শকেরা আহমেদ
আস সালামু আলাইকুম। ফয়সাল সাহেব কেমন আছেন?
এতক্ষণে সারাদেশের বিদ্যুতের ঘাটতি, গুম, খুন, দ্রব্যমূল্যের বল্গা গতি, বামপন্থী–ডানপন্থী রাজনীতি ইত্যাকার গরম খবর নিয়ে গল্পে মত্ত ফয়সাল সাহেব মুখ তুলে একটু দেখে দায়সারা গোছের ভদ্রতায় বলেন, “ও… রিপন সাহেব, তা কেমন আছেন বলুন। বসুন।” কথাটা বলে ফয়সাল সাহেব গল্প বন্ধ করে সামনের ফাইলের স্তুপ থেকে একটা ফাইল টেনে নিয়ে ডুবে গেলেন তাতে।
অপ্রস্তুতভাবে বসে রইলেন রিপন সাহেব নামের লোকটা। দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করে রিপন সাহেব প্রয়োজনের চেয়েও বেশি বিনয় ঢেলে বলেন, “ফয়সাল সাহেব, আমার ফাইলটা রেডি করে আজ কি ছাড়া যাবে?”
“কী বলেন এসব! আপনি আমাদের নিজেদের লোক। রিটায়ার করেছেন বলে কি এতোটাই পর হয়ে গেছেন যে আপনার ফাইল ধরে রাখব? একটু ধৈর্য ধরে বসেন, দেখি আপনার জন্য কী করতে পারি।”— নরম আশ্বাসবাণী বিছিয়ে দিয়ে ফয়সাল সাহেব আবারও টেবিলে মেলে রাখা ফাইলে ডুব দিলেন।
পদমর্যাদা অথবা সম্পর্ক এতটাই ঠুনকো যে, এদের আগে এক্স শব্দ যুক্ত হলেই গুরুত্ব কমে যায়! রিপন সাহেব একটি সরকারি ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার ছিলেন। ব্যাংকটির প্রধান শাখা থেকেই অবসরে যান। একসময় এখানে ওনার প্রভূত কর্তৃত্ত্ব ছিল। অবসর নিয়ে ব্যাংকের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে জনতার স্রোতে মিশে যাবার সাথে সাথে তিনি এদেশের একজন সাধারণ নাগরিক, এই ব্যাংকের একজন সাধারণ গ্ৰাহকে পরিণত হলেন। এ কারণেই বুঝিবা জুনিয়র অফিসার ফয়সাল সাহেব আজ এক্স সিনিয়র অফিসার রিপন সাহেবকে স্যার না ডেকে নাম ধরে ডাকছেন। অবশ্য নাম ধরে ডাকা না ডাকায় খুব একটা আপ্লুত কিংবা অনাপ্লুত হন না তিনি। তবে সবকিছুর ধারাবাহিকতায় বিশ্বাস করেন। সেই ধারাবাহিকতা ভেঙে গেলে কিছুটা হলেও ধাক্কা খান বৈকি! যেমনটা এই মুহূর্তে খেয়েছেন। অথচ, এইতো সেদিন নতুন নিয়োগ হয়ে এলেন ফয়সাল সাহেব। বয়সে একেবারেই তরুণ। কাজ কর্ম কিছুই বোঝেন না। রিপন সাহেবই হাতে ধরে কাজ শিখিয়ে পাকা পোক্ত করেছেন। শত ভুলভাল থেকে বাঁচিয়ে নিয়েছেন তাকে। অথচ নিজের পেনশনের ফাইলের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গোছাতে আজ নিয়ে পাঁচদিন এই ব্যাংকে এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে ঘুরে ক্লান্ত রিপন সাহেব। এ কয়দিন ধরে অবসর ও পিআরএল গমনের মঞ্জুরিপত্র, শেষ বেতন পত্র, না-দাবী প্রত্যায়নপত্র, প্রাপ্তব্য পেনশনের বৈধ ঘোষনাপত্র গোছাতেই পার হয়ে গেল। আজ পেনশন আবেদন ফর্ম তুলে পূরণ করে ফাইলে জমা দিতে হবে।
চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর থেকেই রিপন সাহেবের শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। চাকরিরত অবস্থায় দিব্যি সুস্থ–সবল মানুষ ছিলেন। কলেজ জীবন থেকেই তিনি ছিলেন হুল্লোড়প্রিয়। এম এ পরীক্ষা শেষ হওয়ার দিন সেই রিপন সাহেবকে অবাক করে দিয়েছিলেন সবসময় নিজের ভিতরে গুটিয়ে থাকা মেহেরুন। পরীক্ষা শেষে ছায়াঘেরা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ পাবলিক লাইব্রেরির সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন মেহেরুন। তারপর রিপন সাহেবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কোনো ভূমিকা ছাড়াই বলেন, “আমারা বিয়ে করতে পারি রিপন?” পঁচিশ বছর বয়সী সেদিনের রিপন হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে গাম্ভীর্য মিশ্রিত বিস্ময়ে বলেছিলেন, “সে না হয় আমরা করতেই পারি। কিন্তু আমি জানতাম তুমি তুহিনকে পছন্দ কর এবং তুহিনও তোমাকে।”
মেহেরুন রিপনের চোখে চোখ রেখে দৃঢ় অথচ শান্ত কণ্ঠে বলেন, একই রকম পছন্দ আমি তোমাকেও করি। কিন্তু বিয়ের কথা তোমাকেই বলছি। তুহিনকে নয়। তুহিনের সঙ্গে জীবন কাটাব এমন প্রতিশ্রুতি আমি কখনোই ওকে দেইনি।
সেদিনের তরুণ রিপন কী বুঝেছিল, কতটা বুঝেছিল কে জানে! শুধু বলেছিল, “কিন্তু আমি যে বেকার। স্ত্রীর দায়িত্ব নেবার মতো অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এখনো আসেনি আমার।”
“অর্থনৈতিক দিক থেকে অস্বচ্ছল তোমার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমি আমার জীবনে স্বচ্ছলতা আনতে চাইছি। রাজি থাকলে আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে কথা আগাবার ব্যবস্থা নিতে পার।” কথাগুলো বলে ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করেছিল নতুন রূপের মেহেরুন।
রিপন দূর থেকে ভেসে আসা গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিল, “যদিও তোমাকে আমি সেভাবে ভাবিনি কখনো, তবুও তোমাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেলে আনন্দিত হব। আমি কথা দিচ্ছি না, তবে চেষ্টা করব।”
আজ রিপন সাহেবের শরীর খুব একটা ভালো না। স্ত্রী মেহেরুন তাঁকে একা ছাড়তে সাহস পাননি। তাই তিনি স্বামীর সঙ্গে এসেছেন। একটা খালি চেয়ারে অসুস্থ স্বামীকে বসতে দিয়ে তাঁর পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন মেহেরুন। ফয়সাল সাহেব নামক লোকটির কোনো প্রকার হেলদোল না দেখে মনে মনে চটে যাচ্ছিলেন তিনি। লোকটিকে তার একদমই ভালো লাগছিল না। এ ভালো না লাগা থেকেই লোকটিকে খুঁটে খুঁটে দেখছিলেন আর নিজের এক নতুন শৈল্পিক প্রতিভার সঙ্গে পরিচিত হলেন তিনি। মেহেরুন খেয়াল করলেন, লোকটির আগা মোটা থ্যাবড়ানো নাক। জঙ্গলে ঘেরা উঁচু ঢিবিমতো জায়গার মাঝখানে ছোট্ট একটা পুকুরাকৃতির চারিদিকে চুলের জঙ্গলের মাঝখানে চকচকে টাক। চোখের নিচে এবং চোয়ালের দু’পাশে মাংস ঝুলে পড়েছে বুড়ো মুরগির গলার চামড়ার দাড়ির মত। মেহেরুন দীর্ঘ দু ঘণ্টা লোকটির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। মেজাজ খারাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই লোকটার স্কেচ আঁকছেন আপন মনে আর প্রচণ্ড রাগে সেই স্কেচের উপর কালির আঁকিবুঁকি এঁকে দিচ্ছিলেন। আজ অবশ্য সকাল থেকেই তাঁর মেজাজ খারাপ। তার দেখা মতে কলেজজীবন থেকে শুরু করে কর্মজীবন পর্যন্ত এতো হুল্লোড়প্রিয় মানুষটা হঠাৎ করে চুপচাপ হয়ে গেল রিটায়ারের পর থেকে। কলেজে পড়াকালীন সময়ে মেহেরুনকে নির্ভরতা দিয়ে আগলে রাখা মানুষটা বিয়ের পর থেকে কেমন যেন পাল্টে গেল। উল্টে মেহেরুনেরই সবসময় আগলে রাখতে হয়েছে রিপন সাহেবকে। চাকরি, বন্ধু আড্ডায় একনিষ্ঠ রিপন সাহেব সংসারের দায়িত্ব পালনে খুব একটা নিষ্ঠ ছিলেন না। তাই বলে তিনি স্ত্রীকে অবহেলা করেননি কখনো। বরঞ্চ সসম্মানে তাকে ছেড়ে দিয়েছেন তার আপন রাজ্যপাটে। কখনো ভুলেও উঁকি দিয়ে দেখেননি। এটাকে মেহেরুন সংসারের প্রতি স্বামীর নিস্পৃহতাই মনে করেন। এই নিস্পৃহ নির্লিপ্ততায় মাঝে মাঝেই হাঁপিয়ে উঠেন তিনি। আজ ছিল এমনই একটি দিন। গতকাল রাতে রিপন সাহেবের প্রেসারটা ঔচিত্যের সীমানা পার হয়ে হুড়হুড় করে বেড়েছে। সন্ধ্যারাতে তাই নিয়ে সে কী হুড়োহুড়ি! সেই মানুষ কিনা সকালে ঘুম থেকে উঠেই বলেন ব্যাংকে আসবেন। মেহেরুন তখন রান্না ঘরে ব্যস্ত। গ্যাসের আগুনে তেতে থাকা তার মেজাজটাও উঠলো আরো তেতে। হাড়ি, পাতিল আর রুটির পিঁড়ি, বেলুনে ঠাসঠুস করতে করতে বলতে থাকলেন, “বিয়ের পর থেকে একটা দিনের জন্যেও তুমি আমার শান্তির কথা ভাবনি। পুরো সংসারের হাল আমার হাতে ছেড়ে দিয়ে দিব্যি নিজের গায়ে হাওয়া লাগিয়ে জীবন পার করে দিলে। এখন বুঝি সব ভার আমার মাথায় দিয়ে ভব নদী পার হতে চাইছ?” রিপন সাহেব স্ত্রীর এ ধরনের উপর্যুপরি বাক্যবাণ পাশ কাটিয়ে নিচু কণ্ঠে শুধু বলেছিলেন, “এগুলো কোন ধরনের কথা, রুনু? তুমি আমাকে একা ছাড়তে চাইছ না, আমার সঙ্গে যেতে চাইছ, সেটা মুখে সোজাসুজি বললেই ল্যাঠা চুকে যায়। তাই বলে এমন কথা! ছেলে মেয়েরা যার যার সংসারে থিতু হয়েছে বেশ আগে। এ বাড়িতে সাকূল্যে আছি শুধু তুমি আর আমি। সেই আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে চাইছি – এ কথা তুমি বলতে পারলে! নাহ, দিন দিন তুমি যেন কেমন হয়ে যাচ্ছ।” এরপর কর্তা–গিন্নি দুজনেই আর কথা না বাড়িয়ে পরিপাটি হয়ে ব্যাংকে এসেছিলেন।
বেলা সাড়ে এগারোটা। মেহেরুন বসে আছেন বাশার সাহেবের টেবিলের বিপরীতে। আজকের উপলক্ষও স্বামীর পেনশনের ফাইলটা এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে ঠেলে ঠুলে ম্যানেজারের টেবিল পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া। গতকালের অভিজ্ঞতার কারণে আজ রিপন সাহেবকে আনেননি। গতকাল ফয়সাল সাহেবের টেবিলের প্রয়োজনীয় কাজ শেষ হওয়ার পর যেতে হয়েছিল জনাব ননীভূষণের ডেস্কে। সেখানে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে ফর্ম পেয়েছিলেন। এরপর সেটা পূরণ করতেই লাঞ্চের সময় হয়ে গেল। তখন চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে ননীবাবু বলেছিলেন, “দুঃখিত রিপন সাহেব, আপনার কাজ আজকে আর সম্ভব না।”
অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে বসে থাকার ক্লান্তি আর কাজ না হওয়ায় বিরক্ত ছিলেন মেহেরুন। তবুও বিরক্তি চেপে যথাসম্ভব শীতল গলায় বলেছিলেন, “তাহলে আমরা লাঞ্চের পর আসি। আজ কাজটা শেষ করতে পারলে আমাদের জন্য ভালো হত।”
“না, না, আজ আর সম্ভব না। আপনি এক কাজ করুন, ফর্মটা রেখে যান। আগামীকাল আমি ফর্ম চেক করে সাইন দিয়ে দেব” ব্যস্ত ভঙ্গিতে কথাটা বলেছিলেন ননী বাবু।
আজ সকাল সাড়ে নয়টায় ব্যাংকে এসেছেন মেহেরুন। ননীবাবুর কথামতো গতকাল ফর্মটা রেখে গিয়েছিলেন রাকিব নামের ছেলেটির কাছে। আজ রাকিবের খোঁজ করতেই জানা গেল, মা হাসপাতালে ভর্তি আছেন বলে ও ছুটিতে আছে। ওদিকে অফিসে আসার আগে পা মচকে যাওয়ায় ননীবাবুও ছুটিতে আছেন। গতকাল রেখে যাওয়া ফর্মটা কার কাছে পেতে পারেন তা কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেও কোনো হদিস পেলেন না। সবাই অন্য টেবিল দেখিয়ে দেন। উপায়ন্তর না পেয়ে ম্যানেজারের রুমে যান মেহেরুন। পাজামা–পাঞ্জাবী পরা মার্জিত চেহারার ভদ্রলোক বন্ধুসুলভ গল্প করছিলেন বিপরীতে বসা একজনের সঙ্গে। সমস্যার কথা জানাতেই তিনি ওকে বাশার সাহেবের টেবিলে পাঠালেন। দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে বাশার সাহেবের টেবিলে ফর্ম পাওয়া গেল।
এর পরের টেবিল মশিউর রহমানের। ইনি ব্যাংকের দ্বিতীয় কর্মকর্তা। আগের বাশার সাহেব এবং ননীভূষণের চেয়ে ইনি এক কাঠি নয়, দশ কাঠি সরেস। প্রথম দিকে বুঝতে না পারলেও একটু পরেই মেহেরুন বুঝতে পারেন যে, লোকটি শারীরিক প্রতিবন্ধী। কিছুক্ষণ পরপর ঘাড়টা বামদিকে বেঁকে যায়, কথা বলেন টেনে টেনে। এই টেবিলে এসে আরো একঘন্টা দাঁড়ানোর পর লোকটি যখন বলেন— “আজ আর কাজ হবে না।” তখন মেহেরুনের ইচ্ছে হয় লোকটার বাম কানে কষে একটা বনচটকানা দিতে। যাতে তার বেঁকে যাওয়া ঘাড়টা সোজা হয়ে যায় ইহজীবনের মতো। ভাবনাটা অমানবিক হলেও এই মুহূর্তে এটাই সঠিক মনে হচ্ছে। তবুও গলায় যতটা সম্ভব বিনয় ঢেলে বলেন, “দেখুন অফিসার, যদি দয়া করে আমার কাজটা আজ শেষ করে দেওয়া যায়। একঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি আপনার সামনে।”
লোকটির ঘাড়টা আবার বামদিকে বেঁকে গেল। ঠোঁট দুটো ডানে বাঁয়ে দুই ইঞ্চি করে প্রশস্ত করে বলেন, “নাহ আমার অত দয়া করার কোনো প্রয়োজন নাই। সকাল থেকে এসে বসে আছি। এখনো নামাজ পড়তে পারিনি। লাঞ্চ করতে পারিনি।”
মেহেরুন মনে মনে বলেন, “বান্দরের বন্ধু, বদের বদ ব্যাটা। খুব আমাকে কাজ দেখাচ্ছ। তিন–চার ঘণ্টা ধরে দেখছি তোমাদের। তিন ঘণ্টায় মাত্র পাঁচ জন লোকের কাজ করেছ। তাও কম্পিউটার দেখে ভেরিফাই করে সই দেওয়া ছাড়া আর তো কোনো কাজ করনি। তা করতেই গড়িয়ে গড়িয়ে তিন ঘণ্টা। একজনের কাগজ হাতে ধরে আবার রাখ। আরেক জনেরটা ধর। সেটা রেখে আবার বাড়িতে বউয়ের বাজারের লিস্ট নাও। এখন আমাকে কাজ দেখাচ্ছ!” কিন্তু এসবের কিছুই বলতে পারেন না মেহেরুন। আপন মনে রাগে গজর গজর করতে করতে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে এলেন বেলা তিনটার দিকে।
রাগ আর মনখারাপি ভাবটা কিছুতেই কাটছে না। এটা থেকে বের হওয়ার ইচ্ছায় ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করলেন। ফল বাজার পার হয়ে হার্ডওয়ারের দোকানগুলো পেছনে ফেলে রাস্তা পার হয়ে গুড় বাজারে ঢুকে পড়লেন। রিপন সাহেবের অভ্যাস বেলা এগারোটার দিকে আখের গুড়ে লেবুর শরবত খাওয়ার। এজন্যই এক কেজি আখের গুড় কিনে আবার উল্টো পথ ধরলেন। একে একে ক্রেকারিজের দোকান, সীলঘর, লেপতোষক, চশমার দোকানগুলো পার হয়ে কাঠপট্টির রাস্তার কোণায় পুষ্পাঞ্জলীর সামনে আসতেই শ্লথ চলার গতি থেমে গেল। তার তারুণ্যে গোটা শহরে এই একটাই ফুলের দোকান ছিল। তখন ভীষণভাবে রজনীগন্ধাপ্রীতি ছিল মেহেরুনের। সেই দিনগুলোর প্রায়দিনই বাড়ি ফেরার পথে একটা দুটো রজনীগন্ধার ডাঁটা কিনে আনতেন। খালি স্প্রাইটের সবুজ বোতলে পানিতে ভিজিয়ে রাখা ফুলগুলো সারারাত মিষ্টি গন্ধ ছড়াত। যেসব দিনে মেহেরুন যত্ন করে খোঁপা বেঁধে যেতেন, “পুষ্পাঞ্জলী”র মালিক ছেলেটি তাকে জোর করে দুটো গোলাপ দিয়ে বলত, দিদি, আপনার এই খোঁপা খালি থাকা মানায় না। এটা আমার পক্ষ থেকে আপনার জন্য উপহার। বিয়ের পর থেকে এই ফুল কেনার অভ্যাসটা কেমন করে যেন হারিয়ে যায় মেহেরুনের। “আপনি নিশ্চয় মেহেরুন ম্যাডাম?”— হঠাৎ নিজের নাম ধরে ডাকা কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে পাশে তাকাতেই এক ভদ্রলোক আবার উচ্চারণ করলেন, “আপনাকে তুহিন স্যার ডাকছেন।” কথাটা বলে লোকটা পার্টি অফিসের সামনে একটা ঝকঝকে সাদা গাড়ি দেখায়। বিমূঢ় মেহেরুন দেখেন,গাড়ির জানালা থেকে মুখ বের করে আছেন তুহিন মাহমুদ। শহরের এক সময়ের তুখোড় রাজনীতিবিদ।
কত্তো দিন পর দেখা! উচ্ছল তারুণ্য পেরিয়ে এই আধখেচড়া প্রৌঢ়ত্ত্বের প্রান্তে এসেই তুহিনের মুখোমুখি দাঁড়াতে হলো! এই দাঁড়ানোটা না দাঁড়াতে হলে কী এমন ক্ষতিবৃদ্ধি হতো বিশ্বব্রহ্মান্ডের? তার আহ্নিক গতি বার্ষিক গতির হের ফেরও হতো না নিশ্চয়। প্রথম দেখার বিস্ময় কেটে বিষাদ নেমে এলো তার চোখে। তুহিন তার পুরোনো স্বভাব মতো ঠোঁটের কোণায় মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে পুরোনো ভঙ্গিতে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ভালো আছো তো?
“হ্যাঁ, ভালো আছি। তুমি কেমন আছ?” হকচকিতা কাটিয়ে সপ্রতিভ ভাবে বলেন মেহরুন।
পুরোনো স্বভাবসুলভ কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাসি ছড়িয়ে দিয়ে ‘ভালো আছি’– কথাটা বুঝিয়ে দিলেন তুহিন। তারপর বলেন, “পথের মাঝে দাঁড়িয়ে সবাইকে কষ্ট না দিয়ে বরঞ্চ গাড়িতে উঠে আসাটাই ভালো। অনেক দিন পর তোমার সাথে দেখা। আসো, যেতে যেতে গল্প করি।”
“তোমার পথ আর আমার পথ তো এক নয় তুহিন। শুধু শুধু তোমার ঝামেলা বাড়বে।”— বলে ম্লান হাসার চেষ্টা করেন মেহেরুন।
“হাটবারের ভিড়ে এই রাস্তায় বেশিক্ষণ দাঁড়ানো যাবে না। বেশি কথা না বলে চলে আসো।”—কথাটা বলে নিজেই গাড়ির দরজা খুলে দেন তুহিন।
“তারপর বলো, কেমন চলছে তোমার দিনকাল। বহুদিন পর দেখা হলো আমাদের। সেই এক কোটি বছর তোমাকে দেখি না–র মতো।” কথাটা বলে সহজ হতে চাইলেন তুহিন। মেহেরুন কোনো উত্তর না দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কোনো প্রকার উত্তরের অপেক্ষা করেন না অবশ্য তুহিন। নিজের মনেই বলতে থাকেন, হাতের মুঠোর মতো ছোট্ট শহর। একই এই শহরে দুজন মানুষ বসবাস, চলাফেরা করে, বাজার ঘাট, আত্মীয়তা, সামাজিকতা রক্ষা করে। অথচ একবার হারিয়ে গেলে আর তাদের দেখা হয় না। অবাক না ব্যাপারটা?” কথাটা বলে মেহেরুনের মুখের দিকে তাকান তুহিন। এতোক্ষণ লুকিং গ্লাসে রাখা ক্লান্ত চোখটা তুহিনের দিকে ফিরিয়ে সাবলীল হবার চেষ্টা করে মেহেরুন বলেন, “হয় না বলছ কেন, দেখা আমাদের হলো তো।”
গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। অথচ মেহেরুনের মন চলে যাচ্ছে পেছনে। যে দিনগুলো তিনি ফেলে এসেছেন তার জীবনের স্বর্ণালি সময়ে। কী যে মধুরতাময় দিন ছিল তখন! স্কুল জীবন থেকেই রাজনীতি সচেতন তুহিন কলেজে পা দিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠলো। যদিও এদেশে কখনোই সঠিক অর্থে বামপন্থী বা ডানপন্থী রাজনৈতিক দল ছিল না, তবুও মোটের উপর তুহিন সেই কলেজ জীবন থেকেই বামপন্থী রাজনীতি করতো। এই রাজনীতি বিষয়টা মেহেরুনের তখন থেকেই অপছন্দ। এই একটা কারণেই তুহিনও অপছন্দের তালিকায় ছিল। ফেলে আসা সময়গুলোতে একমাত্র আনন্দ আর ভরসা দানকারী সঙ্গী ছিল তুহিন। তুহিনের চোখ থেকে ঝরে পড়ত সুবাস মাখা,মায়া ঘেরা শিরিষের ছায়া। হাতছানি দিত সন্ধ্যা পেরিয়ে যাওয়া পঞ্চমীর চাঁদ। কাঁটাঝোপের মতো পরিবারের বেঁধে দেয়া অদৃশ্য ঘেরাটোপে বেড়ে ওঠা মেহেরুন শিরিষের বিশালতা আর সন্ধ্যার আঁধার পেরিয়ে সুবাস আর চাঁদের আলো দেখার সাহস দেখাতে পারেননি। হঠাৎ কোনো ভনিতা না করেই তুহিনের দিকে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “সেই রাজনীতিতেই পড়ে থাকলে তাহলে সারাটা জীবন! এখান থেকে বের হতে পারলে না আর!”
“কি আর করা বলো, অন্য কেউ পছন্দ করুক চাই না করুক, এখানেই আমি আমাকে খুঁজে পাই।”
“না, ঠিক আছে। নিজের জীবনের জন্য তুমি যেটা ভালো বুঝবে সেই সিদ্ধান্তই নিবে। অন্যের পছন্দ অপছন্দে কী এসে যায়! তাছাড়া রাজনীতিতে তুমি তো সফল হতে পেরেছ।”
“তুমি কী করে জানলে? রাজনীতিতে তোমার আগ্ৰহ কবে থেকে শুরু হলো?”
“এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি তোমার ব্যবসা আর রাজনীতিকে সামাল দাও কী করে? জেলা কমিটিতে তোমার পদমর্যাদা, গ্ৰহণযোগ্যতা তৃণমূল পর্যায়ে তোমার জনপ্রিয়তা জানার জন্য পরিশ্রম করতে হয় না। রাজনীতিতে আগ্ৰহ থাকারও প্রয়োজন পড়ে না। ওসব সফলতার খবর বাতাসে ভেসেই কানে আসে।”
“সফলতা” কথাটা কানে বাজে তুহিনের। সিগারেটের আগায় দেশলাই কাঠি জ্বালানোর মতো ধপ করে জ্বলে উঠলো অতীত। এই সফলতা শব্দটাই একটা সময় তুহিনের মনোকষ্টের কারণ হয়েছিল। তার সরল আত্মনিবেদনকে উপেক্ষা করেছিল মেহেরুন। ছাত্রনেতা তুহিনের অসফলতার সম্ভাবনাই আপত্তির কারণ ছিল মেহেরুনের। তীব্র মেধাবী তিনি বলেছিলেন, “আমাদের কোনোভাবেই মিলবে না, তুহিন। তুমি পারবে আমার জন্য রাজনীতি ছাড়তে? তুমি একজন ব্যক্তি ও বন্ধু হিসেবে ভালো হলেও আমি তো একটা অনিশ্চয়তার জীবন বেছে নিতে পারি না।”
“কণ্ঠের দলা পাকানো কান্নাটাকে গিলতে গিলতে তুহিন বলেছিলেন, না মেহের, রাজনীতি আমি ছাড়তে পারব না। তবে তুমি মেনে নিলে অনিশ্চয়তার জীবন নয়, তোমার চলার পথ আমি লাল গালিচায় ঢেকে দিব।”
না, মেহেরুনের চলার পথ লাল গালিচায় ঢেকে দিতে পারেননি তুহিন। উপেক্ষাকাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হবার পর আর দেখা হয়নি দুজনের। মেধাবী রিপনকে বিয়ের খবরটা বন্ধুদের মাধ্যমেই কানে এসেছিল। সিগারেটে আগুন ধরে যেতে যতেই মিইয়ে আসা দেশলাইয়ের আগুনের মতোই অতীতের উজ্জ্বলতা কমে গেল। বিশেষ কথা বলার প্রস্তুতি হিসেবে গলায় একটা উম…শব্দ করে বললেন, “হ্যাঁ,সফল আমি হয়েছিলাম। কিন্তু এখন আর সেই অর্থে সফল না। রাজনীতি আর ব্যবসার পুরোনো সেই জৌলুস এখন নেই আর। পরপর কয়েকবার কাছের বন্ধুদের প্রতারণার শিকার হয়ে ব্যবসাটা তুলনামূলকভাবে পড়ে গেছে। আর রাজনীতির বর্তমান অবস্থার কথাওতো জানো নিশ্চয়। বাম রাজনীতি সারা বিশ্বে কখনোই শান্তিপূর্ণ ছিল না। আমাদের দেশে তো নয়–ই। যদিও আমাদের দেশে সেই অর্থে বাম রাজনৈতিক দল নেই, তবুও প্রকারান্তরে বাম মতাদর্শেইতো বিশ্বাস করি। তাই আমিও শান্তিতে ছিলাম না একসময়। পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে, জেল খেটেছি। জেলের ভিতর অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করেছি। তোমার বর্তমান দিনকাল, সংসার, বর, সন্তানাদির খবর বলো এবার।”
মেহেরুনের কোনো আপত্তি আমলে না নিয়ে তুহিন মেহেরুনকে নিয়ে এসেছেন নিজ বাড়িতে। মেহেরুনের সব খবর জানতে চেয়েও আপন মনেই আবার বলতে শুরু করেন, “কতোদিন পর দেখা হলো আমাদের বলো তো! চোখের পলকে কেটে গেছে গুনে গুনে বত্রিশটা বছর। ভাবা যায়!”
“হ্যাঁ, কবে, কোথা দিয়ে যে এতো বছর কেটে গেল বুঝতেই পারিনি। তা তোমার বৌ কোথায়?”
“ওরা গ্ৰামের বাড়িতে আছে। দুদিন বেড়িয়ে তবে আসবে। গ্রামের বাড়িতে একটা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছি। প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে কলেজেরই একটা অনুষ্ঠান ছিল। সেখান থেকেই ফিরছি। পথে তোমাকে দেখে থামলাম।
“তোমার সাথে দেখা হয়ে ভালোই হলো। অনেক দিন ধরে একটা অপরাধবোধে ভুগছিলাম। আজকের এই হঠাৎ দেখা হবার সুযোগে সেটা থেকে আমি মুক্তি পেতে চাই। এজন্যই তোমাকে মনে মনে খুঁজছিলাম। হয়তো তোমার গ্ৰামের বাড়িতে গেলে তোমার ফোন নম্বর পেতে পারতাম, কিন্তু কেন যেন মন তাতেও সায় দিচ্ছিল না।”
“কেন আমার ফোন নম্বর ছিল না তোমার কাছে? দু’বছর আগে সবশেষ আমি তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তুমি শ্বশুর বাড়িতে ছিলে। খালাম্মার কাছে আমার ফোন নম্বর দিয়ে এসেছিলাম। খালাম্মা বলেননি তোমাকে?”
“বলেছিলেন। কিন্তু আমি মা’র কাছে থেকে নিতে চাইনি। তোমার ছেলে মেয়ে কয়জন? কতো বড় হয়েছে তারা?”
“আমার একটাই মেয়ে। ট্যুরিজম নিয়ে পড়ছে। ঢাকায় আমার ছোট ভাইয়ের বাসায় থাকে। কি যেন বলতে চাইছিলে?”
“ইদানিং স্মৃতিকাতরতা খুব পোড়ায় আমাকে। পুরোনো সময়ে বড্ড ফিরে যেতে মন চায়। ছেড়ে আসা প্রিয় মানুষদের খুব দেখতে ইচ্ছে করে।”
“সবার জন্য মন কেমন করলে সেটা তো ভিন্নরকম। বিশেষ কারো জন্য নয়তো আর!”
“তোমাকে বিশেষ মনে করেই খুঁজছিলাম। সত্যি বলতে, আমি তোমার সাথে ভীষণ অন্যায় করেছি। সেই কষ্ট থেকে তুমি বলেছিলে, আমি কোনদিন সুখী হব না। সংসারে আমি সুখী হলেও কোথায় যেন একটা গোপন কাঁটা রয়েছে যা আমাকে সারাক্ষণ খোঁচায়। পুরোপুরি সুখী আমি হতে পারিনি। আমি কি এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে পারি? তুমি কি তোমার সেই অভিশাপ তুলে নিবে আমার উপর থেকে? তাতে বাকি জীবনটায় হয়তো আমি সুখী হতে পারব।”
“ধ্যাৎ! কবে কি বলেছি ভুলে যাও। তাছাড়া এখন এই কথা তোলার কোনো দরকারই ছিল না মেহের। উচিতও হয়নি তোমার। তুমি তো আর প্রতারণা করোনি আমার সাথে। তোমাকে আমি আমার জীবনে চেয়েছিলাম। তুমি তা চাওনি। ব্যাস মিটে গেছে। এতে তোমার অপরাধ কোথায় মেহের? এতোদিন পর আমাদের দেখা হলো, আমার খুব ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে আমরা সেই আগের জীবনে ফিরে গেছি।”
এতোদিন পর তুহিনের মুখে নিজের সংক্ষিপ্ত নাম শুনে একই সাথে কষ্ট আর ভালো লাগলো। আগের মতোই আবদারের সুরে বলল, “তবুও বলো না, আমার দেওয়া কষ্টটা ভুলে গিয়ে অভিশাপটা তুলে নিবে।”
“শোন মেহের, মুরগি যখন জবাই করা হয় তখন ভীষণ ছটফটানি থাকলেও কিছুক্ষণ পরে আর তা থাকে না।তাই তোমার থেকে ফিরে যাবার পর যে অবর্ণনীয় তীব্র কষ্ট আমি পেয়েছি, এতদিনে আমারও সেই কষ্টটা নেই আর। আমার ভাগ্যে ছিল না তাই আমি পাইনি তোমাকে। তোমার কি খারাপ লাগছে এখন? আমার কিন্তু খুব ভালো লাগছে। তুহিন আগের মতোই মেপে মেপে কথা বললেও কিছুটা প্রগলভ মনে হলো মেহেরুনের। তুহিন মেহেরুনের থেকে কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবার বলেন, রিপন কেমন আছে?”
“হ্যাঁ,ও ভালো আছে।”– মৃদু স্বরে বলেন মেহেরুন।
“এই অবেলায় তুমি কোথা থেকে ফিরছিলে?
“আর বোলো না, ওর পেনশনের ফাইলটা কিছুতেই ঠিকঠাক করতে পারছি না। বারবার ব্যাংকে এসেও কাজ হচ্ছে না। আগামীকালও আসতে হবে।”
কপালে একটা বিরক্তির কুঞ্চন ফুটে উঠল তুহিনের। সেটা ধরে রেখেই বলেন, “এটা কোনো ব্যপারই না। তুমি সরকারি যে কোনো অফিসে যাবে, এমনটাই দেখতে পাবে। এদের মেনে নিয়েই পথ চলতে হবে। তা আগামীকাল কখন আসবে?”
“দেখি। তবে চেষ্টা থাকবে নয়টা সাড়ে নয়টায় আসার।”
“ভেবো না, আমার সহকারী মিজানকে বলে দিচ্ছি। ও দেখে নেবে সবটা।”
মেহেরুন তুহিনের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল শুধু। তুহিনও দৃষ্টি সরিয়ে নিল সামনের জানালায়। মেহেরুনের নামিয়ে নেয়া এই দৃষ্টিতে কৃতজ্ঞতা, অনুশোচনা নাকি বেদনা মিশে ছিল তার হদিস ওরা কেউই জানে না।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন