সঙ্ঘশ্রী সেনগুপ্ত
বাঙালির ভোজনরসিক বলে খ্যাতি আছে। তাই বোধহয় বাঙালি রান্নায় বহু বিদেশী রান্না মিশেছে, তবে তা একদিনে হয়নি। মুঘল, পর্তুগীজ, ইংরেজ, ফ্রান্স, মধ্যপ্রাচ্য বা ইয়োরোপের অনান্য দেশ থেকে অনেক রকমারি রান্না এলেও তাদের নিজের রান্নাঘরে ঢোকাতে সময় লেগেছে বাঙালির। শুধু কী আর রান্না, এসেছে বহু সবজী, মশলাও। আজ যাকে ছাড়া বাঙালির রান্নাঘর অচল সেই আলুও ১৮২০ বা ১৮২৫ এর আগে বাঙালির রান্নাঘরের দখল নিতে পারেনি। একই কথা টমেটো, গাজর, ফুলকপি, টমেটোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, তবে তারা আরও নবীন। সেদিক থেকে দেখতে গেলে পটলটি বাঙালির ঘরের ছেলে। বাঙলার মাঠঘাঠে লতায় ধরে থাকতো এই পটল। কৃত্তিবাসী রামায়ণেও পটলের পদের উল্লেখ আছে। অন্নদাশঙ্কর রায়, বলেছেন
“পটল নামে লোক ভালো
পটল চেরা চোখ ভালো
পটল খেতে ভালো যে
কিন্তু পটল তুলবে কে?”
যারা বলে মেয়েরা পেটে কথা রাখতে পারে না, তাদের সাথে আমি একমত নই। মেয়েরা ওই ছোট্ট পটলের ভেতর মশলা পুরে দোলমা বানাতে পারে এমনভাবে, যে একফোঁটা পুর বাইরে আসবে না, তারা কথা পেটে রাখতে পারবে না? দোলমা হল বাঙালির রান্নাঘরের এমন একটা পদ যাকে শীতকালে মনেও পড়ে না। শীতকালে বাজার রঙচঙে সবজীতে ভরা থাকে। একঘেয়ে তরকারি খাবার কোনো সম্ভাবনা নেই কিন্তু গরমকালে যখন আলুপটল, পটল পোস্ত, পটলভাজা খেয়ে খেয়ে পটলের দিকে তাকালে পটল তুলতে ইচ্ছে করে, তখন অনায়াসে গৃহিনীরা বানিয়ে ফেলেন দোলমা। ফ্রিজারে রাখা কিমা, মাছের অপছন্দর টুকরোগুলো, পুরনো চিংড়িমাছ সবকিছুই পুরে ব্যবহার হতে পারে, এমনকি কেটে যাওয়া দুধের ছানাও মশলা মিশ্রিত হয়ে পটলের পেটে নিশ্চিন্ত আশ্রয় পায়।
আমরা বাঙালিরা যতই দোলমাকে জিহ্বের মাপে করে নিই না কেন, আদতে দোলমা কিন্তু আমাদের নয়, খাঁটি বিদেশী। মেডিটেরিয়ান অথাৎ ভূমধ্যসাগরের তীরের নীল চোখের সুন্দরীর রান্নাঘর থেকে গঙ্গার তীরের সজল চোখের বাঙালি বউটির ঘরে আসতে তাকে বিস্তর পথ চলতে হয়েছে। আদতে খাবারটির নাম ছিল ডলমেডস, যা গ্রীসে সারাবছর নানারকম পুর সহযোগে আজও বানানো হয়। প্রাচীন গ্রীসে বাইরের মোড়কটি বানানো হত কচি ডুমুর পাতা বা আঙুরপাতা দিয়ে। টার্কিশরাও করতেন আঙুরপাতার ব্যবহার। তার পুর হিসেবে কখনও ভাত, কখনও মাছ,কখনও মাংস বা বিভিন্ন সবজী, ফল ব্যবহার করা হত। তারপর অবশ্য নানা সবজীর ভেতরে মশলা ঢুকিয়ে দোলমা বানানোর রেওয়াজ শুরু হয়। টমেটো, বেগুন, পেঁয়াজ, বাঁধাকপির পাতা সবকিছুর ভেতরই পুর ভরা হয়। ঋতু আর অঞ্চল ভেদে তা বদলে বদলে যায়। দোলমা শব্দটা অবশ্য গ্রীসের নয়, তুর্কীদের দান। দোলমাদ শব্দের অর্থ হল ভর্তি করা। আর বাংলায় তুর্কী শাসকদের হাত ধরেই বোধহয় ঢোকে দোলমা। অবশ্য একে আরও জনপ্রিয় করতে সাহায্য করছেন আর্মেনিয়ানরা।
বাঙালি হেঁসেলে এসে দোলমার দুটি ভাগ হয়েছে, আমিষ আর নিরামিষ। আমিষে মাছ বা মাংসের কিমা আর নিরামিষে নারকেল, পোস্ত, ছানা সবই ব্যবহার করা হয়।
উপকরণ: আমিষ দোলমা বানানোর জন্য।
পটল একটু বড় সাইজের।
মাংসের কিমা ৩০০ গ্রাম
পেঁয়াজ দুটি
কাঁচা লঙ্কা
রসুন
গরমমশলা
নুন ও চিনি
এবার গ্রেভি বানানোর জন্য
কাজুবাদাম কয়েকটি
পেঁয়াজ বাটা
লঙ্কাগুড়ো
দই তিন টেবিল চামচ
ঘি
গরমমশলা, নুন মিষ্টি
পটলের ছালটা হালকা করে চেঁছে নিয়ে নুন আর অল্প গরম জলে ডুবিয়ে রাখতে হবে। এরপর বোটার দিকটা অল্প কেটে নিয়ে একটা সরু চামচের পেছনের দিকটা দিয়ে পটলের মধ্যের বীজগুলো সব বের করে নিতে হবে। এবার কড়াইতে অল্প তেল দিয়ে পেঁয়াজ কুচি, রসুন, আদা আর কাঁচালঙ্কাকুচি দিয়ে ভালো করে ভাজতে হবে তারপর তাতে কিমা দিতে হবে। এবার কম আঁচে কিমাটা রান্না করতে হবে। নুন মিষ্টি স্বাদ অনুযায়ী দিতে হবে। গরম মশলা ছড়িয়ে রান্নাটা শেষ করতে হবে।
এবার আরেকটা কড়াইতে তেল নিয়ে ফাঁপা পটল গুলো ভালো করে ভাজতে হবে। তারপর কিমার মিশ্রণটা ঠান্ডা হলে আস্তে আস্তে সাবধানে পটলের খোলের মধ্যে ঢোকাতে হবে মিশ্রণটা। এই সময় তাড়াহুড়ো করলে হবে না কিন্তু। পটলগুলো পেটের ভেতর কিমার মশলাটা পুরে অল্প ময়দার লেচি দিয়ে মুখটা বন্ধ করে দিতে হবে। এই অবস্থায় আরেকবার হালকা করে ভেজেই খাওয়া যায় এই দোলমা। আমি সাধারণত তাই খাই।
কিন্তু গ্রেভি বানিয়ে খেলে আরও ভালো লাগে। একটা মিক্সিং জারে পাঁচ ছটা কাজু গুড়ো করে নিতে হবে। এবার একটা পেঁয়াজ বেটে নিতে হবে ওই জারেই। কড়াইতে পটল ভাজার পর যে তেলটা আছে তাতে ফোড়ন হিসেবে অল্প জিরে, একটু দালচিনি আর একটা ছোট এলাচ দিতে হবে। তারপর একটু চিনি রঙ হবার জন্য। এরপর বাটা পেঁয়াজটা দিয়ে বাদামি করে ভাজতে হবে। তারপর অল্প শুকনো লঙ্কা গুড়ো দিয়ে, তেল ছাড়লে দই দিতে হবে তিন টেবিলচামচ। কাজুর গুঁড়োও দিতে হবে তখন। ভালো করে নাড়াচাড়া করে তাতে এককাপ গরম জল দিতে হবে। জল ফুটলে খুব সাবধানে ছাড়তে হবে পটলগুলো। মাখামাখা হয়ে গেলেই ঘি গরমমশলা ছড়িয়ে নামিয়ে নিতে হবে।নুনমিষ্টি অবশ্যই নিজেদের জিভের মাপে।
পুরটা নিরামিষ বানাতে চাইলে আমি অল্প তেল দিয়ে তাতে কাঁচালঙ্কা আর আদাবাটা দিই। ছানাটা অল্প তেলে ভালো করে নাড়াচাড়া করি, কিশমিশ দিই কয়েকটা, দিই নুন মিষ্টি। তার সাথে পটলের নরম বীজও মিশিয়ে নিই। তারপর খানিকক্ষণ পর জল টেনে গেলে এটা পুরের উপযুক্ত হয়। সেটাও চমৎকার খেতে হয়। তবে পটলের দোলমা গ্রেভিতে সাবধানে ফেলবেন কারণ এর মনটা বাঙালি মেয়ের মতই নরম আর কোমল বটে কিন্তু যদি ময়দার ওই প্রলেপটুকু খুলে যায়…..তাহলে ভয়ঙ্কর। পুরের সব মালমশলা বেরিয়ে আসবে আগ্নেয়গিরির মত ঠিক যেমন রেগে গেলে আমরা সবাই শ্রীমতী ভয়ঙ্করী।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন