হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত
এত বিস্তৃত জলরাশি সমুদ্র ছাড়া আর কোথাও দেখেনি বাসব। আসলে এ জায়গাতে তিন নদী এসে মিশেছে। পদ্মা, মেঘনা আর ডাকাতিয়া নদী। মোহনায় তাদের মিলিত জলস্রোত যেন সমুদ্রের আকার নিয়েছে। নদীর পাড়েই শনের ছাউনির নীচে বাঁশের মাচার ওপর বসেছিল বাসব। টিপ টিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মরসুমের প্রথম বৃষ্টি। কিছুটা দূরে ফ্যাকাশে চাঁদের আলোতে নদীবক্ষে দাঁড়িয়ে আছে সার সার মাছ ধরার ট্রলার, নৌকা। আর দু-এক দিনের মধ্যেই কাজ শুরু হবে তাদের। ইলিশ ধরার কাজ। এ জায়গার নাম চাঁদপুর। বাংলাদেশের সব থেকে সুস্বাদু ভালো ইলিশ পাওয়া যায় এই চাঁদপুর মোহনাতেই। এখানে এত ইলিশ ওঠে যে সরকারীভাবেই এ জায়গার নামকরণ করা হয়েছে – ‘ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর’।
বাসব ইন্ডিয়া থেকে বাংলাদেশের চাঁদপুর মোহনায় আজই এসে উপস্থিত হয়েছে বর্ষার মরশুমে ইলিশ ধরা দেখতে। গতকালই সে ঢাকা এসে পৌঁছেছে। তারপর আজ দুপুর নাগাদ ঢাকা থেকে এখানে এসে পৌঁছেছে সে। বাসব ইন্ডিয়ার যে সংবাদ সংস্থায় চাকরি করে সেখান থেকেই বাসবকে এ জায়গাতে পাঠানো হয়েছে ইলিশ ধরার ব্যাপারটা কভার করার জন্য। তবে চাঁদপুরের ব্যাপারটাই মুখ্য। কারণ, এপার বাংলা হোক বা ওপার বাংলা, সারা পৃথিবীব্যাপি বাঙালীর কাছে ‘ইলিশ’ শব্দের আকর্ষণ অমোঘ। তাঁরা জানতে চান কোথায় সব থেকে ভালো ইলিশ মেলে, কী ভাবে তা ধরা হয়, ইত্যাদি, ইত্যাদি। ইলিশ সংক্রান্ত যে কোনও ব্যাপারেই অদম্য কৌতূহল বাঙালীর। ইলিশ ধরার ব্যাপারটা চাক্ষুস করে খবরের কাগজের মাধ্যমে পাঠককে জানানোই বাসবের এখানে আসার মূল উদ্দেশ্য। মোহনা থেকে কিছুটা তফাতেই রেল স্টেশন আর মাছের আড়ৎ। সেখানে একটা ছোট হোটেলে বাসবের থাকার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে হাবিবুর নামে স্থানীয় এক সংবাদপত্র কর্মী। হাবিবুর বলেছে সেই তাকে সব কিছু দেখিয়ে বুঝিয়ে দেবার ব্যবস্থা করবে। ইলিশ ধরার নৌকাতেও উঠিয়ে আনবে তাকে। বাসবকে দেখাবে জালে আটকে পড়ে ছটফট করা জ্যান্ত ইলিশ! বাসব এখানে আসার পর তার সঙ্গে সঙ্গেই ছিলো হাবিবুর নামের ছেলেটা। রাত ন’টায় বাসব ডিনার সারার পর হাবিবুর তার বাইক নিয়ে রওনা হয়েছে বাড়ি ফেরার জন্য। কাছেই কুমিল্লায় তার বাড়ি। হাবিবুর চলে যাবার পর হোটেল থেকে বাসব বেরিয়ে পড়েছে। তারপর পায়ে পায়ে চলে এসেছে নদীর পাড়ে। খুব বেশী হলে নদীর পাড়ে আসতে তার পাঁচ-সাত মিনিট সময় লেগেছে। এতটাই কাছে তার হোটেলটা।
আবহাওয়া দপ্তর আজকাল মোটামুটি যে ঠিকঠাক খবর দেয় তা বাসব বুঝতে পারল। তার ওপর ভিত্তি করেই বাসবের বাংলাদেশ আগমন। হোটেল ছেড়ে নৈশ ভ্রমণে বেরিয়ে নদীর পাড়ে আসতেই ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি নেমেছে। দিনের বেলা এখানে ছোটখাট মেলার মতো বসে তা দেখেছে বাসব। শনের চালার নীচে বাঁশের মাচা বা কাঠের চৌকিতে পসরা সাজিয়ে বসে দোকানীরা। এখন অবশ্য এই রাত দশটায় কেউ কোথাও নেই। বৃষ্টি নামাতে তেমনই একটা ছাউনির নীচে বাসব আশ্রয় নিয়েছে। হাবিবুর বলেছে, ও জায়গায় চোর ডাকাতের কোন উপদ্রব নেই। তাই বেশ রাত হলেও নতুন পরিবেশে এই নির্জন নদী মোহনাতে বসে থাকতে বাসবের কোনও সমস্যা হবার কথা নয়। তাই বেশ নিশ্চিন্তভাবেই বাসব বসে ছিলো। কলকাতার মানুষদের সাধারণত এমন উন্মুক্ত পরিবেশ মেলে না। তাই টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যে মোহনার পাড়ে বসে থাকতে বেশ ভালোই লাগছিল তার।
নদী বয়ে যেখানে সার বেঁধে নৌকা ট্রলারগুলো দাঁড়িয়ে থাকে যেদিকে তাকিয়ে বাসব মনে মনে মাছ ধরা দেখার ব্যাপারে একটা খসড়া পরিকল্পনা ভাবছিল। বিন্দু বিন্দু আলো জ্বলছে নৌকাগুলোতে। নদীর জলস্রোতে মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে নৌকাগুলো। আকাশে মেঘে ঢাকা চাঁদ। হঠাৎই একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনে বাসব তাকিয়ে দেখল একটা লোক এসে দাঁড়িয়েছে ছাউনিটার কাছে। পরনে গেঞ্জি আর লুঙ্গি। বুক পর্যন্ত নেমে আসা দাড়ি। নদীর পাড়ের দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখার চেষ্টা করছে লোকটা। শনের ছাউনির নীচে আধো অন্ধকারে বসা বাসবকে হয়তো বা সে খেয়াল করেনি। লোকটাকে দেখে বাসবের স্থানীয় জেলে বা মাঝি গোত্রের মানুষ বলেই মনে হলো। লোকটা তাকিয়েছিল নদীর দিকে আর বাসব তার দিকে। ঠিক এমন সময় বাসবের হাতে ধরা মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। হাবিবুরের ফোন। সে বাড়ি পৌঁছে গেছে সেই সংবাদটাই বাসবকে জানালো। তার সঙ্গে দু-একটা কথা বলে লাইনটা কেটে দেবার পর বাসব দেখল ফোনের শব্দ শুনে নদীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বাসবের দিকে তাকিয়ে আছে মাঝবয়সী লোকটা। এরপর সে বাসবকে একটু যেন ইতস্ততভাবে প্রশ্ন করল, ‘লক্ষীরে দেখেছেন ভাই? সায়েদাকে?’
বাসব জবাব দিল, ‘আমি এখানে নতুন এসেছি। কাউকে চিনিনা আমি।’
লোকটা আবারও প্রশ্ন করল, ‘কোন বউকে এখন এখানে দেখেছেন আপনি?’
বাসব আবারও জবাব দিল, ‘না কোন মেয়ে বা বউকে আমি এখানে দেখিনি। প্রায় আধঘণ্টা হল আমি এখানে আছি বৃষ্টি নামার পর থেকে।’
লোকটা যেন এবার হতাশভাবে ঘাড় নাড়ল তার উত্তর শুনে। তারপর যেন বৃষ্টির ফোঁটা থেকে বাঁচার জন্যই ছাউনির ভিতর ঢুকে বাসবের কিছুটা ওধারে নদীর দিকে মুখ করে মাচার ওপর বসল। কয়েক মূহুর্ত নিশ্চুপ ভাবে কেটে গেল এরপর। লোকটা তাকিয়ে নদীর দিকে।
এইসব স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে কথা বললে নানানরকম খবর পাওয়া যায়। আর খবর সংগ্রহ করাইতো বাসবের কাজ। তাই সে এরপর একটু গলা খাঁকারি দিয়ে লোকটাকে প্রশ্ন করল, ‘আপনি ভাই এখানেই থাকেন?’
লোকটা জবাব দিল, ‘হ্যাঁ এখানেই।’
‘কী করেন?’ জানতে চাইল বাসব।
লোকটা নদীর দিকে তাকিয়ে জবাব দিল, ‘নদীতে মাছ ধরি। চাঁদপুরের কালো চোখের বড় ইলিশ।’
একথা বলে সে প্রশ্ন করল, ‘আপনি কোত্থেকে আসছেন?’
বাসব জবাব দিল, ‘ইন্ডিয়া, কলকাতা। এখানে ইলিশ ধরা দেখতে এসেছি।’
লোকটা কথা শুনে স্বগতোক্তির স্বরে বলল, ‘ও কলকাতা। আমি যাই নাই কখনও। তবে শুনেছিলাম লক্ষীর কোন এক চাচাতো ভাই নাকি ওখানে থাকত।’
লোকটা জেলে, তার ওপর আবার ইলিশ ধরার কাজ করে! এমন লোকের সঙ্গেই তো বাসবের কথা বলা প্রয়োজন। তাই এরপর সে লোকটাকে প্রশ্ন করল, ‘ইলিশ ধরা শুরু হবে কবে থেকে?’
লোকটা জবাব দিল, ‘আজ থেকে তো বর্ষা শুরু হল। কাল অথবা পরশু থেকেই ইলিশের জাল ফেলা শুরু হবে। সে জন্যইতো লক্ষীকে খুঁজছি।’
লক্ষী নামের বউটা লোকটার কোনও এক পরিচিত হবে। তবে তার সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ না করে বাসব জানতে চাইল, ‘ঠিক কোন সময় জাল ফেললে সব থেকে ভালো ইলিশ ওঠে?’
লোকটা নদীর দিকে তাকিয়ে জবাব দিল, ‘জোয়ার ভাটার মাঝখানের সময় যখন নদীর পানি যখন একদম থম মেরে দাঁড়ায় থাকে, আর আকাশ থেকে এমন ঝিরঝির হালকা পানি নামে, তখন সব থেকে ভালো ইলিশ মেলে চাঁদপুরের মোহনাতে। যেমন তার সোয়াদ, তেমনি তার গতর। অমন ইলিশ পদ্মাতেও কোথাও মেলে না।’
‘এক একটা কত ওজনের হয়? জানতে চাইল বাসব।’
লোকটা জবাব দিল, ‘দু-এক কেজির মাছ তো হামেশাই মেলে। আল্লার ইচ্ছা থাকলে কখনও কখনও তিন, সাড়ে তিন কেজির ইলিশও মেলে। তবে…’ এই বলে থেমে গেল লোকটা।
বাসব প্রশ্ন করল, ‘তবে কী?’
একটু চুপ করে থেকে লোকটা জবাব দিলো, ‘তবে একবার নিয়াজ মিঞার জালে ছয়-সাত কেজি ওজনের ইলিশ ধরা পড়েছিল। অত বড় ইলিশ চাঁদপুরের কোন নৌকা আজ পর্যন্ত ধরতে পারেনি।’
বাসব কথাটা শুনে অবাক হয়ে বলল, ‘অত ওজনের ইলিশ হয় নাকি?’
সে বলল, ‘হয়। ওরা হলো রানী ইলিশ। ওরা ধরা দেয় না। তবে ওই লক্ষীর জন্যই নিয়াজের জালে ধরা পড়েছিল ওরা।’
রানী মৌমাছির কথা শুনেছে বাসব। কিন্তু রানী ইলিশের কথা কোনওদিন শোনেনি সে। ব্যাপারটা নিয়ে ভালো স্টোরি হতে পারে। তাই কথাটা শুনে সে বলল, ‘ওই রানী ইলিশ জালে কীভাবে ধরা পড়েছিল বলবেন?’
লোকটা একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘তাহলে তো লক্ষী মানে ওই সায়েদা আর নিয়াজ মিঞার কথা বলতে হয় আপনাকে। একটু সময় লাগবে সে কথা বলতে।’
লোকটার কথাতে বাসব বলল, ‘আপনি বলুন। আমার কোন তাড়া নেই। তাছাড়া বৃষ্টি পড়ছে। হোটেলে ফেরা যাবে না। আপনি বলুন।’
লোকটা তবুও তার গল্প শুরু করার আগে একটু সংকোচের স্বরে বলল, ‘সে কথা কি আপনি বিশ্বাস করবেন?’
বাসব হেসে জবাব দিলো, ‘দেখুন আমি পেশায় একজন সাংবাদিক। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করবে না এমন অনেক অবিশ্বাস্য ঘটনা আমরা অনেক সময় দেখি বা শুনি। কাজেই আপনার কথা বলতে কোন অসুবিধা নেই।’
বাসবের আশ্বাস শুনে কয়েক মুহুর্ত চুপ করে রইল লোকটা। তারপর বর্ষণসিক্ত নদীর দিকে তাকিয়ে শুরু করল তার কথা –
‘নিয়াজের তখন জোয়ান বয়স। এই সাতাশ-আঠাশ বয়স হবে তার। চাঁদপুরের গায়েই কুমিল্লাতে তার জন্ম। বর্ষায় ইলিশের জাল টানার জন্য বাড়তি লোকের প্রয়োজন হয়। তখন বাইরে থেকে এখানে লোক আসে কাজের জন্য। তেমনই এখানে এসেছিল সে। তারপর এখানকার মাছের আড়তে কাজ নিয়ে এখানেই রয়ে গিয়েছিল সে। বর্ষার কয়েকটা মাস সে ইলিশের ট্রলারে, নৌকাতে জাল টানার কাজ করত। বাকি সময়টা মাছের আড়তের কাজ, আর কখনও একলাই নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে বেরিয়ে পড়ত সে। এখানে এসে কয়েক বছর থাকার পর পয়সা জমিয়ে সে একটা ছোট পুরানো নৌকা আর জাল ইত্যাদি কিনেছিল। সত্যি কথা বলতে কী নিয়াজের জীবন মন্দ কাটছিলো না এই চাঁদপুরের মোহনায়। দু-বেলা দু-মুঠো ভাত, হাতে পান-বিড়ির টাকা, পরনের কাপড়, এর থেকে সাধারণ গরীব মানুষের জীবনে বেশী কী চাই? ও সবই জোগাড় হয়ে যেত নিয়াজের। বেড়া আর খড়ের ছাউনি দেওয়া একটা ঘরও কাছেই বানিয়ে ফেলেছিল সে। নিয়াজ কর্মঠ, পরিশ্রমী। তাই সে কিছু টাকা পয়সাও জমিয়ে ফেলেছিল। বলতে গেলে তোফা চলছিল তার জীবন।
এক সময় স্থানীয় মাঝি, জেলেরা অনেকেই নিয়াজকে বিয়া করার জন্য অনুরোধ জানাতে লাগল। তাদের অনেকেরই বাসায় মেয়ে বোন আছে। তাই তাদের এই অনুরোধ। পাত্র হিসাবে নিয়াজ তো আর মন্দ নয়। সৎ, কর্মঠ। চরিত্র ভালো। বয়সও খুব একটা বেশী নয়। তাদের কথা বলে নিয়াজও এরপর মনে মনে ভাবল, বিয়াটা এবার সে সেরে ফেলবে। তাতে সুরাহা হবে তার। রোজ রোজ ভাত ফুটিয়ে খেতে হয়, বউ হলে রেঁধে দেবে। তাছাড়া নিজের নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে গেলে সঙ্গীকে মাছের টাকার ভাগ দিতে হয়। ঘরের লোক যদি নৌকার হাল ধরে তবে সে টাকার ভাগ দিতে হবে না কাউকে। নিয়াজের ইচ্ছা আছে ভবিষ্যতে আড়তে নিজের একটা দোকান দেবার। তার জন্য টাকা জমাচ্ছে সে। বিয়া করলে সেদিকের কাজটাও এগিয়ে যাবে। তবে বিয়া-শাদীর ব্যাপারটা তো আর একদিনের কোনও ব্যাপার নয়। কাজেই বিয়া করার সিদ্ধান্ত নিলেও নিয়াজ একটু ধীরে সুস্থে মেয়ে পছন্দ করার জন্য সময় নিতে লাগল।
কথায় বলে, আল্লা যা ঠিক করে রাখেন, মানুষের জীবনের ঠিক তাই ঘটে। বিয়ার জন্য মেয়ে দেখছিল নিয়াজ। কয়েকজন মাঝির মেয়েকে পছন্দও হয়ে ছিল তার। কিন্তু হঠাৎই সে একটা মেয়েকে দেখে ফেলল এখানকার এক হোটেলে মাছ দিতে গিয়ে। বাইশ-তেইশ বছরের একটা মেয়ে। পোশাকে গরীব হলেও কী রূপ তার! পান পাতার মতো মুখ, চাঁদপুরের ইলিশের ঘন কালো চোখের মতোই তার চোখ, ভোরবেলা সুয্যি ওঠার সময় নদীর পানির যেমন ফর্সা রঙ হয় তেমনই তার গায়ের রঙ। এঁটো বাসন মাজছিল মেয়েটা। কিন্তু সে অবস্থাতেই মেয়েটাকে দেখে নিয়াজ যেন প্রেমে পড়ে গেল তার। নিয়াজ খোঁজ নিয়ে জানতে পারল মেয়েটা জাতে হিন্দু। নাম লক্ষী। বরিশালে বাসা ছিলো তার। কোন এক দাঙ্গায় নাকি মেয়েটার বাপ-মা মারা পড়ে। এদেশে তার কেউ নেই। হোটেলে যে বুড়ি আপা রান্না করে সেও বরিশালের মেয়ে। এবার বরিশাল থেকে ফেরার পথে সে সঙ্গে করে লক্ষীকে এনেছে তার দুটো ভাতের ব্যবস্থা করে দেবার জন্য। প্রথমদিনই লক্ষীকে দেখে নিয়াজের এত ভালো লেগে গেছিল যে এরপর কাজে অকাজে সে সেই হোটেলে যাওয়া আসা শুরু করল। কয়েকদিনের মধ্যেই মেয়েটার সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তাও বলতে শুরু করল নিয়াজ। কিছুদিন ধরে মেয়েটাকে দেখার পর নিয়াজ বুঝতে পারল তার স্বভাব চরিত্রও বেশ ভদ্র ধরনের। তাই শেষ পর্যন্ত নিয়াজ একদিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। হোটলের রান্নার আপাকে গিয়ে নিয়াজ জানালো লক্ষীকে সে বিয়া করতে চায়। লক্ষী ব্যাপারটাতে আপত্তি জানালো না। হয়তো নিয়াজকে দেখে তারও ভালো লেগে গেছিল, অথবা সেও একটা নিরাপত্তা খুঁজছিল। সুন্দরী যুবতী একলা মেয়ে দেখলে তো শিয়ালের অভাব হয় না। ও সব কোন কারণেই হয়তো নিয়াজ ধর্মে মোছলমান হলেও তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেল লক্ষী। সে বছরই পৌষমাসে লক্ষীর সঙ্গে বিয়া হয়ে গেল নিয়াজের। লক্ষীর নতুন নাম হল সায়েদা।’ একটানা কথাগুলো বলে থামল লোকটা।
যদিও নিয়াজ নামের লোকটা আর তার লক্ষী বা সায়েদার বিবাহ কাহিনীতে কোন আগ্রহ খুঁজে পেল না বাসব। লক্ষী কীভাবে বা কী কৌশলে অত বড় বড় ইলিশ জালে উঠিয়েছিল সে ব্যাপারটাই বাসব জানতে চায়। কিন্তু পাছে লোকটা তার গল্প বলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে তাই তার কথার মধ্যে বাসব বাধা দিলো না। বরং লোকটা থামার পর তাকে বলল, ‘তারপর কী হল বলুন? আমার কিন্তু বেশ লাগছে আপনার কথা শুনতে।’
বাসবের কথা শুনে লোকটা যেন উৎসাহিত বোধ করে আবার বলতে শুরু করল তার কথা-
‘আল্লার ইচ্ছায় বিয়েটা হল ঠিকই। মেয়েটা খারাপ নয়। রেঁধে বেড়ে যত্ন আত্তি করে লক্ষী খাওয়াতে শুরু করল নিয়াজকে। যখনই নিয়াজ আদর চায় তার কাছ থেকে তখনই সে আদর দেয়। শুধু একটা ব্যাপার। সায়েদা নামে ডাকলে সাড়া দিতে একটু দেরী করত সে। হয়তো নতুন নামে সে তখনও ঠিক ধাতস্থ হয়নি বলেই। পুরানো নাম ধর্ম কি এত তাড়াতাড়ি মুছে ফেলা যায়? নিয়াজও তাকে পুরানো নামেই তাই ডাকতে লাগল। কয়েক মাস প্রথমে বেশ ভালোই চলল তাদের জীবন। কিন্তু পদ্মার পানির নীচে কী আছে তা সেসব কেউ আগাম জানতে পারে না, তেমনই আল্লার মনে কী আছে তা কেউ আগাম জানতে পারে না। লক্ষীকে বিয়া করার মাস তিনেকের মধ্যেই আড়ৎ মালিকের সঙ্গে সামান্য কথা কাটাকাটির জেরে চলে গেল নিয়াজের পুরানো চাকরীটা। ব্যাপারটাতে নিয়াজ একটু চাপে পড়ে গেল ঠিকই। সে বিয়ে করেছে। তাই তার খরচ এখন দ্বিগুণ। তবে সে হিসাব করে দেখল বিয়াতে তার কিছু টাকা খরচ হয়ে গেলেও তার হাতে যে জমানো টাকা আছে তা দিয়ে আগামী তিনমাস যেমন চলছে চলে যাবে। আর তারপরই তো দেখতে দেখতে আষাঢ় মাস চলে আসবে। টানা তিন মাস ধরে চলবে ইলিশের মরসুম। তখন জলে নামলেই শুধু পয়সা। পাঁচ-ছয় মাসের সংসার খরচের যোগাড় হয়ে যাবে ওই ইলিশের মরসুমে। আর তার মধ্যে সে নিশ্চয়ই অন্য কোনও আড়তদারের কাছে কাজ জুটিয়ে নিতে পারবে। কাজেই কাজটা হারালেও সংসারটা যেমন চলছিল তেমনই চলতে লাগল। লক্ষী, তাকে ভরসা দিয়ে বলতে লাগল, ‘দেখবে এবার ইলিশের মরশুমে অনেক টাকা রোজগার করবে তুমি। আর কোন আড়তে কাজও নিশ্চয়ই জুটে যাবে।’ নিয়াজও ওই একই কথা ভাবতে লাগল মনে মনে।
দেখতে দেখতে সত্যি একদিন বর্ষা এসে গেল। একদিন রাত থেকে এমনই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হল চাঁদপুরের মোহনায়। সেদিন রাতে আনন্দে উত্তেজনায় ঘুম এলো না নিয়াজের। যে নৌকা ইলিশ ধরতে যাবে তার সঙ্গে তার প্রতিবারের মতো এবারও পাকা কথা হয়ে আছে। ভোরবেলাতেই সেই নৌকাতে অন্যদের সঙ্গে জলে ভেসে পড়বে সে। এ সময় কখনও কখনও একটানা তিন-চারদিনও ঘরে ফেরা হয় না নিয়াজের। জলে যত বেশী সময় সে থাকতে পারবে ততই তার পয়সা। কাজেই এ রাতটা সে লক্ষীর সঙ্গে নানা গল্প করে তার আদর খেয়েই কাটিয়ে দিল, তারপর ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই সামান্য কিছু খেয়ে বৃষ্টির মধ্যে রওনা হল এই মোহনার দিকে। ইলিশ ধরার নৌকাতে চড়ে বসল সে। সার বেঁধে নৌকারা নদীর গভীরে এগোল ইলিশ ধরার জন্য। প্রথম দিনই সব নৌকাতে প্রচুর ইলিশ উঠল। কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল, নিয়াজ যে নৌকাতে ছিল শুধু সেই নৌকাতেই একটাও ইলিশ উঠল না! তবে এমনটা কখনও কখনও কোন নৌকার ক্ষেত্রে হয়। তাই প্রথম দিন ঘটনাটাতে আমল দিল না কেউ। পরদিন ভালো করে জালটাল বেঁধে নতুন জায়গাতে জাল ফেলল নিয়াজদের নৌকা। কিন্তু সেদিনও একই ব্যাপার ঘটল। তবে শুধু সেদিন নয়, পরপর আরও কয়েকটা দিন। আশেপাশের সবার নৌকায় রাশি রাশি চাঁদপুরের ইলিশ, কিন্তু নিয়াজের নৌকায় একটাও ইলিশ নাই। দিন পাঁচেক এমন চলার পর নৌকা মালিক একদিন সন্ধ্যায় অন্য নৌকা নিয়ে সন্ধ্যাবেলা পাড়ে ফিরে এসে নিয়াজকে বলল, ‘আল্লা যখন মাছ দিচ্ছে না তখন আর কয়েক দিন জলে নামব না। তাই তোমারও আর এখন আসার দরকার নেই। যখন আবার জলে নামব তখন আবার ডেকে নেব। ইচ্ছা হলে তুমি এ ক’দিন অন্য নৌকাতে কাজ করতে পারো।’
নৌকা মালিকের কথা শুনে নিয়াজের মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলেও সে ভেবে নিল যে সেটাই করবে মাঝের কয়েকটা দিন। যতদিন না আবার তার পুরানো নৌকা জলে নামে সে দিন পর্যন্ত ইলিশ ধরার নৌকার তো আর অভাব নেই, আর লোকও ডাকছে তাকে। তারই কোন একটাতে নিয়াজ উঠে পড়বে। রাতে ঘরে ফিরে নিয়াজ ব্যাপারটা লক্ষীকে জানাতে সে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘দেখবে কাল নতুন নৌকাতে তুমি অনেক মাছ পাবে। তারপর তুমি আমাকে একটা রূপোর মল গড়িয়ে দেবে।’
নিয়াজ বলল, ‘হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়। হ্যাঁ, দেব।’
নিজের পরিকল্পনা মতো পরদিন আবার এই মোহনার ঘাটে পরদিন ভোরে এসে হাজির হল নিয়াজ। নতুন নৌকাতেও তার কাজ পেতে নিয়াজের অসুবিধা হল না। সে নৌকাতে প্রতিদিনই রাশি রাশি ইলিশ উঠছে। এত ইলিশ যে জাল টেনে তোলার জন্য আরও একজন লোকের দরকার ছিল সে নৌকায়। কাজেই কাজ জানা লোক নিয়াজকে সে নৌকা তুলে নিল। কিন্তু সেদিনও সেই অদ্ভুত ব্যাপারটা ঘটল – যে নৌকা প্রতিদিন রাশি রাশি ইলিশ তুলছে সেদিন নিয়াজের সেই নতুন নৌকাতে একটাও ইলিশ ধরা পড়ল না। বিকালবেলা সেই নতুন নৌকা যখন শূন্য খোল নিয়ে পাড়ে ফিরে এলো তখন আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখতে পেল নিয়াজ। তার পুরানো নৌকার মালিক বলেছিল যে কিছুদিন নৌকা নামাবে না। কিন্তু সে নৌকা জলে নামিয়েছিল। আর সেই নৌকা খোল ভর্তি ইলিশ নিয়ে ফিরেও এসেছে কিছুক্ষণ আগে। পাড়েও উঠে পড়েছে তারা ইলিশ নিয়ে। নিয়াজের নৌকা পাড়ে ফিরতেই তাকে দেখে সেই পুরানো নৌকার মালিক আর লোকজন কেমন যেন তড়িঘড়ি মাছগুলো নিয়ে আড়তের দিকে রওনা হয়ে গেল। নিয়াজ অবশ্য তাদের পিছু ধাওয়া করল না। সন্ধ্যা নামতে চলেছে। সে তার ঘরে ফিরে এল। নতুন নৌকাতে উঠেও এদিন নিয়াজ মাছের মুখ দেখেনি শুনে মুখে কিছু না বললেও লক্ষী যেন বেশ কিছুটা অবাকই হল।
পরদিন কাকভোরে উঠে আবার মোহনায় এসে তার নতুন নৌকাতে ভেসে পড়ল নিয়াজ। সেদিনও কিন্তু এমনই টিপটিপ বৃষ্টি। বাবু হয়তো বা শুনে থাকবেন এ বৃষ্টি কে ‘ইলশেগুড়ি’ বৃষ্টি বলে। আগেই আপনারে বললাম যে এ বৃষ্টিতে সব থেকে ভালো ইলিশ ওঠে। তাই এ বৃষ্টির এমন নাম। কিন্তু দ্বিতীয় দিন ইলশেগুড়ি বৃষ্টি চললেও, চারপাশের জালে প্রচুর ইলিশ উঠলেও নিয়াজদের নৌকাতে একটাও ইলিশ উঠল না। সেদিনও গম্ভীর মুখে সন্ধ্যাবেলায় ঘরে ফিরে এল নিয়াজ। শুধু দু-দিন নয়। তৃতীয়দিনও একই ঘটনা ঘটল, একটাও মাছ পাওয়া গেল না। দিনশেষে ফেরার পথে নিয়াজ একবার খেয়াল করল নৌকার ছইয়ের ভিতর বসে নৌকা মালিক চাপাস্বরে কী যেন আলোচনা করছিল তার দু-জন সঙ্গীর সঙ্গে। নিয়াজ তাদের কাছে যেতেই আলোচনা থামিয়ে দিল তারা। তবে সেদিন সেই নৌকা পাড়ে ভিড়তেই সেই নৌকার মালিক নিয়াজকে জানিয়ে দিল, মাছ যখন উঠছে না, তখন কাল থেকে তোমার আর আসার দরকার নেই। প্রয়োজন হলে তোমাকে ডেকে নেব।
নিয়াজের নৌকা যে এদিনও মাছ পাবে না তা ধারণা করতে পারেনি লক্ষী। তাই নিয়াজ ঘরে ঢুকতেই লক্ষী তার উদ্দেশ্যে হেসে বলল, ‘আজ নিশ্চয়ই অনেক মাছ উঠেছে তোমার নৌকাতে। মাছ ধরা শেষ হলে আমাকে রূপার মল গড়িয়ে দেবে কিন্তু।’
লক্ষীর কথা শুনে নিয়াজ শুধু গম্ভীর মুখে জবাব দিল ‘না পাইনি।’
সেদিন লক্ষীর সঙ্গে সারারাত একটাও কথা বলল না নিয়াজ। কোন রকমে রাতের খাওয়া সেরে লম্ফ নিভে যাবার পর বিছানায় শুয়ে নিয়াজ ভাবতে লাগল। আল্লা তার সঙ্গে কী খেলা খেলছেন? দুশ্চিন্তায় সারা রাত ঘুমাতে পারল না। পরদিন ভোরের আলো ফোটার আগে, লক্ষীর ঘুম ভাঙার আগেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল সে। নিয়াজ যখন এই মোহনায় এসে পৌঁছাল তখন সবে ভোরের আলো ফুটছে। তবু তারই মধ্যে প্রতিদিনের মতোই নৌকাগুলো ভাসতে শুরু করেছে ইলিশ ধরার জন্য। নিয়াজ দেখতে পেল তার পুরানো নৌকাটাও কাছি খুলছে পানিতে ভেসে পড়ার জন্য। নিয়াজ খবর পেয়েছে যে গত দু-দিনও ভালোই মাছ উঠেছে সেই নৌকাতে। এবার আবার হয়তো তারা নিয়াজকে তাদের নৌকায় তুলে নেবে। একথা ভেবে নিয়ে সে তাড়াতাড়ি পাড় বেয়ে সেই নৌকার কাছে পৌঁছাতেই নৌকার মালিক তাকে দেখে বলল, ‘কিছু মনে কোরো না মিঞা। তোমারে আর নৌকাতে তোলা লাগব না।’
কথাটা শুনে নিয়াজ তাকে প্রশ্ন করল, ‘ক্যান, তোলা লাগব না ক্যান?’
নিয়াজের পুরানো নৌকার মালিক তার কথার কোন জবাব না দিয়ে নৌকার রশি খুলে দিল। নৌকা ভেসে পড়ল ইলিশ ধরার জন্য।’ একটানা আবারও কিছুক্ষণ বলে থামল লোকটা।
বাসবের এবার কিছুটা অধৈর্য বোধ হল। ওই রানী ইলিশগুলো কীভাবে ধরা হয়েছিল তা এখনও বলে উঠল না লোকটা। তবে এবারও তাকে কিছু বলল না বাসব। একটু দম নিলো লোকটা। তারপর বলতে শুরু করল।
নিয়াজের পুরানো নৌকা তাকে ফেলে রেখে ইলিশ ধরতে চলে যাবার পর আরও বেশ কয়েকটা নৌকাতে সেদিন কাজ জোটাবার চেষ্টা করল সে। কিন্তু কোন নৌকাই নিয়াজকে কাজে নিতে রাজি হল না। সারাদিন ওই মোহনার পাড়ে কাটিয়ে রাতে ঘরে ফিরল সে। লক্ষী তাকে গত দিনের মতো একই কথা বলল, এবং সে একই উত্তর দিল। এর পরের দুদিনও অন্য নৌকাগুলোতে পানিতে ভাসার চেষ্টা করল কিন্তু কেউ তাকে নিলো না। তার পরদিনও কাজ না পেয়ে সারাদিন মোহনার পাড়েই বসেছিল নিয়াজ। বিকাল হতে না হতেই নদী থেকে ফিরে আসতে লাগল একের পর এক ইলিশভর্তি নৌকা। মোহনার পাড়ে নানা মানুষের ভিড়। লোকজনের হাঁক ডাক। খোল থেকে ঝুড়ি ভর্তি চাঁদপুরের ইলিশ রওনা হচ্ছে আড়তের দিকে। সবাই কাজে ব্যস্ত কিন্তু নিয়াজেরই শুধু কাজ নেই। এসব দেখতে দেখতেই বিকাল গড়িয়ে একসময় সন্ধ্যা নামল। নৌকাগুলোতে দিনের শেষে এবার রান্নার তোড়জোড় শুরু হল। ছইয়ের ভিতর জলে উঠতে লাগল বিন্দু বিন্দু আলো। নিয়াজও এরপর উঠে দাঁড়াল তার ঘরে ফেরার জন্য। ঠিক তখনই তার সামনে এসে দাঁড়াল একজন লোক। তার নাম কিসমত। নিয়াজের পুরানো এক পরিচিত। সেও পানিতে ইলিশ ধরার জাল টানে। নিয়াজকে দেখে সে বলল, ‘চলো দুজন আজ একটু আনন্দ করি। আল্লা আমাদের নৌকা ইলিশে ভরিয়ে দিছেন।’
কিসমতের কথা শুনে নিয়াজ বুঝতে পারল বেশ পয়সা এসেছে তার পকেটে। আর আনন্দ করার ইঙ্গিতটাও নিয়াজ বুঝতে পারল। নদীর পাড়ে বেশ কয়েকটা ঝুপড়ি আছে যেখানে পচা চালের রস বিক্রি হয়, খেলে বেশ নেশা হয়। গরীব মাঝি মাল্লারা ভাজা মাছ দিয়ে তা খেয়ে গায়ের ব্যাথা জুড়ায়। ইয়ার দোস্তদের পাল্লায় পড়ে নিয়াজ বার কয়েক সেখানে ইতিপূর্বে গেছে তবে ব্যাপারটার প্রতি তার নেশা নেই। কিন্তু কিসমতের সঙ্গে সেখানে গিয়ে তার সঙ্গে কথাবার্তা বললে কাজ পাবার কোন সুযোগ আসতে পারে। এ কথা ভেবে নিয়ে একটু ইতস্তত করে নিয়াজ। কিসমতের সঙ্গে রওনা হল সেই শুঁড়িখানার দিকে।
একটা ছোট ইলিশমাছ কিসমত তার সঙ্গেই এনেছিল। সেটা সেখানে ভাজা হল। কিসমতের অনুরোধে নিয়াজ আর আপত্তি করে না সেই ধেনো রস খেতে। ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে বেশ কয়েক পাত্র তারা পান করার পর নিয়াজ এক সময় কিসমতকে বলল, ‘তোমাদের নৌকাতে বা অন্য কোন নৌকাতে কাজের লোকের দরকার হচ্ছে না?’
কিসমত বলল, ‘ইলিশের ভরা মরসুম। তা তো হচ্ছেই। অনেক নৌকাতেই তো নতুন লোক নেওয়া হচ্ছে রোজই।’
কথাটা শুনে নিয়াজ তাকে বলল, ‘দেখো না কিসমত ভাই আমাকে তোমাদের নৌকাতে বা অন্য নৌকাতে তুলে নেওয়া যায় কিনা? দুটো নৌকাতে উঠলাম। কিন্তু পুরানো-নতুন দুটো নৌকাই আমাকে নামিয়ে দিল।’
নিয়াজের কথা শুনে প্রথমে কোন জবাব না দিয়ে কিসমত আরও এক ভাঁড় পান করে প্রথমে চুপ করে রইল। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে নিয়াজ বলল, ‘তুমি কথা কও না ক্যান? পারবেনা আমারে কোন নৌকায় তুলে দিতে। ইলিশের মরসুম। সবার হাতে এত কাজ। অথচ আমার হাতে কোন কাজ নাই।’
কিসমত বলল, ‘তোমাকে তো নেওয়াই যেত। কিন্তু…’
‘কিন্তু কী?’ প্রশ্ন করল নিয়াজ।
কিসমত হয়তো নিয়াজকে কথাটা বলতে চায়নি, কিন্তু হয়তো বা নেশার ঝোঁকেই সে সত্যি কথাটা বলে ফেলল। সে বলল, ‘কিছু মনে কোরো না নিয়াজ ভাই। আমি যা শুনছি তাই তোমারে বলি, লোকে বলছে তুমি অপয়া। যে নৌকাতে উঠছ তাতে মাছ মিলছে না। এ কথা চাউর হয়ে যাবার পর কে তোমায় নৌকায় তুলবে বলো?’
কথাটা শুনে নিয়াজ অবাক হয়ে গেল। একটু চুপ করে থেকে সে বলল, ‘হ্যাঁ, এ কথা ঠিকই যে আমি যে কদিন নৌকায় উঠেছিলাম সে কয়দিন মাছ ওঠেনি। কিন্তু পরে উঠবে না কে বলতে পারে? আমি অপয়া হয়ে গেলাম ক্যামনে?’
কিসমত বলল, ‘আসলে মাঝিরা বলছে, তুমি নও তোমার ওই বেজাতের বউটাই আসল অপয়া। তার ছোঁয়ায় তুমিও অপয়া হয়ে গেছ! ওর জন্যই তোমার আড়তেই কাজটা গেছে। যে নৌকায় উঠছ তাতে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো তেমন কোন মাঝি বা জেলেই কথাটা প্রচার করছে যার ইচ্ছা ছিল তার মাইয়ার সঙ্গে তোমার বিয়া দেবার। কিন্তু সে ইচ্ছা পূরণ না হওয়ায় এখন তোমার বিরুদ্ধে লোক খেপাচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এ সব কথা মিলে যাওয়াতে লোকজনও ব্যাপারটা বিশ্বাস করছে।’ একটানা কথাগুলো নেশার ঘোরে বলে দিল কিসমত।
কথাগুলো বলে কিসমত এক ভাঁড় ধেনো বাড়িয়ে দিল নিয়াজের দিকে। তার কথা শোনার পর বেশ কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল নিয়াজ। তারপর ভাঁড়টা এক চুমুকে শেষ করে রওনা হল ঘরে ফেরার জন্য। তার মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল কিসমতের বলা কথাগুলো।
এসব খাওয়া অভ্যাস নেই নিয়াজের। মাথার মধ্যে কিসমতের বলা কথাগুলো নিয়েই টলতে টলতে বাড়ি ফিরল নিয়াজ। সে যে নেশা করে রয়েছে তা প্রথমে বুঝতে পারেনি লক্ষী। প্রতিদিনের মতোই সে তাকে দেখে বলল, ‘আজ নিশ্চয়ই মাছ পাইছো? আমাকে মল গড়ায় দেবা কিন্তু।’
নিয়াজের এদিন লক্ষীর কথা শুনেই মাথাটা কেমন গরম হয়ে গেল। হয়তো বা সেটা নেশার কারণেই। তবুও সে নিজেকে সংযত রেখে প্রথমে বলল, ‘পানিতে নামি নাই। কোন নৌকা আমারে ন্যায় নাই।’
লক্ষী মোহনাতে না গেলেও দাওয়াতে বসেই, অন্য লোকজনের মুখ থেকে শুনতে পায় সব নৌকা মাছ পাচ্ছে, সব লোক কাজ পাচ্ছে। তবে তার ঘরের লোক মাছ পায় না। কাজ পায় না কেন? হয়তো বা ও জন্য নিয়াজের কথায় একটা সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছিল তার মনে। এ সন্দেহ অন্যায় কিছু নয়। সে চারপাশে যা দেখছে শুনছে তার সঙ্গে নিয়াজের কথার মিল নাই। সে নিয়াজকে প্রশ্ন করল, ‘তুমি নৌকা পাচ্ছ না কেন?’
নিয়াজ এবার একটু চড়া গলায় জবাব দিল, ‘তা জেনে তোর কাম কী? নিজের কাজ কর।’
লক্ষী এবার বলল, ‘সবাই কাজ পাচ্ছে আর তুমি পাচ্ছ না!’
নিয়াজ এরপর আর নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে বলল, ‘লোকে বলছে তুই অপয়া। তোর ছোঁয়ায় আমিও অপয়া হয়ে গেছি। যে জন্য আমার আড়তের কাজ গেছে, যে নৌকায় উঠছি তাতে মাছ উঠছে না। এবার বুঝলি কেন আমি কাজ পাচ্ছি না?’
কথাটা শুনে অবাক হয়ে গেল লক্ষী। নিয়াজের জড়ানো কণ্ঠস্বর শুনে সে ইতিমধ্যে বুঝতে পারল নিয়াজ নেশা করে এসেছে। নেশার ঘোরে নিয়াজ কথা বানিয়ে বলছে না তো? সম্ভবত এ কথা ভেবে নিয়েই লক্ষী একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘তুমি তো ঘর থেকে পয়সা নিয়ে বার হও না। কাম যদি না করে থাকো তবে নেশার পয়সা জুটলো কই?’
স্পষ্ট অবিশ্বাসের সুর ভেসে উঠল লক্ষীর গলায়। হঠাৎই নিয়াজের মাথার মধ্যে কী একটা হয়ে গেল লক্ষীর কথা শুনে। সে একটা চড় কষিয়ে দিল লক্ষীর গালে। তারপর চিৎকার করে বলে উঠল, ‘তোর জন্য আমার সর্বনাশ হচ্ছে হারামজাদী। তুই দূর হ, দূর হ আমার ঘর থেকে।’
নিয়াজের এই আচরণে হতভম্ব হয়ে গেছিল লক্ষী। তবুও সে বলল, ‘আমি অপয়া! কী কইতাছো তুমি?
নিয়াজ আরও জোরে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তুই অপয়া মাগী। তুই এখনই ঘর ছাড়। নইলে তরে পিটায় বার করুম।’
নিয়াজের কথাটা শুনে তার দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইল লক্ষী। তারপর মুখে আঁচল চাপা দিয়ে এক ছুটে বাইরের অন্ধকারে বেরিয়ে গেল। আর নিয়াজও নেশার ঘোরে বিছানাতে টলে পড়ল।
পরদিন ঘুম থেকে ওঠার পর নিয়াজ বুঝতে পারল নেশার ঘোরে সে কী ভুল করে বসেছে। বেলা হবার পরও যখন লক্ষী ঘরে ফিরল না তখন নিয়াজ খুঁজতে বেরলো লক্ষীকে। কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। পরপর দু’দিন তার কোন খোঁজ মিলল না।’ এ পর্যন্ত বলে আবারও আগের কয়েকবারের মতোই থেকে গেল বক্তা।
বাসবের এবার সত্যি ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটল। নিয়াজের আর লক্ষীর দাম্পত্য কাহিনী ছেড়ে এখনও বাইরে বেরোতে পারেনি লোকটা। বাসবের জানা দরকার ওই বড় বড় ইলিশ মাছগুলো কীভাবে ধরা হয়েছিল সে ঘটনা। রাত ক্রমশ বেড়ে চলেছে, বৃষ্টিও এবার থামতে চলেছে। ঢাকা থেকে এতটা পথ আসাতে এবার একটু ক্লান্তিও লাগছে তার। বাসব তাই এবার লোকটার উদ্দেশ্যে বলে ফেলল, ‘মাছগুলো কীভাবে ধরা হয়েছিল সেটা এবার বলুন? আমাকে হোটেলে ফিরতে হবে।’
অপরিচিত সেই জেলেও এবার বলল, ‘আমার কথাও আর বেশী বাকি নাই। তাছাড়া আমাকেও লক্ষীকে খুঁজতে যেতে হবে।’
একথা বলে সে বলতে শুরু করল তার শেষ কথা-
‘পুরো দুটো রাত লক্ষী ঘরে ফিরল না। কেউ বলল লক্ষী কুমিল্লায় ফিরে গেছে, আবার এমনও কেউ কেউ বলতে লাগল লক্ষীর চরিত্র নাকি আসলে ভালো ছিল না, সে অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে পালিয়েছে। এমনকি ইন্ডিয়াতেও পালিয়ে গিয়ে থাকতে পারে। এ সব কথা কানে আসতে লাগল নিয়াজের। তৃতীয়দিনও মোহনার চারপাশে লক্ষীর খোঁজ চালালো নিয়াজ। কিন্তু কেউ তার কোনও খোঁজ দিতে পারল না। পানির বুকে অন্ধকার নামল এক সময়। নিয়াজ তখন নদীর পাড় বরাবর হাঁটছিল। হঠাৎ তার সে সময় চোখে পড়ল সেই শুঁড়ি ঘরটা। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত নিয়াজের সে ঘরটা দেখে হঠাৎই মনে হল, দু-পাত্তর ধেনো খাওয়া যাক। তাতে যদি তার ক্লান্তি, দুঃখ কিছুটা কমে। নিয়াজ ঢুকে পড়ল সেখানে। তবে দু-পাত্তর নয়, সেখানে বসে থাকতে থাকতে কীভাবে যেন বেশ অনেক কটা ভাঁড় ধেনো রস খেয়ে ফেলল সে। তারপর যখন সে তার ঘরের দিকে রওনা হল তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। আর তার সঙ্গে সঙ্গে ইলশেগুড়ি বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেছে। এই মোহনা থেকে টলতে টলতে কোনওরকমে সে ঘরে ফিরে দরজার ঝাঁপ বন্ধ করে শুয়ে পড়ল।
এখন মাঝরাত। বাইরে ইলশেগুড়ি বৃষ্টি হয়েই চলেছে। হঠাৎই একটা শব্দ শুনে নিয়াজ একটু হুঁশ ফিরে পেল। যদিও তখনও তার নেশার ঘোর কাটেনি। শব্দটা দরজার ঝাঁপ ধাক্কানোর। নিয়াজ উঠে ঝাঁপ খুলতেই তাকে ঠেলে ঘরের ভিতর ঢুকল লক্ষী! তার সর্বাঙ্গ ভিজা। তাকে দেখে বিস্মিত নিয়াজ বলল, ‘তুই কোথায় গেছিলি? দু-রাত কোথায় ছিলি?’
লক্ষী জবাব দিল, ‘মাছ খুঁজতে।’
নিয়াজ বলল, ‘মাছ খুঁজতে মানে?’
লক্ষী বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ মাছ খুঁজতে। কোথায় মাছ পাওয়া যাবে জেনেছি আমি। তুমি যে মাছ ধরতে পারলে কেউ আর আমাকে অপয়া বলতে পারবে না। যাও সে মাছ ধরো গে। যাও, এখনই বেরিয়ে পড়। নইলে অন্য কেউ হয়তো ধরে নেবে।’
তার কথা শুনে নিয়াজ বলল, ‘তোর কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’
লক্ষী বলল, ‘এখন তোমার সব কথা বোঝার দরকার নেই। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড় তোমার ছোট নৌকাটা নিয়ে। ধলা চরের গায়ে যে পাকুড় গাছটা আছে তার সামনে পানিতে জাল ফেলো। দেরি কোরো না।’
নিয়াজ বলল, ‘তুই কী করে জানলি ওখানে মাছ আছে? একটা ছোট নৌকায় ইলিশ ধরব কীভাবে?’
লক্ষী বলল, ‘সে কথা পরে বলব। এখন যাও। আমি বলছি তুমি একলাই ইলিশ ধরতে পারবা। এরপর বারবার একই কথা বলতে লাগল লক্ষী। ধলা চর জায়গাটা মোহনার কাছেই। শরৎকালে ওখানে ধলা, মানে শাদা রঙের কাশফুল ফোটে বলে ওর নাম ধলা চর। নিয়াজ নেশার ঘোরে থাকার কারণেই হোক বা লক্ষীর কথার মধ্যে কোন একটা অদ্ভুত ব্যাপার থাকার কারণেই হোক এরপর রাজি হয়ে গেল তার প্রস্তাবে। সে লক্ষীকে বলল, ‘তোকে কিন্তু আমি ঘরে আটকায় রেখে যাব।’
লক্ষীর ও কথার পর ঘরের কোণে রাখা জাল আর কিছু সরঞ্জাম নিয়ে লক্ষীকে ঘরে রেখে বাইরে থেকে ঝাঁপের শিকল আটকে ওই মোহনার দিকে রওনা হয়ে গেল নিয়াজ। তারপর ওখানে এসে নৌকা নিয়ে পানিতে নেমে পড়ল।
কিছু সময়ের মধ্যেই সে জায়গায় পৌঁছে পানিতে জাল ফেলল নিয়াজ। আবছা চাঁদের আলো নদীতে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। ইলশেগুড়ি বৃষ্টি। নিয়াজ জাল ফেলে অপেক্ষা করতে লাগল ভোরের আলো ফোটার জন্য।
আলো ফুটতে শুরু করল এক সময়। নিয়াজের নেশাটাও তখন সবে এসেছে। জাল টানতে শুরু করল নিয়াজ। কিন্তু সেই ছোট জাল যেন কিছুতেই টেনে তুলতে পারে না। এত্ত ভারী সেই জাল। আর তারপরই সে দেখতে পেল জালের গায়ে আটকে বিশাল বিশাল সব ইলিশ উঠে আসছে! এতবড় ইলিশ নিয়াজ আগে কোনদিন দেখেনি, হয়ত চাঁদপুর ঘাটের কেউই দেখেনি। কোনরকমে এক একটা ইলিশ সে জাল থেকে খোলে তুলতে লাগল। তার ভারী জাল টেনে অত বড় বড় মাছ একলা তার পক্ষে নৌকাতে তোলা সম্ভব ছিল না। যতটুকু মাছ সে পারল তুলল, তারপর জাল সমেত বাকিগুলো ফেলে রেখে রওনা হল এখানে ফেরার জন্য। পাড়ের দিকে এগোতে এগোতে নিয়াজ ভাবতে লাগল সত্যি এবার তার আর বউ বা তাকে কেউ আর অপয়া বলতে পারবে না। নিয়াজের নৌকা যখন পাড়ে এসে ভিড়ল তখন সবে ভোর হয়েছে। অন্য নৌকারা রওনা হতে চলেছে মাছ ধরার জন্য। নিয়াজ নৌকা থেকে মাছগুলো ওঠাতেই হতবাক হয়ে গেল সবাই। এত বড় বড় ইলিশ! এ যে আগে চোখে দেখেনি কেউ! কৌতূহলী হয়ে সবাই জানতে চাইল, ‘এ মাছ তুমি কোথায় পেলে?’
প্রশ্নের জবাবে সত্যি কথাই বলল নিয়াজ। সে বলল, ‘ধলা চরে। আমার বউ লক্ষী সেখানে মাছ ধরতে পাঠিয়েছিল। অনেক মাছ ছিল, একলা মানুষ টেনে উঠাতে পারিনি।’
লোকজন জানতে চাইল, ‘পানির তলে মাছে কথা একমাত্র আল্লা ছাড়া কেউ জানে না। তোমার বউ জানল ক্যামনে?’
কথার জবাব না দিয়ে নিয়াজ মাছের ঝুড়ি নিয়ে ছুটল আড়তের দিকে।’
এ পর্যন্ত কথা বলে ছাউনির নীচের মাচা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সেই জেলে। তারপর বলল, ‘বৃষ্টি থেমে গেছে, আমি এবার যাই। লক্ষীকে খুঁজে বার করতে হবে।’
বাসবও উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কিন্তু আসল ব্যাপারটাই তো বুঝতে পারলাম না। ওই নিয়াজের বউ মাছের সন্ধান পেল কীভাবে?’
লোকটা কিন্তু বাসবের কথার কোন জবাব দিল না। ছাউনি থেকে বেরিয়ে সোজা এগোলো ঢাল বেয়ে জলের পাড়ে নামার জন্য।
ছাউনি ছেড়ে বেরিয়ে এলো বাসবও। লোকটার উদ্দেশ্যে আবারও সে একবার বলে উঠল, ‘লক্ষী কীভাবে মাছগুলোর খোঁজ পেল সেটা বলে যান…’
কিন্তু লোকটা যেন তার কথা শুনতেই পেল না। ঢাল বেয়ে নেমে নদীর পাড়ের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল! বাসব তা দেখে মনে মনে বলল, বেশ খ্যাপা লোক তো! গল্প বলল এতক্ষণ ধরে, কিন্তু গল্পের আসল রহস্যটাই বলল না!
বাসবের আর কিছু করার নেই। বৃষ্টি থেমে গেছে। রাতও হয়েছে বেশ। আবারও যে কোন মুহূর্তে বৃষ্টি নামতে পারে। কাজেই বাসব আর যেখানে না দাঁড়িয়ে ফেরার পথ ধরল।
চাঁদপুরের হোটেলে নির্বিঘ্নেই রাতটা ঘুমিয়ে কেটে গেল। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই বাইক নিয়ে এসে হাজির হল স্থানীয় সাংবাদিক হাবিবুর নামের ছেলেটা। তাকে নিয়ে সে মোহনায় যাবে। চা বিস্কুট খেয়ে তার সঙ্গে মোহনায় এসে দাঁড়াল বাসব। সকালের আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। কী বিরাট এই চাঁদপুরের মোহনা। পদ্মা, মেঘনা আর ডাকাতিয়ার জল মিলে মিশে যেন সমুদ্রের সৃষ্টি করেছে! সূর্যের প্রথম আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই বেশ কিছু নৌকা মোহনার গভীরে ভেসে পড়েছে। দূরে নদীবক্ষে তাদের বিন্দুর মতো দেখাচ্ছে। বাকি নৌকাগুলো ভেসে পড়ার তোড়জোড় শুরু করেছে। চারপাশে লোকজনের চিৎকার চেঁচামেচি আর নানা ধরনের শব্দ। ঢাল বেয়ে নীচে নেমে যেখান থেকে নৌকাগুলো ছাড়ছে সেখানে এসে দাঁড়াল তার দুজন। হাবিবুর বাসবকে বোঝাচ্ছিল এসব নৌকা কীভাবে জাল ফেলবে। হঠাৎ তার কানে এল একটা কন্ঠস্বর, ‘লক্ষীকে তোমরা দেখেছ? জায়েদাকে?’
কথাটা কানে যেতেই মৃদু চমকে উঠে সেই কণ্ঠস্বর লক্ষ্য করে তাকাল বাসব। হ্যাঁ গতকালের সেই অদ্ভুত গল্প বলা লোকটা। একটা নৌকার রশি খোলা হচ্ছে কাছেই। সেখানে দাঁড়িয়ে সে নৌকার লোকদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল লোকটা।
তার প্রশ্নের জবাবে প্রথমে কোন উত্তর দিলো না নৌকার লোকগুলো। কিন্তু গতরাতের লোকটা আবার তাকে একই প্রশ্ন করতে নৌকার একজন লোক তার উদ্দেশ্যে বৈঠা তুলে ধমকের সুরে বলল, ‘যাও, যাও এখান থেকে। নৌকা ছাড়ার সময় লক্ষীর খোঁজ করবে!’
ধমক শুনে লোকটা আর দাঁড়ালো না। সে এগোলো অন্য একটা নৌকার দিকে, সম্ভবত তাদের কাছে লক্ষীর খোঁজ করার জন্য।
সে সেদিকে এগোতেই বাসব লোকটার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে হাবিবুরকে প্রশ্ন করল ওই লোকটা কে? কাল রাতে আমার কাছেও লক্ষীর খোঁজ করছিল।
প্রশ্ন শুনে হাবিবুর জবাব দিল, ‘ও স্থানীয় একজন জেলে। একসময় মাছ ধরত। এখন মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। ওর নাম হল নিয়াজ। আর ও যার খোঁজ করছে সে হল ওর বউ।’
হাবিবুরের কথা শুনে বাসব বিস্মিত ভাবে বলে উঠল, ‘নিয়াজ!’
হাবিবুর বলল, ‘হ্যাঁ, ওর নাম নিয়াজ। ওকে একডাকে এখানে সবাই চেনে। ও একবার কয়েকটা এতবড় ইলিশ একলা ধরেছিল যে অমন ইলিশ ওর পরে আর চাঁদপুরের ঘাটে কেউ ধরতে পারেনি।’
বাসব কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করল, ‘সে ঘটনাটা কেমন?’
হাবিবুর বলল, ‘একটা বড় ঘটনা। দুঃখজনকও বটে। সংক্ষেপে বলি। হাবিবুর বিয়ে করেছিল লক্ষী নামের একটা মেয়েকে। কিন্তু তাকে বিয়ে করার পরই নিয়াজের জীবনের দুর্ভোগ নেমে আসে। রটে যায় বউটা অপয়া। তার জন্যই নিয়াজের দুর্ভোগ। ইলিশের মরশুমে নিয়াজ কাজ হারিয়ে একদিন রাতে তার বউকে মারধর করে ঘর থেকে বার করে দেয় অথবা বউটা নিজে বেরিয়ে যায়। এর তিনদিনের মাথাতেই নিয়াজ মাছগুলো ধরে। কিন্তু এরপরের ঘটনা আরও চমকপ্রদ। নিয়াজের কথা শুনে সেখানে মাছ পাবার আশাতে বেশ কয়েকটা নৌকা সেখানে জাল ফেলে। ওই বড় মাছ তাদের জালে ওঠেনি। উঠেছিল একটা কঙ্কাল। তার পরনের কাপড়ের টুকরো আর হাতের চুড়ি দেখে লোকে সেটাকে নিয়াজের বউ লক্ষীর কঙ্কাল বলে চিহ্নিত করে। আপনি জানেন কিনা জানিনা, অনেক মাছের মতো ইলিশেরও প্রিয় খাদ্য মড়া। বিশেষত মানুষের মড়া। চাউর হয়ে যায় নিয়াজই বউয়ের উপর রেগে গিয়ে তাকে খুন করে জলের নীচে ওখানে ডুবিয়ে রেখে ইলিশের টোপ হিসাবে ব্যবহার করে। সেই জন্যই অতবড় ইলিশ মাছ ধরতে পেরেছিল সে। নিয়াজ লোকজনকে বলেছিল তার বউই নাকি দু’রাত পর ফিরে এসে তাকে সেই ধলাচরে ইলিশ ধরতে যেতে বলেছিল। তা কি কখনও সম্ভব? যাই হোক বউকে খুনের অভিযোগে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায় ওকে। বেশ কয়েক বছর জেলও খাটে নিয়াজ। তারপর প্রমাণের অভাবে অথবা মাথা খারাপের স্বভাবে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ও আবার এখানেই ফিরে আসে। ও সবসময়ই ওই লক্ষীকে খুঁজে বেড়ায়। সে সন্ধান দিলে নাকি ও ইলিশ মাছ ধরতে যাবে!’ একটানা কথাগুলো বলে থামল হাবিবুর।
বিস্মিত বাসবের মনে ভেসে উঠল গত রাতে নিয়াজের মুখে শোনা সে বর্ণনাটা। যেখানে সে বলছিল ইলশেগুড়ি বৃষ্টির রাতে লক্ষীর ফিরে এসে মাছের খোঁজ দেওয়ার ব্যাপারটা। নিয়াজের কথা কি সত্যি? নাকি পাগলের প্রলাপ?
এ কথা বলতে বলতেই বাসবের আবার কানে এল, নিয়াজ আর একজন লোককে গিয়ে জিজ্ঞেস করছে, ‘লক্ষীকে দেখেছ? সায়েদাকে?’
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন