rannaghar-polao-ghee-bhat

পোলাও অথবা ঘি – ভাত
সাবিনা ইয়াসমিন রিংকু

 

রক্তিমের কথায় আলেয়ার মনে এখন আর কোনো আলোড়ন হয় না। না আনন্দ হয়! না দুঃখ! সারাদিনের মধ্যে লাঞ্চব্রেকেই রক্তিমের সঙ্গে দেখা হয় তার। রক্তিম বাড়ি থেকে অল্প ভাত খেয়ে অফিসে আসে। দুপুরে আলেয়া এবং আলেয়ার মত অনেকেই যখন বাড়ি থেকে আধুনিক লাঞ্চবক্সে ক’রে ভাত, তরকারী, মাছের ঝোল বা মাছভাজা নিয়ে এসে ক্যান্টিনের থালায় ঢেলে খায় তখন রক্তিম দু পিস চিকেন স্যান্ডউইচ চেবোয়। সঙ্গে কফি। আলেয়া আর একটা প্লেট আনতে বলে হরিয়াকে। সেই প্লেটে তার থেকে অল্প ভাত, তরকারি, ভাজা তুলে দেয় রক্তিমকে। অন্য কলিগরা দ্যাখে। মনেমনে কিছুমিছু ভেবেও নেয় হয়ত! রক্তিম কিন্তু খুব ভালোভাবে খায়। রক্তিম কেমন যে খেয়ে আসে সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না আলেয়ার। 

রক্তিমের বউ শ্রাবণী একটা নামী বেসরকারি স্কুলে পড়ায়। মাইনে এবং মেজাজ…. দুটোই বেশ চড়া। শ্রাবণীকে দেখেছে আলেয়া। নতুন ফ্ল্যাটের গৃহপ্রবেশ উপলক্ষে অফিসের অনেককেই বলেছিল রক্তিম। আলেয়াও গিয়েছিল। তখনই শ্রাবণীর সঙ্গে তার আলাপ হয়। বেশ একটা দিদিমণিসুলভ গাম্ভীর্যের ছাপ আছে শ্রাবণীর চোখেমুখে। বাড়িতে দশবছরের পুত্র এবং সত্তর বছরের শ্বশুর আছেন। 

রক্তিম যখন সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়িটা বিক্রি করে নতুন গাড়ি কিনল, তখন আবার নেমতন্ন পেয়েছিল আলেয়া। আর কাউকে নয়, শুধু আলেয়াকেই বলেছিল রক্তিম। তবে এবার বাড়িতে নয়। দক্ষিণ কলকাতার একটি অভিজাত রেস্টুরেন্টে। তখনই সে বুঝতে পেরেছিল রক্তিম খেতে খুব ভালবাসে। সবরকমের খাবার। বেশ রসিয়ে রসিয়ে খায়। খেতে খেতে খাওয়ার গল্প করতে পছন্দ করে।  

খবরের কাগজের দপ্তরে কাজ করে ওরা। তবে বিভাগ আলাদা এবং আলেয়া রক্তিমের জুনিয়র। আলেয়ার রান্না করতেও ভালো লাগে। রাজা,ওর হাজব্যান্ড খাদ্যরসিক নয় বলে তাকে রেঁধে খাইয়ে তেমন আনন্দ পায় না। আলেয়ার হাতের বিশেষ কোনো পদ খাওয়ার পরে কোনোদিন এতটুকু প্রশংসা করে না। তবে নুন কম হলে বা তরকারিতে চুল পড়লে পঞ্চাশবার ক’রে বলে। রাজার পাতে যা হোক কিছু থাকলেই হলো! খিচুড়ি, ডিমপাউরুটি, গোলারুটি, পান্তা, পাস্তা সবই চলে তার। বাজার করতে দিলে ভুলভাল বাজার করে আনে। পোনা এবং চিংড়ি ছাড়া অন্য কোনও মাছ চেনে না। আলেয়ার বন্ধুরা তাকে বলে “তুই খুব লাকি, অলি। রাজাদার জন্য তোকে রান্নাঘরে যেতে হয় না। আমারটা জ্বালিয়ে খায়।”

আলেয়া ভাবে জ্বালিয়ে খাওয়া ঠিক কেমন, সেটা জানাই হলো না তার। সে যখন রান্না করবে, তখন পেছন থেকে এসে জাপটে ধরবে প্রিয় পুরুষটি! নাকি নরম সুতির নরম আঁচলটা টেনে ধরবে মাঝেসাঝে। তোয়ালে গামছা হাতের কাছে না পেলে আঁচলে মুখ মুছবে? কিন্তু বাড়িতে তো শাড়ি পরেই না আলেয়া। থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট এবং টি শার্ট। তবে শাড়ি পরতে তার খুব ভালো লাগে। অফিসে জিন্স কুর্তি পরলেও বিশেষ বিশেষ দিনে শাড়ি পরে যায়।

এই যেমন সেদিন রক্তিমের জন্মদিনে শাড়ি পরে অফিস এসেছিল আলেয়া। 

লাঞ্চটাইমে অনেকের নজর সামলে মুখটা আলেয়ার কানের কাছে নিয়ে রক্তিম বলেছিল “তোকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে, অলি। চোখ ফেরাতে পারছি না। “

কিশোরী বয়স থেকে এমন কথা অনেকজনের কাছ থেকে শুনে খুশি হয়েছে আলেয়া, তবে সেদিনের খুশিটা আগের খুশিগুলোকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। 

রক্তিমও খুব খুশি ছিল সেদিন। অন্যদিন রক্তিম বাসে যাতায়াত করে, সেদিন গাড়ি নিয়ে এসেছিল। নিজে ড্রাইভ করতে পছন্দ করে রক্তিম।

কাগজের দপ্তরে কাজের যেন শেষ নেই! মন দিয়ে কাজগুলো সেরে নিচ্ছিল আলেয়া।  

রক্তিমের মেসেজ এল টুং করে। “আমি ঠিক পাঁচটায় অফিস থেকে বেরোব। গেট থেকে একটু দূরে গাড়িটা রাখব, তুই ঠিক ৫:১৫ তে বেরিয়ে সোজা এসে গাড়িতে উঠে বসবি।” 

সেই মত পেছনের দরজা খুলে গাড়িতে উঠে বসেছিল আলেয়া। রক্তিম স্টিয়ারিং ধরে বসেছিল। আলেয়া উঠে বসতেই গাড়ি চলতে শুরু করল। কিছুটা দূর গিয়ে গাড়িটা থামিয়ে পেছন ফিরে আলেয়ার জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে রক্তিম বলেছিল “নেমে এসে সামনে বোস্।” শরীরে মনে শিহরণ জেগেছিল আলেয়ার। একটা অদ্ভুত ভালো লাগা গ্রাস করেছিল তাকে। 

রাজার সঙ্গ তাকে স্বস্তি দেয় ঠিকই,কিন্তু এরকম শিহরণ জাগায় না। মাত্র তিনবছরের বিবাহিত জীবন তাদের। প্রেমের বিয়ে। কাঁচা মনের প্রেম। প্রেম করতে করতেই সব কথা ফুরিয়ে গিয়েছিল যেন! বিয়ের পর আর কোনও নতুন কথা নেই। আলেয়া যা বলে অর্ধেকটা শুনেই রাজা বলে “হ্যাঁ হ্যাঁ জানি।”

আবার রাজা কিছু বলতে শুরু করলে আলেয়ার ধৈর্য থাকে না। রাজাকে থামিয়ে দিয়ে বলে “একই কথা এতবার শুনতে ভালোলাগে না।” 

একই ঘরে পাশাপাশি বসে অথবা শুয়ে নিজের নিজের মোবাইল ঘাঁটে।

অথচ রক্তিমের যেকোনো কথাতেই মুগ্ধ হয় আলেয়া। যে কথার কোনো মানে নেই রক্তিমের এমন কথাকেও সে আঁকড়ে ধরে।

রক্তিমের জন্মদিনে রক্তিম আলেয়াকে একটা ভালো রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়েছিল। একটা টেবিল আগে থেকেই বুক করে রেখেছিল রক্তিম।

আলেয়া বলেছিল “আজ তোমার জন্মদিন, রক্তিমদা। আমিই তোমাকে খাওয়াবো।”

“চুপটি করে বোস। শ্রাবণী আজ ভালো ভালো রান্না করেছে। আমি বাড়ি ফিরে সেসব তো খাবই! এখন তুই বল্ কী খাবি?”

আলেয়াও হেরে যাবার মত মেয়ে নয়। হেসে বলেছিল, “দাঁড়াও আগে কেক কাটা হোক!”

ব্যাগ থেকে সুদৃশ্য একটা কৌটো বের করে ঢাকনাটা খুলে রক্তিমের সামনে ধরেছিল আলেয়া। একখানা চকলেট কেক। একটা চামচ বের করে রক্তিমের হাতে চামচটা ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল “নাও এবার কেকটা কেটে ফ্যালো।”

ব্যাপারটা রক্তিমের মনে হয় ভালো লাগছিল! নইলে আপত্তি করত! চামচ দিয়ে কেকটা একটু কেটে আলেয়াকে খাইয়ে দিয়েছিল রক্তিম। আলেয়াও একটুকরো কেক রক্তিমকে খাইয়ে দিয়েছিল। রেস্টুরেন্টে অনেকেই বসে খাবার খাচ্ছিলেন এবং ওদের দিকে তাকাচ্ছিলেন। কিন্তু ওসব নিয়ে ওদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। ওরা নিজেদের মধ্যে ডুবে ছিল। 

সেদিন সরমালাই পোলাও, চিকেন কোপ্তা আর আইসক্রিম খেয়েছিল ওরা।

পোলাও, কোপ্তা একপ্লেট করে নিয়ে দুজনে ভাগ করে খেয়েছিল। রক্তিম আইসক্রিম পছন্দ করে না। আলেয়া একচামচ জোর করে খাইয়ে দিয়েছিল। চামচটা রক্তিমের ঠোঁট স্পর্শ করে আলেয়ার ঠোঁট ছুঁয়েছিল। আবার এক অপূর্ব ভালোলাগায় ভরে উঠেছিল আলেয়া।

রক্তিম খেতে অসম্ভব ভালোবাসে। কী যে যত্ন করে পোলাও আর কোপ্তা খেয়েছিল সেদিন!

রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আলেয়া বাস ধরে নিয়েছিল। রক্তিম কেমন একটা মন উচাটন করা হাসি বিলিয়ে,হাত নেড়ে গাড়ি চালিয়ে চোখের সামনে দিয়ে হুস করে বেরিয়ে গিয়েছিল….

রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোনোর আগে রেস্টুরেন্টের প্রধান কুকের কাছ থেকে সর মালাইপোলাও এবং কোপ্তার রেসিপি জেনে নিয়েছিল আলেয়া। বাসে বসে সেগুলো মনে মনে ঝালিয়েও নিয়েছিল। 


সরমালাই পোলাও


উপকরণ: বাসমতি চাল ১ বাটি,নারকেলের গাঢ় দুধ ১ বাটি, কাজু, কিশমিশ, ছোটএলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি, গরম মশলার গুঁড়ো, জৈত্রী, তেজপাতা, ডাবের শাঁস, সরের টুকরো, নুন, চিনি, পরিমাণমত ঘি বা সাদা তেল, কিছুটা গ্রেট করে নেওয়া আদা।

প্রণালী: চাল ভালো করে ধুয়ে জল কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রাখতে হবে। এরপর প্যানে অল্প ঘি দিয়ে কাজু, কিশমিশ, দুধেরসর, ডাবের শাঁস ভেজে তুলে রাখতে হবে। কড়াইতে আরো কিছুটা পরিমাণ ঘি বা সাদা তেল যুক্ত করে তেজপাতা, গোটা গরম মশলা, জৈত্রী ফোড়ন দিয়ে গ্রেট করা আদা ভেজে নিয়ে চালগুলো ঢেলে দিতে হবে। চালে স্বচ্ছ রং ধরলে একবাটি নারকেলদুধ আর হাফবাটি গরমজল দিয়ে ঢাকনা এঁটে রেখে দিতে হবে। জল শুকিয়ে এলে নুন, চিনি, কাজু, কিশমিশ, ডাবের শাঁস, সরভাজা, গরম মশলার গুঁড়ো দিয়ে নিভু আঁচে দমে বসাতে হবে। মিনিট সাতেক পরে পোলাও হালকা হাতে নেড়ে পাত্রের ঢাকনা লাগিয়ে গ্যাস অফ করে দিতে হবে। কিছুক্ষণ পর পরিবেশন করতে হবে।

 

চিকেন কোপ্তা


উপকরণ: চিকেন কিমা ১০০ গ্রাম, পেঁয়াজ কুচি হাফকাপ, হলুদ গুঁড়ো, লংকাগুঁড়ো, ধনে জিরেরগুঁড়ো, রোস্টেড বেসন দু চামচ, নুন, সাদা তেল।

গ্রেভির উপকরণ: পেঁয়াজবাটা, আদা, রসুনবাটা, টমেটোবাটা, লংকাগুঁড়ো, ধনে জিরে গোলমরিচ গুঁড়ো, এক চিমটে হলুদগুঁড়ো, তেজপাতা, গোটা শুকনোলংকা, গরম মশলার গুঁড়ো।

প্রণালী: মিক্সিতে চিকেন কিমা পেঁয়াজকুচি, নুন দিয়ে পেস্ট করে নিতে হবে। তারপর পেস্টটা একটা বাটিতে রেখে গুঁড়ো মশলা আর রোস্টেড বেসন মিশিয়ে ভালো করে মেখে বলের আকারে গড়ে তেলে ভেজে নিতে হবে।

এবার কিছুটা তেল কমিয়ে নিয়ে ওর মধ্যে অল্প ঘি মিশিয়ে গোটা জিরে, তেজপাতা, শুকনোলঙ্কা ফোড়ন দিয়ে পেঁয়াজবাটা, আদারসুনবাটা দিয়ে কষিয়ে নিতে হবে। এরপর টমেটোবাটা, গুঁড়োমশলা দিয়ে ভালো করে নেড়েচেড়ে গ্রেভির জন্য দু কাপ গরম জল দিতে হবে। গ্রেভি গাঢ় হয়ে উঠলে কোপ্তাগুলো সাবধানে গ্রেভিতে ছেড়ে দিয়ে গরম মশলার গুঁড়ো ছড়িয়ে গ্যাস অফ করে দিলেই রেডি চিকেন কোপ্তা।

একদিন রক্তিমকে বাড়িতে নেমতন্ন করে খাওয়ালে বেশ হয়! রাজা চেনে রক্তিমকে। চেনে মানে আলেয়ার মুখে অনেকবার শুনেছে রক্তিমের কথা। আলেয়াকে অফিসের কাজে প্রচুর সাহায্য করে। বিভিন্নরকমভাবে গাইড করে। রক্তিমের কথা বলার সময় আলেয়ার মুখে একরকমের আলো জ্বলে ওঠে,সেটা কি রাজা বুঝতে পারে?

আলেয়ার এখনো বাচ্চাকাচ্চা হয়নি। কোভিড এসে মানুষকে বড় শিক্ষা দিয়ে গেছে। কেমন যেন হয়ে গেছে পৃথিবীটা! যুদ্ধ,অশান্তি,মূল্যবৃদ্ধি,কর্মহীনতা গ্রাস করেছে গোটা বিশ্বকে। দূর্বৃত্তরা সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। শান্তিপ্রিয়, সৎ মানুষরা এখন ভয়ে ভয়ে বাঁচে। বাঁচার আনন্দটাই যেন আর নেই! চারিদিকে কেবল সমস্যা আর সমস্যা। এখানে নিষ্পাপ শিশুকে আনা মানেই তাকে বিভিন্নরকমের কষ্ট আর অসুবিধার মধ্যে ফেলে দেওয়া। তারচে বরং একটা পোষ্য থাকলে বেশ হবে। পায়ে পায়ে ঘুরবে। গায়ে গা ঘষবে। আলেয়া অফিস থেকে ফিরলে দৌড়তে দৌড়তে গেটের কাছে যাবে। নাক, গাল চেটে দেবে। যখন আলেয়া আর রাজা দু চারদিনের জন্য মন্দারমনি বা শান্তিনিকেতন যাবে,সেই কুট্টুটাও ওদের সঙ্গে যাবে।

রাজাকে এই নিয়ে কথা বলা বা না বলা সমান। আলেয়া যা বলবে, ভালো করে না শুনে বলে উঠবে “আচ্ছা।”

অথচ এই কথাটা রক্তিমকে বলার বলার পরে রক্তিম হেসে বলেছিল “তুই বড্ড ছেলেমানুষ অলি! কোথায় একটা বিড়াল বা কুকুরছানা আর কোথায় তোর নিজের সন্তান! তোর একটা ফুটফুটে বাচ্চা হবে,একদম তোর মুখের আদলের। ঠিক যেন একটা ছোট্ট আলেয়া। দেখবি জীবনটাই পাল্টে যাবে। একটা পোষ্যও থাকবে তোদের। তোর নিজের সন্তানের সঙ্গে সেও বড় হবে। এখন যে শূন্যতার মধ্যে আছিস, সেটা একদম চলে যাবে।”

রক্তিম কী করে তার এই শূন্যতার কথা জানল! সরাসরি কোনোদিন তাকে কিছু বলেনি আলেয়া। ফেসবুকে রাজার বক্ষলগ্না হয়ে যে আদুরে ছবিগুলো আলেয়া দেয়, সেগুলো দেখে তার শূন্যতা বোঝার ক্ষমতা কারোর থাকে না। 

রক্তিমকে একদিন সত্যিই বাড়িতে আসতে বলবে আলেয়া। নিজের হাতে পোলাও, মাংস, পায়েস রান্না করে খাওয়াবে। রান্নার মাসি একবেলা এসে দুবেলার রান্না ক’রে দিয়ে যায়। রক্তিম যেদিন আসবে সেদিন মাসিকে সে ছুটি দিয়ে দেবে। সে নিজেও অফিস থেকে ছুটি নেবে সেদিন। অনেকদিন পরে রেসিপির খাতাখানা খুলে বসল আলেয়া। রাজার সঙ্গে যখন প্রেম করত, তখন রেসিপি সংগ্রহ করার খুব বাতিক ছিল। পত্রপত্রিকা থেকে আলেয়া রেসিপি টুকে রাখত। পরবর্তীকালে বাড়িতে কোনো গেষ্ট এলে ওই খাতাখানাই তার মান বাঁচাত। এখন অবশ্য ইউটিউবে রেসিপির ছড়াছড়ি। তবু বিশেষ অতিথিদের জন্য সে খাতা থেকেই রেসিপি বাছে। রক্তিমের জন্য সে দরবারি চিকেন বানাবে। ওটা রাজাও ভালো খায়। সঙ্গে পোলাও তো থাকবেই! স্যালাড আর গোলাপ পাপড়ির পায়েস। রেসিপিদুটো ভালো করে আরেকবার দেখে নিল আলেয়া।

 

দরবারি চিকেন

 

উপকরণ:  চিকেন ১ কেজি, পেঁয়াজবাটা ২কাপ, আদা রসুনবাটা ২ টেবিল চামচ,হলুদগুঁড়ো, ধনেগুঁড়ো, জিরেগুঁড়ো, গোলমরিচের গুঁড়ো, গরম মশলারগুঁড়ো, তেজপাতা, এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি, নুন,চিনি, টকদই ১ কাপ, কাঁচালংকাবাটা ২ চামচ দুধ ২ কাপ ভিনিগার ২ চামচ, পরিমাণ মতো সাদাতেল।

পদ্ধতি : চিকেনের টুকরোগুলো খুব ভালো করে ধুয়ে জল ঝরিয়ে নিয়ে ভিনিগার মাখিয়ে দু’ঘণ্টা ম্যারিনেট করে রাখতে হবে। দু’ঘণ্টা পর চিকেনগুলোকে ভালো করে ধুয়ে একটা বড় পাত্রে চিকেনগুলোকে দুধের মধ্যে ডুবিয়ে আবার ম্যারিনেট করতে হবে প্রায় তিনঘন্টা মতো। ম্যারিনেট করা মাংস ফ্রিজে রেখে দিতে হবে। তিনঘন্টা পর ফ্রিজ থেকে বের করে চিকেনগুলোকে নরমাল তাপমাত্রায় এনে রান্নার প্রস্তুতি নিতে হবে। তেল গরম করে গোটা গরমমশলা ফোড়ন দিতে হবে। সুগন্ধ বের হলে পেঁয়াজবাটা আদা রসুনবাটা দিয়ে ভালো করে কষাতে হবে। একটা বাটিতে টকদই, জিরেগুঁড়ো ,ধনেগুঁড়ো, গোলমরিচগুঁড়ো, কাঁচালংকাবাটা ফেটিয়ে নিতে হবে। মশলা থেকে তেল ছাড়লে চিকেনের টুকরোগুলো দিয়ে দিতে হবে। আরও কিছুক্ষণ কষাতে হবে। নুন, হলুদ, চিনি, হলুদগুঁড়ো দিয়ে নেড়েচেড়ে ফেটানো টকদইয়ের মিশ্রণটা মাংসে ঢেলে দিতে হবে। আরও কিছুক্ষণ কষিয়ে নিয়ে চিকেনে ভেজানো দুধটুকু ঢেলে দিতে হবে। মাংস সেদ্ধ হলে গরমমশলা ছড়িয়ে গ্যাস অফ করে দিতে হবে।

 

গোলাপ পায়েস

 

উপকরণ: ফুলক্রিম মিল্ক ১ লিটার, আরও ১ কাপ দুধ নিতে হবে, লাল বা গোলাপি গোলাপের পাপড়ি, গোলাপের এসেন্স, কাজুবাদামের গুঁড়ো, চিনি, সবুজ এলাচ।

প্রণালী: এক কাপ দুধ দিয়ে গোলাপের পাপড়ি পেস্ট করে নিতে হবে। এক লিটার দুধ জ্বাল দিতে হবে। দুধ জ্বাল দেওয়ার সময় এলাচ দিতে হবে। পরে এলাচদুটো তুলে ফেলে দিতে হবে। দুধ গাঢ় হলে ওর মধ্যে কাজুর গুঁড়ো, গোলাপের পাপড়ির পেস্ট দিয়ে খুব নাড়তে হবে। মিশ্রণটা ঘন হয়ে এলে চিনি দিয়ে দিতে হবে। গোলাপের এসেন্স দিয়ে নামিয়ে নিয়ে বাটিতে ঢেলে গোলাপের পাপড়ি সাজিয়ে পরিবেশন করতে হবে।

সবই ঠিক ছিল। কিন্তু সেদিন বেড়াচাঁপা গিয়ে পুরোটা ঘেঁটে গেল। বেড়াচাঁপায় একটা প্রাচীন শিবমন্দির আছে। ঠাকুর খুব জাগ্রত। রক্তিমের মুখ থেকেই মন্দিরটার কথা প্রথম শুনল আলেয়া।

রক্তিম বলল “চল্! একদিন অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে মন্দিরটা দেখে আসি। ওইদিন গাড়ি নিয়ে আসব। আশীষদার কাছ থেকে লোকেশন জেনে নিয়েছি। জায়গাটা নাকি খুব সুন্দর! দেখে আসা যাবে। একেবারে পুজো দিয়ে ফিরব।”

রক্তিমকে কদিন খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিল। অফিসের কাজের চাপ এবং বউয়ের সঙ্গে নানান ঝামেলায় নাজেহাল ছিল রক্তিম। আলেয়া সবই আন্দাজ করেছিল। কিন্তু রক্তিমকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি।

পার্সোনাল ব্যাপারে যেচে নাক গলিয়ে নিজের কৌতূহল মেটানোটা অসভ্যতার পর্যায়ে পড়ে।

রক্তিমের ইচ্ছে হলে নিশ্চয় তাকে বলবে!

কিন্তু রক্তিম কিছু বলল না। উপরন্তু বেড়াচাঁপায় গিয়ে স্বপ্নভঙ্গ হল আলেয়ার। 

পুজো দেওয়ার সময় পুরোহিতমশাই রক্তিমকে বললেন “স্বামী – স্ত্রী হিসেবে আপনাদের জুটিটা খুব ভালো। ঈশ্বর আপনাদের মঙ্গল করবেন।”

রক্তিম ফট্ করে বলে উঠল “ইনি আমার স্ত্রী নন, সহকর্মী।”

গাছপালা দিয়ে ঘেরা ছোট্ট একটা মন্দির। বনজ গন্ধের সঙ্গে মিলেছে ধূপ – ধুনোর গন্ধ। পাখিদের বাড়ি ফেরার কলকাকলি শোনা যাচ্ছে মাঝেমাঝে। একপাল ছাগল নিয়ে ঘরে ফিরে যাচ্ছে রাখাল বালক। দূর থেকে সন্ধের আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে। পাশে পছন্দের পুরুষ। নিরীহ একটা শব্দ “সহকর্মী” ……শব্দটা শান্ত স্নিগ্ধ মনোরম সন্ধেটাকে ছিঁড়ে ফালাফালা করে দিল। রক্তিম ভুল তো কিছু বলেনি! সে সহকর্মী ছাড়া আর কী? কিন্তু পুরোহিতের কাছে ওই ভুলটুকু না না ধরিয়ে দিলে কী এমন ক্ষতি হতো! পুরোহিত মশাই ভুল করে যা ভেবেছিলেন সেটা আলেয়ার জীবনের একটা অনন্য সঞ্চয় হয়ে থাকলে রক্তিমের কি কিছু অসুবিধে হতো! ……. যে মন নিয়ে আলেয়া বেড়াচাঁপায় এসেছিল, সেই মন নিয়ে সে ফিরতে পারল না।

রক্তিম ভালোমত জানে কখন মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে হয়! কখন রাশ আলগা করতে হয়। কখন রাশ টেনে ধরতে হয়! আলেয়া আর পাঁচটা বোকা মেয়ের মতোই একে ভালোবাসা ভেবে ফেলেছে। ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ!

লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করল আলেয়ার।

ফেরার পথে আলেয়া একটা কথাও বলল না। রক্তিম গাড়ি চালাতে চালাতে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মজার মজার কথা বলে চলছিল। কখনও রোমান্টিক গানের কলি গেয়ে উঠছিল। অবাক হচ্ছিল আলেয়া। আজ রক্তিমের দুটো আলাদা সত্তা খুব স্পষ্টভাবে ধরা পড়ছিল আলেয়ার কাছে। আলেয়ার মনে হল এই কষ্ট তার নিজেরই সৃষ্টি। একজন হেসে কথা বললে বা একটু আশকারা দিলে সেটা যে ভালোবাসা হয়ে যায় না, সেটা তার বোঝা উচিত ছিল। রাজার ওপরে খুব রাগ হল আলেয়ার। এ সব রাজার কারণেই হয়েছে! রাজার উদাসীনতা, উপেক্ষা, সংসারের প্রতি দায়িত্বহীনতা …. আলেয়াকে ধীরে ধীরে রক্তিমের দিকে ঠেলে দিয়েছে। 

রক্তিমের দাম্পত্যজীবনও আঠালো নয়। সংসার এবং শ্রাবণীকে নিয়ে রক্তিমের মধ্যে যথেষ্ট বিরক্তি, হতাশা লক্ষ্য করেছে আলেয়া। তবুও রক্তিম বাকি অনেকের মত ঘরটাকে ওপর ওপর ঠিক রাখতে চেয়েছে। 

সুযোগমত নিজের আবেগটাকে কাজে লাগিয়েছে। আবার ইচ্ছেমত আলেয়ার আবেগের টুটি চেপে ধরেছে। আলেয়া যেন রক্তিমের হাতের পুতুল!

অনেকদিন পর আজ অফিস গেল না আলেয়া। একসময় রাজার জন্য সে প্রাণপাত করেছে। তারপর রক্তিমের জন্য। রক্তিমের কথা ভেবেই সে লাঞ্চবক্স সাজিয়েছে প্রতিদিন। সে নিজে কী খেতে ভালোবাসে, কী খেতে ইচ্ছে করছে…. তার মনকে শুধোয়নি কোনোদিন। নিজের কাছ থেকে দূরে সরে গেলে নিজের কী দশা হয় এখন বুঝতে পারছে আলেয়া। মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে আলেয়ার। ভাঙা মন নিয়ে কার কাছে গেলে সান্ত্বনা পাবে সে। কার সামনে মন খুলে কেঁদে হালকা হবে আলেয়া! 

গ্যাসের ওপরে ভাত ফুটছে টগবগ করে। ভাতের মধ্যে সেদ্ধ হচ্ছে দু কুচি চন্দ্রমুখী আলু। একপাশে একটা বাটিতে দেশি ডিম গুলে রাখা আছে। তাতে কুচনো পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা, নুন, গোলমরিচের গুঁড়ো পড়েছে। ভাত হয়ে গেলেই ফ্রাইংপ্যানে ডিম ভাজা হবে। অল্প গরম তেলে ডিমটা ভাজার জন্য ডিম ভাজার রং হবে সাদা।

পোলাও নয় ঘি- ভাত, আলুসেদ্ধ, ডিমভাজা আলেয়ার সবচেয়ে প্রিয় খাবার। এতদিন ভুলে গিয়েছিল সে! আজ পেট ভরে ভাত খেয়ে টানা ঘুমোবে। নিজের মনকে খুব কষ্ট দিয়েছে। মনকে বিশ্রাম দেবে সে।

 

1 thought on “rannaghar-polao-ghee-bhat

  1. জমজমাট ভালবাসার গল্প, সঙ্গে দারুণ দারুণ রান্না। খুব ভাল লাগল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *