বনেদি বাড়ির পুজোর ইতিকথা

বনেদি বাড়ির পুজোর ইতিকথা
পাঞ্চালী দত্ত

জংধরা বাতি স্তম্ভগুলো এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে। কোনোটায় টিমটিম জ্বলছে আলো আবার কোনোটায় বা আধ ভাঙ্গা কাঁচ ঝুলে আছে। নিভু আলোগুলো আজ বয়সের ভারে ক্লান্ত। মাঝেমধ্যে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে উঁচু লাল দেয়ালের ইটগুলোর সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলে। নাহ, বিশাল লোহার গেট খুলে দেওয়ার জন্য দারোয়ান দাঁড়িয়ে নেই। ঘোড়ার গাড়ির টক টক আওয়াজ কত কাল কেটে গেল আর শোনা যায় না চকমিলানের গাঁথা ইটে। নাচঘর এখন কতগুলো টুকরো ঘর হয়ে আলাদা নামে পরিচিতি পেয়েছে। অমুক দাদার ঘর, তমুক জ্যাঠার ঘর। কিন্তু এখানেই যে একসময় বেলোয়ারির ঝাড়বাতির তলায় মুঠো মুঠো টাকা উড়ত আজ তার প্রতি আনার হিসেবের মাশুল যেন বুঝিয়ে দেয় বেপরোয়া ” সময়” । পুজোপার্বণের দেখনদারি বনেদি বাড়ি বনাম বনেদি বাড়ি চলতো প্রতিযোগিতা। আর তার মধ্যে দুর্গাপুজো ছিল প্রধান আকর্ষণ। নিজেদের বৈভব, প্রতিপত্তি ইংরেজদের কাছে যাচাই করতে শুরু হয়েছিল বনেদি বাড়িগুলোতে দুর্গোৎসব। আড়ম্বর দেখে ইংরেজরা প্রায় ভিরমি খাবার জোগাড়। আর এই আড়ম্বরের অর্থের ফোয়ারার সাক্ষী আজ বাড়ীর ফাটল ধরা নির্জলা ফোয়ারা, রংচটা ইট, ঠাকুর দালান, মন্দিরের প্রতিষ্ঠিত দেব দেবী, চক মিলান, গেট, অলিন্দ আর অলিন্দের কোথাও কোথাও এখনো ঝুলে থাকা লোহার পিঞ্জিরাগুলো। কোনোটা খালি, কোনোটায় বা এখনো দু একটা টিয়া পাখি একসুরে ডেকে যায় … রাধা গোবিন্দ… রাধা গোবিন্দ…। সেজবৌ, মেজো বউ, ন বউ মিলে পাখি সংগ্রহের সে কী প্রতিযোগিতা! আর সেই ‘কোল্ড ওয়ার’-এ মাঝে মাঝেই অদৃশ্য কামান চালানোর কাজ করতো খেন্তি দাসী, মিনু দাসীরা। আজকাল পাখিদের গলায় সোনার চেনের বদলে ঝুলছে লাল নীল সুতো। তবে অবসর প্রাপ্ত পেন্ডুলাম ঘড়ি নীরবে গোনে ক্যালেন্ডারের দুর্গোৎসবের দিনগুলি। এই কদিন গোটা বাড়িতে কিছুটা হলেও ফিরে আসে বড় চেনা সেই গমগম আওয়াজ। আহা, কতদিন পর এরকম শব্দ খাঁখাঁ প্রাসাদটায়। শঙ্খধ্বনি, কাসর ঘণ্টা, ঢাকের শব্দ, চণ্ডী পাঠে ক্ষয়িষ্ণু বনেদিয়ানায় হালকা রঙ খেলে যায় পুজোর দিনগুলোতে। অনাগত আনন্দ প্রাধান্য বিস্তার করে পলেস্তরা খসে পড়া নাট মন্দিরে এই পাঁচ দিনে। শিউলি ফুটে থাকা সকাল আর কিছু হলদেটে ইতিহাস জীবন্ত হয়ে ওঠে শরতের সোনালী দিনগুলোতে। চকমিলানে মিলন ঘটে বনেদি পরিবারদের আপাতত শহর বা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আত্মীয় স্বজনদের ভিড়ে। সেই দুধেল গরুর দুধের ঘি তোলা নেই শিশিতে, তবুও খিচুড়ির গন্ধ ভেসে আসে শামিয়ানা বাঁধানো ওই ঘরের পেছন কোণ থেকে। ক্যাটারের রান্নার মেনুতে রয়েছে খিচুড়ি, লাবড়া, বেগুনি, চাটনি আর পোলাও এর সস্তার গন্ধ। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম দুর্গাপুজো হয় শোভা বাজার রাজবাড়ীতে। তখন দুর্গাপুজোর আমন্ত্রণ পত্র দুরকম ভাবে ছাপানো হত। সাহেবদের জন্য ইংরেজি আর দেশীয় ব্যক্তিদের জন্য সংস্কৃত ভাষায়। দুধ সাদা মার্বেল পাথরের ঠাকুর দালানটি। মন্দিরের ভেতরে ও বারান্দায় ঝুলছে কয়েকটি ঝাড় বাতি যা আজো বুঝিয়ে দেয় বনেদিয়ানার ছোট্ট একটি উদাহরণে। এই রাজবাড়িতে উল্টোরথের দিন কাঠামো পুজো হয়। প্রতিমার গড়ন, মাপ, মুখের ছাঁচ আড়াইশো বছরের পুরনো সেই দূর্গামূর্তির মত অবিকল রাখা হয়। পলাশীর যুদ্ধের পর রাজা নবকৃষ্ণের উদ্যোগে প্রথম দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয় এই বাড়িতে। রাজবাড়ীর নিয়ম হলো কোনো অন্নভোগ মাকে দেওয়া হয় না। চাল কলা নৈবেদ্য এবং বাড়িতে ভিয়েন বসিয়ে তাদের তৈরি মিঠাই ভোগ দেওয়া হয়। মেদিনীপুর থেকে ঠাকুরেরা এসে মিষ্টি তৈরি করে, যেমন গজা, দরবেশ, চন্দ্রপুলি, বালুসাই, মতিচুর, পান্তুয়া, পক্কনী, শোন পাঁপড়ি, পুর্ণ চন্দ্রপুলী, কচুরি, শিঙ্গাড়া, নিমকি এধরনের খাবার মা-কে নিবেদন করা হয়। নবমীর দিন নয়টি বলি হয়। পাঁঠা, চাল কুমড়া, মাগুর মাছ এবং এরকম আরো কিছু উপকরণ। তবে পুজোর বলির মাংস পরিবারের কারও গ্রহণ করার নিয়ম নেই। দশমী দিন কৈলাশে মহাদেবকে মায়ের রওয়ানা হওয়ার বার্তা পৌঁছতে নীলকন্ঠ পাখি আজও ওড়ানো হয় আকাশে। সময়ের কাঁটা ঘুরে যায়। কিন্তু বনেদি বাড়ীর ঐতিহ্য আজও জ্বলজ্বল করে উত্তর কলকাতার আকাশে বাতাসে ।

উত্তর কলকাতার বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিট এর ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে লাহা বাড়ি। লাহা পরিবারের দুর্গামূর্তির বিশেষত্ব হলো দুর্গা শিবের কোলে এখানে গৌরী নামে শান্তিরূপিনী আশীর্বাদ মুদ্রায় বসা। শিব বৃষের উপর উপবিষ্ট। মা তার সন্তানসন্ততিদের সঙ্গে একই চাল চিত্রে রয়েছেন। এখানে শিব দুর্গাকে সৃষ্টির প্রতীক হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। ষষ্ঠীর দিনে দেবীকে সুসজ্জিত করা হয় নানা অলংকার ও বসনে। পুরোহিতেকে দান করা হয় আতপ চাল, ঘি, চিনি, দুধ, ফল ইত্যাদি ।নানা রকম ফল, নারকেল নাড়ু , তিলের নাড়ু , মুগের নাড়ু , ছোলার নাড়ু , গুঁড়ো চাল, গুড় ও নারকেল দিয়ে বুটের নাড়ু, মুড়ির মোয়া, খইয়ের মোয়া, বেলা পিঠে, জিভে গজা, পানগজা, ছোট গজা, চৌকো গজা, চিরকুট গজা, প্যারাকি চিনির মুড়কি – এধরনের খাবার নিবেদন করা হয় মাকে। এছাড়া থাকে লুচি, কচুরি, সিদ্ধ ছোলা, কুমোড়ের ছক্কা, বেগুনি, ফুলুরি, বেগুন ভাজা, আলু ভাজা, পটল ভাজা ও ডাবের জল। উত্তর কলকাতার ঘটিদের নিয়ম হচ্ছে যেহেতু তারা ব্রাহ্মণ নন, তাই অন্ন পাক করে দেওয়া বারণ। তাই স্তুপ করে মায়ের সামনে রাখা হয় কাঁচা চাল। সপ্তমীর দিন মাকে স্নান করানো হয় ঘি, দুধ, মধু, নারকেলের জল, আখের রস, চিনি, আলতা, সরিষা সুপারি দিয়ে। সেদিন ছাঁচি কুমড়ো বলি দেওয়া হয়। তারপর নৈবেদ্য ভোগ ও মিষ্টান্ন বরাদ্দ থাকে মায়ের জন্য। এভাবেই পুজোর প্রতিদিন নানা বিধ উপাচারে মাকে সাজিয়ে দেওয়া হয় খাবার। দশমীর দিন সকাল সাড়ে এগারোটার ভেতর সকল পূজা সম্পন্ন করে ঠাকুর ঘরে কুলদেবীকে শয়ন করানো হয়। এরপর গৃহবধূরা দেবীর হস্তে জোড়া খিলি, পান, নাড়ু দিয়ে কপালে সিঁদুর হলুদ ও দুধের ফোঁটা লাগিয়ে মাকে বরণ করেন। বিকেল চারটে নাগাদ প্রতিমা নিরঞ্জনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা হয়। বাঁশে দড়ি বেঁধে দোলনা তৈরি করে তার ওপর প্রতিমা বসিয়ে গঙ্গায় নিয়ে যাওয়া হয়। মূর্তিকে যখন বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় বাড়ির সমস্ত দ্বার ও সদর দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রতিমা বিসর্জনের পর গৃহে ফিরে আসার পর বাড়ির কর্তা বন্ধ দরজার বাইরে থেকে প্রশ্ন করেন, “মা আছেন ঘরে?” বাড়ির ভেতর থেকে কেউ বলেন, “মা আছেন ঘরে”। তারপর বাড়িতে সবাই ঢোকেন। বিশ্বাস এটা, যে মাকে বিসর্জন দিলেও মা সবসময় বাড়িতেই অধিষ্ঠাত্রী। তারপর প্রণাম ও কোলাকুলি শেষে মিষ্টিমুখে শেষ হয় বছরের পুজো। এভাবেই চলছে নিষ্ঠা সহকারে যুগের পর যুগ দুর্গাপুজো। অবশিষ্ট যা কিছু রয়েছে এই বাড়ির, এখনো যত্ন সহকারে রাখায় এই বাড়ি কলকাতার গর্ব। রিক্সার ঢং ঢং আওয়াজে সাবেকি ঐতিহ্য, বাবু কালচার দমকা হাওয়ায় পুরনো কলকাতার গন্ধ মনকে আচ্ছন্ন করে দেয় মুহূর্তকালের জন্য।

বঙ্গের বিত্তশালী জমিদার হিসেবে সাবর্ণ রায় চৌধুরি পরিবারের সুনামই ছিল আলাদা। মুঘল সম্রাট আকবর তাঁদের “রায়” ও জাহাঙ্গির তাঁদের “চৌধুরী” উপাধি দিয়েছিলেন। এবং পরবর্তী কালে এটাই তাঁদের পদবি হয়। ১৬১০ সাল থেকে বড়িশার সাবর্ণ পরিবারে দুর্গাপূজা শুরু হয় এবং সম্ভবত কলকাতা অঞ্চলের এটাই প্রথম দুর্গাপুজো। বর্তমানে কয়েকটি শিব মন্দির ও আটখানা থাম ছাড়া তেমন কিছুই বেঁচে নেই দেখার মত। বড়িশা অঞ্চলের পরপর কয়েকটি শিব মন্দির ও আটটি থাম বনেদিয়ানার শেষ চিহ্ন বয়ে নিয়ে চলেছে যুগ যুগান্ত ধরে। এ বাড়ির পুজো হয় দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী মতে। নবমাদিকল্পে পুজোর বোধন শুরু হয় কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথিতে। এর হিসেবটা হল মহানবমীর ১৫ দিন আগে। শিউলিফুলের বোঁটার রঙের সঙ্গে মিল রেখে দেবীর গাত্রবর্ণ সেই রঙের হয়। আর মহিষাসুরের গাত্রবর্ণ বেলপাতার রঙ অনুযায়ী। এই পরিবারের রীতিতে দেবীকে কিন্তু কৃষ্ণা নবমী থেকেই দুবেলা করে ভোগ দেওয়া শুরু হয়ে যায় বোধনকক্ষে এবং এই ব্যবস্থা চলে ষষ্ঠী পর্যন্ত। আর সপ্তমী থেকে মন্ডপে ভোগ নিবেদন করা হয়। এই বাড়িতে কিন্তু মাকে অন্ন ভোগ দেওয়া হয়। সপ্তমী অষ্টমী ও নবমীতে খিচুড়ি, লাবড়া, পাঁচ রকম ভাজা, পোলাও, ধোকার ডালনা, ছানার ডালনা, শুক্তো, ডাল, সাদা ভাত, বাঁধা কপির ঘণ্ট, ফুলকপির ডালনা, পোনা মাছ, ইলিশ মাছ, চাটনি, পায়েস, ফল, মিষ্টি এরকম নানাধরনের ব্যঞ্জন সাজিয়ে মাকে দেওয়া হয়। সন্ধিপুজোতে একটা নিয়ম রয়েছে ভোগ নিয়ে। সন্ধিপুজোর চল্লিশ মিনিটের ভেতর মাকে মালসাতে খিচুড়ি তৈরি করে দিতে হয় এবং সঙ্গে দিতে হয় ল্যাটা মাছ পোড়া। পুজোর শেষ দিন অর্থাৎ দশমীতে সকালবেলায় মাকে পান্তা ভাত দেওয়া হয় আর তার সঙ্গে কচুর শাক। তবে দশমীতে কোনো রান্না আলাদা করে করা হয় না। নবমীর দিন কিছু রান্না আলাদা করে রেখে দেওয়া হয় এবং সেখান থেকেই পান্তা ভাতের প্রচলন। কারণ সেদিন সিঁদুর খেলা, মাকে মিষ্টি মুখ করানো, বাড়ির উদ্দেশ্যে যাওয়ার সমস্ত প্রস্তুতি ও ভরাক্রান্ত হৃদয় …এসব কথা মনে করেই বোধহয় বাসি খাবারের প্রচলন শুরু হয়। কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার বনেদি বাড়িগুলোতে এভাবেই দুর্গাপুজো চলে আসছে, এক এক বাড়ির এক এক নিয়ম ও উপচারে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *