জয়তী রায়
চাঁদ এখন রহস্য নেই। সব্বাই জানে সব কিছু। তবে, সেখানে রান্না হয় কি না কে জানে? রহস্য না রেখে বলে ফেলি, বেড়াতে গিয়েছিলাম MEXICO। মেক্সিকো। নামটার অর্থটা হল —চাঁদের পেট। দেশটা বিচিত্র। বিলুপ্ত প্রায় মায়া সভ্যতাকে সামান্য অনুভব যদি করতে পারি, সেই আশায় গিয়েছিলাম। মায়া সভ্যতা একটি রহস্যময় অজানা সভ্যতা। অতি শক্তিশালি মায়া সভ্যতার পতন ঘটে নানা দুর্যোগের কারণে। তবে, এখনো পর্যটকদের কৌতূহলের সীমা নেই। এখানকার একটা গুরুত্বপুর্ন জায়গা হল — চিচেন ইতজা। আমাদের গন্তব্য ছিল ওই রহস্যময় রাজ্যটি। মেসো আমেরিকান সাহিত্যে উল্লেখ আছে, Itza অর্থ জলের জাদুকর। দুর্দান্ত জায়গা। বিশ্বের নতুন সাতটি আশ্চর্যের একটি। ১,৫০০ বছরের বেশি বয়স। ঘুরে ঘুরে দেখলাম কুকূলকানের মন্দির। স্টেপ পিরামিড। সূর্যের আলো এঁকে বেঁকে তৈরি করছে সাপের লেজ। এটার মধ্যে লুকিয়ে আছে কঠিন জ্যামিতি। গোপনীয়তায় ভরা মহান প্রাচীন সভ্যতার মতই আকর্ষণীয় মেক্সিকো খাবার।
দিন সাতেক থাকার সুবাদে যখন আরামে খাচ্ছি সেই দেশেরে নানা রকমের খাবার। সঙ্গে থাকা স্থানীয় বন্ধু বলল — কেমন লাগছে মেক্সিকান খাবার?
—- দারুণ।
সংক্ষিপ্ত উত্তর শুনে, বন্ধু বলল —- প্রাচীন কালে রাঁধুনি যদি খুশি করতে না পারত, তবে সঙ্গে সঙ্গে গলা কেটে নেওয়া হত। মায়া সভ্যতায় শাসক ছিল শেষকথা। ভগবানের মত। মহা আরামে থাকত ধনীর দল। সারাদিন হাড় ভাঙা পরিশ্রম করে যেত দাস – দাসী। যুদ্ধে দখল করা ক্রীতদাসদের তো কথাই নেই। অকথ্য পরিশ্রম করতে হত। অভিজাতদের জন্যে নিত্য নতুন রান্না করা হত। রান্না নিয়ে রীতিমত পরীক্ষা নিরীক্ষা চলত বলা যায়। খুশি না করতে পারলে নিষ্ঠুর শাসকের হাতে গর্দান ছিল অনিবার্য। সোনা হীরে মুক্তো, পশু চামড়ার দামী পোশাক পরে থাকত অভিজাত শ্রেণী। আর, রাঁধুনির পরণে গরম কালে নেংটি, শীতকালে কম্বলের ঝোলা পোশাক। দরিদ্রদের ছিল মাত্র দুটি বিলাসিতা। একটি হল — স্নান। অপরটি — উল্কি।
রান্নার ভিতরের ইতিহাস শুনে মন খারাপ হলেও আজ অবস্থা বদলেছে। সত্যি বলতে, পৃথিবীতে যে গুটিকয় দেশ শিল্পে পরিণত করেছে রান্নাকে মেক্সিকো তার মধ্যে একটি।
ভুট্টা। বাপরে। ভুট্টা যে কতরকমের কত ধরণের হতে পারে, না খেলে বা না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল। ভুট্টার রুটি একবার খেলে আর ভোলা যায় না।
শাসকদের খুশি করার জন্যে দরিদ্র রাঁধুনি রীতিমত আবিষ্কার করত এক একটি অসাধারণ রান্না। তাঁদের নাম কেউ মনে রাখে নি। পুরষ্কার স্বরূপ হয়ত তারিফ নয় কাটা যেত মুন্ডু। তবু, ভুট্টা দিয়ে মদ, শুঁটি, স্কোয়াশ, লঙ্কা, হরিণ, হাঁস, তেলাপিয়া মাছ — কি নেই! রান্না নয় যেন ছবি এঁকে যেত মায়ান রাঁধুনি।
কাকাও গাছ থেকে চকলেট তৈরি হত। কাকাওয়ের বীজ এক সময় মুদ্রার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হত। আমাদের যেমন কড়ি ছিল মুদ্রার বিকল্প, কাকাও বীজ তেমনি ছিল।
ইতিহাস যেমন হোক — খাওয়ার ব্যাপারে কোনো কথা হবে না। সারাদিন ঘুরে বেড়িয়ে রঙীন রেস্টুরেন্টে বসে কি কি খাওয়া যেতে পারে বলা যাক।
১. Enchiladas —- পনির, আলু, শাক সবজি, তফু, জলপাই, কাটা পেঁয়াজ, মরিচ, সালসা, তাজা ধনেপাতা দিয়ে পরিবেশন করা হয়। লাল সস, লাল চাল দিয়ে পরিবেশন করা হয়।
২. Chiles and nogada
৩. Pozole
৪. Tamales
৫. স্প্যানিশ রাইস।
আমার সবচেয়ে পছন্দ হয়েছে Spanish rice refried Beans
পেট ভরা, সুস্বাদু ,পুষ্টিকর, পকেট সাশ্রয়কারী খাবার।
এক ঘণ্টার মধ্যে বানিয়ে নেওয়া যায়। প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার। জিরা, পেপরিকা, সালসা ভিজিয়ে রেখে রান্না করতে হয়।
আজ বরং এই একটি রান্নার রেসিপি ভাগ করে নিচ্ছি।
কি কি লাগবে:
: ১ থেকে ২ চামচ অলিভ অয়েল।
: সাদা বড় পেয়াঁজ। পাতলা করে কাটা।
: দুই কাপ লম্বা দানা বাদামি চাল।
: ৩ কাপ সবজি সেদ্ধ ঝোল।
: সালসা লাগবে। টমেটো সালসা যাবে ভালো।
: গ্রাউন্ড জিরা — নিয়ে আসবে স্প্যানিশ গন্ধ।
: স্মোকড প্যাপ্রিকা
: ১৫ আউন্স কালো মটরশুটি।
: নুন স্বাদ অনুযায়ী।
: তাজা কাটা ধনেপাতা।
মাঝারি আঁচে কিছু তেল দিয়ে পেঁয়াজ ভাজতে হবে। নরম করে। এরপরে, চাল, সবজির ঝোল, জিরা, পেপ্রিকা, সালসা যোগ করে অল্প আঁচে নাড়তে হবে। ৪০ মিনিটের মত আঁচ কমিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। চাল সেদ্ধ হবে। মটর যোগ করতে হবে। আরো স্বাদ আনতে গেলে, লাল বেল পেপার, রসুন, অলিভ, অ্যাভাগাডো যোগ দেওয়া যেতে পারে।
টেকিলার মত জনপ্রিয় পানীয় (মদ্য) যেন যৌবনের প্রতীক। দেশীয় নীল আগাভ উদ্ভিদ থেকে তৈরি। জয়েন্ট ফ্যামিলিতে বিশ্বাস করে এই দেশ। বাড়ি শুদ্ধু তুতো লোকজন মিলে মিশে হৈ হৈ করে উপভোগ করে রঙিন খাবার। একটা অদ্ভুত প্রথা আছে, দি ডে অফ দি ডেড। মৃত দিবস। এই দিনটিতে লোকেরা তাদের প্রিয়জনের আত্মার উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য দিয়ে তাদের বাড়িতে বেদী তৈরি করে। মোমবাতি জ্বালিয়ে মৃত ব্যক্তির ছবি এবং রেখে যাওয়া জিনিসপত্র। জল, খাদ্য, আগুনের জন্যে মোমবাতি বাতাসের জন্যে রঙিন টিস্যু।
ভুট্টা এবং মরিচ। বন্ধুর বাড়ির রান্না ঘর এই দুটো জিনিসে আমোদিত। আরো আছে, মটর শুটি, লাল – সাদা মাংস, আলু, টমেটো, বাদাম, অ্যাভাকাডো। স্থানীয় নানান ভেষজ।
চম্পুরাঢ় — আশ্চর্য সুস্বাদু ঘন পানীয়। ভুট্টার আটা, দারচিনি, মৌরির বীজ, ভ্যানিলা, কমলালেবু, বাদাম যুক্ত পানীয়টি খুব সুস্বাদু। ডে অফ দি ডেড এর মত বিশেষ দিনে এটি পরিবেশন করা হয়। মনে করা হয় এই পানীয়তে জাদুকরী শক্তি আছে। পান করলে অলৌকিক শক্তি লাভ হয়। জাদু শক্তি কি না জানি না, তবে, ওই যে মনের মধ্যে ঢুকে গেল এই পানীয়ের থেকে মিলবে অলৌকিক কিছু। বেশ ভালো লাগল। জাদু তো মনের থেকেই ঘটে।
বন্ধু বলল — ১০০ টির বেশি বিভিন্ন ধরণের মরিচ ব্যবহার করা হয়। হাবানেরো, জালাপেনো, এরকম আরো অনেক। দারুচিনি, লবঙ্গ এবং কোকো ব্যবহার করা হয় খুব সুন্দর করে। একটা অসাধারণ ভেষজ হল — Epazote। স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়। গ্লুটেন মুক্ত, ওষধি গুণ আছে।
সবচেয়ে বড় কথা, খাবার পরিবেশনের কৌশল। বর্ণময় উজ্জ্বল উপস্থিতি নজর কেড়ে নেয়। মন ভরিয়ে দেয়। প্রতিটি পদ সুস্বাদু। তেলাপিয়া মাছ খেলাম, জিভে লেগে আছে। একটা দেশের কত রকমের ইতিহাস। মেক্সিকান খাবার তার আশ্চর্য জনক স্বাদ, প্রাণবন্ত রঙ, খাঁটি স্বাদ, সাহসী মশলা দিয়ে লোকের মন জয় করেছে। সবচেয়ে বড় কথা, কমপ্লিট মিল। পুরো খাবার। পেট ভরে যায়। শৌখিনতা নয় প্রয়োজন মেটায়। সর্বজনের সর্ব স্তরের জন্যে উপযোগি মেক্সিকান খাবার আজ তাই জনপ্রিয়তম।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন