short-story-aakromon

আক্রমণ
বিপুল দাস

 

প্রথম দিন থেকেই ধুতিপাঞ্জাবি পরে ক্লাস নিতে শুরু করেছিলেন জে এস স্যার। অঙ্কের স্যার জয়রাম সান্ন্যাল। শীতকালে ওপরে দামি শাল। ব্যস্‌, ওতেই তার হয়ে যায়। ধুতিপাঞ্জাবিতে তাকে মানায়ও বেশ ভালো। টকটকে ফর্সা রং। একটু পরিশ্রমেই গালদুটোয় লাল আভা ফুটে ওঠে। অল্প দিনেই অঙ্কে তাঁর প্রতিভার কথা মফস্বল শহরে চাউর হয়ে যায়। টিচার্স রুমে জানাজানি হয়ে যায় যে কোনও অঙ্কের ঘেঁটি ধরে তাকে নাস্তানাবুদ করা জয়রামের কাছে জলভাত। আরও জানা যায় যে, অ্যালোপ্যাথি কসাইরা ওষুধের নামে মানুষের শরীরে বিষ ঢোকায়। চোদ্দ রকমের টেস্ট করে তার রিপোর্ট দেখে গম্ভীর মুখে জানায় যে অমুকটা হতে পারে। হানিম্যান সাহেব কিন্তু একেবারে গোড়ায় চলে যান। হোমিওপ্যাথি নিয়ে কেউ হালকা রসিকতা করলে জয়রাম প্রথমে গম্ভীর হয়ে যেতেন, তারপর একদম গোড়ায় চলে যেতেন।  

“এসব আপনারা বুঝবেন না। সমঃ সমং শময়তি। সদৃশতা। সিমিলিয়া সিমলিবাস।”

“বুঝলেন সান্ন্যালবাবু, আমার ছোট ছেলেটাকে নিয়ে একটা প্রব্লেম হয়েছে। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি, রোগ সারছে না। ছুটির পর আপনার সঙ্গে একবার আলোচনা করব।”

  ভূগোলের বিজন দত্ত খুব বিনয়ের সঙ্গে সান্ন্যালকে বলল। সান্ন্যালবাবুর মুখটা ঝলমল করে উঠল। এ রকম আমরা মাঝে মাঝে দেখতাম। কারও মুখে একটা ফুস্কুড়ি দেখলে বা হাতেপায়ের কোথাও অস্বাভাবিক স্পট থাকলে জয়রাম স্যার তন্ময় হয়ে যেতেন, তার চোদ্দগুষ্টির খবর নিতেন। নারায়ণ ঘোষের কনুয়ে কালো দাগ ছিল। অনেক দিনের পুরনো। জয়রামের প্রবণতা বুঝতে পেরে নারায়ণ পুরো হাতা জামা পরে স্কুলে আসতে শুরু করেছিল। গরমের দিনেও।

  জয়রাম সান্ন্যালের কথা বলার ভঙ্গিতে একটা ব্যাপার থাকত। উঁচু গলায় নয়, নিচু স্কেলে, কিন্তু স্বরে এমন নিশ্চয়তা থাকত, কেউ বিশেষ কথা বাড়াত না। আরও কিছু ব্যাপার ক্রমে সবাই বুঝতে পেরেছিল। যেমন তার জাতপাতের ব্যাপারে রক্ষণশীলতা, মেয়েদের লেখাপড়া শেখার ব্যাপারে আপত্তি। বাইরে চাকরি করতে যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। শোনা যায়, জনান্তিকে বলতেন বারো হাত কাপড়েও যারা কাছা দিতে পারে না, তারা নাকি মনুষ্যপদবাচ্যই নয়। সবাই বুঝতে পারত নারীজাতির ওপর আন্তরিক বিদ্বেষ ছিল জয়রাম স্যারের। অলৌকিক কোনও ঘটনার কথা শুনলে স্যার বিশদে শুনতে চাইতেন। তারপর উদ্ভাসিত মুখে বলতেন – তবে যে, অ্যা। আছে বাবা, একটা সুপার পাওয়ার আছে। বিশ্বজগত চলছে একদম নিয়মের ছন্দে। অঙ্কের নিয়ম। কোথাও এতটুকু এধার ওধার হওয়ার উপায় নেই। খোদার ওপর যারা খোদকারি করার চেষ্টা করে, তাদের ধ্বংস অনিবার্য। জয়রামের আরও কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। মাইকেলের ওপরে কোনও কবিকেই পাত্তা দিতেন না। রবিঠাকুরের কথা উঠলে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটত। সব রবীন্দ্রসঙ্গীত নাকি শুদ্ধ ‘নি’ দিয়ে যায়, আর কোমল ‘নি’ দিয়ে ফেরে। গান হ’ল নজরুলগীতি। এক একটা গান পাথর ফাটিয়ে দেয়। ‘আমার যাওয়ার সময় হ’ল, দাও বিদায়’। কিংবা ‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই’ … আহা হা। এই হ’ল গান। ক্লাসের অনেকে মুখে ব্রণর দাগ, পুরনো ঘা কিংবা সাইকেলের চেনে কেটে যাওয়া ক্ষত দেখিয়ে ওষুধ চাইত। স্যার ওষুধের নাম বলে দিতেন। ছাত্রদের ওষুধের নামও মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। ব্রায়োনিয়া, সালফার থার্টি, নক্সভোমিকা, বেলেডোনা।

  ছুটির পর বিজন দত্ত জয়রামকে নিয়ে একটু আড়ালে গেল। স্যার যথোচিত গাম্ভীর্য সহকারে বিজনের মুখের দিকে তাকালেন।

“আমার ছেলেটা, বুঝলেন, ক্লাস এইটে পড়ে। তা বড়ই হয়ে গেছে বলা যায়। কিন্তু, কী বলব, এখনও প্রায় রাতেই বিছানা ভিজিয়ে ফেলে। অ্যালোপ্যাথি করব না। ওর মা বলছিল ভালো হোমিওপ্যাথি করাতে। এর কোনও প্রতিকার হয় না?”

“কোনও কোনও সময় মেয়েদের মধ্যেও বুদ্ধির স্ফুলিঙ্গ দেখা যায়। যদিও রেয়ার, কিন্তু ব্যতিক্রমই নিয়মের লক্ষণ। অবশ্যই প্রতিকার আছে। দোবেলাই কি ভাত খায়?”

“হ্যাঁ, তাই তো খায়। বন্ধ করব? ভাত ভীষণ ভালোবাসে ছেলেটা। শুধু ভাতই একথালা সাবড়ে দেয়।”

“বুঝেছি, আর বলতে হবে না। ওটি বন্ধ করতে হবে। আর কয়েকটা জিনিস আমি বলব। আপনি লক্ষ করে সেগুলো আমাকে কনফর্ম করবেন। সেরে যাবে। মুহুরিপাড়ার মধু সান্ন্যালের ছেলেরও ছিল। আমিই ট্রিটমেন্ট করেছি। এখন একদম ও কে।”

“ইয়ে, কথাটা পাঁচকান না হলেই ভালো। হিস্ট্রির প্রদীপের কানে গেলে একবেলায় দুনিয়ার লোক জেনে যাবে।”

“আমাকে মেডিক্যাল এথিক্স শেখাতে হবে না। নিশ্চিন্ত থাকুন। কত লোকের কত গোপন অসুখের কথা জানি। কোনও দিন আমার মুখে শুনেছেন। স্বয়ং আমাদের হেডস্যারের … থাক, সে বড় বাজে ব্যাপার। এখন তো দিব্যি ফুলপ্যান্ট পরে ইস্কুলে আসছে। আমি উপলক্ষ্য মাত্র, সব হানিম্যান সাহেবের কেরামতি।”

“আর একটা কথা ছিল। ছেলেটা অঙ্কে বড় কাঁচা। আপনার কাছে পাঠাব নাকি? ওই, সবার সঙ্গে কোচিং ক্লাসে বসবে।”

“সোম বুধ শুক্রের সকাল সাড়ে সাতটার ব্যাচে একটা সিট খালি আছে। পাঠাতে পারেন। একমাসের টাকা সবসময় অ্যাডভান্স দেবেন। পাশ করিয়ে দেব।”

  জয়রামের মেজাজ বিগড়ে আছে। নারীজাতির প্রতি আন্তরিক বিদ্বেষজনিত কারণেই তার সংসারধর্ম পালনের কোনও ইচ্ছেই ছিল না। বরং বাকি জীবন হানিম্যান সাহেবকে নিয়ে আর অলৌকিক বিষয়ের চর্চা করে কাটিয়ে দেবেন। ঘর ভরে উঠছিল অলৌকিক তত্ত্ববিষয়ক বইয়ে। দেবতারা কি গ্রহান্তরের মানুষ, বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্য, মমিরহস্য, জন্মান্তরবাদ, মরণের পরে ইত্যাদি বই দিয়ে। কমনরুমে তাকে অলৌকিক তত্ত্ব নিয়ে কেউ কথা তুললেই অনেক গোপন কথা জানা যেত। রামগঞ্জের গোপাল সাহা নিজের চোখে দেখেছে। মিথ্যে বলায় কী স্বার্থ আছে তার। প্রত্যেক বছর কৌশিকী অমাবস্যার রাতে পুবপাড়ার বড় তেঁতুলগাছের মাথা থেকে কেউ একজন কালো চাদর গায়ে আকাশে ওড়ে। কালো চাদর ডানার মত পতপত করে উড়তে থাকে। বেগুনটালির শেখ সিরাজের একটা পা খুঁতো। সে কী করে অত উঁচু আমগাছের মগডালে উঠে গলায় দড়ি দিল। তুরস্কের একটা কুয়ো থেকে ক্রমাগত ফোয়ারার মত রক্ত বেরিয়ে আসে। অরিজিনাল ব্লাড। গ্রুপ জানা যায়নি। এসব তো মিথ্যে নয়। তা হ’লে বইয়ে ছাপা হ’ত না। আরে বাবা, একটা পাওয়ার তো আছে।

  ইচ্ছে না থাকলেও মৃত্যুপথযাত্রী তার ঠাকুমার কান্নায় বিবশ হয়ে জয়রাম বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের পর ঠাকুমা ক্রমশ বাঞ্ছারামের মত তাজাতর হয়ে উঠতে থাকে। গায়ে গত্তি লাগে। ডাক্তারবাবুও আশ্চর্য হয়ে পড়েছিলেন। চোখ বড় করে বলেছিলেন – মিরাকল্‌। ঠাকুমা আদর করে তার নাত বউয়ের চিবুক ধরে বলেছিলেন—এই তো আমার মিরাবউ।

  বিয়ের ছ’মাসের ভেতর জয়রাম বুঝতে পারল মিরা, আদতে তার বউ পূর্ণিমা একদম বুনো ঘোড়া। একে বশ মানিয়ে তার ওপর চড়ে ছোটাতে বেগ পেতে হবে। সে নিজে হ’ল বি. এস. সি, অঙ্কে অনার্স। মেয়ে ইতিহাসে এম. এ শুনে তখনই তার মনে কু ডাক দিয়েছিল। পরে ভেবেছিল — থাক, টিউশনির বাজার পুরো দখল করে একছত্র সাম্রাজ্য চালানো যাবে। বউ হিউম্যানিটিজ গ্রুপ ম্যানেজ করবে। তা না করে পূর্ণিমা বি. এড-এ ভর্তির তোড়জোড় শুরু করল। অর্থাৎ চাকরির চেষ্টা শুরু করেছে। নাঃ, এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে। গাছ বেড়ে ওঠার আগেই গোড়ায় কোপ মারা দরকার।

  “জনা দশেক আর্টসের স্টুডেন্ট আমি জোগাড় করে দিচ্ছি। তুমি ব্যাচ শুরু করে দাও। বাইরে চাকরি করতে যাওয়ার দরকার নেই। আমাদের বংশে কোনও মেয়েছেলে চাকরি করতে বাড়ির বাইরে যায়নি।”

  “নিজের ফ্যামিলির ভদ্রমহিলাদের ‘মেয়েছেলে’ বলছ কেন। ও আবার কেমন ভাষা। আমাদের বাড়িতে কোনও দিন শুনিনি। বড় কানে লাগে। আর, চাকরি পাওয়ার কি কোনও গ্যারান্টি আছে। চারদিকে দেখছ না টাকাপয়সার খেলা। দেখা যাক, যদি পরীক্ষা দিয়ে এমপ্যানেলড্‌ হতে পারি, ক্ষতি কী। আমার নিজের জন্য তো নয়, সংসারের সাশ্রয়ের জন্যই ভাবছি। চাকরি না করলে শুধুশুধু এত লেখাপড়া করলাম কেন।”

  “তোমার চাকরির টাকায় আমার সংসার চলবে, কী করে ভাবলে। সে সময় যেন না দেখতে হয়। আর একটা কথা, মুখে মুখে তর্ক করা আমি একদম পছন্দ করি না। খেয়াল রেখো। নিজের উচ্চতা কতটুকু, সেটা বুঝে ওপরে তাকাবে।”

  নিজের মনেই মৃদু হাসল পূর্ণিমা। স্যারের যে কোথায় লেগেছে, সেটা বুঝতে তার অসুবিধা হয় না। জয়রামের আপাতসুন্দর চেহারার আড়ালে পুরনো দিনের রক্ষণশীল পুরুষতান্ত্রিক কুৎসিত চেহারাটা মাঝে মাঝেই মুখোশ খুলে বেরিয়ে পড়ে। তার পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি নিয়ে সূক্ষ্ম খোঁচামারা কথা, বাড়ির বউকে বাইরে চাকরি করতে দেবার ব্যাপারে আপত্তি, যে কোনও বিষয়ে শেষ কথাটি জয়রাম বলার পরেও পূর্ণিমা কিছু বললে অসহিষ্ণু হয়ে তাকে থামিয়ে দেওয়া – এসব দেখে পূর্ণিমা বুঝতে পারে নিজেকে এবং তার বংশগৌরব নিয়ে ভয়ানক ইগোয় ভোগে লোকটা। তার ধারণা নারীজাতির নিয়তি হচ্ছে পুরুষের নিচে থাকা। নিজের ভাগ্য জয় করে জেগে উঠতে চাইলে জোর করে বসিয়ে দাও। সংসারে যা কিছু সিদ্ধান্ত নেবার, পুরুষ একা নেবে। এখনও সে প্রাগৈতিহাসিক যুগের পুরুষ রয়ে গেছে। মহিলাদের সে ভোগের জন্য একতাল হাড়মাংস ছাড়া আর কিছু ভাবতেই শিখল না।

  “পূর্ণিমা, রাগ কোরও না। আসলে মাথাটা আমার একটু গরম হয়ে রয়েছে।”

  “কেন, কী হয়েছে? রাতদিন অত টিউশন করছ, মাথা তো রেস্টই পাচ্ছে না। একটা ব্যাচ কমিয়ে দাও না।”

  “না, সে জন্য নয়। আমার টিউশন নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। আসলে আমাদের স্কুলের ক্লার্ক বাবু দাসের সঙ্গে একটা জমি দেখতে গিয়েছিলাম। বাবু বলেছিল স্ক্যোয়ার জমি, পঁচাত্তর বাই পঁচাত্তর, মানে তোমার স্ক্যোয়ার ফুটের হিসেবে … দাঁড়াও …”

  জয়রাম তার মোবাইলে ক্যালকুলেটর খুলে হিসেব করার আগেই পূর্ণিমা বলল – পাঁচ হাজার ছ’শ পঁচিশ স্ক্যোয়ার ফুট। তারপর, জমি দেখলে? আমাকে বলোনি তো জমি কেনার কথা।”

  বুকে বিষম ঘা লাগল জয়রাম স্যারের। সে ক্যালকুলেটরে হিসেব করার আগেই এক সেকেণ্ডে কী করে বলে দেয় পূর্ণিমা। তাও আবার সঠিক বলে। কোথা থেকে এত সাহস পায় মেয়েটা। কথার উত্তর দিল না জয়রাম। পূর্ণিমার চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। পূর্ণিমা দেখল স্যারের এক চোখে বিস্ময়, অন্য চোখে ক্রোধ।

  “তোমাকে বলার কী আছে। তোমার থেকে পারমিশন নিয়ে সব কাজ করতে হবে নাকি। আর, সত্যি বলতে কি, শুভকাজে যাওয়ার আগে আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইনি। তুমি তো আবার সব কিছু বেশি বোঝো।”

  “এর ভেতরে আমি কী অন্যায় করলাম?”

  “মিঠুর ছেলেটার প্রচণ্ড পেট খারাপের সময় আমি ওষুধ দিয়ে এসেছি। তার ওপর তুমি গিয়ে নুনচিনির জল দিয়ে বারে বারে শরবত খাওয়াতে বলোনি? তুমি ডাক্তার, না আমি ডাক্তার? তারপর সেজকাকা মারা যাওয়ার পর তুমি কোন হিসেবে কাকিমাকে থান পরতে বারণ করে এসেছ। শুধু তাই নয়, আমিষও নাকি খেতে বলেছ। অশৌচের বাড়ি, তুমি দিব্যি ওদের ঘরে ঢুকে বিছানায় বসলে। তুমি জানো না জীবিত আত্মার চেয়ে মৃত আত্মা অনেক বেশি শক্তিশালী। গত মাসে লোকসভা ভোটের সময় আমি তোমাকে বলে দিলাম যেখানে ভোট দিতে, তুমি বললে তোমার পছন্দমত জায়গায় কাস্ট করবে। মেয়েছেলের এত স্বাধীনতা কিন্তু সংসার ধ্বংস করে দেয়।”

  “ও, এই ব্যাপার। কেন তুমি তো ডাক্তারি করো। লক্ষ্য করনি ডি-হাইড্রেশনে মিঠুর ছেলেটা কেমন নেতিয়ে পড়েছিল। ওই শরবতটুকু না খাওয়ালে ছেলেটা বাঁচতই না।”

  “দাঁড়াও, আর একটা কথা তোমাকে ভাবছিলাম বলব না। কিন্তু কথা যখন তুললে … গত জানুয়ারিতে আমার জন্মদিনে তুমি পায়েস রেঁধেছিলে? আমি কিন্তু জানি সেদিন তোমার শরীর খারাপ ছিল। অশুদ্ধ শরীর নিয়ে তুমি আমার জন্মদিনের পায়েস রাঁধলে? ছি ছি। সব বিষয়েই আমার আগে আগে কথা বলা তোমার স্বভাব হয়ে গেছে। নিজেকে কি খনা মনে করো। বড় বিদ্বান হয়ে গেছ? নিয়মকানুন আচার আচরণ কিছুই মানতে চাও না। খুব প্রগতিশীল মনে কর নিজেকে।  

  মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল পূর্ণিমা। কিন্তু বুকের ভেতরে এক রকম জয়ের আনন্দ টের পাচ্ছিল সে। মনে মনে হাসছিল। জয়রামের কষ্ট বুঝতে পারছিল পূর্ণিমা।

       পয়লা বৈশাখের দিন সকালে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে মাংস এনেছে জয়রাম। অনেক দিন মাংস খাওয়া হয় না। পূর্ণিমাকে বেশ জম্পেশ করে রাঁধতে বলবে। আজ মনটা ভালো আছে। বাবুর ঠিক করে দেওয়া জমিটা আজ বায়না করে এসেছে। এখনই নতুন বাড়ি তোলার কথা ভাবছে না। পূর্ণিমা যদি টিউশনগুলো করত, তার সংসারে অনেকটাই সাশ্রয় হত। বড় বেয়াড়া তার বউ। কোনও কোনও দিন ইচ্ছে করে চুলের মুঠি ধরে দু’ঘা দিতে। সত্যি বলতে কী, ইচ্ছে হলেই ভেতরে একটা দুশ্চিন্তাও থাকে। মার খেয়ে এ মেয়ে ছেড়ে দেবে না। ওপরে নরম দেখালেও ভেতরে পাথরের মত শক্ত। বলা যায় না, ফ্যামিলি ভায়োলেন্সের কেস করে দিতে পারে। এজন্যই শিক্ষিত মেয়ে সে বিয়ে করতে চায়নি। এখন আর উপায় নেই। কাঠ খেয়ে আংরা হাগতে হবে। মাঝে মাঝে পূর্ণিমার কথা শুনে মনে হয় আগেকার দিন হ’লে মেয়েটার জিভ টেনে ছিঁড়ে নিত।

  পাতের পাশে একবাটি মাংস সাজিয়ে দিয়েছে পূর্ণিমা। চুড়োকরা ভাত ভেঙে তার মাঝে মাংস ঢেলে নিল জয়রাম। আঙুল দিয়ে ঘেঁটে কী যেন খুঁজছে জয়রাম।

“আরও দেব, মাংস?”

“মেটে দু’পিস এনেছিলাম। এখানে একপিস দেখছি। আর একটা কোথায়? তুমি জান আমি মেটে খেতে ভালোবাসি …।”

“না, মানে আমি ভেবেছিলাম আমাদের দু’জনের জন্য দু’পিস এনেছ। আছে, এনে দিচ্ছি।”

“থাক, এখন আর আনতে হবে না। আমার এক পিসেই হয়ে যাবে। যার কপালে যা লেখা আছে, তার পাতে তাই জুটবে। এটা কী?”

  অবিকল মানুষের জিভের মত দেখতে একটা মাংসের টুকরো। হয়তো পাঁঠা, খাসি বা ছাগলের জিভ। কিংবা হয়তো মাংসের টুকরোটা দেখতেই ও রকম। ভয়ানক একটা রাক্ষসের মত সেই টুকরো আক্রমণ করল জয়রাম। তীক্ষ্ণ, হিংস্র দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল, যেন কোনও মানুষের জিভ আক্রোশে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে উপবাসী এক দানব।              



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *