স্বাতী রায়
মানুষের বারোমাসে তেরো পার্বণ থাকে এটা আর কারো জন্য কতটা সত্যি তা জানা নেই বটে, আমার কাছে ব্যাপারটা তেরো নয় তেইশ কি চব্বিশ হবে৷ কারণ আমি বারো মাসে চব্বিশের বেশী পার্বণ পালন করি৷ ওহো, পার্বণ হলো আমার কাছে বাড়ি থেকে দূরে ঘুরে বেড়ানো৷ তা কখনও শহরের আসেপাশে হতে পারে আবার কখনও দূর পাহাড়- জঙ্গল-উপত্যকা -সাগরপার। এবার জানতে চাইবেন বেড়াতে তো কম বেশী সকলেই যায়, তাহলে পার্বণ বলার কারণ কি? পার্বণ কথার অর্থ বাঙালী মাত্রেই জানেন, উৎসব বা পুজো৷ আর উৎসব বা পুজোয় আমি একটি পুজোই নিষ্ঠাভরে করে থাকি তা হল পেট পুজো (ঠাকুর দেবতা মেনে চলা মানুষেরা অপরাধ নেবেন না, জিভ থুড়ি জীব সেবাই শিব সেবা কিনা।)
তো যাই হোক ধান ভাংতে শিবের গীত না গেয়ে সরাসরি শিব সেবার কথায় আসি৷ বাঙালী রান্নায় এত বৈচিত্র্য যে জোর দিয়ে বলতে পারি ভারতের আর কোনো প্রদেশে স্বাদে-গুণে-রান্নার পদে এত সম্পদ নেই৷ তা সে বাটা-ভর্তা হোক বা সাধারণ শুক্ত বা চচ্চড়ি। এ নিয়ে আমার প্রচ্ছন্ন গর্ব আছে বললে অত্যুক্তি হবেনা৷ তা সেই রসনার তাড়নায় যেখানেই যাই না কেনো সেখানের নিজস্ব রান্না চেখে দেখা বা শিখে নেওয়ায় আমার অসীম আগ্রহ৷ বিশেষ করে তা যদি কোনো রকম উপজাতীয় ও পার্বত্য অঞ্চলের হয়৷ কখনও তাতে নিজের মনের মাধুরি মেশাই না তা নয়, মানুষে ভাবে আমি বোধয় শিল্পী, আসলে তাঁরা জানেননা বাঙালীরা সেরা জুগাড়ু ও বটে (জুগাড়ু শব্দের সুন্দর বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে পেলাম না, থাকতে পারে হয়ত কিন্তু তাতে এই গুগাড়ু শব্দের অভিঘাত থাকবে না)। স্থানীয় মশলা সব সময় কলকাতায় বসে পাওয়া যায়না আবার কিছু জিনিস পাওয়া গেলেও তার স্বাদের সেই খাঁটি ব্যাপারটি থাকেনা৷ এই যেমন ধরুন রাইশাক। এ কোনোভাবেই আমাদের বাঙালী সর্ষে শাক নয়৷ শর্ষে শাকের হালকা তিতকুটে ব্যাপারটি রাইশাকে নেই৷ আর ওই রাইশাক পাওয়া যায় উত্তর পূর্ব ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলে। তাজা নধর শাকের আঁটি দেখলেই মানুষ এককালে শাখামৃগ ছিলো ভুলে আমার মনে হয় আমার পূর্বজেরা আসলে বোধয় মৃগ ছিল৷ গাছের ডালের বদলে পাতায় নজর বেশী ছিল। আহ আবার সেই গান ধরেছি, বয়সের দোষ বুঝলেন কিনা৷ তা এই নানান জায়গার নিজস্ব রান্না চেখে দেখতে গিয়ে সিকিম-বাংলা বর্ডারের এক গ্রামে প্রথম খেয়েছিলাম রাইশাক-মাটন (পরবর্তী কালে রাইশাক দিয়ে রান্না বরাহ ও খেয়েছি বটে, কিন্তু এই পাঁঠার ঝোল বাঙালী ললনার মন নিমেষে জয় করেছিলো সেই জয়ের কাছে ভাস্কো ডা গামা ফেল) অবশ্য মাটন অর্থাৎ ছাগলও খামারের না, পাহাড়ি ছাগল। তারা জন্মসূত্রেই ভাগ্যবান যে পলিথিনে মোড়ানো সোনার দামের স্ট্যাম্প দেওয়া অর্গানিক খাবার খেতে হয়না, এমনিই পায়৷ সেই গ্রামের নাম তাগাথাং, সেখানে হোমস্টে ওনার জীবন দাজুর স্ত্রী দিলু বৈনি আমায় এই অসাধারণ রান্না খাইয়েছিলেন৷ খাওয়ার পরেই আমি একটি লম্বা উদগার ছেড়ে সযত্নলালিত পঞ্চরাসভের স্বর ও ছেড়েছিলাম- ও জীবন রে ইত্যাদি প্রভৃতি।
রান্নাটির স্বাদ আসলে অসাধারণ, রান্নার পদ্ধতি খুবই সাধারণ সেটি বলার জন্যই এত ভনিতা। বড়ে গুলাম আলির গান শুরু করার আলাপের মত ব্যাপার খানিকটা।
রাই শাক মাটন ( চিকেন, পর্ক, বিফ সব দিয়েই বানানো যায়)-
৫০০ গ্রাম মাংস +১০০ গ্রাম চর্বি বাধ্যতামূলক। পিস করা মাংস বেশী ধোবেন না।
দুই টেবল চামচ পরিমান আদা রসুন, স্বাদ মত কাঁচালঙ্কা থেঁতো বা একদম মিহি কুচি, পেঁয়াজ কুচো করা (খুব মিহি না), টমেটো কুচি (না থাকলে নাও দিতে পারেন, বাধ্যতামূলক নয়) এক টেবল চামচ পরিমান ধনে-জিরে- খান ১০ গোটা গোলমরিচ- স্বাদ মত শুকনোলঙ্কা বাটা (শিলে বাটা হলে ভালো, না থাকলে সামান্য জলে গোটা মশলা ২০-২৫ মিনিট মত ভিজিয়ে রেখে এক টুকরো বরফ দিয়ে মিক্সিতে বাটবেন, শিলে বাটা মশলার সাথে মিক্সিতে বাটা মশলার স্বাদের তারতম্য হওয়ার মূল কারণ টেম্পারেচারের তারতম্য) সাথে দুই টেবল চামচ সর্ষের তেল ও স্বাদ মত নুন দিয়ে মাংস মেখে ঘন্টা খানেক রেখে দেবেন। লেবু/টক দই ভুলেও দেবেন না। এবার গ্যাসে প্রেশার কুকার বসিয়ে এক টেবল চামচ সর্ষের তেল দেবেন৷ তেল গরম হলে তাতে এক ছোটো চামচ গোটা জিরে দেবেন, তাতে মেখে রাখা মাংস দিয়ে ভালো করে কষিয়ে পরিমান মত ঈষদুষ্ণ জল ঢেলে প্রেশার কুকারে দুটি সিটি দিয়ে গ্যাসের আঁচ বন্ধ করে রেখে দিন। এবার প্রেশার বেরিয়ে গেলে মাংস ফুটন্ত অবস্থায় ফ্রেশ, ধুয়ে জল ঝরিয়ে রাখা রাই শাক হাত দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে এতে দিতে হবে৷ ছিঁড়েই দিতে হবে কেটে দেওয়া চলবেনা। স্বাদ ব্যালেন্স করার জন্য আমি৷ এই পর্যায়ে এতে যৎসামান্য চিনি দিই (এটাও বাধ্যতামূলক নয়) মিনিট পাঁচেক ফুটিয়ে গরমা গরম ভাতের সাথে পরিবেশন করুন রাই শাক মাটন৷ বেশ পাতলা সুস্বাদু ঝোল হবে, ঘন থকথকে নয় একেবারেই। তেলের পরিমাণ বাড়াতেই পারেন, কিন্তু কম তেলে ভালো রান্না করা যায়না যাঁরা ভাবেন তাঁরা ভুল ভাবেন এই রান্না তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।
এই রান্নার স্বাদ বাড়ায় তীব্র ঝাল তাজা দল্লে খোরসানি (নেপালী ভাষায় দল্লে মানে গোল, খোরসানি মানে লঙ্কা)৷ আমি ঝাল বেশী খাই বলে কাঁচা লঙ্কার বদলে খান চারেক দল্লে দিই ৫০০ গ্রাম মাংসে। মানে শুরুতে বলা কাঁচা লংকার বদলে বা সাথে মিহিকুচো বা থেঁতো দল্লে খোরসানি (এটা করার পর অবশ্যই মনে করে বাসন মাজার বার ঘষে হাত ধোবেন নাহলে সমূহ বিপদ) । আমি এই দল্লে খোরসানি পাহাড় থেকে কিনে এনে সারা বছরের জন্য সংরক্ষণ করে রাখি। দল্লে খোরসানি সিকিম- উত্তরবঙ্গের পাহাড়ের নানা জায়গায় পাওয়া যায়, মোটামুটি ৩০০-৪৫০টাকা/কেজি দরে বিক্রি হয়। আমি সাধারণত ৫০০০ ফিট উপরের কোনো গ্রাম থেকেই কিনে আনি (ঠাণ্ডা না হলে এই লঙ্কায় ঝাল হয়না)৷ মানুষ বেড়াতে গেলে স্যুভেনির কেনে আমি নানান জায়গার রকমারি লঙ্কা, শাক-সবজি কিনি (আবার ওই মৃগ, বিবর্তন ইত্যাদি)৷ সমতলে দল্লে খোরসানি সংরক্ষণের নিয়ম হল লংকা ধুয়ে পরিস্কার কাপড়ে মুছে ফ্যানের হাওয়ায় একটু শুকিয়ে নিতে হবে। তারপর একটি কাচের বয়ামে লংকা দেওয়ার পর সমস্তটা ডুবে যাওয়া পর্যন্ত লবন দিয়ে ঝাঁকিয়ে মিশিয়ে নিন। এবার লংকা লবন-ডুবে যাওয়া পর্যন্ত ভিনিগার ঢেলে দিন৷ এতে তেল একদম দেবেন না, পেটে ব্যথা ও পেট খারাপ হবেই হবে৷ এই ভাবেই আমার বাড়িতে নানান মাপের কাচের বয়ামে শোভা পায় আর নানান ধরণের রান্নায় স্বাদ বাড়ায় মণিপুরের উমরো বা নাগাল্যান্ডের ভূতজোলোকিয়া।
দল্লে শুকিয়ে সংরক্ষণের নিয়ম হল ওই ধোয়া শুকনো লঙ্কা ফুটন্ত গরম জলে ফেলে ৩০ সেকেন্ড রেখে তুলে নিয়ে সম্পূর্ণ জল ঝরিয়ে রোদে ফেলে শুকিয়ে নেওয়া। এবার চাইলে গুঁড়ো করে নিতেই পারেন, নাও পারেন৷
আমার বেশীরভাগ পার্বণ কাটে পাহাড়ে বা জঙ্গলে, কখনও কোনো আদিবাসী গ্রামে। অমনই কখনও উড়িষ্যার গ্রামে খাওয়া শালপাতা পোড়া মুরগী, অযোধ্যা পাহাড়ের সাঁওতালী গ্রামে পিঁপড়ের ডিমের চাটনি, অথবা চেরাপুঞ্জিতে দোহ নেইয়ং আবার কখনও রামিতে ফলস ট্রেক করতে গিয়ে কাঠকুটো জ্বেলে গাইডের বানানো বাঁশপোড়া মুরগী আর বাঁশের মধ্যেই বানানো স্টিকি রাইস৷ পার্বণ থেকে পেট পুজো সবেতেই একটা ব্যাপার অবশ্যম্ভাবী – মনের ও প্রাণের আরাম৷ আর এই আরাম খেয়ে বা খাইয়ে সব চেয়ে বেশী পাওয়া যায় বলেই এক ভোজনরসিকের বিশ্বাস। Bon Appetit…
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন