আলমগীর রেজা চৌধুরী
আয়নামহলের পাশ ঘেষে বংশাই নদী। পাহাড়ি নদী। কলকল জলের অনুরণন আছে। নিস্তরঙ্গ ধ্বনি তুলে এঁকেবেঁকে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে হারিয়ে গেছে। নদীর ওপারে প্রাচীন বটবৃক্ষ বিস্তৃত জায়গায় বোরকাপরা নববধূর মতো বসে আছে সবুজ মাথায় নিয়ে। ঝাঁক ঝাঁক টিয়ে, হরিয়ালসহ নানান রকম পাখিদের উৎসব চলছে তাকে ঘিরে। ওই গাছ যেন এ অঞ্চলের ঠিকানা। নদীর দু’পাশে গজারী, সেগুনসহ হরেক রকম বৃক্ষাদি সার সার দাঁড়িয়ে আছে। নদীর ওপর লোহার সাঁকো,ব্রিটিশদের তৈরি। এখনও অক্ষত আছে। আয়নামহল থেকে বেরিয়ে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সড়ক সীমানায় সাঁকোতে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, দিগন্ত জুড়ে ঘন নীলের মাতামাতি! এ পথটি থানার দিকে চলে গেছে পাহাড়ি পথ দিয়ে। পূর্ব দিকের রাস্তা বিল পেরিয়ে চলে গেছে গুপ্ত বৃন্দাবনের দিকে। বনভূমি অঞ্চল। উত্তরে পাল রাজাদের বেহুলা-লক্ষিন্দরের ইঁদারা। পূর্বে সাগরদীঘি, দক্ষিণে প্রাচীন গোবিন্দপুর শহর। পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে পানি বিলের দিকে গড়ায়। ধানি জমি খুব বেশি নেই। তারপরও যা কিছু ফলবান ভূমি তার মালিক আয়নামহল। এ এলাকার ডাকসাইটের ভূস্বামী জনাব কফিল শিকদার। ফরেস্ট কাঠের বিটের লটগুলোর বড় ক্রেতা। সজ্জন, বিদোৎসাহী জনহিতৈষী বলে খ্যাতি অর্জন করেছে। টাংগাইলের এসডিও মি. হেমিল্টন সাহেব ঘোড়া হাকিয়ে চলে আসে। শিকার, ভুরিভোজন আর উপঢৌকন নিয়ে ফিরে যায়।
একদিন কফিল শিকদার ‘চৌধুরী’ পদবী পেল খাস ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের পক্ষ থেকে। তাই আয়নামহল নিয়ে গল্প।
আয়নামহল মোঘল স্থাপত্যে নির্মিত। বায়ান্ন কুঠুরি বিশিষ্ট। সামনে পুকুর। পুকুরে জল টলমল। পুকুরের পর দিগন্ত জোড়া মাঠ। ধানি জমি। পাহাড় থেকে গড়িয়ে আসা পানির তোড়। পুকুরপাড়ে ইজিচেয়ারে বসে কফিল চৌধুরী গল্প বলে।
পূর্ব পুরুষ শাহ জামাল ওলীয়ে কামেল। পারস্য থেকে এসেছিলেন ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। উজ্জ্বল গাত্রবর্ণ, উন্নতনাসা, দীর্ঘকায় পুরুষ। বসতি গেড়েছিলেন জামালপুরে। ওই বংশেই জন্ম নেয় আমানুল্লাহ শিকদার। প্রথম দিকে ইসলামী শিক্ষাগ্রহণ করলেও পরবর্তীতে এদিকে থাকেনি। ভাগ্য অন্বেষণে চলে আসে প্রাচীন গোবিন্দপুর শহরে। আসলে শহর না। প্রবাদ আছে, ‘বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলি’ হলো না বিধায় ঢাকা শহর ঢাকাতে চলে গেছে। জনশ্রুতিই। তবে মোগল আমলে প্রশাসনিক কাঠামোর নজির আছে। প্রাচীন দীঘি, কোনও টিলার অন্তরালে ইট, পাথর, ইঁদারা বিদ্যমান। কালক্রমে গভীর বনভূমিতে পরিণত হয়েছে। বেশ কিছু আদিবাসী। যারা কৃষি নির্ভর জীবনযাপন করে। অল্প কিছু ঘর হিন্দু। বাকি সব মুসলমান জনগোষ্ঠী। আমানুল্লাহ শিকদার মুসলমান জনগোষ্ঠীর জুম্বা ঘরে মোয়াজ্জ্বিনের পেশা নিয়ে ভাগ্যের সন্ধানে ব্রত হন। এ বংশের সবাই উজ্জ্বল গাত্রবর্ণের সুপুরুষ। আমানুল্লাহ শিকদার খুব অল্প বয়সে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়। গোবিন্দপুর শহরের বাসিন্দা হয়ে যায়। আটিয়া পরগনার জমিদার করটিয়ার পন্নী পরিবার থেকে জমি পত্তনি নিয়ে গড়ে তোলে মাদ্রাসা।
আমানুল্লাহ শিকদার স্ত্রী তালেবুন্নেসাকে গভীর ভালবাসতেন। তার সব সাফল্যের সঙ্গে স্ত্রী তালেবুন্নেসাকে জড়িয়ে ফেলে। ধানি জমি কিনে। টুকটাক কাঠের ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে যায়। পাহাড় থেকে কাঠ নামাতে হলে বংশাইরপাড় বিষ্ণুপুর যেতে হতো। নৌকাতে রাত যাপন করতে হয়। আমানুল্লাহ শিকদার বিষ্ণুপুরে কিছু জমি কিনে চারচালা টিনের ঘর তোলে গোবিন্দপুর শহর থেকে বিষ্ণুপুরে ঢেরা বাঁধে। নতুন বাড়িতে আসার আগেই জন্ম নেয় কফিল চৌধুরী। এ বড় বাড়িতে হাপিয়ে ওঠে তালেবুন্নেসা। সবকিছু কেমন অপরিচিত। শুধু কফিল চৌধুরী তার একমাত্র সান্ত্বনা। আমানুল্লাহ শিকদারের সময় কোথায়। তার দুটো কাঠের লট যাবে ঢাকার সোয়ারীঘাট কাঠের আড়তে। তার আমজাম চলছে।
কফিল চৌধুরীর মুখেভাতের মধ্য দিয়ে তালেবুন্নেসা অনুভব করে, আরে বিষ্ণুপুর এ বাড়িটি আমার। গোবিন্দপুর শহর অনেক পর হয়ে গেছে। আমানুল্লাহ নামের সুপুরুষ মানুষটি আমার আত্মার সম্মান। তালেবুন্নেসার শিক্ষা নেই। পবিত্র কোরআনই সর্বশেষ শিক্ষা। একমাত্র পুত্র কফিলকে জড়িয়ে ধরে যে পৃথিবী তৈরি করে তা এ রকম, যখন আমানুল্লাহ দিবানিশি অর্থের পিছনে ছুটছেন, আর বছর বছর ধানি জমি কিনছেন। শণৈঃ শণৈঃ বাড়ছে তার গোলাঘরের কুঠুরী। নায়েব গোমেস্তাদের ব্যস্ততা বাড়তে থাকে। কফিল চৌধুরীর যখন চৌদ্দ বছর বয়স, তখন আমানুল্লাহ শিকদার মারা যান কলেরা আক্রান্ত হয়ে। নায়েব গোমেস্তা দিয়ে তালেবুন্নেসা একা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, জমিজমা রক্ষা করে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে। এ কারণে আয়নামহলের সব বাসিন্দারাই মনে করে অশিক্ষিত তালেবুন্নেসা অসাধারণ নারী। এ বংশের অত্যন্ত পূজনীয় নাম। হঠাৎ সম্পদ পেয়ে অপরিণত কফিল চৌধুরী বিগড়ে যায়নি। বরং পূর্বপুরুষের ভিটেয় গড়ে তোলে বিশাল ইমারত। এ এলাকার মানুষের বিস্ময় ‘আয়নামহল’।
আয়নামহল তৈরি করার পর ভূস্বামী কবির শিকদারের কন্যা হায়াতুন্নেসা বেগমকে বিয়ে করে ঘরে আনে কফিল চৌধুরী। হায়াতুন্নেসা মাঝারি উচ্চতার নারী। আঠারো বছরের কফিল চৌধুরী নিকট চৌদ্দের হায়াতুন্নেসা বেগমের সাদী মোবারক ওই সময় বেমানান নয়। তবে দীর্ঘকায় কফিল চৌধুরীর পাশাপাশি দাঁড়ালে অবাক হতে হয়। হ্যাঁ, হায়াতুন্নেসা প্রথম বধূ যে, ঝরোকায় মুখ লুকিয়ে কফিল চৌধুরীর সঙ্গে আয়নামহলের প্রধান ফটক দিয়ে এ বাড়িতে প্রবেশ করে। তখন হায়াতুন্নেসাকে মনে হয়েছিল বাদশাহ বেগম। যে কিনা আয়নামহলের চাবি হাতে নিতে আসছে। আর শাশুড়ি তালেবুন্নেসা! প্রথম দিনই আয়নামহলের চাবি হাতে দিয়ে বলে, ‘এটা তোমার স্বামীর সম্পদ। রক্ষা করবে।’
চৌদ্দ বছরের বালিকা হায়াতুন্নেসার এসব বোঝার বয়স নয়। কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে শাশুড়ির মুখের দিকে তাকায়। আর এ বছরই নতুন এক পরগনা পত্তনি নিয়ে কৃষি কাজ শুরু করে কফিল চৌধুরী। এ কাজ পরবর্তীতে আয়নামহলের বাসিন্দাদের ভিতকে শক্ত করেছে। কফিল চৌধুরী পিতার মতো স্ত্রীর ভাগ্যের প্রতি প্রসন্ন। আর হায়াতুন্নেসা শাশুড়ির মতো আয়নামহলকে আবিষ্কার করতে থাকে। অল্প সময়ের মধ্যে নায়েব গোমস্তা থেকে আরম্ভ করে সব কর্মচারীর মাঝে ‘বেগম সাহেবা’য় পরিণত হয়। স্বয়ং আয়নামহলের মালিক কফিল চৌধুরী বেগম সাহেবাকে সমীহ করতে থাকে।
মা তালেবুন্নেসা ছেলেকে বলে, ‘তুমি যেমন বাড়ির সম্রাট, তেমনি তোমার বউ এ বাড়ির সম্রাজ্ঞী। পরস্পরকে সম্মান করবে। তোমার বাবা আমাকে সম্মান করতেন।’ মা’র এ আদেশ যথার্থ পালন করে। হায়াতুন্নেসা বিশাল এই সম্পদের ঝামেলা থেকে কিছুটা মুক্ত রাখে কফিল চৌধুরীকে। কলকাতার ওয়াসেল মোল্লার দোকান থেকে মসলিন কিনে উপহার দিয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করে। সেই মসলিন পড়ে আয়নামহলের দীর্ঘ বারান্দা পেরিয়ে শাশুড়ির রুমে ঢুকতেই তিনি বলে, ‘আলহামদুল্লাহ, কফিলের জন্য আল্লাহ পাঠিয়েছেন।’ আবেগে কেঁদে ফেলে হায়াতুন্নেসা। চোখ দিয়ে জল গড়ায়।
তালেবুন্নেসা মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘বউ তোমার শ্বশুর একা ছিলেন, কফিল একা। আমার বংশ দরকার।’
না! কিছু বলেনি হায়াতুন্নেসা। পরপর পাঁচ পুত্র জন্ম দিয়ে আয়নামহলের বারান্দা কলকলিয়ে তোলে। আর এ সময় ইন্তেকাল করেন আয়নামহলের বটবৃক্ষ তালেবুন্নেসা। কিশোরী মাতার গর্ভে এতগুলো সন্তান জন্ম দিয়ে শাশুড়ির বাক্য পালন করেছে হায়াতুন্নেসা বেগম।
আয়নামহলের কুঠুরী কুঠুরীতে বিশেষ পরিচর্যায় বড় হতে থাকে সন্তানেরা। কফিল চৌধুরীকে মনে হয় একান্ত বাধ্য স্বামী। আর হায়াতুন্নেসা যে স্বামীকে মনে করেন দেবতা। বিদ্যাৎসাহী মা নির্দিষ্ট বয়সে এক একটি ছেলেকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেন লেখাপড়া শেখানোর জন্য। আয়নামহলের জৌলুসের বাতি আরো উজ্জ্বল হতে থাকে।
২
আয়নামহলের জৌলুস বৃদ্ধি পেলেও হায়াতুন্নেসার কাছে সব কিছুতেই শূন্যতা লেগে থাকে। ছেলেরা সব দূর দেশে থাকে। কফিল চৌধুরী একা সবকিছু সামলিয়ে নেয়। কোথাও কোনও ত্রুটিতে তিনি বিশ্বাস করে না। তার ধারণা, কর্ম মানুষকে আদমসুরতে পৌঁছুতে সাহায্য করবে। বড় ছেলে এ বছর ওকালতি পাস করে ফিরবে। ওর জন্য টাঙ্গাইল শহরে একটি বাড়ি কেনা হল। যাতে আমীর চৌধুরী টাঙ্গাইল বারে আইন ব্যবসা শুরু করতে পারে। এর মধ্যে অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেছে। কফিল চৌধুরী পাঁচ ছেলের শিক্ষা শুরুর পর থেকে প্রতিটি ধাঁপে উত্তীর্ণ হবার খবরে চারদিক থেকে দলে দলে লোকজন আসত। দেখে যেত চৌধুরী সাহেবের মেঝ ছেলে ইমরোজ চৌধুরী বিএ পাস দিয়েছে। তিন নম্বর ছেলে এলএমএফ ডাক্তার হয়ে ফেরার সময় হলো বলে। চতুর্থ ছেলে সালেহ চৌধুরী এন্ট্রাস পাস করার পর আর পড়তে চাইলো না। আয়নামহলের মালিবাড়ি, কালগাঁও খামারের জমিজমা তদারকিতে ব্যস্ত। ছোট ছেলে সিরাজ চৌধুরী প্রেসিডেন্সী কলেজের ইংরেজী সাহিত্য পড়ে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস লিখে। সওগাত, মোহাম্মদী, বুলবুল, রূপায়ন, কল্লোলসহ ওই সময়ের প্রসিদ্ধ কাগজগুলোতে তার লেখা ছাপা হয়। কলকাতার এক নামকরা প্রকাশনী থেকে তার একটি গ্রন্থ বেরিয়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম তাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। দু’জনের মধ্যে ভাব বিনিময় হয়। আর ওই সময় নজরুল তো ক্রেশ। সারা দেশ জুড়ে তোলপাড় করার ব্যাপার। কফিল চৌধুরী ছোট ছেলের এই গুণকে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ভাবতেন। তাই আয়নামহলে বঙ্গসাহিত্যের অনেক বড় বড় দিকপালের আগমন ঘটতে লাগল। ইব্রাহীম খাঁ, শাহাদাৎ হোসেন, মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিন, আবুল মনসুর আহমেদসহ আরো অনেক ব্যক্তিত্ব আয়নামহলের অতিথি হয়ে এসেছেন। তাছাড়াও অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্ট ফেডারেশনের সক্রিয় সদস্যসহ ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ করে দু’বার জেলও গিয়েছে। আবার কমরেড মুজাফফর আহম্মদের সঙ্গে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে দেখা যায়। দু’একবার থানা থেকে বড় দারোগা কবি সিরাজ চৌধুরী খোঁজ খবর নিতে আসে। পুলিশের অভিযোগ, সে সুভাষ বোসের গুপ্ত বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। কফিল চৌধুরী এসব নিয়ে ভাবে না। বৃদ্ধ বয়সে সন্তানদের যে কোনও সংবাদ বাবা মাকে উৎকণ্ঠিত করে। কফিল চৌধুরী ভাবে, সিরাজ সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে। ভারতবর্ষের সব মানুষ যখন স্বাধীনতা চাইছে। তখন সিরাজ চুপ থাকবে কেন? খুব ঠান্ডা মাথায় সব পরিস্থিতি সামাল দেয় কফিল চৌধুরী।
শুধু ছেলেকে বলল, ‘গ্রামে কোনও স্কুল নেই। শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।’ কেন যেন পিতার এ কথাটি সিরাজ চৌধুরীর পছন্দ হলো। কলকাতা থেকে ফিরে এসে শিক্ষা বিস্তারে জড়িয়ে গেলো। আর এ সময় মৃত্যু হয় কফিল চৌধুরীর। হঠাৎ মৃত্যু। মেজো ছেলে ইমরোজ চৌধুরী সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে আয়নামহলের দায়িত্বভার গ্রহণ করে। এতদিনে আয়নামহল জুড়ে এক এক করে নব বধূদের আগমন ঘটছে। দু’একজন করে বংশধর আসছে। বিশাল এ সম্পদের অধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয় কফিল চৌধুরীর মৃত্যুর তিন বছরের মাথায়। সম্পদের জন্য কোর্টে লড়াই চলে। কোর্ট পাঁচ ভাইয়ের অংশ ভাগ করে দেয়। সালেহ চৌধুরী কালগাঁও মৌজা দাবি করলে ভাইকে সামান্য অনুকম্পা না দেখিয়ে অধিকার নিয়ে সামন্ত প্রভূ সুলভ ঝগড়া চলতে থাকে। ভাগ হয়, আয়নামহলের কুঠুরী, পুকুর, জমিজমা, ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। শুধু একদিন মধ্য রাতে আর্তচিৎকারে আয়নামহলের সবাই জেগে ওঠে। সালেহ চৌধুরী খুন হয়েছে। কে বা কারা এ দুঃসাহসিক কর্মটি করেছে প্রায় পঞ্চাশ বছর যাবত আয়নামহলের বাসিন্দারা অনুসন্ধান করেও জানতে পারেনি। কী কারণে সালেহ চৌধুরী খুন হয়েছিলেন? মা হায়াতুন্নেসা ছেলের মর্মান্তিক সংবাদ জেনে যায়নি। তার কিছুদিন আগেই ইন্তেকাল করেছেন।
ইতোমধ্যে ইংরেজ চলে গেল। কবি সিরাজ চৌধুরীর স্বাধীনতা চলে আসে। নিজেকে গুটিয়ে আনে স্কুল আর কবিতার মধ্যে। আরে আয়নামহলের বংশধর তো সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। আমানুল্লাহ শিকদার আর কফিল চৌধুরীর গড়া বিশাল সম্পদ পাঁচ সন্তানের মধ্যে ভাগ করে নিয়েই এক একজন প্রভূত সম্পদের কান্ডারী।
নতুন পাকিস্তানের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে উকিল সাহেব চুয়ান্ন সালে মুসলিম লীগের প্রার্থী হয়েছিলেন। পৌরসভা চেয়ারম্যান, বার সমিতির সভাপতিসহ জনকল্যাণকর কর্মী হিসেবে খাজা নাজিমুদ্দীনের প্রিয়ভাজন। এ সুবাদে অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের আগমন ঘটে আয়নামহলে। বিদ্যাৎসাহী আয়নামহলের বাসিন্দাদের আভ্যন্তরীন জটিলতা থাকলেও মান-সম্মানের প্রতি ছিল সজাগ দৃষ্টি। তালেবুন্নেসা এবং হায়াতুন্নেসা বেগমের কঠোর নির্দেশ, এ বাড়ির আব্রু কেউ যেন নষ্ট না করে। অন্দরমহলে বাইরের লোকের প্রবেশ ছিল সীমিত। প্রয়োজনীয় চাকর-চাকরানী ব্যতীত। নায়েব, কেরানীরাও প্রধান ফটক পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে গৃহকর্ত্রীর অনুমতি লাগত। আমানুল্লাহ শিকদার থেকে ইমরোজ চৌধুরী পর্যন্ত পারিবারিক রীতিগুলোর ধারা অব্যাহত রেখেছিল। ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে যাবার পর ডাক্তার সাহেব সরকারি চাকরি নিয়ে দেশে দেশে ঘুরতে থাকে। দুই ছেলে দুই মেয়ে জন্ম দিয়ে এক সময় অবসরে চলে আসে। ততদিন ছেলেমেয়েরা অনেক বড় হয়ে গেছে। ডাক্তার সাহেব বিনা পয়সায় রোগী দেখে, আর আয়নামহলের টাকায় মানব কল্যাণে ব্যস্ত করে তোলে নিজেকে। আর এ কারণে তার সর্বজন প্রিয় একটি সুন্দর ইমেজ তৈরি হয়ে যায়। তার দু’ছেলে তখন কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করে। কন্যা রানু, আর মাজেদার বিয়ে হয়ে গেছে সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে। আয়নামহল এখন অনেক সদস্যের গোলজার চলছে। উকিল সাহেবের দু’ছেলে। একজন ব্যাংক অফিসার আর একজন জমিজমা দেখে। কফিল চৌধুরীর প্রথম বংশধর আইনজ্ঞ সন্তান পরিণত বয়সে ইন্তেকাল করেন। সালেহ চৌধুরী তিন ছেলে রেখে মারা যায়। ইমরোজ চৌধুরী সম্প্রতি হজব্রত পালন করে এসেছেন। সংসার কর্মে মন নেই। আল্লাহর রাস্তায় ফানাফিল্লাহ হবার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এক সন্তান সাহাব চৌধুরী ব্যবসা-বাণিজ্য, জমিজমা তদারকি করে। নারীদের তুলনায় আয়নামহলের বাসিন্দাদের মধ্যে পুরুষদের আয়ু বেশি। তাদের গড় আয়ু সত্তর বছর।
কবি সিরাজ চৌধুরী কনিষ্ঠ সন্তান। স্কুল, আর দুই সন্তান নিয়ে জগতকে আবিষ্কার করতে চায়। তার চাওয়া পাওয়ার সঙ্গে আয়নামহলের বাসিন্দাদের কোনও মিল নেই। একেবারে আলাদা। মহলের বাসিন্দাদের মধ্যে সবচেয়ে বঞ্চিত চরিত্র। যে শুধু কবিতা নামক অধরাকে খুঁজে খুঁজে একসময় নিজকে আর অসহায় ভাবেনি। এখন তার মনে হয়, প্রকৃতির সন্তান হিসেবে এইটুকু অধিকার নিয়ে পৃথিবীতে আগমন ঘটেছিল। আর কিছু নয়। বিভ্রমকে নয়, সত্যকে আবিষ্কার করতে হয়। দু’ছেলে সন্তান নিয়ে তার আশ্চার্য সুন্দর পৃথিবী।
৩
বিরাট আয়নামহলের কুঠুরীগুলো খালি হতে থাকে। উকিল সাহেব ইন্তেকাল করেছেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র আসাদ জমিজমা, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে থাকে। বউ-ছেলে ফেলে রাখে টাঙ্গাইল শহরে। ছোট ছেলে মাসুদ ঈশ্বরদীতে হাবিব ব্যাংকে চাকরি করে। বিয়ে করেনি। চাকরি আর পড়াশোনা নিয়ে আস্তে আস্তে আয়নামহল খালি হতে থাকে। ডাক্তার সাহেবের ছোট ছেলে রাজনীতিতে জড়িয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে পড়াশোনা শেষ করেছে। ঊনসত্তরের ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। শেখ মুজিবের সঙ্গে বত্রিশ নম্বরে প্রচুর মিটিং করেছে। আচরণে বুলবুল চৌধুরী সঙ্গে আয়নামহলের কারো মিল খায় না। অতিশয় ধার্মিক মানুষ। ছেলেবেলা থেকে সত্যের পক্ষে। সৎ, শান্ত চরিত্রে নিয়ে সর্বজনে আলাদা ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়েছে। এসময় একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। স্বাধীনতা সমর্থক হিসেবে বুলবুল চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অস্ত্র ধরে। আর তার কারণে পাকবাহিনীর নির্মম ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয় আয়নামহল। আয়নামহলের দালান ব্যতীত সবকিছু লুণ্ঠিত এবং আগুন দিয়ে পোড়ানো হয়। এ সময়টা আয়নামহল ছিল সত্যিকার প্রেতপুরী। দীর্ঘকাল মহলের বাসিন্দারা ছিল সরব। যুদ্ধের দিনগুলোতে সদস্যরা উদ্বাস্তুর মতো বন-জঙ্গলসহ সারা দেশে পালিয়ে বেড়াতে থাকে। ভয়ার্ত ওই সময় বুলবুল চৌধুীর মতো সবাই স্বাধীনতা চেয়েছিল। প্রতিটি জীবনকে তুচ্ছ মনে করেছে। বংশাই নদীর জল নয়মাস গড়ায়। একদিন ভোরবেলা। সূর্য ওঠেনি। উত্তরে বাদলি গ্রামের দিকে সহস্র মানুষের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ‘জয় বাংলা’।
তার তিনদিন পর পিছনে স্টেনগান ঝুলিয়ে মাথায় সৈনিকের ক্যাপ হাকিয়ে বিষ্ণুপুরে ফিরে এলো বীর মুক্তিযোদ্ধা বুলবুল চৌধুরী। আয়নামহলের বাসিন্দা। বুলবুল চৌধুরী আমৃত্যু রাজনীতিতে অনড় ছিলো। উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছিলেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর আয়নামহলের বাসিন্দা ক্রমাগত কমতে থাকে। কফিল চৌধুরীর পাঁচ সন্তানের বংশধরদের সংখ্যা এখন চল্লিশ অতিক্রম করেছে। কিন্তু কেউ মহলে থাকে না। ইতোমধ্যে ডাক্তার সাহেব, সিরাজ চৌধুরী ইন্তেকাল করেন। দু’ছেলে ঢাকায় থাকে। বড়জন বিএ পাস। চাকরি করে ইউনিয়ন ব্যাংকে। ছোট ছেলে জেনিটিক দিয়ে পিতার জিন পেয়েছে। কবিতা লিখে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য পড়ে। না কেউ আয়নামহলে ফেরে না। আস্তে আস্তে আয়নামহলের সর্বশেষ প্রবীণ সদস্যের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শুরু হয় আমানুল্লাহ শিকদারের বংশ নির্ঘন্ট। তৃতীয় পুরুষ শেষ। চতুর্থ পুরুষ শুরু হয়েছে। না কেউ আয়না মহলে বসবাস করে না। সব দিক দিয়ে আয়নামহল প্রতিটি ক্ষেত্রে আরো পলিশ হয়েছে। ঝকঝকে তকতকে এনশিয়েন্ট বাড়িটি কেয়ারটেকারের অধীনে থাকে। বাসিন্দাদের নাগরিক সুবিধা অনেক। বৈদ্যুতিক আলোর ঝলকানিতে আগের চেয়ে আরো বেশি খোলতাই। পূর্বপুরুষরা যেখানে ঘোড়ার আস্তাবল করেছিল, সেখানে গাড়ির গ্যারেজ হয়েছে। উত্তরপুরুষরা এখন গাড়িতে চলাচল করে। শুধু প্রাচীন ইঁদারা বন্ধ হয়ে গেছে। পাম্পের পানি রুমে রুমে পৌঁছে যায়। বাড়ির পিছনে সার সার পায়খানা বন্ধ হয়ে গেছে। এ যুগে ওই পায়খানার জন্য গৃহকর্তাকে আইনের মুখোমুখি হতে হতো। পুকুরের জল টলমল। পুকুর পারে পূর্ব পুরুষদের গোরস্থানটি এ বাড়ির প্রাচীনতা প্রকাশ করে। আয়নামহলের বাসিন্দারা মহলে বসবাস করে না। দল বেঁধে আসে, হইচই করে, আবার ফিরে যায়। আয়নামহলের বাসিন্দারা দেশ থেকে দেশান্তরিত হতে থাকে। তালেবুন্নেসার এ বিশাল উত্তর পুরুষদের একজন অরিন্দম খালিদ দশ বছর পর মিলান থেকে ফিরে ওর বউকে লেখেন –
প্রিয় রোজ,
বিবাহিত জীবনের এক দশক কাটল। মিলান থেকে এখানে আসা হয়নি। অথবা তোমাকেই বিষ্ণুপুরের আয়না মহলে নিয়ে আসা হয়নি। সে অভিযোগ আয়নামহলের বধূ হিসেবে করতে পারো। সে অধিকার তোমার রয়েছে।
প্রিয় রোজ আমার। আয়নামহল কোনো এনশিয়েন্ট দুর্গ না, যেখানে জড়িয়ে আছে মানুষের ক্রন্দন কাহিনী। আয়নামহল যেন তার উল্টো। আমানুল্লাহ শিকদারের বংশ ঠিকুজির মাঝে জড়িয়ে আছে বংশ পরম্পরায় শ্রম, মমতা, শিক্ষা, মানবপ্রেম। আয়নামহলের প্রতিটি বাসিন্দা ভিন্নতর জীবনকে আবিষ্কার করতে চেয়েছে। তুমিও আয়নামহলের বাসিন্দাদের একজন। হায়াতুন্নেসার মতো তুমিও আয়নামহলের বধূ। তোমার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তুমি চলে আসতে পারো। পারিবারিক কবরখানায় পূর্ব পুরুষদের জন্য প্রার্থনা করতে পারো।
তোমার সঙ্গে আমার অমিল আছে। খাদ্যাভ্যাস থেকে আরম্ভ করে অন্তর্গত কথোপকথনে। শুধু এক জায়গায় মিল। আমি তোমাকে ভালোবাসি। এ কারণে বিগত দশ বছর এক জীবন কাটিয়ে দিলাম। তোমার গর্ভে জন্ম নিয়েছে দুটো স্বপ্নের কিশোর-কিশোরী। আর ওরাও আয়নামহলের বাসিন্দা। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আগামী সামারটা আমরা আয়নামহলে কাটাবো। ইয়াফি আর লাবণ্য আয়নামহলের প্রশস্ত লনে ছোটাছুটি করবে। বুনো ঘাস মাড়িয়ে একটি শৈশব নির্মাণ করবে।
রূপবতী রোজ, আয়নামহলের বধূরা নিয়তিসিদ্ধ সুন্দরী, তুমিও তাই। শিগগির চলে আসো। কতোদিন হইচই। একটা জীবনকে নতুন করে দেখা। তারপর আমরা ফিরে যাবো মিলানে। হিথরো বিমান বন্দরে নেমে যাবো আমি আর ইয়াফি। ইয়াফিকে আমি লন্ডন মিউজিয়াম দেখাতে চেয়েছিলাম। তুমি লাবণ্যকে নিয়ে মিলানে যাবে। পাঁচদিন লন্ডন থেকে আবার ফিরে যাবো মিলানে। ইয়াফিকে দ্বিতীয় সিজনের জন্য তৈরি করতে হবে।
তুমি আসছো। আয়নামহল তোমার জন্য প্রতিক্ষা করছে। অপেক্ষা করছে নদী বংশাই। অপেক্ষা করছে শতাব্দীব্যাপী এক মানবিক উপাখ্যান।
একদিন কফিল শিকদার ‘চৌধুরী’ পদবী পেল খাস ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের পক্ষ থেকে। তাই আয়নামহল নিয়ে গল্প।
আয়নামহল মোঘল স্থাপত্যে নির্মিত। বায়ান্ন কুঠুরি বিশিষ্ট। সামনে পুকুর। পুকুরে জল টলমল। পুকুরের পর দিগন্ত জোড়া মাঠ। ধানি জমি। পাহাড় থেকে গড়িয়ে আসা পানির তোড়। পুকুরপাড়ে ইজিচেয়ারে বসে কফিল চৌধুরী গল্প বলে।
পূর্ব পুরুষ শাহ জামাল ওলীয়ে কামেল। পারস্য থেকে এসেছিলেন ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। উজ্জ্বল গাত্রবর্ণ, উন্নতনাসা, দীর্ঘকায় পুরুষ। বসতি গেড়েছিলেন জামালপুরে। ওই বংশেই জন্ম নেয় আমানুল্লাহ শিকদার। প্রথম দিকে ইসলামী শিক্ষাগ্রহণ করলেও পরবর্তীতে এদিকে থাকেনি। ভাগ্য অন্বেষণে চলে আসে প্রাচীন গোবিন্দপুর শহরে। আসলে শহর না। প্রবাদ আছে, ‘বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলি’ হলো না বিধায় ঢাকা শহর ঢাকাতে চলে গেছে। জনশ্রুতিই। তবে মোগল আমলে প্রশাসনিক কাঠামোর নজির আছে। প্রাচীন দীঘি, কোনও টিলার অন্তরালে ইট, পাথর, ইঁদারা বিদ্যমান। কালক্রমে গভীর বনভূমিতে পরিণত হয়েছে। বেশ কিছু আদিবাসী। যারা কৃষি নির্ভর জীবনযাপন করে। অল্প কিছু ঘর হিন্দু। বাকি সব মুসলমান জনগোষ্ঠী। আমানুল্লাহ শিকদার মুসলমান জনগোষ্ঠীর জুম্বা ঘরে মোয়াজ্জ্বিনের পেশা নিয়ে ভাগ্যের সন্ধানে ব্রত হন। এ বংশের সবাই উজ্জ্বল গাত্রবর্ণের সুপুরুষ। আমানুল্লাহ শিকদার খুব অল্প বয়সে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়। গোবিন্দপুর শহরের বাসিন্দা হয়ে যায়। আটিয়া পরগনার জমিদার করটিয়ার পন্নী পরিবার থেকে জমি পত্তনি নিয়ে গড়ে তোলে মাদ্রাসা।
আমানুল্লাহ শিকদার স্ত্রী তালেবুন্নেসাকে গভীর ভালবাসতেন। তার সব সাফল্যের সঙ্গে স্ত্রী তালেবুন্নেসাকে জড়িয়ে ফেলে। ধানি জমি কিনে। টুকটাক কাঠের ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে যায়। পাহাড় থেকে কাঠ নামাতে হলে বংশাইরপাড় বিষ্ণুপুর যেতে হতো। নৌকাতে রাত যাপন করতে হয়। আমানুল্লাহ শিকদার বিষ্ণুপুরে কিছু জমি কিনে চারচালা টিনের ঘর তোলে গোবিন্দপুর শহর থেকে বিষ্ণুপুরে ঢেরা বাঁধে। নতুন বাড়িতে আসার আগেই জন্ম নেয় কফিল চৌধুরী। এ বড় বাড়িতে হাপিয়ে ওঠে তালেবুন্নেসা। সবকিছু কেমন অপরিচিত। শুধু কফিল চৌধুরী তার একমাত্র সান্ত্বনা। আমানুল্লাহ শিকদারের সময় কোথায়। তার দুটো কাঠের লট যাবে ঢাকার সোয়ারীঘাট কাঠের আড়তে। তার আমজাম চলছে।
কফিল চৌধুরীর মুখেভাতের মধ্য দিয়ে তালেবুন্নেসা অনুভব করে, আরে বিষ্ণুপুর এ বাড়িটি আমার। গোবিন্দপুর শহর অনেক পর হয়ে গেছে। আমানুল্লাহ নামের সুপুরুষ মানুষটি আমার আত্মার সম্মান। তালেবুন্নেসার শিক্ষা নেই। পবিত্র কোরআনই সর্বশেষ শিক্ষা। একমাত্র পুত্র কফিলকে জড়িয়ে ধরে যে পৃথিবী তৈরি করে তা এ রকম, যখন আমানুল্লাহ দিবানিশি অর্থের পিছনে ছুটছেন, আর বছর বছর ধানি জমি কিনছেন। শণৈঃ শণৈঃ বাড়ছে তার গোলাঘরের কুঠুরী। নায়েব গোমেস্তাদের ব্যস্ততা বাড়তে থাকে। কফিল চৌধুরীর যখন চৌদ্দ বছর বয়স, তখন আমানুল্লাহ শিকদার মারা যান কলেরা আক্রান্ত হয়ে। নায়েব গোমেস্তা দিয়ে তালেবুন্নেসা একা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, জমিজমা রক্ষা করে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে। এ কারণে আয়নামহলের সব বাসিন্দারাই মনে করে অশিক্ষিত তালেবুন্নেসা অসাধারণ নারী। এ বংশের অত্যন্ত পূজনীয় নাম। হঠাৎ সম্পদ পেয়ে অপরিণত কফিল চৌধুরী বিগড়ে যায়নি। বরং পূর্বপুরুষের ভিটেয় গড়ে তোলে বিশাল ইমারত। এ এলাকার মানুষের বিস্ময় ‘আয়নামহল’।
আয়নামহল তৈরি করার পর ভূস্বামী কবির শিকদারের কন্যা হায়াতুন্নেসা বেগমকে বিয়ে করে ঘরে আনে কফিল চৌধুরী। হায়াতুন্নেসা মাঝারি উচ্চতার নারী। আঠারো বছরের কফিল চৌধুরী নিকট চৌদ্দের হায়াতুন্নেসা বেগমের সাদী মোবারক ওই সময় বেমানান নয়। তবে দীর্ঘকায় কফিল চৌধুরীর পাশাপাশি দাঁড়ালে অবাক হতে হয়। হ্যাঁ, হায়াতুন্নেসা প্রথম বধূ যে, ঝরোকায় মুখ লুকিয়ে কফিল চৌধুরীর সঙ্গে আয়নামহলের প্রধান ফটক দিয়ে এ বাড়িতে প্রবেশ করে। তখন হায়াতুন্নেসাকে মনে হয়েছিল বাদশাহ বেগম। যে কিনা আয়নামহলের চাবি হাতে নিতে আসছে। আর শাশুড়ি তালেবুন্নেসা! প্রথম দিনই আয়নামহলের চাবি হাতে দিয়ে বলে, ‘এটা তোমার স্বামীর সম্পদ। রক্ষা করবে।’
চৌদ্দ বছরের বালিকা হায়াতুন্নেসার এসব বোঝার বয়স নয়। কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে শাশুড়ির মুখের দিকে তাকায়। আর এ বছরই নতুন এক পরগনা পত্তনি নিয়ে কৃষি কাজ শুরু করে কফিল চৌধুরী। এ কাজ পরবর্তীতে আয়নামহলের বাসিন্দাদের ভিতকে শক্ত করেছে। কফিল চৌধুরী পিতার মতো স্ত্রীর ভাগ্যের প্রতি প্রসন্ন। আর হায়াতুন্নেসা শাশুড়ির মতো আয়নামহলকে আবিষ্কার করতে থাকে। অল্প সময়ের মধ্যে নায়েব গোমস্তা থেকে আরম্ভ করে সব কর্মচারীর মাঝে ‘বেগম সাহেবা’য় পরিণত হয়। স্বয়ং আয়নামহলের মালিক কফিল চৌধুরী বেগম সাহেবাকে সমীহ করতে থাকে।
মা তালেবুন্নেসা ছেলেকে বলে, ‘তুমি যেমন বাড়ির সম্রাট, তেমনি তোমার বউ এ বাড়ির সম্রাজ্ঞী। পরস্পরকে সম্মান করবে। তোমার বাবা আমাকে সম্মান করতেন।’ মা’র এ আদেশ যথার্থ পালন করে। হায়াতুন্নেসা বিশাল এই সম্পদের ঝামেলা থেকে কিছুটা মুক্ত রাখে কফিল চৌধুরীকে। কলকাতার ওয়াসেল মোল্লার দোকান থেকে মসলিন কিনে উপহার দিয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করে। সেই মসলিন পড়ে আয়নামহলের দীর্ঘ বারান্দা পেরিয়ে শাশুড়ির রুমে ঢুকতেই তিনি বলে, ‘আলহামদুল্লাহ, কফিলের জন্য আল্লাহ পাঠিয়েছেন।’ আবেগে কেঁদে ফেলে হায়াতুন্নেসা। চোখ দিয়ে জল গড়ায়।
তালেবুন্নেসা মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘বউ তোমার শ্বশুর একা ছিলেন, কফিল একা। আমার বংশ দরকার।’
না! কিছু বলেনি হায়াতুন্নেসা। পরপর পাঁচ পুত্র জন্ম দিয়ে আয়নামহলের বারান্দা কলকলিয়ে তোলে। আর এ সময় ইন্তেকাল করেন আয়নামহলের বটবৃক্ষ তালেবুন্নেসা। কিশোরী মাতার গর্ভে এতগুলো সন্তান জন্ম দিয়ে শাশুড়ির বাক্য পালন করেছে হায়াতুন্নেসা বেগম।
আয়নামহলের কুঠুরী কুঠুরীতে বিশেষ পরিচর্যায় বড় হতে থাকে সন্তানেরা। কফিল চৌধুরীকে মনে হয় একান্ত বাধ্য স্বামী। আর হায়াতুন্নেসা যে স্বামীকে মনে করেন দেবতা। বিদ্যাৎসাহী মা নির্দিষ্ট বয়সে এক একটি ছেলেকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেন লেখাপড়া শেখানোর জন্য। আয়নামহলের জৌলুসের বাতি আরো উজ্জ্বল হতে থাকে।
আয়নামহলের জৌলুস বৃদ্ধি পেলেও হায়াতুন্নেসার কাছে সব কিছুতেই শূন্যতা লেগে থাকে। ছেলেরা সব দূর দেশে থাকে। কফিল চৌধুরী একা সবকিছু সামলিয়ে নেয়। কোথাও কোনও ত্রুটিতে তিনি বিশ্বাস করে না। তার ধারণা, কর্ম মানুষকে আদমসুরতে পৌঁছুতে সাহায্য করবে। বড় ছেলে এ বছর ওকালতি পাস করে ফিরবে। ওর জন্য টাঙ্গাইল শহরে একটি বাড়ি কেনা হল। যাতে আমীর চৌধুরী টাঙ্গাইল বারে আইন ব্যবসা শুরু করতে পারে। এর মধ্যে অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেছে। কফিল চৌধুরী পাঁচ ছেলের শিক্ষা শুরুর পর থেকে প্রতিটি ধাঁপে উত্তীর্ণ হবার খবরে চারদিক থেকে দলে দলে লোকজন আসত। দেখে যেত চৌধুরী সাহেবের মেঝ ছেলে ইমরোজ চৌধুরী বিএ পাস দিয়েছে। তিন নম্বর ছেলে এলএমএফ ডাক্তার হয়ে ফেরার সময় হলো বলে। চতুর্থ ছেলে সালেহ চৌধুরী এন্ট্রাস পাস করার পর আর পড়তে চাইলো না। আয়নামহলের মালিবাড়ি, কালগাঁও খামারের জমিজমা তদারকিতে ব্যস্ত। ছোট ছেলে সিরাজ চৌধুরী প্রেসিডেন্সী কলেজের ইংরেজী সাহিত্য পড়ে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস লিখে। সওগাত, মোহাম্মদী, বুলবুল, রূপায়ন, কল্লোলসহ ওই সময়ের প্রসিদ্ধ কাগজগুলোতে তার লেখা ছাপা হয়। কলকাতার এক নামকরা প্রকাশনী থেকে তার একটি গ্রন্থ বেরিয়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম তাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। দু’জনের মধ্যে ভাব বিনিময় হয়। আর ওই সময় নজরুল তো ক্রেশ। সারা দেশ জুড়ে তোলপাড় করার ব্যাপার। কফিল চৌধুরী ছোট ছেলের এই গুণকে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ভাবতেন। তাই আয়নামহলে বঙ্গসাহিত্যের অনেক বড় বড় দিকপালের আগমন ঘটতে লাগল। ইব্রাহীম খাঁ, শাহাদাৎ হোসেন, মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিন, আবুল মনসুর আহমেদসহ আরো অনেক ব্যক্তিত্ব আয়নামহলের অতিথি হয়ে এসেছেন। তাছাড়াও অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্ট ফেডারেশনের সক্রিয় সদস্যসহ ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ করে দু’বার জেলও গিয়েছে। আবার কমরেড মুজাফফর আহম্মদের সঙ্গে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে দেখা যায়। দু’একবার থানা থেকে বড় দারোগা কবি সিরাজ চৌধুরী খোঁজ খবর নিতে আসে। পুলিশের অভিযোগ, সে সুভাষ বোসের গুপ্ত বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। কফিল চৌধুরী এসব নিয়ে ভাবে না। বৃদ্ধ বয়সে সন্তানদের যে কোনও সংবাদ বাবা মাকে উৎকণ্ঠিত করে। কফিল চৌধুরী ভাবে, সিরাজ সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে। ভারতবর্ষের সব মানুষ যখন স্বাধীনতা চাইছে। তখন সিরাজ চুপ থাকবে কেন? খুব ঠান্ডা মাথায় সব পরিস্থিতি সামাল দেয় কফিল চৌধুরী।
শুধু ছেলেকে বলল, ‘গ্রামে কোনও স্কুল নেই। শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।’ কেন যেন পিতার এ কথাটি সিরাজ চৌধুরীর পছন্দ হলো। কলকাতা থেকে ফিরে এসে শিক্ষা বিস্তারে জড়িয়ে গেলো। আর এ সময় মৃত্যু হয় কফিল চৌধুরীর। হঠাৎ মৃত্যু। মেজো ছেলে ইমরোজ চৌধুরী সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে আয়নামহলের দায়িত্বভার গ্রহণ করে। এতদিনে আয়নামহল জুড়ে এক এক করে নব বধূদের আগমন ঘটছে। দু’একজন করে বংশধর আসছে। বিশাল এ সম্পদের অধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয় কফিল চৌধুরীর মৃত্যুর তিন বছরের মাথায়। সম্পদের জন্য কোর্টে লড়াই চলে। কোর্ট পাঁচ ভাইয়ের অংশ ভাগ করে দেয়। সালেহ চৌধুরী কালগাঁও মৌজা দাবি করলে ভাইকে সামান্য অনুকম্পা না দেখিয়ে অধিকার নিয়ে সামন্ত প্রভূ সুলভ ঝগড়া চলতে থাকে। ভাগ হয়, আয়নামহলের কুঠুরী, পুকুর, জমিজমা, ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। শুধু একদিন মধ্য রাতে আর্তচিৎকারে আয়নামহলের সবাই জেগে ওঠে। সালেহ চৌধুরী খুন হয়েছে। কে বা কারা এ দুঃসাহসিক কর্মটি করেছে প্রায় পঞ্চাশ বছর যাবত আয়নামহলের বাসিন্দারা অনুসন্ধান করেও জানতে পারেনি। কী কারণে সালেহ চৌধুরী খুন হয়েছিলেন? মা হায়াতুন্নেসা ছেলের মর্মান্তিক সংবাদ জেনে যায়নি। তার কিছুদিন আগেই ইন্তেকাল করেছেন।
ইতোমধ্যে ইংরেজ চলে গেল। কবি সিরাজ চৌধুরীর স্বাধীনতা চলে আসে। নিজেকে গুটিয়ে আনে স্কুল আর কবিতার মধ্যে। আরে আয়নামহলের বংশধর তো সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। আমানুল্লাহ শিকদার আর কফিল চৌধুরীর গড়া বিশাল সম্পদ পাঁচ সন্তানের মধ্যে ভাগ করে নিয়েই এক একজন প্রভূত সম্পদের কান্ডারী।
নতুন পাকিস্তানের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে উকিল সাহেব চুয়ান্ন সালে মুসলিম লীগের প্রার্থী হয়েছিলেন। পৌরসভা চেয়ারম্যান, বার সমিতির সভাপতিসহ জনকল্যাণকর কর্মী হিসেবে খাজা নাজিমুদ্দীনের প্রিয়ভাজন। এ সুবাদে অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের আগমন ঘটে আয়নামহলে। বিদ্যাৎসাহী আয়নামহলের বাসিন্দাদের আভ্যন্তরীন জটিলতা থাকলেও মান-সম্মানের প্রতি ছিল সজাগ দৃষ্টি। তালেবুন্নেসা এবং হায়াতুন্নেসা বেগমের কঠোর নির্দেশ, এ বাড়ির আব্রু কেউ যেন নষ্ট না করে। অন্দরমহলে বাইরের লোকের প্রবেশ ছিল সীমিত। প্রয়োজনীয় চাকর-চাকরানী ব্যতীত। নায়েব, কেরানীরাও প্রধান ফটক পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে গৃহকর্ত্রীর অনুমতি লাগত। আমানুল্লাহ শিকদার থেকে ইমরোজ চৌধুরী পর্যন্ত পারিবারিক রীতিগুলোর ধারা অব্যাহত রেখেছিল। ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে যাবার পর ডাক্তার সাহেব সরকারি চাকরি নিয়ে দেশে দেশে ঘুরতে থাকে। দুই ছেলে দুই মেয়ে জন্ম দিয়ে এক সময় অবসরে চলে আসে। ততদিন ছেলেমেয়েরা অনেক বড় হয়ে গেছে। ডাক্তার সাহেব বিনা পয়সায় রোগী দেখে, আর আয়নামহলের টাকায় মানব কল্যাণে ব্যস্ত করে তোলে নিজেকে। আর এ কারণে তার সর্বজন প্রিয় একটি সুন্দর ইমেজ তৈরি হয়ে যায়। তার দু’ছেলে তখন কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করে। কন্যা রানু, আর মাজেদার বিয়ে হয়ে গেছে সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে। আয়নামহল এখন অনেক সদস্যের গোলজার চলছে। উকিল সাহেবের দু’ছেলে। একজন ব্যাংক অফিসার আর একজন জমিজমা দেখে। কফিল চৌধুরীর প্রথম বংশধর আইনজ্ঞ সন্তান পরিণত বয়সে ইন্তেকাল করেন। সালেহ চৌধুরী তিন ছেলে রেখে মারা যায়। ইমরোজ চৌধুরী সম্প্রতি হজব্রত পালন করে এসেছেন। সংসার কর্মে মন নেই। আল্লাহর রাস্তায় ফানাফিল্লাহ হবার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এক সন্তান সাহাব চৌধুরী ব্যবসা-বাণিজ্য, জমিজমা তদারকি করে। নারীদের তুলনায় আয়নামহলের বাসিন্দাদের মধ্যে পুরুষদের আয়ু বেশি। তাদের গড় আয়ু সত্তর বছর।
কবি সিরাজ চৌধুরী কনিষ্ঠ সন্তান। স্কুল, আর দুই সন্তান নিয়ে জগতকে আবিষ্কার করতে চায়। তার চাওয়া পাওয়ার সঙ্গে আয়নামহলের বাসিন্দাদের কোনও মিল নেই। একেবারে আলাদা। মহলের বাসিন্দাদের মধ্যে সবচেয়ে বঞ্চিত চরিত্র। যে শুধু কবিতা নামক অধরাকে খুঁজে খুঁজে একসময় নিজকে আর অসহায় ভাবেনি। এখন তার মনে হয়, প্রকৃতির সন্তান হিসেবে এইটুকু অধিকার নিয়ে পৃথিবীতে আগমন ঘটেছিল। আর কিছু নয়। বিভ্রমকে নয়, সত্যকে আবিষ্কার করতে হয়। দু’ছেলে সন্তান নিয়ে তার আশ্চার্য সুন্দর পৃথিবী।
বিরাট আয়নামহলের কুঠুরীগুলো খালি হতে থাকে। উকিল সাহেব ইন্তেকাল করেছেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র আসাদ জমিজমা, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে থাকে। বউ-ছেলে ফেলে রাখে টাঙ্গাইল শহরে। ছোট ছেলে মাসুদ ঈশ্বরদীতে হাবিব ব্যাংকে চাকরি করে। বিয়ে করেনি। চাকরি আর পড়াশোনা নিয়ে আস্তে আস্তে আয়নামহল খালি হতে থাকে। ডাক্তার সাহেবের ছোট ছেলে রাজনীতিতে জড়িয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে পড়াশোনা শেষ করেছে। ঊনসত্তরের ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। শেখ মুজিবের সঙ্গে বত্রিশ নম্বরে প্রচুর মিটিং করেছে। আচরণে বুলবুল চৌধুরী সঙ্গে আয়নামহলের কারো মিল খায় না। অতিশয় ধার্মিক মানুষ। ছেলেবেলা থেকে সত্যের পক্ষে। সৎ, শান্ত চরিত্রে নিয়ে সর্বজনে আলাদা ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়েছে। এসময় একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। স্বাধীনতা সমর্থক হিসেবে বুলবুল চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অস্ত্র ধরে। আর তার কারণে পাকবাহিনীর নির্মম ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয় আয়নামহল। আয়নামহলের দালান ব্যতীত সবকিছু লুণ্ঠিত এবং আগুন দিয়ে পোড়ানো হয়। এ সময়টা আয়নামহল ছিল সত্যিকার প্রেতপুরী। দীর্ঘকাল মহলের বাসিন্দারা ছিল সরব। যুদ্ধের দিনগুলোতে সদস্যরা উদ্বাস্তুর মতো বন-জঙ্গলসহ সারা দেশে পালিয়ে বেড়াতে থাকে। ভয়ার্ত ওই সময় বুলবুল চৌধুীর মতো সবাই স্বাধীনতা চেয়েছিল। প্রতিটি জীবনকে তুচ্ছ মনে করেছে। বংশাই নদীর জল নয়মাস গড়ায়। একদিন ভোরবেলা। সূর্য ওঠেনি। উত্তরে বাদলি গ্রামের দিকে সহস্র মানুষের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ‘জয় বাংলা’।
তার তিনদিন পর পিছনে স্টেনগান ঝুলিয়ে মাথায় সৈনিকের ক্যাপ হাকিয়ে বিষ্ণুপুরে ফিরে এলো বীর মুক্তিযোদ্ধা বুলবুল চৌধুরী। আয়নামহলের বাসিন্দা। বুলবুল চৌধুরী আমৃত্যু রাজনীতিতে অনড় ছিলো। উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছিলেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর আয়নামহলের বাসিন্দা ক্রমাগত কমতে থাকে। কফিল চৌধুরীর পাঁচ সন্তানের বংশধরদের সংখ্যা এখন চল্লিশ অতিক্রম করেছে। কিন্তু কেউ মহলে থাকে না। ইতোমধ্যে ডাক্তার সাহেব, সিরাজ চৌধুরী ইন্তেকাল করেন। দু’ছেলে ঢাকায় থাকে। বড়জন বিএ পাস। চাকরি করে ইউনিয়ন ব্যাংকে। ছোট ছেলে জেনিটিক দিয়ে পিতার জিন পেয়েছে। কবিতা লিখে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য পড়ে। না কেউ আয়নামহলে ফেরে না। আস্তে আস্তে আয়নামহলের সর্বশেষ প্রবীণ সদস্যের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শুরু হয় আমানুল্লাহ শিকদারের বংশ নির্ঘন্ট। তৃতীয় পুরুষ শেষ। চতুর্থ পুরুষ শুরু হয়েছে। না কেউ আয়না মহলে বসবাস করে না। সব দিক দিয়ে আয়নামহল প্রতিটি ক্ষেত্রে আরো পলিশ হয়েছে। ঝকঝকে তকতকে এনশিয়েন্ট বাড়িটি কেয়ারটেকারের অধীনে থাকে। বাসিন্দাদের নাগরিক সুবিধা অনেক। বৈদ্যুতিক আলোর ঝলকানিতে আগের চেয়ে আরো বেশি খোলতাই। পূর্বপুরুষরা যেখানে ঘোড়ার আস্তাবল করেছিল, সেখানে গাড়ির গ্যারেজ হয়েছে। উত্তরপুরুষরা এখন গাড়িতে চলাচল করে। শুধু প্রাচীন ইঁদারা বন্ধ হয়ে গেছে। পাম্পের পানি রুমে রুমে পৌঁছে যায়। বাড়ির পিছনে সার সার পায়খানা বন্ধ হয়ে গেছে। এ যুগে ওই পায়খানার জন্য গৃহকর্তাকে আইনের মুখোমুখি হতে হতো। পুকুরের জল টলমল। পুকুর পারে পূর্ব পুরুষদের গোরস্থানটি এ বাড়ির প্রাচীনতা প্রকাশ করে। আয়নামহলের বাসিন্দারা মহলে বসবাস করে না। দল বেঁধে আসে, হইচই করে, আবার ফিরে যায়। আয়নামহলের বাসিন্দারা দেশ থেকে দেশান্তরিত হতে থাকে। তালেবুন্নেসার এ বিশাল উত্তর পুরুষদের একজন অরিন্দম খালিদ দশ বছর পর মিলান থেকে ফিরে ওর বউকে লেখেন –
প্রিয় রোজ,
বিবাহিত জীবনের এক দশক কাটল। মিলান থেকে এখানে আসা হয়নি। অথবা তোমাকেই বিষ্ণুপুরের আয়না মহলে নিয়ে আসা হয়নি। সে অভিযোগ আয়নামহলের বধূ হিসেবে করতে পারো। সে অধিকার তোমার রয়েছে।
প্রিয় রোজ আমার। আয়নামহল কোনো এনশিয়েন্ট দুর্গ না, যেখানে জড়িয়ে আছে মানুষের ক্রন্দন কাহিনী। আয়নামহল যেন তার উল্টো। আমানুল্লাহ শিকদারের বংশ ঠিকুজির মাঝে জড়িয়ে আছে বংশ পরম্পরায় শ্রম, মমতা, শিক্ষা, মানবপ্রেম। আয়নামহলের প্রতিটি বাসিন্দা ভিন্নতর জীবনকে আবিষ্কার করতে চেয়েছে। তুমিও আয়নামহলের বাসিন্দাদের একজন। হায়াতুন্নেসার মতো তুমিও আয়নামহলের বধূ। তোমার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তুমি চলে আসতে পারো। পারিবারিক কবরখানায় পূর্ব পুরুষদের জন্য প্রার্থনা করতে পারো।
তোমার সঙ্গে আমার অমিল আছে। খাদ্যাভ্যাস থেকে আরম্ভ করে অন্তর্গত কথোপকথনে। শুধু এক জায়গায় মিল। আমি তোমাকে ভালোবাসি। এ কারণে বিগত দশ বছর এক জীবন কাটিয়ে দিলাম। তোমার গর্ভে জন্ম নিয়েছে দুটো স্বপ্নের কিশোর-কিশোরী। আর ওরাও আয়নামহলের বাসিন্দা। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আগামী সামারটা আমরা আয়নামহলে কাটাবো। ইয়াফি আর লাবণ্য আয়নামহলের প্রশস্ত লনে ছোটাছুটি করবে। বুনো ঘাস মাড়িয়ে একটি শৈশব নির্মাণ করবে।
রূপবতী রোজ, আয়নামহলের বধূরা নিয়তিসিদ্ধ সুন্দরী, তুমিও তাই। শিগগির চলে আসো। কতোদিন হইচই। একটা জীবনকে নতুন করে দেখা। তারপর আমরা ফিরে যাবো মিলানে। হিথরো বিমান বন্দরে নেমে যাবো আমি আর ইয়াফি। ইয়াফিকে আমি লন্ডন মিউজিয়াম দেখাতে চেয়েছিলাম। তুমি লাবণ্যকে নিয়ে মিলানে যাবে। পাঁচদিন লন্ডন থেকে আবার ফিরে যাবো মিলানে। ইয়াফিকে দ্বিতীয় সিজনের জন্য তৈরি করতে হবে।
তুমি আসছো। আয়নামহল তোমার জন্য প্রতিক্ষা করছে। অপেক্ষা করছে নদী বংশাই। অপেক্ষা করছে শতাব্দীব্যাপী এক মানবিক উপাখ্যান।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন