prabandho-sishukishore-muktiyuddho

শিশুকিশোর গল্প-উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ
রাশেদ রউফ


১৯৭১। বাঙালির এক অবিস্মরণীয় ও জ্যোতির্ময়ী বছর। ওই বছরে বাঙালি অর্জন করেছিল তার শ্রেষ্ঠ সম্পদ ‘স্বাধীনতা’। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার জন্য বিশাল আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাঙালির জাতীয় মানসে যে চেতনার বীজ বপন করা হয়েছিল, সেই চেতনারই চূড়ান্ত রূপ পরিলক্ষিত হয় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে বিবেচিত সেই ‘মুক্তিযুদ্ধই’ আমাদের শ্রেষ্ঠ গৌরব ও অহঙ্কার। এই অহঙ্কারের স্বতন্ত্র চিত্রায়ন ঘটেছে আমাদের শিল্প-সাহিত্যের নানা শাখায়, নানা প্রশাখায়, কবিতায়, ছড়ায়, গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে, চলচ্চিত্রে। আমাদের শিল্পী-সাহিত্যিকরা তাঁদের লেখায় রেখায় তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধের দুঃসহ চিত্র, ব্যক্ত করেছেন আগুন ঝরা দিনের কথা, লিপিবদ্ধ করেছেন বীরত্ব ও গৌরবগাথা। বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যে প্রতিফলিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় নানা আখ্যান, ধ্বনিত হয়েছে শৌর্য-বীর্যের প্রদীপ্ত অহঙ্কার, উন্মোচিত হয়েছে বাঙালি জাতির স্বরূপ-চেতনা। অত্যন্ত সফলভাবে রূপায়িত হয়েছে যুদ্ধ দিনের বিচিত্র অনুষঙ্গ। ‘সন্ত্রাসবন্দি বুলেটবিদ্ধ দিন রাত্রি’র ভয়াল চিত্র, অবরুদ্ধ মানুষের নির্বাক আহাজারি, অসহায়ত্বের গোঙানি, হানাদার বাহিনীর হত্যা, লুট, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, শহীদের আত্মত্যাগ, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, স্বপ্ন, প্রাপ্তি-সব কিছুই যেন উজ্জ্বল ও ছবির মতো স্পষ্ট ও জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে আমাদের শিশুসাহিত্যে। মুক্তিযুদ্ধের ছড়া আমাদের জাতীয় ইতিহাসের শৈল্পিক ফসল, বাঙালি চেতনা-বোধের রক্তিম অনুরণন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ধীরে ধীরে পুষ্ট হতে থাকে আমাদের সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখা। গতি পেতে শুরু করে নানা চর্চা ও আয়োজনের মাধ্যমে। কিন্তু পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর দেশের অগ্রগতি যেমন থেমে যায়, তেমনি ব্যাহত হয় শিল্পসাহিত্যের চর্চা।

আহমদ মাজহার তাঁর ‘শিশুসাহিত্যের রূপরেখা’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন, রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হলেও স্বাধীনতার কয়েক বছরের মধ্যেই যেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে আমাদের শিশু-কিশোর সাহিত্য নিস্পৃহ হয়ে পড়েছিল। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত কাল পরিসরের দিকে যদি আমরা লক্ষ করি তাহলে এ ধরনের বইয়ের চরম অপ্রতুলতা দেখতে পাব। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গল্প-উপন্যাস, একাত্তরের ঘটনাবলি বা বাংলাদেশের ইতিহাস বিষয়ে বই প্রকাশিত হতে থাকে প্রচুর সংখ্যায়। নব্বইয়ের দশকে এসে এর পরিমাণ হয়ে ওঠে বিপুল। প্রধান লেখকদের মধ্যে যাঁরা সচরাচর ছোটদের জন্য লেখেন না তাঁরাও যখন একটা দুটো বই লিখতে বসেছেন মুক্তিযুদ্ধই হয়েছে প্রধানত তাঁদের বিষয়। নিঃসন্দেহে পুরো বিশ-শতকের বাংলা শিশুসাহিত্যের মধ্যেই আশি ও নব্বইয়ের দশকের এই দিকটি একটা বড় রকমের বাঁক বদল ঘটিয়েছে।’

বর্তমানে আমাদের শিশুসাহিত্যের বিষয়, মান ও রচনার পরিমাণ নিয়ে আমরা গৌরববোধ করি। অনবরত চর্চার ফলে আমাদের শিশুসাহিত্য হয়ে উঠেছে উজ্জ্বল, মানবিক ও ইতিহাসঋদ্ধ। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাহিত্যের চেয়ে বাংলাদেশের সাহিত্যকে আলাদা করা যাচ্ছে দুটি অবিস্মরণীয় অধ্যায়ের কারণে। একটি মহান ভাষা আন্দোলন, অন্যটি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের আছে বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন। আমাদের আছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। যে দুটি আমাদের শিশুসাহিত্যের মূল উপজীব্য।

আমাদের দেশের শিশু-কিশোরদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে লেখকরা ছড়া-কবিতা-গল্প-উপন্যাস লিখে চলেছেন। এটা লেখকের দায়। শাহ্জাহান কিবরিয়া এ বিষয়ে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পর্কে শিশুদের সঠিক ধারণা দিতে হবে। ধারণা দিতে হবে দেশের শত্রু-মিত্র সম্পর্কে। তারা যে একটা বীর জাতির বংশধর এ ধারণা, এ বিশ্বাস তাদের মধ্যে গেঁথে দিতে হবে। শুধু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নয়, পৃথিবীর সকল মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস তাদের জানাতে হবে। তাদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। শিশুসাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে এ সমস্ত বিষয় বিবেচনায় রাখা অতীব জরুরি। ভোগ নয়, ত্যাগের মহিমার আদর্শ আমরা মুুক্তযুদ্ধ থেকে পেয়েছি। আমাদের সকল শুভ বুদ্ধির উৎস ও ভিত্তি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।” অন্যদিকে, কাইজার চৌধুরী বলেছেন, ‘শিশুসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু আমাদের অহঙ্কারের বিষয়’।

আনজীর লিটন তাঁর ‘নতুন আলোয় জেগে উঠুক শিশুসাহিত্য’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার। এই অহংকার নিয়েই স্বাধীন দেশে জন্ম নেয়া আজকের শিশুরা দেশটাকে গড়বে। আর তাইতো দেশ গড়বার প্রেরণামূলক লেখা ছড়িয়ে দিতে হবে শিশুদের মনে। এই দায়িত্বটি শিশুসাহিত্যিকদের ওপরই বর্তায়। কারণ শিশুসাহিত্যিকরা কল্পনার রঙে বিজয়ের গল্প শোনান। তারাই শিশুমনে জ্বালাতে পারেন আলোর প্রদীপ।’

সে-হিসেবে আমাদের শিশুসাহিত্যের বিষয় হিসেবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এসেছে ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে শুরু করে আন্দোলন-সংগ্রাম পর্যন্ত। মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি বিষয় হিসেবে এসেছে বাঙালি জাতির ধ্রুবতারা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিষয় হিসেবে এসেছে শোষণহীন বাংলাদেশ গড়বার স্বপ্ন, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী মহলের স্বরূপ উদঘাটনের সক্রিয় অনভূতি, স্বৈরাচার বিরোধিতা, অসাম্প্রদায়িকতা, সমাকালীন প্রসঙ্গ ইত্যাদি।


 

আমাদের ভাবতে ভালো লাগে, এ দেশে এমন কোনো সাহিত্যিকই নেই, যাঁর লেখায় মুক্তিযুদ্ধ আসেনি। যে লেখক মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে কোনো লেখাই লিখতে পারেননি, তাঁকে বাংলাদেশের লেখক হিসেবে ভাবাও যায় না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধটা এত বড় একটি বিষয় যে একে বাদ দিয়ে দেওয়ার কথা ভাবাই যায় না। যার ভেতরে দেশপ্রেম নেই, তার ভেতরে সাহিত্যপ্রেম থাকে কিনা সন্দেহ। আমরা দেখেছি, লেখকদের লেখায় মুক্তিযুদ্ধ এসেছে নানাভাবে। ছড়া, কবিতা, যেমন লেখা হয়েছে, তেমনি লেখা হয়েছে গল্প-উপন্যাস। এই গল্প-উপন্যাস হয়তো ছড়া-কবিতার মতো প্রবলভাবে হয়নি, কিন্তু মোটা দাগে বেশ কিছু রচনা আমরা পেয়েছি, যেগুলোতে প্রকাশ পেয়েছে বাঙালির শৌর্য-বীর্য তথা শ্রেষ্ঠত্বের সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ। আমাদের শিশু-কিশোরদের জন্য যা অনুসরণীয়। আনন্দের সঙ্গে বলা যায়, দেশের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ  সাহিত্যিক উপহার দিয়েছেন দায়িত্বশীল রচনা। যেমন শওকত ওসমান। তিনি তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘মুজিবনগরের সাবু’র মাধ্যমে কিশোর পাঠকদের কাছে পরিচিত হয়েছেন আলাদা ভাবনায়। গ্রামের ছেলে সাবু। তার নাম বদলে হয়েছিল ‘এলেমজি’, যেটি অস্ত্রের নামে নাম! এছাড়া শওকত ওসমানের গল্প-উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘জুজু গগা’, ‘পঞ্চসঙ্গী।

সরদার জয়েনউদ্দীনের মুক্তিযুদ্ধের কিশোর উপন্যাস ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’। তাঁর এই উপন্যাসের শেষদিকে বলা হয়েছে এভাবে: ‘চাঁদ তখন লক্ষ তারার মালা গলে তার সমস্ত সুষমা ঢেলে পৃথিবীকে স্নান করিয়ে দিচ্ছে…তারই ভেতর দিয়ে সামনে দ্রুত এগিয়ে চলছিল ওরা কয়জন মুক্তিযোদ্ধা…ওদের যে আরও অনেক দূর যেতে হবে, সেই স্বাধীনতা পর্যন্ত চলতে হবে যে!’ ইস! কী চমৎকার!

সেলিনা হোসেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক। বড়দের পাশাপশি ছোটোদের জন্য লেখেন অত্যন্ত মমতা নিয়ে। তাঁর মুক্তিযুদ্ধের কিশোর উপন্যাস ‘সাগর’ একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা।

আনোয়ারা সৈয়দ হকের কথাসাহিত্য ব্যাপক সমাদৃত। তার পাশাপাশি কিশোর রচনা তাঁকে বিশিষ্ট করে তুলেছে। ‘ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ’, ‘মুক্তিযোদ্ধার মা’, ‘মুক্তিযোদ্ধার ছেলে’, ‘তপনের মুক্তিযুদ্ধ’, ‘আমাদের মুক্তিযোদ্ধা দাদাভাই’ প্রভৃতি তাঁর সেরা রচনা।

হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। বড়দের জন্য যেমন লিখেছেন, তেমনি গভীর যতেœ তিনি লিখেছেন শিশু-কিশোরদের জন্য। তাঁর মুক্তিযুদ্ধের কিশোর উপন্যাস ‘সূর্যের দিন’। আমাদের দেশের আরেক জনপ্রিয় লেখক ইমদাদুল হক মিলন। দুহাতে লিখেছেন এই লেখক। ছোটোদের জন্য তিনি প্রচুর লিখেছেন। তাঁর মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ‘একাত্তরের মোসলেম ডাকাত’ আখতার হুসেনের ‘ফ্রিডম ফাইটার’, ও ‘সাত কিশোরের অভিযান’ শিশুকিশোরদের জন্য বড় পাওয়া। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বড়দের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে চলেছেন আরেক জনপ্রিয় লেখক আনিসুল হক। তিনি ছোটোদের জন্য লিখলেন ‘একাত্তরের একদল দুষ্টু ছেলে’।

চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে খ্যাত হলেও আমজাদ হোসেন এক শক্তিমান কথাসাহিত্যিক। ছোটোদের জন্য খুব বেশি লিখেননি তিনি। তবে ‘জন্মদিনের ক্যামেরা’ নামে আছে তাঁর অসাধারণ এক কিশোর উপন্যাস। এছাড়া আছে মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প।

শাহরিয়ার কবির ও মুনতাসীর মামুন বাংলাদেশের সাহিত্যে দীপ্তি ছড়িয়েছেন নানা লেখার মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধের কিশোর উপন্যাস রচনায় তাঁরা দেখিয়েছেন সপ্রতিভ দক্ষতার ছাপ। শাহরিয়ার কবিরের পুবের সূর্য, একাত্তরের যীশু, একাত্তরের পথের ধারে, ঘাতকের সন্ধানে এবং মুনতাসীর মামুনের ‘জয় বাংলা’ বিস্ময়কর সংযোজন।

কাইজার চৌধুরী শিশু-কিশোরদের প্রিয় এক লেখক। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর বেশ কয়েকটি বই রয়েছে। প্রায় সব ক’টি বই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ‘শোভনের একাত্তর’, ‘মুক্তিযুদ্ধে হে কিশোর’, ‘একাত্তরের ছেলেরা’, ‘একাত্তরের একদিন’ প্রভৃতি। কিশোর শোভনের চরিত্র নিয়ে সাজিয়েছেন তাঁর অসাধারণ এই উপন্যাস ‘শোভনের একাত্তর’।

রফিকুর রশীদ কথাসাহিত্যিক হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। বড়দের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ‘দাঁড়াবার সময়’ ও ‘ছায়ার পুতুল’-এর পাশাপাশি তাঁর রচিত মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প ও উপন্যাস আমাদের শিশুসাহিত্য অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছে নিঃসন্দেহে। তিনি ছোটোদের উপহার দিয়েছেন ‘বীরের মাটি, ‘অপারেশন জয় বাংলা’, ‘পিন্টুবাহিনীর যুদ্ধযাত্রা’ প্রভৃতি গ্রন্থ।

আমাদের কিশোর সাহিত্যে মুহম্মদ জাফর ইকবাল এক জনপ্রিয় নাম। প্রচুর লিখেছেন তিনি। তাঁর ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ ও ‘কাজলের দিনরাত্রি’ তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা। ফরিদুর রেজা সাগরও ছোটোদের জন্য লিখছেন দীর্ঘদিন ধরে। প্রচুর বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। ‘একাত্তরে ওরা’ তাঁর কিশোর উপযোগী মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক এক অপূর্ব বই।

ছড়া ও কবিতায় অধিক মনোযোগী ও নিবেদিত হলেও বেশ কয়েকজন লেখক গল্প-উপন্যাস রচনাতেও সপ্রাণ। তাঁদের মধ্যে আছেন আখতার হুসেন, সুজন বড়–য়া, আমীরুল ইসলাম প্রমুখ।

আখতার হুসেন আমাদের শিশুসাহিত্যে এক দরদি লেখক। ছড়া কবিতা তাঁর প্রধান চর্চিত মাধ্যম হলেও গল্প উপন্যাসেও তিনি স্বচ্ছন্দ ও খ্যাতিমান। তাঁর মুক্তিযুদ্ধের কিশোর উপন্যাস ‘ফ্রিডম ফাইটার’ এক অনন্যসাধারণ সৃষ্টি। এছাড়া রয়েছে তাঁর আরেক চমৎকার গ্রন্থ ‘নায়ের ছোট্ট মাঝি’।

সুজন বড়–য়া কিশোর কবিতায় অনিবার্য নাম। কিন্তু তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের বেশ কয়েকটি গল্প-উপন্যাস। এদের মধ্যে ‘বন পাহাড়ের আমি’, ‘সূর্য ওঠার সময়’, ‘আলো ফুটবেই’, ‘আকাশ ছোঁয়া বীর’ উল্লেখযোগ্য। আমীরুল ইসলাম নানামুখী ছড়া লিখে সমাদৃত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তাঁর লেখা ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা হতে চাই’, ‘মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প’, ‘একাত্তরের মিছিল’ আমাদের সাহিত্য জগতে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।

গল্প-উপন্যাসে সক্রিয় আরো কয়েক জনকে আমরা আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে পারি। তাঁরা লেখেন নিবিড় ভালোবাসায়। যেটুকু লেখেন, তাতে আনন্দ থাকে, থাকে গভীর চিন্তা। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মনি হায়দার, দীপু মাহমুদ ও আহমেদ রিয়াজ। আহমেদ রিয়াজের ‘আঙ্কল গ্রেনেড ও তার দল’, ‘একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সবুজ’, বীরবিচ্ছু’, ‘একাত্তরেরর রবিনহুড’, ‘মতিরাজাকার’ উল্লেখযোগ্য বই। তেমনি উল্লেখযোগ্য মনি হায়দারের ‘ঘাসফড়িং’ ও দীপু মাহমুদের ‘নীতুর ডায়েরী ১৯৭১’।

আসলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সাহিত্যের অন্যতম প্রধান উপজীব্য বিষয় ও মূলভিত্তি হিসেবে দাঁড়িয়েছে। শিশুকিশোররা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রতিনিধি বলে তাদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করতে এবং তাদের ইতিহাস সচেতন করাতে আমাদের লেখকরা প্রচুর সময় ও শ্রম দিয়ে চলেছেন। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে শিশু-কিশোরপাঠ্য গল্প-উপন্যাসের বইয়ের হিসাব আমাদের কাছে নেই। তবু যে কয়েকটি বইয়ের নাম আমাদের সংগ্রহে আছে, সেগুলো উল্লেখ করতে চাই।  যেমন : বশীর আল হেলালের ‘আনারসের হাসি’, মমতাজউদদীন আহমদের ‘সজল তোমার ঠিকানা’, জাহানারা ইমামের ‘বিদায় দে মা ঘুরে আসি’, ‘বুকের ভিতর আগুন’, খালেদা এদিব চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প, আগুনের চমক, তোমার পতাকা যারে দাও, রাবেয়া খাতুনের ‘একাত্তরের নিশান’, হুমায়ুন আজাদের ‘আব্বুকে মনে পড়ে’, মাহমুদ আল জামানের ‘যুদ্ধদিনের পোড়ো বাড়ি’, শাহজাহান কিবরিয়ার ‘বাঘা’, পান্না কায়সারের ‘হৃদয়ের বাংলাদেশ’, আলী ইমামের রক্ত দিয়ে কেনা, মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প, মাহবুব সাদিকের ‘তরুণদের একাত্তর’, রশীদ হায়দারের ‘পুনর্জন্ম’ ও ‘শোভনের স্বাধীনতা’, দাউদ হায়দারের ‘রাজপুত্র’, হেলেনা খানের মুক্তিযুদ্ধের গল্প, আতোয়ার রহমানের ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম’, মোস্তফা হোসেইনের ‘একাত্তরের বীর কিশোর’, মঞ্জু সরকারের ‘যুদ্ধে যাওয়ার সময়’, ‘একাত্তরের বোবাভূত’, মিলা মাহফুজার ‘যুদ্ধদিনে জোনাকী’, আলম তালকুদারের ‘অবশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা’, ঝর্ণাদাশ পুরকায়স্থের ‘মেঘ জোছনায় টুপুর’, ‘একুশ ও মুক্তিযুদ্ধের গল্পগুচ্ছ’, মোস্তাফা হোসেইনের ‘যুদ্ধ শেষের যুদ্ধ’, শিহাব সরকারের ‘হাত বাড়ালেই সূর্য’, আফরোজা পারভীনের তোমাদের জন্য যুদ্ধের গল্প, বিপ্রদাশ বড়–য়ার ‘জাদুমানিক স্বাধীনতা’, ঝর্ণা দাস পুরুকায়স্থের ‘একুশ ও মুক্তিযুদ্ধের গল্পগুচ্ছ’ ইশতিয়াক আহমেদের ‘মায়ের কাছে ফেরা’, মুস্তাফা মাসুদের ‘হিজলডাঙ্গার মুক্তিবাড়ি’, বেবী মওদুদের ‘জয় বাংলা’, হারুন হাবীবের ‘যুদ্ধে যাবোই’, ঝর্না রহমানের ‘আদৃতার পতাকা’, রহীম শাহ’র ‘আগুন ডানা পাখি’, রাশেদ রউফের ‘খোলা আকাশের দিন’, ইশতিয়াক আলমের কিশোর উপন্যাস ‘মায়ের কাছে ফেরা’, সিরু বাঙালির ‘যুদ্ধশিশুর যুদ্ধজয়’, আপারেশন বিমান ঘাঁটি’, ‘আব্বুর জন্য যুদ্ধ’, ‘মাগো আমরা লড়তে জানি’, ‘অথৈ পেয়েছে পতাকা’, রহস্যময় প্লানেটে একুশ’, আমিনুর রহমান সুলতানের ‘বলধা গার্ডেনের গেরিলাকন্যা’, আনজীর লিটনের ‘বাবা ফিরে আসেনি’, মাহবুব রেজার ‘পুরান ঢাকার ফজল ও ১৯৭১’ ‘দীর্ঘ অন্ধকারে রঞ্জু একা’, সেজান মাহমুদের মনের ঘুড়ি লাটাই, ইসহাক খানের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা, ফজলে আহমেদের ‘আমিও যুদ্ধে যাবো’, নাসরীন মুস্তাফার ‘একজোড়া সবুজ চোখ’, আনোয়ারা আলমের ‘গেরিলা যোদ্ধার গল্প শোনো’ ও ‘ক্র্যাক প্লাটুনের রবিন হুড’, উৎপলকান্তি বড়–য়ার ‘রাতুলের মুক্তিযুদ্ধ’, মালেক মাহমুদের ‘একুশ আমার পতাকা আমার’, লাল রঙের গল্প’, মানজুর মুহাম্মদের ‘জলপাই রঙের গ্রেনেড’, ‘ক্ষুদে ক্যাপ্টেন’, ‘একাত্তরের পাখি’, ‘গন যখন গেরিলা’, ‘বিনুর বাঁশের বন্ধুক’, ‘কাটা পাহাড়ের লাল টিয়ে’, রমজান আলী মামুনের ‘মিতুর স্বাধীনতা’, শিবুকান্তি দাশের কিশোর উপন্যাস ‘যুদ্ধদিনের গল্প’, কিশোর গল্প ‘জলপাই রঙের গাড়ি’, ইফতেখার হালিমের কিশোর গল্প ‘পতাকা আমার দেশ’, মিলন বনিকের ‘মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও শেখ রাসেলের গল্প’ প্রভৃতি।

এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের গল্প লিখে চলেছেন সগৌরবে বেশ কয়েকজন প্রতিভাদীপ্ত লেখক। তাঁদের মধ্যে আছেন, মঈনুল আহসান সাবের, শরীফ খান, আবু সাঈদ জুবেরী, ঝর্ণা রহমান, সৈয়দ ইকবাল, জাকির তালুকদার, ইমতিয়ার শামীম, মাহফুজুর রহমান, দন্ত্যস রওশন, দিলারা মেসবাহ, আশরাফুল আলম পিনটু, রোকেয়া খাতুন রুবী, বিপুল বড়–য়া, মাহবুব রেজা, ওমর কায়সার, দীপক বড়–য়া, সারওয়ার-উল-ইসলাম, তাহমিনা কোরাইশী, ধ্রুব এষ, দিলতাজ রহমান, শরীফুল ইসলাম ভূঁইয়া, মোশতাক আহমদ, হুমায়ুন কবীর ঢালী, শেলী সেনগুপ্তা, আশিক মুস্তাফা, রুনা তাসমিনা, ইফতেখার মারুফ, জসীম আল ফাহিম, সুসেন কান্তি দাশ, ইমরুল ইউসুফ প্রমুখ।

আমাদের জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের মতো এত বড় ঘটনা আর নেই। একটি জাতির স্বাধীনতা অর্জন অন্য সব প্রাপ্তি থেকে সেরা। যে আশা-আকাক্সক্ষার স্বপ্ন লালন করে সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল তাদের সেই চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন আমাদের গল্প-উপন্যাসে উঠে এসেছে। ছোটোদের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে এবং নিয়মিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের চিত্র।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নানা ধরনের প্রবন্ধ বা রচনা সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে, যেসব গ্রন্থে লেখকদের ইতিহাস চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। এখানে কিছু বইয়ের না উল্লেখ করতে পারি। যেমন : মোহাম্মদ হাননানের ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ : কিশোর ইতিহাস’, ‘উত্তাল উনসত্তর : কিশোর ইতিহাস’, লুৎফর রহমান রিটনের ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস’, ‘বাংলাদেশের অগ্নিকিশোর’, আসাদ চৌধুরীর ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’, মুহম্মদ জাহাঙ্গীরের ‘সব কটা জানালা’, সাহিদা বেগমের ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনো’, মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘ছোটদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’, রফিকুল ইসলামের ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধ’, সুব্রত বড়–য়ার ‘আমাদের এই বাংলাদেশ’, মনজুর আহমেদের ‘ফিরে চলো একাত্তরে’, সিরু বাঙালির ‘স্বাধীনতার গল্প শোনো’, রণজিৎ সরকারের ‘ছোটদের মুক্তিযুদ্ধের অজানা গল্প’, নেছার আহমদের ‘শহীদ বুদ্ধিজীবীদের গল্প’, অমল সাহার ‘ছোটদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ ইত্যাদি।

আনন্দের সংবাদ হলো, এখানে অনেকে শুধু ‘মুক্তিযুদ্ধের ছড়া ও কিশোরকবিতা’ নিয়েই একক গ্রন্থও করেছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন, যেমন লুৎফর রহমান রিটন (ছড়া ও ছবিতে মুক্তিযুদ্ধ), আসলাম সানী (ছড়ায় ছড়ায় মুক্তিযুদ্ধ), আমীরুল ইসলাম (বীর বাঙালির ছড়া), মুহম্মদ নূরুল হুদা (মুক্তিযুদ্ধের ছড়া), মসউদ-উশ শহীদ (মুক্তিযুদ্ধের ছড়া), শাহাবুদ্দীন নাগরী (স্বাধীনতার ছড়া), সুজন বড়–য়া (পতাকা আমার আয়না), রফিকুর রশীদ (যুদ্ধদিনের ছড়া), সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল (একাত্তরের দত্যি), সুখময় চক্রবর্তী (মুক্তিযুদ্ধের বর্ণমালা), আনওয়ারুল কবীর বুলু (আমার মা আমার স্বাধীনতা), স ম শামসুল আলম (মুক্তিযুদ্ধের কিশোর কবিতা), সৈয়দ আমির উদ্দিন (ও আমার দেশের মাটি), আবুল কালাম বেলাল (প্রিয় দেশ, প্রিয় স্বাধীনতা), ইফতেখার হালিম (মুক্তিযুদ্ধের কিশোর কবিতা), মহসিন খোন্দকার (মুক্তিযুদ্ধের ছড়া )। আবার অনেকে করেছেন সম্পাদিত গ্রন্থ, যেমন-আমীরুল ইসলাম সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধের ছড়া ও কবিতা’, রাশেদ রউফ সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধের ছড়া ও কবিতা’, ফারুক নওয়াজ ও বাদল ঘোষ সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধের কিশোর কবিতা’ সঞ্জিত বনিক সম্পাদিত ‘ভালোবাসি আমি আমার এ দেশ’ এবং বাংলাদেশ শিশু একাডেমী প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্পগাথা’।

যতই দিন অতিবাহিত হচ্ছে, আমাদের জাতির সবচেয়ে গৌরবময় আখ্যান ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নিয়ে তত বেশি রচিত হচ্ছে ছড়া। সংখ্যাপ্রাচুর্যে ও প্রাণপ্রাচুর্যে মুক্তিযুদ্ধের ছড়া ভবিষ্যতে আরো শিল্পসফল হয়ে উদ্দীপ্ত করবে আমাদের চেতনাকে, এ আশাবাদ ব্যক্ত করা যায় অনায়াসে। লেখক: শিশুসাহিত্যিক, সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী: ফেলো, বাংলা একডেমি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *