short-story-apalak-somoy

অপলক সময়
নাসরিন জাহান মাধুরী


পলাশপুর গ্রাম। নিতান্ত দরিদ্র মানুষের বাস ঐ গ্রামে। ৭১-এর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সেই সময়টা। কোন উন্নয়নের ছোঁয়া এই গ্রামে তখনো লাগেনি।

জলিল সাহেব লুঙ্গী পাঞ্জাবী পড়ে ডাক্তারি ব্যাগ হাতে ছুটছেন গ্রামের এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি, এটা নৈমিত্তিক দৃশ্য।

আজ একবাড়িতে রোগী দেখার সময় জলিল সাহেবে সপ্তম সন্তান দৌঁড়ে এসে জলিল সাহেবকে বললো, “আব্বা তাড়াতাড়ি বাড়ি আসেন, আম্মর যেনো কি হয়েছে।”

খুব বিরক্ত হয়ে তাকালেন তিনি ছেলের দিকে, “এখানে আসলি কেন হারামজাদা? যা বাড়িতে আমি আসছি।”

জলিল সাহেবের কোন ডাক্তারি ডিগ্রী নেই, তবে কিছু পড়াশোনা করেছেন ডাক্তারি বিদ্যায়। গ্রামেও কোন ডাক্তার নেই, তাই তার উপরই নির্ভর করে সবাই। আয় রোজগার মোটামোটি বেশ।

তিনি মহা বিরক্ত হয়ে বাড়িতে এলেন। এসে দেখেন ওঁর স্ত্রী প্রসব ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। খুব দুর্বল শরীর। জলিল সাহেব গ্রামের দাইকে খবর পাঠালেন। 

দাই আসার কিছুক্ষণের মধ্যে ওঁর স্ত্রী তার চৌদ্দতম সন্তানের জন্ম দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।

থমকে গেলেন জলিল সাহেব। এইতো সেদিন পুতুলের মতো বউটিকে ঘরে তুলে আনলেন। রূপে গুণে লক্ষ্মী সরস্বতী। কি ভালোবাসা দুজনের! কি শখ করেই না ঘরে তুলেছিলেন এই অসম্ভব রূপবতী বউটিকে। বছর না ঘুরতেই প্রথম মেয়েটি জন্ম নিলো। তাই মন খারাপ ছিল জলিল সাহেবের। প্রথম সন্তান মেয়ে হলো! রাগে গজগজ করতে থাকেন। আঁতুড়ঘরে শুয়েই ওঁর স্ত্রী সব শুনতে পান, কোলের শিশুটির দিকে তাকিয়ে চোখ ফেটে কান্না আসে। কান্না আটকে রেখে শিশুটির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করেন, কেন এলি এই দুনিয়ায়! এলিই যদি ছেলে হয়ে কেন এলি না? আমি একটু শান্তি পেতাম, রে, আমার কলিজার টুকরা।

ছেলের আশায় পরপর চার মেয়ের জন্ম হলো। পঞ্চম বার বিধাতা মুখ তুলে চাইলেন। পুত্র সন্তানের বাবা হলেন তিনি। আহা কি আনন্দ! সারা গ্রামে মিষ্টি বিতরণ করলেন। ঘরে বংশের বাতি এলো যে! আনন্দের আর সীমা নেই।

তার বউয়ের অদ্ভূত প্রাণশক্তি, সংসারের কাজ, সন্তান লালন, স্বামীর দেখভাল সব করে যান একহাতে। বছরে একটি করে সন্তান উৎপাদন!

কিন্তু না! শেষমেশ আর পারলেন না। সন্তান জন্মদানের সময় প্রচুর রক্তক্ষরণ হয় তার। ডাক্তার হয়েও কিছু করার রইলোনা তার। শুধু দেখলেন তার স্ত্রীর চলে যাওয়া। কোন রকম আবেগই প্রকাশ করলেন না জলিল সাহেব।

স্ত্রীর অন্তেষ্টিক্রিয়া সুসম্পন্ন করার পরদিন, বড় মেয়েকে ডাকলেন। বড় মেয়ে রাবেয়া মায়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে পিত্রালয়ে এসেছে। মেয়েকে ডেকে বললেন, এ সংসার টিকিয়ে রাখতে হলে একজন স্ত্রীলোকের প্রয়োজন, তাই তিনি আবার বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

মেয়ে বাবার কথা শুনে হতভম্ভ! একি কথা! পাঁচ দিনও হয়নি মায়ের মৃত্যুরর মাঝেই বাবা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলো! মায়ের জন্য কোন ভালোবাসাই ছিলো না?

মেয়ে চুপ করে আছে দেখে বাবা রাগত স্বরে বললেন, “বিয়ে না করলে এ সংসার কে সামলাবে। এতগুলা ছেলেমেয়ে মানুষ করবে কে?”

বাবার কথায় ভীষণ রাগ হলো রাবেয়ার। সে ভাবনায় পড়লো। পাঁচ দিনও হয়নি মা নেই। মায়ের জন্য খুব কষ্ট হলো তার। কিসের জন্য তার মা এই সংসারের জন্য খেটে মরলো?

বছর ঘুরতে না ঘুরতে ওর একেকটা ভাইবোনের জন্ম দেখেছে। প্রসূতি মা দুই দিন যেতে না যেতেই আবার সংসারের হাল ধরেছে। না ধরে উপায় কি? এতগুলো ছোট শিশু এদের জন্য নূন্যতম আহার তো তৈরি করতে হবে।

রাবেয়া বিয়ের আগে মাকে সহয়তা করতো সংসারের সব কাজে। হুট করেই একদিন ওর বিয়ে হয়ে গেলো পাশের গ্রামের এক রেশন ডিলারের সঙ্গে। রাবেয়ার মা মেয়েকে বিয়ে দিয়ে নিজেও একটু একা হয়ে গিয়েছিলেন। প্রথম সন্তান হিসেবে একটা অন্যরকম মায়াও ছিলো।

রাবেয়ার খুব মন খারাপ হলো। মায়ের জন্য তার বাবার কি একটুও ভালোবাসা ছিলো না? নইলে কেমন করে পারলেন বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে। ছোট ভাইবোনদের দিকে তাকিয়ে মনে হলো তার বাবা ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। এদের দেখভালের জন্য একজন মানুষ প্রয়োজন। তাকেও চলে যেতে হবে শ্বশুরবাড়ি। শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে অনির্দিষ্টকাল বাপের বাড়ি থাকতে দেবে না।

রাবেয়া মোহর আলি ঘটককে খবর দিলো, বললো ওর বাবার জন্য একজন সহধর্মিণী দরকার। তার ভাইবোনকে দেখাশোনা করবে, সংসার সামলাবে। বিধবা বা তালাকপ্রাপ্ত, কোন আপত্তি নেই, শর্ত শুধু একটাই, ঐ নারীকে বন্ধ্যা হতে হবে।

রাবেয়া ভেবে দেখলো এমনিতেই ওরা চোদ্দ ভাইবোন, আর নতুন বউ এসেই যদি ওর ভাইবোনের সংখ্যা বাড়াতে থাকে তবে তো এই সংসার এমনিতেই লাটে ওঠবে। ছোট ভাইবোনদের দিকে তাকিয়ে খুব অসহায় বোধ করে রাবেয়া।

মায়ের কথা খুব মনে পড়ে, ওদের পারিবারিক কবরস্তানে মায়ের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। তার চোখ থেকে নামে জলের ধারা।

দুইদিন যেতেই মোহর আলি ঘটক হাজির। রাবেয়া তখন উঠানে ধান শুকাচ্ছিল। ওর সদ্যোজাত বোনটাকে রাবেয়ার আরেক বোন সালমা কোলে নিয়ে বারান্দায় বসে আছে। মাকে হারানোর পর সালমাই যেন ওর মায়ের দায়িত্ব নিয়েছে।

মোহর আলি ঘটক জানালো পাত্রীর খোঁজ। পাশের গ্রামের মিয়া বাড়ির মেয়ে। তালাক প্রাপ্তা। বারো বছর সংসার করার পরও কোন সন্তানের জন্ম দিতে পারেনি। তাই আগের স্বামী তালাক দিয়েছে বন্ধ্যা অপবাদ দিয়ে। পাত্রীর আর কোন খারাপ গুণ নেই। নম্র, ভদ্র সংসারী। রাবেয়া খুশিই হলো। যেভাবে হোক ওর বাবার বিয়ে সুসম্পন্ন করে তাকেও যেতে হবে শ্বশুরবাড়ি। তাগাদা আসছে।

রাবেয়া জানালো তার বাবাকে। বাবা পাত্রীর খোঁজ পেয়ে মহা খুশী। তড়িঘড়ি রাজি হয়ে গেলেন বিয়েতে। খুবই অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিয়ের কাজ সম্পন্ন হলো। মেয়ের পরিবার যেনো তাকে বিদায় করতে পারলেই খুশি। তাই তারাও পাত্র পেয়ে দেরী করেনি।

জলিল সাহেব তার দ্বিতীয় বউকে ঘরে তুললেন। ছেলেমেয়েদের ডেকে বললেন “ইনি হলেন তোমাদের নতুন মা। আজ থেকে তাকে সবাই আম্মা বলে ডাকবে” ছেলেমেয়েগুলো আহত চোখে ওদের বাবার দিকে তাকিয়ে ছিলো। কেউই মায়ের জায়গা ঐ মহিলাকে দিতে রাজি নয়।

নতুন বউ নিজেই এগিয়ে গেলেন, সবাইকে আপন করে নিলেন। সালমার কোল থেকে শিশুটিকে নিয়ে বুকে চেপে ধরলেন। তার চোখ থেকে অশ্রু ঝরছিলো, কষ্টের না আনন্দের বুঝা মুশকিল।

কয় মাস যেতে না যেতেই দ্বিতীয় বউয়ের গর্ভবতী হওয়ার ঘটনায় সবাই অবাক। যে নারীকে বন্ধা বলে অমানবিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে আগের সংসারে, প্রাক্তন স্বামীর লাত্থি গুতা খেয়ে খেয়েও সংসারে থাকতে পারেনি। তালাক দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিলো।

বাবা মায়ের সংসারেও গুল নাহার বোঝা। তাই সুযোগ পেয়েই তার বাবা মা দেরী করেনি বিপত্নীক জলিল সাহেবের কাছে বিয়ে দিয়ে নিজেরা কন্যা দায় থেকে মুক্তি পেতে।

সন্তান জন্ম দিতে না পারাটা অনেক কষ্টের। গুল নাহার জানে সেটা। কিন্তু সমাজ তার এই কষ্টের কথা বোঝে না। সব দায়ভার নারীটিকে সহ্য করতে হবে। কত গঞ্জনা কত ধিক্কার!

গুল নাহার আজ খুব খুশি মা হতে পারার আনন্দে।

বিয়ের প্রথম দুই বছরেই গুল নাহারের কোল আলো করে দুই ছেলের জন্ম হলো।

গুল নাহার হিমশিম খায় নিজের সন্তান, সতীনের সন্তানদের আর স্বামীর মন রক্ষা করতে, আহারের যোগাড় করতে করতে। সন্তানদের পড়ালেখার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করাটাও ছিলো কষ্টকর। বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছেন, তবে ঠিকমতো তদারকি করাটাও ছিলো অসম্ভব।

রাবেয়া আসে মাঝেমধ্যে, এসে চিন্তিত হয়ে পড়ে ওর ভাইবোনের হাল দেখে। কোন যত্ন নেই, সৎ মায়ের জন্যও মায়া হয়। ভাবে বছর বছর এভাবে নতুন সদস্যের আগমন চলতে থাকলে পরিণতি কি হবে?

গুল নাহারকে রাবেয়া আম্মা বলেই ডাকেন, মা-মেয়ের সম্পর্ক না হলেও ওদের মধ্যে একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়। দুজন সুখদুখের কথা ভাগাভাগি করে।

রাবেয়া বোঝায় তুমি সতর্ক না হলে তোমার পরিণতি মায়ের মতোই হবে।

নিজের দিকে তাকাও, কেমন রূপ নিয়ে এসেছিলে। এখন কি হাল হয়েছে তোমার!

গুল নাহার ভাবলো, ওর স্বামী তো এই শরীর ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। ওর ইচ্ছা অনিচ্ছা, চাওয়া পাওয়ার কোন মূল্য নেই যার কাছে, তার শারিরীক চাহিদা মিটাতে গিয়ে বছর বছর মা হয়ে নিজেকে কেন নিঃশেষ করবে?

গুল নাহার রাজি হলো রাবেয়ার কথায়। ওর দুই সন্তান আর আগের সংসারের সবার দেখভালের দায়িত্বতো তারই। তাকে যেভাবেই হোক সুস্থ থাকতে হবে।

একদিন রাবেয়া গুল নাহারকে নিয়ে যায় ফ্যামিলি প্ল্যানিং কার্যালয়ে। সেখান থেকে মাকে লাইগেশন করিয়ে আনে। এবার সে একটু নিশ্চিন্ত।



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *