prabandho-rabindra-nozrul

রবীন্দ্র – নজরুল পারস্পরিক সম্পর্কের স্রোত ধারা
ছন্দা বিশ্বাস


রবীন্দ্র নজরুলের সম্পর্কের অন্তরঙ্গ দিকটি তুলে ধরার আগে যে কথাটি বলতে হয় সেটি হল বাংলা সাহিত্যের প্রধান ব্যক্তিত্ব নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কাব্য, সাহিত্য, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, গান, অঙ্কন – শিল্পের প্রতিটি শাখায় তার দৃপ্ত পদসঞ্চার। বাঙালির মননে, জীবনে তার অবাধ উপস্থিতি। দেড়শ বছর আগে জন্ম গ্রহণ করেও তার আধুনিকতা নিয়ে আজ কোনও প্রশ্ন থাকতে পারে না। বাঙালির সংস্কৃতি কিংবা রুচি সবেতেই রবীন্দ্রনাথের চূড়ান্ত উপস্থিতি। তিনি বাংলা সাহিত্যের ভগীরথ।

ঠিক একইভাবে বাংলা সাহিত্যে তার চাইতে বয়সে অনেকটাই ছোট একজন কবি অজ গ্রামে নিতান্ত অবহেলায় বড় হয়ে উঠছিলেন রবীন্দ্রনাথকে স্পর্শ করে। রবীন্দ্রনাথ যখন খ্যাতির আলোতে দীপ্যমান সেই সময়ে বর্ধমান জেলার জামুরিয়া থানার অন্তর্গত চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কবি নজরুল ইসলাম (১৮৯৯)। রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা নিয়েই তার বালক বয়স থেকে কৈশোরে পদার্পণ। নজরুলের কাব্য সাহিত্যে তাই রবীন্দ্রনাথের নামটি অসংখ্যবার উচ্চারিত হয়েছে। ছেলেবেলায় পিতা ফকির আহমেদের মৃত্যুর পরে খুব স্বাভাবিক কারণে বালক নজরুল নিদারুণ আর্থিক অনটনের স্বীকার হন। মৌলবী কাজি ফজল আহমেদের কাছে তিনি আরবী, ফার্সী, উর্দু শিক্ষালাভ করেন যেমন তেমনই তার এক প্রতিবেশী কাকার কাছে ছেলেবেলাতেই লোটো গান এবং প্রাচীণ সাহিত্যপাঠের সুযোগ ঘটে। ১৯০৯ সালে যখন তার পিতার মৃত্যু হয় তখন তার বয়স মাত্র নয় বছর। নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হলেও উপার্জনহীন পরিবারের পক্ষে তাকে আর লেখাপড়া চালানো সম্ভব হল না। তখন থেকে তাকে রুজি রোজগারের আশায় বেরিয়ে পড়তে হল। তখন থেকেই তাকে গ্রামের মসজিদের ইমাম বানানো হয় এবং তাকে আজান দাতার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু সেখান থেকে সামান্য যা আয় হয় তাতে সংসার চালানো দুরুহ ব্যাপার মনে করে তিনি লোটো দলে নাম লেখান। এই সময়ে তিনি গান রচনা এবং অভিনয় করতে থাকেন। লোকায়ত সংস্কৃতি এবং সাহিত্যের প্রাধান্য ছিল লোটো গানে। তিনি এখানে সান্নিধ্য লাভ করেন দলের সঙ্গীতগুরু শেখ গোদার। গোদার সঙ্গস্পর্শে এসে তিনি অজস্র লোক গাথা, উপমার সাথে সাথে জয়দেব, চন্ডীদাস ছাড়াও বহু কবির কাব্য সাহিত্যের সংস্পর্শে আসেন। সেই সাথে তিনি হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথের একজন অন্ধ ভক্ত। রবি ঠাকুরের একটা ফোটো জোগাড় করে প্রতি সন্ধ্যায় তাকে ধূপ জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা জানাতেন। পরবর্তীকালে ‘বড়র পিরীতি বালির বাঁধ’ নামক একটি প্রবন্ধে তিনি সেই কথার উল্লেখ করেছেন।

এরপর এগার বছর বয়সে লোটোর গান ছেড়ে তিনি মঙ্গল কোটের মাথরুণ স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হলেন। তখন সেখানে শিক্ষকতা করতেন কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিক। এরপর তিনি ক্লাস নাইনে সিয়ারশোল স্কুলে যখন ভর্তি হলেন সেই বছরেই লিখে ফেললেন ‘ক্ষমা’ কবিতাটি। সেটি রবীন্দ্রনাথের ‘পলাতকা’ কবিতার সমিল মুক্তছন্দে লিখিত। কলকাতা থেকে প্রকাশিত বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকায় সেটি ‘মুক্তি’ নামে ছাপা হয়। সিয়ারশোল স্কুলে সেবার তিনজন শিক্ষক অবসর নিলেন। তাদের বিদায় সম্বর্ধনা উপলক্ষ্যে তাদের উদ্দেশ্যে কবিতা লেখার ভার এসে পড়ল কাজীর উপরে। সেদিন বিদায় উৎসবে নজরুল রবি ঠাকুরের একটি কবিতা আবৃত্তি করেন এবং ‘হে ক্ষণিকের অতিথি’ গানটি গেয়েছিলেন।

এরপর ১৯১৭ সালে নজরুলের শিক্ষক শ্রী নিবারণ চন্দ্র ঘটক পুলিশের হাতে ধরা পড়লে নজরুল স্কুল ছেড়ে সেনা বাহিনীতে যোগদান করন। এ সময়ে তার কাছে থাকত ‘গীতাঞ্জলী’ এবং ‘চয়নিকা’। সেই বয়সেই তিনি প্রবাসী, ভারতবর্ষ, মানসী, সবুজ পত্র, ভারতী, মর্মবাণী ইত্যাদি পত্রিকা পড়ে ফেলেছেন। সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন তিনি পারস্যের কবি হাফেজের কবিতার অনুবাদ করেন। ‘দেওয়ানী হাফেজে’র মুখবন্ধে তিনি রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।

নজরুল গোড়া থেকেই ১৯২০ সালে কাজি মোজেম্মেল হকের সম্পাদনায় ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় নজরুলের ‘শাত ইল আরব’, ‘বোধন’ এবং ‘খেয়াপারের তরণী’ এই তিনটি কবিতা এই পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিল। এই পত্রিকা থেকে নজরুলের কবিতা পড়ে কবি মোহিতলাল মজুমদার মুগ্ধ হয়ে মোসলেম ভারতে একটি পত্র লেখেন। ১৯২০ সালে শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথের একান্ত সচিব শ্রী সুধাকান্ত রায়চৌধুরী নজরুলকে অভিনন্দন জানিয়ে ‘সৈনিক কবি কাজী নজরুলের প্রতি’ নামে একটি কবিতা লিখে পাঠান। কবিতাটির কয়েকটি পংক্তি এখানে উদ্ধৃত করা হল,

‘ছন্দে গানে বাজাও কবি বাজাও প্রাণের গান,

মুগ্ধ কর বিশ্বজনে দাও গো নূতন প্রাণ।

দমকে চলা হাওয়ার মত ছন্দ তোমার চলে

মাড়িয়ে দিয়ে সকল বাধা ক্ষিপ্ত চরণ তলে।’

এতটাকাল যাকে তিনি অন্তর থেকে পূজা করে গেছেন অথচ তখনও পর্যন্ত তিনি রবীন্দ্রনাথকে চোখেই দেখেননি। তিনি অপেক্ষা করে আছেন কবে তিনি তার ডাক পাবেন। তার সবসময়ে সংকোচ ছিল তিনি একজন গরীব গ্রাম্য মানুষ। অথচ রবীন্দ্রনাথ কত বড় মাপের একজন মানুষ। কত দেশ বিদেশ ঘুরেছেন কত কত বিদগ্ধজনের সাথে তার পরিচয়, সমগ্র দেশবাসী নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গর্বিত, আপ্লুত। কিন্তু নজরুল আপন মনে তার সৃষ্টিকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে নজরুলের কবিতাগুলো পড়তেন। তার ‘শাত ইল আরব’ এবং ‘খেয়াপারের তরণী’ পড়ে তিনি মুগ্ধ হন। এমন সাবলীল কবিতা, আরবি, ফারসী শব্দের এমন যথাযথ মেলবন্ধন তিনি এই প্রথম দেখলেন এবং ভিতরে ভিতরে এই নবীন কবিকে দেখার জন্যে একটা টান অনুভব করতে লাগলেন। ঠিক এইরকমই একটা সময়ে কবির সঙ্গে দেখা করতে এলেন পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়। কবির সামনে ‘মোসলেম ভারত’ দেখে তিনি নজরুলের প্রসঙ্গ তুললেন। পবিত্রবাবু জানালেন নজরুল তার বিশেষ বন্ধু। কবি তখন তাকে বিশেষভাবে নিয়ে আসার জন্যে বললেন।

১৯২১ সালে অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে শান্তিনিকেতনের কলাভবনের দোতলায় বন্ধু মহম্মদ শহীদুল্লাহকে নিয়ে কবির সামনে উপস্থিত হন নজরুল। প্রথম দর্শনেই কাজী আপ্লুত। রবীন্দ্রনাথ তাকে বসতে বললেন। তারপর বহুক্ষণ তারা দুজনেই নীরব রইলেন।

এরপর বেশ কয়েকবার নজরুল জোড়াসাঁকোতে রবীন্দ্রনাথের বাসভবনে যান। কবির সাথে কথা বলেন। ১৯২২ সালে তিনি ‘ধূমকেতু’ পত্রিকাটি প্রকাশ করেন। পত্রিকা প্রকাশের আগে নজরুলের বাসনা জাগল রবীন্দ্রনাথ যদি তার এই পত্রিকাটিতে কোনও শুভেচ্ছা বাণী বা আশীর্বাদসূচক কিছু লিখে পাঠান। মনের ভিতরে দারুণ দোলাচলতার ভিতরে পত্রিকা প্রকাশের ঠিক আগের দিন অর্থাৎ ২৪শে শ্রাবণ ১৩২৯ তারিখে রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ সম্বলিত কবিতা এসে পৌঁছল নজরুলের হাতে। তাতে লেখা ছিল,

কাজি নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েসু,
‘আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয়কেতন!

অলক্ষণের তিলকরেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা,
জাগিয়ে দে রে চমক মেরে
আছে যারা অর্ধচেতন!’

শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১৯২২ সালের ৮ই নভেম্বর ধুমকেতুর পত্রিকা অফিসে হঠাৎ করে পুলিশে হানা দেয়। ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ১২৪এ ধারা অনুযায়ী কাজীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করা হয়- the poet who was convicted under section 124 IPC by the chief Presidency Magistrate, Calcutta on 16.1.23 and sentenced to one year RI, arrived at this jail from the Alipore Central jail on 14.4.23. He occupied cell NO. 5 in the east facing row of cells. He was transferred here from Berhampore jail as a special class prisoner on 18.6.23. … (Letter from superintendent, hoogli jail DO NO. 2078Dt,8.8.57 A.K. Mukherjee M.A. to Shri Prantosh Mukherjee, Chinsurah).

নজরুল বুঝতে পেরে বেশ কিছুদিন কুমিল্লায় আত্মগোপন করেছিলেন। পরে তাকে গ্রেফতার করে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে আনা হয়। কয়েকদিন পরে তাকে কিছু না জানিয়ে বহরমপুর জেলে পাঠানোর নাম করে হুগলী ডিস্ট্রিক্ট জেলে সাধারণ কয়েদীদের পোশাক পরিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে নৈহাটি স্টেশনে নামিয়ে গাড়ি বদল করে হুগলি ডিস্ট্রিক্ট জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। এখানে এসে তাকে সাধারণ কয়েদিদের মতোই খেতে হত লোহার থালায়। পরতে হত কয়েদিদের পোশাক।

এর প্রতিবাদে নজরুল আমৃত্যু অনশন শুরু করে দিলেন। নজরুল অনশন শুরু করে দিলে এই সংবাদ দ্রুত চারিদিকে ছড়িয়ে যায়। অনশনের পনের দিনের কেটে গেলে নজরুলের শরীর ভেঙে পড়ে। বন্ধুরা সকলে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তারা নানাভাবে কাজীকে বোঝালেও তিনি সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। রবীন্দ্রনাথ এই সময়ে শিলং-এ ছিলেন। সেখানে এই সংবাদ পৌঁছে যায়। সেই সময়ে তার কাছে সব কিছু জানিয়ে টেলিগ্রাম করা হল। তিনি জানালেন, নজরুল একটা আদর্শের জন্যে লড়াই করছে। তার অনশন এই আদর্শকে অবলম্বন করেই। তাকে আদর্শ ভাঙতে বলা মানে আত্মহত্যায় সাহায্য করা। এটি তিনি কখনই করতে পারেন না। সেই সময়ে নজরুলের অনশন ভঙ্গের অনুরোধ জানান শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, চিত্তরঞ্জন দাশ, নলিনীকান্ত সরকার প্রমুখ।

এরপরে একমাস কেটে গেলেও জেল কর্তৃপক্ষ যখন এ ব্যাপারে উদাসীন তখন রবীন্দ্রনাথ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ তার স্মৃতিকথায় বাবার একখানি পত্রের উল্লেখ করে জানান, নজরুলকে রবীন্দ্রনাথ কতখানি স্নেহ করতেন। রথীন্দ্রনাথকে কবি সেই সময়ে লিখছেন,

কল্যাণীয়েসু রথী,
‘নজরুল ইসলামকে প্রেসিডেন্সী জেলের ঠিকানায় টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলুম। লিখেছিলুম, give up hunger strike, our literature claims you.
জেল থেকে memo এসেছে , address not found. অর্থাৎ ওরা আমার বার্তা ওকে দিতে চায় না, কেননা নজরুল প্রেসিডেন্সী জেলে না থাকলেও ওরা নিশ্চয় জানে সে কোথায় আছে। অতএব নজরুলের আত্মহত্যায় ওরা বাধা দিতে চায় না।
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অবশেষে চল্লিশ দিন পরে নজরুল তার অনশন ভঙ্গ করেন। শোনা যায় রবীন্দ্রনাথ এবং চিত্তরঞ্জনের যুগ্ম হস্তক্ষেপেই নাকি নজরুল অনশন ভঙ্গ করেন। জেল কর্তৃপক্ষ অবশ্য নজরুল যে যে দাবী তুলেছিলেন সেই সেই দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়।

নজরুলের অনশনের ঠিক এক মাস পরেই রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে তার ‘বসন্ত’ নাটকটি উৎসর্গ করেন। কিন্তু নাটকটি নিজের হাতে নজরুলকে দেবার জন্যে ব্যগ্র হয়ে পড়েন। তখন তিনি পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে ডেকে পাঠান। রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে তার নাম লিখে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে দিয়ে বললেন, “আমি নিজের হাতে তাকে এটি তুলে দিতে পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ প্রকাশ না করে। আমি তাকে অন্তর থেকে আশীর্বাদ জানাচ্ছি। আর বোলো, সে যেন কবিতা লেখা বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে, কিন্তু যুদ্ধে প্রেরাণা যোগাবার কবি তো চাই।”

পবিত্র কুমার তার স্মৃতিচারণায় লিখছেন, জেলের গরাদে প্যাকেট খুলে গুরুদেবের উৎসর্গপত্র দেখাতেই নজরুল একেবারে লাফিয়ে উঠল। বন্দীর ভিতরে প্রবল উত্তেজনা অনুভব করে ইউরোপিয়ান ওয়ার্ডার তার কারণ জানতে চাইল। আমি তখন বললাম, “পোয়েট টেগোর ওকে একটি বই ডেডিকেট করেছেন।” সাহেব আমার ইংরেজির ভুল ধরে বলল, “ইউ মীন প্রেজেন্টেড।” আমি জোর দিয়ে বললাম, “নো ডেডিকেটেড।”

সাহেবের মুখে বিস্ময়।
“ইউ মীন দি কনভিক্ট ইজ সাচ অ্যান ইম্পরট্যান্ট পার্সন!”
তারপর কী ভেবে সাহেব দরজাটা খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে ধরে নাচতে শুরু করল নজরুল। তারপর বইটাকে কপালে ঠেকিয়ে বুকে চেপে ধরলেন।

১৯২৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি রচনা করেন। ততদিনে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার এক বছর পূর্ণ হয়েছে। আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে নজরুলকে হুগলী জেলে পাঠানো হল। জেল সুপারকে উদ্দেশ্য করে তিনি একটি প্যারডি লেখেন, ‘সুইপার বন্দনা’।

“তোমারি জেলে পালিছ ঠেলে
তুমি ধন্য ধন্য হে। ………
রেখেছ সান্ত্রী পাহারা দোরে
আঁধার কক্ষে জানাই আদরে
বেধেছ শিকল প্রণয় ডোরে
তুমি ধন্য ধন্য হে।
……….”
(ভাঙার গান।)

রবীন্দ্রনাথের বই উৎসর্গ হিসাবে পাওয়ার এই বিরল সম্মানের কথা নজরুল কোনওদিন ভুলতে পারেননি। তিনি লেখেন, ‘তার এই আশীর্বাদের মালা পেয়ে আমি জেলের সর্বজ্বালা, যন্ত্রণা, অনশন ক্লেশ ভুলে যাই।’ তিনি লেখেন,

‘হে সুন্দর, বহ্নিদগ্ধ মোর বুকে তাই
দিয়েছিলে ‘বসন্তের’র পুষ্পিত মালিকা।’

নজরুল তার কাব্যে রবীন্দ্রনাথের এই ঔদার্যের কথা নানাভাবে স্মরণ করেছেন। যেমন তিনি লেখেন,

‘দেখেছি তোমারে যবে হইয়াছে মনে
তুমি চির সুন্দরের পরম বিলাস!
মানুষ এই পৃথিবীতে অন্তর বাহিরে
কত সে উদার, কত নির্মল মধুর,
কত প্রিয় ঘন, প্রেম রস সিক্ত তনু,
কত সে সুন্দর হতে পারে সর্বরূপে
তাই প্রকাশের তরে পরম সুন্দর
বিগ্রহ তোমার গড়েছিল ওগো কবি।’

এই সময়ে অনেকে নজরুলকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করতেও ছাড়েনি। কেউ কেউ এমন কথাও লিখেছিল,

‘বসন্ত দিল রবি
তাইতো হয়েছ কবি।’

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, সেই সময়ে কিছু কিছু সাহিত্য পত্রিকা যেমন ‘ইসলাম দর্শন’ ও ‘মোসলেম দর্পণ’ পত্রিকায় সেকালে তীব্র নজরুল বিরোধী কুৎসায় মেতে ওঠে। ‘শনিবারের চিঠি’র মত ‘ইসলাম দর্শন’ পত্রিকাও নজরুলকে শাসাতে শুরু করে। সাহিত্যক্ষেত্রে নজরুলের অতি দ্রুত প্রতিষ্ঠা ও জনপ্রিয়তা নজরুলের কাল হল। তার বিপক্ষে প্রথম বিরোধীমূলক প্রচার চালালেন শ্রী সজনীকান্ত দাস। নজরুলকে ব্যঙ্গ করে তিনি অসংখ্য কবিতা, ছড়া এবং প্যারোডি লেখেন। এগুলি সবই ‘শনিবারের চিঠি’র ১৩৩৩ আষাঢ় সংখ্যা থেকে ১৩৩৪-এর কার্তিক সংখ্যার মধ্যে প্রকাশিত হয়েছিল। অনেকেই তখন ছদ্মনামের আড়ালে নজরুলের নামে কুৎসা রটাতে শুরু করল। নজরুলের ‘অনামিকা’ কবিতার অনুসরণে প্যারোডি লিখলেন গাজী আব্বাস ‘বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ’ নামে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাকে ব্যঙ্গ করে লেখা হল ‘তোমাদের প্রতি’। কবি ছিলেন শ্রী মধুকর কুমার কাঞ্জীলাল। সজনীকান্ত নজরুলকে ব্যঙ্গ করে লিখেছিলেন ‘ভান্ডারী হুশিয়ার’ (কান্ডারী হুশিয়ার)। লিখেছিলেন বহু আক্রমণাত্মক প্যারোডি, ব্যঙ্গ কবিতা। ক্রমাগত আক্রমণ শানিয়ে শেষে ব্যর্থ হয়ে রবীন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হলেন। রবীন্দ্রনাথ তার চিঠিতে লিখলেন,

কল্যাণীয়েসু,
কঠিন আঘাতে একটা আঙ্গুল সম্প্রতি পঙ্গু হওয়াতে লেখা সহজে সরচে না। ফলে বাক সংযম স্বতঃসিদ্ধ।

আধুনিক সাহিত্য আমার চোখে পড়ে না। দৈবাৎ কখন যেটুকু দেখি, দেখতে পাই, হঠাৎ কলমের আব্রু ঘুচে আছে। আমি সেটাকে সুশ্রী বলি এমন ভুল করো না। কেন করিনে তার সাহিত্যিক কারণ আছে। নৈতিক কারণ এ স্থলে গ্রাহ্য না হতেও পারে। আলোচনা করতে হলে সাহিত্য ও আর্টের মূলতত্ব পড়তে হবে। এখন মনটা ক্লান্ত, উদভ্রান্ত, পাপগ্রহের বক্র দৃষ্টির প্রভাব প্রবল, তাই এখন বাগবাত্যার দিগ দিগন্তে ছড়াবার শখ একটুও নেই। সুসময় যদি আসে তখন আমার যা বলবার বলব।

ইতি ২৫ শে ফাল্গুন, ১৩৩৩।
শুভাকাঙ্খী
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এ প্রসঙ্গে একটি কথা না বললেই নয়, ১৩৩৩ সালের ফাল্গুন মাসের ২৩ তারিখে সজনীকান্ত একটা পত্র লিখে নতুন সাহিত্য এবং সাহিত্যিকদের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথকে উত্তেজিত করার প্রথম পরিকল্পনা করেছিলেন। সজনীকান্তের সেই চিঠি এবং রবীন্দ্রনাথের সেই চিঠির উত্তর দুটিই শনিবারের চিঠিতে ছাপা হয়েছিল (আধুনিক বাংলা সাহিত্য – শ্রী সজনীকান্ত দাস, শনিবারের চিঠি, ভাদ্র ১৩৩৪)।

এই ঘটনার ঠিক মাসখানেক আগে নজরুল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সাথে হিন্দু মুসলমান বিরোধ সমস্যা নিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করার জন্যে তার বাড়িতে আসেন। রবীন্দ্রনাথ পাঁচ মাসের বিদেশ সফর সেরে (২৫ শে সেপ্টেম্বর ১৯২৪ থেকে ১৭ই ফেব্রুয়ারী ১৯২৫) সবে কলকাতায় এসেছেন। এই সময়ে দুই কবির ভিতরে অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল। নজরুলের ‘১৪০০ সাল’ কবিতাটি ছিল রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তার ‘১৪০০ সাল’ কবিতারই অনুসরণে লেখা।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *