সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
এই প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য এই সময়ের গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ নিয়ে কিছু অভিমত তুলে ধরা। পূর্ববর্তী কথাসাহিত্যের চেয়ে সাম্প্রতিক কথাসাহিত্য কি দুর্বল হয়ে উঠছে? অনেকেই বলেন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো কথাসাহিত্য এখন আর চোখে পড়ে না। পাঠক বা সমালোচকের এমন দাবি কতটা বাস্তবসম্মত? কিংবা তাদের আক্ষেপ ঠিক কোথায়? সাহিত্যে সময়ের ছাপ বিদ্যমান। কালের বিবর্তনে তাই তার গতি-প্রকৃতি পাল্টে যেতেই পারে। তাই বলতেই পারি, সমকালেও উৎকৃষ্ট কথাসাহিত্য রচিত হচ্ছে। সেটি হয়তো পরবর্তী প্রজন্ম উপলব্ধি করতে পারবে। সমকালে বসে সমকালের সাহিত্য বিচার করা অতটা সহজ নয়। যতটা সহজ পূর্ববর্তী সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করা। প্রথমেই যদি বলি, গল্প বা উপন্যাস কী? তাহলে বলবো, পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষের জীবনজুড়েই যেন গল্পের বিস্তার। আনুষ্ঠানিক গল্পের কথা বাদ দিলে মানুষের গল্প বলার প্রবণতা সেই আদিমকাল থেকেই। পাহাড়ের গুহায় বসবাসরত মানুষ তখনই গোত্রের মধ্যে গল্প বলতো। শিকার করে এসে জানাতো, তারা কীভাবে প্রাণীটি শিকার করেছেন। তখন তাদের মুখে ভাষা ছিল না। ছিল আঙ্গিকের ব্যবহার। গল্প বলার সেই তো শুরু। গল্প বলার আরও অনেক প্রবণতা আছে। সেগুলো ভিন্ন নামে ভিন্ন আঙ্গিকে মানুষের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে। ধর্মের কাহিনি, ইতিহাস বা যুদ্ধ জয়ের কাহিনিকেও গল্প বলা যেতে পারে। ছোট ছোট গল্প কখনো কখনো বড় হয়ে রূপ নিয়েছে উপন্যাসে।
আমাদের আশেপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোই লেখকের কলমে গল্প বা উপন্যাস হয়ে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মানুষের নানাবিধ অনুভূতির প্রকাশ ঘটায়। আমাদের না বলা কথাগুলো গল্প-উপন্যাস হয়ে যখন আমাদের সামনে হাজির হয়, আমরা তখন আপ্লুত হই। যেন আমার জীবনের গল্পটিই বলেছেন লেখক। নিজের অজান্তেই ভিজে ওঠে চোখের কোণ। শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায় অবনত হই লেখকের কল্যাণে। এই যে দীর্ঘ জীবনের এত এত গল্প-কাহিনি, আমরা কি কখনো প্রকাশ করতে পেরেছি? হয়তো পারিনি। আমার না পারা সেই কাজগুলোই করে দিচ্ছেন একজন কথাশিল্পী। আমাদের জীবন-মৃত্যু, প্রেম-প্রতারণা, মিলন-বিরহ, আশা-নিরাশা, পাওয়া-না পাওয়া, সফলতা-ব্যর্থতা; সবই তো উঠে আসে তার লেখায়। আমরা সেগুলো পড়ে প্রীত-আবেগাপ্লুত হই। চরিত্রের মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করি। সংকট ও হতাশা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজি। এতেই যেন লেখকের সফলতা নিহিত। এই সফলতা-ব্যর্থতার দোলাচলে কালে কালে গল্প-উপন্যাস ধরন পাল্টায়। লেখক-পাঠকের সম্পর্ককে মজবুত করে। লেখককে পাঠকের কথা ভাবতে শেখায়। তাই ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে লেখার ধরনেও আসে পরিবর্তন। কাহিনির উপজীব্য হয়ে ওঠে নানা অনুষঙ্গ। সেই অনুষঙ্গ উঠে আসে সমকাল থেকে। শিক্ষা নেয় ইতিহাস থেকে। প্রত্নতাত্ত্বিক চেতনাও জাগ্রত হয় মাঝে মাঝে। এমন ধারাবাহিকতায় এগিয়ে যায় গল্প-উপন্যাস, এগিয়ে যান কথাশিল্পীরা। ফলে ব্যক্তির আবেগ-অনুভূতি-ভালোবাসা-বিরহ-যাবতীয় বিষয় উঠে আসে কাহিনিতে। তখন অ্যানালগ যুগের কাহিনি আর ডিজিটাল যুগের কাহিনির মধ্যেও পার্থক্য সূচিত হয়। উপাদানে আসে ভিন্নতা।
পাহাড়ের গুহা বলি আর চাকচিক্যময় রাজপ্রাসাদ বলি—সমকালীন প্রভাবটা সব সময়েই ছিল। মাঠ থেকে রাজনীতির মঞ্চ, ঘর থেকে বিশ্বমঞ্চ—সর্বত্রই সমসাময়িক অবস্থা বা বিষয়কে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে গল্প-উপন্যাসের আদ্যোপান্ত। তারই ধারাবাহিকতায় বর্ণনায়, পোশাকে, জীবন-যাপনে এবং ভাষায়ও পরিবর্তন এসেছে। যুগে যুগে সংস্কৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যেরও চেহারা বদলেছে। গ্রামীণ আবহ থেকে শুরু করে নাগরিক যন্ত্রণা—কোনকিছুই বাদ যায়নি। মানুষের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তনের পাশাপাশি কাহিনিতেও পরিবর্তন এসেছে। পরাধীন দেশের গল্পও একদিন স্বাধীনতা লাভ করেছে। উঠে এসেছে পরাধীনতার গ্লানি, জয়ের আনন্দ, দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা, যোদ্ধার স্বদেশ প্রেম ইত্যাদি। ক্ষমতার পালা বদলের সঙ্গে সঙ্গে বিষয়-ভাবনাও আবর্তিত হয়েছে সব সময়। রাজনীতি-ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চরিত্রে ফুটে উঠেছে সুচারু রূপে। অতীতের গল্পে জমিদার থেকে শুরু করে খেটে খাওয়া মানুষ, কুসংস্কার থেকে সামাজিক সংস্কার, সাংস্কৃতিক বিপ্লব, শ্রমিক শ্রেণির দাবি, রাজপরিবারের উত্থান-পতন, মানব-মানবীর মিলন বা বিরহগাথাসহ প্রভৃতি বিষয় আলোচিত হয়েছে। সাম্প্রতিক গল্প-উপন্যাসে অতীতের ছায়া তো রয়েই গেছে। বরং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন উদ্ভাবন। পাল্টে গেছে কষ্টের ধরন। মিলনের আকাঙ্ক্ষা নিয়েছে ভিন্নরূপ। মানুষের হতাশা, হঠকারিতা, বিশ্বাসহীনতা, উগ্রতা যেন ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে।
অনগ্রসর জনগোষ্ঠী যখন সমৃদ্ধশালী হতে থাকে—সেই অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চিন্তা-ধারায়ও পরিবর্তন আসে। এমনকি তা অবলীলায়েই এসেছে। বিজ্ঞানের উৎকর্ষের ফলে আমাদের হাতে এসেছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। সেই প্রযুক্তির কল্যাণে সুবিধার পাশাপাশি অসুবিধাও কম নেই। এমন সব বিষয়গুলোও উঠে আসে সাম্প্রতিক কথাসাহিত্যে। শিরোনাম, বর্ণনা, চরিত্র, ফ্যাশন, পরিণতিতে বিরাট প্রভাব ফেলছে। এই পরিবর্তনকে অস্বীকার করা যায় না। মেনে নিতে হয়। মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার নামই তো আধুনিকতা। বাংলা গদ্যের এই জন্মলগ্ন ১৮০১ সালে হলেও আধুনিকতা তো শেষ হয়ে যায়নি। বরং চরমতম আধুনিক সময় পার করছি আমরা। আর আধুনিক সময়ের যন্ত্রণা আরও আধুনিক। তা প্রকাশের ভঙ্গিও আলাদা। পারিবারিক বলয় থেকে আমরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনের কথাও ভাবতে শুরু করেছি। উঠে আসছে সংগ্রামী প্রবাস জীবন। কখনো কখনো আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পা রাখছেন আমাদের দেশের কথাশিল্পীরা। দেশের গণ্ডি থেকে তাদের লেখা পৌঁছে যাচ্ছে ভিনদেশিদের কাছে। আমাদের হাতেও পৌঁছে গেছে ভিনদেশি সাহিত্য। একটি দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি পৌঁছে যাচ্ছে কথার ডানায় ভর করে।
একসময় পাঠকের সীমাবদ্ধ জগৎ ছিল। যোগাযোগব্যবস্থা অনুন্নত থাকায় তুলনার জায়গাটি দুর্বল ছিল। তখন কেবল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হয়ে রবীন্দ্রনাথের হাতে গড়া গল্প-উপন্যাস পর্যন্ত পাঠকের হাতে পৌঁছেছিল। তাদের দেখানো পথ ধরে হেঁটে এ সময়ে নবীনদের হাতেও সমুজ্জ্বল বলা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমসাময়িক বা তার পরবর্তী লেখকদের ভেতরে রাবীন্দ্রিক টান থেকে গেলেও এ সময়ের লেখকরা অনেকটা সেই টানমুক্ত হাতেই লিখছেন। এখনো যে গল্পগুলো মানুষের মুখে মুখে, তার স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যয়, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ, দেবেশ রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সোমেন চন্দ প্রমুখ। তারা যে ধারায় লিখে গেছেন; তা থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়াস লক্ষ্য করেছি আমরা। তবে তাদের চরিত্রগুলো এখনো মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। সাম্প্রতিক কোনো চরিত্র সেভাবে কারও হৃদয় ছুঁয়েছে কি না, জানা নেই। এখনো যেমন ফটিক, হৈমন্তী, কাদম্বিনী, বিলাসী, গফুর, আমেনারা পাঠকের অন্তরে স্থান করে আছেন।
শুধু তা-ই নয়, এ সময়ের কোনো কোনো লেখা বুঝে উঠতেও পাঠককে হোচট খেতে হয়। কোনো কোনো গল্প-উপন্যাস পড়তে বাংলা অভিধান নিয়ে বসতে হয়। বেশিরভাগ লেখায় কাব্যিক টোনটা থেকে যায়। প্রাসঙ্গিক কারণে কবিতা আসতেই পারে। তবে কাহিনি নির্মাণে যদি কবিতার মতো ধোঁয়াশা থেকে যায়, তাহলে পাঠকের বুঝে ওঠা কঠিনই বটে। ফলে সেটা না হয় গল্প-উপন্যাস, না হয় কবিতা। পাঠকই যদি সারমর্ম বুঝতে না পারেন, তবে সেই লেখা কার জন্য? এ ছাড়া কোনো কোনো লেখককে দেখা যায়, একই কথা ঘুরিয়ে পেচিয়ে কিছুটা লম্বা করা ছাড়া আর কোনো কৃতিত্ব নেই। তারা শুরু এবং শেষটা চমৎকৃত করতে পারেন না। কাহিনি ও চরিত্র নির্মাণে মাধুর্য থাকে না। চাবুক হাকড়ানো সমাপ্তি নেই। খুঁজে পাওয়া যায় না কোনো নাটকীয়তা। সংলাপে থাকে না আকর্ষণ। একটি ঘটনাকে শুধু ঘটনার মতো করে বর্ণনা করাই লেখকের কাজ নয়। ঘটনাকে শিল্পসম্মত করে উপস্থাপন করাই তার কাজ হওয়া উচিত।
কখনো কখনো একই ধাঁচের, একই ধারার, একই কাহিনির, একই প্যাটার্নের গল্প-উপন্যাস বারবার ঘুরেফিরে আসে। তাদের গল্পে চিন্তার গভীরতা নেই। মানুষের জন্য বিশেষ বার্তা নেই। সমাজের কল্যাণ নেই। মাঝে মাঝে কাহিনির ঐক্যও থাকে অনুপস্থিত। লেখক হয়ে ওঠার প্রাণান্তকর চেষ্টাও তাদের মধ্যে নেই। সাময়িক বাহবা বা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশংসার জোয়ার তাদের ভুল পথে পরিচালিত করে। তবে এর ভেতর থেকেও কেউ কেউ নিজের অবস্থানকে শক্ত করে নিতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ প্রশংসাও কুড়িয়েছেন। অনেকেই হয়তো টিকে যাবেন। আবার অনেকেই অকালে ঝরে যাবেন। তবে নতুন নতুন উপাদান তুলে আনছেন অনেকেই। প্রেক্ষাপটের সঙ্গে চরিত্রের দারুণ সমন্বয় করতে পেরেছেন। অন্যদিকে কপি করা, থিম চুরি করার মতো অভিযোগও উঠে আসে কখনো কখনো। অহেতুক যৌনতার ছড়াছড়ি লক্ষ্য করা যায়। তবে যৌনতাকে শৈল্পিক রূপে প্রকাশ করলে তার একটি নান্দনিক দিক ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। অথচ রগরগে বর্ণনা, অযাচিত দৃশ্য উপস্থাপন করে পাঠক ধরার চেষ্টা করলেও প্রকাশ্যে পাঠকের বিরাগভাজন হন অনেকেই। মাঝে মাঝেই ‘সাহিত্যে যৌনতা’ বিষয়ে কিছু অভিমত প্রকাশিত হয়। তাতেই স্পষ্ট হয়—আসলে যৌনতা সাহিত্যের জন্য অপরিহার্য না হলেও অপ্রাসঙ্গিক নয়; তবে তার ব্যবহার হতে হবে মার্জিত।
বিষয় নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ বটে। যুগ যুগ ধরে একই বিষয় নিয়ে বহু গল্প-উপন্যাসের জন্ম হয়েছে। তাই বিষয় নির্বাচনে সচেতন হওয়া জরুরি। তা না হলে পাঠকই বলে উঠবেন, এমন একটি গল্প আগেও হয়তো পড়েছিলাম। তাই বিষয় নির্বাচনে পূর্বাপর গল্প সম্পর্কে ধারণা রাখা প্রয়োজন। অনেকেই আবার বাংলা লেখাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বন করেন। অথচ দেশে এখনো বিষয়ভিত্তিক গল্প, নতুন ধরনের প্রেক্ষাপট অহরহ তৈরি হচ্ছে। লেখককে শুধু সেটাকে ফাইন্ডআউট করতে হবে। ‘আমি অমুকের মতো লিখতে চাই’ না বলে ‘আমি আমার মতো লিখতে চাই’—এ কথা ভাবতে হবে। এ সময়ে যারা লিখছেন, তারা ভালো লিখছেন না—এমনটি বলার সুযোগ নেই। বাংলা সাহিত্যের মান দিন দিন উন্নত হচ্ছে। প্রাচীন ধ্যান-ধারণাকে পেছনে ফেলে নাগরিক যন্ত্রণা, আন্তর্জাতিক চক্রান্ত, মানবতা বোধ, মানবিক বিকার, ক্ষমতার দৌরাত্ম্য—সবকিছু উঠে আসছে সাম্প্রতিক কথাসাহিত্যে। এখনো স্থান পাচ্ছে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সুখ-দুঃখসহ নিখাদ ভালোবাসা। অন্ত্যজ শ্রেণির সংগ্রাম-উত্তোরণ ঠাঁই করে নিচ্ছে সাম্প্রতিক কথাসাহিত্যের কংক্রিট দেওয়ালের মাঝখানে। হাওয়া বদলের এই সময়ে বদলে যায় আমাদের মন ও মগজ। সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে হাজির হয় সামনে। ফলে আজকের হতাশ লেখকও ভবিষ্যতে বাক বদলের, যুগ বদলের আবিষ্কর্তা হিসেবে ভূষিত হবেন। হয়তো ভবিষ্যতে আলোচিত হবেন এ সময়ের লেখকও। সময়ই তাদের সাক্ষী হয়ে থাকবে। যুগই তাদের স্মরণ রাখবে।
গল্প-উপন্যাসের প্রসঙ্গ থেকে চোখ সরালে দেখা যায়, অনেকেই বলেন, ইদানিং ভালো প্রবন্ধ চোখে পড়ছে না। কেউ আসলে প্রবন্ধ লিখছেন না। লিখছেন কবি-লেখকের স্তুতিবাক্য। কোনো দিকনির্দেশনা নেই। সম্পর্কের চর্চা শুরু হয়েছে যেন সাহিত্যকে ঘিরে। ফলে নতুন যারা সাহিত্যচর্চা করতে আসছেন, তারাও সম্পর্কচর্চায় জড়িয়ে পড়ছেন। একজন কবি চাইলে শক্তিশালী প্রাবন্ধিক হয়ে উঠতে পারেন। যা আমরা আগেও দেখেছি। তবে এখনকার কবিদের যেন অনীহা প্রবন্ধ লেখায়। কবির সংখ্যা বাড়লেও প্রাবন্ধিকের সংখ্যা বাড়েনি। একইভাবে বেড়েছে ঔপন্যাসিক ও গল্পকারও। ফলে কথাশিল্পীর বড়ই অভাব। আমরা জানি, ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন শাখার উদ্ভব হলো, যাকে আমরা প্রবন্ধ সাহিত্য বলি। এ প্রবন্ধ রচিত হয় গদ্যে। প্রবন্ধের ভিত্তি মানুষের চিন্তা, মনন ও তত্ত্ব। তথ্য ও যুক্তির সাহায্যে মননজাত কোনো বিষয়ের প্রতিষ্ঠা দান করাই প্রবন্ধের লক্ষ্য। কিন্তু প্রবন্ধের সেই লক্ষ্য কি অর্জিত হচ্ছে? যদি না হয়, তা হলে কেন হচ্ছে না—সে বিষয়ে কি কেউ ভেবে দেখেছেন? ভাবেননি। আর ভাববেন কি না, তা-ও গবেষণার ব্যাপার।
বাংলা সাহিত্যে এখনো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, বুদ্ধদেব বসু, সৈয়দ আলী আহসান, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদের লেখা প্রবন্ধই পাঠযোগ্য। সাহিত্যের ধারা, বাঁক বদল কিংবা গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে নতুন কোনো প্রবন্ধ চোখে পড়ছে না। দৈনিকের সাহিত্যপাতা, ওয়েবম্যাগ, লিটল ম্যাগ, কিংবা অনলাইন পোর্টালে চোখ রাখলেও আশানুরূপ প্রবন্ধ খুঁজে পাওয়া যাবে না। যদি এখন দৈনিকের পাতা কমে এসেছে। কেউ কেউ একপাতায় কাজ করছেন। লিটলম্যাগ হিমশিম খাচ্ছে বিভিন্ন কারণে। ওয়েবম্যাগ যতটা বিপ্লবের কথা বলে ততটা অগ্রসর এখনো হতে পারেনি। আমরা কেউই এ কথা তো অস্বীকার করতে পারি না যে, বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে সাধারণত জ্ঞান, বিজ্ঞান, ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সাহিত্য, শিল্প ইত্যাদি চিন্তামূলক ও তত্ত্বমূলক বিষয় গদ্যাকারে প্রকাশিত পায়। এ সমস্ত লেখার পেছনে থাকে যুক্তি। কোনো চিন্তাগ্রাহ্য বিষয়কে লেখক যখন যুক্তির সাহায্যে প্রতিষ্ঠা করতে চান, তখনই তা প্রবন্ধ হয়ে ওঠে। এ সময়ের কতজন প্রাবন্ধিক আছেন, যারা কি না যুক্তি, চিন্তা, তত্ত্বকে প্রাধান্য দেন? যারা এসবের গুরুত্ব দেন, তারা নমস্য। বেশিরভাগই সংবাদের মতো বিবরণসর্বস্ব গদ্য প্রকাশ করে থাকেন। যাতে থাকে নিজের চিন্তার লেশ, থাকে না কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তি। ফলে এসব গদ্য পড়ে মানুষও পায় না মুক্তি। মূলত এসব লেখা পৃষ্ঠা ভরানোর জন্য যথেষ্ট হলেও কোনো সিদ্ধান্তে আসার ক্ষেত্রে কাজে লাগে না।
এবার আসি মূল কথায়, আমরা প্রবন্ধকে দুভাগে ভাগ করেছি—তন্ময় বা বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ এবং মন্ময় বা ভাবনিষ্ঠ প্রবন্ধ। তন্ময় বা বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধে লেখক নিরাসক্তভাবে বিষয়ের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে যুক্তিশৃঙ্খলার মাধ্যমে গভীরভাবে বিষয় বিশ্লেষণ করবেন। চিন্তাশীল অনুসন্ধানী পাঠক এ জাতীয় প্রবন্ধের অনুরাগী। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বাঙ্গালা ভাষা’ বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধের অন্তর্ভুক্ত। এ ছাড়াও বঙ্কিমচন্দ্রের ‘প্রবন্ধপুস্তক’, জ্যোতিরিন্দ্র নাথের ‘প্রবন্ধমাধুরী’, রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের ‘নানা প্রবন্ধ’, কাজী মোতাহের হোসেনের ‘সংস্কৃতি কথা’ প্রভৃতি তন্ময় বা বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ। মন্ময় বা ভাবনিষ্ঠ প্রবন্ধকে ব্যক্তি প্রবন্ধ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। এ ধরনের প্রবন্ধে বিষয় অপেক্ষা লেখক পাঠককেই বেশি গুরুত্ব দেন। নিজের অনুভূতিকে পাঠকের অনুভূতি ও সংবেদনশীলতার সঙ্গে সংযুক্ত করতে চান। এ জাতীয় প্রবন্ধে লেখকের ব্যক্তিসত্তার আত্মপ্রকাশ ঘটে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ ও ‘লোক রহস্য’, রবীন্দ্রনাথের ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ এ রচনার অন্তর্ভুক্ত। এখন কেউ যদি লেখকের স্তুতিবাক্যকে মন্ময় বা ভাবনিষ্ঠ প্রবন্ধ বলে চালিয়ে দিতে চান, তাহলে অবাক হবো না। কারণ প্রকৃতপ্রস্তাবে সমালোচনা হজম করার মতো শক্তিও কবি-লেখককে অর্জন করতে হয়। কবি-লেখকের দুর্বলতা বা খামতিকে কোনো প্রাবন্ধিক তুলে আনলে, তা সহজেই গ্রহণকরা বাঞ্ছনীয়। পদভারে বা পদমর্যাদায় আবিষ্ট কোনো লেখক তার লেখার খামতি অন্য কারো মুখে শুনতে চান না। সাহিত্য সমাজে তাতে তার ব্যক্তিত্বকে ক্ষুণ্ন করতে পারে বলে হীনম্মন্যতায় ভুগতে থাকেন। আবার প্রাবন্ধিক নামধারী কিছু চাটুকার নিজ স্বার্থ উদ্ধারে মরিয়া হয়ে স্তুতিবাক্যকে প্রবন্ধ বলে চালিয়ে দিতেও কুণ্ঠিত হন না।
এছাড়া প্রবন্ধ দুধরনের হতে পারে—ভাবগম্ভীর ও লঘু। লঘু রচনা কখনোই ভাবগম্ভীর রচনার মতো হবে না। এমনকি প্রবন্ধে তুলনামূলক বিচার করতে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য বিশ্লেষণ করতে হয়। সব মিলিয়ে প্রবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয়ের চেয়ে অপ্রাসঙ্গিক বিষয় প্রকট হয়ে ওঠে। কবি-লেখকের কাহিনি বিন্যাস, চরিত্র নির্মাণ, শিল্পরূপ, ভাষাশৈলী, ছন্দজ্ঞান, অলঙ্কার সম্পর্কে ধারণা, রচনাশৈলীর চেয়ে তার ব্যক্তিগত ক্ষমতা, পদ-পদবী, কতবার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন—এসব বিষয়ই মূখ্য হয়ে ওঠে। আলোচিত লেখকও এসবেই বাহবা দিতে থাকেন। ফলে নিজের লেখার ঘাটতি সম্পর্কে তার কখনোই জানার সুযোগ হয় না। একটা জীবন আবর্জনা লিখে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলেতে পরলোক গমন করেন। যে কারণে মৃত্যুর পরের দিনই কেউ আর তার লেখা সম্পর্কে আলোচনা করেন না। করার আগ্রহও তৈরি হয় না। এমনকি ক্ষমতাবান ওই কবি-লেখক অবসরে গেলে তাকে আর মূল্যায়ন করা হয় না। যতটা করা হতো তার জীবদ্দশায় বা ক্ষমতারোহণ কালে।
এতক্ষণ প্রবন্ধ বিষয়ে যে কথাগুলো বলেছি, তাতে অনেকেই রুষ্ট হবেন। তার জন্য কিছু সহজ সমাধানও জরুরি বলে মনে করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে আমাদের প্রবন্ধ লেখার সময় চিন্তা, মনন ও তত্ত্বকেই প্রাধান্য দিতে হবে। প্রবন্ধকে হতে হবে মস্তিষ্ক প্রসূত রচনা। এখানে তথ্য, তত্ত্ব, যুক্তি, তর্ক, সিদ্ধান্ত হবে প্রধান উপকরণ। এ ছাড়া আমরা শুধু সাহিত্য নিয়েই নিয়মিত প্রবন্ধ লিখে যাচ্ছি। তাও ব্যক্তির সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। সময় বা প্রেক্ষাপট এখানে অনুপস্থিত। ফলে প্রবন্ধ সাহিত্যে জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম প্রভৃতি বিষয়সমূহ উপেক্ষিত হয়ে থাকে। এর যে কোনো বিষয় সম্পর্কেই লেখকের চিন্তাগ্রাহ্য তত্ত্বকে কেন্দ্র করে সফল প্রবন্ধ তৈরি হয়ে উঠতে পারে। কবি-সাহিত্যিককেও হতে হবে জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম সচেতন। যুগে যুগে যে কোনো বিপ্লবে প্রাবন্ধিকের ভূমিকাও অনস্বীকার্য।
আমাদের মনে রাখা উচিত, একজন প্রাবন্ধিকের বৈশিষ্ট্য কী হওয়া জরুরি। কেননা যিনি প্রবন্ধ রচনা করছেন, তাকে বুঝতে হবে তন্ময় প্রবন্ধের ক্ষেত্রে যুক্তিনিষ্ঠা ও ভাবনার নির্দিষ্ট শৃঙ্খলা থাকতে হবে। এতে তত্ত্ব ও তথ্যের লক্ষণীয় প্রাধান্য থাকতে হবে। তার ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতির চেয়ে বস্তুনিষ্ঠা বেশি প্রধান্য পাওয়া উচিত। এমনকি প্রবন্ধের বিষয় সম্পর্কে প্রবন্ধকারের থাকবে নিঃস্পৃহতা ও নিরপেক্ষতা। বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ রচনার সময় লেখকের ভাষা ব্যবহারে সতর্কতার মাধ্যমে প্রবন্ধের বক্তব্য উল্লেখিত হবে। তবে মন্ময় প্রবন্ধের ক্ষেত্রে যুক্তি ও মননশীলতার পরিবর্তে হৃদয় আবেগেরই প্রাধান্য থাকতে হবে। প্রবন্ধের বিষয়বস্তু ভাবরসে জারিত হয়ে পাঠকের হৃদয়কে স্পর্শ করবে। সরস, মর্মস্পর্শী, আত্মকেন্দ্রিক ভঙ্গিতে পাঠকদের কাছে টেনে নেবেন। বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধকারের মতো মন্ময় প্রাবন্ধিক সোচ্চার বা উদ্দেশ্যতাড়িত নন বরং আত্মমগ্ন ও কিছুটা রহস্যময়। মন্ময় প্রবন্ধ মূলত ব্যক্তিগত নৈর্ব্যক্তিক নয়। তাই ভাষার ব্যবহারে প্রবন্ধকার অনেক বেশি স্বাধীনতা পাবেন এবং পাঠকের সঙ্গে আন্তরিক বিনিময় গড়ে তুলতে পারেন।
প্রবন্ধকে সার্থক করে তোলার দায়িত্ব লেখককেই নিতে হবে। তাই একটি প্রবন্ধ রচনার আগেই লেখককে কিছু প্রস্তুতি নিতে হয়। যে কাজগুলো আগেই নিজেকে স্থির করে নিতে হয়। প্রাবন্ধিকের লক্ষ্য থাকা উচিত সবধরনের পাঠকের প্রতি। একজনকে সন্তুষ্ট না করে তিনি পুরো পাঠকসমাজকে উপকৃত করতে পারেন। তাহলেই তিনি প্রাবন্ধিক হিসেবে নমস্য হয়ে উঠবেন। আগামী প্রজন্মকেও প্রবন্ধ রচনায় দিকনির্দেশনা দিতে পারবেন। সাম্প্রতিক প্রবন্ধ চর্চার অন্তরায় হিসেবে অনেক কিছুই উঠে আসতে পারে। এরমধ্যে অন্যতম হতে পারে বিজ্ঞ সম্পাদকের অভাব। ফলে যারা সম্পাদনা করছেন, তাদেরও প্রবন্ধ সম্পর্কে ব্যুৎপত্তি অর্জন করতে হবে। বেশিরভাগ প্রবন্ধই যেন মন্ময় বা ভাবনিষ্ঠ না হয়ে যায়। সম্পাদকের নির্দেশনাও প্রাবন্ধিককে সঠিক পথে পরিচিালিত করতে পারে। এছাড়া বেশি বেশি পড়তে হবে। তথ্য ও তত্বের জন্য বেশি বেশি পড়ার কোনো বিকল্প নেই। লেখকের পাণ্ডিত্য এমনিতেই তৈরি হয় না। নিরলস চর্চা আর অধ্যাবসায় বড় একটি ভূমিকা রাখে। এই প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক হিসেবে যদের নাম উল্লেখ করেছি, তারা নিজেরা সচেতন এবং সচেতন ভাবেই প্রবন্ধ রচনার দিকে মনোনিবেশ করেন। তাদের প্রত্যেকের প্রাবন্ধিক হয়ে ওঠার পেছনে কোনো না কোনো সম্পাদকের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ হাত রয়েছে। অনেকেই জন্মগতভাবে মেধারবী হয়ে থাকেন। আবার অনেকেই চর্চাগতভাবে মেধা অন্বেষণ করতে থাকেন। যে যেভাবেই মেধারবী হোন না কেন, মেধার স্বাক্ষর রাখাই এখানে মুখ্য।
শুরুতেই যেসব অভিযোগের কথা বলেছিলাম, সে বিষয়ে চিন্তার সময় এসেছে। ভালো প্রবন্ধ সৃষ্টি না হওয়ার কারণ উদঘাটন করতে হবে আগে। আমাদের প্রবন্ধ একুশ শতকে এসে যে অবস্থানে আছে, সেখান থেকে উত্তরণের জন্য নিজেদেরই যত্নশীল হতে হবে। কবি-লেখকের স্তুতিবাক্যও যেন মন্ময় প্রবন্ধ হয়ে উঠতে পারে; সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। সাময়িক সম্পর্ক বা স্বার্থের জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উৎকৃষ্ট প্রবন্ধ থেকে বঞ্চিত করা মোটেই যৌক্তিক নয়। তাতে আগামী প্রজন্ম ঘোর অন্ধকারে পতিত হবে। কেননা একুশ শতকে এসেও আমরা একশ বছর আগের রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দের প্রসঙ্গ টেনে আনি। কিন্তু একশ বছর পরে আমাদের প্রসঙ্গ কীভাবে আলোচিত হবে, যদি আমারাই কোনো উপাদান রেখে যেতে না পারি।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন