আনোয়ারা আজাদ
ক্যাপাচিনো কফির মগটা ঠোঁট বরাবর নিতেই সামনের দুটো সারি বাদ দিয়ে তৃতীয় সারিতে বসা মেয়েটির ঠোঁটে র দিকে চোখ গেল সানির। টকটকে লাল লিপস্টিক। মনে হচ্ছে রক্ত চুষে এসেছে! সানির গা শিরশির করে উঠলো লাল ঠোঁট দুটোকে মগের কাছাকাছি এগিয়ে আসতে দেখে। মগের রং উজ্জল হলুদ। হলুদ আর লালের কমবিনেশন এমনিতে মন্দ নয় কিন্তু রক্ত চোষা লাল ঠোটের সাথে! উঁহু, তার মোটেও মগ হওয়ার ইচ্ছে জাগেনি, উল্টোটা হচ্ছে! ঠোঁটে এত কটকটে রং দেখলে কেমন জানি গা শিরশির করে অদ্ভুত একটা অনুভুতি হয় তার। অনুভুতিটা কেমন হয় প্রকাশ করার ভাষা খুঁজে পাওয়ার আগেই মনে হয় ঠোঁটের রং হতে হবে এমন যেন দেখলেই হালকা চুমু দেওয়ার ইচ্ছে জাগে, আদর করার ইচ্ছে জাগে! কটকটে রং দেখলে ড্রাকুলা টাইপ লাগে তার কাছে! চেহারার মাধুর্য নষ্ট হয়ে যায়! কোমল ভাবখানা থাকে না। ক্যাপাচিনো কফির ফ্যানা ঠোঁট দিয়ে সুরুৎ করে টেনে ভাবনা প্রসারিত করলো সানি। কফি কালারের মধ্যে একটা শেড আছে যেটাতে মেয়েদের বেশ লাগে, খেয়াল করে দেখেছে সে। গাঢ় কফি কালারেও কয়েকজনকে দেখেছে, একেবারে খারাপ লাগে না। অনেককে অবশ্য হালকা কোনও রংয়েও বেশ লাগে। তবে বেশিরভাগ মেয়েকেই কফি রংয়ে দেখতে ভালো লাগে তার। প্রায় দু’মাসের ওপর হতে চললো বিনে পয়সার এই গবেষণা তার। খেয়াল করেছে সে, বেশিরভাগ মেয়েই উল্টোপাল্টা রং দেয় ঠোঁটে। তবে মেয়েরা ঠোঁটে রং দেয় কেন এই চিন্তায় খুব বেশি সময় নষ্ট করেনি সানি যেমন ছেলেরা গোঁফ রাখে কেন সেই চিন্তায়ও নষ্ট করেনি। গাঢ় বেগুনী রং ঠোঁটেও কিছু মেয়ের দেখা পেয়েছে সে এখানে। পুঁইশাকের বিচির রংয়েও দেখেছে! পুঁই বিচির রং আর বীটের রং অনেকটাই একই রকম। এমনিতে বেশ লাগে। কিন্তু ঠোঁটে? না বাবা, সহ্য করার নয়! ঠোঁট এবং ঠোঁটের রং দেখার এটাই একটা উপযুক্ত জায়গা বলে মনে হয়েছে সানির। মাঝে মাঝেই সন্ধ্যা কিংবা বিকেলের শেষে কফি খেতে আসে সে এখানে। একাই। না, লিপস্টিক তার গবেষণার বিষয় নয়। এখানে আসা যাওয়া করতে করতেই বিষয়টি তার মাথায় ঢুকেছে। সত্য মিথ্যা নিশ্চিত নয়, ইয়েমেনের এক রাখাল বালক নাকি জঙ্গল থেকে কফি বীজ আবিষ্কার করেছিল নিজের ভেড়াদের খেতে দেখে আর বিবিসির একটি গবেষণা থেকে সে জেনেছে যে, প্রতিদিন প্রায় দুইশো কোটি কাপ কফি পান হয় পৃথিবীতে! সানির মনে হয় আরও বেশি, প্রতিবেদনগুলো কখনোই সঠিক তথ্য দিতে পারে না, গড়পড়তা একটা দিয়ে দেয়, কখনো ডাহা বানোয়াট তথ্যও দেয়!
কফির ফ্যানায় ঠোঁট রেখে চোখ বন্ধ রাখা কিংবা নিচের দিকে চোখ রাখা দুটোই বাস্তবসম্মত নয়! কফি মুখে তোলার সাথে সাথেই চোখ এদিক ওদিক ঘুরবেই! কোনায় দু’জন বালিকাকে মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত দেখা যাচ্ছে। তেরো চোদ্দর বেশি হবে না বয়স। হয়তো কারও আসার অপেক্ষা করছে। মা-বাবার কিংবা শুধু মায়ের জন্যও অপেক্ষা হতে পারে। মা হয়তো দুজনকে এখানে বসিয়ে রেখে আশেপাশেই কোনো কিছু আনতে গেছেন। হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। অঙ্কের মতো সব কিছুতেই প্রোবাবিলিটির বিষয়টি থাকে। ডানেই একজন আঙ্কেল টাইপ বসে আছেন। সামনে এক প্লেট নুডলস। শুরু করার আগে কাঁটা চামচ আর সাধারণ চামচ নিয়ে ডান হাত বাম হাত করছেন। কোন হাতে কাঁটা চামচ ধরলে নুডলস মুখে তুলতে সুবিধে হবে সেই দ্বিধায় মনে হচ্ছে! এদিক ওদিক চোখ ঘোরানো শেষ হলে সামনে বসা কোনো মেয়ের ঠোঁটে থিতু হয়ে এক ধরনের গবেষণার ভেতর ডুবে যায় সানি! ঠোঁট ও লিপস্টিক গবেষক হয়ে যায়! কফি পানরত রক্তচোষা রং ঠোঁটের এই মেয়েটির পরনে অ্যাশ কালারের টপটা বেশ লাগছে তার। ঘাড়ের কাছে অ্যাশ-কমলার কম্বিনেশন মন্দ নয়।
জায়গাটা তেমন বড় নয়। বড় একটা শপিং মলের এক কোনায় কাচ দিয়ে ঘেরা, পনেরো বিশটা চেয়ার মুখোমুখি সাথে মিনি সাইজের একটা করে টেবিল। একটা ট্রে সহ টিস্যু স্ট্যান্ড রাখা যায় এমন সাইজের টেবিল। মেয়েরা হাতের ব্যাগও রাখতে পারে না, হয় হাতে নয় কাঁধে ঝুলিয়ে রাখতে দেখা যায়। ভেতরে যে জায়গায় রান্নার কাজ হচ্ছে সেটাও খুব বড় হওয়ার কথা নয়। যদিও সে দেখেনি শুধু অনুমান করেছে। ভেতরে জায়গা থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে ভাবতে ভাবতে প্রায়ই মেনু কার্ড দেখে সানি যেটা অনেকটাই ছোট আকারের। তারপরেও মাঝে মাঝেই নেড়েচেড়ে দেখে সে। মেনু লিস্টে দশটা মাত্র আইটেমের নাম। কফি, পাস্তা, কয়েক পদের নুডলস, মোমো টাইপের সাথে কিছু ড্রিংক্স। সম্ভবত যারা শপিংমলে এসে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে গরম বা ঠান্ডা কিছুতে তৃষ্ণা মেটাতে চায় তারাই এখানে আসে। আবার কিছু মানুষ আছে যাদের প্রতি ঘন্টায় কিছু খাওয়াখাদ্য পেটে চালান না করলে এসিডিটি হয় তারাও আসে। হয়তো! হয়তো তার মতো অন্যরাও আসে, সবটা এখনও জানে না সানি। জেনে যাবে। প্রযুক্তির এই যুগে জানবার ইচ্ছেটাই প্রধান। যাদের জানবার ইচ্ছে নেই তারা মূর্খ হয়ে থাকুক, সানি সব কিছু জানবার ইচ্ছে নিয়ে, মাথায় হাজার প্রশ্ন নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। জানার ইচ্ছে নেই এমন মানুষের সাথে তাই বেশিক্ষণ কথা বলতে পারে না সে। বিরক্ত হয়। অনেকে এটাই জানার আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারে না মানুষের উৎপত্তি কোথা থেকে। সোজাসুজি আবির্ভাব নাকি বিবর্তনের ভেতর দিয়ে এটুকু জানতে চাওয়া মানুষের মৌলিক অধিকার মনে করে সানি। যারা কোনও কিছু জানতে না চেয়ে শুধু আলু পটলের চাষবাস করে তাদের সাথে দশ মিনিটের বেশি কথা বলতে পারে না সানি!
মাত্র দু’মাসের মতো হয়েছে এই এলাকাটা চেনার। শপিং মলটার পেছনের একটা বিল্ডিংয়ে সে উঠেছে মাস তিনেক হলো। আপাতত একাই। দশ বছর আগের সানি আর আজকের সানির মধ্যে যেমন অনেকটাই পরিবর্তন তেমনি দশ বছর আগের ঢাকা আর আজকের ঢাকার ভেতর অনেক পার্থক্য। ঢাকা এখন মসজিদ আর গাড়ির শহর! পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ আর রাস্তায় রাস্তায় গাড়ি। রাস্তায় গাড়ির ভিড়ে হেঁটে চলা মানুষের পা রাখাই মুশকিল! ক’বছর পর হয়তো আকাশে গাড়ির ভিড় দেখতে হবে। এদিকে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি আর মুদ্রাস্ফীতির সংবাদ রোজই পড়তে হলেও এইসব ক্যাফেতে লোকসমাগমের ঘাটতি মনে হয় না সানির। বিশেষ করে এই সময়টাতে ভালোই ভিড় দেখা যায়। ছোট পরিসর বলে এই সময়টায় মানুষকে বসতে না পেয়ে বাইরে অপেক্ষা করতেও দেখেছে। সানি নিজেও একদিন দাঁড়িয়েছিল প্রায় দশমিনিট। অপেক্ষা করার সময় কফির তেষ্টা যেন দ্বিগুন হয়ে যায়! কফির তেষ্টার সাথে আগামী একশ বছরে পৃথিবী ঠিক কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে সেটা জানবার ইচ্ছে হয়! তখনও কি ক্যাফেতে এসে কফি পান করবে নাকি ততদিনে ট্যাবলেটেই সব তৃষ্ণা মেটানোর ব্যবস্থা হয়ে যাবে? মনে হয় হয়েই যাবে। আবার নাও হতে পারে কারণ রান্নাবান্না এখন অনেকটাই শিল্পের পর্যায়ে চলে গিয়েছে। মানুষও দিনকে দিন ভোগী হয়ে উঠছে। ট্যাবলেট খাওয়া প্রযুক্তির অভিষেক মেনে নেবে না মানুষ! এই দশ পনেরো বছরেই কত কিছু বদলে গেলো! আহা, তখন তরুণেরা কফি খেতে খেতে তরুণীদের ভেজা ঠোঁট দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে নাতো!
মা ঘ্যান ঘ্যান করছিলেন, গুরুত্বই দেয়নি সানি। বাবা মায়ের ক্যাচালের সংসার দেখে তার এমনিতেই অস্থির অবস্থা! ছোটবেলা থেকে এইসব দেখে দেখে বড় হওয়াতে অন্য ফরম্যাটে জীবনযাপন করার কথা ভাবে সে। বাবা মায়ের ফরম্যাটে নয়। সারাক্ষণ এটা ঠিক না, ওটা ঠিক না! ঠিক না, ঠিক না করতে করতেই পঞ্চাশ পার করে দুজনেই ষাটের রাস্তায় এখন তবুও আক্কেল হয় না! বাবা মাকে তার অদ্ভুত প্রকৃতির লাগে, কেউ কাউকে ছেড়ে যান না কিন্তু তেমন ভালো সম্পর্কেও নেই। খাবার টেবিলে বসলেই শুরু হয়ে যায় বাক যুদ্ধ! দুজনের দূরত্বটা ছোটবেলা না বুঝলেও এখন বোঝে। তাই কোনও সমীহ তৈরি হয় না, শুধু প্রয়োজনের মনে হয়। সানি তাই নিজের অবস্থানটাও পরিষ্কার বোঝে না! শুধু একটা জিনিস খেয়াল করে দেখেছে, ওদের থেকে দূরে থাকলে স্বাচ্ছন্দবোধ করে সে! একধরনের ফ্রিডম অনুভব করে। মনের ভেতর আনন্দের বুদবুদ তৈরি হয়। এগুলো সাইকো হওয়ার লক্ষণ কিনা সেটাও অবশ্য ভাবায় তাকে!
এই তিন মাসেই রাইস কুকারে ভাত রান্না করায় এক্সপার্ট হয়ে গেছে সানি। মা-ই শিখিয়েছেন। ভাত রাঁধার সাথে আরও কিছু রান্না শিখিয়েছেন মা যা প্রয়োজনটুকু মেটায়। এর জন্য মায়ের কাছে কৃতজ্ঞ সে। অনেক সময়ই ভেবেছে সানি, জন্ম দেওয়ার জন্য মায়ের প্রতি তার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত কিনা! জন্ম দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞ না হলেও ভালোভাবে মানুষ করার জন্য অবশ্যই কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত, এরকম ভাবনাতেও সময় কেটেছে তার! মা বাবার ক্যাচাল টাইপ সংসার দেখে তার একান্ত নিজের ভাবনাতে পরিবর্তন শুরু হয়ে গেছে বেশ আগে! মেয়েদের সাথে আড্ডা দিতে মন্দ লাগে না, ঠোঁটের রং দেখতেও বেশ লাগে কিন্তু সারাক্ষণ একটি মেয়ের সাথে লেপ্টে থাকার, এক টেবিলে বসে খাওয়ার চিন্তা কেন জানি মাথায় ঢোকাতেই পারছে না। একা একা খেতে তার বেশ লাগে! মা মোটামুটি চেষ্টা করে যাচ্ছেন তার মতো করে, সানিও তার মতো এড়িয়ে যাওয়ার বাহানা তৈরি করছে নানা কায়দায়! অযথা মা আবার যেন ঘ্যান ঘ্যান না করেন তার জন্য পথ বের করতেই হয়! সানি ঠিক করে রেখেছে মা সরাসরি মেয়েটির সাথে দেখা করতে বললে বা ভিডিওকলে কথা বলতে বললে কী বলে পাশ কাটিয়ে যাবে। আপাতত এরকম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত নয় সানি। সত্যি বলতে কী, সানির মগজে বিয়ে করার বিষয়ে অনীহা একেবারে ঢুকে বসে আছে বড় হওয়ার পর থেকেই। বৈবাহিক জীবনকে আজব একটা জগৎ মনে হয় তার কাছে! তার কাছের দু’একজন আত্মীয়কে দেখেও এমনটাই মনে হয়েছে। সবার শুধু অভিযোগ আর অভিযোগ!
সামনে বসা মেয়েটি বেশ আয়েশ করে কফি পান করছে। সাথের বন্ধু কিংবা স্বামীটির কফির কাপ কখন ঠোঁটে কখন টেবিলে এটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না কারণ সানি শুধু তার পিঠ দেখতে পাচ্ছে। পুরুষটি বন্ধু না স্বামী সেটা ঠিক না জানলেও মন বলছে বন্ধুই। স্বামীও হতে পারে। সামনে স্বামী বসে থাকলে মেয়েরা এদিক ওদিক চোখ ঘোরায় কম! সামনে বউ বসে থাকলে ছেলেরাও! মেয়েটি দু’বার মাত্র সানির দিকে তাকিয়েছে! সানি কয়েকবার! ইচ্ছে করলেই মেয়েটি আরও দু’একবার তাকাতে পারতো কিন্তু খুব সাবধানে নিজের চোখ তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হচ্ছে। হয়তো তাকিয়েওছে কিন্তু সানি দেখতে পায়নি এমনটাও হতে পারে। আহা, চোখ রাখারাখির এই খেলাটা বেশ জমে উঠতে পারতো কিন্তু উঠলো না!
সানির হঠাৎ খুব ইচ্ছে করে মেয়েটি অন্তত আর একবার তার দিকে তাকিয়ে দেখুক। সে চমৎকার পরিপাটি একজন সুদর্শন যুবক, কেন মেয়েটি আর একবার তাকাবে না? হ্যাঁ, কল্পনায় মেয়েদের নিয়ে সানিও অন্যদের মতো অনেক কিছুই দেখে বা ভাবে এটা অস্বীকার করবে না সে কিন্তু কোনওটাই সানিকে ঐ বিয়ে করে সংসার পর্যন্ত ভাবনায় পৌঁছে দিতে পারে না। প্রায়ই এখানে এসে বসার কারণে এই খেলাটি বেশ মনে ধরেছে তার, কফির কাপে ঠোঁট রেখে মেয়েদের চোখে চোখ রাখা! ঠোঁটের রং দেখা! মাকে তেমন করে সাজতেও দেখেনি কখনও অথচ বাবাকে বেশ স্টাইলিশই মনে হয়। পরিপাটি বাবা নতুন নতুন শার্ট কেনেন নিজের আগ্রহেই। শুধু শার্ট প্যান্ট নয়, সংসারের জন্য যেটা পছন্দ হয় কিনে ফেলেন। পছন্দও খারাপ নয়। বাবার সাথে সানির চমৎকার একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে পারতো, অনেক ছেলের সাথেই বাবাদের সম্পর্ক মধুর হয় শুনেছে, কিন্তু সানির কেন জানি হয়নি। এই ব্যর্থতা তার না বাবা- মার ভাবতে চায় না সে। কারণ ব্যর্থতা যারই হোক সেও ভাগীদার অবশ্যই!
বেশিরভাগ মেয়েই সাজগোজ করে কিন্তু মা অনেকটাই সাদামাটা। কসমেটিকস ব্যবহার নিয়ে সাউথ ইন্ডিয়ান একটা সিনেমা দেখার পর তার চিন্তায় লিপস্টিকের ব্যবহার আর রংয়ের বিষয়টি গেড়ে বসেছে বেশ বুঝতে পারছে সানি। লিপস্টিক নিয়ে এই অহেতুক আগ্রহ সম্ভবত সিনেমাটি দেখার পর থেকেই। কোনও কিছু দেখার প্রভাব যে মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে সানি বেশ ভালোই বোঝে এখন। বন্ধু ফরহাদকে দেখেই প্রেমে পড়ার ভাবনায় প্রভাবিত হয়েছিল অস্বীকার করে না সে! সেই ফরহাদের প্রেমও টেকেনি। তো, প্রথম যে মেয়েটির সাথে সানির আন্তরিকতা তৈরি হয়েছিল সে ছিল ক্লাসের দেবিকা। এই যুগে যেখানে রিংকি সিংকি নামের প্রচলন সেখানে দেবিকার মা বাবা দেবিকা টাইপের নাম কেন রেখেছিল এটা নিয়েই সানির সাথে কথা শুরু হয়ে পরবর্তীতে প্রেম পর্যায়ে চলে যাওয়ার আগেই সরে গিয়েছিল দুজনেই। হ্যাঁ, আপোষেই সরেছিল ওরা। ওই যে ছোটবেলায় বাড়ি থেকে পূজা আর ঈদের পার্থক্য মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে তাতে যতই প্রগতিশীল প্রগতিশীল বলে চেঁচিয়ে টেবিল চাপড়াক না কেন, সংস্কার ঠিকই হাঁটু গেড়ে বারান্দায় বসে থাকে! বিশেষ করে তার মা-বাবার ক্ষেত্রে। খুব ভালো চেনে সে ওদের। ঘটনাটি মা বাবার কানে যাওয়া মাত্রই চিল্লাচিল্লি করে হাত কামড়ে বসে থাকতেন মা, বাবা কী করতেন জানে না সানি তবে আরতির থালা নিয়ে সামনে দাঁড়াতেন না এটা জানে! মাকে শান্ত রাখার জন্য সাপোর্ট দিতেই হতো বাবার। একটা কথা কেন জানি সানির মাথায় ঢুকে আছে; সে যাই করুক মা-বাবা কোনওভাবেই সেটাকে সহজে গ্রহণ করবেন না, কোনও না কোনও ফ্যাকরা তুলে হইচই করবেনই। এটা ওদের স্বভাব। এই স্বভাবের উৎপত্তি কত আগে থেকে সেটা জানা সম্ভব হয়নি! দুজনের পরিবার থেকেই কী এগুলো রপ্ত করেছিলেন নাকি পাশাপাশি থাকতে থাকতে এগুলো রপ্ত হয়েছে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। খেয়াল করেছে, সে ডাইনে যেতে চাইলে বাঁয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ওনারা! রুটি খেতে চাইলে ভাত কেন খাবে না তার জবাব দিতে হয় ওকে। মাছ খেতে চাইলে মাংস কেন পাতে নিচ্ছে না সেটার জন্যও জেরা করেন। বাবা মা কোনোভাবেই সানির নিজস্বতাকে মেনে নিতে চান না। কেন চান না সানি জানে না।
ক্যাপাচিনো কফি পান করা শেষ। সাত সতেরো ভাবতে ভাবতেই কখন যে কফি শেষ হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি সানি। ভাবনাগুলো এমনভাবে মাথা দখল করে নিয়েছিল যে কয়বার সামনের দিকে তাকিয়েছে কিংবা আর কেউ কাঁচের দেয়াল ঠেলে ঢুকেছে কিনা খেয়াল করতে পারেনি। মাথায় একবার একটি বিষয় ঢুকে গেলে সামনের সব কিছু ওয়াশ আউট হয়ে যায়। কফি খাওয়া শেষ হলে বেশিক্ষণ বসে থাকা শোভনীয় নয় তাই উঠতেই হয়। বিল দিয়ে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ানোর সময় শেষবার সামনের মেয়েটির চোখে চোখ রাখতে ইচ্ছে হয় সানির। কিন্তু কোথায় সেই চোখ বা ঠোঁট? মেয়েটির বসা ওই চেয়ারেই পুরু গোঁফে শ্যামলা মতো নিপাট এক ভদ্রলোক কফির কাপে কায়দা করে ঠোঁট রেখে সানির দিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিচ্ছেন। পকেটে বাকি টাকা রাখতে রাখতে দু’মিনিট দাঁড়ায় সানি। তাকিয়ে থাকে। দু’দুবার পুরু গোঁফের সাথে এরকম চোখ রাখারাখি হলে মেয়েটির অ্যাশ কালারের টপসের পেছন দিকটা চোখে পড়ে সানির। নিশ্চিত হয়। ঘাড়ের কাছে অ্যাশ-কমলার কম্বিনেশনের টপ দেখে নিশ্চিত হয়, এ ওই রক্তচোষা ঠোঁটের মেয়েটিই! নতুন কেউ নয়। ওরাই।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন