আমি মাইকেলকে বাঁচাইনি
অভীক মুখোপাধ্যায়
বিশ্বের সবথেকে নির্দয় স্থান কোনটা জানতে চাইলেই সবাই আমেরিকার দিকে আঙুল তুলে দেখায়। তারা নাকি গুয়াটেমালা বে-তে একটা জঘন্যতম জেল বানিয়ে রেখেছে, যেটাকে নরকের সঙ্গে তুলনা করা চলে। সেখানে আমার যাতায়াত করার সৌভাগ্য না হলেও হলপ করে বলতে পারি, নয়ের দশকের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যসড়কগুলোর হাল যা ছিল, তাতে যে কোনও বাসের পেছনের সিটে বসলেই নির্দয়তার চূড়ান্ত নিদর্শন দেখতে পাওয়া যেত। শুদ্ধ বাংলায় যাকে পশ্চাৎদেশ বলে, তার যে কী চরমতম নিগ্রহ চলত সেসব মুহূর্তে, উফ! তড়াক-তড়াক করে সে কী লাফানি! থপ-থপ শব্দ। সরি টু সে, ডাইনে-বাঁয়ে রগড়ে লাল করে দিয়ে যে যাতনা চলত, তা অপ্রাকৃতিক সেক্সের থেকে কম কিছু ছিল না। প্রতিদিন। হর ওয়াক্ত। আর কপালখানা দেখুন আমার, হয় সিট পেতাম না, নয়তো ধাক্কাধুক্কি দিয়ে বাকিরা আমাকে ঠিক পেছনের সিটেই বসতে পাঠাত।
এমনই কোনও এক দুর্ভাগা দিনে, অমনই কোনও একটা বাসে করে কম করে ২০-২৫ কিমি পথ অতিক্রম করতে হচ্ছিল। ভাবছেন, এ আর এমন কি রাস্তা? না রে, বাপু! ইহুদিখুড়ো আইনস্টাইন কবেই বলে গিয়েছিলেন, স্টোভে বসার ব্যাপারটা। সুন্দরীর সামনে স্টোভে বসতে বললে ঘণ্টার পর ঘণ্টাকেও কয়েক সেকেন্ড মনে হয়, নতুবা… থাক, সবাই জানে। জ্ঞান বিতরণ করে লাভ নেই। আমার মনে পড়ে কম করে দু-ঘণ্টার ওপর লেগেছিল। পারমুটেশন-কম্বিনেশনের খেলায় আমি হড়কে-হড়কে জানলার ধার অবধি পৌঁছে গিয়েছিলাম। রাস্তায় গর্ত এলেই ঝট করে উঠে দাঁড়াচ্ছিলাম। কিন্তু সমস্যা হল গোটা রাস্তাতে এত বেশি গাড্ডা যে ৩০-৪০ বার উঠে দাঁড়ানোর পরে মনে হল এহেন বৈঠক দেওয়ার থেকে রোড-অ্যানাল সহ্য করা ভালো।
যা বলছিলাম, মানে রাস্তা নেই, শুধু গাড্ডা। ওম পুরীর গালের মতো? ম্মম্মমমম… না তারও একটা মর্যাদা আছে। চাইনিজ চেকারের মতো একটা গর্ত থেকে আরেকটা গর্তে গিয়ে পড়ছিল বাসটা। সামনের সিটটাকে দু-হাতে শক্ত করে ধরে আমি ‘জয় মা তারা’ বলে বসলাম। কত ঘষবি ঘষ! আমার মনোভাব সেই সময়ে যেমন হয়েছিল, পরে সম্ভবত এমন কোনও বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই ‘থ্রি ইডিয়টস’ সিনেমার সেই কালজয়ী সিনে-মুহূর্তটির জন্ম হয়েছিল, ‘তোহফা কবুল করো, জাঁহাপনা!’
ঘুম তো দূরের কথা, চোখ বুজলেও ঝাঁকুনির চোটে খুলে যাওয়ার খাপ। এমনভাবে চোখ খুলে যেতেই দেখি পেছনের সিটের একটা জানলার ধারে আমি, মাঝখানটাতে কেউ নেই, ওদিকের জানলার ধারে দুটো মধ্যবয়সী ধুতিপরা লোক পাশাপাশি বসে আছে। সে থাক, বাসে জায়গা পেলে বসবে না তো কি লুডো খেলবে? কিন্তু তারা শুধু বসে ছিল না। বসে বসে একে অপরের ছক্কা চালছিল। এবার বলবেন সেটা কী জিনিস? লোক দুটো একে অন্যের প্যান্টের জিপার খুলে হাত ঢুকিয়ে হস্তমৈথুন করে চলেছিল সমানে।
একে বাসের ঝটকা, তার ওপরে আমার তদানীন্তন জ্ঞানবুদ্ধিতে এমনতর তথাকথিত কুকীর্তি দেখে মাথা থেকে পেট পর্যন্ত সব গুলিয়ে উঠল। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! আমি আরও জোরে চোখ বুজে ফেললাম।
তবে সে-ই শুরু। এরপরে এমন সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণের দৃশ্য, নজির, কাহিনি, সিনেমা বার বার সামনে আসতে লাগল। আমিও বুঝতে শুরু করলাম, অজানা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি। বুঝলাম সমকামিতা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরং বহুক্ষেত্রে প্রাকৃতিক যৌন আকর্ষণের থেকেও বেশি সুলভ।
যখন যৌবন মাথাচাড়া দিল, তখন খেয়াল করলাম বইপত্রের মধ্যে ডুবে থাকতে থাকতে শরীরের রস সব নিংড়ে গেছে। অস্থিচর্ম সার। পাঁজরা গোনা যায়। যত্ন নিইনি নিজের কোনওদিন। আত্মগ্লানিতে জিমে ভর্তি হলাম। কিন্তু সেখানেও হতাশার পেরেক মনের প্লাইউডে খচখচ করতে লাগল। এক একটা জিম-গোয়ারের সে কী পেশীবহুল শরীর! মনে হচ্ছে ফুঁসতে থাকা কিং কোবরা। আহা! ক’দিন যাওয়ার পরে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। ভাবলাম, সদস্য পদের জন্য দেওয়া টাকাগুলো জলে গেল। ডাম্বেলের দুনিয়া নিপাত যাক।
জিম যাওয়ার মতো সাহস আর জুটিয়ে উঠতে পারছিলাম না কিছুতেই। মিডল ক্লাস… টিপিকালি মিডল ক্লাস মেন্টালিটি। প্রথমে দোকানে কোনও জিনিস দেখে সেটা কেনার জন্য টাকা জমায়। সেইসময়ে সে দোকানির কাছে যায় না বা যেতে পারে না। তারপর দোকানে গিয়ে রেকি করে, কবে ভিড় কম থাকবে, কষ্ট কম হবে। কী জানি যদি দাম বেড়ে যায়? দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি তো যে কোনও সময় হতেই পারে। ৫০০-১০০ হয় সামলে নিল নাহয়। কোনও কমদামের জিনিস কিনবে বলে দোকানে ঢুঁ মারে। মিশন সাকসেসফুল হলে পরে মালটাকে ট্রফির মতো কাঁধে তুলে নিয়ে ঘরে ফেরে।
এই একই পলিসিতে চলে আমি রেকি করে বুঝে নিলাম ঠিক কোন সময়টাতে জিম ফাঁকা ফাঁকা থাকে।
শুরু হল জিমযাত্রা। দেখার মতোই। প্রথমে লাফালাফি করে গা-গরম করা। তারপর ডাম্বেল নিয়ে লোফালুফি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ডাম্বেল চাগানোর মধ্যে একটা পৈশাচিক আনন্দ কাজ করে তা জিমে না গেলে বুঝতে পারতাম না। চারদিকে আয়না। আয়নাই আয়না। এত প্রতিচ্ছবি দেখে দেখে আত্মমুগ্ধতা দ্বিগুণ হয়ে যায়। প্রথমে টিশার্ট প’রে। তারপর শুধু স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে। নিজের মিনি সাইজ মাসলগুলোকে দেখে মন নাচে। আহা নাচে নাচে!
ক’দিন পরে জিমে একটা মডেল টাইপ ছেলে এন্ট্রি নিল। পেশিবাহুল্য ট’সে ট’সে পড়ছে। ডিকশনারির মতো বাইসেপস। রডের মতো ট্রাইসেপস। তার সামনে হাতে ডাম্বেল তুললে নিজেকে খ্যাংড়াকাঠি মনে হচ্ছিল আমার। তাকে দেখে ডাম্বেল গুছিয়ে রেখে পোশাক চাপালাম গায়ে। জিমের এক কোণে বসে ছেলেটাকে লক্ষ্য করতে লাগলাম। দু-তিনদিন এমনভাবেই চলল। তারপর কী মনে হতে নিজের হীনমন্যতা ঝেড়ে ফেলে তাকে আমার গুরু হওয়ার জন্য অনুরোধ করলাম।
জিম আসলে একটা পন্থা। ধর্মের যেমন পথ থাকে, জিমের হয় কাল্ট। জিম-জগত বাকি দুনিয়ার থেকে আলাদা। জিম যাওয়া লোকেরা অন্যদের একটু দয়ার চোখে দেখে। জিমপন্থার মানুষেরা অন্য সকল পন্থার মানুষকে নিজেদের পথে নিয়ে আসার জন্য কোনও কসুর বাকি রাখে না। ধর্মান্তরিত করার মতোই চলে ব্যাপারটা। আমাদের জিমের নতুন সদস্য নিজের নাম বলল মাইকেল। মাইকেল বেশ ফ্রেন্ডলি দেখলাম। কী খেতে হবে, কীভাবে খেতে হবে এসব নিয়ে দীর্ঘ তালিকা দিয়ে দিল আমাকে। কসরতের সুন্দর একটা রুটিন সাজিয়ে দিল। সপ্তাহে একটা দিন হাত আর বাহুর জন্য ডেডিকেটেড করে দিল। একটা দিন শুধু বুকের পেশি বৃদ্ধি করার ব্যায়াম করতে হবে বলল। কাঁধ আর পিঠের জন্য একটা দিন রাখতে হল। একদিন থাকবে লেগস-এর জন্য। সঙ্গে দেহে ভ’রতে হবে অনেক অনেক প্রোটিন। ছখানা করে ডিমের সাদা অংশ। প্রতিদিন নতুন টিপস দিত মাইকেল। বলত, প্রোটিন বেশি গেলে আর ওয়ার্কআউট কম করলে নাকি হার্ট এনলার্জড হয়ে যাবে। আমি দাঁত বের করে বলেছিলাম, ভালোই হবে, মনের মধ্যে অনেককে জায়গা দিতে পারব। মাইকেল এমন তাকিয়েছিল যেন তক্ষুনি ভস্ম করে দেবে।
এক সপ্তাহেই আমার হালুয়া টাইট হয়ে গেল। সারা গায়ে অসহ্য ব্যথা। স্টিফ। যেখানে যেখানে পেশিগুলো হাড়ে গিয়ে মিশেছে, সেখানে সেখানে গুলি করেছে বলে মনে হচ্ছিল। একটা উইক টানা ডুব মেরে দিলাম। পা দুটো রোবটের মতো ফাঁক করে হেঁটেছিলাম ওই কদিন।
কিন্তু ওই যে, জিম কাল্ট। বড় ঘাঘু মাল হয় জিমের লোকেরা। বেদানি বুড়ির চায়ের ঠেকে দাঁড়িয়ে বিড়ি–চা সহযোগে আড্ডা দিচ্ছিলাম, দেখি বুলেট চালিয়ে এক হেলমেটধারী আমার ঠিক পাশে এসে ব্রেক কষল। শিরস্ত্রাণ সরাতেই বুকে শিহরণ জাগল। এ যে মাইকেল! স্কুল বাংক করে পালানো ছাত্রকে ধরতে যেমন হেডমাস্টার ছোটেন, তেমনই মাইকেল এসেছে। এবার কী আমাকে মুরগি বানিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখবে? আমি অগ্রিম ক্ষমা চাইলাম। মাইকেল দরাজ দিল নিয়ে আমাকে মাফ করেও দিল। বলল, এই ব্যথা-বেদনার একমাত্র ওষুধ হল আরও বেশি করে ব্যায়াম করা। ব্যায়াম থেকে পালিয়ে ব্যথা কমানো যাবে না। উদাহরণ দিল, পুরনো গাড়ি চালু হওয়ার সময় ঘর্ঘর করে। একটু দূর পর্যন্ত গেলে সব ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু বসিয়ে রাখলেই জঙ ধরে যাবে। আমি আবার ময়দানে ফিরলাম। কাজ হতে লাগল। বুক চওড়া হচ্ছিল। টিশার্টের হাতাগুলো টাইট হয়ে বসছিল। যেসব মেয়েরা পাত্তাও দিত না, তারা রীতিমতো ঝাড়ি মারছিল। বডি লাঙ্গোয়েজ আর নিজের ল্যাঙ্গোয়েজের মধ্যে মনে হয় মিল থাকে। আমি বিনোদ মেহরা থেকে ক্রমশ অমিতাভ বচ্চনে পরিণত হচ্ছিলাম। চিকন চিকন চকোলেট হিরোটা ক্রমশ আখরোটে রূপান্তরিত হচ্ছিল।
এরই মধ্যে মাইকেল একদিন আমাকে বলল ওয়ার্কআউটের সঙ্গে মাসাজের কী সম্পর্ক।
আমি বললাম, মালিশ?
উঁহু, মাসাজ। মালিশ আখড়ায় করে। এটা পিওর মাসাজ।
আমি করাব না মাসাজ।
আমি সেদিনটা জিমটা পুরো ঘুরে দেখলাম। ঠিকই ভেবেছিলাম। সবাই মাসাজ করাচ্ছিল। অর্ধনগ্ন হয়ে শুয়ে, একে অপরকে তেল চাপড়ে মালিশ করছিল। চেপে চেপে টিপে টিপে মাসলগুলোকে শিথিল করে দিচ্ছিল ম্যাসিওররা। মাইকেল আমার পাশে এসে দাঁড়াল। স্টিফনেস কেটে যাবে। মাসলগুলো আরও ফুলে উঠবে।
আমি বললাম, এই ছেলেতে ছেলেতে রোমান্স আমার দ্বারা বরদাস্ত হবে না, গুরুদেব।
কথাটা খুব মজার ছলে বললেও মাইকেল কিন্তু আমার কথা শুনে একটুও হাসল না। বরং চোখ দুটো লাল হয়ে উঠল। ঘুরে দাঁড়িয়ে সে একজনের মাসাজ দেখতে লাগল। আমি সম্ভবত গুরুতর কোনও অপরাধ করে ফেলেছিলাম। ইংরেজিতে যেটাকে বিলো দ্য বেল্ট হিট করা বলে।
অনেক বছর পরে কিছুটা এধরনেরই মাসাজ আমি গোয়ার একটা হাই-ফাই স্পা-তে করিয়েছিলাম। নর্থ ইস্টের এক সুবেশা মহিলা অন্ধকার কক্ষে ক্লাসিক্যাল মিউজিক চালিয়ে আমার সারা শরীরে মালিশ করেছিল। সারা দেহের লোম খাড়া হয়ে গিয়েছিল। মুখেই মারিতং জগত স্বরূপ অবতার নিয়ে ঘুরি, কিন্তু সেদিন অর্ধনগ্ন অবস্থায় শায়িত হয়ে এক অচেনা মহিলার সমক্ষে আমি অসহায় অনুভব করেছিলাম ভীষণভাবে। মাসাজ সমাপ্ত হতে না হতেই ‘ছোট ছেড়ে পেছনে বাঁশ’ মার্কা একটা দৌড় লাগিয়েছিলাম।
যাইহোক, মাইকেল আর আমার গুরু রইল না। জিমে নিজের টাইমিং বদলে নিয়েছিল। আমাদের দেখাসাক্ষাৎও বন্ধ হয়ে গেল। পরীক্ষা আসতেই আমার কসরত করার ইচ্ছেটাও ম’রে গেল।
প্রথমে জওহর নবোদয়ের স্কুলে এবং পরে পুনের মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলে ছাত্রজীবনটা কাটিয়েছি। আমার সমস্যা ছিল হোস্টেলের খাবার কখনও মনে ধরত না। বলা হয়, ম্যাকডোনাল্ডস-এর বার্গার নাকি বছরের পর বছর ধরে নিজের একই স্বাদ ধরে রেখেছে। উত্তম স্বাদের সমাহার। আমি বলি, এই একই বৈশিষ্ট্য ভারতীয় মেস বা হোস্টেলের কিচেনের উৎপাদনগুলিতেও পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। একই খাবারের মেনু বছরের পর বছর চলে। অখাদ্য যেমন আছে, সুখাদ্যের কথাও কানে আসে। যেমন বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্সের ধোসা নাকি বেশ বিখ্যাত। আমি এমন অনেক নতুন জায়গাতে খাবার এক্সপ্লোর করেছি। কিছু ভালো লেগেছে, বেশিরভাগই মনে ধরেনি। শেষে গিয়ে মন বাঁধা দিলাম এক সর্দারজির ধাবা টাইপের মেস-এ।
সর্দারের বউ মানে সর্দারনী সাক্ষাৎ মাতা অন্নপূর্ণা। যাকে খেতে দেন, তার মনে বুঝেই খেতে দেন। কিংবা উল্টোটা, তিনি যা খেতে দেন, সেটাই খাদকের মনে ধরে যায়। ভদ্রমহিলার সঙ্গে তাঁর এক বিধবা ননদও ছিলেন। তিনি অপরূপা। বয়স কত আন্দাজ করা মুশকিল ছিল। তবে শুনেছিলাম বিয়ের পরপরই তাঁর স্বামীর মৃত্যু হয়। সৈনিক ছিলেন ভদ্রলোক। জঙ্গি-হামলাতে নিহত হয়েছিলেন। আমার সাথে সামান্য ঘনিষ্ঠতাও হল। জানালেন, পেনশনের টাকা শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দেন। এখানে দাদা-বউদির সঙ্গে কাজে ব্যস্ত থাকেন। তাতে মন ভালো থাকে, দায়িত্ব থাকলে জীবনটা বিরক্তিকর হয়ে ওঠে না। ভদ্রমহিলার প্রতি একটা আকর্ষণ বোধ করছিলাম। আর্মি ওয়াইফের প্রতি এহেন টান দেশদ্রোহের সমান হলেও হতে পারে। কিন্তু কিছু করার ছিল না। আমার মতো আজন্ম মেস-শাবকের ক্ষেত্রে অমন ফুলকো রুটি আর কে অত যত্ন করে পরিবেশন করত? তিনি একটার পর একটা রুটি প্লেটে দিয়ে যেতেন, আর আমি গিলে চলতাম।
সন্ধে নামলেই সর্দারজি জলপুলিশের আন্ডারে চলে যেতেন। আমাদের খাওয়াদাওয়া কী হল সেসব নিয়ে ভদ্রলোকের মাথাব্যথা ছিল না। তবে লোকটা মহা বদরাগী ছিল। মেল ইগোতে ঠাসা। সর্বসমক্ষে সর্দারনীকে চড় কষিয়ে দিয়েছেন একাধিক বার। আমার তখন মনে হতো আমাদের মা অন্নপূর্ণার ওপর অসুরে আক্রমণ করছে। রাগে মাথা জ্বলে যেত, কিন্তু কিছু করার মুরোদ নেই। রুটি তড়কার মধ্যে ডুবিয়ে মুখের মধ্যে রাগ সমেত চালান করে দিতাম। উনি একের পর এক চড় খেতেন, আর আমরা রুটি খেয়ে যেতাম। ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সটা আমাদের মেসের প্রাত্যহিক এন্টারটেইনমেন্টে পরিণত হচ্ছিল। প্রতিদিন খেতে বসলেই কেমন এক ধরনের নিষিদ্ধ রোমাঞ্চের জন্য অপেক্ষা করতাম। মনে হতো প্রাচীন রোমে গ্ল্যাডিয়েটর এরিনাতে বসে আছি। পৌরুষের শক্তি প্রদর্শন দেখব, বিধবা সুন্দরীকে দেখে চোখ ধন্য হবে। পাশবিক আনন্দে ক্রমশ জানোয়ারে পরিণত হচ্ছিলাম। পরে কোর্স কমপ্লিট হওয়ার পরে হোস্টেল ছেড়ে সর্দারজির বাড়ির সামনেই একটা বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম। হয়তো মনটাই এতটা নিচে নেমে গিয়েছিল যে ওইসব দৃশ্যগুলোকে ছেড়ে আসতে চাইছিলাম না।
সারাদিন চেম্বার সেরে ফিরে এসে সর্দারজির জানলার দিকে আকুল নয়নে তাকিয়ে থাকতাম। বেদম প্রহারের দৃশ্য কিংবা মোহময়ী বিধবার মুখ কিছু একটা অন্তত দেখতে পাব। এরপর কোনও এক রাতে এভাবেই তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখলাম, সর্দারজি বাড়ির দোতলার বারান্দায় মাল খেয়ে লাট হয়ে পড়ে রয়েছেন, জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে কক্ষে নিভৃতে, আঁধারে দুই রমণী পরস্পরের প্রণয়পাশে বদ্ধ। নাহ, পূর্ণ অন্ধকার নয়, রুমের নীলচে নাইট-লাইটের কল্যাণে দুটো নগ্ন নারী শরীরের সিলুয়েট ধরা পড়েছিল সেই রাতে। বড় বড় রাজঘরানার হারেমের গল্প পড়েছি আগে। কিন্তু সেই রাতের সেই আবছায়া দৃশ্য দেখে সারাটা রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছিলাম। বিছানায় শুয়ে শুধু এপাশ ওপাশ করেছি। একগাদা প্রশ্ন মাথায় ভিড় করেছে। মনে পড়ে গেছে কয়েক বছর আগে বাসের পেছনের সিটে দেখা দুই মধ্যবয়সী পুরুষের হস্তমৈথুনের ছবি। সেদিন তাদের দেখে আমার গা ঘিনঘিনিয়ে উঠেছিল, অথচ আজ? আজ দেখে এমন শিহরণ জাগছিল কেন? ফারাক কোথায়? ঠিক করে উঠতে পারছিলাম না যে, আমার আর ওদের মধ্যে কে বা কারা বেশি বিকৃত।
পসার জমছিল না। তাই ভাড়া নেওয়া বাসাটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম। আবার ফিরলাম হোস্টেলে। এবারে প্রশ্ন করবেন, পড়া ছাড়ার পরে কীভাবে হোস্টেলে ফেরা যায়? আজ্ঞে, এবারে আমি প্যারাসাইট হিসেবে ফিরেছিলাম। প্যারাসাইট মানে অনুপ্রবেশকারী, যারা কোর্স পাস করে বেরিয়ে যাওয়ার পরেও বেআইনিভাবে হোস্টেলে থেকে যায়। আরও একটা টার্ম আছে। ক্রোনি। প্যারাসাইট আর ক্রোনি, এই দুটি প্রজাতি হোস্টেল জগতে বড় গুরুত্বপূর্ণ।
ক্রোনি কাদের বলে? যারা বছরের পর বছর ফেল করে রয়ে গিয়ে হোস্টেলের প্রতিটা ইটকে ভালোবেসে ফেলে। হোস্টেলের প্রতি তাদের আলাদাই একটা টান থাকে। এঁটুলি যেমন কুকুরকে ভালোবাসে, অনেকটা তেমনই। বয়স বেড়ে চলে অথচ ভাইঝির বয়সী ফ্রেশার মেয়েগুলোর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। নতুন ঢোকা ভোলাভালা ছেলেগুলোকে সিগারেটের রোলে গাঁজা ঢুকিয়ে টানতে শেখায়। জ্ঞানের আগ্নেয়গিরি এক একটা।
পুনে শহরটা বরাবরই লিক থেকে স’রে পথ চলেছে। বৈপরীত্যের চরম সমাহার। কিছু বিদ্বান যেমন আছেন, আছে কিছু ফালতু গাঁজাখোর। তারা শুধু গাঁজাই খায় না, জ্ঞানের কথাও বলে। কীসের সঙ্গে কীসের তুলনা টেনে দেবে কল্পনাও করতে পারবেন না। হচ্ছিল শিবাজি মহারাজ আর আওরেংজেবকে নিয়ে কথা। বলল, শিবাজি মহারাজের পেছনে ছুটে আওরেংজেবের জীবনের আদ্ধেকটা সময় কেটে গেল। টম অ্যান্ড জেরির মতো ব্যাপারটা। কেউ একজন গান্ধীজিকে নিয়ে কিছু বলতেই, অন্য দুজন বলল, গান্ধী, লিংকন, লুথার কিং এঁরা বিশ্বের পথপ্রদর্শক ছিলেন, ম্যালেরিয়া-ডায়েরিয়াতে মরেননি, মরেছেন কীসে? গুলিতে! আমার মাঝে মাঝে মনে হতো শহরটার হাওয়াতেই কিছু একটা আছে, যা ছেলেগুলোকে অমন মহাজ্ঞানী রজনীশের মতো করে তুলছে।
রজনীশ বা ওশোর আশ্রম পুনেতেই। ওশোর প্রভাব নাকি পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সংস্পর্শ জানি না, তবে পুনে শহরের যৌন সংস্কৃতিও একটু আলাদা। কেউ কেউ বলেন যে, এই শহরে দেশের সর্বাধিক মহিলা যন্ত্রচালিত দ্বিচক্র যান চালক রয়েছেন। মুখ রঙবেরঙের স্কার্ফে ঢেকে সরু কোমর নিয়ে স্কুটি চালাতে থাকা যৌবনবতীর দল। মেয়েদের মধ্যে আলাদাই একটা স্তরের আত্মবিশ্বাস। চাঁপাফুলের মতো আঙুলে যখন জ্বলন্ত সিগারেট ধরা থাকে, তার র্যালাই আলাদা। ম্যাক্সি কখন যে মিনি মিডিতে পরিণত হয় তা ধরাই যায় না। কেউ বলেন সংস্কৃতিহীন, আমি বলি সাংস্কৃতিক উন্মুক্ততা। ঠিক এমন উন্মুক্ততাই কিছু পুরুষের মধ্যেও লক্ষ্য করেছিলাম সেখানে। দেহের বিভিন্ন অংশে ট্যাটু। কাঁধ পর্যন্ত বাহারি চুল। বিপজ্জনকভাবে নেমে থাকা লো-ওয়েস্ট জিন্সের মধ্যে থেকে উপত্যকার প্রদর্শন। পথ হাঁটার সময় অদ্ভুত একটা ছন্দ, যা দেখলে রক্তে দোলা লাগে। খবর পেলাম, ওরা সমকামী, রাতের রাস্তায় অ্যাডাম টিজিং করতে বেরোয়।
খবরটা কাঁচা নাকি পাকা জানতাম না, হোস্টেলের গোলটেবিলে এই নিয়ে সম্মেলন বসছিল। গুজব রটছিল। অমুককে রাস্তায় ধরে ওরা প্যান্টের চেইন খুলে দিয়েছে। অনেক কষ্টে নাকি সে পালিয়ে এসেছে। আমাদের মধ্যে হুলিয়া জারি হল, কোনও ছেলে রাতে একলা বেরোবে না। গেলে অন্তত তিন-চারজন যেন সঙ্গে থাকে। আমরা ক্রমশ ওদের নানান নামে ডাকছিলাম। ছক্কা, মগা, মিঠা, গুড় ইত্যাদি ইত্যাদি। পরিচয় চিহ্নগুলো আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। ওরা টাইট পোশাক পরে, পা ফাঁক করে হাঁটে। সন্ধের পর বিভিন্ন স্টেশনের শৌচালয়গুলোতে ওদের সন্ধান মেলে। চিউয়িংগাম চিবোয় তখন। চুলে হাইলাইট। ঠোঁটে লিপস্টিক।
ব্যস, আর যায় কোথায়? আইডি প্যারেড চালু হয়ে গেল। দল বেঁধে বেরোতে লাগল হোস্টেলের ছেলেগুলো। রাস্তায় খেয়াল রাখত, কোথায় মিঠা গুড় পাবে। অদ্ভুত মানসিকতা জন্ম নিচ্ছিল। যাকেই সন্দেহ হতো, তাকে ‘হোমো’ বলে রাগাতো। সত্যিই কোনও সমকামীর সন্ধান পেলে তার পেছনে দৌড়ত। শিকারি যেভাবে শিকারকে ছোটায়, ঠিক তেমন একটা আনন্দ মিলছিল। রোজ রাতে লাঠি নিয়ে হোমো তাড়াও অভিযান এমনভাবে চালানো হচ্ছিল যেন পথকুকুরকে মারতে বেরোনো হয়েছে। খেলাটা ক্রমশ রোমাঞ্চকর হয়ে উঠছিল। প্রতিদিন নতুন যুদ্ধনীতি তৈরি হতো, রাতে চলত তার একজিকিউশন। কিছু সুদর্শন ছেলেপুলে নিজেদের প্রেমজালে ফাঁসিয়ে হোমোদের হোস্টেলে তুলে এনে কেলিয়ে তাদের কল বিগড়ে দিত। ছাত্রজীবনের ফ্রাস্ট্রেশন সব ওদের ওপরেই ঝাড়ত। অশ্রাব্য গালিগালাজ, যৌনদণ্ড টিপে ধরা, পায়ুদ্বারে শক্ত কিছু প্রবেশ করিয়ে দেওয়া, এগুলোকে রেপ ছাড়া আর কিছু বলা যেতে পারে কি?
এমনিতে আমি এমনতর নৈতিক দাঙ্গাগুলোতে অংশগ্রহণ করতাম না, কিন্তু সেই রাতে পরিবেশ-পরিস্থিতি একটু অন্যরকমেরই ছিল। কারো জন্মদিন ছিল। মদের বোতল খোলার পর থেকেই শিকার করার শখটা রাজাবাদশাদের বদ নেশার মতো রক্তে চাগাড় মারছিল। একদল বলল শিকার ধরে আনতে কাউকে টোপ হিসেবে পাঠানো হোক। আমি এসবে থাকতাম না, সিগারেট আনার দায়িত্ব নিলাম। বাইকটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। দোরাবজির ওল্ড স্টোরের সামনে দাঁড়িয়ে রাত্রির পুনে নগরীর সৌন্দর্য দেখতে লাগলাম। হাসি হাসি মুখ পুনেবাসীর। কত কিসমের লোক! দোরাবজি, পুনেওয়ালার মতো পার্সি ব্যবসায়ীদের নগর। আগে নাকি রেসের ঘোড়া ছুটত, লাখ-লাখ টাকা কয়েক মিনিটে উড়িয়ে দিত ধনীরা। পেছনেই মুসলিম বসতি শিবাজিনগর। সামনের দিকে হিন্দু এলাকা। আগাখাঁ সাহেবের মহল। ওই প্রাসাদেই গান্ধীজি থেকে গেছেন। শান্তিদূতদের নগরী পুনে, আবার মারাঠা পৌরুষের নগরীও পুনে।
দুচোখ ভ’রে পুনের অনির্বচনীয় সৌন্দর্য অবলোকন করে যখন হোস্টেলে ফিরলাম, তখন খেলা শুরু হয়ে গেছে। চক্রব্যূহ দেখেই বুঝেছি কাউকে পেটানো চলছে। ভিড় ঠেলে কেন্দ্রে পৌঁছে চমকে উঠলাম। রক্তাক্ত এক যুবক। কী সুন্দর মডেলের মতো চেহারা ছেলেটার। মুখটা মার খেয়ে ফুলে গেছে। কপাল, ঠোঁট ফেটে রক্ত ঝরছে। আমাকে দেখেই তার ধ্বস্ত হতে থাকা আত্মবিশ্বাস শেষবারের মতো ফরফর করে উঠল। হবে নাই বা কেন? আমার ভুজার পেশিতে যে দম আছে, তাতে তার অবদান যে অনস্বীকার্য।
মাইকেল! না, মুখে নয়, মনে মনে বললাম।
আমার চোখে কখনও যে একদা শক্তির জীবন্ত স্বরূপ ছিল, আজ তাকে নপুংসক মনে হচ্ছিল। আমাকে দেখে কেঁদে ফেলল। জানি না আমার নাম সে স্মরণ করতে পারছিল কিনা। কিংবা ক্রমশ পরিস্ফুট হতে থাকা আমার অনাসক্ত মুখাবয়বের বীভৎস প্রতারণার ফলে সে আমাকে স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে চাইছিল।
বিশ্বাস করুন, আমি সেদিন মনের মধ্যে তোলপাড় হতে থাকা মাইকেল নামটাকে মুখে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়েছিল, যদি বলি আমি মাইকেলকে চিনি, সবাই আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাবে। হোস্টেলে আমার আর কোনও দাপট থাকবে না। এখন একবার আঙুল তুললে, সবার হাত থেমে যায়। কিন্তু মাইকেল আমার পরিচিত বললে সবার আঙুল আমার দিকে উঠবে। জানতে চাইবে আমিও কি হোমো? হয়তো এসব কারণেই প্রতিষ্ঠা আর বিবেকের যুদ্ধে বিবেক হেরে গেল।
মাইকেল তখনও আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে রয়েছিল। মার খাচ্ছিল। চোখ বুঝে আসছিল, তবুও জোড় করে মেলছিল চোখের পাতা। একবার যদি পরিচয় দিয়ে আমি সবাইকে থেমে যেতে বলি।
আমি জানি, ওর ওই তাকানি দেখে কয়েকজন আড়চোখে আমাকে মেপেছে। তাদের সন্দেহ নিরসনের জন্য আমি বলেছি, কে রে, মগা-টা!
সবাই নিশ্চিত এবং নিশ্চিন্ত হয়েছে যে রক্তাক্ত সমকামী যুবকের সঙ্গে আমি কোনভাবেই যুক্ত নই। আরও মেরেছে মাইকেলকে।
আগেই বলেছি যে, আমি নৈতিক দাঙ্গাকারী নই। সেখান থেকে নীরবে বিদায় নিয়েছি। ফালতু কেন সবার চোখে হোমো হতে যাব?
তবে পরে শুনেছিলাম মাইকেলকে কাবু করাটা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়েছিল। মার খেয়ে আবার উঠে দাঁড়াচ্ছিল। অসীম সহ্যশক্তি। অবশ্য সবকিছুর মতোই ওর সহনক্ষমতারও এক্সপায়ারি ছিল। মাইকেলকে বাঁচানো যায়নি। বা বলা ভালো আমি মাইকেলকে বাঁচাইনি।
