নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে বাধ্য করা ছিলো সামন্তপ্রভুদের খেয়ালের বহিঃপ্রকাশ। সামন্তব্যবস্থার পরিবর্তে কায়েম হয়েছে ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে কি? রোকেয়ার সংগ্রামকে সফল করার জন্য আরো মনোযোগী হতে হবে এবং নারীর অনগ্রসরতার কারণগুলো চিহ্নিত করে সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *