rannaghar-bangladesher-pitha

বাংলাদেশের পিঠা পর্বের ইতিহাস
মেহেরুন নেসা


বাংলাদেশের ঐতিহ্য পিঠা। এদেশের পরিবেশ, ভৌগলিক আবহাওয়া ও কৃষি উৎপাদনের উপর নির্ভর করে এপেটাইজার ও ডেজার্ট হিসাবে পিঠার উৎপত্তি।

বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের উৎসব,বিয়ের অনুষ্ঠান, নতুন জামাই আদর, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, ধানের নবান্নের উৎসব হয়। শীতকালে গ্রামে ঘরে ঘরে একদিনে প্রায় ৫ কেজি নতুন চালের পিঠা তৈরী করা হয়। ভাপা পিঠা, চিতুই পিঠা, পাটি সাপটা, খোলাজালি, ছিটরুটি পিঠা, ম্যরা পিঠা ইত্যাদি তৈরীর ধুম পরে যায়। শীতকালে চুলার চারপাশে বাড়ীর সকল সদস্য ও পাড়া প্রতিবেশী বসতো। পিঠা তৈরী হতো এবং সবাই মিলে গরম গরম পিঠা খেত। এখনও গ্রামে এই সংস্কৃতি আছে। শহরের বাড়ীতে এইসব পিঠা খুব একটা তৈরী হয় না। শহরের ছেলেমেয়েরা পিঠার দোকান থেকে পিঠা কিনে খায়। আমাদের দেশে জামাই পিঠা নামে কয়েক ধরনের পিঠা আছে। মেয়ের সংসার সুখের হওয়ার জন্য এবং জামাইকে সম্মান ও খুশী করার জন্য নানা পদের পিঠা তৈরী করে শাশুড়ীরা।

পিঠা তৈরী করতে বিশেষ উপকরন : চালের গুড়া বা চালের আটা, গুড়, নারকেল, দুধ, ডিম, চিনির সিরা, মাংস, সামান্য লবণ, নানা রকম মসলা। কয়েক পদের পিঠাতে বর্তমানে রং দেওয়া হয়। আমি বর্তমানে গবেষনা করে গাজর, বিটরুট, পুদিনাপাতা, পালং পাতার রস দিয়ে রং করানো শিখাই। বৃটিশ শাসন আমল থেকে কিছু কিছু পিঠায় আটা, ময়দা, সুজি ও মিষ্টি আলু ব্যবহার করা হয়।

নকশি পিঠা বাংলাদেশের ঐতিহ্য। নকশি পিঠা ঢাকার কাছে নরসিংদী জেলা থেকে উৎপত্তি যা ইতিহাস থেকে জানা যায়। ইতিহাস থেকে আরও জানা যায় যে ঐ এলাকার মানুষ খুবই সৌখিন ছিল এবং জামিদার বড়ীর করুকার্য ছিল অতুলনীয়। বাংলাদেশের মেয়েরা অবহেলিত ছিল। তাদের সুখ দুঃখ, আনন্দ, সৃষ্টিশীলতা কিছুই প্রাধান্য পেত না। বাংলাদেশের মেয়েদেরকে রংতুলি দেওয়া হতো না যাতে করে তাদের শিল্পী মনোভাব প্রকাশ পায়। পিঠার কারুকার্য দিয়ে শিল্পী মনের প্রকাশ ঘটে। নরসিংদীর এক গ্রামে আলপনা আঁকা হত চালের গুড়া দিয়ে। তা দেখে ১৩ বছরের একটি মেয়ে চালের আটা সিদ্ধ করে সেই সিদ্ধ মন্ড হাত দিয়ে চেপে রুটির মত করে খেজুর গাছের কাঁটা দিয়ে সুন্দর নকশা তৈরী করে। সেই নকশা দেখে মা, দাদীর বাড়ীর সকল সদস্যরা অবাক হয়। রোদে শুকিয়ে রাখার পর গ্রামের সবাই দেখতে আসে সেই নকশা। তারপর অনেক গবেষনা করে নকশা রুটি টা সামান্য তেলে ভেজে আবার ডুবা তেলে ভেজে তুলে গুড়ের সিরাতে দিয়ে তুলে নেয়। বৃটিশ শাসন আমল থেকে নকশা করা হয় বিধায় এই পিঠার নাম নকশি পিঠা নামে বাজার জাত করা হয়। ঐ মেয়েটির নকশি পিঠার গল্প ছড়িয়ে পড়ে এবং তার গুনের জন্য সম্পদশালী পরিবারে বিয়ে হয়।

বাংলাদেশের গ্রামের অশিক্ষিত মেয়েদের জন্মগত শৈল্পীক মনোভাব পিঠার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। বাংলাদেশের মেয়েরা এত সুন্দর মজার সুস্বদু পুষ্টি যুক্ত পিঠা তৈরী করে তা সকলের কাছে প্রসংশার যোগ্য।

আমি নকশি পিঠা, ঝিনুক পিঠা, পাতা নকশা, মাছ পিঠার রেসিপি ও ছবি দিলাম। বিশ্বের কাছে পৌঁছে যাবে বাঙ্গালী মেয়েদের নিখুঁত কর্ম। আমি প্রথম গবেষনা করে ১৩০ রকম পিঠার নাম ও রেসিপি উদ্ধার করেছি। আমি আশা করি, বাঙ্গালী মেয়েদের নিপুন কর্ম বাজার জাত করতে অনেকে এগিয়ে আসবেন এবং যোগাযোগ করবেন।

নকশি পিঠা


উপকরণ : চালের গুড়া – ২কাপ, পানি – ৩ কাপ, লবণ – আধা চাচামচ, গুড় – ১ কাপ, চিকন মুখ কাঠি – ২ টি বা খেজুর কাঁটা ইচ্ছামত, ভাজার জন্য তেল – পরিমাণ মত।

প্রস্তুত প্রনালী : পানি ও লবণ চুলায় ফুটতে দিন। ফুটে উঠলে চালের গুড়া ঢেলে ঢেকে দিন ৫মিনিটের জন্য। তারপর চুলা বদ্ধ করে ভাল করে নেড়ে ঠান্ডা করে মাখিয়ে নিন। রুটির পিড়াতে তেল মাখিয়ে নিন। চালের গুড়ির মন্ড ছোট ছোট ভাগ করে একটু মোটা রুটি বেলে তেল মাখিয়ে খেজুর কাঁটা দিয়ে নকশা করে নিন। এবার অল্প গরম তেলে হালকা ভেজে তুলুন। যে দিন গুড়ের সিরাতে দিবেন, সেই দিন আবার তেল গরম করে বাদামি করে ভেজে তুলুন। গুড়ে আধা কাপ পানি দিয়ে সিরা করে পিঠা ১ মিনিট ভিজিয়ে তুলে নিন। এভাবেই তৈরী হয়ে গেল বাংলাদেশের ঐতিহ্য জনপ্রিয় নকশি পিঠা।

টিপস : নকশি পিঠা আবার এয়ার টাইট করে ১ মাস সংরক্ষন করা যায়।



ঝিনুক পিঠা


উপকরণ : চালের গুড়া – ১ কাপ, পানি – দেড় কাপ, লবণ – সামন্য, গুড় – আধা কাপ, নতুন চিরুনি – ২ টি, ভাজার জন্য তেল – পরিমাণ মত।

প্রস্তুত প্রনালী : চুলায় ১ কাপ পানি ও সামান্য লবণ দিয়ে ফুটতে দিন। ফুটন্ত পানিতে চালের গুড়া দিয়ে ঢেকে চুলার আঁচ কমিয়ে দিন। ৫ মিনিট পরে ঢাকনা খুলে নেড়ে দিন। চালের গুড়া সিদ্ধ হলে ঢেকে ৫ মিনিট রাখুন। এবং চুলা বন্ধ করে দিন। ঠান্ডা হলে ভাল করে মাখিয়ে নিন। ছোট ছোট করে লেচী কেটে নিন। এবার হাত দিয়ে গোল করে একদিক গোল অপর দিক সরু করে নিন। এবার পরিষ্কার চিরুনি দিয়ে সামান্য চেপে টেনে নিন। দেখতে হবে ঝিনুকের মত। এবার ডুবো তেলে অল্প করে ঝিনুক পিঠা দিয়ে বাদামি করে ভেজে তুলে নিন। যে দিন গুড়ের সিরাতে দিবেন, সেই দিন আবার তেল গরম করে বাদামি করে ভেজে তুলুন। গুড়ে আধা কাপ পানি দিয়ে সিরা করে পিঠা ১ মিনিট ভিজিয়ে তুলে নিন। এভাবেই তৈরী হয়ে গেল বাংলাদেশের জনপ্রিয় ঝিনুক পিঠা।



পাতা নকশা পিঠা


(লেঙ্গড়া জনগোষ্টি পাহাড়ী এলাকা)

উপকরণ : চালের গুড়া – ৩ কাপ, গুড়া চিনি – আধা কাপ, লবন – সামান্য, কলা পাতা- প্রয়োজন মত, খাবারের রং – প্রয়োজন মত।

প্রস্তুত প্রনালী : পরিমাণমত পনি ও লবন দিয়ে ২ বাটিতে ২ রকমের রং দিয়ে ১ কাপ করে চালের গুড়া নিয়ে মাখিয়ে লেই তৈরী করুন। কলাপাতা ছোট করে কেটে নিন। নারিকেলের খোলে সরু ছিদ্র করে লেই নিয়ে পাতার উপর মনের মাধুরী মিশিয়ে দুই রকম রং দিয়ে নকশা করুন। এরপর রোদে শুকিয়ে নিন। এবার ডুবো তেলে ভেজে তুলে নিন এবং চিনি গুড়া ছড়িয়ে দিন। তৈরী হয়ে গেল জামাই আদরের পাতা নকশা পিঠা।



মাছ পিঠা


উপকরণ : ময়দা – ২ কাপ, সিদ্ধ ইলিশ মাছের কিমা – ১ কাপ, পেয়াজ কুচি – ১ টেবিল চামচ, ধনে জিরা গুড়া- ১ চাচামচ, ধনেপাতা কুচি – পরিমাণমত, কাঁচা মরিচ কুচি – পরিমাণমত, লবন – স্বাদমত, তেল- পরিমাণমত।

প্রস্তুত প্রনালী : ২ টেবিল চামচ তেল ও সামান্য লবন ও পরিমাণমত পানি দিয়ে ময়দা মাখিয়ে ১ ঘন্টা ঢেকে রাখুন। কড়াইয়ে ১ চা চামচ তেল গরম করে সিদ্ধ মাছের কিমা ভেজে তারপর পেয়াজ, কাঁচা মরিচ, জিরা ও ধনিয়া গুড়া দিয়ে ২ মিনিট ভেজে নিন। ধনে পাতা ও লবন দিয়ে নামিয়ে নিন। ময়দার মন্ডকে ৮ ভাগ করে নিন। একটি ভাগ বেলে রুটির মত করে রুটির দুই পাশে সরু করে কেটে নিন। মাঝের অংশে ঠান্ডা কিমা দিয়ে দুই পাশ থেকে একটি কাটা অংশ দিয়ে ঢেকে দিন। একপাশে মাথা ও অন্য পাশে লেজের আকার দিয়ে চোখে গোল মরিচ বা লবঙ্গ দিয়ে নিন। সব তৈরী হয়ে গেলে ডুবো তেলে বাদামি করে ভেজে তুলুন। এভাবেই তৈরী হয়ে গেল মাছ পিঠা।

টিপস : মাছের টুকরা, হলুদ, লবন ও সামান্য পানি দিয়ে সিদ্ধ করে কাঁটা বেছে নিন। ইলিশ মাছ ছাড়া অন্য মাছ ও ব্যবহার করা যায়।



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

7 thoughts on “rannaghar-bangladesher-pitha

  1. সংগ্রহে রাখার মত লেখা, দারুন সাবলীল। ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় পিঠাগুলোর রেসিপি পেয়ে উপকৃত হলাম। আপনার গবেষনা এবং সুনিপুন উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে বাঙ্গালি হেঁসেলের এ সুমিষ্টতা পৌঁছে যাক বিশ্বের দরবারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *