দীপান্বিতা রায়
কথায় বলে বাঙালির পায়ের তলায় সর্ষে। দ্যাখ না দ্যাখ পোঁটলা-পুঁটলি বেঁধে বেরিয়ে পড়ে। কথাটা বোধহয় খুব একটা মিথ্যে নয়। ভারতের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় বাঙালির ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার প্রবণতা বেশি। সেইজন্য যে কোনও ট্যুরিস্ট স্পটে গেলেই বাঙালির মুখোমুখি হওয়াও প্রায় অনিবার্য। ইদানীং আমাদের দেশেও বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারটা বেশ সহজ হয়ে গেছে। ইন্টারনেটের কল্যাণে অনেক আগে থেকেই ঘরে-বসে ট্রেন কিংবা প্লেনের টিকিট বুকিং করে ফেলা জায়গায়। যেখানে যেতে চাই সেখানে হোটেল এমনকি ঘোরাঘুরির গাড়ি পর্যন্ত ঠিক করে রাখাও এখন জলভাত। আর নিজে কিছুটি করতে না চাইলেও অসুবিধা নেই। নানা নামের-দামের অজস্র সংস্থা আছে যারা আপনার হয়ে সব ব্যবস্থা করে দেবে। অবশ্যই অর্থের বিনিময়ে। আপনাকে শুধু সময়মতো জিনিসপত্র গুছিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে।
অবস্থাটা যখন এরকম ছিল না, তখনও কিন্তু বাঙালির বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছার কোনও কমতি ছিল না। তবে তখন নানা অসুবিধার কারণে এমন সব ঘটনা ঘটে যেত এককথায় যার তুলনা মেলা ভার। সেরকম দু-একটি ঘটনার কথাই আজ বলব। আমার বাবার ছিল বেড়াতে যাওয়ার নেশা। তাঁর বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনাটিও হতো বেশ বিস্তারিত। মানে ট্রেনে চেপে পুরী বা বেনারস ঘুরে এলাম, এমনটা মোটেই নয়। একধাক্কায় অন্তত গোটা পাঁচ-সাত জায়গা ঘুরে আসতে না পারলে পিতৃদেবের মতে সেটা কোনও বেড়ানোই নয়। নেহাতই টাকাগুলোকে জলে ফেলে দেওয়া। সময়টা নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। সেবছরও পুজোর সময় ঠিক হয়েছে বেড়াতে যাওয়া হবে। মা-বাবা তখন থাকেন আসানসোলে। আমার সবে বিয়ে হয়েছে। আমরা থাকি কলকাতায়। যাত্রা শুরু ধরে নেওয়া যাক্ আসানসোল থেকে। প্রথমে লক্ষ্ণৌ। সেখান থেকে কাঠগোদাম হয়ে নৈনিতাল। তারপর কৌসানি, চকৌরি, বিনসর, আলমোড়া, রানিখেত হয়ে ফেরা। সবমিলিয়ে প্রায় দিন দশ-বারোর ধাক্কা।
বাবার পুরো প্ল্যান ফাইনাল হয়ে যাওয়ার পর, প্রথম সংকট হল ট্রেনে রিজার্ভেশন। আসানসোল থেকে কোনও ট্রেন বার্থ রিজার্ভেশন পাওয়া গেল না। আগে ট্রেনে টিকিট পাওয়া যাচ্ছে কিনা দেখে নিয়ে তারপর প্ল্যান করবেন, এমন ধারণায় বাবা মোটেই বিশ্বাসী নন। অতএব দিনক্ষণ সব আগেই ঠিক করে ফেলেছেন এবং আমাদেরও মোটামুটি হুকুম দিয়ে সেই মতো ছুটির আবেদন করিয়েছেন। ছুটি মঞ্জুর হয়ে গেছে। তাই অন্যদিনের টিকিট পাওয়া গেলেও কাটা যাবে না কারণ অফিস তো আর আমার ইচ্ছে মতো ছুটি বদলে দেবে না। সে এক উদ্ভট পরিস্থিতি। যাই হোক্ অনেক চেষ্টায় আমাদেরই এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়, যিনি রেলে কাজ করতেন তাঁর সহায়তায় টিকিট কাটা হল ওই তারিখেই। তবে আসানসোল থেকে নয়, টিকিট পাওয়া গেল ধানবাদ থেকে। খুব একটা অসুবিধাজনক কিছু নয়। আসানসোল থেকে ধানবাদের দূরত্ব বেশি নয়। ট্রেনে সময়ও বেশি লাগে না। ফলে সবাই মোটামুটি আশ্বস্ত হলাম। বাবা আমাকে ফোনে জানিয়ে দিলেন কোন ট্রেনে রিজার্ভেশন। কত নম্বর কামরা এবং সিট ও বার্থ নম্বর কত। মোবাইল ফোন তখন স্বপ্নেও নেই। বাড়ি বাড়ি ফোনও তখনও পর্যন্ত আসেনি। ফলে বাবা যে তথ্যগুলি আমাকে দিলেন সেগুলি আমি সযত্নে একটি চিরকুটে লিখে রাখলাম। কারণ বারবার যোগাযোগ করার তো উপায় নেই।
দেখতে দেখতে পুজোর ছুটি এসে গেল। শিয়ালদা স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়বে। ঠিক হয়েছিল ধানবাদ থেকে আমাদের রিজার্ভেশন যে কামরায় সেখানেই আমরা উঠে পড়ব। দিনের বেলায় অসুবিধা হবে না। বাবা-মা এবং আমার দুই বোনও আসানসোল থেকে ওখানেই উঠবে। তাহলে ধানবাদে সিট খালি হলে নিশ্চিন্তে নিজেদের আসনে বসে পড়া যাবে। যাওয়ার আগে আমি আমার ঘরের মানুষটিকে বারবার মনে করাচ্ছি, চিরকুটটা যাতে নিয়ে যেতে ভুলে না যাই। কারণ তাহলে ঠিক কামরায় উঠতে পারব না। ভীষণ মুশকিল হবে। তিনিও বারবার আমাকে আশ্বস্ত করছেন যে অবশ্যই সেটা সঙ্গে নেবেন। বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে ট্যাক্সিতে চেপে শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছানোর একটু আগে বোঝা গেল চিরকুটটি সযত্নে বাড়ির ড্রয়ারে রাখা আছে। কেউই সেটি সঙ্গে আনিনি। তখন বাড়ি গিয়ে আনতে হলে ট্রেন মিস্ হয়ে যাবে। অতএব উপায় নেই। ট্যাক্সি থেকে নেমে প্ল্যাটফর্মে গেলাম। যদিও আমার সঙ্গী খুব নিশ্চিতভাবে আমাকে বললেন যে তাঁর স্পষ্ট মনে আছে, বাবা বলেছিলেন বি সেভেন কামরায় আমাদের বার্থ কিন্তু আমার ঠিক কারও কথায় অতটা আস্থা রাখা অভ্যাস নয়। সেযুগে প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ছাড়ার বেশ খানিকক্ষণ আগে রিজার্ভেশন চার্ট টাঙিয়ে দেওয়া হত। সেদিনও সেটি দেওয়া ছিল। সেখানে দেখা গেল বি সেভেন কামরার সব যাত্রীই লক্ষ্ণৌ পর্যন্ত যাবেন। সুতরাং সেখানে আমাদের সিট থাকার কোনও সম্ভাবনা নেই। সঙ্গীর আত্মবিশ্বাসকে সারাজীবনের মতো ধূলিসাৎ করে দেওয়ার উপযোগী বেশ কিছু কড়া কড়া বিশেষণ প্রয়োগের পর আমি সেই বিশাল রিজার্ভেশন চার্ট প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত খুঁটিয়ে দেখে আবিষ্কার করলাম বি টুয়েলভ কামরায় পাশাপাশি ছটি আসন ধানবাদে খালি হচ্ছে। আমরাও ঠিক ছজনই আছি। তারমানে ওগুলোই আমাদের সিট। বাবা নিশ্চয় বি টুয়েলভ বলেছিলেন, সেটাকে বি সেভেন বানিয়ে ফেলার জন্য বরকে আরেকবার দোষারোপ করে আমরা তো বি-টুয়েলভে উঠে বসলাম।
ট্রেন ছেড়ে দিল। হিসাবমতো বাবা এবং অন্যদের আসানসোলে ওই কামরায় ওঠার কথা। আসানসোল স্টেশনে ট্রেন যথাসময়ে এসে পৌঁছল। কিন্তু কামরায় কেউ উঠল না। বাবারা কি তাহলে ট্রেন ফেল করলতঁ? তাহলে কি অন্য কোনও ট্রেনে যাওয়ার কথ? আমরা কি ভুল ট্রেনে উঠলাম? আতঙ্কে আমার তো চোখ দিয়ে জল পড়ো পড়ো। এদিকে আমাদের কাছে তো ধানবাদ পর্যন্ত টিকিট। অন্য টিকিট সব বাবার কাছে। তাই ধানবাদের আগে খুঁজে না পেলে আমাদের ট্রেন থেকে নেমে যেতে হবে। নাহলে তো চেকারে ধরলে জেলের ঘানি। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। সে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। ইতিমধ্যে লাইনে কিছু একটা গণ্ডগোল হওয়ায় ধানবাদের আগে একটা জায়গায় ট্রেন সিগন্যাল না পেয়ে দাঁড়াল। বেশ কিছু লোক লাইনে নেমে এদিক-ওদিক করছে। সেই সময় আমার বর দরজা দিয়ে অনেকখানি মাথা ঝুঁকিয়ে দেখে এসে বলল, মনে হচ্ছে বাবারা এই ট্রেনেই উঠেছেন। কিন্তু কোথায় উঠেছেন বুঝতে পারলাম না। দূর থেকে টাকটা দেখতে পেয়েছি…..
ওই রকম উদ্বেগের মধ্যে এহেন উক্তিতে আমার পিত্তি শুদ্ধ জ্বলে গেলেও তখন তো কিছু করার নেই। যতক্ষণ না বাবার সঙ্গে দেখা হচ্ছে ততক্ষণ তো এর ভরসাতেই থাকতে হবে। তাই বাধ্য হয়েই চুপ করে রইলাম।
ধানবাদ স্টেশন আসতেই আমরা দুজনে লাফ দিয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমেছি। আমার তো রীতিমত হাত-পা কাঁপছে। এক মিনিটের মধ্যে দেখা গেল সব জিনিসপত্র নিয়ে মা-বাবা আর দুই বোন ছুটতে ছুটতে আসছে। সঙ্গে আমাদের মামা। তিনি ধানবাদেই থাকেন। স্টেশন তাঁর দেখা করতে আসার কথা ছিল। কোনওরকমে সবাই হুড়মুড় করে কামরায় উঠে বসার পর জানা গেল পুরো ব্যাপারটাই রেল কোম্পানির সাংঘাতিক অবিমৃশ্যকারিতার ফল। আমাদের টিকিট ছিল বি সেভেন। আত্মবিশ্বাসী ভদ্রলোক ঠিকই বলেছিলেন। কিন্তু আসানসোল থেকে ট্রেনে উঠে বাবারা আবিষ্কার করেন প্রথমত আমরা সেই কামরায় উঠিনি। দ্বিতীয়ত, আমাদের আসনে অন্য লোক বসে আছেন এবং তাঁরাও লক্ষ্ণৌ যাবেন। সে এক ভীষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। এদিকে আমার মামা স্টেশনে এসে আবিষ্কার করেন যে বাবা তাঁকে যে কামরায় থাকবেন বলেছেন, রিজার্ভেশন চার্টে সেখানে অন্য লোকের নাম লেখা আছে। তিনি তখন খুব দ্রুত স্টেশন মাস্টারের কাছে গিয়ে জানতে পারেন, যে পুজোর সময় অতিরিক্তি ভিড়ের কারণে ট্রেনে দুটি নতুন কামরা যোগ করা হয়েছে এবং কিছু যাত্রীকে সেখানে আসন দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদেরও কামরা বি সেভেন থেকে বি টুয়েলভ হয়ে গেছে। যাদের কামরা বদলে গেছে তাদের কিছু জানানো হয়নি, জানানোর কোনও প্রয়োজনও রেল কোম্পানি বোধ করেনি। ফলে মামা প্ল্যাটফর্মে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন এবং ট্রেন পৌঁছানোমাত্র সবাইকে কোনওরকমে বি সেভেন থেকে নামিয়ে ছুটতে ছুটতে বি টুয়েলভে এনে উঠিয়েছেন। আর আমরা দুজন তো সেখানে আগে থেকেই ছিলাম। সেদিন থিতু হয়ে বসার পর পরোটা আর কিমাকারি খেতে খেতে অনেকক্ষণ রেল কোম্পানির অপদার্থতা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। তবে আমি মনে মনে আত্মবিশ্বাসীকে অত বেশি চোখা চোখা বাক্যবাণে অভিষিক্ত করার জন্য একটু অপ্রস্তুতই বোধ করেছিলাম।
সেযাত্রায় নিরাপদে লক্ষ্ণৌতে নেমে কাঠগোদাম যাওয়ার ট্রেন ধরেছিলাম। তারপর অন্য যেসব জায়গায় যাওয়ার কথা ছিল সেখানেও গেছিলাম। সর্বত্রই ছোটখাটো দুর্ঘটনা হয়েছে। তবে যেটা সবথেকে সাংঘাতিক হতে পারত সেটার কথা বলে লেখা শেষ করব।
আগেই বলেছি বাবার ছিল বেড়াতে যাওয়ার নেশা। দেশে-বিদেশে বহু জায়গায় তিনি ঘুরেছেন। মুশকিল হচ্ছে তাঁর বেড়ানোর ধরনটা ছিল বোহেমিয়ান টাইপ। মানে বেড়াতে বেরোলে ভোজনং যত্রতত্র, শয়নং হট্টমন্দির-টাই তাঁর আদর্শ। বিয়ের আগে এভাবে বহু জায়গায় গেছেন, অসুবিধা হয়নি। কিন্তু স্ত্রী এবং মেয়েদের নিয়ে বেরোলে ব্যাপারটা যে একটু জটিল হতে পারে সেটা তিনি ভাবতেনই না। ফলে বেড়াতে যাওয়ার আগে হোটেল বুকিং-এর কোনও প্রশ্ন উঠত না। দার্জিলিং স্টেশনে, সন্ধের মুখে মা আমাদের দুই বোনকে নিয়ে টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন আর বাবা গেছেন হোটেল খুঁজতে এমন অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। এবারেও সেরকমই একটা ট্রাপিজের খেলা চলছিল। পুজোর সময়। ফলে সর্বত্রই ট্যুরিস্টের ভিড়। তাও কোনওক্রমে সবসময় পছন্দমতো না হলেও মোটামুটি একটা থাকার জায়গা ম্যানেজ করা যাচ্ছিল। এভাবেই নৈনিতাল, কৌশানি হয়ে আমরা রওনা হলাম চকৌরির উদ্দেশ। বাবার ঘোর অনিচ্ছসত্ত্বেও নৈনিতাল থেকে একটা গাড়ি নেওয়া হয়েছিল। তাতেই পুরোটা ঘোরা হবে। চকৌরি তখন খুবই নির্জন জায়গা। তবে আমাদের জানা ছিল কুমায়ুন বিকাশ নিগমের একটি ট্যুরিস্ট বাংলো সেখানে আছে।
বাস যাচ্ছে পাহাড়ি পথ দিয়ে। চারিদিকের দৃশ্য অসম্ভব সুন্দর। আমরা সবাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মগ্ন। হঠাৎ দেখা গেল একটা ছোট ট্যুরিস্ট বাস আমাদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল। রাস্তা একটাই। অন্য কোথাও যাওয়ার কোনও উপায় নেই। তারমানে বাসও নির্ঘাত্ চকৌরি যাচ্ছে। আমার হঠাৎ মনে হল একটাই তো থাকার জায়গা। বাস আগে পৌঁছে গেলে যদি আমরা জায়গা না পাই? বাকিরা তখনও তেমন কিছু ভাবেনি। বাবা তো রীতিমত নিশ্চিন্ত। গোটা একটা ট্যুরিস্ট লজ আছে, সুতরাং জায়গা তো পাওয়া যাবেই। আমি কিন্তু নীচু গলায় ড্রাইভারকে বললাম, চেষ্টা করো, বাসটাকে ওভারটেক করতে।
নতুন গাড়ি। তাই বাস ছাড়িয়ে এগিয়ে যাওয়া তেমন কিছু কঠিন হল না। বেশ খানিকটা রাস্তা। আমাদের পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে যাবে। বাস যখন বেশ কিছুটা পিছনে পড়ে গেছে এবং আমিও অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করছি, তখনই দুম করে গাড়িটার টায়ার জবাব দিল। গাড়ি দাঁড়াল রাস্তার ধারে। স্টেপনি বার করে টায়ার বদলানোর মাঝখানেই, ট্যুরিস্ট বাস হুহু করে আমাদের পাশ কাটিয়ে, আমার রক্তচাপ বাড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল।
টায়ার বদলানো হল। গাড়িও ছাড়ল। আমি মুখ চুন করে বসে আছি। হঠাৎ দেখি রাস্তার পাশে একটা ধাবার মতো জায়গায় বাসটা দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত যাত্রীরা খাওয়া-দাওয়া করতে নেমেছিলেন, তাঁরা তখন বাসে উঠছেন। তাই দেখে বাবা হৈহৈ করে বলে উঠলেন,
এই তো একটা ধাবা পাওয়া গেছে। এখানেই খেয়ে নিই চল্….
কিন্তু আমার তখন হার্টবিট ক্রমশ বাড়ছে। আমি আর ধৈর্য রাখতে না পেরে রীতিমত বাঘা গলায় হুংকার দিলাম, কোথাও দাঁড়াব না। আগে ট্যুরিস্ট লজে চলো….তারপর দেখা যাবে….
বাবা শুধু নয় বাকিরাও সবাই অবাক। কিন্তু ড্রাইভার আমার কথায় গুরুত্ব দিয়ে গাড়ি না থামানোয়, কেন আমি এরকম করছি, বোঝার আগেই গাড়ি বেশ খানিকটা এগিয়ে চলে এসেছে। তারপর সব শুনে আমার উদ্বেগকে বাবা মোটেই পাত্তা না দিলেও অন্যরা বোঝা গেল মোটেই অতটা নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। বিশেষ করে মা, জায়গা না পাওয়া গেলে রাতে কোথায় থাকা হবে সেই ভেবে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এদিকে তখন বাসের সঙ্গে আমাদের রীতিমত রেস চলছে। ড্রাইভারকে আমি বলে দিয়েছি, কোনওভাবেই বাসকে এগিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। সুতরাং পাহাড়ি রাস্তায় জুঁ…ই…জুঁ…ই করে গাড়ি চালিয়ে একসময় আমরা চকৌরি ট্যুরিস্ট লজের হাতায় ঢুকলাম, আমাদের পিছু পিছু বাসও ঢুকল। তারপর গাড়ি থেকে নেমে আমি আর আমার বোন মোটামুটি হান্ড্রেড মিটার স্প্রিন্ট টেনে সোজা রিসেপশনে। তখনকার চেহারায় সম্ভব হয়েছিল। এখন হলে নিশ্চিত মধ্যপথেই গদাম হতাম। রিসেপশনের ভদ্রলোকটি মরি-বাঁচি করে ছুটে আসা দুই মহিলাকে খুবই ঠাণ্ডা, নিরুত্তাপ গলায় বললেন, লজের সব ঘর ভর্তি। শুধুমাত্র ডরমেটরি খালি আছে। ডরমিটরিতে ছটি বেড। আমরাও দলে ঠিক ছয়জন। বাসের যাত্রীদের পাণ্ডা যখন অফিস ঘরে এসে পৌঁছালেন তখন আমি রেজিস্টারে সই করছি।
সবশেষে দুটি জিনিস বলার। বাসে যাত্রী ছিল মাত্র নজন। কদিন আগেই ওই এলাকায় বোমা বিস্ফোরণ হওয়ায়, তারা সেদিন রাতে ফিরে যাওয়া নিরাপদ মনে করেনি। ট্যুরিস্ট লজের লাউঞ্জেই সোফায় শুয়ে ভেড়া গুণে ছিল। ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডায় কম্বলমুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে আমি শুধু ভাবছিলাম পরিস্থিতি ঠিক উল্টোটাও তো হতে পারত।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন