প্রচেত গুপ্ত
এখন ভোর তিনটে বেজে সাতাশ মিনিট। শালিনী পালাচ্ছে।
শালিনী প্রথমে ভেবেছিল বাড়ি ছেড়ে পালাবে। তারপর ভেবেচিন্তে দেখে বাড়ি নয়, শহর ছেড়ে পালাতে হবে। পরে আরও ভাবে। বোঝে ওতে লাভ হবে না, ঝুঁকি থেকে যাবে। দেশের মধ্যে থাকলে ঠিক ধরে ফেলবে। নিয়ে আসবে। একেবারে দেশ ছেড়ে পালানোটাই সবথেকে ভাল। যাকে বলে ‘সেফ’।
তাই শালিনী পালাচ্ছে। একটা কুকুর কোথাও উচ্চস্বরে ডেকে উঠল। জানান দিল, শেষ রাত। উত্তর কলকাতার গড়পাড়ে তো আর শিয়ালের ডাক শোনা যায় না, গলির কুকুরেরাই প্রহরে প্রহরে ডাকে।
পালানো নিয়ে খুঁটিনাটি আগে থেকেই ভাবা ছিল শালিনীর। এমন কোনও ফ্লাইটের টিকিট কাটবে যাতে শেষ রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়া যায়। সবাই ঘুমোবে। পা টিপে বেরোবে। বিশাল কোনো সাজগোজ করবে না, পরবে ক্যাজুয়াল পোশাক। পায়ে চটি। বাড়ির কেউ ঘুম ভেঙে দেখে ফেললেও যেন বুঝতে না পারে। ভাবে, মেয়ে অনেকদিন ভোরের কলকাতা দেখেনি, তাই মর্নিং ওয়াকে যাচ্ছে। এক হাতে থাকবে ব্যাগ, জামার পকেটে থাকবে প্লেনের টিকিট, পাসপোর্ট, অন্য হাতে জুতো। চটি ফেলে জুতো পরে নেবে।
শালিনী ঠিক করেছিল, বাড়ি থেকে বেরিয়ে সদর দরজা টেনে দেবে। তারপর চিন্তা হল, অত রাতে সদর দরজা খুলে যাওয়াটা কি উচিত হবে? চোর ঢুকে পড়তে পারে। পরে মনে পড়ে গেল, দাদা সদরে অটোমেটিক লক লাগিয়েছে। টানলেই বন্ধ হয়ে যায়। সুতরাং চিন্তা নেই।
শালিনী এখন নিজের ঘরে ব্যাগ গোছাচ্ছে। আলো জ্বালায়নি। বাইরে থেকে কেউ দেখে ফেলতে পারে। মোবাইলের টর্চ জ্বেলে নিয়েছে। ঠিকঠাক সব নেওয়া হচ্ছে তো? কোনও চান্স নেই। এভাবে পালানোর সময় সব ঠিকঠাক নেওয়া যায় না। দরকারও নেই। এখানে জামা–কাপড় পড়ে থাকলে কী এসে যায়। হোটেল তো নয়, নিজের বাড়ি। বাড়ির লোকগুলোর মাথা থেকে ভূত ধরলে আবার তো আসবে।
দেশ ছেড়ে পালায় কারা? বড় ধরনের অপরাধীরা। এমন বড় যে তাদের ফটো খবরের কাগজে ছাপা হয়। আমাদের এই মেয়ে শালিনী রায়চৌধুরী কি সেরকম কোনো বড় অপরাধী?
একেবারেই নয়। শালিনী এক ঝকঝকে, বুদ্ধিমতী তরুণী। লেখাপড়ায় অতিরিক্ত ভালো। শুধু অতিরিক্ত ভালো নয়, বাড়াবাড়ি রকম অতিরিক্ত ভালো। আমেরিকার ইউনিভার্সিটিতে পোস্ট ডক করছে। স্বভাব চরিত্র খুবই ভালো। দেখতেও সুন্দর। একটা পুরোনোদিনের বাংলা সিনেমার নায়িকা নায়িকা ভাব রয়েছে। মুখের ডানদিক থেকে দেখলে অনেকটা সুচিত্রা সেনের মতো লাগে। অপরাধ তো দূরের কথা, এই মেয়ে ঠিক মতো মশা–মাছি মারতেও পারে না। ছাত্র বয়েসে বন্ধুরা খুব জোর করায় একবার ‘শালা’ বলেছিল। ব্যস্, গালাগালিতে এই পর্যন্ত দৌড়।
তাহলে শালিনী পালাচ্ছে কেন? কোথা থেকে পালাচ্ছে? কেনই বা পালাচ্ছে?
ব্যাগের মধ্যে কটা শার্ট প্যান্ট ঠেসে ঢুকিয়ে নিয়েছে। জুতোটা কি একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরে নেবে? প্লাস্টিক কোথায়? ইশ্ আগে থেকে গুছিয়ে রাখলে হতো। তাড়াহুড়োর এই হচ্ছে সমস্যা। জুতো না নিলে কেমন হয়? খুব খারাপ হবে। চটি পরে আমেরিকা পর্যন্ত যাওয়া যাবে না। দু’বছর আগে জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্টে জুতোর ফিতে ছিঁড়ে গিয়েছিল। ফিতে জোড়াতালি দেওয়ার জন্য সে প্রথমে সেফটিপিনের খোঁজ করে। পায় না। অত বড় এয়ারপোর্টে সেফটিপিন নেই! বাধ্য হয়ে চটি কিনেছিল। চটিতে ফোসকা না পরার প্রতিশ্রুতি ছিল, কিন্তু উত্তর কলকাতার পা সেই প্রতিশ্রুতি মানতে পারেনি। এক ঘন্টার মধ্যে পায়ে ফোস্কা পড়ে যায়। আমেরিকা থেকে সে দেশে ফিরেছিল একরকম খালি পায়ে। সুতরাং জুতো নিয়ে কোনো ঝুঁকি নেওয়া যাবে না।
এক হাতে জুতো, অন্য হাতে ব্যাগ নিয়ে শালিনী ঘর থেকে বের হল। এবার সিঁড়ি দিয়ে নামতে হবে। সিঁড়ি অন্ধকার। এতো পরিচিত সিঁড়ি, তারপরেও সে খুব সাবধান। হোঁচট খেয়ে পড়লে সর্বনাশ। বিরাট আওয়াজ হবে। ঘুম ভাঙবে সবার।
আচ্ছা, শালিনী এভাবে চোরের মতো পালাচ্ছে কেন?
শালিনীর বিরুদ্ধে ‘চক্রান্ত’ হয়েছে। খুব বড় ‘চক্রান্ত’। যদি ‘চক্রান্ত’ সে আগে আঁচ করতে পারত, সে এবছর দেশে আসতই না। চক্রান্তে জড়িয়ে আছেন তার মা রেখাদেবী, দাদা সুবীর। সে একজন অফিসার। শালিনীর থেকে সাত বছরের বড়। আর শালিনীর কলেজে পড়া বোন মালিনী। মালিনী লেখাপড়ায় খুব কম সময় দেয়, তারপরেও সব পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে। যেমন বুদ্ধিমতী, তেমন নানা ‘দুষ্টুমি’ করবার প্ল্যান করতে পারে। বন্ধুরা তাকে ডাকে ‘প্ল্যানকন্যা’।
এছাড়াও চক্রান্তে আছে শালিনীর বৌদি সৌমিলি। সৌমিলির রান্নার হাত অতি চমৎকার। কোনো কোনো সময় পেটুক শালিনীর মনে হয়, বৌদির হাতের রান্না খাবারের জন্য হাজার হাজার মাইল দূর থেকে চলে আসা তার জন্য কোনো ব্যাপারই নয়।
‘চক্রান্ত’ শালিনী কাছে ফাঁস হয়েছে মাত্র এক সপ্তাহ আগে। বাড়িতে সব পাকা করে ফেলবার পর। শুধু একটা অংশ বাকি আছে। র্যাপিড ফায়ারের মতো শালিনীকে বলতে হবে ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’। শালিনী গত তিনদিন ধরে বলছে।
‘না, না এবং না।’
বৌদি মুচকি হেসে বলেছে, ‘এখন বললে হবে না। সময় যখন হবে তখন বলতে হবে।’
মালিনী বলেছে, ‘তাও আমাদের নয়, বলতে হবে তাকে।’
শালিনী বলেছে,‘অসম্ভব।’
বৌদি ভুরু কুঁচকে বলেছে, ‘কেন? অসম্ভব কেন? তোমার কম্পিউটারের পড়াশোনায় কত ইয়েস নো, ইয়েস নো বলে টিক মেরে এসেছো। এখন কেন পারবে না?’
শালিনী অসহায় গলায় বলেছে, ‘উফ্ বৌদি এটা কম্পিউটার প্রোগ্রামিং নয়।’
মালিনী ঘাড় কাত করে বলেছে, ‘তাহলে নিজে কোনো প্রোগ্রাম করে নিবি। সিনেমা দেখা, রেস্টুরেন্টে খাওয়া, যদি চাস্ গঙ্গার ঘাটে গিয়ে বসতে পারিস। তাই না বৌদি? আমরা তো আর তোর প্রোগ্রামে নাক গলাচ্ছি না।’
শালিনী বলেছে, ‘মেরে তোর মাথা ফাটিয়ে দেব ফাজিল মেয়ে। আমি কোথাও যাব না। কাউকে মিট করব না।’
বৌদি বলল, ‘সেটা আমাকে বলছো কেন? সাহস থাকলে মাকে বল।’
কথাটা শুনে মালিনী মুখ টিপে হাসল। এটাই মুশকিল। যতই বিদেশে থাকুর আর বড় গবেষনা করুক, মায়ের মুখের ওপর কথা বলবার মতো সাহস এখনও তার দিদির হয়নি।
শালিনী দাদাকে ধরল।
‘দাদা, তুমি মাকে বুঝিয়ে বলো।’
সুবীর গম্ভীর ধরনের মানুষ। দুমদাম করে কোনো কাজ করবার মানুষ নয়। কিন্তু বড় বোনের বিষয়ে দুম করে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাতে তার সম্পূর্ণ মত রয়েছে।
‘কী বলব।’
শালিনী বলল, ‘বলবে, এখন সম্ভব নয়।’
সুবীর বলল, ‘কেন সম্ভব নয়?’
শালিনীএকটু চুপ করে থেকে বলল, ‘এখন গবেষনার কত কাজ!’
সুবীর বলল, ‘তাতে কী? আমার অফিসেও তো কাজ।’
শালিনী বুঝতে পারল, বড়দাও এই চক্রান্তে ভাল ভাবে জড়িত। সে সাহস করে রেখাদেবীর কাছে গেল।
‘মা, আমি এখন ছুটি পাব না।’
রেখাদেবী বললেন, ‘তোমাকে ছুটি নিতে কে বলেছে?’
শালিনী আমতা আমতা করে বলল, ‘দু’মাস পরে আমাকে ফিরে যেতে হবে।’
রেখাদেবী বললেন, ‘অবশ্যই ফিরবে। কোনবার আমি তোমাকে বেশিদিন থেকে যেতে বলেছি? অবশ্যই তুমি ঠিক সময়ে ফিরে গিয়ে কাজে যোগ দেবে।’
শালিনী বলল, ‘মা, আমি বলছিলাম কী…।’
রেখাদেবী গম্ভীর গলায় বললেন, ‘বলো কী বলছো?’
শালিনী মাথা চুলকে বলল, ‘না, থাক। পরে বলব।’
বড় মেয়ে ঘর থেকে চলে যাওযার পর রেখাদেবী মুখে টিপে হাসলেন। না, মেয়েটা বড্ড ভালো হয়েছে।
শালিনী সিঁড়ি দিয়ে দোতলা পর্যন্ত নেমে এসেছে। এখন পর্যন্ত কোনও সমস্যা হয়নি। কারও ঘুম ভাঙেনি। সদর দরজার কাছে টিমটিম করে একটা হলুদ বাল্ব জ্বলছে। রোজই জ্বলে। এই তিনতলা বাড়ি শালিনীর ঠাকুর্দার তৈরি। তিনতলায় একটাই ঘর। বড়মেয়ে বাড়ি এলে ওখানেই থাকে। দোতলায় দাদা–বৌদি একদিকে, মালিনী একদিকে। একতলায় থাকেন শালিনীর বাবা–মা।
শালিনী একটু থমকে দাঁড়াল। বাবার বিখ্যাত নাক ডাকার আওয়াজ কি শোনা যাচ্ছে? হ্যাঁ, বন্ধ ঘরের দরজা ভেদ করে ভেসে আসছে।
চক্রান্তের খবর শালিনী জানতে পারে সেদিন দুপুরে খেতে বসে। সেদিন ছিল রবিবার। সবাই মিলে হই হই করে খেতে বসা হল। মেনু জবরদস্ত। উচ্ছে থেকে মাছের মাথার ডাল, ইলিশ মাছের ভাপা, আনারসের চাটনি। হাফ রান্না বৌদির, হাফ মায়ের। মেনু দেখে শালিনী তো গদগদ হয়ে পড়েছিল। বিদেশ বিভুঁইয়ে একা থাকে, এসব লোভনীয খাবার কোথায় জুটবে। তার ওপর নিজে ভাত, আলু সিদ্ধ, ডিম সিদ্ধ ছাড়া তেমন কিছু রাঁধতে পারে না। হাত পুড়িয়েও চেষ্টা করেছে, লাভ হয়নি।
শালিনী খেতে বসে হাসিমুখে বলল,‘আজ তো দেখছি এলাহি মেনু! ব্যাপার কী?’
মালিনী নির্লিপ্ত মুখে বলল,‘ব্যাপার খুবই গুরুত্বপূর্ন দিদি। মা একটু পরেই ঘোষনা করবে।’
শালিনী বলল,‘ব্যাপার কিছু থাক বা না থাক, আগে তো আমি জমিয়ে খাই।’
সৌমিলি মুখ টিপে হেসে বলল, ‘তাই ভাল। আগে মন দিয়ে খেয়ে নাও, ঘোষনা শুনে বিষম খেতে পারো।’
শেষ পাতে রসগোল্লার পায়েস পরিবেশন করতে করতে রেখাদেবী সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আমি ঠিক করেছি, এবার শালিনীর বিয়ে দেব। ও এবার আমেরিকা ফিরবে বরের সঙ্গে।’
মালিনী, সৌমিলি টেবিল চাপড়ে বলল, ‘দারুণ সিদ্ধান্ত। দারুণ।’
শালিনী রসগোল্লা মুখে স্ট্যাচু হয়ে গেল। নিজেকে সামলে বলল, ‘কী বলছো মা!’
রেখাদেবী বললেন, ‘ঠিকই বলছি। আমি ছেলে পছন্দ করে রেখেছি। এখন শুধু রেজিস্ট্রেশন। পরেরবার তোমরা আসবে, তখন সানাই বাজিয়ে বিয়ে, রিসেপন হবে। অসুবিধে কিছু নেই, ছেলেও আমেরিকায় থাকে। ভাল চাকরি করে।’
শালিনী বলল, ‘আমেরিকায় থাকুক আর জাপানে থাকুক, বিয়ে অসম্ভব।’
সুবীর ধমক দিয়ে বলল, ‘কীসের অসম্ভব। বিয়ে করতে দু’মাস সময় কি কম?’
শালিনী বলল, ‘আমি এখন বিয়ে করতে পারব না দাদা।’
রেখাদেবী ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘কেন? তুমি এখানে বা ওখানে কাউকে কথা দিয়েছো? তোমার নিজের পছন্দের কোনো ছেলে আছে?’
শালিনী প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, ‘একেবারেই না। কখনই না।’
এবার বাবা মুখ খুললেন, ‘তাহলে তোমার মায়ের পছন্দে আপত্তি কোথায়?’
শালিনী মিনমিন করে বলল, ‘আপত্তি তো বলিনি, বলছি এখনই নয়। এখন আমি পড়ছি।’
মালিনী হেলে বলল, ‘পাত্র লেখাপড়ায় তোর থেকে ভালো দিদি। তোর জন্য ওয়েট করবে না।’
সৌমিলি বলল, ‘অবশ্যই করবে না। পাত্র শুধু লেখাপড়ায় ভালো নয়। খুবই সুন্দর দেখতে। তোমার আমেরিকায় অমন হ্যান্ডসাম ছেলে আছে বলে মনে হয় না।’
সুবীর বলল, ‘শুনেছি ছেলের রান্নার হাতও ভাল। তাহলে তো শালিনীর সুবিধেই হবে। নিজে তো কিছু পারে না।’
শালিনীর বাবা বললেন, ‘এরকমটা ভাবা ঠিক নয়। ছেলে কি রান্না করে বউকে খাওয়াতে বিয়ে করছে? এক–দুদিন রান্না করতেও পারে।’
মালিনী বলল, ‘মা আমি কি দিদিকে ফটো দেখাব?’
শালিনী বলল, ‘নানা, আমি দেখব না।’
রেখাদেবী বিরক্ত গলায় বললেন, ‘ওসব ফটো টটো দেখা আমি পছন্দ করি না। আমার মেয়ে তো সিনেমার ডিরেক্টর নয়, যে ফটো দেখে হিরো খুঁজতে বেরিয়েছে। যাকে বিয়ে করবে, তাকে সামনাসামনি, কথা বলে চেনাটাই আসল। আমি ছেলের বাবা– মায়ের সঙ্গে কথা বলে একটা তারিখ ঠিক করেছি। শালিনী ছেলেটির সঙ্গে দেখা করবে। তারপর ওরা নিজেরা নিজেদের বুঝে নেবে। হ্যাঁ হলে হ্যাঁ, না হলে না।’
শালিনীর প্রায় কেঁদে ফেলবার মতো অবস্থা। সে বলল, ‘মা, এসব ডিশিসন এতো তাড়াতাড়ি হয় না।’
সুবীর বলল, ‘বাজে কথা। পছন্দ অপছন্দ বুঝতে সময় লাগে না। আবার সারা জীবন ধরেও পছন্দ অপছন্দ বোঝা যায় না।’
রেখাদেবী বললেন, ‘এই বিষয়ে আমি আর কথা শুনতে চাই না। এবার তোমাকে বিয়ে করেই ফিরতে হবে। আমাদের বয়স হয়েছে, কবে কী হবে জানি না। আমি বাপু ওসব লিভিং টুগেদার ফুগেদার পছন্দ করি না। বাঙালি ঘরের মেয়ে এখানে থাকলেও বাঙালি, আমেরিকা, জাপানে থাকলেও বাঙালি। এই ছেলে যদি তোমার পছন্দ না হয়, অথবা ছেলের যদি তোমাকে পছন্দ না করে তাহলে আমার অন্য কোথাও যোগাযোগ করব। এখন উঠে পড় হাত ধোও। হাতে ভাত শুকিয়ে যাচ্ছে। কাঁটা চামচে খাও, হাতে ভাত ডাল শুকিয়ে গেল মুশকিল।’
দুপুরে নিজের ঘরে একরকম মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল শালিনী। এ কেমন বিপদে পড়ল সে! এ তো ভয়ংকর বিপদ। সে যে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে রেখেছে, কোনোদিন বিয়ে করবে না। প্রতিজ্ঞা কারণ অতি গোপন। ছেলেমানুষিও বটে। আজ থেকে ঠিক বারো বছর আগের ঘটনা। তখন শালিনী বয়স কত? তখন কিশোরী। অঙ্ক স্যারের কাছে প্রাইভেট টিউশন নিতে গিয়ে দেখা হল এক তরুণের সঙ্গে। লম্বা, ঝকঝকে চোখ, এক মাথা এলোমেলো চুল। ছেলেদের রূপ নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় ছিল না ‘গুড গার্ল’ শালিনীর। সেই তরুণও প্রথমদিকে ফিরে তাকায়ও নি। তাকাল যেদিন শালিনীর না পারা ক্যালকুলাস ঝটপট করে দিল। মাথা ঘুরে গিয়েছিল শালিনীর। এর আগে ওর ধারনাই ছিল না, ছেলেরা এতো সুন্দর হয় আর দারুণ অঙ্কও পারে। স্যার বলেছিলেন, ওই ছেলে নাকি এরকম। সেই তরুণের প্রতি শালিনীর প্রতি ঘোর বিস্ময় তৈরি হল। একেই কি প্রেম বলে? কিছুদিন জন্য ঘোরের মধ্যে চলে গেল শালিনী। তিনতলার ঘরে, পড়ার টেবিলে বসে, অঙ্ক খাতা খুলে তাকিয়ে থাকত, ছেলেটির কষে দেওয়া ক্যালকুলাসের দিকে। মনে হতো, ক্যালকুলাসের ডি ডিওয়াই বাই ডিএক্স নয়, সেই সুন্দর তরুণ তার খাতায় লিখেছে, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
শালিনী নিজে থেকেই জোর করে সেই ছেলেটির সঙ্গে আলাপ করে। সঙ্গে হাঁটে। রেস্টুরেন্টে যেতে চায়। ছেলেটি যে এ ব্যাপারে খুশি হতো এমনটা নয়। বরং খানিকটা এড়িয়েই চলত। একদিন কড়া গলায় বলে বসল, ‘আগে ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাসকে ভালোবাসো, তারপর অন্যকে বাসবে। সহজ অঙ্ক পারো না কেন?’
ব্যস্। ঝাঁ ঝাঁ করা কান মাথা, লাল হয়ে যাওয়া মুখ, চোখে জল নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো শালিনী। প্রতিজ্ঞা করল, জীবনে কোনোদিন কোনো ছেলের সঙ্গে প্রেম করতে যাবে না। বিয়ের তো প্রশ্নই ওঠে না। ছেলেরা নিষ্ঠুর, ভয়ংকর। অঙ্ক টিউশনে যাওয়া বন্ধ করে দিল শালিনী। দিনে সাত ঘন্টা ক্যালকুলাসের বই নিয়ে বসে থাকতে শুরু করল। পরীক্ষার সময়ে ক্যালকুলাসে হায়েস্ট নম্বর তার বাঁধা হয়ে গেল। সবাই বলতে লাগল ক্যালকুলাস কন্যা।
সেই তরুণ শালিনীর জীবন থেকে হারিয়ে গেল, ক্যালকুলাস হারালো না।
এই প্রত্যাখানের কাহিনী কখনো কাউকে বলেনি শালিনী। কাউকে নয়। এখন বাড়িতে বলেই বা কী হবে? হাসাহাসি শুরু হবে। ক্যালকুলাসের জন্য সারাজীবন বিয়ে না করবার পণ কে–ই বা মেনে নেবে?
ক্যালকুলাস–কন্যা ঠিক করেছে, আর কেউ না মানুক, সে মানবে। বাড়ির সবাই যতই তার প্রিয়জন হোক, সে অবাধ্য হবে। বিয়ে করবে না। কিছুতেই না। মালিনী সেদিন দুপুরে পাত্রর ফটো নিয়ে দিদিকে দেখাতে এলে খামশুদ্ধু তাকে পত্রপাঠ বিদায় করেছ শালিনী। মালিনীর উৎসাহ বেশি। কারণ এই মেয়ের খোঁজ এনেছে সে। বান্ধবীর দাদা। আমারিকায় থাকে। ভাল চাকরি করে। পড়াশোনায় ভাল। ছেলের বাড়ি থেকে এখনই বিয়ে দিতে চায়। ছেলেও নিমরাজি। তারপরই মালিনী মাকে এসে বলেছে।
আগামীকাল সেই ছেলের শালিনীর দেখা করবার তারিখ ঠিক হয়েছে।
রেখাদেবী বলেছেল, ‘এটা যদি চেনাজানা হতো, অবশ্যই তোমরা নিজেরা দিনক্ষন ঠিক করতে। আমরা জানতেও চাইতাম না। কিন্তু যেহেতু তা নয়, তাই দু’বাড়ির গার্জেনদের জানিয়েই দেখা করাটা ভদ্রতা।’
ঠিক হয়েছে, এই দেখাতেই ছেলেমেয়ে পরস্পরকে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলে দেবে। নিজেরাই দায়িত্ব সারবে। রেখাদেবীর মতে এটাই আধুনিক এবং স্পষ্ট পদ্ধতি।
এরপরই শালিনী গোপনে আমেরিকা ফিরে যাওয়ার জন্য টিকিটের এজেন্টকে ফোন করে। টিকিট পাওয়া গিয়েছে। খরচ বেশি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এই বিপদের হাত থেকে বাঁচার জন্য সেই খরচ কিছু নয়। সে যথেষ্ট স্কলারশিপ্ পায়।
আজ সেই ভয়ংকর দিন ছিল। শালিনী আর পাত্রর ‘হ্যাঁ–না’ বলবার দিন। তার আগেই এই কাকভোরে শালিনী পালাচ্ছে। মনটা খারাপ। হওয়ারই কথা। বাড়ির সবাইকে ফেলে চলে যেতে হচ্ছে। কিন্তু উপায় কী? এক লাইনের ছোটো চিঠি লিখে, তিনতলার টেবিলে সে রেখেও এসেছে। সবার উদ্দেশ্য লেখা চিঠি।
‘আমাকে ক্ষমা করো। বিয়ে আমি করব না।’
শালিনী সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। দরজার ফাঁক দিয়ে হালকা আলো আসছে। ভোর কি হল? বোনের জন্য বেশি মন কেমন করছে। কিন্তু উপায় নেই, কোনো উপায় নেই। তিনতলা থেকে নামবার আগে ক্যাব ধরবার চেষ্টা করেছিল। এতো ভোরে বলে পারেনি। কলকাতায় এই সুবিধেটা এখনও যেন হয়েও পুরোটা হয়নি। যাক, গলির মোড়ে গেলে নিশ্চয় ট্যাক্সি পাওয়া যাবে।
সাবধানে সদর দরজা খুলল শালিনী। ভোরের নরম, সিগ্ধ আলো আর টাটকা বাতাস ঝাঁপিয়ে পড়ল গায়ে। বাইরে পা দিতেই মনটা হু হু করে উঠল। চোখে জল এলো। মনকে শক্ত করল। এই অল্প বয়েসেও সে বুঝতে পারছে প্রেম হল অদৃশ্য ফাঁসের মতো। একবার চেপে বসলে খোলা যায় না। এক কাঁধে ব্যাগ, আর এক হাতে জুতো নিয়ে শালিনী গলির মোড় পর্যন্ত এগিয়ে গেল।
সে জানতেও পারল না, ঠিক এই মুহূর্তে বোন মালিনী, বৌদি সৌমিলি, বড়দা সুবীর সবাই উঠে পড়েছে ছাদে। ভোরের হিম ঠেকাতে কারও মাথায় টুপি, কারও আঁচল, কেউ ওড়না মুড়ি দিয়েছে। তারা হাসি হাসি মুখে পাঁচিলের আড়াল থেকে উঁকি মেরে ঘটনা দেখছে। দেখবেই তো। ‘প্ল্যান মেয়ে মালিনী’ এই প্ল্যান করেছে। কদিন আগেই দিদির মোবাইলে আসা একটা টেলিফোন সে ধরে ফেলে। শালিনী তখন বাথরুমে। ওপাশ থেকে হড়বড়ে করে বলে, ‘ম্যাডাম, ২৮ তারিখ আপনার বোস্টন যাওয়ার ফ্লাইটের টিকিট কনফার্মড। ভায়া মুম্বাই। আপনি একবারে ভোরের ফ্লাইট ধরে মুম্বাই চলে আসবেন। আমরা মেলে টিকিট পাঠিয়ে দিলাম।’
মালিনী কিছু বলবার আগেই ওপাশ থেকে ফোন ছেড়ে দেয়। ঘটনা বুঝতে মালিনীর দেরি হয়নি। বিয়ের ভয়ে দিদি পালাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে সে অ্যাকশন নেয়। বান্ধবীকে ফোন করে জানায়, ‘তোর দাদাকে বল, কাল একেবারে ভোর পাঁচটায় তোদের গাড়িটা নিয়ে আমাদের বাড়ির সামনে চলে আসে। বিকেলে যেমন কনে দেখা আলো থাকে, ভোরে নাকি তেমন বর দেখা আলো থাকে। দিদি সেই আলোয় ছেলে দেখতে চায়।’
এদিকে গলির মোড়ে তখন নাটক।
সাদা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। শালিনীকে দেখে দরজা খুলে নেমে এসেছে এক ঝকঝকে তরুণ। সাদা হাফ শার্ট আর ডেনিমের নীল জিনসে তাকে দেখাছে অতি চমৎকার। তবে মুখটা টুপি দিয়ে ঢাকা।
ছেলেটি এগিয়ে এলে বলে, ‘আসুন।’
শালিনী অবাক হয়ে বলে, ‘আসুন মানে! আপনি কে?’
তরুণ আবার হেসে বলে, ‘গাড়িতে উঠুন বলছি।’
শালিনী রেগে বলে, ‘গাড়িতে উঠুন! আপনার সাহস তো কম নয়। একটা অপরিচিত মেয়েকে বলছেন গাড়িতে উঠুন।’
ছেলেটি টুপিতে মুখটা আরও একটু ঢেকে বলে, ‘আস্তে। লোকে শুনতে পাবে। দেখছেন তো এক–দুজন করে মর্নিং ওয়াকে বেরোতে শুরু করেছে।’
শালিনী ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে, ‘শুনতে পেলে পাবে। আমি কিন্তু চিৎকার করে লোক জড়ো করব। ওই আমার বাড়ি। দাদাকে ডাকব? আমার দাদা কিন্তু কুস্তি জানে।’
ছেলেটি অবাক গলায় বলে, ‘সেকী! আপনি চিৎকার করবেন কেন! আমার তো আজ আপনার সঙ্গে দেখা করবারই কথা।’
শালিনী বলে, ‘আপনার সঙ্গে দেখা! কী বলছেন আপনি? আপনি কি চান আমি পুলিশ ডাকি? পথ ছাড়ুন আমার ফ্লাইটের সময় হয়ে যাচ্ছে।’
ছেলেটি বলল, ‘ফ্লাইট! সেকী? আমাকে যে আপনার বোন ফোন করে বলল, আপনি একবারে ভোরে আমার সঙ্গে দেখা করতে চান? নিজের মুখে বলতে পারছেন না। বাড়িতে গেলে খারাপ দেখাবে, তাই গলির মুখে অপেক্ষা করতে বলেছেন। কিন্তু আপনি হাতে ব্যাগ, জুতো এনেছেন কেন! আপনার বোন তো এরকম কিছু বলেনি…।’
শালিনী বলল, ‘বোন! আমার বোনকে আপনি চেনেন!’
ছেলেটি বলল, ‘মালিনীই তো আপনার বোন। তাই না? সেই তো কাল বেশি রাতে ফোন করে জানিয়েছে আপনি খুব ভোরে আমার সঙ্গে দেখা করতে চান।’
শালিনী ভুরু কুঁচকে বলল, ‘আপনি কে?’
ছেলেটি মাথা চুলকে আমতা আমতা করে বলল, ‘আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হবার একটা কথা চলছে…যদিও আমি বুঝতে পারছি সেটা ম্যাচিওর করবে না। আমারও মনে হচ্ছে, না করাই ভাল। আপনি যা রাগি দেখছি।’
শালিনী ভুরু কুঁচকে বলল, ‘আপনাকে গলা কেমন চেনা লাগছে। আপনার নাম কী? মুখটা ওভাবে ঢেকে রেখেছেন কেন?’
ছেলেটি হেসে নিচু গলায় বলল, ‘বর দেখা আলো মুখ দেখতে চেয়েছেন বলে ঢেকে রেখেছি। সেই আলো কি ফুটেছে? চলুন আপনি ফ্লাইট ধরবার আগে কোথাও বসে একটু চা খাই।’
শালিনী কেমন একটা ঘোরের মধ্যেই গাড়িতে উঠে বসে।
সে এবারও দেখতে পায় না, এই দৃশ্য দেখে তাদের বাড়ির তিনতলার বাড়ির ছাদে মালিনী আর সৌমিলি হাততালি দিয়ে লাফিয়ে উঠেছে। মালিনী ছাদ থেকে নামতে নামতে চিৎকার করে উঠেছে, ‘মা, দিদির বিয়ে ঠিক করে ফেল। ‘ক্যালকুলাস কন্যা’ পটেছে।’
সুবীর বলল, ‘তুই এতো জানলি কী করে?’
মালিনী বলল, ‘আমার বান্ধবীকে দিদির ফটো দিয়েছিলাম তো। সে তার দাদাকে সেই ফটো দেখাতেই চিনতে পেরেছে। বলেছে, এই সেই ক্যালকুলাস কন্যা না? আমার বান্ধবী তার দাদাকে চেপে ধরে। ক্যালকুলাস– কন্যা! সে আবার কী রে বাবা! তখনই ওদের পুরোনো প্রেমের গল্প জানতে পারে। ছেলের নাম আবির। আবিরদা এই বিয়ের জন্য খুব ইন্টারেস্ট দেখিয়েছে। আমার সঙ্গে তার কথা হয়েছে। সেও চায় আমেরিকা চলে যাওয়ার আগে বিয়ে করবে। দুজনে একসঙ্গে ফিরবে। বান্ধবী আমাকে ধরে। মাকে সব বলি। মা বলল, খুব ভালো এত ভাল একটা পাত্র পেলে হাতছাড়া করা যায় না। তারওপর দুজনেরই যখন আগের পরিচয় রয়েছে আর দুজনেই যখন আমেরিকায় থাকে তখন তো কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা একটাই তোর দিদি পুরোনো রাগ ভুলতে পারবে তো? আমি বলেছি, দেখাই যাক না। এখন তো দেখছি রাগ অনুরাগ হয়ে গিয়েছে। তোমরাও তো নিজের চোখে দেখলে।’
এই মুহূর্তে গঙ্গার পাড়ে বেঞ্চে বসে মাটির ভাঁড়ে চা খাচ্ছে শালিনী আর আবির। পাশে শালিনীর ব্যাগ ও জুতো রাখা।
আবির বলল, ‘তুমি আমাকে চিনতে পারলে না!’
শালিনী মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘বয়ে গিয়েছে চিনতে।’
আবির বলল, ‘তুমি হারিয়ে যাওয়ার পর অনেক খুঁজেছি।’
শালিনী বলল, ‘মিথ্যে কথা।’
আবির বলল, ‘তুমি কি জানো আমিও তোমার মতো বোস্টনেই থাকি? ছুটিতে এসেছি। বাড়িতে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে।’
শালিনী একটু যেন নড়ে উঠল। বলল, ‘জানতে চাইও না।’
আবির হেসে বলল, ‘বাপ্রে এখনও রেগে আছো? তুমি কোন সাবজেক্টে গবেষনা করছো?
শালিনী একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘ক্যালকুলাস।’
আবির হো হো করে হেসে উঠল। দূরে, ভোরের গঙ্গায় স্টিমার ভোঁ বাজিয়ে উঠল। আবির বলল,
‘চল তোমায় ফ্লাইট ধরতে হবে। এয়ারপোর্ট অনেকটা পথ।’
শালিনী বলল, ‘আমি যাব না। টিকিট ক্যানসেল। যত টাকা লস হবে হোক। আগে আমি বাড়ি ফিরে আমার পাজি বোনের সঙ্গে বোঝাপড়া করব। ও কেন এতকিছু লুকিয়েছে তার হেস্তনেস্ত করব।’
আবির বলল, ‘সে করো। আর আমাদের হ্যাঁ–না? তার কী হবে?’
শালিনী আবিরের কানের কাছে মুখ নিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘না…।’
তারপর হাসতে হাসতে আবিরের হাত ধরল।
ওই যে গঙ্গার পাশ দিয়ে দুজনে হাঁটছে। আবিরের হাতে শালিনীর ব্যাগ ও জুতো।