rannaghar-kheer-kamal

ক্ষীর কমল
অপর্ণা গাঙ্গুলী



দিম্মির মেয়েবেলার নাম কমল বলেই কিনা জানি না, ওঁর হাতে তৈরী একটি বিশেষ মিষ্টির নাম দেওয়া হয়েছিল ক্ষীর কমল। ক্ষীর কমল দেখতে একটা অদ্ভুত মায়াবী সূর্য্য ওঠা প্রত্যাশাপূর্ণ দিনের মতোই। দিম্মির সর্বসাকুল্যে একটিই জামাই। আমার বাবা। তা সেই জামাইয়ের আগমনে, প্রায় হাঁটুর ওপরে শাড়ি গুটিয়ে দিম্মি যেভাবে ‘চরিচাপটে’ লুচি বেলতে বসতেন, সে এক সুখকর দৃশ্য। ‘চরিচাপটে’ শব্দটি আমার বাবার আমদানী। এ হেন শব্দ আমি এর আগে কখনো শুনি নি বা পড়ি নি সে যা হোক, ঘটনার সত্যতা বজায় রাখতেই শব্দটি অবিকৃত রাখলাম। বাবা বলতেন মাকে, অয় দেখো গো, তোমার মা কেমন …. ইত্যাদি। সে যা হোক, জামাই আদরের এক অপরিহার্য অঙ্গ ছিল ওই ক্ষীর কমল। বাবা পেতেন, কাঁসার জামবাটি ভর্তি এক বাটি আর আমরা পাতে এই এত্তটুক করে। তাই সই। সে ক্ষীর আর কমল মানে কমলা লেবুর কোয়া যখন মুখে মিলে মিশে রূপকথা রচনা করতো, তার, তারই আলাদা। আমরা ভাইবোনেরা খুনসুটি করে এক আঙুল ডুবিয়ে মুখে তুলতাম, কারটা কত বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারে … গরুর দুধ জ্বাল দিতে দিতে যখন বেশ ঘন হয়ে উঠবে, আর তার রঙ হবে পুব আকাশের প্রথম সূর্যের আভা, কিংবা চাঁদের জোছনার মতো গোলাপী তখনই বুঝতে হবে দুধ ক্ষীর হবার পথে। তখন সেই দুধ বারবার নাড়তে হবে। যতটা দুধ নেওয়া হবে, তার অর্ধেক করতে হবে জ্বাল দিয়ে। যেন তলা ধরে না যায়। ধরা গন্ধ হলেই সব মাটি।



দিম্মি ছিলেন ভারী ঈশ্বর বিশ্বাসী। বলতেন, দেখ রে মেয়ে, এ যেন সেই ঈস্বরে বিশ্বাস করা আর নাম করা। যাই হোক আর তাই হোক, ওই দুধের কড়া থেকে মন উঠবে না কিছুতেই। সংসারে আরও কত যে কাজ, কিন্তু মন সেই দুধের কড়াতেই, যতক্ষণ না ক্ষীর তয়ের হয়। এইবার আস্তে আস্তে চিনি দাও আন্দাজমতো, যে যেমন মিষ্টি খেতে পছন্দ করো। চিনিই দিতে হবে কারণ কমলা লেবুর সঙ্গে গুড় এর যোগসাজস তেমন জুতের নয়। বেশ ক্ষীর তৈরী হলেই কমলা ছাড়াতে হবে নিপুণভাবে। দিম্মি ওইভাবেই বসে বসে কমলা ছাড়াতেন ব্যস্ত হাতে। এক লিটার দুধে দু’টি মাঝারি মাপের কমলা হলে ভালো হয়। কমলা ছাড়িয়ে শুধু ওর বুকের ফুলগুলো ছড়িয়ে দিতেন ইতিউতি, উনুন থেকে নামিয়ে নেওয়া ক্ষীরে। ওঁর গোলাপী হাতের আভা মিশে থাকতো কমলা লেবুর রঙে, বর্ণে, গন্ধে। আর সবচেয়ে শেষে মিলিয়ে দিতেন ভালোবাসার পরাগ একমুঠি। জাঁতি দিয়ে বাদাম কেটে খুব সরু সরু ছড়িয়ে দিতেন তার ওপর। এর পর কুরুশে বোনা সাদা খুনচিপোষ চাপা দেওয়া ক্ষীর কমল দেওয়া হতো রাধামাধবের ভোগে।



দাদু আর দিম্মির মানামানি, রাগারাগি লেগেই থাকতো। একবার দাদুর রাগ ভাঙাতে দিম্মি জামাইয়ের জন্যে না বানিয়ে দাদুভাইয়ের জন্যে ক্ষীর কমল বানালেন। আমাদের সেবার সেই মিঠাই খেয়ে মনে হয়েছিল একটু যেন পাতলা, কী যেন নেই, কিন্তু দাদু খুব খুশি। দিম্মির কাছে এসে বললেন, বুঝলে কমল, আজকের ক্ষীর কমলটেই বাপু, গ্র্যান্ড হয়েছে, দিব্য হয়েছে বটে। দিম্মি হেসে বললেন, তা হবে ।

পরে আমাদের দিকে চোখ মিচকে বললেন, আজ একটু ধরে গিয়েছিলো বুঝলি, গোলাপ জল দিয়ে ম্যানেজ দিয়েছি, বাহাত্তুরে বুড়ো বুঝলে তো!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *