prabandho-rupali-jyotsnai

রুপালি জ্যোৎস্নায় একরাশ গন্ধরাজ
মণিকা চক্রবর্তী


শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কাব্যসমগ্র কোলে নিয়ে বসে আছি। বিরাট এই রচনাবলীর ভিতর যেন তলিয়ে যাচ্ছি, যেন বহুবর্ণিল আর বিস্তৃত এক মহাসমুদ্র। ক্ষুদ্র থেকে বৃহতের এক মহাজাগতিক চেতনার ভিতর দিয়ে তিনি তার সময়কে উপলব্ধি করেছেন। সময়ের কাছে প্রবলভাবে সত্যকাম তিনি; অস্তিত্ব, বিবেক, প্রকৃতি সব মিলিয়ে তাঁর কবিতায় ঘনীভূত হয় এক অসাধারণ নন্দনতত্ব। এই কাব্যসমগ্রটিতে গ্রন্থিত হয়েছে, ন’টি কাব্যগ্রন্থ, একটি ছড়ার বই। শ্রেষ্ঠ কবিতার স্বীকারোক্তিতে কবি বলছেন, ’স্বভাবে আমি চিরদিন বাইরে দূরের মানুষ। জীবনকে ভালোবেসে নির্জনে নীলিমার দিকে ক্রমশ প্রসারিত হয়েছে আমার যাত্রাপথ। যত্নশীল প্রতিষ্ঠার দিকে লক্ষ রেখে কখনো কবিতা লিখিনি।’ সৃজনী বিবেকের উল্টোদিকে যখন কোনো সৃষ্টিশীল ব্যক্তি নিজেই প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেন বা উঠতে চান,তখন রচয়িতার মূল্যবোধ ও ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে দারুণ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তাই স্রষ্টার দেবায়নের ভিতর যে নিয়ত প্রবাহ, তাতে দীক্ষিত হয়ে, নিবিষ্ঠ থেকেই কবিতার বিশুদ্ধতা ও সূক্ষ্ম শিল্পকে আত্মস্থ করতে হয়। কবি তা জানতেন। তাই ব্যক্তিজীবনের প্রচন্ড ভগ্নদশাতেও তিনি নির্বিকার ও শান্ত। তাঁর কবিতাগুলোর ভিতর এত সূক্ষ্মতা, এত কোমলতা, এত আত্মখনন, এতটাই বৈচিত্র্যময় বিস্তার- তবুও রয়েছে, নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য রক্ষার নিজস্ব পদ্ধতি।

শ্রেষ্ঠ কবিতাগ্রন্থের একটি কবিতা ‘হলুদ পাখি’।

হলুদ পাখি
একটি হলুদ পাখি জলের ওপরে বাঁকা ডালে
স্থির বসে আছে – শুধু জলে ছায়া কাঁপে।
মনে হয় এ-ভাবেই অস্থির হলুদ-ছায়া থেকে
অন্য দিকে নয়ন ফেরালে
প্রকৃত সত্যের দেখা পাবো।
যাব। এই জলরেখা দৃষ্টির বিভ্রম নীচে রেখে,
হলুদ পাখির দিকে যাব।
শরীরী দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা কিছু কবিতা পাঠের পর, এই কবিতাটিতে এসে চুপচাপ স্তব্ধ হয়ে থাকি। শরীরের দ্বিধাগ্রস্ততা আর সংশয়ের মধ্যে এক স্থির বিশ্বাসের দিকে যাত্রা। দূর প্রসারিত দৃশ্যমান ও অদৃশ্য থাবার নীচে বসেও কবি ঠিক ঠিক অনুভব করেছেন, নিজ অস্তিত্বকে নিয়ে যাত্রা করেছেন, প্রকৃত সত্যের দিকে। চেতনাপ্রবাহে আশ্রয় পাওয়া হাজার বোধের মধ্যেও তিনি সময়চেতনায় নিবিষ্ঠ। নিজের কাছে সরে আসার আর আত্মস্থ হওয়ার শৃঙ্খলাকে শিল্পে পরিণত করার কথন এই কবিতায়। গভীরতর অন্তর্স্রোত ধাবিত হয় এক স্থিরতার দিকে।

শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থের আরেকটি কবিতা–

আর্কিমিডিসের শেষ দিন

সেনাপতি মার্সেলাস বলেছিল-আর্কিমিডিসের প্রতি যেন
কোনোরূপ অসম্মান দেখানো না হয়-
অথচ সমুদ্রতীরে রোমান বাহিনী এসে কীভাবে দাঁড়ালো!
নিয়তি-নির্দিষ্ট ছিল সাক্ষাতের বিশেষ সময়?
বিধ্বস্ত নগরী সেই সায়রাকিউজে..
আত্ম-সমাহিত এক মনীষীকে যখন পেয়েছে তারা খুঁজে,
সেখানে তখন ছিল স্নিগ্ধ হাওয়া, সিন্ধু পাখি, শান্ত বেলাভূমি!
সৈনিকের চোখে তবু শ্বাপদ দৃষ্টির রক্ত-আলো!
বালিতে অঙ্কিত ছিল জ্যামিতিক ছবি-
কী যেন রহস্যময় অভিনব রচনা-সংকেত, কিছু রেখা;
বর্বরতা বোঝে না সে মৌনভাষা, প্রতিভার গূঢ়-স্বপ্নলেখা:
সে শুধু সন্ধান করে জড়রাশি, বস্তু পরিচয়।
সৈনিক দাঁড়ালো এসে আর্কিমিডিসের কাছে, চিত্রিত গণিতে:
পাখিরা সহসা কিছু আতঙ্কে উধাও..
তখন প্রার্থনা যেন কুসুমকোমল:আহা, বৃত্তটি আমার
বিনষ্ট করো না, সরে যাও-
সে – মুহূর্ত সৈনিকের- কোনো দিব্য প্রতিভার নয়:

চকিত আঘাতে তাই বর্শামুখে বিদ্ধ হল অমল হৃদয়!

খুব সহজ করে লেখা এই কবিতাটিও চেতনার দরজাকে উন্মুক্ত করে দেয়, সাবলীলভাবে। মানুষ মানবিক মানুষ হবে, এটাই জগতের স্বাভাবিক দাবি। কিন্তু যতবার সে মানবিক হতে চেয়েছে, ততবার হয়ে উঠেছে নিষ্ঠুর থেকে নিষ্ঠুরতর। কোমলতার পক্ষে যে সত্য, তাকেই মাঝে মাঝে মনে হয় বিভ্রম! যে আত্মসমাহিত মানুষটি দাঁড়িয়েছেন অধিক কোমলতায়, তাঁরই অঙ্কিত বৃত্তের সামনে, নিষেধ ও করুণ আবেদন সত্ত্বেও তাঁর বুকে এসে বিদ্ধ হয়, সৈনিকের তীক্ষ্ণ বর্শা। এই সরল কবিতাটি অতি প্রবলভাবে, আমাদের স্নায়ুগুলোকে সজাগ করে তুলে। আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয়, সভ্যতার মাঠে ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ। নিহত নায়কেরা মিশে থাকে, মানুষের হৃদয়ে, উপন্যাসের হৃদয়ে, কবিতার হৃদয়ে। অস্তিত্ব রক্ষার বিষয়ে, অতিশয় বিপন্ন এই সব আত্মনিমগ্ন মানুষ। একদিকে বাইরের পৃথিবীর সংঘাত, অন্যদিকে নিজের স্থির সংকল্পের মাঝখানে দাঁড়িয়ে-যখন চারপাশে মৃত্যুর মরুভুমি। তবু এক অন্তঃপ্রেরণাগামী মানুষ অন্ধকারের খাদের সামনে দাঁড়িয়েও নিজ প্রদীপের আলোয় আমাদের সম্মোহিত করছেন।

তৃষ্ণা

অন্ধকার সমুদ্রজলে যেন ফসফরাসের নীলাভ আলো
তৃষ্ণা জ্বলে ওঠে নিজস্ব নিয়মে;
চিরদিন রক্তের প্রবাহে গভীর শিহরনে
অলৌকিক অস্তিত্ব রয়েছে তার…

মীরনের ছুরি কাব্যগ্রন্থের এই কবিতাটি চিরকালীন রহস্যের ভিতর আশ্রিত সেই সংকেতকে বহন করে। যাকে আমরা দিনের আলোতে আনতে চাই না। খুব সংযতভাবে বিলম্বিত লয়ে চলা এই কবিতাটি চিরকালীন সেই রহস্যময় তৃষ্ণার কথা বলে। মানুষের ভিতরে আলোর পাশাপাশি অন্ধকারের যে সত্ত্বা রয়েছে, সেই পরিণতিহারা রহস্যময়তার তৃষ্ণা মানুষকে পতনের অভিজ্ঞতার পরেও তীব্রভাবে ডাকে। সেই ডাকে কাঙাল হয়ে, ‘অনিবার্য মধ্যনিশীথে তাই বন্দর ছেড়ে যায় দূরগামী সব জাহাজ:/অন্ধকারে পাড়ি দিতে চায় আবছা দ্বীপ -দ্বীপান্তরে।’ মানুষ ও প্রকৃতির এই রহস্যময় অজানা দিকটি রয়েছে,আজও আলো -আঁধারিতে। সকল যুক্তির বাইরে যেয়েই ,সকল সাবধানবানী উপেক্ষা করেই, মানুষ পরিণতিহারা প্রেমের দিকে এগোবে। জার্মান কবি হোল্ডার্লিন, শেষ বয়সে বিবাহিতা এক রমণীকে ভালবেসে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। কেন এই রহস্যময়তা, কেন এই দিকভ্রান্তি, কেন এই তৃষ্ণার ডাক, কেন এই বিশেষ ফাঁদ, কেন এক সত্ত্বা থেকে অন্য সত্ত্বায় অন্ধকারে পারাপার-তা কেবলিই রহস্যজালে হাবুডুবু খাওয়া। কবিতার পরতে পরতে মনোজগতের পরম্পরার এক ঘনীভুত রূপ দেখি। কবিতাগুলো আমাকে মুগ্ধ করে।

‘রত্নকুসুমের বনে’ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা আমার বেশ শক্তিশালী মনে হয়। ছোট্ট, নমনীয়, অথচ খুবই সুস্থিত এই কবিতাটি আমায় মুগ্ধ করে, তার গভীর অর্ন্তদৃষ্টির ভিতর দিয়ে।

‘ঝাড়খন্ডে এক আদিবাসী গ্রামে’ কবিতার প্রথম লাইনটিই যেন আমাকে তীব্রগতিতে নিয়ে যায় বিভূতিভূষণের আরণ্যকের বর্ণনায়। ‘এখন অরণ্যে যেতে ভয় করে-মারাত্মক ভয়-’ ভাবনার এই গড়ন আমাদের চেনা। আধুনিক সভ্যতার বিস্তার কেমন করে লুট করে নিয়েছে বন্যতাকে তার অনেক বিবরন আমরা পেয়েছি, আরণ্যক উপন্যাসের পাতায় পাতায়। সত্যচরণ জানতো, লবটুলিয়া, ফুলকিয়া, বইহারের অপরূপ প্রকৃতি অবশ্যই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে যাবে। তাই তার মনে অপরাধবোধ ও ভয় ছিল। কিন্তু তখনও রাষ্ট্র কীভাবে সহযোগী হয়ে, তার দাঁত-নখ বের করে বিশাল অরণ্যের জনগোষ্ঠীকে অনিশ্চিত জীবনের পথে ঠেলে দেয়, তার কথা আরণ্যকের সত্যচরণ ভাবেননি। ‘বৃক্ষের আড়াল থেকে চোরা-গুলি, না হয় মাটিতে সহসা পায়ের নীচে বিস্ফোরণে উড়ে যেতে পারি!’ কিন্তু এই কবিতায় তা যেন স্পষ্টভাবে বলে দেয়- ‘বাতাস এখানে যেন রুদ্ধশ্বাস। সাবধানে দেখি কোনোদিকে- সামান্য নড়েছে কিনা শান্ত লতাপাতা-এত অনিশ্চিত এই পরিবেশ!/ আমার স্বদেশে স্বাধীন ভ্রমনসুখ আর বুঝি কখনো পাবো না।/আদিবাসী গ্রাম থেকে ফিরে আসি, বনরেখা দেখে–

শতশত বছর ধরে অরণ্যের এই নিবিড় একান্ত মমতাময় পরিবেশকে গুড়িয়ে দিচ্ছে রাষ্ট্র নামক চাকার শক্তি, ক্রমেই ভারসাম্য হারাচ্ছে মানুষ ও প্রকৃতির নিবিড় সহাবস্থান। বনবাসী মানুষ তার নিজস্ব ভুমি ও জীবন থেকে উৎখাত হয়ে স্থান নিয়েছে, শহরের হাইওয়েতে। কবিতাটিতে এই গভীর ও বাস্তব বিষয়টি উঠে এসেছে অবলীলায়। শান্ত লতা-পাতারা বাতাসের দোলায় একটুকু নড়তেও ভয় পাচ্ছে।

শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থের আরেকটি কবিতার মধ্যে এক তীব্র অনুভবকে পেলাম। শব্দগুলোকে মনে হল আশ্চর্য নতুন। জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে কবির স্বরূপকে একটিবার দেখে নেবার এক বিস্ময়কর দৃষ্টি পেলাম, এই কবিতায়। কবির জীবন, যেন এক কঠোর শ্লেষের মতো। অথচ, কবিতাটি তারপরেও দিয়ে যায় সুগন্ধের ঢেউ। কবিতাটির নাম ‘ষ্টোন কাটারস্ আইল্যান্ডে একা’। আহা, কবির সেই পাথর কাটার জীবন। ভাষার ভিতর ভাঙাগড়া,ভাষার ভিতর সূক্ষ্ম নকশার কাজ। যেন কঠিন পাথর ভেঙে মূর্তি গড়ার কাজ।

হীরা–চুনি–পান্না নয়, দুঃখের পাথর কেটে দিন চলে যায়…
জীবনের সুকঠিন ভাস্কর্য এমন অভিনব:
যদি বেঁচে আছি তবে শব্দের ভিতরে বেঁচে আছি।
পাথরে আঘাত করি…স্ফুলিঙ্গ জোনাকি ঝরে পড়ে,
এই সুখ হাতে নিয়ে ফিরে যাব সূর্যাস্ত-হাওয়ায়।

কত ছোট্ট আর হাল্কা মেজাজের এই কবিতাটি কত অবলীলায় কবিজীবনের গভীর কথাগুলো বলে ফেলে। যেন কবির ভিতরে থাকা তীব্র শক্তি আশ্চর্যভাবে উচ্ছসিত হয়ে তার পাথুরে জীবনের ভিতরে উছলে উঠে।

এই কাব্যগ্রন্থটি পড়তে পড়তে একজন বিরাট চিত্রশিল্পীর একটি লাইন মনে পড়ল। তিনি পিকাসো। তিনি বলতেন, ‘শিল্পীর পাঁচটি আঙ্গুল,প্রতিটিই অপরিহার্য।’ এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোও যেন পাঁচটি আঙ্গুলেরই কর্মদক্ষতার প্রতীক। কবির চারপাশের জগতের ভাঙ্গন, গড়ন, হাহাকার, অন্ধকার, আলো, দন্দ্ব সব কিছু নিয়েই তিনি চলেছেন কবিতার দূর্গে। সমস্ত ভাবনাকে ছেঁকে ছেঁকে তুলছেন কবিতায়। একটি কবিতা থেকে অন্য কবিতায় যাবার পথে যে অবারিত পৃথিবী, সেগুলির ভিতর দিয়ে এক বিশাল সমগ্রতাকে অবলোকন করেছেন কবি। তিনি তাঁর সময়ের কাছে একনিষ্ঠ। পুরো কাব্যগ্রন্থটি যেন তার সকল নির্মাণ নিয়ে এক নির্বানের পথে ধাবিত।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *