আত্মসমর্পণ

আত্মসমর্পণ
পলি শাহিনা

বিকেলের উপর সুমনার ভারী মায়া। বিকেল মানে ছায়া, ঝুলি ভরা প্রকৃতির ছায়া। মেঘের ছায়া, গাছের ছায়া, পাখীর ছায়া, প্রজাপতির ছায়া, ফুলের ছায়া, ঘুড়ির ছায়া। বিকেলের ছায়া ওর চারপাশে ঘুরেঘুরে গল্প বলে। সুমনা মন দিয়ে ওদের গল্প শোনে আর অনন্ত ছায়াপথ ধরে হাঁটতে থাকে। বিকেলকে ওর হারিয়ে যাওয়া দাদাভাই-এর ছাতার মত মনে হয়। বিকেল যেন ছায়ার ফেরিওয়ালা।

জাগতিক চাপে সারাদিন তেতেপুড়ে সুমনা অপেক্ষায় থাকে মায়াময় ছায়াঘেরা শীতল বিকেলের জন্য। বিকেল ওর প্রিয়জন। মাঝেমধ্যে বিকেলের প্রেমে আকুল হয়ে মনে মনে ও ইচ্ছে পোষণ করে, যেন প্রিয়তম বিকেলের বুকের সুশীতল ছায়াতলে অবশ্যম্ভাবী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারে শান্তিতে। প্রিয়জনের বুকে মাথা রেখে মরণেও যে সুখ। সুমনার মন আকাশে আজ অবধি সব সুন্দর অনুভূতির জন্ম হয়েছে বিকেলের কোলে মাথা রেখে। দিনভর মাথার উপরে বয়ে যাওয়া সমস্ত চাপ মুছে দেয় বিকেলের স্নিগ্ধ ছায়ার হাতছানি। বিকেলের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকে শ্রান্ত – ক্লান্ত দিন শেষের অপার শান্তি।

শুক্রবার বিকেলের মেঘমুক্ত আকাশ। ছুটির দিন। বাগানবিলাস ফুলের লতানো ডাল ঢুকে পড়েছে সুমনার পড়ার ঘরে। ফুলভারে নুয়ে পড়া গাছটি ঢেকে রেখেছে পুরো ঘরটিকে। কী যে স্নিগ্ধ সুন্দর দেখতে! চোখ-মন-প্রাণ জুড়িয়ে আসে!

সুমনা গাছ থেকে একটি ফুলের থোকা ছিঁড়ে পরম যত্নে গুঁজে দেয় চুলে। কিছু সময় দেয়ালে ঝুলানো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে বিকেলের নরম আলোয় নিজেকে দেখে। আয়না থেকে চোখ সরিয়ে জানালার গ্রীল ধরে ঝুমুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। ছুটির বিকেল সুমনার সময় কাটে প্রিয় বান্ধবী ঝুমুর সঙ্গে। ওরা আজ একসঙ্গে রঙিন কাগজের নৌকা বানাবে, জলে ভাসাবে।

নির্ধারিত সময় পেরিয়েছে বেশ আগে। ঝুমু এখনো আসে নি। ওর আসতে অনেক দেরি দেখে সুমনার কিছুটা মন খারাপ হয়। সে কখন থেকে রংবেরঙের কাগজ হাতে অপেক্ষায় আছে। অবশেষে ঝুমুর দেখা পেয়ে সুমনার মন আনন্দে নেচে উঠে। রোদের ঝাঁঝ একদম নেই বললেই চলে। পাকা লেবুর মতো হলুদ মিষ্টি আভা ছড়িয়ে বিকেল প্রকৃতির বুকে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করছে ওদের দুই সখীর জন্য। ওরা যেমন বিকেলের অপেক্ষায় থাকে, তেমনি বিকেলও যেন অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়ে ওদের অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকে। বিকেল আর ওরা, একে অপরের প্রাণের সঙ্গী। একে অন্যের সান্নিধ্য অনুভব করে প্রাণভরে নিংড়ে নিংড়ে।

ঝুমু দেরি করে এসে কাঁচুমাচু দৃষ্টিতে সুমনার দিকে তাকিয়ে থাকে। সুমনা অভিমানে চুপ করে থাকে। কিছুসময় পর দু’জনের চোখাচোখি, মুখরেখা ফুটে উঠে সহজ হাসিতে। দু’জনে ভালোবাসায় হাত ধরে পা বাড়ায় বাইরে। প্রকৃতির মৃদু সুরভী গায়ে জড়িয়ে ওরা পুকুরের শান্ত জলে পা ডুবিয়ে বসে। রঙিন কাগজের নৌকা বানিয়ে ওগুলো জলে ভাসিয়ে দেয়। নৌকাগুলো ভাসানোর আগে ওরা দু’বান্ধবী মিলে একটা খেলা খেলে। খেলাটা হচ্ছে – প্রতিটি কাগজের নৌকা ভাসিয়ে দেয়ার আগে মনে মনে একটা ইচ্ছে পোষণ করে, কাগজের নৌকাটি যদি না ডোবে তাহলে ইচ্ছে পূর্ণতা পাবে, ডুবে গেলে ইচ্ছে পূর্ণতা পাবে না। কাগজের নৌকাগুলো একটা সময় ঢেউয়ের সঙ্গে ডুবে যেত। তবুও ওরা ছুটির দিনে জীবনকে পূর্ণ গভীরতায় পরম আদরে ভালোবেসে এই খেলাটি খেলে যেত। কারণ, ওরা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসত। ওরা বিশ্বাস করতো, স্বপ্ন মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। স্বপ্ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে।

কাগজের নৌকাগুলো স্রোতের সঙ্গে হেলেদুলে ভেসে যেতে যেতে একসময় অদৃশ্য হয়ে যেত। সুমনার ইচ্ছে হয় কাগজের নৌকার সঙ্গে ভেসে ভেসে বহুদূরের জলের মাঝে হারিয়ে যেতে। জল দেখলেই সুমনা কেমন যেন অন্যরকম হয়ে যায়। জল ওকে চুম্বকের মতো কাছে টানে। জলের মায়াময় ছোঁয়ায় ইচ্ছের তীব্রতা বেশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। ইচ্ছের পূর্ণ রূপ দিতে কলা গাছের ভেলায় ওঠার জন্য ঝুমুকে আহবান জানায় সুমনা। ও অসম্মতি জানায়। ঝুমু সাঁতার জানে না বলে পানিতে নামতে ভয় পায়। ঝুমুকে পাড়ে বসিয়ে সুমনা তার ইচ্ছানুসারে ভেলায় চেপে চলে যায় জলের মাঝখানে, মেঘমুক্ত ভুবনে প্রকৃতির কোলে। সবুজ মুকুট পরা প্রকৃতির খোলা আকাশের নিচে জলের উপর শীতল বাতাসে ভাসছে সুমনা। প্রাণভরে শ্বাস নিচ্ছে। আহা শান্তি! মুগ্ধতা যেন অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে নিয়েছে ওকে। প্রকৃতির মধুর কোলাহলে সুমনা হারিয়ে যায়।

একটি প্রকান্ড বটগাছ বাতাসে সাঁতার কেটে এসে ছায়া ফেলেছে ঠিক সুমনার মাথার উপরে। ও তাজ্জব হয়ে ভাবছে – গাছের ছায়া এতদূর আসলো কেমন করে! কি ঠান্ডা বাতাস! ও জানে বাতাস ছায়া দায়ী বটবৃক্ষটিকে ছুঁয়ে এসেছে বলেই এমন শীতল হয়ে বইছে। এই বটগাছের ছায়ায় কত ভিখারি, কত ক্লান্ত পথিককে ঘুমাতে দেখেছে সুমনা। ওঁদের ঘুম মুখের দিকে তাকিয়ে সুমনা গাছটির নাম দিয়েছিলো ঘুম গাছ। এই গাছের মায়ের মতো ছায়ায় মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে নিশ্চিন্তে। এই গাছের বাতাসে মায়ের হাতের পাখার মত স্বর্গীয় প্রশান্তি রয়েছে। এই গাছ সুমনার দাদাভাই-এর হাতের ছাতাটির মতো, ছায়া দিয়ে যায় ঝড়-বৃষ্টি-রোদে। এই গাছের মায়ায় সুমনা জড়িয়ে আছে বোধ জ্ঞান হবার পর থেকেই।

সুমনার চারপাশে রাজহাঁসের দল বৃত্তাকারে ঘুরছে। পাখীরা ছায়া ফেলে নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। জলের অতল থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছেদের ঘাই জলের উপরিভাগে এসে গোলাপ হয়ে ফুটছে। হাঁস,পাখী, মাছেদের সঙ্গে গল্প, খুনসুটিতে মেতে উঠেছে ও। কলমী, শাপলা, পানা ফুলেদের তুলে জড়ো করছে, রাতে কুপির আলোয় বসে সুঁই-সুতোয় মালা গাঁথবে বলে। তাজা ফুলের মালা গাঁথা সুমনার অন্যতম প্রিয় শখ। ঘরের দেয়ালে, পড়ার টেবিলের পাশে, আয়নার চতুর্দিকে ফুলের মালা দিয়ে সাজিয়ে রাখে। তাজা ফুলের ঘ্রাণে চোখ বুজে ও হারিয়ে যায় ভাললাগার অন্য ভূবনে। সুমনা জানে ভালোলাগার পরিচর্যা করতে হয়। তাই তো নিজ হাতে ফুলের বাগান করে, বাগানের যত্ন নেয়। ভালোলাগাকে আগলে রাখে ভালোবেসে।

জলের বুকে সুমনা এবার গভীর আগ্রহে নিজের হাসি মুখের প্রতিবিম্ব দেখতে থাকে। কমলা রঙের জামদানী শাড়ী পরা চিকচিকে আলোকিত আকাশ, পাখীদের গান, হাঁসেদের নৃত্য, ভ্রমরের গুঞ্জন, ফুলেল সুভাস, শীতল বাতাসে সুমনার মন অপার্থিব ভাললাগায় ডুবে আছে। ততক্ষণে স্থলে অপেক্ষায় বসে থাকা ঝুমুর কথাও সুমনা ভুলতে বসেছে। শব্দ পেয়ে পাশ ফিরে দেখে পদ্ম পাতা টেনে বাসা বাঁধছে জল ময়ূর। ওদের বাসা বাঁধবার ধরণটা বাবুই পাখীর মতো শৈল্পিক। বাবুইপাখি শূন্যে বাসা বাঁধে আর জল ময়ূর পানির উপরে। আচমকা সুমনা দেখতে পায় শূন্য হতে ঈগল নেমে এসে বসেছে ওর খুব কাছে, খাবারের সন্ধানে। সুমনা আর প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

দূরের ঝোপঝাড় থেকে ভেসে আসা শিয়ালের ডাক কানে ভেসে আসতে সুমনা সম্বিত ফিরে পায়। অন্ধকারের আধিপত্যের কাছে প্রদোষের আলো তখন ম্লানমুখে যাই যাই করছে !

‘আয় আয় কিত কিত! আয় আয় চৈ চৈ!’

চোখ মেলে দেখে সকাল পেরিয়ে দুপুরের সোনালি আলো জানালার পর্দা ভেদ করে রুমের আনাচ-কানাচে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ঝকঝকে আলোর তীব্রতায় মধু মাখা দিবা স্বপ্ন থেকে দূরে ছিটকে পড়ে কিছু সময় থরথর কাঁপতে থাকে সুমনা। স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় বুকে হাহাকার জাগে। কোথায় মা! মায়ের গৃহপালিত হাঁস-মুরগী! কোথায় রঙিন কৈশোর- কলা গাছের ভেলা! কোথায় প্রাণের বান্ধবী ঝুমু! খোলা আকাশ – পাখীর গান – ভ্রমরের গুঞ্জন – জল ময়ূর – ঈগল – শান্ত জল! কোথায় বটবৃক্ষ – কাগজের নৌকা – পানি ফুল – মাছের ঘাই! কোথায় সে প্রাণজুড়নো শীতল বাতাস!

সুমনা তো শুয়ে আছে ইঁট সুরকি ঘেরা নিউইয়র্ক শহরের এক বদ্ধ ঘরে। যেখানে চারপাশজুড়ে শুধু দেয়াল আর দেয়ালের ঠাসাঠাসি ভীড়! এখানে দেয়ালগুলো গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকলেও পরস্পর সম্পর্কহীন। ঠিক মানুষের মতো। এত কাছে তবুও কেউ কাউকে চেনে না। কোথাও কোন সখ্যতা নেই। সুমনার বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগে এই যান্ত্রিক শহরে। এই শহরের মানুষগুলো জলের কাছে যায় না। ওঁরা আকাশ ছোঁয়ার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। এই শহরের মানুষগুলোর বসবাস এক বিযুক্ত জীবনে। ওঁদের হৃদয়ে কখনো ধূলিঝড় আবার কখনো বরফ জমে থাকে।

বাতাসের শরীরজুড়ে বয়ে বেড়াচ্ছে মন কেমন করা উদাস কান্নার সুর। রোজকার মতো নিয়ম করে সূর্য উঠলেও এই মধ্য দুপুরেও অদৃশ্য অণুজীব করোনা ভাইরাসের ভয়ে মানুষ এবং শহর ঘুমিয়ে আছে। কত মানুষের বসবাস এই শহরে, তবুও বাড়ীগুলো – শহর, নিঃসঙ্গ- নির্জনে, দুপুর রোদের একলা আকাশের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কবরের নিঃস্তব্ধতা ঘিরে আছে মানুষের মনে, বাড়ীর অন্দরমহলে।

সুমনা ভাবতে থাকে – মানুষ যত বড় হয় তত একা হয়। একা হতে হতে একসময় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ছোটবেলায় খুব করে চাইতো বড় হতে, এখন আর ও বড় হতে চায় না। বড় হতে হতে একদম শূন্য হয়ে গেছে সুমনা। নিজেকে এখন তার বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো মনে হয়।

করোনাকালীন এই গৃহবন্দী সময়টাতে সুমনার নিয়মানুবর্তী জীবনে অনিয়মের রাজত্ব বেড়েছে চরমভাবে। খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে দৈনন্দিন কাজ-ঘুম সবকিছুতে। ফলস্বরূপ সারারাত জেগে থেকে এই ভরদুপুরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখছিলো।

দেশ ছেড়ে হাজার হাজার মাইল দূরের শহর নিউইয়র্কে দীর্ঘদিন ধরে বাস করলেও, সুমনার অনুভূতির ভাঁজে ভাঁজে বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতির রং-রূপ-গন্ধ মিশে আছে ওতপ্রোতভাবে। এই শহরের মাঠ-ঘাট-বন পেরিয়ে দিবারাত্রি ওকে দেশ হাতছানি দিয়ে ডেকে চলে। মানুষের মনোভূমিতে যা বিচরণ করে, স্বপ্নে তাই দেখে৷ সুমনার ভাবনার গোটা উঠোনজুড়ে বাংলাদেশ, স্বপ্নে বারবার ছুটে আসে৷

সদ্য দেখা স্বপ্নের লাল-সবুজ মায়া শরীরে জড়িয়ে সুমনা চা হাতে বাইরের রূপা গলা পৃথিবী দেখছে। গাড়ীর ধোঁয়া নেই, কোনরকম শব্দ সন্ত্রাস নেই। চারদিকে গভীর নৈঃশব্দ। সুমনার বাসার সামনে, বাসার বিপরীতে, চতুর্দিকে আগে অনেক গাছগাছালি ছিল। গ্রীষ্মের দিনে এগুলোকে মনে হতো ছায়াগাছ। সুমনা এদের ছায়া উপভোগ করতো, স্বপ্ন দেখতো, ওদের ঘ্রাণে ভালোবাসায় বিভোর হতো। কবিতা লিখতো, গলা ছেড়ে গান গাইতো। গাছেদের ছায়া সুমনাকে গভীর মায়ায় জড়িয়ে রাখতো। কোন কারণ ছাড়া ওদের ছুঁয়ে দিয়ে শান্তি পেতো। ওদের পরশে প্রাণভরে শ্বাস নিতো। সে গাছগুলো এখন আর নেই, কেটে ফেলা হয়েছে। কারণ, গাছের শিকড়, ডালপালা নাকি বাড়ীর অনেক অনিষ্ট করে, পানির লাইন, সুয়ারেজ লাইন ভেঙে ফেলে। গাছ কাটতে আসা ব্যক্তির কাছে জিজ্ঞেস করে এমনটাই জেনেছিল সুমনা। প্রথম গাছটি নিধন হওয়ার দিন গাছ কাটা মেশিনের তীব্র শব্দ উপেক্ষা করে ভারী মনে অনেকক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সুমনা। গাছ কাটার পর ঝরে পড়া তরলকে ছোটবেলায় ‘কষ’ বলে জেনেছে ও। বড়বেলায় জেনেছে গাছের প্রাণ আছে এবং আঘাত পেলে তারা কাঁদে। সেদিন গাছটি হতে অনেক কষ ঝরেছিল নাকি অনেক কান্না, সুমনা জানেনা।

গাছগুলোর ডালে পাখীর বাসা ছিল। এখন নেই। পাখীগুলো গৃহহীন হয়ে কোথায় গেছে তাও জানা নেই। অনেক না জানা নিয়েই বেঁচে থাকে মানুষ। তাছাড়া প্রকৃতিকে জানা মানুষের সম্ভব হয় না।

‘এত জেনেই বা কি হবে, পাখীদের খবর জেনে আমি কি করবো’ – এসব বলে নিজের মন কে স্বান্তনা দেয় সুমনা। যদিও খুব গোপনে বুকটা আজ হু হু করছে ওদের জন্য। ওরা হয়ত উচ্ছেদ হয়ে অন্য কোথাও গিয়ে বাসা বেঁধেছে। লাল ঠোঁটে কুড়িয়ে আনা খড়কুটো দিয়ে ওদের বাসা বাঁধবার দৃশ্যটি চোখের সামনে ভাসছে। স্বপ্নে দেখা পদ্ম পাতায় জল ময়ূরের বাসা বাঁধবার শৈল্পিক দৃশ্যটিও চোখের মণিতে ঘোরের সৃষ্টি করছে। দেশের স্বজনদের কাছ হতে সুমনা শুনেছে – এখন নাকি আর জল ময়ূর দেখা যায় না। ঈগল নির্ভয়ে খাবারের অন্বেষণে মানুষের গা ঘেঁষে আর বসে না। মাছেদের ঘাই তেমন নজরে পড়ে না।

কয়েকবছর আগে দেশে বেড়াতে গিয়ে সুমনা দেখেছে- পুকুর, খাল, বিল ভরাট করে মানুষ দালান তুলেছে। কোথাও একটু মাটি খুঁজে পায়নি ও পায়ে, শরীরে মাখতে। মানুষ হয়েও পদ্ম পাতা, মাটি, পুকুরের জল খুঁজে পায়নি যেখানে, সেখানে ওরা পাবে কোথায়! টিকে থাকবেই বা কিসে! এসব ভাবতে ভাবতে সুমনার হাঁসফাঁস লাগে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ঝাপসা চোখ যায় বাড়ীর আঙিনায়। কয়েকটা কাঠবিড়ালি খেলা করছে। কতদিন হলো ওদের খাবার দেয় না। রান্নাঘর হতে কিছু পাউরুটি এনে সুমনা ছুঁড়ে ফেলে ওদের সামনে। ওরা লেজ নাড়িয়ে নাড়িয়ে পাউরুটি খেতে থাকে আর বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে খেলতে থাকে। আগে আরো বেশি কাঠবিড়ালি ছিল। এখন অল্প কয়েকটা আছে। ওরাও হয়ত খাবারের খোঁজে অন্য কোথাও চলে গেছে। কাঠবিড়ালির সান্নিধ্যে দুপুরটা কিছুটা উপভোগ্য হলেও বাকি কাঠবিড়ালিদের কথা ভেবে সুমনার মন খারাপ হতে লাগলো। বিষাদগ্রস্ত মন অন্যদিকে ঘুরাতে ও পা বাড়ায় নিত্যদিনের আনাজপাতির হিসেব কষা জীবনে।

সিএনএনের খবর চলছে ঘরে। করোনায় ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে জীবন হারিয়েছে এক লক্ষ তিরিশ হাজার মানুষ। সুমনার মনে পড়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কথা, শুরুর দিকে তিনি বলেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের সংখ্যা এক লক্ষের মধ্যে রাখতে পারলেই তিনি সফল হবেন। আজ তিনি সফল নেতা নাকি একজন ব্যর্থ নেতা, কে জানে! সুমনার মত অতি সাধারণ মানুষের এসব জানায় কীই বা আসে যায়!

এক লক্ষ তিরিশ হাজার প্রাণের হিসেব কষতে কষতে অঙ্কে আজীবন কাঁচা সুমনার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ও হাঁপাতে থাকে। ইনহেলারেও স্বস্তি পায় না। ওর বুকে মরু ঝড় বইছে। ও যেন তপ্ত বালুর উপর দিয়ে হাঁটছে আর এক লক্ষ তিরিশ হাজার সংখ্যাটির সঙ্গে নিজের সংখ্যাটির কথাও ভাবছে।

সুমনার কানে বাজতে থাকে ষোল বছর বয়সী সুইডিশ তরুণী গ্রেটা থানবার্গের কথাগুলো। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অবিলম্বে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য রাজনৈতিক নেতা, বিশ্ব নেতাদের কাছে যে কিশোরী মেয়েটি আহ্বান জানিয়েছিলো। ভূমন্ডলীয় উষ্ণতা বৃদ্ধির বিষয়টি একটি কিশোরী মনকে ভাবিয়ে তুললেও, বিশ্ব নেতারা ভ্রুক্ষেপহীন।

করোনা ভাইরাস নাকি ভ্রুক্ষেপহীন ক্ষমতাধর বিশ্ব নেতারা – মানব প্রজাতির জন্য কোনটা বেশি ভয়ংকর, আপনমনে সুমনা ভাবছে আর হাঁপাতে হাঁপাতে টেলিভিশনের খবর শুনছে।

বিষন্নতার সাগরে সুমনা হাবুডুবু খেতে থাকে। কোন কিছুতেই মন শান্ত হচ্ছে না। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে বদলে গেছে মানুষের জীবন ও যাপনের নৈমিত্তিক কড়চা। সমুদ্রসমান অস্থিরতা এসে গ্রাস করেছে মানুষের মস্তিষ্কে। মন এমন অশান্ত হয়ে উঠলে সুমনা সাধারণত পাহাড় – অরণ্য কিংবা সমুদ্রের সান্নিধ্যে ছুটে যায়। মায়ের মত মমতাময়ী প্রকৃতির কোলে ওর মন শান্ত হয়ে যায়। প্রকৃতির সঙ্গে ওর হৃদয়ের প্রগাঢ় সংযোগ রয়েছে বোধ জ্ঞান হবার পর থেকেই। মহামারীর এই বন্দী জীবনে এখন সে উপায়ও নেই। বাইরে যাওয়া তো দূরের কথা দরজার কাছে যেতেই ভয় হয়। মনে হয় মৃত্যু দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে। ঘরের দরজা খুললেই মৃত্যু হাসিমুখে সম্ভাষণ জানাবে। অদৃশ্য এই অনুজীব করোনা ভাইরাস, কিন্তু কী সাংঘাতিক। ভাবতেই ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে। অবরুদ্ধ মানুষগুলোর দীর্ঘদিন ধরে চার দেয়ালের মাঝে থাকতে থাকতে বাইরের জগতের কথা যেন ভুলেই গেছে। মনে হয় বাইরের পৃথিবীর সাথে ইহজাগতিক সকল সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে মানুষের। স্বঘোষিত সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ আজ সময়ের কাছে ভীষণ অসহায়। মানুষের যত অহংবোধ, বিভ্রম উবে যাচ্ছে আজ সময়ের হাত ধরে।

শেষ কবে ঘরের বাইরে পা রেখেছে বা ঘরের জানালা খুলেছে সুমনার মনে নেই। করোনা ভাইরাস বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারে শোনার পর থেকে আতঙ্কে ও আর জানালার পাশেও যায় নি। বাতাসকে বিশ্বাস করতেও ভয় হয় ওর। বাইরের পৃথিবী ও প্রকৃতির সঙ্গে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে ও।

মানুষিক প্রশান্তির জন্য সুমনা আশ্রয় নেয় বারান্দার টবে লাগানো গাছগুলোর কাছে। গাছের হলুদ পাতাগুলো তুলে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়ার সময় ও ভাবতে থাকে, কবে কখন এভাবে ওকেও ফেলে আসবে অজানায়, কে জানে! নিভৃতবাস সময়ের প্রথম দিকে সিনেমা-গান-বই পড়ে বেশ কাটতো সময়। ইদানীং প্রযুক্তিও আর ভালো লাগছে না। বই পড়তে বসে, না পড়ে কয়েক পাতা উল্টেপাল্টে রেখে দেয়। আসলে গতিহীন জীবনে সময়ের কাঁটা এবং দিনপঞ্জিকার পাতা লাফিয়ে লাফিয়ে এগোতে থাকলেও, জীবনের তরঙ্গ থেমে আছে। সুমনা আকাশ দেখার চেষ্টা করে। দেয়াল আকীর্ণ এই শহরে খোলা আকাশ দেখাও দুষ্কর। নিয়নবাতির এই শহরে শেষ কবে চাঁদের আলো, জোনাকি দেখেছে সুমনার মনে নেই। বাতাসের শনশন শব্দ এসে লাগছে কানে। সুমনা বারান্দায় ইজিচেয়ার টেনে বসে। কিছু সময় ফেসবুকে ঘোরাঘুরি করে। মন বসে না। রাজ্যের চিন্তা ভর করছে মনে। লকডাউনে গোটা শহর। নৈঃশব্দ ঘিরে রেখেছে চারপাশ। ওর ঘরে কিছু খাবার মজুত আছে। ওর মনে পড়ে রাস্তায় বসবাস করা মানুষগুলোর কথা। ওরা কেমন আছে? কিভাবে ওদের জীবন চলছে? পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তা এ কিসের শাস্তি দিচ্ছেন মানুষকে? কবে তিনি মানুষের প্রতি সদয় হবেন? কত অশ্রুজলে তিনি মানুষকে আর ভাসাবেন? কবে বন্ধ হবে এই অদৃশ্য ভয়ংকর প্রলয়ঙ্করী ঝড়? কবে এই ন্যানো ভাইরাস বিলুপ্ত হবে? কবে ঘরের সবকটা জানলা খুলে দিতে পারবো নির্ভয়ে?

রাজ্যের প্রশ্নবাণে জর্জরিত সুমনা কিছু সময় পর বারান্দা থেকে উঠে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়।

ঘরে ঢুকে সুমনা পড়ার টেবিলে গিয়ে বসে। দেয়ালে ঝুলানো প্রিয় চিত্রশিল্পী ভিনসেণ্ট ভ্যানগগের আঁকা ছবিতে ওর চোখ আটকে থাকে। ভিনসেন্টের আঁকা ছবিগুলোতে কোন না কোন রহস্য লুকিয়ে থাকে – সুমনা এই কথাটি ওর বাবার মুখে শুনেছে। ভিনসেন্টের ছবির দিকে তাকালেই ওর ভীষণ বাবার কথা মনে পড়ে। সুমনার পড়ার ঘরের দেয়ালে ভিনসেন্টের আঁকা ১৮৮৯ সালের একটি চিত্র রয়েছে। এই চিত্রে তিনি অলিভ গাছের একটি সিরিজ এঁকেছিলেন বলে সুমনা জেনেছে।

ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সুমনা নস্টালজিক হয়ে পড়ে।

ছোটবেলায় সুমনা গোসল সেরে রোদের তাপে ওর লম্বা ঘন চুল শুকাতে দিয়ে গাছেদের সঙ্গে গল্পে মেতে উঠতো। পেয়ারা গাছের পাশে বসে কত কথা বলতো! গাছ ছিলো ওর বিশ্বস্ত বন্ধু। গাছ কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করতো না। গাছের প্রতিটি ডাল, শাখা- প্রশাখা, ফুল-পাতা, ওর সুখ-দুঃখের সব কথা মন দিয়ে শুনতো। ওর কথাগুলোকে আগলে রাখতো। কোন কারণে মন খারাপ হলে গাছেদের সঙ্গে অভিমান করতো। গাছ তখন ওর মান ভাঙাতে শীতল বাতাস বইয়ে দিতো। বাতাসের সুশীতল পরশে ওর মন খারাপ নিমিষেই উবে যেত।

পড়ার টেবিলের এক কোণে পড়ে আছে ঝর্ণা কলম। এই কলমটি সুমনার মা দিয়েছিলো। বুঝ বুদ্ধি হবার পর থেকেই সুমনা ওর জন্মদিনে মায়ের কাছ হতে উপহার হিসেবে ঝর্ণা কলম বা লেখার জন্য ডায়েরি পেত উপহার হিসেবে। মায়ের কোল ছেড়ে বহুদূর চলে আসার পরও জন্মদিনে মায়ের থেকে পাওয়া এই অমূল্য উপহারের ধারা অব্যাহত ছিল।
সুমনা কলমটি হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে। চোখ বন্ধ করে মায়ের হাতের স্পর্শ, ঘ্রাণ খোঁজে। মা গত হয়েছেন অনেক আগে। সুমনা এখনো প্রতি নিঃশ্বাসে মায়ের ঘ্রাণ খোঁজে তাঁর পাঠানো জিনিসপত্রের ভীড়ে। এই এক স্বর্গীয় সুখ।
অনেকদিন ব্যবহার না করায় কলমটার উপর ধূলার মিহি প্রলেপ পুরু হয়ে পড়েছে দেখে তাড়াতাড়ি খুব যত্নে পরিষ্কার করে নেয় সুমনা।
কলমটি পরিষ্কার করতে করতে সুমনার মনে পড়ে কোথায় যেন পড়েছিলো – ‘কালি কলম মন লেখে তিনজন।’

প্রযুক্তির ডানায় ভর করে উড়তে থাকা এখনকার সময়ে যদিও এই কথার যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যাবে না আর। কলমের জায়গা এখন দখল করেছে – কম্পিউটার, মোবাইল ইত্যাদি। সময়ের সঙ্গে মানব ইতিহাসে লেখার উপকরণে ব্যপক পরিবর্তন চোখে পড়ে। খাগের কলম, হাড়ের কলম পালকের কলম, ঝর্ণা কলম- এগুলো যেন আজ রূপকথার গল্প। আজকের সভ্যতা থেকে কলম শব্দটাই তো যেন মহা প্রস্থানের পথে। মায়ের দেয়া ঝর্ণা কলমটি বুকের সঙ্গে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সুমনা ভাবছে স্লেট, চক, পেন্সিল এগুলো কি পাওয়া যায় এখনো? কে জানে! এখনকার বাচ্চারা হয়তো স্লেট-পেন্সিল চিনেই না!

সুমনার হাতে খড়ি হয়েছিলো স্লেটে। দাদার কাছ থেকে উপহার হিসেবে স্লেট-চক পেয়ে সে কি খুশি ওর! দিনরাত্রি স্লেটে আঁকিবুঁকি করতো। অক্ষরের পরিবর্তে ফুল-পাখী-প্রজাপতি-গাছ আঁকতো। আহা! জীবনের মধুমাখা সেসব দিনগুলি কতই না রঙিন আদরে কাটতো!

মাধ্যমিক পর্যন্ত সুমনা ঝর্ণা কলম ব্যবহার করেছিলো। যতদূর মনে পড়ে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার পর ও ইকোনো কলম কিনেছিলো। সে বছর প্রথম ও পরীক্ষার হলে দোয়াত- কালি নিয়ে যায়নি। ঝর্ণা কলম ব্যবহারের দিনগুলোতে সবসময় পরীক্ষার হলে যাওয়ার সময় ওর মনে হতো লিখতে লিখতে যদি কলমের কালি ফুরিয়ে যায়! যদিও কোন পরীক্ষায় লিখতে লিখতে কলমের কালি ফুরায়নি, তবুও ওর ভয় থেকে যেত। ঝর্না কলম-কালির দোয়াত, স্লেট-চকের মধ্যে যে চরাচরব্যাপী মায়া জড়িয়ে ছিল, তা এখনকার দিনের অত্যাধুনিক যন্ত্রে খুঁজে পাওয়া যাবে না। চকের সাদা গুঁড়ো মুখে মেখে যে জীবনে স্লেটে অক্ষর শেখে নি, দোয়াতের কালি সাদা কাগজে ফেলে যে জীবনে ঝর্ণা কলম দিয়ে লেখে নি, সে জীবনের অন্যরকম এক আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

দ্রুত গতির যন্ত্রের কাছে ঝর্ণা কলম হেরে গিয়ে সুমনার হাতে এখন অত্যাধুনিক ল্যাপটপের কিবোর্ড থাকলেও, টাইপ করার সময় ওর ঝর্ণা কলমের কথা খুব মনে পড়ে। কান পেতে শোনে সাদা কাগজের বুকে ঝর্ণা কলমের বয়ে যাওয়া জলপ্রপাতের শব্দ। জীবনের প্রথম শিহরণ জাগানিয়া অনুভূতির প্রকাশ পেয়েছিলো ওই ঝর্ণা কলমেই, যা আজ হারিয়ে গেছে ঝর্ণা কলমের সঙ্গে।

কোন যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছে আজ সুমনা ঠিক বুঝতে না পারলেও, তবে এটুকু বুঝতে পারছে ওর মনের আকাশ অঝোরে কাঁদছে, এই গৃহবন্দী সময়ে। কোনকিছু ওর ভালো লাগছে না। অন্তরে ঝড় উঠেছে। প্রচন্ড ঝড়। আয়নায় নিজেকে দেখে। চোখের নিচে কালি, শুকনো মুখ। দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। কত কাছের মানুষ, চেনা মুখসহ অগণিত মানুষ হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। তাঁদের কথা ভেবে বুকে হাহাকার জাগে।

অন্তরে এমন ঝড় উঠলে সুমনা আশ্রয় নেয় সাদা কাগজের বুকে। ল্যাপটপের কিবোর্ড ফেলে অনেকদিন পর সুমনা হাতে তুলে নেয় মায়ের দেয়া ঝর্না কলম। ছোটবেলার মতো অনুভূতিগুলোকে লিপিবদ্ধ করবে বলে ডায়েরি খুলে লিখতে বসে। অনেক সময় চুপচাপ বসে থাকে। অঝোর ধারায় অশ্রুজলে ভিজে ওঠে ডায়েরির পাতা। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো গভীর শূন্যতা। অনুভূতির তীব্র প্রসব যন্ত্রণায় কাতরালেও কিছুই লিখতে পারলো না। মনের ঝড় বেড়েই চলেছে। মন যেন আজ অভিমানে ফুঁসে উঠেছে। মন খুঁজছে তার প্রিয় সঙ্গীকে। মন তার একান্ত সঙ্গ ছাড়া কোনভাবেই শান্ত হবে না, সুমনা বুঝে গেছে।

রোদের তাপ কমে এসেছে। সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমাকাশে। বিধ্বস্ত সুমনা জানালার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। মনের একান্ত সঙ্গীর খোঁজে, শান্তির খোঁজে, ভালোবাসার খোঁজে, আলোর খোঁজে – সুমনা ঘরের সবকটি জানালা খুলে দেয়! নিজেকে ওর জল ময়ূর মনে হলো। পেখম মেলে নাচতে ইচ্ছে হলো। সুমনা ভুলে যায় মারণব্যাধি করোনার কথা। ও প্রাণভরে শ্বাস নিতে থাকে। প্রকৃতির সবুজ ঘ্রাণ, শীতল বাতাসে ধুয়েমুছে যায় মনের সব অস্থিরতা। ফুলের ঘ্রাণে মন আনন্দে ঘাসফড়িং এর মতো লাফাচ্ছে। একদল পাখী উড়ছে। পাখীদের পাখনায় ভর করে সুমনার মনও অজানার পানে ছুটছে।

কি সুন্দর বিকেল! প্রকৃতিতে আলো-ছায়া-মায়ার মিষ্টি খেলা! সুমনার অশান্ত-তৃষ্ণার্ত মন শান্ত হয়ে আসে, প্রাণ ফিরে পায় প্রকৃতির অনাবিল সান্নিধ্যে।

‘আনন্দধারা বহিছে ভূবনে, দিন-রজনী কত অমৃত রস, উথলি যায় অনন্ত গগনে’ – সকল ভীতি ভুলে প্রকৃতির বুকে নিজেকে সঁপে দিয়ে সুমনা সহসা গলা ছেড়ে গান ধরে মনের অথৈ আনন্দে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “আত্মসমর্পণ

  1. কংক্রিটের চার দেয়ালে মানুষ নিজেকে গোপন করেছে। সভ্যতার ঘেরাটোপে
    সবুজ ঘাস ডাকে “আয় আয় আমার কাছে
    আয়, পুকুরের বুড়ো কাতলা ঘাই মারে মায়ের
    পায়ের শব্দে, পাশের বাড়ীর হাঁস কেমন ছুটে
    যায় পুকুরের মায়ায়.”
    দেশের প্রতি, সবুজের প্রতি এই অনুভব এই লেখায়। মন কেমন করা লেখা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *