rannaghar-nolrajar-biryani-ranna

নলরাজার বিরিয়ানি রান্না
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

 

মহাভারতের বনপর্বে নল-দময়ন্তী উপাখ্যান প্রসঙ্গ এক অন্যতম অধ্যায়। সেখানেই বনবাসে মন্দভাগ্য এবং দুঃখক্লিষ্ট যুধিষ্ঠিরকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন বৃহদাশ্ব মুনি আর শোনাচ্ছেন তাঁর চাইতেও অধিক ক্লিষ্ট, রিক্ত, সর্বস্বান্ত এক দুঃখী রাজার গল্প। আর তিনিই মহাভারতের নল রাজা যিনি নিষধরাজ বীরসেনের জ্ঞানী পুত্র,  ব্রাহ্মণ পালক, বেদজ্ঞ, দ্যুতক্রীড়াপ্রিয়, অশ্বতত্ত্বজ্ঞ সত্যবাদী এবং বৃহৎ অক্ষৌহিণী সেনার অধিপতি ছিলেন। এছাড়াও নল ছিলেন একজন উত্তম পাচক এবং দৈববলে যমরাজের আশীর্বাদেই তাঁর কালে কালে এমন রন্ধনকুশলতা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিদর্ভরাজ ভীমসেনের অসামান্যা সুন্দরী এবং গুণবতী কন্যা দময়ন্তীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ এবং সন্তান লাভ হলেও তাঁদের জীবনে একদা নেমে আসে ঘোর বিপর্যয়।

অন্যান্য গুণ ছাড়াও সুপাচক হিসেবে নলরাজার খ্যাতিলাভের মূলে ছিলেন তাঁর অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন কোশলরাজ ঋতুপর্ণ। আর তাঁরই অনুগ্রহে এবং উৎসাহে রন্ধনশাস্ত্রের ওপর গ্রন্থ রচনার জন্য বিখ্যাত হয়ে গেলেন মহাভারতের রাজা নল। নল বিরচিত “পাকদর্পণ” গ্রন্থটি প্রাচীন ভারতের রন্ধনশাস্ত্রের সর্বপ্রথম এবং প্রাচীনতম রন্ধনসাহিত্যের দলিল। মহাকাব্যিক যুগের রন্ধনসাহিত্যের এই নজিরবিহীন দলিলের প্রলেখন বা দস্তাবেজীকরণ এর সূত্রপাত রাজা নলের হাত ধরে। ভারতবর্ষের আয়ুর্বেদিক ঐতিহ্য, চরক, সুশ্রুত, বাগভট্ট প্রভৃতি ঋষিদের পরম্পরা অনুসরণ করে পাকদর্পণ গ্রন্থটিই আমাদের দেশীয় রন্ধনশাস্ত্রের ওপর রচিত প্রথম পুস্তক।

পাপাত্মা, ছিদ্রাণ্বেষী কলির প্রভাবে নলের জীবনে ঘনিয়ে এসেছিল দুঃসময়। সর্বত্যাগী রাজার বনবাসে দময়ন্তীর সঙ্গেও বিচ্ছেদ হয়েছিল কিন্তু কর্কোটক নামক এক বন্ধু নাগের প্রভাবে যেন পুনর্জন্ম হল বনবাসী নলের। চেহারায় আমূল পরিবর্তন হল আর তিনি এসে পৌঁছলেন অযোধ্যার ইক্ষ্বাকু বংশের রাজা ঋতুপর্ণের দরবারে। নতুন নাম হল বাহুক। অশ্বচালনা ব্যাতীত বাহুক যে একজন সুদক্ষ পাচক তাও রটে গেল রাজবাড়ির অন্দরমহলে। স্বয়ং রাজা ঋতুপর্ণই বাহুকের রন্ধনশাস্ত্রে আগ্রহের কথা শোনামাত্রই দায়িত্ব দিয়েছেন রাজবাড়ির পাকশালারও। তবে সেদিন নিজেকে প্রমাণ করতে, নিজের পারঙ্গমতা বোঝাতে বাহুককে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল রাজা ঋতুপর্ণের সম্মুখে। সেই মুহূর্তে এমন নিরাপদ আশ্রয়, আহার এবং যুগপৎভাবে কর্মসংস্থানেরও প্রয়োজনীয়তা আবশ্যক ছিল তাঁর জীবনে। অতএব নিজেকে প্রমাণ করার সেই ক্ষণে রন্ধনশাস্ত্র নিয়ে নিজের অর্জিত সকলপ্রকার জ্ঞান অকপটে উজাড় করে দিতেও কুন্ঠিত হননি তিনি।

এহেন সর্বহারা রাজার তখন রাজবাড়ির পাকশালায় চাকুরী প্রাপ্তি কি আর মুখের কথা? যমরাজের আশীর্বাদ তো মাথায় ছিলই কিন্তু জীবনে কোনোদিন রন্ধনের প্রবেশিকা পরীক্ষার সম্মুখীন তো তিনি হননি। কিন্তু এক লহমায় অভিজ্ঞ পাচক নলের মনোবল তো বৃদ্ধি পেলই আর সেইসঙ্গে প্রাপ্তি হল ভারতবাসীর কারণ সেই বই ভারতবর্ষের পাকশাস্ত্রের অন্যতম দলিল হয়ে রইল। এই হল পাকদর্পণ গ্রন্থের প্রেক্ষাপট।

রাজা ঋতুপর্ণ রীতিমত বাজিয়ে নিলেন বাহুকবেশী নলকে। মানবশরীরের প্রয়োজনীয় খাদ্যাখাদ্য থেকে সেসবে আয়ুর্বেদের গুণাগুণ, তিথি ও ঋতু ভেদে খাদ্যের বাছবিচার থেকে আহার্যপ্রস্তুতির কৌশল এমন কি কোন মাংসের কী দ্রব্যগুণ বা পঞ্চবিধভোজন বা ভোক্ষ্য, চর্ব্য, চূষ্য, লেহ্য, পেয় ইত্যাদি আর খাদ্যবস্তু কেমনভাবে রন্ধন করলে পুষ্টিগুণ বজায় থাকে সবই পাকদর্পণে তুলে ধরেছিলেন নখদর্পণে। আর দ্বাপরযুগে রচিত মহাভারতের কালে শালিধানের সামান্যান্ন বা শুদ্ধান্ন (প্লেইন রাইস) থেকে মাংসোদন (পলান্ন বা বিরিয়ানির অনুরূপ) অথবা ত্রহর্যান্ন বা তেহরির রেসিপি যে নল রাজার উদ্ভাবন তা বুঝতে বাকি থাকে না। সেদিন মুগ্ধ হয়েছিলেন ঋতুপর্ণ আর অভিজ্ঞ পাচক নলের রন্ধনশাস্ত্রের এহেন পারঙ্গমতা জেনে বিস্মিত হয়েছিলেন। 

স্বামীর থেকে বিচ্ছিন্না দময়ন্তীও একসময়ে হাজির হয়েছিলেন সেই রাজ্যে। প্রথমে স্বামীকে বাহুকের বেশে চিনতে হয়ত পারেননি কিন্তু রাজবাড়ির পাকশালায় রন্ধনের চিরপরিচিত ঘ্রাণ পেয়েই নিশ্চিত হয়েছিলেন যে এই বাহুকই তাঁর স্বামী হতে বাধ্য কারণ যেসব মশলাপাতি ব্যবহার করে নল পলান্ন প্রস্তুত করতেন সেই কৌশল আর কেউ জানার কথা নয়। স্ত্রী হিসেবে আর সেই সুখাদ্য গ্রহণ করে একমাত্র তিনিই অবগত আছেন। কারণ তিনিও রন্ধনবিশারদ নলের গুণমুগ্ধ ছিলেন।

এবার আসি নলরাজার বিভিন্ন রকমের অন্ন প্রকরণে। সে যুগে মূলত শালিধানের অন্নই গ্রহণ করতেন রাজ পরিবারের লোকজন। সে যুগে প্রাপ্ত উৎকৃষ্ট শালিধানের চালই ব্যাবহারের কথা পেলাম পাকদর্পণে। এই শালিধানকে প্রাচীনকালে বলা হত রাজঅন্ন। হয়তবা তা আজকের বাসমতীর মতই মহার্ঘ ছিল। আর তা দিয়ে কাঠ কয়লার আঁচে বিশুদ্ধান্ন থেকে বিভিন্ন ধরণের উৎক্রাণোদক (উদক-জল) বা নানান সুগন্ধী পুষ্প, কস্তুরী, কর্পূর প্রভৃতির জলে মাংসের টুকরো, তরমুজের বীচি ইত্যাদি ফেলে চালের সঙ্গে ফুটিয়ে প্রস্তুত হত বিশেষ পলান্ন। পাকদর্পণে ছাগ (পাঁঠা), মেষ(ভেড়া), কুক্কুট (মুরগি), বিহগ (পাখি)…এমন সব পলান্নের উল্লেখ দেখি। কখনও শুদ্ধান্ন রান্নার সময় দেখি তার মধ্যে তক্র বা ছাচ অথবা দুধ ঢালতে তো কখনও দেখি অন্ন প্রকরণের সঠিক উপায়। ভাত সিদ্ধ করতে সঠিক জলের পরিমাপ, এসব মাথায় রাখতে হবে একজন সূদ বা পাচক কে। অধিকক্ষণ তাপের প্রভাবে আঠালো বা অতিসিদ্ধ হলে চলবে না তাহলে চালের দানা ভঙ্গুর হয়ে যাবে। আবার স্বল্প সময়ে সিদ্ধ হলে তা অভগ্ন হবে ঠিকই কিন্তু তা পাচনে সহায়ক হবে না। তাই শুদ্ধান্ন হবে অভঙ্গুর এবং তা কখনোই গলিত নয়। রন্ধনের সময় পাত্রমধ্যে ফুটন্ত অন্নকে ক্রমাগত নাড়তে হবে। তবে কোথাও ফ্যান ঝরানোর কথা নেই। রাজা নলের মতে এমন ভাতই মানুষের দীর্ঘায়ু এবং সুস্বাস্থ্য প্রদানে সাহায্য করে। (পাকদর্পণ, পৃষ্ঠা ২০-২১)* 

সেই প্রসঙ্গেই মনে পড়ে এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে শ্রীহর্ষকে। বাংলার সেন রাজাদের আমলে রাজা জয়চন্দ্রের পৃষ্ঠপোষক কবি এই শ্রীহর্ষ তাঁর লেখা নৈষধচরিতে নল-দময়ন্তীর বিয়ের ভোজে গরম ধোঁয়া ওঠা অভগ্ন, ফুরফুরে সাদা ভাতের উল্লেখ করেছেন।

“পরিবেশিত অন্ন হইতে ধুম উঠিতেছে, তাহার প্রতিটি কণা অভগ্ন, একটি হইতে আরেকটি বিচ্ছিন্ন! সে অন্ন সুসিদ্ধ, সুস্বাদু আর শুভ্রবর্ণ, সরু ও সৌরভময়!’’**

এই অভগ্ন ভাত বলতে মনে পড়ে বাঙালীর ঝরঝরে, ফুরফুরে দুধ সাদা জুঁইফুলের মত ভাতকেই। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় আমরা দেখি সবাই স্টিকি রাইস খেতেই বেশী পছন্দ করে। আমরা হয় খাই ফ্যানাভাত আর নয় খাই ঝরঝরে স্টিমড রাইস আর নয়ত একটার গায়ে একটা না লাগা ধূমায়িত পোলাও ভাত। তবে নলের রেসিপিতে কোথাও ফ্যান ঝরিয়ে ভাত রান্নার কথা পেলাম না।

রাজ অন্তঃপুরের পাচক বাহুকের কাছে রাজা ঋতুপর্ণ সামান্যমাংসোদন রন্ধন পদ্ধতি সম্বন্ধে জানতে চাইলে বাহুকবেশী নল জানালেন বিশদে।  

এই সামান্যমাংসোদন নির্মাণবিধির বাংলা করলে দাঁড়ায় সাধারণ মাংসের পোলাও। শুধু রেসিপিই নয় রাজার কথায় বাহুক এবার এযাবতকাল তাঁর মাংসোদন বা পলান্ন নামক মাংসমিশ্রিত অন্নের এই রাজকীয় পদটির ওপর যাবতীয় গবেষণা এবং সেই অভিনব সুখাদ্যের খাদ্যগুণের কথাও জানালেন।

এই পুলাও বা পোলাও রান্নায় দক্ষতা অর্জন তাঁর মতে একটি শিল্প । যে পাত্রে পোলাও রান্না হবে তার এক চতুর্থাংশ ধোয়া শালিধান নিলে বাকী তিন চতুর্থাংশ বিশুদ্ধ জল নিতে হবে। প্রথমে ফুটন্ত জলের মধ্যে চাল দিতে হবে। তারপর চাল আধসেদ্ধ হলে প্রথমে সৈন্ধব লবণ আর ভাতের জল সম্পূর্ণ টেনে নিলে ঘি দিতে হবে। কিছুক্ষণ উনানের আঁচে তা থাকবে। এবার একে একে তার মধ্যে যোগ করতে হবে নারকোলের দুধ, কেতকী ফুল (Pandanus tectorius বা screw pine flowers, বা আমাদের আজকের কেয়াগাছের ফুল থেকে প্রাপ্ত কেওড়ার জল), সামান্য কর্পূর, কস্তুরী (Musk বা মৃগনাভি থেকে প্রস্তুত সুগন্ধ), কয়েকটি পর্পট পাতা ( আধুনিক কালে সুপরিচিত সুগন্ধি পার্সলে পাতার বৈজ্ঞানিক নাম Petroselinum crispum, সেটিই শুকনো করে দেওয়া হত কি না তা জানা নেই । আমরা জানি পর্পট আক্ষরিক অর্থে পাঁপড় অর্থাৎ তা হল কুড়মুড়ে বস্তু। তবে আয়ুর্বেদ অভিধানে পর্পট হল ক্ষেৎপাপড়া যার ওষধি গুণ প্রচুর। তেমনি কোনও সুগন্ধি crispy and crunchy পাতা দিয়ে পোলাও রান্নার রীতি হয়ত ছিল সে কালে। যা গুরুপাক এই অন্নের হজমে সহায়তা করে। আমরা তেজপাতা ব্যাবহার করি এখন। এরপর আরও কিছুটা ঘি দিতে হবে। আর সবশেষে পাত্রের ঢাকা বন্ধ করে চারিধার দিয়ে ময়দার পুলটিশ দেওয়ার রীতিও জানিয়েছেন বাহুকবেশী নল যার ফলে পাত্রের অভ্যন্তরের যাবতীয় সুগন্ধ নির্গমনের পথ রুদ্ধ থাকে। পাত্রটিকে ঈষৎ আন্দোলিত করতে হবে। আরও কিছুক্ষণ এভাবে কয়লার আঁচে রেখে সেই সাধারণ বা আজকের প্লেন পোলাও পরিবেশন করার রীতি। এর মধ্যে প্রথম থেকে মাংসের টুকরো নিক্ষেপ করলেই তা সাধারণ বা সামান্য মাংসোদন বা আজকের বিরিয়ানির অনুরূপ। অর্থাৎ ভাতের সঙ্গে মাংস এবং সুগন্ধ মিলেমিশে এই পল মিশ্রিত অন্ন বা পলান্নের এক অভিনব রসায়ন তৈরী হবে যা মানুষের রসনা তৃপ্তির এক অভাবনীয় পদ হিসেবে আজও সমাদৃত ভারতবর্ষ তথা সারা বিশ্বে। এই সাধারণ মাংসোদনের গুণ নিয়ে নল জানাচ্ছেন এটি রুচিকর, সুস্বাদু, পুষ্টিকর এবং শক্তিবর্ধক আহার।  (পাকদর্পণ, পৃষ্ঠা ২১-২২)*  

সেখানেই থেমে রইলেন না বাহুক। এরপরেই জানালেন তহর্যন্ননির্মাণবিধি বা তেহরির রেসিপি ।

আমরা বর্তমানকালে খুব নাম শুনছি ভাতের একটি পদ তেহরি বা তাহরির যা এখন হল ভারত, নেপাল এবং বাংলাদেশের হলুদ চালের বিশেষ ব্যুটিক রেসিপি। মাংস ইত্যাদি সহযোগে রান্না করা বিরিয়ানির জাতভাই এই তহরি বা তেহরি (Tahari or Tehri) রান্নার কথা বিশদে জানিয়েছিলেন মহাভারতের আমলে নল রাজা। পাকদর্পণের সংস্কৃতশ্লোকে তা তহর্যন্ননির্মাণবিধি নামেই উপস্থিত। মনিয়ার-উইলিয়ামস সংস্কৃত-ইংরেজি অভিধান অনুসারে, হিন্দি শব্দ তেহরি সংস্কৃত শব্দ তাপাহারি থেকে উদ্ভূত হয়েছে যা সুগন্ধি চাল, অল্প ডাল, শাকসবজি, মাংসের টুকরো এবং বিশেষ করে কিছু মশলা সহযোগে ঘি দিয়ে রান্না করা একটি হরিদ্রাভ অন্ন। নলের আমলে আলু পড়ত না এই তেহরিতে। পর্তুগীজরা এদেশে আলু আমদানি করলে তা কালে কালে যুক্ত হয়েছে তেহরির অভ্যন্তরে। 

তা কি ছিল নল রাজার তেহরির রেসিপিতে?

নল বিরচিত পাকদর্পণ গ্রন্থের মূল সংস্কৃত শ্লোকের অনুবাদ করলে দাঁড়ায় এই তহরির নির্মাণবিধি এবং তার গুণাবলী।

রন্ধনবিশারদ ব্যক্তি প্রথমে কড়াইতে জল নিয়ে তার মধ্যে খণ্ডিত শিম্ব ( ফ্ল্যাট বিনস বা সংস্কৃতে নিষ্পাভ ) বা টুকরো করে কাটা শিম দিয়ে যত্নপূর্বক রান্না করবেন। অত:পর তার মধ্যে অর্ধসিদ্ধ চাল ও কুক্কুট মাংস অর্থাৎ মুরগীর মাংস সংমিশ্রিত করবেন। নির্দিষ্ট পাত্রে এগুলিকে আগুনের তাপে ততক্ষণ ভাজতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না এই তিনটি উপকরণ (চাল, শিম, মাংসখণ্ড) সুচারুরূপে পক্ব হচ্ছে। এই ব্যঞ্জন উত্তম আহাররূপে পরিবেশনযোগ্য। এই ব্যঞ্জন অত্যন্ত সুস্বাদু এবং মানবশরীরে পাচনতন্ত্রের উন্নতিবিধায়ক। শরীরের বাতব্যাধির অপহারকও বটে। প্রাজ্ঞজন এই ব্যঞ্জনকেই ‘তহরি’ নামে অভিহিত করেন।

(পাকদর্পণ, শ্লোক ৮১-৮৫, পৃষ্ঠা-২২) *

আরেকটি তহরির রেসিপিতে আবার মুগডাল যোগ করার কথা রয়েছে। তবে এ নিয়ে দ্বিমত আছে। মুদ্গ আয়ুর্বেদে আমাদের মুগডাল। কিন্তু ইংরেজি অনুবাদে যাকে Kidney beans বলা হয়েছে তা আমাদের কাছে রাজমার অনুরূপ।

সেখানে পাত্রে ফুটন্ত জলের মধ্যে যখন চাল ফুটবে তখন তার মধ্যে মুদ্গ (বা মুগ ডাল) দিতে হবে। এরপর সৈন্ধব লবণ। চাল এবং ডাল আধ সেদ্ধ হলে তার মধ্যে দিতে হবে পরিষ্কার করে ধোয়া মুরগির মাংসের টুকরো। এবার চাল, ডাল, মাংস একই সঙ্গে নাড়াচাড়া হবে সেই পাত্রেই। সব শেষে কিছুটা ঘি ছড়াতে হবে। তাঁর সবধরণের মাংসোদন বা পলান্ন / পোলাও রেসিপিতে এই অন্ন প্রকরণের মশলাগুলিও নিশ্চিত দিতে হবে তেহরিতেও। রান্নায় আমার সামান্যতম নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও বইটি পড়ে তেমনি মনে হল। মাংসোদনে উল্লিখিত সব উপকরণ যেমন কেতকী, কস্তুরী, কর্পূর, জাফরান, পর্পট আর সর্বোপরি দরাজ হস্তে শুরু ও শেষে ঘি দিতে হবে এই তেহরীতে। (পাকদর্পণ, শ্লোক- ৮১-৮৫, পৃষ্ঠা- ২২) *

এছাড়াও মহাভারতের যুগে নল যে লাবুক-পলান্ন বা কোয়েল পাখির মাংসের পোলাও, কুক্কুটমাংসতৈলোদন বা তেলযুক্ত মোরগ পোলাও, সূক্ষমাংসোদন বা মাংসের কিমা পোলাও রান্নার কৌশল, প্রণালী এবং গুণাবলী শিখিয়ে গেছিলেন সেই যুগে, তা ভাবলে বিস্ময় জাগে। আয়ুর্বেদ ধন্য ভারতবর্ষে যেসব মশলাপাতি দিয়ে সেই অসামান্য পলান্ন রান্না হত সেগুলির ভেষজ গুণাগুণ পড়ে চমকে উঠতে হয়। তাই কোশলরাজ ঋতুপর্ণের দরবারে সামান্য পাচকের পদে চাকরি পেয়ে জীবন যুদ্ধে জর্জরিত নলই শুধু সে যাত্রায় বেঁচেবর্তে যাননি। ধন্য হয়েছি আমরাও। এসব রেসিপিই কপি পেস্ট হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। তাই জন্যই বোধহয় বলে যা নেই ভারতে তা নেই মহাভারতে। ভারতবর্ষের রন্ধন সংস্কৃতির একটি দর্পণও বটে।

তথ্যসূত্র

নল বিরচিত পাকদর্পণ (English Traslation from Sanskrit)  PAKDARPANA OF NALA (Chaukhambha Orientalia Varanasi) by Dr. Madhulika. Edited by Prof Jay Ram Yadav)

**নৈষধচরিত – শ্রীহর্ষ

চিরঞ্জীব বনৌষধি ( ১-৯ টি খন্ড) (আনন্দ পাবলিশার্স) – শিবকালী ভট্টাচার্য

*মূল সংস্কৃত শ্লোকের অনুবাদ – ডঃ সাবেরী রক্ষিত, রামকৃষ্ণ সারদামিশন বিবেকানন্দ বিদ্যাভবনের সংস্কৃতের অধ্যাপক। 

1 thought on “rannaghar-nolrajar-biryani-ranna

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *