ঝর্না রহমান
বনবীথি আবাসিক এলাকার প্রধান ফটকে তিনটি ট্রাক থেমে আছে। বেলা তিনটার দিকে ট্রাক তিনটি এসেছে। এখন বাজে পাঁচটা। দু’ঘণ্টা যাবৎ ট্রাক তিনটি থেমে আছে। কর্তৃপক্ষ ট্রাকগুলোকে এলাকার ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিচ্ছে না। অথচ ট্রাক ড্রাইভারের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সবই আছে। ভেতরে যেখানে যাবে সেই ঠিকানা আছে। নিজের হাতে কাগজে ঠিকানা লিখে দিয়েছেন ইঞ্জিনিয়ার তাহসিনুর রহমান। ধানমণ্ডির ভাড়া বাসা ছেড়ে তিনি তাঁর নিজের ফ্ল্যাটে উঠছেন। ছুটির দিনগুলোতে কিছু কিছু করে জিনিসপত্র মালামাল পাঠিয়ে দেবেন। আজ প্রথম লটটি পাঠানো হয়েছে। ট্রাক ড্রাইভার শওকতের কাছে ঠিকানা ও বনবীথি আবাসিক এলাকার ভেতরে ঢোকার অনুমতিপত্রের কপি দিয়ে দিয়েছেন তাহসিনুর। বাসার চাবিও দিয়ে দিয়েছেন শওকতের কাছে। বাসার ভেতরে যাতে মালসামান তুলে ফেলতে পারে। আট তলায় বাসা। জিনিসপত্র তুলতে সময় লাগবে। তিনি গাড়ি নিয়ে পরে আসছেন।
শওকত ঠিকানা লেখা কাগজটা নিজেও অনেকবার পড়েছে। টেন বাই এইচ, সাউথ গেইট, সেলেস্টিয়াল গার্ডেন, ব্লক বি, বনবীথি আবাসিক এলাকা, ঢাকা। তাহসিনুর রহমানের নতুন অ্যাপার্টমেন্টের ঠিকানা। গেটের সিকিউরিটি অফিসের প্রধান কর্মকর্তাসহ লোকজনকে বারবার দেখাতে দেখাতে কাগজটা ল্যাতলেতে হয়ে গেছে। তারা প্রত্যেকবার ঠিকানাটি দেখেছে। আর প্রত্যেকবার একই কথা বলেছে, এ ঠিকানায় এ মাল আমরা এন্ট্রি দিতে অপারগ। এ অনুমতিপত্র অ্যাপার্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট কমিটির। এতে চলবে না। এরিয়া ম্যানেজমেন্ট হায়ার অথরিটির পারমিশন লাগবে। শওকত ট্রাকবাহিনীর প্রধান ড্রাইভার। বাকি দুজন ড্রাইভার তারই সাগরেদ। ড্রাইভার ছাড়া সঙ্গে আছে আরও চারজন। ওরা শ্রমিক। ট্রাকের মালগুলো তাহসিনুর রহমানের ধানমণ্ডির বাসা থেকে তুলেছে। আবার ঠিকানা মোতাবেক আনলোড করবে। শওকত আর দুজন ড্রাইভার হারুন এবং শাহাদাতকেও মাল ওঠানামায় হাত লাগাতে হয়। এর বেশি তাদের দায়িত্ব নেই। হায়ার অথরিটি ফথরিটি এসব শুনে কী করবে।
শওকত ফোনের বাটন টেপে। স্যার…
এই দুঘণ্টায় কতবার যে ফোনাফুনি হলো তার ইয়ত্তা নেই। তবে শওকত যতবার ফোন করেছে তার চেয়ে তিনগুণ বেশি ফোন এসেছে ওপাশ থেকে। তাহসিনুর রহমান ফোন করছেন।
– কী অবস্থা শওকত?
– অবস্থা সেইম স্যার, বইসা আছি।
– এখনও বসে আছো? কেন, ওরা যে বললো, আচ্ছা দেখছি।
– খালি দেখতেই আছে। মাল লাইরা চাইরা কার্টন ফাইরা কাইট্টা সাড়ে সব্বোনাশ। কিন্তু হেরা তবু বিশ্বাস করতাছে না। মাল ঢুকতে দিব না।
– এখনও বলছে ঢুকতে দেবে না? কেন! আর কার্টন কাটাছেঁড়া করবে কেন? ইললিগাল মাল নিয়ে যাচ্ছি নাকি? কী আশ্চর্য! দাও, ওদের কাছে ফোনটা দাও।
শওকত ফোনটা এগিয়ে দেয় সিকিউরিটি অফিসারের দিকে, ‘নেন, স্যারের লগে কথা কন।’
অফিসার ফোন কানে লাগান। হ্যালো।
– হ্যালো, আচ্ছা ভাই সমস্যাটা বুঝিয়ে বলবেন? কেন ওদের ঢুকতে দিচ্ছেন না? আমার নাম ঠিকানা দেয়া আছে, পারমিশন লেটার আছে—
– বলেছি তো, সমস্যা সেটা না। আপনার মাল সন্দেহজনক।
– মাল সন্দেহজনক! কী বলেন? কার্টন খুলে দেখেন! ওর ভেতরে কী আছে অস্ত্র না গোলাবারুদ! দেখেন, কোনো সমস্যা নেই!
– সমস্যা সেটা না। মাল আমরা দেখেছি। দেখেছি বলেই সমস্যা।
– কী সমস্যা?
– আপনার ঠিকানা রেসিডেন্ট এর। পারমিশনও রেসিডেন্সের। কিন্তু—
– কিন্তু কী?
– মাল তো অন্যরকম! বাসাবাড়ির জন্য না! ব্যবসা খুলবেন বলে মনে হচ্ছে।
– ব্যবসা? কী বলেন? আমি চাকরি করি! ব্যবসা করবো কেন?
– সেটা আপনি জানেন। বনবীথি আবাসিক এলাকা টোটালি আবাসিক। এখানে কোনো ব্যবসায়ের জন্য জমি বা প্লট বা ফ্লাট এলোট করা হয়নি, হয় না। পারমিশনও নেই।
– আমি তো প্লট বা জমি নিইনি! সেলেস্টিয়াল গার্ডেন আবাসিক অ্যাপার্টমেন্ট। সেখানে আটতলায় ফ্লাট নিয়েছি। ওটা আমার বাসা!
– কিন্তু আপনার সব মাল তো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য…..
– ও গড! ওইসব একসেসরিজ বাসাবাড়িরই!
– বাসাবাড়ির? কেউ বিশ্বাস করবে? দুই তিন ট্রাক ভরতি আর কিছু নাই, আছে শুধু……
– আচ্ছা কী বললে আপনারা আমাদের কথা বিশ্বাস করবেন?
– আপনি আসেন, তারপর ফয়সালা হবে।
শওকতকে ফোন ফেরত দেয় অফিসার। আমরা দেখছি। তোমাদের ওয়েট করতে হবে। এত অস্থির হলে চলবে না। আর ফোনও করবে না। মালের মালিক আসুক, তার সাথে কথা হবে।
শওকত প্যাঁচা মুখে ট্রাকের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।
ড্রাইভার হারুনের মেজাজাটা সবচেয়ে বেশি তিতা হয়ে আছে। ট্রাকে মাল সেট করার সময় তার ডান হাতের শাহাদাৎ আঙুলের গোড়াটা ডিপ হয়ে কেটে গেছে। একটা বুক শেলফের কাচের নিচের দিকের কোনা ভাঙা ছিল। বেখেয়ালে ঘ্যাচাৎ করে ধারালো ভাঙা কাচটা ঢুকে গেল। আর একটু হলে গোটা আঙুলই খসে যেত। বহুৎ রক্ত ঝরেছে। তাহসিনুর স্যারই তাড়াতাড়ি লোকাল ক্লিনিকে কাছে পাঠিয়ে ফার্স্ট এইড দিয়ে এনেছে। আঙুলে প্যাঁচানো ব্যান্ডেজের সাদা গজটা ময়লা টয়লা লেগে এখন কালো হয়ে আছে। গাড়ি চালিয়ে আসতে যতবার স্টিয়ারিং টার্ন করেছে ততবার আঙুলের ভেতরে চিলিক দিয়ে উঠেছে। কয়েকবার ঝলক দিয়ে রক্তও বেরিয়েছে। এখন রক্ত শুকিয়ে আছে। তবু কাটা জায়গা টপ টপ করে লাফাচ্ছে। পেটেও সকাল থেকে দানা পড়েনি। কথা ছিল তিনটার মধ্যে মালপত্র নামিয়ে দিয়ে পেমেন্ট নিয়ে কোনো একটা হোটেলে ঢুকবে। গরুর মাংস আর ডাল দিয়ে গপাগপ দু তিন প্লেট ভাত মেরে দেবে। গাড়ি ছাড়ার আগে একটা করে সবরি কলা খেয়েছিল ওরা। সেটা হজম হয়ে এক চামুচ শক্তি হয়েছিল, তাও ফুড়ুৎ হয়ে গেছে কখন! প্রচণ্ড গরম পড়েছে। আশ্বিন মাসের অর্ধেক হতে চললো তবু আসমান জমিন যেন তাওয়ায় টালা হচ্ছে। বেলা বাড়ার আগেই যেন মাটি থেকে রোদে পোড়া গন্ধ উঠতে থাকে। টালা মাটির গন্ধ। হারুন কিট বক্সের ভেতর থেকে দলাপকানো তেলচিটা গামছাটা বের করে। ঘসে ঘসে ঘর্মাক্ত ঘাড় মাথা মুছে ফেলে। গামছা নাড়িয়ে হাওয়া করে। আর মুখ দিয়ে হুশহুশ করে দম নেয়। তারপর দাঁত খিচে বলে, ওস্তাদ, কী গ্যাড়াকলে পড়লাম আমরা কন তো? কী করমু এহন?
– কী করমু আর? বইয়া থাকুম।
– বইয়া থাকুম? বইয়া বইয়া কি আঙ্গুল চুইমু? আঙ্গুলও তো কাইট্টা গেছে। চুইতে পারুম না। চুইলে রক্ত আর স্যাভলনের গন্দ লাগবো। হ্যাত তেরি!
আঙুলের ব্যান্ডেজটাকে ভালো করে টিপে টিপে পরখ করে। চিপ চিপ করে রক্ত বেরুচ্ছে। ঠোঁট বিকৃত করে আঙুলের রক্তভেজা ব্যান্ডেজের ওপর আর এক প্রস্থ গজ প্যাঁচায় হারুন।
– হেই! ফালতু কথা থামাবি হারুইন্যা? বেয়াদ্দপ বেয়াল্লিশ কোনহানকার! স্যার আসতাছে। তার গাড়ি এফডিসিতে জামে আটকাইয়া আছে আধা ঘণ্টা ধইরা। স্যারও খুব বিরক্ত! গাড়ি চালাইতে চালাইতে চৌদ্দবার কতা কইছে। হ্যার কান গরম অইয়া গ্যাছে। আর কতা কইবো না। আইসা ফয়সালা করবো। এই হালারা বিটলামি করতাছে! হালারা সব মুরুক্খু। তাই বই দেইখ্যা ডরাইছে।
– আমিও ডরাইছিলাম ওস্তাদ। বাসার থনে বইয়ের কার্টন নামাইতে গিয়ে ডরাইছি। এত্ত বই!
ইসমাইল, শ্রমিকদের একজন, ঘাড়ের ব্যায়াম করতে করতে বলে।
– তুমি তো ডরাইবাই! তুই তো মুরুক্ষু। প্যাটে কুড়াল মারলেও একটা ক বাইরাইবো না, তাই ডরাইছছ।
ইসমাইল শওকতের কথার ওপর কথা বলে না।
– এই দ্যাশে ট্রাক ভইরা অস্ত্র ঢুইকা যায়, আর বাসাবাড়িতে বইয়ের ট্রাক ঢোকতে দিবো না। হালারা বই দেইখ্যা ডরায়। ট্রাকে হেলান দিয়ে আপনমনে গজ গজ করে করে শওকত।
ইসমাইল মট মট করে ঘাড় ফোটায়।
– বাবা গো, গর্দানের রগে এক্কেবারে গিটটু লাইগ্যা গ্যাছে গা। এহেকটা বাকসো, বাবারে বাবা, হেব্বি ওজন। মাতায় উডাইতে গিয়া মনে অইছে, বই তো না পাত্থরের বোস্তা উডাইতাসি য্যান। ওস্তাদ, তিনডার মইদ্যে দুইডা টেরাক তো বইয়ের কার্টনেই লোড অইয়া গেছে। ফার্নিচারগুলা একটায়ই ঢুইক্যা গ্যাছে, সেইডার মইদ্যেও তিন চাইরডা বইয়ের বাসকো আছে, দ্যাহেন। থেমে থাকা ট্রাকগুলোর পিঠের খোড়লে বইয়ের কার্টনগুলোর দিকে ইশারা করে ইসমাইল।
– তুইই দ্যাখ। দ্যাখতে দ্যাখতে খাড়া দুইফরের সুরুজ পচ্চিমে ঢইলা পড়লো। দুই টেরাক বই লইয়াই না এত কাণ্ড!
ইসমাইল একটু সিধা কিসিমের। শওকতের কথায় সত্যিই সে আকাশে তাকিয়ে সূর্যের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করে।
আপনমনে বলে, ’ল্যাখাপড়া শিখলাম না, কিছুই জানলাম না। কিয়ের পুরুষপোলা অইলাম? আর সায়েবের মা, হেই বেডি বুইড়া অইয়া গেছে গা, ভালামত চোহেও দ্যাহে না, কানেও শোনে না। মাইয়ামানুষ অইয়া হে পড়ছে এত বই? কত বিদ্যা আছে এই বইগুলার ভিৎরে! আর তার বেরেনে মগজ কয় কেজি? কইতে পারেন হারুন ভাই?’
ড্রাইভারদের মধ্যে শওকত আর হারুনই শিক্ষিত। শওকত এসএসসি দিয়েছিল, পাস করেনি আর হারুন টেনেটুনে এইট পাস। অভাব আর দারিদ্র্যের কারণে লেখাপড়াটা আর হয়নি।
হারুন অবাক হয়। ‘কী কছ? সত্যই এই বইগুলা সাহেবের মায়ের?’
– হ। আমি জানি। হ্যারই। স্যারে কইছে, আম্মার বইগুলোই তো এক ট্রাক হবে! আমি কইলাম, না স্যার, দুই টেরাক তো হইবোই। শুইনা স্যারে হাইসা দিয়া কয়, বাবারে, আম্মার তো বইয়ের বাজার! তো আমি এক ফাঁকে হেই বুড়ি বেডিরে জিগাইছিলাম…
– হেই ব্যায়াদ্দপ, একজন শিক্ষিত ভদ্রমহিলারে তুই কইতাছস বুড়ি বেডি, তর জিবলা ছিড়া ফালামু! শওকত দাঁত খিচোয়।
– ছরি ওস্তাদ, ভুল হইয়া গেছে। নানী কমু। আমার নানীর বইস্যাই। তো নানীরে জিগাইলাম, আপনেরা কি বই বানান? ফেক্টরি আছে?
– এ্যা? এই কতা জিগাইছছ? গাধা কোহানকার।
– হ, জিগাইছি তো! নানীয়ে তো পয়লা হাইসা দিল। বুড়ির দুইডা.. থুক্কু, নানীর দুইডা দাঁত নাই। ফোকলা দাঁতে হাইসা কয়, বই বানাই না, বই লিখি। আমি তো টাসকি খাইলাম। কয় কী? এই বুড়ি কেমতে লেখে এত বই? সত্য কই ওস্তাদ, এত বইয়ের মিদে কেমতে এত ল্যাহা লেখে, এইসব আর জিগাই নাই। মুরুক্ষু মানুষ, কী কইতে কী কমু, শ্যাষে হাসবো। কইব গাধা।
– গাধা তো তরে আমরাই কইতে আছি। শওকত হারুনের মাথায় ঠোনা মারে।
– বই লেখে মানে, সে হইল ল্যাখক। কবিসাহিত্যিক। তার লেখা বই পাবলিশাররা ছাপায়। আমি আগের থেইকাই জানি, তাহসিন স্যারের মা হইল নামকরা সাহিত্যিক। তার ল্যাখা অনেক বই আছে। বিদ্যাশ থেইকাও তার বই পরকাশ হয়। তারা শিক্ষিত ফ্যামিলি। নিজেরা পড়ার জন্য অনেক বই কিনে। কিনতে কিনতে বইয়ে ঘর ভরতি হইয়া যায়। আমি তো আষ্ট বচ্ছর তাহসিন স্যারের গাড়ি চালাইছি। বইমেলার সময় মাঝে মাঝে গিয়া গাট্টি ভইরা বই কিনা আনতো। একদিন স্যারের ওয়াইফ বলে, এবার বইকে ঘর ছেড়ে দিয়ে আমাদের গাছতলায় গিয়ে বাস করতে হবে। এত বই কোথায় রাখবো!
গল্পে গল্পে সময় পেরিয়ে যেতে থাকে। কাশেম একফাঁকে গিয়ে পাউরুটি আর কলা কিনে এনেছে। সে-সব খেয়ে পানির বোতল খুলে ঢক ঢক করে পানি খেয়ে বড় করে ঢেকুর তোলে ইসমাইল। পেট হাতিয়ে এক পোঁচ হাসি ছড়ায়, যাউক, প্যাটটা এট্টু ঠাণ্ডা হইল। একেবারে চুলা জ্বলতাছিল।
হারুনের ব্লাডার ফুলে উঠেছে। এদিকে কোথাও তো প্যান্টের জিপার খুলে দাঁড়িয়ে পড়া যাবে না। সিকিউরিটি অফিসের ভেতেরে নিশ্চয়ই টয়লেট আছে। কিন্তু শালারা যেই খতরনাক, শেষে কিছু একটা বলে দিলে লজ্জার একশেষ। হারুন কাজটা কোথায় সারবে, চারদিকে তাকিয়ে সে রকম কোনো জায়গা অনুসন্ধান করে।
ইসমাইল হারুনকে জিজ্ঞেস করে, ‘কী বিছরাইতাছেন ভাই? মোতবেন? অই যে ডেরামের দোকানটার পিছে একটা জঙ্গল আছে। আমি চিনি। সেহানে যাইয়া মোততে পারেন।’
হারুন মুখ বিকৃত করে বলে, ‘হালা গাড়ল। মোখের ট্যাকসো নাই! বইপুস্তকের আলোচনা শুইন্যাও মোখের ভাষা শুদ্দু হইলো না। তর কোনো ভবিষ্যৎ নাই।’
শওকত ফোনে কারো সাথে কথা বলছে। হারুন তলপেটের চাপ সহ্য করে আশাভরা চোখে সেদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ফোন শেষ হলে শওকতকে বলে, ‘কিছু অইল ওস্তাদ? ক্যাডায় ফোন করলো?’
– নাহ। কিছু না। বাসা থেইকা ফোন করছিল। আমার ওয়াইফ। স্যার তো আসতাছে, কইলাম না? কইছে চুপ কইরা বইসা থাকো।
– ওস্তাদ, আপনে না কইছিলেন, স্যারের কোন আত্মীয় র্যাবের বড় অফিসার! সায়েবে তারে একটা ফোন দেয় না ক্যান? তাইলেই তো এই সিকুরিটি মিকুরিটি মুইত্যা ইনিফরম ভাসায়া দিত। টেরাক আবার ঢোকতে দিব না! হুহ! বাপ বাপ কইরা দিবো!
রসিকতার হাসি হাসতে হাসতে হারুন বড় বড় পা ফেলে ড্রামের দোকানের পেছনে চলে যায়।
আচমকা একটা ভেজা দমকা হাওয়া গায়ের ওপর এসে হুড়মুড় করে পড়ে। শাহাদাত তাড়াতাড়ি সেল ফোনের বাটন টিপে ফোনের স্ক্রিন অফ করে দেয়। কখন যেন আকাশে গাঢ় একটা ছায়া বিছিয়ে দিয়েছে কেউ। কখন মেঘ জমলো? শওকত ভালো করে মেঘ দেখার আগেই আকাশ ভেঙে গলগল করে বৃষ্টি নেমে আসে।
ঝকঝকে রোদ্দুরের মধ্যে গাড়ি ছেড়েছিল ওরা। আকাশে মেঘ তো দূরের কথা এক টুকরো আবের ছায়াও ছিল না। তাই ত্রিপল দিয়ে ট্রাকগুলো ঢাকার কথা ভাবেনি। এখন পাঁচ মিনিটের ঝুম বৃষ্টিতেই বইয়ের কার্টনগুলো ভিজে চুবচুবে হয়ে গেল। তড়িঘড়ি করে ত্রিপল বের করে ট্রাকের মালগুলো ঢাকা হলো বটে কিন্তু ততক্ষণে যা হবার তা হয়ে গেছে। শওকত কার্টনগুলো আঙুল দিয়ে খোঁচা দেয়। দুধে ভেজানো পাউরুটির মতো নরম পিচবোর্ড ভেদ করে আঙুল ঢুকে গেল ভেতরে। ওপরের দিকের বই নিশ্চয়ই সব ভিজে গেছে। এখন কী হবে?
শওকত লেবারদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
– হালার টিকটিকি আর তেইল্যাচোরার দল। গায়ে নাই বল, তাইলে লেবারগিরি করতে আওছ ক্যান। কয়ডা মাল নামাইয়া কুত্তার লাহান তগ জিবলা বাইরাইয়া গেল, তেরপলডা দিয়া মালগুলা ঢাকলি না। কইলি দরকার নাই। এমতেই অইবো। এহন এই বই নষ্ট হওনের খেসারত দিমু কী দিয়া? কী জবাবডা দিমু আমি স্যাররে? মাথায় হাত দিয়ে শওকত বসে পড়ে।
কাসেম ইসমাইল শাহাদাত সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে নিজেদের ভেজা জামাকাপড়ের রফা করা চেষ্টা করে।
হারুনই শুধু খেঁকিয়ে ওঠে, ‘ঐ হালারা গাড়িগুলারে না আটকাইলে এই আজাইরা ঝামেলার মইদ্যে পড়তে অইত? কুন সুম মালমুল নামায়া থুইয়া পুরান অইয়া যাইতাম! কৈফিয়ত দিলে ঐ হালারা দিব। আমরা দিমু ক্যান?’
শওকত কেন যেন হারুনের এ কথায় লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে সিকিউরিটি অফিসের ভেতরে চলে যায়। টেবিলের সামনে গিয়ে ডিউটি অফিসারকে শান্ত গলায় বলে, ‘স্যার, গাড়ি আটকায়া থুইলেন, বিষ্টিতে তো বেবাক বই ভিজ্যা গেল, এহন মালিক তো আমাগো থুইবো না। তার মায়ের বই। কী জবাব দিমু কন?’
অফিসার ভুরু কুঁচকে শওকতের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘বৃষ্টি কি বদনার নল দিয়া পড়ছে? এতগুলা বাকসের মইধ্যে বাইছা বাইছা মালিকের মায়ের বাকসোটার মইধ্যেই সেই নলের পানি পড়লো?’
শওকতও খানিকক্ষণ ভ্রু কুঁচকে থাকে কথাটা হৃদয়ঙ্গম করার জন্য। অফিসার ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছেন। লেবারদের বলেন, ‘সবই তো ভিজছে। এর মধ্যে মালিকের মায়ের বাকসো কোনটা?’
ইসমাইল আগ বাড়িয়ে আসে। ‘স্যার, বেবাক বইই সাহেবের মায়ের।’
– সব বই সাহেবের মায়ের?
– জি স্যার! বুড়ি মা। ছরি। বৃদ্ধ মা। আশি বচ্ছর বয়স। দুইডা দাঁত পড়ছে।
– এই এত বই আশি বচ্ছরের একজন বৃদ্ধ মহিলার?
– জি স্যার। স্যায় হইল একজন ল্যাখক। বই ল্যাখে। সব তার বই।
অফিসার কৌতূহলি হন। ‘তাই নাকি? আমাদের দ্যাশে আশি বচ্ছইরা একজন লেখিকা আছেন, যাঁর এত বই, কে সে? নাম কী?’
একটা ভেজা বাকসের ওপরের ডালা ধরে টান মারতেই রুটির মত খসে আসে সেটা। অফিসার ভেতর থেকে টেনে বের করেন একটা মোটা বই। বই বের করে হাতে তুলে ধরতে তাঁকে রীতিমত গলদঘর্ম হতে হয়।
– ওরে বাবা! এত ওজন ক্যান। ম্যাঘের পানি সব কি এই একটা বইয়ে সান্দাইছে না কি?
বইটা সুদৃশ্য। সুন্দর ঝকঝকে মলাট। পিছলে যাচ্ছে পাতা। পাতার ভেতর থেকে রুপুলি আলো ঝিলিক দিচ্ছে। অফিসার ইংরেজিতে লেখা বইয়ের নামটি একটু সময় নিয়ে পড়েন। ক্যালিফোর্নিয়া রাইটিংস – আমেরিকান লিটরেচার। বাম হাতের ওপর বইটি রেখে অন্য হাতে সিলকের মত মসৃণ মোলায়েম পাতা ওলটান। হাত মুচড়ে আসে তাঁর। ধুড়–ম করে বইটি নিচে জমে থাকা কাদাপানির মধ্যে পড়ে হাবুডুবু খেতে থাকে। একটু অপ্রস্তুত হন অফিসার। তারপর শওকতকেই বলেন, ‘হাঁ করে দেখছো কি, বইটা তোলো। আর বাকসো খুলে বাকি বই সব দেখাও!’ নিরাপত্তা কর্মকর্তার দাপট তার গলায়।
শওকত একটু ঘাবড়ে যায়। তারপরেও বলে, ‘স্যার, একবার তো আপনার লোকেরা সব লাইরা চাইরা দ্যাখছে। আবার দেখবেন?’
– একবার কেন, সিকিউরিটি দশবার দেখতে চাইলে দশবারই দেখাতে হবে! এ বই সন্দেহজনক। একবার বলছো মালিকের বই। এখন বলছো মালিকের দাঁতপড়া বুড়ি মায়ের বই। এখন দেখছি বিদেশি বই। আমরিকান বই। এত আমরিকান বই দিয়ে কী হবে? বাকসো খোলো! সব বইয়ের চুদুরবুদুর জানা আছে। হ্যাঃ আশি বচ্ছরের বৃদ্ধা পড়বে আমরিকান বই! আর কী বই আছে দেখি। রাশিয়ান বই আছে! উলফাতান বইও আছে নাকি?
উলফাতান বই? কইতে পারি না স্যার। আমগো কাছে তো বইয়ের লিস্টি দেয় নাই!
ইসমাইল একটা ভেজা কার্টনের ছাল ছাড়াতেই সেটার ভেতর থেকে গাদা গাদা বিদেশি বই আর জার্নাল বেরিয়ে আসে। দামি দামি ওজনদার বই। সিকিউরিটির লোকগুলো সবাই মিলে এক একটা করে বই হাতে তুলে নেয়। স্বর্ণের বারের মত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে।
ইসমাইল ভীত চোখে বইগুলোকে দেখে। তার কাছে মনে হয় এই বুঝি কোনো বইয়ের ভেতর থেকে ভয়ানক কিছু বেরিয়ে এলো। বোকা বোকা গলায় সে প্রশ্ন করে, ‘স্যার এইগুলা কি উলফাতান বই? সেইটা কোন দেশি?’
সিকিউরিটি অফিসার হাতের বইটা ফেলে আর একটা মোটা বই তুলে নেন। পাতা ওলটাতে গিয়ে থেমে পড়েন।
– অ্যাঁ? উলফাতান কোন দেশ? আ রে! ঐটা তো মজা করে বলছি। উলফার নাম শোনো নাই? আসামের সন্ত্রাসী সংগঠন? উলফা নেতারা দেশে বইসা গোপনে ট্রাক ভইরা ভইরা অস্ত্র আমদানি করে! দশ ট্রাক অস্ত্রের কথা জানো না তোমরা?
শওকত সতর্ক হয়ে ওঠে। চোখের ইশারায় ইসমাইল ও অন্যদের চুপ করে থাকতে বলে।
সেই দশ ট্রাক অস্ত্র যখন ধরা পড়ে তখন তার ভিতরের প্যাকেটগুলাও এই রকম বইয়ের প্যাকেটের মতই বড় বড় ভারি ভারি ছিল। তারপরে তো সইষ্যার ভিতর থেইকা ভূত বাইরাইল। চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলেন অফিসার।
‘এই তো স্যার, পাইছি! অস্ত্রের নিশানা!’ একজন গার্ড একটি বই খুলে চেঁচিয়ে ওঠে। সেখানে নানারকম অস্ত্রের রঙিন ছবি। মোটা, ভারি বই। বেশ বড়সড়। অফিসার দেখেন বইটি একটি যন্ত্র ও যন্ত্রাংশবিষয়ক এনসাইক্লোপিডিয়া। সে যাই হোক। অস্ত্র, সে ছবিই হোক, যন্ত্রাংশই হোক কি ভগ্নাংশই হোক, এমনি এমনি ছেড়ে দেয়া যায় না।
সুতরাং দশ মিনিটের মধ্যেই ট্রাকের মধ্যেকার সব কটা বইয়ের কার্টন খোলা হয়ে যায়। ভেজা আধভেজা বইগুলো সব চারপাশে ছড়িয়ে ফেলা হয়। শওকতের দলটাকে বলা হয় মোটা মোটা বইগুলো বেছে সব আলাদা করতে। ওগুলো সন্দেহের তালিকায় আছে। কিন্তু কাজে হাত লাগানোর আগেই প্রবল বৃষ্টির তোড়ে আকাশের তলা আর এক দফা খুলে যায়। বনবীথি আবাসিক এলাকার সামনে দাঁড়ানো তিনটি ট্রাকসহ ছড়ানো ছিটানো বইগুলো আপনমনে ভিজতে থাকে।