short-story-chhobi-tumi-kar

ছবি তুমি কার
শুভমানস ঘোষ


অলৌকিক সাহিত্যের পরিচিত লেখক বর্ণদীপ শিল্প প্রদর্শনীর ছবি দেখছিল। ছবির শিল্পী মৌমিতা তার কলেজের পার্ট টাইম কম্পিউটার টিচার। কিছু কাল হল পোড়াডোবায় বাড়ি কিনে চলে গেছে। ছবি আঁকার পাশাপাশি সে জোডিয়াক চার্ট অর্থাৎ জ্যোতিষচর্চায় এক্সপার্ট। তার জন্যই তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল বর্ণদীপ।

পরে দেখা যায় মৌমিতা সাহিত্যও ভাল বোঝে। কোথাও বর্ণদীপের অলৌকিক গল্প বেরোলে গোগ্রাসে পড়ে ফেলে। লেখায় কোনও শিল্পগত ভারসাম্যের অভাব থাকলে দেখিয়ে দেয়। পরে যখন সে সব বই হয়ে বেরোয়, তখন তার মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে সেগুলি সংশোধন করে নেয় বর্ণদীপ। কিছু দিন হল নতুন গল্প লিখে সে মৌমিতাকে পড়াতেও শুরু করেছে। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করেছে, মৌমিতার দেখে দেওয়া গল্প একচোটেই বেরিয়ে যায়। নতুন গল্প চেয়ে ফোন আসে না পত্রিকার দফতর থেকে। একটু আগে ছবির প্রদর্শনীর উদ্বোধন হয়েছে। বর্ণদীপের পাড়ায় নাম-করা এক শিল্পী থাকেন। এক সময় দেশে-বিদেশে তাঁর ছবি সমাদৃত হয়েছিল। নাম দেবব্রত ধর। মৌমিতা চেয়েছিল ছবির উদ্বোধন তাঁকে দিয়ে করাতে।

শিল্পীদের কারও কারও নাক উঁচু ভাব থাকে। বিদেশ থেকে পুরস্কার পেতে দেবব্রতবাবুর তা এতটাই বেড়ে গেছে, ছবি আঁকা ছেড়ে কাগজে-টিভিতে জ্ঞান বিতরণ করে বেড়ান। কিন্তু শিল্প সমালোচক হিসাবে তাঁর সুনামের চেয়ে বদনামই ছড়িয়েছে বেশি। কারণ তাঁর মতে, এ দেশে ভাল কাজ হচ্ছে না। বিদেশের তুলনায় আমাদের শিল্পচর্চা একশো মাইল পিছিয়ে আছে। শিল্পীদের ছবির চুলচেরা বিশ্লেষণ করে অনেক শিল্পীরই ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে ছেড়েছেন। বর্ণদীপকে সঙ্গে করেই মৌমিতা তাঁর বাড়িতে গিয়েছিল‌। দেবব্রতবাবুর চেহারা-স্বাস্থ্যের মধ্যে একটা সৌম্য ভাব ছিল। ইদানীং ছবি আঁকা ছেড়ে তিক্ত সমালোচনায় ঢোকায় মুখ-চোখে একটা কর্কশতার ছাপ পড়েছে। চোখের দৃষ্টিও ভাল ঠেকল না।

‘‘হঠাৎ আমাকে টানাটানি কেন?” মৌমিতার প্রস্তাব শুনে দেবব্রতবাবু রেগেই উঠেছিলেন, “যতই উদ্বোধনে ডাকো, খারাপ ছবিকে ভাল ছবি বলে সার্টিফিকেট দিতে পারব না। এ আমার স্পষ্ট কথা।’’

মৌমিতা বলেছিল, ‘‘ঠিক আছে। আপনি যেমন বুঝবেন, তাই বলবেন। আপনার মতামত পেলে আমাদের উপকার হবে। দরকার পড়লে সংশোধন করে নিতে পারব।’’

‘‘আর্টের সঙ্গে সংশোধন যায় না। আর্ট আর্টিফিশিয়াল হয়ে যায়,’’ দেবব্রতবাবু ধাওয়া দিয়েছিলেন মৌমিতাকে, ‘‘দু’দিনের মেয়ে! যাও! যাও! আমাকে বিরক্ত কোরো না! এর তার কাছ থেকে আইডিয়া চুরি করে আর্টিস্ট হওয়া যায় না।’’

শুনে মুখ লাল করে ফিরে এসেছিল মৌমিতা। বর্ণদীপও অস্বস্তিতে পড়েছিল। ভাল শিল্পীর অভাবে শেষ পর্যন্ত উদ্বোধক হিসাবে একজন মোটামুটি নামকরা প্রচ্ছদ শিল্পী অর্জুন মুখার্জিকে খুঁজে পেতে এনেছিল। ছবির প্রদর্শনীর জন্য মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানকে ধরে নিখরচায় হল-ও ঠিক করে দিয়েছিল।

একটু আগে উদ্বোধন হয়ে গেছে। অর্জুন মুখার্জিও চলে গিয়েছেন। হল ভর্তি লোক। ঘুরে ঘুরে ছবি দেখছে। তাদের মধ্যে বর্ণদীপও ছিল। মৌমিতার ছবি তার ভাল লাগে। যে ছবির দিকে তার চোখ, সেটাও ভাল লাগছে। ছবিতে মৌমিতা চারধামের ছবি এঁকেছে। নীচে বিশাল জলস্রোত জটায় ধারণ করে আছেন দেবাদিদেব মহাদেব। দেখেই মুখ দিয়ে অটোমেটিক্যালি বেরিয়ে এল, ‘‘বাহ্‌!’’

হলের মাঝখানে কাঁচের ছোট একটা সেন্টার টেবিল। তার সামনে চেয়ার টেনে বসেছে মৌমিতা। টেবিলে তার পরিচিতি ও শিল্পচর্চার ইতিহাস সম্বলিত ফোল্ডার ও মতামতের খাতা। ছবি দেখে দর্শকরা ইচ্ছে হলে কেউ কেউ তাদের প্রতিক্রিয়া লিখে যাচ্ছেন।

বড় হলের চার দেওয়ালে কম-বেশি প্রায় ত্রিশটা ছবি শোভা পাচ্ছে। কোনও ছবি কারও পছন্দ হলে কিনতে বাধা নেই। প্রদর্শনীর পর ছবি চলে যাবে তার বাড়ি।

ছবিগুলোর মধ্যে বর্ণদীপের একটা পোর্টেটও স্থান পেয়েছে। যার পোর্টেট আঁকা হয়, তাকে সামনে বসিয়ে আঁকেন শিল্পী। কিন্তু বর্ণদীপকে অবাক করে মৌমিতা শুধু স্মৃতি থেকে বর্ণদীপের অবিকল ছবি এঁকে তাকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। মৌমিতা ছবিটা বর্ণদীপকে গিফ্ট করতে চায়।

“এক্সেলেন্ট! কী ছবি! কী আইডিয়া! চমৎকার হাত মৌমিতার!”

বর্ণদীপ ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল নবদ্বীপ কলেজের প্রিন্সিপাল মাঝবয়েসি ডক্টর গোপাল হাটি। মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছেন ছবিটির দিকে। ডক্টর হাটি কাছেই থাকেন। কলেজে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেন। বর্ণদীপের সঙ্গে তাঁর পরিচয় আছে।

“আপনি কখন এলেন স্যার?” বর্ণদীপ খুশি হল।

ডক্টর হাটি বললেন, “এই তো জাস্ট। ডাইরেক্ট কলেজ থেকে এলাম। ইনঅগুরেশন ঠিকঠাক হয়েছে তো?”

“হ্যাঁ, স্যার। আপনি থাকলে ভাল লাগত।”

ডক্টর হাটিকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানে থাকবেন বলে সময় মতোই বেরিয়ে ছিলেন কলেজ থেকে‌। কিন্তু ট্রেন লেট করায় থাকতে পারলেন বলে আফশোস করে বললেন, “মৌমিতার সঙ্গে কথা হল‌। আমি থাকতে না পারলে কী হবে? এই দ্যাখো, আমার ফুল-ব্যাজ-উত্তরীয়-স্মারক সব ধরিয়ে দিয়েছে।”

ডক্টর হাটি হাতে ঝোলানো প্লাস্টিকের প্যাকেট দেখিয়ে বললেন, “ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম, দারুণ সব ছবি এঁকেছে মৌমিতা! ছবি আমি যেটুকু বুঝি, দেখবে খুব নাম করবে এক দিন। তোমাদের কলেজের মুখোজ্জ্বল করবে।”

বর্ণদীপ ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বলল, “মৌমিতা খুব গুণী মেয়ে।”

আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল বর্ণদীপ, হঠাৎ হই-হট্টগোলের শব্দে সচকিত হয়ে উঠল। ভিড়ের জন্য দেখা যাচ্ছে না, পরিচিত গলায় কে যেন “চোর! চোর!” করে চিৎকার করছে। ছবি দেখা রেখে দর্শকরা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মেন গেটে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। বাইরে থেকে দল বেঁধে লোকজন এগজিবিশন হলে এসে ঢুকছে।

ডক্টর হাটিকে নিয়ে বর্ণদীপ ভিড় ঠেলে মৌমিতার টেবিলের কাছে এসে হতবাক হয়ে গেল। দেবব্রতবাবু। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। গলায় মোটা সোনার চেন পরে ফিটফাট হয়ে এসেছেন। মৌমিতা উঠে দাঁড়িয়েছে। মুখ শুকিয়ে গেছে তার। বিব্রত ভাবে বলছে, “এসব কী বলছেন, স্যার? আপনি এত বড় আর্টিস্ট, এত শ্রদ্ধা করি আপনাকে– ’’

“নিকুচি করেছে শ্রদ্ধা!” গলা চড়ালেন দেবব্রতবাবু, “অ্যাই সেদিন কী যেন নাম বলেছিলে তোমার? তাই বলি আমাকে ঘটা করে আমন্ত্রণ করা কেন? চোরাই মাল দিয়ে ফোকটে নাম কামানোর ধান্দা? দাঁড়াও জন্মের মতো শিল্পী হওয়ার সাধ ছুটিয়ে দিচ্ছি তোমার! তুমি আমার ছবি চুরি করেছ।”

এর মধ্যে লোকজনের ভিড় আরও বেড়েছে। বিল্ডিংয়ের সেকেন্ড ফ্লোরের হলে কোনও অনুষ্ঠান আছে। লোকজন আসা-যাওয়া করছিল। গলার শব্দে তাদের মধ্যে এক জন রিপোর্টার স্টোরির খোঁজে ফোটোগ্রাফারকে সঙ্গে করে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল। গদার মতো বিশাল ক্যামেরার চোখ জ্বলে উঠল।

“চুরি করেছে মানে?’’ ডক্টর হাটি দেবব্রতবাবুর দিকে চেয়ে ঝাঁজালেন, ‘‘কে আপনি?’’

দেবব্রতবাবু তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, “কোন গ্রহে থাকেন মশাই, আমায় চেনেন না? আমি ওয়ার্লড ফেমাস অ্যাটিস্ট দেবব্রত ধর। এই মেয়েটা গত রোববার আমার বাড়ি গেছিল। নামাও! নামাও ছবিগুলো!”

সাংবাদিক ছেলেটি চমকে গেল, ‘‘অ্যাঁ! আর্টিস্ট দেবব্রত ধর? আপনি তো নমস্য ব্যক্তি! নমস্কার স্যার! নমস্কার!’’

দেবব্রতবাবু খুশি হলেন। ডক্টর হাটির দিকে চেয়ে বললেন, ‘‘শুনলেন? শুনলেন? দু’পয়সার পাবলিক আমার সঙ্গে লাগতে এসেছে। যান! যান!’’

এই বলে দেবব্রতবাবু যা বললেন সকলে হতবাক হয়ে গেল। এই এগজিবিশনের ন’টা ছবির কমপ্লিট একটা সেট তাঁর আঁকা। মৌমিতা নিজের নামে চালাচ্ছে।

বর্ণদীপ দেবব্রতবাবুকে খুঁটিয়ে দেখছিল। তাঁর চোখের ভাব আজ যেন আরও অস্বাভাবিক। মণিদুটো সরু ও তীক্ষ্ণ হয়ে প্রায় বিন্দুর আকার নিয়েছে। চোখের তারায় হলুদ ছোপ।

“প্লিজ, স্যার! আপনি শান্ত হোন!” মৌমিতা ভয় পেয়েছে, “আমি আপনার ছবি চুরি করিনি!”

“চোপ!” হুংকার ছাড়লেন দেবব্রতবাবু।

আরও ঘাবড়ে গেল মৌমিতা। কাঁপতে শুরু করল। নাহ্, বিপদেই পড়েছে মৌমিতা। এ বার কিছু একটা না-করলেই নয়। বর্ণদীপ “ওয়েট! ওয়েট!” বলে দেবব্রতবাবুকে থামিয়ে প্রশ্ন হানল, “আপনি বলতে চান এখানকার ন’টা ছবি আপনার? ঠিকঠাক গুনেছেন তো?”

দেবব্রতবাবুর চোখ জ্বলে উঠল। বর্ণদীপকে দেখেই চিনল, “এই তো! এই তো! এও ছিল সঙ্গে। বলে, কলেজের প্রফেসর! কী রকম প্রফেসর কে জানে! শিক্ষা-দীক্ষার যা হাল হয়েছে আজকাল। টাকা দিয়ে চাকরি কিনেছে হয়তো।”

ডক্টর হাটি রাগে ফেটে পড়লেন, “কাকে কী বলছেন? নমস্য ব্যক্তি হলেও আপনি তো দেখছি নেহাতই এক পয়সার পাবলিক! কথাবার্তা যা বলছেন মনে হয় মাধ্যমিকও ডিঙোতে পারেননি। স্টপ সাউটিং!”

দেবব্রতবাবু থামার নাম করলেন না। চেঁচাতেই লাগলেন। মৌমিতা একটু মুখচোরা ধরনের মেয়ে। সিন ক্রিয়েট করা তার ধাতে নেই। অসহায় ভাবে চেয়ে আছে বর্ণদীপের দিকে। ভাবছে কী করা যায়।

“আপনি গিয়েছিলেন আর্টিস্ট স্যারের বাড়ি?” হঠাৎ সাংবাদিক ছেলেটি মৌমিতাকে লক্ষ করে প্রশ্ন করল।

মৌমিতা আরও গুটিয়ে গেল। ঘাড় নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। গিয়েছিলাম। আমি তো ইনভাইট করেছিলাম। উনিই তো রাজি হলেন না।”

“আস্পর্ধা দেখুন এক বার!” থামার নাম নেই দেবব্রতবাবুর, “কোথাকার হরিদাস পাল, ওর ছবির ওপেনিং আমায় করতে হবে! হ্যাহ্!”

‘‘থামুন!’’ ডক্টর হাটি জোর ধমক দিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘‘উনি আপনার ছবি চুরি করেছেন কী করে বুঝলেন?”

উত্তরে দেবব্রতবাবু যা বলল আকাশ থেকে পড়ল বর্ণদীপ। সেদিন ওরা দু’জন তাঁর বাড়িতে গিয়েই ছবিগুলো চুরি করেছে। যে ঘরে ওরা বসেছিল, সেখানে দেওয়ালে টাঙানো ছিল ছবিগুলো। দেখে তারা লোভ সামলাতে পারেনি। তাঁর অন্যমনস্কতার সুযোগে পেড়ে নিয়ে এসেছে।

“আপনার সামনেই ছবি নিয়ে চলে এল? আপনি চেয়ে চেয়ে দেখলেন?” ডক্টর হাটি লেগে আছেন।

“আমার সামনে নয়। আমি এদের চায়ের জন্য বলতে গিয়েছিলাম ভেতরে। তখনই চুরি করেছে।’’

মৌমিতা অবাক, “আপনি তো নিজের জন্য চা বলতে গিয়েছিলেন। আমরা তো চা খাইনি‌।”

“আবার মিথ্যে বলে! চুরি করে শিল্পী হওয়ার শখ!” দেবব্রতবাবু ঘুরে গেলেন বর্ণদীপের দিকে, “এই যে! এই যে! এরই কাণ্ড নির্ঘাত। প্রফেসর হয়ে ছেলে না-পড়িয়ে চুরিতে হাত পাকিয়েছে! আরে ছ্যা ছ্যা ছ্যা!”

“সাট আপ!” আর চুপ করে থাকা গেল না। মুখ খুলতেই হল বর্ণদীপকে, “তখন থেকে খালি বাজে বকে যাচ্ছেন! কোন ছবিগুলোর কথা বলছেন? দেখান!”

দেবব্রতবাবু ডান দিকের ওয়ালে টাঙানো ছবিগুলো দেখিয়ে বললেন, “ওই তো! ওই তো! এর মধ্যে একটা ছবি আছে। বাকিগুলো কোথায়?”

“কোনটা বলুন!” বর্ণদীপ বলল।

“দাঁড়ান! দাঁড়ান! ছবি পরে খুঁজবেন,” সাংবাদিক তাকাল দেবব্রতবাবুর দিকে, “আপনি বলছেন আপনার ছবি এরা চুরি করেছে? চোরাই মাল?’’

‘‘অ্যায়! অ্যায়! এত ক্ষণে ঠিক কথাটা বলেছ ব্রাদার! চোরাই মাল।’’

‘‘অ্যাবসার্ড!’’ বর্ণদীপ গলা তুলল, ‘‘প্রমাণ আছে আপনার কাছে?”

‘‘আলবাত!’’ দেবব্রতবাবু হুমকে উঠলেন, ‘‘আমার বাড়ির লোকেরা সাক্ষী আছে। থানায় এফআইআর করেছিলাম, তা ছাড়া— ’’

‘‘বলে যান!’’

‘‘ছবিগুলো আমার অনেক চিন্তা-ভাবনার ফসল। তাই পার্সোনাল কালেকশনে আলাদা করে রাখব বলে কোনও ছবিতেই সই করিনি। দেখে নাও! দেখে নাও!’’

সঙ্গে সঙ্গে সকলের ঘাড় ঘুরে গেল ছবিগুলোর দিকে। বর্ণদীপ মনে মনে বলল, ‘‘সব্বোনাশ!’’ সাধারণত শিল্পীদের হাতের লেখা ভাল হলেও মৌমিতা বিচিত্র ব্যতিক্রম। তার হাতের লেখা তেমন ভাল নয়। তাই ছবির শো নষ্ট হয়ে যাবে বলে সে ছবিতে নিজের নাম লেখে না। কোথায় লেখে জানবে জানবে করে জানা হয়নি বর্ণদীপের। শিল্পীর সই ছাড়া ছবি যে কেউ নিজের বলে ক্লেম করতে পারে।

কিন্তু সকলে তা জানলে তো! মুহূর্তে পরিস্থিতি বদলে গেল। সাংবাদিক ভুরু কুঁচকে জেরা করল মৌমিতাকে, ‘‘কী ম্যাডাম? জবাব দিন, সই কই আপনার?’’

মৌমিতা কাঁদো কাঁদো গলায় জানাল, সে ছবির পেছনেই সই করে।

‘‘ফ্রড! ফ্রড!’’ দেবব্রতবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘‘ছবির পেছনে সই? মামার বাড়ি!’’

সাংবাদিকের ভুরুর ভাঁজ আরও চওড়া হল। সে বড়সড়ো স্টোরির খোঁজ পেয়েছে। উৎসাহের সঙ্গে সকলকে অপেক্ষা করতে বলে চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করতে এগিয়ে গেল। দেবব্রতবাবুর নির্দেশ মতো দেওয়াল থেকে ছবিটা পেড়ে উল্টেপাল্টে দেখে গলা ছাড়ল, ‘‘নেই! নেই! কিচ্ছু নেই! নাথিং!’’

মৌমিতা ঢোক গিলল, ‘‘ওখানে নেই। ফ্রেমের ভেতরে ছবির পেছনে আছে।’’

‘‘চালাকি দেখেছেন?’’ দেবব্রতবাবু যেন উল্লসিত হলেন, ‘‘তার মানে ফ্রেম খুলে আসল ছবি বের করতে হবে। মহা ঘোড়েল মেয়ে!’’

পরিস্থিতির আরও অবনতি হল। দর্শকদের মধ্যে জিন্‌স-শার্ট পরা এক আধুনিকা ছিল। সে নিদান হাঁকল, ‘‘পুলিশে দিন! পুলিশে দিন! চুলের মুঠি ধরে দু’ঘা দিলেই সব বলে দেবে!’’

‘‘না! না! মারধর নয়,’’ সাংবাদিক ছবিটা হাতে করে এগিয়ে এসে গোয়েন্দার চালে চোখ সরু করে মৌমিতাকে বলল, ‘‘কোথায় থাকেন আপনি?’’

মৌমিতা যে-কোনও সময় কান্নায় ভেঙে পড়বে দেখে বর্ণদীপ এ বার সাংবাদিকের দিকে চেয়ে পরিস্থিতি সামলাতে চাইল, ‘‘তাতে আপনার কী দরকার?’’

‘‘রাইট!’’ ডক্টর হাটিও মুখ খুললেন, ‘‘আপনার এত ইন্টারেস্ট কেন? আপনি কোন মিডিয়ায় আছেন?’’

‘‘সেটা তো বুমেই লেখা আছে। ভাল করে দেখে নিন!’’ সাংবাদিক ফোটোগ্রাফারকে দেখিয়ে বলল, ‘‘অভীক দেখিয়ে দে!’’

‘‘দেখাতে হবে না! যান এখান থেকে!’’ বর্ণদীপ রুখে উঠল, ‘‘আপনাদের ডাকা হয়েছে?’’

‘‘শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল!’’ দেবব্রতবাবু হঠাৎ বর্ণদীপের জামা খামচে ধরে চেঁচালেন, ‘‘কোথায় থাকো তোমরা? কোথায় বলো! তার পর দেখছি।’’

ঝটকা দিয়ে জামা ছাড়িয়ে বর্ণদীপ বলল, ‘‘গায়ে হাত দিলেন কেন?’’

অবস্থা সুবিধের নয় দেখে মৌমিতা ব্যস্ত হল, ‘‘বর্ণদীপদা প্লিজ! মাথা গরম করো না প্লিজ। বলছি! বলছি! আমি থাকি পোড়াডোবায়।’’

‘‘এই তো মুখ খুলেছে!’’ সাংবাদিকের উৎসাহ দ্বিগুণ হয়ে গেল। ছবিটা উল্টে ফেলল। তার পর অপরাধী পাকড়াও করে ফেলেছে এমন ভাব করে সকলকে ছবিটা দেখিয়ে বলল, ‘‘দেখুন পেছনে লেখা আছে, ‘সেন বাঁধাইঘর, উত্তরপাড়া। থাকে পোড়াডোবায়, ছবি বাঁধাতে উত্তরপাড়ায়?’’

‘‘ধরা পড়েছে! ধরা পড়েছে! থ্যাঙ্ক ইউ ব্রাদার!’’ দেবব্রতবাবু পিঠ চাপড়ে দিলেন সাংবাদিকের।

‘‘আপনি চুপ করুন!’’ ডক্টর হাটি ধমকে উঠলেন দেবব্রতবাবুকে, ‘‘উনি তো উত্তরপাড়ায় চাকরি করেন। কলেজ টিচার। কলেজের উল্টোদিকেই সেন বাঁধাইঘর। না হওয়ার কী আছে?’’

মৌমিতাও ঘাড় নাড়াল, ‘‘আমাদের ওখানে ভাল দোকান নেই। তার জন্যই এখানে এসেছিলাম।’’

‘‘সব ছবি এখান থেকেই বাঁধিয়েছিলেন?’’ সাংবাদিক তা-ও সন্তুষ্ট নয়, ‘‘সব বয়ে বয়ে এনেছিলেন বাড়ি থেকে?’’

‘‘হ্যাঁ তাই,’’ মৌমিতা বলল, ‘‘জীবনে প্রথম প্রদর্শনী করছি, ভাল দোকান থেকে না-বাঁধালে লোকে কী বলবে? সময়ও লেগেছিল।’’

‘‘সময় তো তোমার হাতে ভালই ছিল,’’ দেবব্রতবাবু মনে করালেন, ‘‘আমার বাড়ি গিয়েছিলে গত সোমবার। ছবিগুলো চুরি করে এনেছিলে। আজ রোববার। আমার ফ্রেমগুলো ফেলে দিয়ে নতুন করে বাঁধিয়ে নিলে কে আটকাচ্ছে?’’

বলতে বলতে অধৈর্য হলেন দেবব্রতবাবু, ‘‘সকলে মিলে কিছু করুন! এত বড় অনাচার চোখের সামনে দেখেও চুপ করে থাকবেন? আমি এক জন এজেড লোক, এত নাম আমার, আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? ব্যবস্থা করুন একটা।’’

বর্ণদীপ রাগে ফুঁসছিল। তবে পরিস্থিতি যেদিকে গড়িয়েছে, রাগ করে যে কিছু করা যাবে না টের পাচ্ছিল। দেবব্রতবাবু নামী শিল্পী। রীতিমতো কঠিন ঠাঁই। মৌমিতাকে বের করে আনা কঠিন বুঝে হাল ছাড়তে বসেছে, হঠাৎই মাথাটা খুলে গেল তার। ‘‘হচ্ছে! হচ্ছে! ব্যবস্থা হচ্ছে!’’ বলে গলার স্বর নামিয়ে হো হো করে হেসে উঠল।

দেবব্রতবাবু থমকে গেলেন, ‘‘হাসছ কেন, অ্যাঁ? হাসছ কেন?’’

‘‘হাসব না?’’ হাসতে হাসতেই বর্ণদীপ বলল, ‘‘সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে যা শুরু করেছেন!’’

‘‘আরে! এ তো হেসেই গেল!’’ দেবব্রতবাবু এ বার অবাকই হলেন, ‘‘সামান্য ব্যাপার?’’

‘‘সামান্য নয়?’’ বর্ণদীপ গলা বদলাল, ‘‘মিটিয়ে নিন স্যার! মিটিয়ে নিন!’’

‘‘মিটিয়ে নেব?’’ চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল দেবব্রতবাবুর, ‘‘এত বড় চুরির কেস মিটিয়ে নেব?’’

‘‘এত বড়? হা! হা! হা!’’ বর্ণদীপ জুড়ল, ‘‘আজেবাজে ফোর্থ ক্লাস ছবি সব! পেটি কেস! পেটি কেস! আমার তো বিশ্বাসই হয় না আপনার মতো ফেমাস আর্টিস্ট ছবিগুলো এঁকেছে! একেবারে যা তা! এগুলো ছবিই নয়!’’

‘‘অ্যাঁ!’’ এ বার ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন দেবব্রতবাবু।

ঠিক তখনই ঘটে গেল অদ্ভুত এক ঘটনা। একেবারে আচমকাই। এত ক্ষণ ভয়ে কাঁপছিল। হঠাৎ রাগে জ্বলে উঠল মৌমিতা। কারও চেহারা যে এক নিমেষে এ ভাবে বদলে যায়, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত। চোখ দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে।

‘‘কী বললে? কী বললে বর্ণদীপদা?’’ মৌমিতা চেঁচিয়ে উঠল, ‘‘তুমি এ ভাবে বলতে পারলে আমায়? তুমি ছবির কী বোঝো? এক বছর ধরে না-খেয়েদেয়ে ছবিগুলো এঁকেছি। রাতের পর-রাত জেগেছি। পছন্দ হয়নি, ছিঁড়ে ফেলেছি, আবার এঁকেছি। খারাপ ছবি? ফোর্থ ক্লাস, অ্যাঁ? বলতে পারলে বর্ণদীপদা? মুখে আটকাল না তোমার? তোমায় আমি ভাল ভেবেছিলাম। তুমি খারাপ! খুব খারাপ! এমন জানলে তোমার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখতাম না। একাই যা করার করতাম।’’

বলতে বলতে ফুলে উঠল ঠোঁট মৌমিতার। মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়ল। কাজ শেষ। সঙ্গে সঙ্গে মুড বদলে গম্ভীর হয়ে গেল বর্ণদীপ। সকলকে লক্ষ করে বলল, ‘‘দ্যাটস ইট! কী বুঝলেন?’’

সাংবাদিকও অবাক, ‘‘কী?’’

‘‘কাঁদছে দেখতে পাচ্ছেন না?’’ বর্ণদীপ বলল, ‘‘ছবিগুলো ওর আঁকা না হলে এ ভাবে কাঁদত? যারা রিয়েল আর্টিস্ট তারা ভীষণ সেন্টিমেন্টাল হয়। নিজের সৃষ্টিকে সন্তানের চেয়েও ভালবাসে। ইচ্ছে করেই আমি ওকে আঘাত দিয়েছিলাম যাতে আপনারা বুঝতে পারেন ছবিগুলো কার আঁকা। ছবিগুলো মোটেই চোরাই মাল নয়। নিশ্চিত ভাবে ওরই আঁকা।’’

হইহই পড়ে গেল হলে। কান্না থেমে গেল মৌমিতার। ভুল ভেঙেছে তার। মুখ থেকে হাত সরিয়ে সজল চোখে অভিভূত ভাবে তাকাল বর্ণদীপের দিকে।

‘‘নিশ্চিন্ত থাকো মৌমিতা,’’ বর্ণদীপ নরম গলায় বলল, ‘‘তোমায় পরীক্ষা করছিলাম। পরীক্ষায় স্যার ফেল করেছেন। তুমি পাস করেছ।’’

হুঁ ঠিক তাই। তখনই ঘটে গেল একটা ঘটনা। “কই? কই?” করে ভিড়ের মধ্যে মুখ বাড়াল তিরিশ-বত্রিশ বছরের এক যুবক। তার দিকে মুখ তুলেই মুহূর্তে চেহারা বদলে গেল দেবব্রতবাবুর। ভয় পাচ্ছেন। পালানোর চেষ্টা করছেন।

কিন্তু যুবকটি অ্যালার্ট ছিল। ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে দেবব্রতবাবুর হাত চেপে ধরে বলল, “বাড়ি চলো! তোমায় একা বেরোতে বারণ করা হয়েছে না? সেই বেরিয়েছ?”

এক লহমায় সব পরিষ্কার হয়ে গেল বর্ণদীপের। ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করল, “মেন্টাল প্রবলেম?”

“আর বলবেন না!” ছেলেটি বলল, “সব সময় আর্টিস্টদের আক্রমণ করে লিখছে। পত্রিকা লেখা ছাপানো বন্ধ করে দিতেই এই অবস্থা। এই ছবিগুলোকে নিজের বলে ক্লেম করছিল তো? কারও ভাল দেখতে পারে না। সকলের ক্ষতি করে বেড়ায়। আমাদের হয়েছে জ্বালা।”

ছেলেটি টানতে টানতে দেবব্রতবাবুকে নিয়ে চলে যেতেই সকলে হাঁপ ছাড়ল। বদলে গেল পরিবেশ। ডক্টর হাটিও খুশি। সাংবাদিকের চেয়ে বললেন, “পেলেন তো স্টোরি? মরালটা বুঝেছেন?’’

সাংবাদিক চেয়ে রইল।

“বুঝলেন না?” ডক্টর হাটি ব্যাখ্যা করলেন, “একে বলে শিল্পীর অভিমান। চোর বলা হলেও উনি দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করলেন। কিন্তু ছবির নিন্দা করতেই দেখলেন তো কী রি-অ্যাকশন হল! অনেক হয়েছে। এ বার যান!”

হতাশ ভাবে সাংবাদিক ক্যামেরাম্যানকে নিয়ে চলে গেল। মৌমিতার মুখ থেকে মিলিয়ে গেছে দুর্ভাবনার দাগ। কৃতজ্ঞ চোখে বর্ণদীপের দিকে চেয়ে বলল, “কিছু মনে করো না বর্ণদীপদা। তোমাকে অনেক আজেবাজে কথা বলেছি। তোমরা না থাকলে কী যে হত!”

ডক্টর হাটিও উচ্ছ্বসিত হলেন, “বুদ্ধিটা ভালই বের করেছিলে বর্ণদীপ। একেবারে মোক্ষম। ভবিষ্যতে আরামসে গোয়েন্দাগিরিতে নাম লেখাতে পারো!”

রাগ-তাপ-অভিমান শেষ মৌমিতার। হেসে ফেলল, “লেখাবে কী? অলরেডি লিখিয়ে বসে আছে স্যার!”

“অ্যাঁ!”

“হ্যাঁ স্যার, তবে যা দেখলাম চিন্তাও হচ্ছে,” বর্ণদীপ চিন্তিত গলায় বলল, “দেবব্রতবাবু সব সময় অপরকে হিংসে করে ডুবেছেন। আমিও চোর-ডাকাত-খুনির পেছনে ছুটে তা-ই হয়ে যাব না তো?”

“তা হবে কেন? তবে বোকা হয়ে যাবে কি না তাই ভাবছি,” ডক্টর হাটি বললেন।

“বোকা!” বর্ণদীপ অবাক।

“খুনি-বদমাশরা তো বোকাই। নইলে ধরা পড়বে কেন?”

হা হা করে হেসে উঠলেন ডক্টর হাটি।

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “short-story-chhobi-tumi-kar

  1. অসাধারণ একটা গল্প পড়লাম। লেখককে অনেক ধন্যবাদ পাঠকদের এমন একটি গল্প উপহার দেওয়ার জন্য। আরও এমন লেখার প্রত্যাশায় রইলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *