ধূসর একটা বস্তু অঘ্রাণের ন্যাড়া খেতের ভেতর দিয়ে ভীতু কোনও প্রাণীর মত ঘুরে বেড়াচ্ছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় রাতচরা কোনও প্রাণী। রাতচরা প্রাণীরা এখন খুব ব্যস্ত। আলো ভালো করে ফুটে ওঠার আগে গাছের কোটরে, মাটির নীচে গর্তে ফিরে যেতে হবে। যতক্ষণ না আবার আকাশের দবদবে আগুনের গোলাটা তলিয়ে না যায়, ততক্ষণ অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা ওদের। যা কিছু উজ্জ্বল, আলো ঝলমলে- সে সব বর্জন করে রাতচরা এই সব ইঁদুর, প্যাঁচা, শেয়ালের দল। এরা আগুনের বিপক্ষে জোট বাঁধে। তখন পুবপশ্চিমউত্তরদক্ষিণ সমান অন্ধকার। তখন মথ খোঁজে রাতেফোটা সাদা ফুল। শেয়াল মুরগির তালাশ করে। বাদুড় পাখি নয়, কিন্তু ওড়ে, সর্বনাশ করে গোলক সামন্তর জামরুল ও জহিরুল শেখের লিচুবাগানের।
এ সময়েই, সন্ধেবেলা, নীলধোঁয়া আর কুয়াশা মিশে ভারি হয়ে নীচে নেমে আসে যখন, অন্ধকার একটু ঘন হলেই বস্তা পিঠে খন্তা হাতে নিয়ে ধানকুড়ানিরা মাঠে ঘুরে বেড়ায়। ধান কেটে নিয়ে যাওয়ার সময় শস্যমঞ্জরী থেকে ধান গড়িয়ে পড়ে মাঠে। সে নেহাত কম নয়। আসলে ওরা খুঁজে বেড়ায় ইঁদুরের গর্ত। সেখানে সঞ্চিত ধানের পরিমাণ অনেক বেশি। সে রকম একটা গর্ত খুঁজে পেলে ওদের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠ। শাবল দিয়ে গর্তের মুখ বড় করে। ভেতর থেকে টেনে আনে ইঁদুরেকাটা ধানের ছড়া। আর ভোরে, সূর্য ওঠা্র অনেক আগে শিশিরভেজা মাটিতে ছোট ছোট পায়ের ছাপ ফেলে ওরা ধান কুড়িয়ে বেড়ায়। কখনও একসঙ্গে এক ছড়া পাওয়া দৈবাৎ ঘটে। নইলে ফসল কেটে নেবার পর মাটিতে পড়ে থাকা উদ্বৃত্ত শস্যকণা একটি একটি করে সংগ্রহ করে ওরা।
পুরন্দর এসব জানে। ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছে। জমিজমা, ধানপান নিয়েই তার কারবার। তবু এই দৃশ্যের সামনে তার কেমন যেন ঘোর লেগে যাচ্ছিল। এভাবে, রাত যখন প্রায় পুইয়ে এসেছে, কৃষ্ণপক্ষের মরা চাঁদ উঠেছে অনেক দেরিতে, কুয়াশামাখা দিগন্তজোড়া ন্যাড়াখেতের সামনে দাঁড়িয়ে তার কেমন ঘোর লেগে গেল। আকাশে কেউ ঝুলিয়ে রেখেছে মৃদু লন্ঠন। আকাশজুড়েই, যেন কতকাল ছাইমাজা হয়নি, এমনই সেই লন্ঠনের কাচের আড়াল। তার ভেতরে লালচে আলো। সেই আলো দেবীডাঙার মাঠে ছড়িয়ে পড়লে এই মাঠ, শুকিয়ে যাওয়া ধানের গোড়াগুলোর অস্পষ্ট জেগে থাকা, অনেক দূরের গাছপালার মৃদু আভাস– সব মিলে মনে হয় অলৌকিক এক দৃশ্য। বুঝি কোনও প্রাচীন পৃথিবীতে সে এসে পড়েছে। এই পৃথিবী আমার চেনা জগত নয়, যে সমস্ত চিহ্ন দিয়ে আমার অস্তিত্ব বাঁধা রয়েছে সংসারের সঙ্গে– এই মরা আলোর, শব্দহীন পৃথিবী আমি চিনি না– এই কথা মনে হলেই সংসার থেকে উৎখাত হওয়ার ত্রাসে প্রাণ কেঁপে ওঠে।
হারামজাদা শরীর– বিড়বিড় করল পুরন্দর। সে জানে সে যা করেছে, তাকে বলে রেপ করা। আঁচড়ে কামড়ে মালা তার হাত থেকে রেহাই পেতে চেয়েছিল, পুরন্দরের সঙ্গে পেরে ওঠেনি। পুরন্দরের কাকলাসের মত শরীরে তখন হাতির বল। শরীরও হয়েছে মত্তহাতির মত পাগল-পাগল। সর্ব শরীর পুড়ে যাচ্ছে মদন আগুনে। মুখ চেপে ধরেছিল মালার। প্রথমে অবাক হয়ে তার চোখের দিকে তাকিয়েছিল মালা। বিশ্বাস করতে পারছিল না। তারপর জোর করে ঠেলে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল পুরন্দরকে। আঁচড়ে কামড়ে দিচ্ছিল। শেষে তার চোখে শুধু ভয় ছিল। পাগলের মত তার শাড়িব্লাউজ ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলছিল পুরন্দর। সেও বুঝতে পারছিল পুরন্দর তাকে ধর্ষণ করতে চাইছে। পাগল হয়ে গেছে তার চেনা মানুষটা।
জোরে একটা শ্বাস ছাড়ল পুরন্দর। এখনও বুকের ভেতরে হাঁপধরা ভাবটা রয়েছে। হিসেবে কি গোলমাল করে ফেলেছে সে– ঠাণ্ডা মাথায় গোড়া থেকে ব্যাপারটা ভাবতে হবে। আসল যে কাজটা তার করার কথা ছিল, যার জন্য এত জোগাড়যন্ত্র, সেটাতেই কোনও ভুল করে ফেলেছে কিনা কে জানে। আসলে ওই সময়, সব হিসেবপত্র ওলটপালট হয়ে যায়। এই শরীর আর মনের কথা শোনে না। নইলে সেবার, তেঁতুলগাছির শ্রীদামও কি জানত না ধরা পড়লে মার খেয়ে মরে যেতে পারে। দিনদুপুরে পাটখেতের ভেতরে মরণচাঁদের হাবাকালা যুবতী মেয়েটার সর্বনাশ করে ভেবেছিল কাকপক্ষী টের পাবে না। পাবলিক শ্রীদামকে ধরে ফেলেছিল। তার লুঙির কাদা, মেয়েটার শরীরে আর জামাকাপড়ে কাদা, লক্ষণ মিলিয়ে দেখেছিল সবাই। বোঝা যাচ্ছিল সেম কাদা। তার ওপর মেয়েটা আঁ আঁ করে এবং আঙুল তুলে শ্রীদামকেই দেখিয়ে দিয়েছিল।
প্রথমে শ্রীদামের পেটে লাথি মেরেছিল নন্দন ভুঁইমালি। নন্দন হ’ল পঞ্চায়েতের মেম্বার। তার নিজের গ্রুপের সর্দারও বটে। গাঁজার ছিলিম হোক, রঙিন পাত্তর হোক, আর সালিশি সভায় ফাইন আদায় হোক– বউনি তার হাতে, প্রথম কথা এবং শেষ কথা সেই বলে। সুতরাং প্রথম লাথি মারার হক তারই জন্মায়।
ভাদ্রমাসের গুমোট গরম ছিল সেদিন। আকাশ মেঘলা, সকাল থেকে ঝিরিঝিরে বৃষ্টি। কেমন যেন আলসেমি লাগে। কাজকর্মে বেরোতে ইচ্ছে করে না। কথা নেই, বার্তা নেই, শরীরটা আইঢাই করে ওঠে। নদীর পারে শেয়ালকাঁটা আর বুনোকুলের ঝোপের আড়ালে বসে নীলসুতোর হাতবাঁধা বিড়িতে সবে একটা সুখটান দিয়েছে নন্দন, তখন একটা সন্দেহজনক শব্দ সে পেয়েছিল। কিন্তু গা করেনি। ভ্যাপসা গরমে পাটখেতের ছায়ায় ঠাণ্ডা আলের ওপর সাপখোপ বিশ্রাম নেয়। সেখানে ছুঁচো বা ইঁদুরের দৌড়োদৌড়ি হতে পারে। পাটখেতের আড়ালে তার মত কেউ বসতেও পারে। দিনের প্রথম বিড়িটার ধোঁয়া টানার পর সুখটা বুক থেকে মাথা হয়ে সর্ব অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে। কালু মহম্মদের হাতবাঁধা বিড়ির ধকই আলাদা। রিমঝিম রিমঝিম করে সুখটা শেষ পর্যন্ত তলপেটে ধাক্কা দেয়। তেঁতুলগাছির কালভার্টে, পঞ্চায়েত অফিসের দেওয়ালে, প্রাইমারি স্কুলের দেওয়ালে– সর্বত্র লেখা আছে– ঘরে ঘরে শৌচালয়, মাঠেঘাটে আর নয়। কিন্তু পুরনো লোকজন ওই লোকদেখানো একবার ভাঙা বালতি নিয়ে সরকারি ভর্তুকির শৌচালয়ে যায় বটে, পরে বিড়িদেশলাই নিয়ে পাটখেতের আড়ালে বা নদীর পারে ঝোপের আড়ালে যায়। উড়ো উড়ো শোনা যাচ্ছে ‘হাতেনাতে’ ধরা পড়লে নাকি ফাইন হতে পারে।
শ্রীদামের চুলের মুঠি ধরে তার পেটে ক্যাঁত করে লাথি মেরেছিল নন্দন। বাবা গো বলে চিৎকার করে উঠেছিল শ্রীদাম। আর সবাই অপেক্ষা করছিল নন্দনের বউনি হয়ে গেলে তাদের সময় আসবে। কী আস্পদ্দা, বোবাকালা মেয়েটাকে দেখেও তোর কাম জাগে। ভারি গতর দেখলেই নোলা সকসক করে। ভাদুরে কুকুরের মত তোর কামজ্বর আজ ঠাণ্ডা করে দেব।
বল, কোন আক্কেলে তুই পাপকাজ করলি ? শ্রীদামকে চুলের মুঠি টেনে ধরে দাঁড় করিয়েছিল নন্দন।
জানি না। আমারে মেরে ফ্যাল তোরা। মহাপাতকী আমি।
মেরে ফেললে তো ল্যাটা চুকে যায়। কিন্তু আমাদের জেল হয়ে যাবে জানিস না। তাছাড়া আইন আইনের পথে চলবে, আমরা আইন নিজের হাতে নেব না। আগে বল কেন করলি এই কাজ।
বেইমান শরিল, কন্ট্রোল দিতি পারি নাই। বিশ্বেস কর তোরা, হঠাৎ মাথা খারাপের মত লাগল। তখন আর ভয়ভীতি, লজ্জাঘেন্না থাকল না। শালা, হাজারে হাজারে পোকা আমারে দংশন করতিছে যেন। নাচার হয়ে পড়িছিলাম। মনটারে দাবায়ে রাখিছে পুরুষমানুষের শরিল। মহাপাতকীর কাজ করিছি। আমারে তোরা যা খুশি শাস্তি দে।
শালারে খাসি করে দে– জমায়েত থেকে প্রস্তাব উঠেছিল। ধ্বনি ভোটে সহর্ষ অনুমোদন থাকলেও দূরদর্শী নন্দন ইশারায় সবাইকে থামিয়ে দিয়েছিল।
তোর জানা ছিল মেয়েটা এ সময়েই গোরুবাছুর নিয়ে নদীর পারে খোঁটা পুঁততে আসে। কতদিন ধরে ফলো করছিস? ফলস্ দিবি না আমাদের, হঠাৎ হয়ে গেছে– অ্যাঁ? তোর আগে থেকেই প্ল্যান করা ছিল। ব্রয়লার মুরগি দেখে শেয়ালের মত তাক করেছিলি ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য। একটা প্রতিবন্ধী মেয়ে, তোর ইমানধরম বলে কিছু নেই?
তখন আর কিছু মনে থাকে না রে। পুরুষমানুষের শরিলে ভগমান যে কোন বিষ দিল … বিশ্বেস কর তোরা, মিথ্যে বললি আমার মুখে কুষ্ঠ হবে, হঠাৎ কী যেন কামড় দিল। সুমিরে কতকাল ধরে দেখতিছি। আমাগের মরণচাঁদের মেয়ে। কোনও দিন পাপ দৃষ্টি দিয়ে তাকাইনি। ঝিরঝিরে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মেয়েটা গোরুবাছুর খুঁটোয় বেঁধে ফিরে যাচ্ছিল। আকাশ তো মেঘলা, আলো কম। ওরে দেখেই কেমন আইঢাই করে উঠল শরিল। শয়তান এসে আমার কাঁধের উপর বসে কানে কানে কী যে মন্তর দিল। পুরুষমানুষের শরিলির জ্বালাযন্তন্না হারামজাদা ঠিক টের পায়। ফুস্মন্তর দেয়। শয়তান আমারে গুণ করে নিল। তারপর মনে হতি লাগল শরিলি য্যান আগুনের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। পুড়ে যাচ্ছিলাম। শয়তান য্যান কানে কানে কয়– ওই দ্যাখ ঠাণ্ডা জলের নদী। দে, ঝাঁপ দে। এ সুযোগ আর পাবি নারে শ্রীদাম। আমার তখন পাগল-পাগল অবস্থা। বোবা হোক, কালা হোক, অন্ধ হোক, খোঁড়া হোক, মেয়েমানুষের শরিলির জন্যি নাচার হয়ে পড়িছিলাম রে। আমারে মেরে ফ্যাল তোরা।
তেঁতুলগাছির হারু গোস্বামীর খবর পেয়ে তার স্কুটি চালিয়ে দেখা করতে গিয়েছিল পুরন্দর। গোসাঁইজির কৃপায় নাকি মামলামোকদ্দমা, পাশফেল, চুরিডাকাতির কিনারা, অপুত্রকের পুত্রলাভ জলভাত। তাকে খবর দিয়েছিল প্রাইমারি স্কুলের মাখন নন্দী। পুরন্দরের কপাল খারাপ। হারু গোসাঁই গেছে ময়নাপুরে কোন শিষ্যবাড়ি ঝুলনপূর্ণিমার অনুষ্ঠানে। মঙ্গলবারে ফিরবে। দেবীডাঙায় ফিরছিল পুরন্দর। লোকজনের ভিড় দেখে সেও সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সব শুনেছে, সব দেখেছে। নন্দন ভূঁইমালির লোকজন বেশ দলাইমলাই করে শেষে থানায় দেবে ঠিক করেছিল। মামুন রশিদের বাইকে চাপিয়ে রওনা হয়েছিল ওরা। সবাই যখন হাতের সুখ করছে, কে জানে কেন নন্দন একটু দূরে পাটখেতের ছায়ায় আলের ওপর বসে ছিল। কে জানে কেন গম্ভীর মুখে সে ওই দূরে মান্নাবাবুর ধানখেতের দিকে তাকিয়ে ছিল। পুরন্দরের মত তার মনেও হয়তো কোনও গোপন দুঃখ আছে। ওপর ওপর দেখে কি আর সব বোঝা যায়। দেখে মনে হয় বাদুলে মেঘ, আসলে হয়তো খরার মেঘ। জলের নামগন্ধ নেই।
দুই
ব্লক ল্যান্ড রেকর্ড অফিসে ফাইল চালাচালি করে পুরন্দর বেশ ফুলে উঠেছিল। জমিজমার পর্চা, দাগখতেনের হিসেব, দলিলপাট্টা, ওয়াকফ সম্পত্তি, খাসজমি, কৃষিজমি- এসব বিষয়সংক্রান্ত কাগজপত্র নিয়ে সে তার বাড়িতেও প্রায় সমান্তরাল একটা দপ্তর চালাত। গ্রুপ ডি স্টাফদের কুলচূড়ামণি ছিল সে। জমি মাপের হিসেব, চেন ফেলা, সব কিছুই সে নিজের গরজে বড় তাড়াতাড়ি শিখে নিয়েছিল। অঞ্চলের যে কোনও জমির ইতিহাস ভূগোল ছিল তার নখদর্পণে। বাবুদের হাটেমাঠের কাজ সে সেধে করে দিত। ক্রমে দপ্তরে প্রচারিত হয় যে, পুরন্দর সাহা অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং খুব কাজের লোক। দূরের জমিজমা দেখাশোনার জন্য শেষে সে বাধ্য হয়েই একটি স্কুটি কিনেছিল। কথিত ছিল যে, পুরন্দর সাহা পিচঢালা চওড়া পথে তার গাড়ি চালাতে পারে না। বাস্তবিক, সে গ্রামের সরু লিক ধরে আসাযাওয়ায় অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করে ফেলেছিল। সার্কাসে দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটার মত সেও নিপুন ভাবে তার স্কুটি চালাত। একদিনও তার গাড়ির টায়ার লিক ছেড়ে পাশে উঁচু ডাঙায় ওঠেনি।
সেদিন বাড়ি ফিরলে তার অস্থির অস্থির ভাব দেখে বউ ভয় পেয়ে গেল। এমনিতে পুরন্দর লোক খারাপ নয়। শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে যথেষ্ট যত্ন-আত্তি করে। বিয়েশাদি থাকলে দামি জিনিসই উপহার দেয়। তার বউয়ের ধারণা পুরন্দর তাকে বেশ ভালোবাসে, এমন কী সন্দেহ হয় বোধহয় প্রেমও করে। সলিড প্রমাণ হয়তো সে দেখাতে পারবে না, কিন্তু মেয়েরা এসব টের পায়।
কী গো, অমন ছটফট করছ কেন। বললে যে টাউনের পার্টিকে তেঁতুলগাছির জমি দেখাতে নিয়ে যাচ্ছ। পছন্দ হয়নি বুঝি ?
কিছুক্ষণ চুপ করে রইল পুরন্দর। আজকের ব্যাপারটা সে গোপনে সারতে চেয়েছিল। তেঁতুলগাছির হারু গোসাঁইয়ের কথা বেমালুম চেপে যেতে হবে। এ পর্যন্ত যা করেছে, সব তার বউকে লুকিয়েই করেছে। আর, পথে রেপকেসের ঘটনাটা পরে বললেও হবে। শ্রীদাম নামের লোকটা বেশ মার খেয়েছে। সে তো খাবেই। দিনদুপুরে তোর কামবাই চাগাড় দিয়ে উঠল, আর অসহায় মেয়েটার তুই সর্বনাশ করলি। কী যে হয়েছে আজকাল চারদিকে। পেপার খুললে, টিভি খুললে শুধু ধর্ষণ আর ধর্ষণ। ভয় করে না এদের। ধরা পড়লে পাবলিকের মার খেয়ে মরে যেতে পারে, জেল-ফাঁসি হতে পারে, সমাজে বদনাম, ফ্যামিলিতে কলঙ্ক। তবু দেখো বড়জোর দশ মিনিটের সুখের জন্য কেমন রিস্ক নেয়।
ফাটাকপাল নিয়ে জন্মেছি। সব কি আর আমার ইচ্ছেতে হবে।
পুরন্দরের বউ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। কী ভেবে পুরন্দর একথা বলল কে জানে। আজ পর্যন্ত পুরন্দর কোনও দিন তাদের ভাগ্য নিয়ে হা-হুতাশ করেনি। কপালে সন্তান নেই বলেই মেনে নিয়েছে। পুরন্দরকে লুকিয়ে সে অনেক মানত, ব্রত, উপোস করেছে। লাভ হয়নি। পুরন্দরের মুখে ফাটাকপাল শুনে হঠাৎ থমকে গেল সে। মাথা নিচু করে বসে রইল।
পুরন্দরের খেয়াল হ’ল তার কথার অন্য অর্থ করে ফেলতে পারে তার বউ। দুঃখ একটা তাদের দু’জনের মনেই আছে। হালকা একটা মেঘের ছায়ার মত। দু’জনই সেটা লুকিয়ে রাখে, আবার দু’জনই টের পায় কখন কোন কথায় ছায়াটুকু তাদের ছুঁয়ে দিচ্ছে। কোনও কোনও রাতে অন্ধকারেও পুরন্দর টের পায় তার বউয়ের শরীরে শেকড়, তাবিজ, মাদুলি। সেগুলো বড় খোঁচা দেয়। পুরন্দর অন্ধকারেও এমন ভাব করে যেন সে ওগুলো বুঝতে পারেনি। যেন ওগুলো আসলে সোনার কোনও গয়না। ওখানে কোনও মন্ত্রতন্ত্র নেই। বউ নিশ্চয় তার মুখে ফাটাকপাল শুনে তাই ভেবেছে।
বড়পার্টি ছিল। ভেবেছিলাম নদীর ওপর ব্রিজ হবে শুনলে হয়তো আজই বায়না করে ফেলবে। নোটিস বেরোতেই তো লাফ দিয়ে জমির দাম চড়ে গেছে। শেষ মুহূর্তে ফোন করে বলল আজ নাকি বেলা দু’টো দশ গতে বারবেলা পড়বে। আজ আর শুভকাজে বেরোবে না। সামনের বিষ্যুতবারে এগারোটা নাগাদ আসবে। মুশকিলে ফেলল, সামনের বিষ্যুতবারে ক্যাম্পের লোকজন আসবে। আমাকে থাকতেই হবে।
চা দেব ? মুড়ি মেখে দিই ?
দাও। আর শোনো, মঙ্গলবারে আমি একটু তেঁতুলগাছি যাব। অন্য কাজ আছে। সাধু মোদকের জলভরা আনব নাকি? তোমার তো খুব পছন্দের।
সত্যি পুরন্দরের কপাল খারাপ। কিছুতেই আর হারাধন গোস্বামীর নাগাল পাচ্ছিল না সে। শেষপর্যন্ত কার্তিকের গোড়ায় গিয়ে তার দেখা পেল পুরন্দর। ভেবেছিল ক্যালেন্ডারে যেমন সাধুসন্ন্যাসীদের ছবি থাকে, মাথায় জটা, দাড়িগোঁফ, তুইতোকারি দিয়ে কথা শুরু করে, মনে হয় যেন মাথার পেছনে একটা সুরক্ষাচক্র বাঁইবাঁই করে ঘুরছে, একবার চোখের দিকে তাকিয়েই ভেতরের সব কথা চোষকাগজের মত শুষে নেয়, পড়ে ফ্যালে– হারাধন গোস্বামী তেমনই হবে। গিয়ে দেখল বারান্দায় একটা লাল প্লাস্টিকের চেয়ারে একজন লোক বসে আছে। গায়ের রং ফর্সা, কিন্তু একটু হলদে ভাব আছে। গাল ভাঙা, পরিষ্কার করে কামানো মুখ। ফলে চোয়ালের হনু আরও বেরিয়ে এসেছে। চেয়ারের উল্টোদিকে একটা বেঞ্চ পাতা। সাদা ধুতি লুঙির মত করে পরা। খালি গা, গলায় পৈতা খুব পরিষ্কার। একটা রুদ্রাক্ষের মালা নাইকুণ্ডলী পর্যন্ত দুলছে। দেওয়ালে দক্ষিণাকালীর ছবি। নীচে একপাশে বিবেকানন্দ, একপাশে শ্রীরামকৃষ্ণ, মাঝে রক্তজবা। হালকা ধুপকাঠির গন্ধ রয়েছে। পেছনে, আশেপাশে তাকিয়ে পুরন্দর দেখল টোটাল জমি দশকাঠার ওপর কয়েক ছটাক হতে পারে।
আসুন, আমিই হারাধন গোস্বামী। লোকজন আমার কাছেই হারু গোসাঁইয়ের খোঁজ করে। সবাই ভাবে বড় বড় দাড়িগোঁফ আর গাঁজা না খেলে আর কীসের সন্নেসী। বুঝলেন না, ভেক না থাকলে ভিখ মেলে না। এ লাইনে দু’নম্বরি মানুষজনের ছড়াছড়ি। সবাই সাক্ষাৎ ভৃগুর শিষ্য। আচার্য আর বাবাদের ভিড়ে আসল সাধক চিনে নেওয়াই মুশকিল।
চেহারা আর কথা শুনে পুরন্দর একটু ধাতস্থ হ’ল। সাদামাটা মানুষ, অথচ মাখন নন্দী বলেছিল নাকি সাক্ষাৎ দৈবজ্ঞ। গ্রহনক্ষত্রের গতিবিধি আর সমুদ্রবিজ্ঞান তার হাতের মুঠোয়। সব জ্যোতিষী বারবার হারু গোসাঁই একবার। কত বেয়াড়া গ্রহের চালচলন সিধে করে দিল। কত লোকের মুখে হাসি ফুটল তার কাছে গিয়েই না। শুনতে শুনতে বেশ শীতল বাতাসে পুরন্দরের বুকের ভেতরে খেলা করছিল। সমস্ত শরীর দিয়েই সে মাখন নন্দীর কথা শুষে নিচ্ছিল।
বলুন, প্রব্লেমটা কী ? জন্মছক এনেছেন ? আপনার তো মশাই পেয়েও হারানোর যোগ।
কাচপোকার সামনে বেবশ আরশোলার মত বসে ছিল পুরন্দর। হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। ঘরে ঢুকে একটা পাওয়ার কাচ এনে খুঁটিয়ে দেখেছিল হারু গোসাঁই। বিনবিন করে সমস্যার কথা বলেছিল পুরন্দর। তার দশ বছরের ম্যারেড লাইফ, টাকাপয়সা, ঘাম ইতাদি প্রচুর ঝরিয়েও কোনও ফল পায়নি। ডাক্তার বলেছে কারও কোনও সমস্যা নেই। অথচ …
ধুর মশাই, এসব গ্রহনক্ষত্রের লীলাখেলা, ডাক্তার আমার ইয়ে ছিঁড়বে। কিছু মনে করবেন না, আমার মুখ একটু ইয়ে আছে। এসব শাস্ত্র যখন তৈরি হয়েছে, তখন কোথায় ছিল আপনার এম বি বি এস ডাক্তার। মিসেসকে একবার আনতে পারবেন ?
একটু চিন্তা করে মাথা নেড়েছিল পুরন্দর। মিসেসকে লুকিয়ে তার এখানে আসা। বউ জানে এ ব্যাপারে তার কোনও আবাহন-বিসর্জন নেই। কপালের লেখা বলে মেনে নিয়েছে। এসব জানলে তার দুঃখ টের পেয়ে যাবে তার বউ। সন্তানের জন্য পুরন্দরেরও ভেতরে ভেতরে ছটফটানি আছে তবে।
ঠিক আছে, ফ্যামিলিকে আনার দরকার নেই। মিসেসের ডেট অফ বার্থ মনে আছে ? বলুন তো … ভাববেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে। আদরগঞ্জের ভবেশ উকিলকে চেনেন ? সেম কেস। তার ছেলে এবার ক্লাস ফোরে উঠল। মানুষের ক্ষমতা কতটুকু বলুন, আমরা ধরুন এই চোখ দিয়ে মাত্র সাতটা রং দেখতে পাই, লিমিটেড কিছু শব্দ শুনতে পাই। অথচ দেখুন সাপ, পাখি– এরা তার বাইরেও কিছু রং দেখতে পায়। শুনতে পায়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্য কতটুকু আর মানুষ জানতে পেরেছে। সব কন্ট্রোল হচ্ছে ওই, ওই ওপর থেকে। যা বলব, করতে পারবেন ? দাঁড়ান, পঞ্জিকাটা একবার দেখে নিই। কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তো, মনে হয় মঙ্গলবার পড়বে।
তিন
গভীর রাতে বিছানা ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠল পুরন্দর। একবার দেয়ালের ঘড়ি, তারপর মোবাইল খুলে সময় দেখে নিল। সময় হয়ে এসেছে। রেডি হতে হবে। এখনই জিনিসগুলো প্লাস্টিকের ছোট প্যাকেটে মুড়ে পকেটে ভরে নিতে হবে।
মালা, সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমাকে এখনই উঠতে হবে।
সে কী গো, কীসের সর্বনাশ? বাবাগো, বুক কাঁপছে আমার। শিগ্গির বলো কী হয়েছে, কোথায় যাবে এখন?
আমার অফিসের ব্যাগ পাচ্ছি না। পেটমোটা চামড়ার ব্যাগটা। ওর ভেতরে সব দলিলপত্র, জমির পাট্টা, নামজারির নোটিস, বায়নানামা– আমার সর্বস্ব রয়েছে। আমার নিজের নথিপত্র, অফিসের কাগজ। একটা সাইডব্যাগে ভরে কাঁধে নিয়ে আমি বেরোই।
কী সর্বনাশ , কী হবে এখন।
দাঁড়াও, মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবতে দাও। আজ ক্যাম্প থেকে ফেরার পথে সন্ধেবেলা কোথায় দাঁড়িয়েছিলাম বলো তো? স্কুটি স্ট্যান্ড করে … ভীষণ বেগ এসে গিয়েছিল। অনেকক্ষণ ধরেই তলপেট ভারি হয়ে ছিল। বাড়ি এসে বাথরুম যাওয়ার আর সময় ছিল না। মনে হচ্ছে ওখানে কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে গাড়ির হ্যান্ডেলে ঝুলিয়েছিলাম। নির্ঘাত ওখানেই পড়েছে।
কোথায় দাঁড়িয়েছিলে? ভালো করে ভেবে দ্যাখো। ব্যাগ হারালে অনেক ঝামেলা হবে, তাই না?
ঝামেলা মানে? চাকরি তো যাবেই। জেলের ভাত না খেতে হয়। আরে হাউমাউ করে কান্নার কী হয়েছে। তুমি না খেয়ে থাকবে না। সে ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি।
ঠাকুর, হে রাধামাধব, ব্যাগ যেন পাওয়া যায়। এই মানত করলাম …
মালা, মানত করলে ব্যাগ পাওয়া যাবে না। আমাদের খুঁজে দেখতে হবে।
কান্নার হেঁচকির মাঝেও মালা খেয়াল করল পুরন্দর ‘আমাদের’ বলেছে। হঠাৎ বিপদের মাঝেও তার সুখ হ’ল। তারও একটা দায়িত্ব আছে ব্যাগ খুঁজে বার করার।
বড় টর্চটা তুমি হাতে নাও। আমি ছাতা নিচ্ছি। আকাশে মনে হ’ল মেঘ থম মেরে রয়েছে। অন্ধকারে ঝোপঝাড়ে হাটকাতে হবে, হাতে কিছু থাকা ভালো। লাঠিকে লাঠি, ছাতা কে ছাতা।
মনে পড়েছে, কোথায় দাঁড়িয়েছিলে? জয় মা মঙ্গলচণ্ডী, মঙ্গল কর মা।
হ্যাঁ, মনে পড়েছে। নদীর পারে পাটক্ষেতের পাশের আলে দাঁড়িয়েছিলাম। টর্চটা নিয়েছ?
তুমি আবার হাতে ঘড়ি পরছ কেন এখন। তাড়াতাড়ি চল। কারও চোখে পড়লে আর ফেরত পাওয়া যাবে না। লুঙি পরেই যাবে? বাইরে কিন্তু মিহি ঠাণ্ডা আছে। একটা চাদর নেবে নাকি?
নদীর পারে একটা পরিষ্কার জায়গা খুঁজছিল পুরন্দর। তখন শরীরে কৃষ্ণপক্ষের একাদশীর চাঁদের আলো খেলা করবে। মালার শরীরে একটি সুতোও থাকবে না। সম্পূর্ণ নিরাবরণ, নিরাভরণ মালাকে গ্রহণ করতে হবে। মনে কোনও পাপ বোধ থাকবে না। পবিত্র অন্তরে, যেমন কাদা-কাদা মাটিতে বীজধান ছড়ায় চাষা, তেমনই করে তার মিসেসের জমিতে বীজ ছড়াতে হবে। আর, চূড়ান্ত মুহূর্তের আগে মিসেসের কানে কানে বলতে হবে ‘নমো ব্রহ্মা, নমো প্রজাপতি, নমো পদ্মযোনি বিশ্ববীজ’। ফ্যামিলির মাথার কাছে থাকবে অন্ন আর রবিশস্য। মসুরি ডাল, যব, পেঁয়াজ, মটরশুঁটি। সব সে নিয়ে এসেছে।
টর্চের আলো একটা আলোর বল্লমের মত অন্ধকার ফুঁড়ে ঘাসজমির এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিল। লেদারের পেটমোটা ব্যাগ পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষে একটা জায়গা পছন্দ হ’ল পুরন্দরের। বাঁ দিকে কালকাসুন্দির ঝোপ, হলুদফুল আর শুটিগুলো অস্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, সামনে ঘন পাটক্ষেত, পাটপাতার গন্ধ পাচ্ছিল পুরন্দর, ডানদিকে বাঁশঝাড়।
না, এখানে নয়। মনে হচ্ছে ক্যাম্পেই ফেলে এসেছি। বাপরে, টায়ার্ড হয়ে গেছি। চল, ওখানে একটু বসি। এই যে, এখানে।
মালা আর পুরন্দর পাশাপাশি বসেছিল। টর্চ জ্বালিয়ে পুরন্দর ঘড়ি দেখল। মালা একটা ফুলছাপ শাড়ি পরে এসেছে। এটাই ঘরে পরেছিল মালা। একটু বাদেই এই শাড়ি খুলে ফেলতে হবে- ভাবছিল পুরন্দর। এখন অন্ধকারে শাড়ির ফুল স্পষ্ট নয়।
মালা, কেমন অদ্ভুত লাগছে, তাই না? এরকম অন্ধকারে, খোলা আকাশের নীচে, তুমি আর আমি পাশাপাশি … এই, আমার খুব সেক্স পাচ্ছে। অন্য রকম, তাই না ?
হুঁ, আমারও কেমন যেন লাগছে। মেঘ না থাকলে অনেক তারা দেখা যেত। তুমি ধ্রুবতারা চেনো? উত্তর আকাশে? এই, কী করছ, চাদ্দিক খোলা … উম্ম্।
আকাশিলন্ঠনের মরমর আলো এসে পড়েছে ওদের ওপর। পুরন্দরের পকেটে খসখস করছে প্লাস্টিকের মোড়কে অন্ন আর রবিশস্য। পুরন্দরের হাত ঘুরে বেড়াচ্ছে মালার শরীরের খাঁজেভাঁজে। কোমর থেকে শাড়ির বাঁধন খুলে নিচ্ছে, শায়া খুলে নিচ্ছে, ব্লাউজের বোতাম খুলে নিচ্ছে পুরন্দরের কৌশলী হাত। পুরন্দর বুঝতে পারছে মালার জেগে ওঠা।
এই না, এখানে এসব কী করছ। ঘরে চল। খোলা জায়গায় আমার কেমন অস্বস্তি হচ্ছে।
তোমার ইচ্ছে করছে না? বেশ নতুন রকম। ফিসফিস করে বলল পুরন্দর। কোমরের এই সুতোটা কীসের? খোলো। হাতে এটা কী পরেছ, শক্ত। খোলো।
মালা অবাক হচ্ছিল, লজ্জা পাচ্ছিল। তার শরীরের এসব তাগাতাবিজ, শেকড়বাকড় নিয়ে কোনও দিন পুরন্দর কিছু বলেনি। আজ হঠাৎ সে এসব খুলে ফেলতে বলছে। অন্ধকার, তবু লজ্জা পাচ্ছিল মালা। দু’হাত দিয়ে বুকের তীক্ষ্ণতা আড়াল করার চেষ্টা করছিল। জানুসন্ধি থেকে পুরন্দরের হাত সরিয়ে দিচ্ছিল। বড় তাড়াহুড়ো করছে পুরন্দর।
মালার এই প্রতিরোধ কিছু একটা ঘটিয়ে দিল পুরন্দরের ভেতরে। মুহূর্তে তার শরীরজুড়ে আগ্নেয়গিরির লাভা পাতালনদীর তীব্র আগুন নিয়ে হিংস্র একটা জন্তুর মত, হাজার বছরের বুভুক্ষু জানোয়ারের মত একটা নারীশরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। নারীশরীর, স্তননিতম্বজঙ্ঘায় পরিপূর্ণ নারীশরীর। মালা তখন কারও মিসেস নয়, কারও ফ্যামিলি নয়, শুধুই এক নারী। মেয়েছেলে।
মালার মুখ চেপে ধরে তাকে রেপ করছিল পুরন্দর। সব ভুলে মালাকে, তার মিসেসকে ধর্ষণ করছিল পুরন্দর। অন্ন এবং রবিশস্যের কথা, ‘নমো ব্রহ্মা, নমো প্রজাপতি, নমো পদ্মযোনী বিশ্ববীজ’– বিলকুল ভুলে গিয়েছিল সে। মাথার ওপরে মেঘে ঢাকা আকাশ, ফাঁকে কখনও কৃষ্ণা একাদশীর চাঁদ, নদীর পার থেকে বয়ে আসা বাতাস আর মালার বিস্ময়– সব মিলে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল পুরন্দর। চিরকালের পুরনো, বহুব্যবহৃত বিছানা আর মশারির বাইরে, যেন এক নারীকে সে ফুসলে এনেছে অন্ধকারে, আড়ালে। এই ভাবনায় তার শরীরে ভরাজোয়ার উঠল। তাকে উন্মাদ করে দিচ্ছিল শরীরজুড়ে অদৃশ্য পোকার কামড়। এই পাগলামি থেকে মুক্তির জন্য সে মালার শরীর থেকে সব তাবিজকবচ ছিঁড়ে ফেলার কথা ভুলে গিয়েছিল। ভুলে গিয়েছিল তার জামার পকেটে অন্ন আর রবিশস্যের কথা। কী যেন বলতে হবে– প্রজাপতি…যোনি…বীজ, মনে পড়ল না। নাচার এক পুরুষের মত হারামজাদা শরীরের কাছে হেরে গিয়েছিল বি এল আর অফিসের গ্রুপ ডি স্টাফ পুরন্দর মাইতি। মালা বাধা দিলে যেন আরও উচ্ছসিত হয়ে উঠেছিল তার শরীর। আঁচড়ে কামড়ে মালাকে রেপ করতে চেয়েছিল পুরন্দর। আদিম কোনও জন্তুর মত, অনেক যৌনকাতর সঙ্গীকে হিংস্র কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে সে পেয়েছে একটি মাদি জন্তুর শরীরের অধিকার। মুখ চেপে ধরেছিল মালার। বিস্ময়ে, ভয়ে মালার চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠেছিল। অন্ধকারেও পুরন্দরের চোখে সবুজ আভা দেখল সে।
যৌনকাতর কোনও জন্তুর মত পুরন্দর তার বউ মালাকে যৌনপ্রহার করছিল। তখন তার আর কিছুই মনে ছিল না। এর আগে কতবার তাদের মিলন হয়েছে, অথচ আজ যেন চূড়ান্ত রতিসুখসারের আস্বাদ পাচ্ছে পুরন্দর। পাতালনদী বেয়ে দুরন্ত ক্রোধে উঠে আসছে আগুনের স্রোত। ভয়ঙ্কর একটা মহাবিষ্ফোরণের জন্য অপেক্ষা করে আছে আদিম এক অসহায় পুরুষ। পুরুষ নয়, পুরুষতন্ত্রই যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছে নারীশরীরের ওপর। হয়তো ভাবছে বশ্য মালা কিছু বলতে পারবে না, সাময়িক বোবা হয়ে যাবে। বধির মালা তার কুৎসিত, অপমানজনক শব্দগুলো কিছুই শুনতে পাচ্ছে না।
রাত প্রায় পুইয়ে এসেছে। একটু বাদেই কোনটা পুবদিক, চিহ্ন ফুটে উঠবে। অন্ধকার আস্রাবিত হয়ে ক্রমে স্বচ্ছ হয়ে উঠবে, সেটাই পুবদিক। চেতনাহীন মালা শুয়ে আছে সবুজ ঘাসের ওপর। নগ্ন সেই দৃশ্যের দিকে তাকাতে ভয় করছিল পুরন্দরের। ফেলেরাখা লুঙি আবার পরে নিয়েছে সে। অবসন্ন শরীরে উঠে ন্যাড়াখেতের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ধূসর একটা বস্তু অঘ্রাণের ন্যাড়া খেতের ভেতর দিয়ে ভীতু কোনও প্রাণীর মত ঘুরে বেড়াচ্ছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় রাতচরা কোনও প্রাণী। রাতচরা প্রাণীরা এখন খুব ব্যস্ত। আলো ভালো করে ফুটে ওঠার আগে গাছের কোটরে, মাটির নীচে গর্তে ফিরে যেতে হবে। যতক্ষণ না আবার আকাশের দবদবে আগুনের গোলাটা তলিয়ে না যায়, ততক্ষণ অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা ওদের।
আমন ধান গোলায় উঠে গেছে। শূন্য খেতের আলপথ পা রাখল পুরন্দর। চেনাপথটুকু পার হওয়ার পর কুয়াশার ভেতর দিয়ে ক্রমে এগিয়ে চলল পুরন্দর মাইতি। সামনে কুয়াশার ভেতর দিয়ে অস্পষ্ট একটা প্রাণী ক্রমে মিলিয়ে যাচ্ছে। তার হাতে কুড়িয়ে পাওয়া আমন ধানের ছড়া। শস্যমঞ্জরী থেকে, খোসার আড়াল থেকে জমাটবাঁধা দুধের গন্ধ পাচ্ছিল পুরন্দর। সেই সংকেত ধরে ধরে একটা অচেনা পথে ঢুকে পড়ল।
এ কোন অজানা, অচেনা পথ। এখনও মৃদু অন্ধকার। এখনও দেবীডাঙা, তেঁতুলগাছি, ময়নামারি, সাধুর ডাঙা, পাথরগুড়ি– সব সমান। কিন্তু এ পথ পুরন্দরের অজানা ছিল। গঞ্জজুড়ে কতকাল ধরে সে স্কুটি হাঁকাচ্ছে। কত খানাখন্দ, নাবালজমি, নদীর সোঁতা, বিশাল মাঠ সে পার হয়েছে। বায়নানামা, দলিল, এফিডেভিট, জমির পাট্টা, ডিড- কত কিছু লোড করে কত কিলোমিটার পার হয়েছে। সবই তার চেনা। কিন্তু আজ এ কোন পথে অন্ধকারের ভেতর দিয়ে আপনা হতে সে ছুটে চলেছে। আস্তে আস্তে তার কন্ট্রোলের বাইরে চলে যাচ্ছে তার পাদুটো। কাল রাতে কখন বৃষ্টি হল। এত কাদা, এত পিছল হয়েছে পথ। আর, অন্ধকার কেন আরও ঘন হয়ে আসে– গ্রুপ ডি স্টাফ বোঝে না।
অসংখ্য তারায়-ভরা পথের ইশারাটুকু ধরে ধরে পুরন্দর এগিয়ে যেতে থাকে। তার মাথায় কুয়াশা জমে। কুয়াশায় ভেসে ভেসে এগিয়ে যায়। শূন্যে উঠে যায়। একটা তীব্র ইচ্ছের মত ধুলোয়-ভরা এই পৃথিবীর আকর্ষণ তুচ্ছ করে অনেক ওপরে উঠে গেল পুরন্দর। বাতাসের সীমা পার হয়ে ঝাঁপ দিল মহাশূন্যে। জ্যোতির্ময় কত নক্ষত্রের পাশ কাটিয়ে ছুটতে থাকে অবিশ্বাস্য গতিতে। কত নীহারিকা ছাড়িয়ে, ধূমকেতুর সঙ্গে সংঘর্ষ এড়িয়ে ছায়াপথ ধরে এগিয়ে চলে মুক্তিবেগ পাওয়া মহাকাশ যানের মত।
যেতে যেতে সে কত নক্ষত্রের জন্ম দেখল, মৃত্যু দেখল। কত চন্দ্রসূর্য পার হয়ে গেল। পুরন্দর চলতেই থাকে। ঘন অন্ধকার। গর্ভমন্দিরের আদিম অন্ধকার। একটা জন্মবীজের মত ছুটে যাচ্ছে লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে অপেক্ষা-করে-থাকা একটা প্রাচীরের দিকে।
এই প্রাচীর একটা কুসুম-কুসুম ইচ্ছেকে ঘিরে রেখেছে কত জন্মযুগ ধরে। চরাচরের সমস্ত নিষ্প্রাণ ধূলিকণা বিদ্ধ হবে বলে, প্রাণময় হয়ে উঠবে বলে জমাট পিন্ড হয়ে অপেক্ষা করে আছে। বীজ না এলে, ওই প্রাচীরে আঘাত না করলে ফুল ফুটবে কেমন করে। ময়ূর নাচবে না। ধানের খোসার আড়ালে দুধ জমাট বাঁধবে না। যেখানে যা কিছু প্রাণ, উষ্ণতা– সব মিথ্যে হয়ে যাবে।
ছোট্ট একটা রুপো-রুপো তারা ঘোমটা সরিয়ে বলল– কে যায় ?
–আমি গো, দেবীডাঙার পুরন্দর।
–এসো
রুপো-রুপো তারার বাইরের প্রাচীর থরথর করে কাঁপছে। অনন্ত নক্ষত্রলোক জুড়ে বেজে উঠল শিবরঞ্জনী। প্রণবধ্বনির মত।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে এখানে ক্লিক করুন