নন্দিনী নাগ

বৈশাখ মাস পড়েছে, শুরু হয়ে গেছে বিয়ের মরশুম। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই একটা দুটো করে নিমন্ত্রণ থাকছে। সব নিমন্ত্রণ রক্ষা করা অবশ্য সম্ভব হয় না তনুময়ের পক্ষে, মেয়ে সুতনুকাকে নিয়ে মৌলিকেই যেতে হয় সেসব ক্ষেত্রে। আজকের ব্যাপারটা অবশ্য আলাদারকম। আজ নিমন্ত্রণটা এসেছে তনুময়ের অফিসের তরফ থেকে, অতএব এই নিমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করার উপায় নেই তনুময়ের।
সুকল্যাণ সামন্ত ছিলেন তনুময়ের বস্, বছরখানেক আগে রিটায়ার করেছেন, তাঁরই একমাত্র মেয়ের বিয়ে।
অন্যদিন অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে রাত নটা বেজে যায় তনুময়ের, আজ আটটার আগেই ফিরেছেন, তারপর সপরিবারে এসেছেন নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে।
মেয়ের বিয়ের আয়োজনে কোথাও কিছু বাদ রাখেননি সুকল্যাণ। বিরাট এক ব্যাঙ্কোয়েট ভাড়া নিয়েছেন, ফুলে ফুলে সাজিয়েছেন তোরণ, অভ্যাগতদের প্রবেশপথ। তোরণ পেরিয়ে ঢোকার সময় অতিথিদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে গোলাপ, বেশ একটা নবাবী মেজাজ তৈরি করে দিচ্ছে। সেই মেজাজ আরো গাঢ় হচ্ছে যখন কানে আসছে নিচু স্বরে বাজতে থাকা যন্ত্রসঙ্গীত। কোনো রেকর্ড করা বাজনা চালাননি সুকল্যাণ, সেখানেও রেখেছেন তাঁর আভিজাত্যের চিহ্ন। হলের ভেতরে তৈরি করা হয়েছে ছোট একটা স্টেজ, সাদা ফরাস আর লাল ভেলভেটের তাকিয়ায় সাজানো সেই স্টেজে বসে কয়েকজন যন্ত্রশিল্পী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবেশন করছেন।
“বাহ্! দারুণ ব্যবস্থা তো!”
মৌলি মুগ্ধ হয়ে বলল।
তনুময়েরও বেশ ভালো লেগেছিল আয়োজনটা। ইদানীং অনেক বিয়ে বাড়িতে গিয়েই তিনি দেখেছেন, গানবাজনার আয়োজন করা হয়, কিন্তু সেসব হল নতুন হিন্দি সিনেমার ঝিংচ্যাক গান। গায়ক, গায়িকা, ব্যান্ডের ছেলেমেয়েরা গানবাজনার চাইতে মাথা ঝাঁকায় বেশি, ওসব তনুময়ের ভালো লাগে না। তবে বেশিরভাগ লোকজনের নিশ্চয়ই ভালো লাগে, নইলে নাচে-গানে-বাদ্যে বিয়ে বাড়ির জমায়েতগুলো নিজেরাই এক একটা রঙিন হিন্দি ছবি হয়ে যাবে কেন!
আজ অবশ্য মঞ্চের সামনে ভিড় ছিল না। ছোট ছোট জটলা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল কাবাব, ফুচকা, কফি, রঙিন পানীয়র কাউন্টারগুলোর সামনে। নানারকম সুখাদ্যের লোভনীয় ইশারার মাঝখানে মঞ্চে বসে তিনজন মানুষ নিবিষ্ট মনে বাজিয়ে যাচ্ছিলেন, ডুবে ছিলেন নিজেদের সঙ্গীতে।
“দেখেছ বাবা, লোকটা তখন থেকে একভাবে বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছে, ওর গলা শুকিয়ে যাচ্ছে না? ওকে তো কেউ একটু সফট ড্রিংকস দিতে পারে!”
নিজের হাতের রঙীন পানীয়র স্ট্রটাতে আলতো টান দিয়ে সুতনুকা বলল।
“সত্যিই তো! যা গরম পড়েছে, তার মধ্যে এক নাগাড়ে বাজিয়ে যাচ্ছে লোকটা! এমনিতেই তো বাঁশি বাজানো কত কষ্টের! বাকি দুজন তো হাত দিয়ে বাজাচ্ছে, ওদের না হয় তেষ্টা পাচ্ছে না, কিন্তু বাঁশিওলার তো পাচ্ছে! সুকল্যাণবাবুর উচিত ওদের বিশ্রাম দিয়ে একটু চা-জল খেতে দেওয়া, তাই না?”
মৌলির কথায় ঘাড় ঝাঁকালেন তনুময়। সুকল্যাণ সামন্তকে উচিত-অনুচিতের পাঠ পড়ানো তো তার পক্ষে সম্ভব নয়! অতএব ও নিয়ে মাথা না ঘামানোই ভালো। মঞ্চের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে এলেন তনুময়, প্রাক্তন এবং বর্তমান অনেক সহকর্মী যেখানে পানাহারে মগ্ন ছিলেন, তাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় ব্যস্ত হয়ে গেলেন তিনি।
শরীরটাকে সরিয়ে আনার কিছুক্ষণ বাদে তনুময় অনুভব করলেন, তার মনটা তখনও পড়ে আছে বাঁশিবাদকের কাছেই। তাই তিনি বার বার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছেন। এত লোকের কথাবার্তা, এতরকমের আওয়াজকে পাশ কাটিয়ে বাঁশির সুর তাঁর মস্তিষ্কের ঘুমিয়ে পড়া কোষগুলোতে লাগাচ্ছিল ধাক্কা, তুলছিল অনুরণন। বাঁশির সুরে তনুময়ের স্মৃতিতে জেগে উঠল আবীর, যার কথা এতগুলো বছর ভুলেই ছিলেন তিনি।
আবীরের সঙ্গে তনুময়ের বন্ধুত্ব কলেজে পড়তে গিয়ে। তনুময়দের ছাত্রজীবনে ইলেভেন-টুয়েলভ ক্লাসকে বাধ্যতামূলকভাবে স্কুলে পাঠানো হয়নি, ইচ্ছে করলে কলেজেও পড়া যেত। মুর্শিদাবাদের এক গ্রামের ছেলে তনুময়, গ্রামে উচ্চশিক্ষার সুযোগ না থাকায় মাধ্যমিক পাশ করার পর ওর বাবা বহরমপুরের এক নামী কলেজে ছেলেকে ভর্তি করে দিলেন। হোস্টেলে রেখে আসার সময় বাবা বলেছিলেন, “এত ভালো একটা কলেজে ভর্তি হতে পেরেছ, মন দিয়ে লেখাপড়াটা করবে। পাঁচ বছর বাদে একেবারে গ্র্যাজুয়েট হয়ে বেরবে এখান থেকে।”
তনুময়ও ঘাড় হেলিয়েছিল। কলেজ, ছাত্রাবাস প্রথম দেখাতেই মন জয় করে নিয়েছিল গ্রাম থেকে সদ্য শহরে আসা কিশোরের। কলেজ তো নয়, যেন রাজার বাড়ি! এতবড় কলেজে পড়তে পারার আনন্দই আলাদা।
প্রথমদিনের আনন্দ অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বিকেলে কলেজ ছুটি হয়ে যাবার পর বিরাট হোস্টেল বাড়িটা যেন গিলতে আসে ওকে, বাড়ির জন্য মনখারাপ করতে থাকে তনুময়ের। সেইসময়ে আবীর নামের লাজুক মুখচোরা ছেলেটা বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। ছুটির পরে তনুময় নামের সরল সাদা ছেলেটা করুণ মুখে সকলের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে দেখে সে বলেছিল,
“তুই ছুটির পর আমার সঙ্গে আমার বাড়িতে চল। সন্ধের দিকে আবার তোকে আমি হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে যাব।”
আবীর স্থানীয় ছেলে। সাইকেল চালাতে পারত না বলে বাড়ি থেকে হেঁটেই যাতায়াত করত। ওর সঙ্গী হতে তনুময়ের আপত্তি হয়নি। সবদিন আবার বাড়িতে ফিরত না আবীর, তনুময়কে নিয়ে বসত গঙ্গার পাড়ে। মুড়িমাখা খেতে খেতে দুইবন্ধুতে নানারকম গল্প করত। তনুময়ই বলত বেশি, নিজের গ্রামের কথা, পরিবারের কথা, ফেলে আসা স্কুলজীবনের গল্প, গ্রামের বন্ধুদের সঙ্গে মাঠ দাপিয়ে খেলার গল্প। আবীর ছিল ভালো শ্রোতা, চুপচাপ শুনত। প্রসঙ্গক্রমে তনুময় একদিন জানতে চেয়েছিল, “হ্যাঁ রে, তুই বিকেলে খেলিস না? আমাকেও না হয় তোর সঙ্গে নিয়ে যাস!”
আসলে তনুময় ভেবেছিল, ওকে সঙ্গ দিতে গিয়েই বোধহয় আবীরের বিকেলের খেলা ভন্ডুল হয়ে গেছে। কিন্তু ওর ধারণা উল্টেপাল্টে দিয়ে আবীর বলল, “আমার বল খেলতে ভালো লাগে না, রে! ছোটবেলায় একবার ফুটবল দিয়ে খুব জোরে লেগেছিল কপালে, তারপর থেকে বল দেখলেই ভয় লাগে।”
খেলাহীন বিকেলের কথা ভাবতেই পারে না গ্রামের ছেলে তনুময়, তাই জিজ্ঞাসা করেছিল, “তাহলে বিকেলে এতদিন তুই কি করতিস?”
কথাটা শুনে ম্লান মুখে হাসল আবীর। ব্যাগ থেকে বার করে আনল একটা আড় বাঁশি। বলল, “এই দ্যাখ! এটাই আমার সবসময়ের সঙ্গী। তোর আগে এটাই ছিল আমার একমাত্র বন্ধু।”
বিকেল ফুরিয়ে আসছিল তখন। গঙ্গার জলে গোলাপী ছোপ ধরছিল। জোয়ার আসছিল গঙ্গায়, ছলাৎছল শব্দে ঢেউ আছড়ে পড়ছিল ঘাটের সিঁড়িতে, ওদের পায়ের কাছে। আবীর ততক্ষণে বাঁশিতে লাগিয়ে ফেলেছিল তার নিজের সুর। গানবাজনার কিছুই বোঝে না তনুময়, না জানে তার শাস্ত্র, না বোঝে সুর-তাল-লয়। তবুও আবীরের ফুটিয়ে তোলা সুর জলের ঢেউয়ের মতোই শব্দ তুলে ভাঙতে লাগল ওর বুকের কাছে। একটা জমাট বাধা কান্না বুকের গভীর থেকে উঠে এসে ঝুলে রইল চোখের নিচে। আবীরকে ভালো লেগে গেল তনুময়ের।
আবীরদের বাড়িতে যখনই গেছে তনুময় ওর মা যথেষ্ট যত্নআত্তি করেছেন। ভালো করে খাইয়ে-দাইয়ে বিদায় দেওয়ার সময় প্রতিবারই বলতেন, “আমার ছেলেটা ছোটো থেকেই একটু অন্যরকম। ওর জন্য খুব দুশ্চিন্তা হয় আমার জানো! তুমিই ওর একমাত্র বন্ধু, ওকে একটু দেখেশুনে রেখো বাবা!”
কোনো বিকেলে আবীর তনুময়কে নিয়ে গেছে শহরের প্রান্তে নির্জন এক মাঠে, যেখানে কয়েকটা গোরু ছাগল ছাড়া আর কেউই নেই। সবুজ ঘাস বিছানো মাঠে পাশাপাশি চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশ দেখতে দেখতে তনুময় বলেছে, “আমি গ্রামের ছেলে হলেও প্রকৃতিকে এভাবে কখনো চেনা হয়নি।”
“আমার যে প্রকৃতি ছাড়া আর কিছু নেই, মানে ছিল না এতদিন। তাই আমার সব কথা প্রকৃতিই জানে।”
“আচ্ছা আবীর, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? কিছু মনে করবি না তো?”
“কর না! কেউ তো কোনোদিন আমার মনের কথা জানতে চায়নি, তবুও তো তুই জানতে চাইলি।”
“আচ্ছা, তুই কারো সঙ্গে মিশিস না কেন? এরকম একলা একলা থাকিস, তোর সমস্যাটা কি?”
“কার সঙ্গে মিশব বল? দেখিস না, সবাই কেমন আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে? আমার এদের কাউকে ভালো লাগে না। আর সবচেয়ে সত্যি কথাটা হল আমার নিজেকেও ভালো লাগে না।”
কথাটা শুনে অবাক হয়ে তনুময় উঠে বসল।
“মানে? প্রতিটা মানুষ তো নিজেকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে, তুই বাসিস না?”
“না। কেন জানিস? আমার সবসময় মনে হয়, এই ‘আমি’টা আসলে ‘আমি’ নই। অন্য একটা শরীরে ভগবান আমাকে ভুল করে ভরে দিয়েছেন। এই শরীরটা, এই জীবনটা আমার একদম পছন্দ হয় না। মাঝে মাঝে মনে হয়, এই জীবনটা আর রাখব না, কিন্তু মা বাবার কথা ভেবে সেটাও করতে পারি না। আমি যে কি করব, নিজেও জানি না, রে!”
আবীরের চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল। তনুময় হতবাক। ও বুঝতেই পারছিল না, কিভাবে সান্ত্বনা দেবে আবীরকে! আবীর যা বলল, তেমন অদ্ভুত কথা ও কখনও শোনেওনি আগে। কিন্তু কিছু তো বলা দরকার, তাই অনেক ভেবে বলল, “তোর এই সমস্যার কথা আর কাউকে বলিসনি? মানে, মা-বাবাকে তো বলা দরকার।”
“মাকে বলতে চেয়েছিলাম একবার। তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। আমাদের পাশের বাড়িতে একটা মেয়ে থাকে, টিয়া। আমার তো নিজের ভাই-বোন নেই, তাই ওকেই আমি ‘বুনু’ বলে ডাকতাম, ওর সঙ্গেই ছোটবেলায় খেলতাম। বড় হয়েও রোজ ওর সঙ্গে খেলতে যেতাম বলে মা একদিন খুব বকেছিল। তখন আমি মাকে বলেছিলাম, আমারও নিজেকে মেয়ে মনে হয়, তাই ওর সঙ্গে খেলি। মা শুনে কান্নাকাটি শুরু করে দিল, ভাবল আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে! তাই এখন আর কাউকে কিছু বলি না।”
অন্ধকার গাঢ় হয়ে এসেছিল, কেউ আর কারও মুখ দেখতে পাচ্ছিল না। হোস্টেলে ফিরতে দেরি হলে সুপার বকবেন, তাই তনুময় বাধ্য হয়ে বলল, “এবার উঠি চল! নইলে স্যর ঢুকতে দেবেন না।”
“না দিলে আমার বাড়িতে থেকে যাবি। একমাত্র তোর সঙ্গে যতক্ষণ থাকি, ততক্ষণই আমার ভালো লাগে।”
“তারপর? রাতে অন্য কোথাও থাকলে যদি টি সি দিয়ে দেয়, তখন কি করব?”
তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ফিরে এসেও শেষরক্ষা হয়নি সেদিন। দেরি করে হোস্টেলে ফেরার অপরাধে সুপারের ঘরে ডাক পড়েছিল তনুময়ের। একপ্রস্থ বকাবকি করে উনি বলেছিলেন, “বিকেলবেলা খেলাধুলা, শরীরচর্চা এসব করতে পারিস তো! তা নয়, সারাক্ষণ ওই লেডিজমার্কা ছেলেটার সঙ্গে আঠার মতো সেঁটে আছিস। কি এমন কথা থাকে তোদের যে সারাদিন ক্লাসে বলেও শেষ হয় না? ছুটির পরে আবার একসঙ্গে ঘুরতে হয়?”
তনুময় মাথা নিচু করে বলেছিল, “গ্রাম থেকে আসার পর একা একা লাগত, তখন আবীর বন্ধুত্ব করেছিল, ওদের বাড়িতেও নিয়ে যায়, তাই–”
“অনেকদিন হয়ে গেছে এসেছ, এবার অন্যদের সঙ্গেও বন্ধুত্ব করো।”
তনুময় ঘাড় হেলিয়েছিল। পরদিন আর আবীরের সঙ্গে বেরোয়নি, তার পরের দিনও না। আবীর জিজ্ঞেস করাতে বলেছিল, “রোজ রোজ বেরোব না, রে! স্যর খুব বকাবকি করেছেন।”
আবীর আর কিছু বলেনি, ম্লান মুখে চলে গেছিল।
পরদিন ক্লাসে একটা চিরকুট ধরিয়েছিল আবীর। তাতে লেখা, “এইজন্যই আমি কারো সঙ্গে মিশতাম না। জানি সবাই আমাকে ছেড়ে চলে যাবে।”
তনুময়ের তখন উভয় সংকট। একদিকে স্যরের চোখরাঙানি, অন্যদিকে আবীরের জন্য খারাপ লাগা। বেচারা আবীর! ছেলেটা একটু ক্ষ্যাপাটে ধরনের ঠিকই, কিন্তু খারাপ তো নয়! ওর সঙ্গে মিশলে সকলের এত সমস্যা হয় কেন কে জানে! তনুময় সিদ্ধান্ত নিল, আবীরের সঙ্গে মেলামেশা কিছুতেই বন্ধ করবে না। রোজ না বেরোলেও, মাঝেমাঝে বেরোবে ওর সঙ্গে, আর সময়ের মধ্যেই ফিরে আসবে, যাতে কেউ কিছু বলতে না পারে।
বলতে না পারলেও করে দেখিয়েছিলেন হোস্টেল সুপার। তনুময় আর আবীরের মেলামেশা যে কমেনি সেই খবর অন্য ছেলেদের মারফৎ তাঁর কানে নিয়মিত আসছিল এবং সেটা রঙ চড়িয়ে।
“ওরা কিন্তু রোজ বেরোচ্ছে, স্যর।”
“ক্লাস না করে দুজনে সিনেমা দেখতে গেছিল স্যর।”
“দুজনের মধ্যে চিঠি চালাচালিও হয় স্যর!”
“স্যর! তনু বলেছে, আমার যা ইচ্ছে তাই করব, স্যর কি করে আটকায় দেখি!”
ক্রুদ্ধ, বিরক্ত হয়ে স্যর ডেকে পাঠিয়েছিলেন তনুময়ের বাবাকে।
“আপনি অনেক ভরসা করে ছেলেকে এখানে রেখে গেছেন। কিন্তু আপনার ছেলে কূ-সঙ্গে পড়েছে। ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে শিক্ষক হিসাবে আমি অত্যন্ত উৎকন্ঠিত। ছেলেকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়াই আপনার পক্ষে উচিৎ কাজ হবে।”
তনুময়ের বাবা বোকাসোকা মানুষ, স্যর ছেলের খারাপ-সঙ্গে পড়ার নমুনা হিসাবে যে কথাগুলো বলেছিলেন, তার অর্থ তিনি পুরোপুরি বোঝেননি। তবে শিক্ষকমশাই যখন ডেকে বলছেন, তখন বিষয়টাতে নিশ্চয়ই গুরুত্ব আছে, এটা বুঝেছিলেন। অতএব ছেলেকে হোস্টেল ছাড়িয়ে বাড়িতে নিয়ে যেতে দ্বিধা করেননি।
তনুময়কে হঠাৎ করে যখন ওর বাবা নিতে এল, তখনও বুঝতে পারেনি যে চিরকালের মতো এই কলেজ ছেড়ে চলে যেতে হবে তাকে। আবীরের সঙ্গে শেষবারের মতো দেখাও করতে পারেনি, কিছু বলেও আসতে পারেনি ওকে। পুরো বিষয়টা বুঝে ওঠার পরে আবীরের ঠিকানায় কয়েকটা চিঠি পাঠিয়েছিল বটে, তবে কোনো উত্তর পায়নি। আবীরের জন্য কিছুদিন মন খারাপ ছিল বটে, কিন্তু জীবন আবার নতুন পথে চলতে শুরু করে দেওয়ায় ধীরে ধীরে আবীরকে ভুলেও গেছে তনুময়।
পরিণত বয়সে কয়েকবার মনে হয়েছিল আবীরের কথা, মনে হয়েছিল একবার বহরমপুরে গিয়ে দেখে আসে আবীর কেমন আছে। কিন্তু হয়ে ওঠেনি, কিংবা বলা যায় সাহসে কুলায়নি। যদি গিয়ে শুনতে হয়, সে আর নেই, যদি ওর মা আঙুল তুলে বলেন, “তোমাকে ভালোবাসত আবীর, ভরসা করত। আর তুমিই ওর হাত ছেড়ে আচমকা চলে গেলে? তোমার জন্যই ছেলেটা অকালে চলে গেল!”
হতে পারে, নাও হতে পারে। আবীর আসলে কি ছিল? সমকামী নাকি রূপান্তরকামী? তাও জানেন না তনুময়। শুধু এটা বোঝেন, বহরমপুর থেকে সেদিন বাবার নিয়ে চলে আসাটা তাঁর নিজের পক্ষে ভালোই হয়েছে। নইলে অল্পবয়সের আবেগ তাঁকে কোথায় নিয়ে ফেলত কে জানে!
মঞ্চে বসে যে মানুষটি তাঁর সমস্ত মনপ্রাণ ঢেলে বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছেন, তাঁকে তনুময়ের সমবয়সী বলেই মনে হল। ওইরকমই কাঁধ পর্যন্ত ঝাঁকড়া চুল, ফরসা রঙ, চাপা নাক। ও কি আবীর? তার একমাত্র বন্ধু, একমাত্র আশ্রয় বাঁশিকেই অবলম্বন করে বেঁচে আছে? অনেকগুলো বছরের প্রলেপ পড়েছে বাঁশিবাদকের মুখে, কাছের থেকে খুঁটিয়ে না দেখলে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয় তনুময়ের পক্ষে।
কিন্তু পারলেন না তনুময়। অতীতে যেমন পারেননি আবীরের বাড়িতে গিয়ে তার সামনে দাঁড়াতে, আজও তেমন এগিয়ে গিয়ে নতমুখী নিমগ্ন মানুষটার সামনে দাঁড়িয়ে চিনে নিতে পারলেন না এ-ই সেই হারিয়ে ফেলা বন্ধু কি না। কেবল বাঁশির সুর বিরাট একটা প্রশ্ন হয়ে দুমড়ে মুচড়ে দিতে থাকল তনুময়ের বুকের ভেতরটা।
বিয়েবাড়ি থেকে ফেরবার সময় মৌলি তনুময়কে বলল, “ভারী সুন্দর বাঁশি বাজাচ্ছিল লোকটা, তাই না? অথচ দেখো, শিল্পী হিসাবে এঁরা কতটুকুই বা স্বীকৃতি পান! কে-ই বা এঁদের চেনে!”
তনুময় আনমনে বলল, “ওকে আমি চিনি না, ওই বাঁশিওয়ালার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।”
মৌলি অবাক হয়ে তনুময়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন