short-story-biswaser-khola-janala

বিশ্বাসের খোলা জানালা
শাহিদা মিলকি


সূর্যের প্রখর রোদের মতো চাঁদের ধপধপে সাদা আলো আছড়ে পড়ছে খড়পচা চালটার উপর। সুপারি গাছ থেতলে ঘরের বেড়া দেয়া হয়েছে। ভাঙা বেড়ার চর্তুদিক থেকে জোনাকি আলো ঢুকে যেন খেলা করছে। এক ফালি আলোর সঙ্গে সবেদার কালো মোটা ঠোঁট দুটো মাঝে মাঝেই বিড় বিড় করছে।

পাট খড়ির পার্টিশন দেয়া পাশের ঘর থেকে সদ্য বিবাহিত সালমা আর কুদ্দুসের আবীর রাঙ্গা ফিস ফিস কথায় সবেদার ভীষণ কষ্ট হয়। নিয়ম মাফিক তো তারই আগে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। সংসারের বর্ণিল আলোয় ভাসবার কথা ছিল। ভালোবাসার ঢেউয়ে হারিয়ে যাবার কথা ছিল। কিন্তু কখনো তো কেউ তাকে ভালোবাসার কথা বলেনি। কেউ কখনোই সমুদ্র সন্তরণের আহ্বান জানায়নি। এমন বিসদৃশ্য চেহারা দেখে তাকে কেউ পছন্দই করেনি।

তাছাড়া পছন্দ করবেই বা কি করে। সমস্ত শরীরটাতে যে এ্যালার্জির দগদগে ঘা। হাত পা ফুলে খুঁটির মতো। কালো মোটা ঠোঁট দুটো ফুলে যেন আরো বেশি মোটা হয়েছে। কোন রকমে ভিক্ষা করে জীবনটা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে আর কী! কিন্তু শরীরের এই অস্বাভাবিকতার জন্য সে তো দায়ী নয়। তাহলে কেনো এই অমানবিক জীবনযাপন? কেন এতটুকু শীতল বাতাস তার জন্য অপেক্ষা করে না? কেন ছোট বোনের বাসরের মদিরতা তাকে উদ্বেল করে তুলছে।

গত তিন দিন শুরু হয়েছে কোরবানির ঈদের। এই দুই দিন কী ঝামেলাটাই না গেল। কোথায় কুড়িগ্রামের হাতিবান্ধা আর কোথায় রংপুর। যেমন বড় শহর তেমন বড় লোকও অনেক। একটা মহল্লা ভালো করে ঘুরতে পারলে অনেক গোস পাওয়া যায়। কিন্তু কিছুদিন আগেও এই কষ্টটা করতে হতো না। গ্রামের চাকুরীজীবী বড়লোকগুলো ঈদের ছুটিতে বাড়িতে আসত। তখন গ্রামেই অনেক গোস পাওয়া যেত। এখন আগের মতো আর নেই। এখন প্রায় সবাই শহরে ঈদ করে। ফ্রিজে গোস রেখে অনেকদিন সেই গোস খায়।

প্রায় দশ বছর হল সবেদা রংপুরে। প্রথম দিকে রাজমিস্ত্রির যোগান হিসেবে কাজ করতো। কিন্তু পোষায় না। স্থায়ী কোন আবাস না থাকায় রাতের অন্ধকারে কিছু মানুষ যেন সভ্যতার ভাষা হারিয়ে ফেলে। অনির্বাণ নিয়তি যখন তাড়িত হয়ে নর-খাদকের নিষিদ্ধ গলিতে যেত, তখন কিভাবে এক অসহায় নারী প্লাবনের বিপক্ষে নিজেকে সামলিয়ে রাখবে। অনেক ভেবে এক বাড়িতে সামান্য বেতনে থাকা খাওয়ার বিনিময়ে কাজ নেয়। ভালোই চলছিল সবেদার নীল বসন্তের সকাল দুপুর। সাহেব বড় ব্যবসায়ী খালাম্মা স্কুল টিচার। দুটো বাচ্চাই ঢাকায় থেকেই লেখাপড়া করে। ভোর পাঁচটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত একের পর এক কাজ করতে খারাপ লাগে না মোটেও। নিজের সংসারের মতোই মনে হয়। তাছাড়া খালাম্মাও খুব ভালো মানুষ কোন ঝামেলা নেই। আচার ব্যবহারে মনে হয় উনিও সবেদার উপর সন্তুষ্ট। সেদিন ঢাকা থেকে জরুরী টেলিফোন পেয়ে খালাম্মা ঢাকায় চলে গেলেন। বড় ভাইয়ার নাকী জন্ডিস হয়েছে। খালাম্মাকে বেশ কিছুদিন ঢাকায় থাকতে হতে পারে । বাড়িতে এখন ওরা চারজন। সাহেব, ম্যানেজার, ড্রাইভার আর সবেদা নিজে। সকালে সবাই যে যার মতো কাজে গেলে সবেদা সব কাজ সেরে টেলিভিশনে সিরিয়াল দেখতে বসে। দুপুরে কেউ আসে না বলে রান্নার আয়োজন থাকে না। মাঝে মাঝে একা বাড়িতে গা কেমন ছমছম করে।

এমন এক নির্জন দুপুরের বীভৎস স্মৃতি আজো সবেদাকে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। আজো সেই শিকারি নেকড়ের থাবার ক্ষত চিহ্ন তার সমস্ত শরীর জুড়ে। কেমন দক্ষ শিকরির মতো ম্যানেজার তার দিকে এগিয়ে আসছিল। হিস হিস শব্দে জ্বলতে থাকে অসীম আকাশের নক্ষত্রবীথি। সরল এক নারী হৃদয়ের গহীনে হাত বাড়ায় এক জানোয়ার। দরোজা বন্ধ করে দেয়। সবেদার মনে হয়েছিল একটা বর্শা ফলকের মতো দুপুরের তপ্ত আগুন যেন তার দিকে ঝুঁকে আসছে। তারপর বেশ কিছুদিন শিথিল আচঁল কাঁধে, বিপর্যস্ত পালক ছেঁড়া পাখির মতো প্রাত্যহিক জীবনকে বহন করে চলছিল।

হঠাৎ নতুন কোন অস্তিত্বেও অনুভব তার শরীর বেয়ে মনকে করে তোলে অস্থির। এক পর্যায়ে মধ্যাহ্নের সেই তপ্ত অগ্নিপিন্ডটাকে শরীর থেকে ফেলে দিতে গিয়ে আজকের এই অবস্থা। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে আর ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় সমস্ত শরীর আস্তে আস্তে ফুলে যায়। ধীরে ধীরে কর্মক্ষমতাও কমে যায়। শূন্যতার পাশাপাশি প্রতিঘাতের ব্যাপকতা যেন বিশাল হতে থাকে। তারপর এক সময় জীবনের সমস্ত ঘাত-প্রতিঘাতের সমাপ্তি এনে দেয় ভিক্ষের ঝুলি।

‘মন্নের বিলাইডা মাংসের শুটকি গুল্যান বুজি খাবার দিব্যার নোওয়ায়।’ সালমার কথায় মুহূর্তেই বর্তমানে ফিরে আসে সবেদা। পরশু দিন গোসগুলো কতো কষ্ট করেই না এনেছে। সারাদিন অর্ধেকটা শহর ঘুরে প্রায় দশ কেজির মতো গোস পায়। চার কেজি বিক্রি করে টাকাটা হাতেই রাখে। বাড়িতে ছোট বোন জামাই কাজে লাগতে পারে। ঈদের পরের দিন রংপুর থেকে কাউনিয়ায়  আসতেই গোসের পানি আর পচা গন্ধ বের হয়। যাত্রীদের বকাবকীর আগেই প্রতি বছরের মতো প্লাটফর্মের এক কোনে ইটের চুলায় খড়কুটো দিয়ে মাটির হাঁড়িতে কোন রকমে লবণ হলুদ দিয়ে গরম করে নেয়।

‘আস্তে কতা কও বুজান আচে’। সালমার কথায় কেমন একটা মোচড়ানো ভালোবাসা অনুভব হয় । আজকাল বুকের ভিতর বড় বেশি ভাঙচুর হয়। যেখানে নিভে যায় সমস্ত আলোকমালার জলসিঁড়ি। বন্ধ হয়ে যায় বিশ্বাসের খোলা জানালা। নিশ্বাস ভারি হয়ে ওঠে সহ্যের অতীত চাপে। জীবনের সব চাওয়া পাওয়া যেন অবয়বহীন নগ্নতায় শূন্যে দুলতে থাকে।

বাবা মা যখন বেঁচে ছিলেন চার জনের সংসারে কতোই না ভালোবাসার আবিলতা ছিল। বাবা বর্গা চাষী হলেও স্বচ্ছন্দে দিন কাটছিল। রাক্ষুসী তিস্তার যেন সে সুখ সইল না। ভাসিয়ে নিয়ে গেল সুখের সমস্ত সুবাস। নিয়ে গেল অস্তিত্বের আকাঙ্ক্ষা। সমস্ত চাওয়া পাওয়ার পদাবলী।

দিন মজুর থেকে ভিক্ষের ঝুলি হাতে বাবা চলে গেলেন। সংসারের হাল ধরে সবেদা। কিন্তু এমন লজ্জাবতী মসৃণ শরীরকে সে কীভাবে বাঁচিয়ে রাখবে সূর্যের প্রখর আলো থেকে। কীভাবে রক্ষা রাখবে নারকীয় তাণ্ডব থেকে। কীভাবে কৃষ্ণচূড়ার আলো ছায়ায় ভাসিয়ে নেবে সমুদ্র সময়ের রাত্রি দিনকে। সবেদা পারেনি কৃষ্ণকলি ভালোবাসার লজ্জাবতী মসৃণ আলোক মালায় ভাসতে। পারেনি মধু মাধুরীর মদিরতায় জীবনকে উপভোগ করতে। ছোট বোনের বাসরের সুবাস বুকের ঠিক মাঝ বরাবর যেন হাতুড়ির মতো আঘাত করছে।

রাক্ষুসী তিস্তা তো শুধু খেয়েছিল দৈনন্দিন জীবনকে। ছুঁড়ে তো দেয়নি অসম্মানের নরকে। মানুষের তৈরি নরকের পঙ্কিল কাঁদাজলে খড়কুটোর মতো সবেদা অপেক্ষায় থাকে কখন সকালের পাখি ডাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *