উদর দিয়ে হৃদয়ে
মানসী গাঙ্গুলী

আদিমযুগে মানুষ রাঁধতে জানত না। তারা গাছের ফলমূল খেয়েই মূলত জীবনধারণ করত। আর যা পেত তা কাঁচাই খেত। হঠাৎই একদিন তারা নিজেদের অজান্তে আগুন জ্বালিয়ে ফেলল। আগুনের ব্যবহার করতে শিখল। সে প্রায় ৮লক্ষ বছর আগের কথা। পুড়িয়ে, ঝলসিয়ে খেতে শিখল। ক্রমে রেঁধে খেতে শিখল। জীবনযাত্রায় এল উন্নতি। তারপর বছর বছর বহুবছর কেটে গেছে। ধাপে ধাপে নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে করতে রন্ধন প্রণালী আজ এক শিল্পকলার পর্যায়ে উঠে এসেছে। শাস্ত্রকারদের মতে শাস্ত্র সম্মত শ্রেষ্ঠ চৌষট্টি কলার মধ্যে রন্ধনকলা অন্যতম। এটি মানুষের জীবনে সর্বপ্রথম ও প্রধান শিল্প। এই শিল্পে যিনি পারদর্শী হন তাঁর সমাদর কখনও হ্রাস পায় না। উদর দিয়ে যে হৃদয়ে পৌঁছানো যায়, এ তো সর্বৈব সত্য। আর তাই সেই হৃদয়ে পৌঁছানোর তাগিদে রান্নায় নিত্য যুক্ত হয়ে চলেছে অভিনবত্ব।
বাঁচার জন্য খাওয়ার প্রয়োজন কিন্তু আমরা বাঙালিরা বোধহয় খাওয়ার জন্যই বাঁচি। রান্নার পিছনে বাঙালিরা যে পরিমাণ সময় ব্যয় করে, বোধকরি পৃথিবীর অন্যান্য কোনও দেশই তা করে না। বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মাছ ও ভাত। আমরা বাঙালিরা সেই মূল উপাদান মাছ ও ভাতের রন্ধন প্রক্রিয়ায় বৈচিত্র্য এনেছি এবং তার সঙ্গে যে মশলা ব্যবহার করে থাকি তা স্বাস্থ্যের পক্ষেও বিশেষ উপকারী।
এবার আসি রান্নার কথায়। যে রান্নাটির কথা বলব, তার ইতিহাসটা জানিয়ে দিই আগে। অনেকদিন আগের কথা, একদা একসময়ে এই বাংলার বিভিন্ন গ্রামের কয়েকটি ছেলে কলকাতায় ডাক্তারি পড়তে গেল। কলকাতায় তাদের খাবার থাকার কোনও সংস্থান ছিল না। তারা পাঁচজনে মিলে একটি ঘর ভাড়া করে থাকার ব্যবস্থা করল। নিজেরা রেঁধে খাবে এমন মনস্থ করে রান্নার কিছু সরঞ্জামও কিনে নিল, সঙ্গে একটা স্টোভও। তখন গ্যাস ছিল না। এই ছেলেরা কেউই রান্নায় তেমন পটু ছিল না। কোনোরকমে ডাল, ভাত, সবজি সেদ্ধ, ডিম সেদ্ধ খেয়ে চালাচ্ছিল। তখন মোবাইল ফোন ছিল না, ল্যান্ড ফোনও তেমন কারও বাড়িতে ছিল না অফিস, কাছাড়ি ছাড়া। কাজেই ফোনে ফোনে রান্না শিখে রান্না করারও জো ছিল না। একমাত্র ভরসা তাদের কাজের মাসি। তাকে ওরা রেখেছিল ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা ও বাসন মাজার জন্য। তার কাছে জিজ্ঞেস করে করে ওরা কাজ চালাতে লাগল। একটু একটু রান্না শিখেও ফেলল। আর তাতে ওদের আত্মবিশ্বাসও বেশ বেড়ে গেল। একদিন এই ছেলেদের মধ্যে দুজন বাজারে গিয়ে ইলিশ মাছ দেখে লোভ সামলাতে না পেরে একটা ইলিশ মাছ কিনে নিয়ে আসে। মাসি মাছ কেটে ধুয়ে দিলে উমাশঙ্কর বলে, “মাসি একটু সরষে বেটে রাখো।” বাকীরা হৈহৈ করে ওঠে, “সরষেবাটা কী হবে? মাছ তো আমরা ভাজা খাবো।” উমা বলে, “মাছটা আমি রান্না করব।” বাকীরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। শেষে প্রশান্ত বলেই ফেলল, “পারবি তো? নাহলে ভাজা করে ফেল। মাছের তেল আর মাছভাজা, সঙ্গে একটা কাঁচা লঙ্কা, দিব্যি জমে যাবে।” উমা বলে, “ঠিক আছে, একপিস করে ভাজা আর একপিস করে ঝাল হোক তাহলে।” উমার আগ্রহ দেখে অগত্যা মত দিল সকলে। মনে তাদের সংশয়। সকলে মত দিলে পাঁচজনের পাঁচপিস মাছ ভেজে তুলে, মাছভাজার তেলটাও একটা বাটিতে ঢেলে রাখল সে। ঘর তখন ইলিশ মাছের গন্ধে ম ম করছে। একঘেঁয়ে সেদ্ধ ভাত খেয়ে খেয়ে ছেলেরা এই বৈচিত্র্যে খুব খুশি। শুরু হল উমার কেরামতি। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষায়। কী হয় কী হয়, কী জানি কী হয়। কড়াইতে বেশ খানিকটা জল ঢালতেই বাকীরা হৈহৈ করে উঠল, “মাছটা ভাজ, তারপর তো ঝাল করবি।” উমা বেশ বিজ্ঞের মত বলে, “ঠাকুমাকে বলতে শুনেছি ইলিশ মাছ ভাজতে নেই, কাঁচাই ঝাল করতে হয়। তাতে ইলিশের গন্ধটা ভরপুর থাকে।” সবাই চুপ করে দেখতে লাগল উমার মাছ রান্না। কড়াইতে জল টগবগ করে ফুটলে উমা তাতে নুন, হলুদ, কাঁচালঙ্কা ও মাসির বেটে দিয়ে যাওয়া সরষেবাটা দিয়ে দিল। বাকীরা ভাবছে তখন, “হচ্ছেটা কী? খাওয়া যাবে তো?” এদিকে সবকিছু কড়াইতে বেশ টগবগ করে ফুটতে লাগল যখন নুন-হলুদ মাখানো পাঁচপিস মাছ উমা তার মধ্যে দিয়ে দিল। প্রশান্ত বলে ওঠে, “এ কী রে, তেল ছাড়া মাছের ঝাল?” “আরে দেখ না”, বলে উমা। ওর আত্মবিশ্বাস দেখে সবাই চুপ করে যায়। এরপর বেশ খানিকক্ষণ ফুটে ঝোল কমে ঝালের মত হয়ে এলে উমা খানিক সরষের তেল তাতে ঢেলে দিল। বাকীদের চোখ তখন বড় বড়। উমা বলে, “আমি মা’কে দেখেছি, মাছের ঝাল করে নামাবার সময় কাঁচা তেল ঢেলে দিতে। তাতে স্বাদ ভাল হয়।” নামাবার সময় হয়ে এলে স্টোভের আঁচটা কমিয়ে খুনতি করে একটু ঝোল তুলে ফুঁ দিয়ে নিজের বামহাতের তালুতে ঢেলে নুন ঝালের সমতা একটু চেখে দেখে নিজেই নিজের প্রশংসা করতে লাগল। “আহ্, দারুণ টেস্ট হয়েছে তো!” নিজের কেরামতিতে নিজেই মুগ্ধ সে। ছেলেরা তখনও মানতে পারছে না। এরপর সকলে এক এক করে স্নান সেরে খেতে বসলে দিলীপ বলে, “আগে বরং ঝালটা খাই, উমা কী বানিয়ে রেখেছে কে জানে! পরে মাছভাজা আর মাছের তেল দিয়ে ভাত খেয়ে মুখটা বরং ভাল ছেড়ে যাবে।” প্রশান্ত বলে, “না, দেখে তো মনে হচ্ছে ভালোই হয়েছে। আমি ঝালটা পরেই খাবো।” ঝালটা খাবার পর প্রত্যেকে দারুণ প্রশংসা করতে লাগল। সবাই একবাক্যে স্বীকার করল রান্না খুব ভাল হয়েছে। তারা হৈহৈ করে জিজ্ঞেস করল, “এই রান্নার নাম কী উমা?” উমা বিন্দুমাত্র কালবিলম্ব না করে বলে, “আমি তো এভাবে কোনোদিন রাঁধতে দেখিনি, এটা সম্পূর্ণই আমার মস্তিষ্কপ্রসূত। আমি এটার নাম দিলাম ‘বলকে ইলিশ’। কি ভাল হল না নামটা?” সবাই হৈহৈ করে সায় দিল, “দারুণ, দারুণ” বলে।
এরপর এক ছুটিতে উমা বাড়ি ফিরে এই গল্প মায়ের কাছে করলে মা খুব হাসতে থাকেন। “এভাবে তো আমরা করি না, তবে ভাল যখন হয়েছে, তোমরা খেয়ে আনন্দ পেয়েছ, তখন এভাবেই একদিন বাড়িতে করা যাবে।” দামোদর নদীর তীরে বর্ধমান জেলার জামালপুর গ্রামে উমার বাড়ি। দামোদরে কালেভদ্রে ইলিশ পাওয়া যায়। তবে যখন পাওয়া যায় সে ইলিশ হয় অত্যন্ত সুস্বাদু। উমার বাড়ির সাতপুরুষ ডাক্তার হওয়ায় ডাক্তার বাড়ির খাতিরই আলাদা ছিল। দামোদরে ইলিশ উঠলে তা ডাক্তারবাড়ি পৌঁছে যেত। উমা গ্রামে থাকাকালীন ইলিশ উঠলে সে-ই রান্না করত। পরে বিয়ে করে সংসার হলে, ছেলেমেয়ে হলে ইলিশ রান্না উমা নিজের হাতেই করত। ছেলেমেয়েরা চেটেপুটে খেত বাবার হাতের রান্না।
এটা গল্প হলেও সত্যি। এ গল্প শোনা আমার মায়ের কাছে। এই উমাশঙ্কর আর কেউ নয়, আমার দাদামশাই। আমিও আমার শ্বশুরবাড়িতে এভাবে ইলিশ মাছ রান্না চালু করেছি। সত্যি সুন্দর হয় ইলিশ মাছ, কাঁচালঙ্কা, সরষেবাটা ও সরষের তেলের সুগন্ধে। কারণ আমার শ্বশুরমশাই ছিলেন ভোজনরসিক মানুষ এবং তাঁর মা অর্থাৎ আমার দিদিশাশুড়ির হাতের রান্না ছিল অপূর্ব। আমি তাঁকে দেখিনি বা তাঁর হাতের রান্না খাইনি, শুনেছি আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের কাছে। সেই শ্বশুরমশাই এইভাবে রান্না করা ইলিশ মাছ খেয়ে ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। এর থেকে বড় সার্টিফিকেট আর হয় না আমার কাছে।
তবে আমি আমার দাদামশাইয়ের থেকে এককদম এগিয়ে। মাছ রান্না সুন্দর হলেও তাকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য অন্য একটি কড়াইতে খানিকটা তেল দিয়ে তাতে কালোজিরে, কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে মাছের ঝালের ওপর ঢেলে দিই। আর কাঁচালঙ্কা আমি সবুজ, লাল দুরঙেরই ব্যবহার করি। সার্ভিং প্লেটে রান্না মাছ ঢেলে লঙ্কাগুলো চামচে করে ওপরে সাজিয়ে দিই। তাতে লাল, হলুদ, সবুজ, কালো মিলে খুব দৃষ্টিনন্দন হয়।
উদর দিয়ে হৃদয়ে পৌঁছাতে গেলে এমন কিছু টিপস তো কাজে লাগাতেই হবে।