আদি ঢাকাইয়াদের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার যার নাম বাকরখানি! বাকরখানি ময়দা দিয়ে তৈরি রুটি জাতীয় খাবার বিশেষ। এটি বাংলাদেশের পুরান ঢাকাবাসীদের সকালের নাস্তা হিসাবে একটি অতি প্রিয় খাবার। ময়দার খামির থেকে রুটি বানিয়ে তা মচমচে বা খাস্তা করে ভেজে বাকরখানি তৈরি করা হয়। ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের বাকরখানি পাওয়া যায় পুরান ঢাকায়। বাকরখানিতে সাধারণত ময়দার সাথে স্বাদবর্ধক আর কিছু দেয়া হয় না। তবে চিনি দেয়া বাকরখানিও একেবারে বিরল নয়। ঢাকার একসময়ের প্রসিদ্ধ রুটির মধ্যে অন্যতম ছিল এই বাকরখানি। এখনও পুরনো ঢাকার কোনো কোনো অঞ্চলে তৈরি হয় বাকরখানি। সেখানে তা নিমসুখারুটি নামেও পরিচিত। বাকরখানির উৎপত্তি স্থান হল আফগানিস্তান। ঢাকায় সর্বপ্রথম বাকরখানির দোকান গড়ে উঠে লালবাগ কেল্লার কাছে। পুরান ঢাকার কিছু কিছু জায়গায় এই বাকরখানি তে ঢাকাই পনির দিয়েও তৈরি করা হয়। এমনকি কুরবানির গরুর চর্বি দিয়ে কেউ কেউ বানিয়ে খায় যার স্বাদ অতুলনীয়। বাংলাদেশে বাকরখানির প্রচলন নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন অভিমত। বাকরখানি রুটির নামের পেছনে আছে এক করুণ ইতিহাস। জনশ্রুতি অনুসারে, জমিদার আগা বাকের তথা আগা বাকর খাঁর নামানুসারে এই রুটির নামকরণ করা হয়েছে।নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁর দত্তক ছেলে আগা বাকের। প্রখর মেধার অধিকারী আগা বাকের যুদ্ধবিদ্যাতেও পারদর্শী ছিলেন। রাজধানী মুর্শিদাবাদের নর্তকী খনি বেগম এবং আগা বাকের পরস্পরের প্রেমে পড়েন। কিন্ত উজিরপুত্র নগর কোতোয়াল জয়নাল খান ছিল পথের কাঁটা, সে খনি বেগমকে প্রেম নিবেদন করলে তিনি জয়নাল খানকে প্রত্যাখান করেন। প্রত্যাখ্যাত হয়ে জয়নাল খনি বেগমের ক্ষতির চেষ্টা করে এবং খবর পেয়ে বাকের সেখানে যান ও তলোয়ারবাজিতে জয়নালকে হারিয়ে দেন। অন্যদিকে জয়নালের দুই বন্ধু উজিরকে মিথ্যা খবর দেয় যে, বাকের জয়নালকে হত্যা করে লাশ গুম করেছে। উজির ছেলের হত্যার বিচার চায়। নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁ পুত্র বাকেরকে বাঘের খাঁচায় নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেন। অবশেষে বাকেরের হাতে মারা যায় বাঘ। ইতিমধ্যে জয়নালের মৃত্যুর মিথ্যা খবর ফাঁস হয়ে গেছে ও সে জোর করে খনি বেগমকে ধরে নিয়ে গেছে দক্ষিণ বঙ্গে। উদ্ধার করতে যান বাকের খনি বেগমকে। পিছু নেন উজির জাহান্দার খান। ছেলে জয়নাল খান বাকেরকে হত্যার চেস্টা করলে উজির নিজের ছেলেকে হত্যা করেন তলোয়ারের আঘাতে। এই অবস্থাতে জয়নাল খনি বেগমকে তলোয়ারের আঘাতে হত্যা করে। বাকেরগজ্ঞে সমাধিস্থ করা হয় খনি বেগমকে। আর বাকের সবকিছু ত্যাগ করে রয়ে গেলেন প্রিয়তমার সমাধির কাছে – দক্ষিণ বঙ্গে। বাকের খাঁর নামানুসারেই বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ (পটুয়াখালি-বরিশাল) অঞ্চলের নাম হয় বাকেরগঞ্জ। ঐতিহ্যবাহী বাকরখানি রুটির নামের পেছনেও রয়েছে বাকের-খনির প্রেমের ইতিহাস।অবশ্য নামকরণের ব্যাপারে অন্য আরেকটি জনশ্রুতি রয়েছে। সে অনুযায়ী, মির্জা আগা বাকের ঢাকায় বাকরখানি রুটি প্রচলন করেন। তিনি বৃহত্তর বরিশালের জায়গীরদার ছিলেন। তার প্রেয়সী ছিল আরামবাগের নর্তকী খনি বেগম। তাদের মধ্যে গভীর প্রেম ছিল বলে কথিত আছে। পরবর্তীতে আগা বাকের ২য় মুর্শিদ কুলি খাঁর কন্যাকে বিয়ে করেন। কিন্তু খনি বেগমের স্মৃতি তিনি ভুলে যান নি। তার আবিস্কৃত এবং প্রিয় খাদ্য বিশেষভাবে তৈরি রুটির নাম তার প্রেমকাহিনীর উপর ভিত্তি করেই নামকরণ করা হয়েছিল বাকের-খনি রুটি। পরবর্তীতে এই নাম কিছুটা অপভ্রংশ হয়ে বাকরখানি নাম ধারণ করে। জনশ্রুতি মেনে নিলে ধরে নিতে হয়, বাখরখানির সৃষ্টি আঠারোশো শতকের মাঝামাঝি সময়ে। বাকরখানি সাধারণত আটা , দুধ, লবণ, চিনি, ডালডা, ঘি, পনির এবং খামির দিয়ে তৈরি করা হয়। রুটিটি তাওয়া দেয়ার পূর্বে বেলন দিয়ে কিছুটা চ্যপ্টা ও প্রসারিত করা হয়। তারপর ঘি, গুড়, জাফরান, পোস্ত বা নিগেল্লার বীজ ইত্যাদি দিয়ে তাওয়া বা তন্দুরে সেঁকে নেয়া হয়।প্রকারভেদ –বাকরখানির শুকনো গঠনের কারণে এটি শুকনা নান বা শুকনা রুটি নামেও পরিচিত। হাকিম হাবিবুর রহমান তাঁর ঢাকা পাচাশ বারস পহেলে (ঢাকা পঞ্চয়াশ বছর আগে) গ্রন্থে তিন ধরনের বাখরখানির কথা উল্লেখ করেছেন: গও জোবান, শুকি এবং নিমশুকি। কাইচারুটি এবং মুলামও বাখরখানির অন্য প্রকারভেদ।যেসব খাবারের সাথে ঢাকাইয়ারা খায়-বাকরখানি ঘন দুধ চায়ের মধ্যে ডুবিয়ে খাওয়াটা ঢাকাইয়াদের বেশি প্রিয়। এছাড়া আমরা ঢাকাইয়ারা মিস্টি ও ফিরনি দিয়েও খাই। কুরবানির ঝুরা মাংস দিয়ে খাওয়াটা এখানে বেশি জনপ্রিয়। তাছাড়া যেকোনো মাংস ভুনা দিয়েও খাওয়া হয়।বাকরখানির ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে মুগ্ধ হয়ে কবি প্রতুল মুখোপাধ্যায় তার কবিতায় লিখেছেন-আলু বেচো, ছোলা বেচো, বেচো বাকরখানিবেচো না বেচো না বন্ধু তোমার চোখের মণি।ঝিঙে বেচো পাঁচ সিকেতে হাজার টাকায় সোনাহাতের কলম জনম দুঃখী তাকে বেচো না।
রেসিপি ১ – বাকরখানি-বাকরখানি (চুলায় +ওভেনে)উপকরণঃক) খামিরের জন্য:১.ময়দা ১ কাপ,২.তেল ১ টেবিল চামচ৩.লবণ পরিমাণ মতো৪.গুড়ো দুধ ২ টেবিল চামচ৫.পানি পরিমাণমতোখ) লেয়ারের জন্য:১.তেল ১ কাপ২.ঘি বা ডালডা ৪ টে চা গ) ছিটানোর জন্য:১.ময়দা আধা কাপ২.কর্নফ্লাওয়ার ৪ টে চা
প্রনালীঃক) ময়দা, তেল, গুঁড়ো দুধ, লবণ ও পরিমাণমতো পানি দিয়ে ভালো করে ময়ান করে ঢেকে রাখুন ২ ঘণ্টা।খ) ঘি ও তেল এক সাথে মিক্স করে লেয়ারের জন্য একটি বাটিতে রাখুন।গ) ময়দা, কর্নফ্লাওয়ার মিশিয়ে প্রলেপ এর জন্য রেখে দিন।১. এবার একটি পিড়িতে তেল মাখিয়ে খামিরকে যতটুকু সম্ভব খুব পাতলা রুটি বেলে নিন।২. রুটিতে লেয়ারের তেল দিয়ে এর উপর গ-এর ময়দার মিশ্রণ ছিটিয়ে দিন। রুটিকে দুই ভাঁজ করে আবার তেল দিয়ে ময়দা ছিটিয়ে দিন। এভাবে আবার করুন।৩. এবার কোনা কোনো করে ভাঁজ দিয়ে তেল মাখিয়ে ময়দা ছিটিয়ে দিন। তারপর খামের মতো ভাঁজ করে রোল এর মতো করুন তারপর রোলটিকে ছোট ছোট লেচি কেটে রুটি বেলে নিন,রুটি বেশি পাতলা বা মোটা হবে না। ছুরি দিয়ে ৩ টি আঁচড় কেটে দিন রুটির উপর।ওভেন বেকিং:ওভেন ট্রেতে ঘি ব্রাশ করে ১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এ প্রি-হিট করে ২০-২৫ মিনিট বেক করে নিন।চুলায় বেকিং:চুলায় বেক করলে একটি ছড়ানো ঢাকনা যুক্ত পাত্রে লবন অথবা বালি দিয়ে স্ট্যান্ড বসিয়ে তার উপর তলা সমতল এমন একটি স্টিলের বাটি বা প্লেট উল্টিয়ে তার উপর বকরখানি বিছিয়ে দিন এবং ঢাকনা লাগিয়ে ৩০ মিনিট অল্প আঁচে বেক করে নিন বাকরখানি।
রেসিপি ২ – দুধে ভিজা নিম সুখারুটিউপকরণঃদুধ ২ কেজিচিনি ১ কাপমালাই ১ কাপজাফরান ১ চিমটি গোলাপজল ১ চা চামচনিম সুখা রুটি বা বাকরখানি ১০ টিতবক পরিমাণ মতোএলাচিগুঁড়া গুড়া ১ চিমটি কিশমিশ ১ টে চাপেস্তাবাদাম ও কাঠবাদাম কুচি ৩ টেবিল চামচসাগুদানা ২ টে চা
প্রণালীঃপ্রথমে ২ কেজি দুধকে জ্বাল দিয়ে ১ কেজি করতে হবে। সাগু ধুয়ে ১০ মিনিট ভিজিয়ে রাখুন। গোলাপজলে জাফরান ভিজিয়ে রাখুন। এবার দুধে সাগুদানা ও অর্ধেক মালাই দিয়ে কিছুক্ষণ জ্বাল দিয়ে এলাচ গুঁড়া, কিসমিস, চিনি ও গোলাপ জলে মিশানো জাফরান দিয়ে নেড়েচেড়ে চুলা থেকে নামিয়ে ফেলুন। এবার দুধ ঠান্ডা করে পরিবেশন পাত্রে বাখরখানি সাজিয়ে উপর থেকে দুধ ঢেলে দিয়ে দুই ঘণ্টা ঢেকে রাখুন। এবার দুধে ভেজা নিন সুখা রুটির উপর মালাই, পেস্তা বাদাম, কাঠবাদাম ও কিশমিশ ছড়িয়ে তবক লাগিয়ে পরিবেশন করুন।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন